কামরুল হাসান : স্বপ্নের রংধনু থেকে দুঃস্বপ্নের রূপকার

শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষ আমাদের জন্য এদেশের দৃশ্যকলা জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বের দিকে নতুন করে দৃষ্টিপাতের উপলক্ষ তৈরি করেছে। এ-কালপর্বের বিস্তার ১৯৪৭ থেকে সূচিত হয়ে ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। মাত্র সাতষট্টি বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ আকস্মিক ও নিতান্ত অকালে হিসেবে বিবেচনা করাই যায়। সামাজিক বৈষম্য ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক অগ্রণী কণ্ঠের এ-আকস্মিক তিরোধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে একটি বড় শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে কামরুল হাসানকে সামনে রেখেই প্রতিটি সাংস্কৃতিক লড়াই রাজনৈতিক লড়াইকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। 

আজকের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই শিল্পীকে অনুধাবন করতে হলে সেই সময়ের অবয়বে তাঁর শিল্পভাবনার জগৎটিকে চিনে নিতে হবে। আরো পাঠ করে নিতে হবে তাঁর সৃজনকর্মের বিবর্তন ও তাঁর শিল্পের সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পের প্রবণতাগুলোর বোঝাপড়া। বিশেষ করে বিগত শতকের ষাট-সত্তর-আশির দশকের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর মধ্যে কী ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল আর তার অনুষঙ্গ রচনায় তাঁর প্রেরণার উৎসস্থলগুলোকেও চিহ্নিত করার চেষ্টাটিও গুরুত্বপূর্ণ।

এটি সার্বিকভাবে বলা চলে যে, আমাদের দৃশ্যকলার জগৎটি কামরুল হাসানের অনুপস্থিতিতে অনেকটাই বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। বর্ণ বা বৈভব শিল্পসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য না হতে পারে; কিন্তু সৃজনকর্মের সহজ আকর্ষণ-ক্ষমতারও কিছু গুরুত্ব হয়তো রয়েছে। কামরুল হাসানের শিল্পকর্ম সহজে আকর্ষণ করেও তার অন্তর্নিহিত ভাবের শক্তিময়তা বা প্রতীকী বক্তব্যকে ধারণ করতে সমর্থ। সমকালকে ধারণ করেই তাঁর বয়ানটি উপস্থাপন করেন তিনি, নিজেকে তেমনভাবে বিষয় করে তোলেন না। যখন সৃজনকর্ম ক্রমশই ব্যক্তিগত বয়ানের রূপ নিচ্ছে তখন তাঁর সৃষ্টিকর্মের সর্বজনীন ব্যঞ্জনা অন্যতম ব্যতিক্রম। হয়তো শিল্পকর্মের উৎকর্ষ তার জনসম্পৃক্তির ওপর নির্ভর করে না, তবে আমাদের, বিশেষ করে দৃশ্যকলার ভুবনটির, ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। 

আজকের সমাজ বিভিন্নমুখী টানাপড়েনের জটিলতায় বিভ্রান্ত। তার শরীর নানাবিধ ভাঙনে ও অবক্ষয়ে বিক্ষত। ভারসাম্যহীন বিশ্বব্যবস্থায় শক্তিহীনের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য যখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার বিপন্নতার মুখোমুখি এবং আমাদের নিজেদের মধ্যেই যখন অস্তিত্ব ও পরিচয়ের বিভ্রান্তি আবারো গাঢ়তর অন্ধকার রচনা করেছে, তখন কামরুল হাসানের মতো নির্দ্বিধ শিল্পী ও সংস্কৃতিযোদ্ধার অভাবটি অনুভূত হয় অধিক। উত্তরাধিকার ও আধুনিকতার যে দ্বিধা ও দোলাচলে আমাদের শিল্পজগৎ দোদুল্যমান, সেখানে কামরুল হাসান অনায়াস নিজস্বতায় একটি পথের নির্দেশনা নির্মাণ করেন। 

তবে এ-অবস্থানটি অনায়াসে তৈরি হয়নি। যামিনী রায়ের সাফল্যের অত্যুচ্চ পর্বেই কামরুল হাসানের যাত্রারম্ভ। যেখানে যামিনী রায়ের পটভূমি ছিল লোকশিল্পের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা, সেখানে কামরুল হাসান জন্মেছেন কলকাতার নাগরিক পরিবেশে। দুজনই কলকাতা আর্ট স্কুলের পশ্চিমা বাস্তবতার বাতাবরণে প্রশিক্ষিত হয়েও অনুপ্রেরণা ও শৈলীর খোঁজ করেছেন স্বদেশি লোককলার অভ্যন্তরে। যামিনী রায় তা পেয়ে যান সহজেই, তাঁর জন্মস্থান বীরভূম-বাঁকুড়ার পুতুলের ডৌলে, মৃৎফলকের বিন্যাসে। পরবর্তীকালে বাংলা ও বিহারের পুতুল ও খেলনা, কালিঘাট পট ও ওড়িষি পটচিত্র তাঁকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। কামরুল হাসান যখন পঞ্চাশের দশকে তাঁর অনুসন্ধানের সূচনা করেন তখন তাঁর সামনে প্রত্যক্ষ কোনো অনুপ্রেরণাস্থল ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই যামিনী রায়ের সম্যক প্রভাব স্বীকার করেই তাঁর যাত্রা শুরু। নাগরিক পটভূমি সত্ত্বেও গুরুসদয় দত্তের সাহচর্য ও ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানসগঠনের সূচনাপর্বেই কামরুলের মধ্যে স্বদেশ-অনুসন্ধানের একটি দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর মাধ্যমে তিনি বাংলার তৃণমূল-সংস্কৃতির প্রাণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। লোকজীবনের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ও প্রেম তাঁর জীবনব্যাপী সামাজিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। এটি খুব স্বাভাবিক যে, তাঁর মানসস্ফুরণের প্রধান যে উপায়, চিত্রাঙ্কন, সেখানে তিনি তঁাঁর বিশ্বাসকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হবেন। এখানে তিনি ক্রমশ যামিনী রায়ের সঙ্গে নিজের পার্থক্য স্পষ্ট করতে শুরু করেন। যামিনী রায়ের শিল্প যেখানে রয়ে যায় নির্মিত শৈলীর কাঠামোর মধ্যে, এমনকি ক্রমশ দেখা দেয় ক্রেতারঞ্জক অনুবর্তনের আবদ্ধতা, সেখানে কামরুল হাসানের মধ্যে লোককলার বাইরের অন্যান্য শিল্প বা স্বদেশের পরিধি পেরিয়ে আধুনিক পশ্চিমা শিল্প থেকেও অনুপ্রেরণা আত্মস্থ করার প্রয়াস লক্ষণীয়। 

তাঁর পরিচিতি আরো ব্যাপকতা পেয়েছে সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রায় সকল কর্মকাণ্ডে তাঁর সক্রিয় সম্পৃক্ততার কারণে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে গুরুসদয় দত্ত-প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনের সদস্য, মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক, পুরস্কারজয়ী শরীরচর্চাবিদ ইত্যাদি পরিচয় শিল্পকলার বলয়ের বাইরেও তাঁর একটি অনুরাগীশ্রেণি সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। পরবর্তীকালে জীবন ধারণের তাগিদে তিনি শিল্পকলার শিক্ষক, জাতীয় নকশাকেন্দ্রের পরিচালক, রূপায়ণ নামে নিজস্ব শাড়ি বিপণন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, প্রচ্ছদশিল্পী, কার্টুন-আঁকিয়ে প্রভৃতি বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এবং রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকে সমাজজীবনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়েছেন। 

প্রথম পর্বে যামিনী রায় ছাড়াও লোক-কারুশিল্পীর তৈরি মাটির পুতুলের গড়ন, কালিঘাটের পট তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে তাঁর ছবিতে নারীদেহ পুতুলের মতো ভরাট, গ্রীবা দীর্ঘ, চোখ-নাক লৌকিক আদলে রীতিবদ্ধ এবং পটজুড়ে নকশাধর্মী দ্বিমাত্রিকতা স্থান পেতে শুরু করে। এ-সময় তাঁর বিষয়বস্তু প্রধানত মা ও শিশু, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নারী, একক দ্বৈত বা ত্রয়ী নারীমুখ, পরিবার, নিত্যদিনের গৃহস্থকর্ম, পশু ও পাখির সাহচর্যে মানুষ ইত্যাদি। একটি সুখী, পরিতৃপ্ত, আদর্শ গ্রামীণ রূপ, যা চিরায়ত বাংলার এক কল্পজগৎ উপস্থিত করে – তাঁর এ সময়ের চিত্রের মূল ভাব।

কামরুল হাসানের সৃজনশীলতার জোয়ার আসে ষাটের দশক থেকে। পঞ্চাশের দশকে তিনি সচেষ্ট ছিলেন কমনীয় ও সুডৌল পরিলেখয় এবং সমতলীয় বর্ণপ্রয়োগে অনেকটাই যামিনী রায়ের পদ্ধতিতে লোকচিত্রের রূপাভাস গড়ে তুলতে। ষাটের দশক থেকে সৃষ্টিকর্ম পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ-সময় তিনি জলরং, তেলরং, গোয়াশ, অ্যাক্রিলিক প্রভৃতি মাধ্যমে যেমন এঁকেছেন, তেমনই কাঠখোদাই, লিনোকাট প্রভৃতি ছাপাই মাধ্যমও ব্যবহার করেছেন। বাংলার লোকশিল্পের সরাসরি অনুসরণ ও যামিনী রায়ের প্রভাব কাটিয়ে উঠে এ-সময় তিনি বিভিন্ন নিরীক্ষায় রত হন – দেশজ উপাদানের সঙ্গে মিলিত করলেন পিকাসো-মাতিস প্রমুখের রেখাচিত্রের সংক্ষিপ্ত নিশ্চিতি, অতিরঞ্জন ও রূপান্তরণ, কিংবা কিউবিজমের মতো করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার উপস্থাপনা। সত্তরের দশক থেকে তাঁর কাজে ক্রমশ এসে যুক্ত হতে থাকল রঙ্গ-তামাশা, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও কামরুল হাসান ক্রমশ পরিত্যাগ করছিলেন প্রথাবদ্ধ আদর্শ গ্রামীণ দৃশ্যপটকে, হয়ে উঠছিলেন অনেক বেশি সমসাময়িক, সমাজসচেতন ও উচ্চকণ্ঠ। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কামরুল হাসানকে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাঁর চিত্রকলায় এসব সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপ প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে কামরুল হাসান চিত্রকলা, ছাপচিত্র, এমনকি কিছু ভাস্কর্যকর্মও করেছেন। তিনি ক্রমশ এগিয়েছেন নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও চিত্রভাষা নির্মাণের পথে এবং মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তাঁর এ-প্রবণতা অক্ষুণ্ন ছিল। 

কামরুল হাসানের সৃজন-উত্তরণের পথে লোককলার ভূমিকা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। প্রধানত চিত্রী তিনি, লোকচিত্রই স্বভাবত তাঁর মূল প্রণোদনা। তবে পূর্ব বাংলার লোকঐতিহ্যে পটচিত্র তত সমৃদ্ধ নয়। তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লক্ষ্মীর-সরা, শখের-হাঁড়ি ইত্যাদি, আরো বর্ণাঢ্য শিল্পরূপ রয়েছে মাটির মূর্তিকলা, পুতুল, কাঠের খেলনা, শোলার পুতুল, নকশিকাঁথা ইত্যাদিতে। কামরুল হাসান এসবকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছেন, খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর চিত্রের আঙ্গিক ও শৈলীতে এদের প্রেরণা যুক্ত করেছেন। তবে প্রাথমিক পর্বে তিনি লোকশিল্পের বহিরঙ্গকেই ব্যবহার করেছেন যামিনী রায়ের আদলে। এ-সময় তিনি সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টিনন্দন আলংকারিক নকশাদারিত্ব অর্জন করেছেন মাত্র, এর জান্তব শক্তিময়তা অনার্জিত রয়েছে। ষাট ও সত্তরের দশকে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিক অস্থিরতা তাঁকে আলোড়িত করতে শুরু করে। তাঁর চিত্রে সমকালীন আর্তি ও সংক্ষোভকে প্রবলভাবে উপস্থাপিত করার অভিপ্রায়ে লোককলার বাইরেও তিনি প্রেরণাস্থল অনুসন্ধান শুরু করলেন। স্বাভাবিকভাবেই সমকালীন পাশ্চাত্যশিল্পেই এর নানা বিচিত্র প্রয়োগ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। অতএব, তাঁর চিত্রশৈলীতে পিকাসো-মাতিস, ক্যুবিজম-এক্সপ্রেশনিজম অথবা ক্লি-শাগালের প্রণোদনা অস্বীকার করা যাবে না। এও ঠিক, এসবের মাধ্যমে হয়তো বিশ্বের লোক-ঐতিহ্যের শরণাপন্নই তিনি হয়েছেন শেষতক, বঙ্গীয় পটভূমিতে সীমাবদ্ধ না থেকে। এইভাবে সংশ্লেষণের মাধ্যমেই তিনি এগিয়েছেন, তাঁর বিপুল রেখাচিত্রের সম্ভার তাঁর ক্রমাগত ক্লান্তিহীন নিরীক্ষারই রোজনামচা যেন। বস্তুত এসব রেখাচিত্রের মধ্যেই তাঁর সম্মুখবর্তী সম্ভাবনার একটি দিকনির্দেশনাও দৃষ্ট হয়। তাঁর শেষজীবনের রেখাচিত্রগুলো সংশ্লেষণ, অতিরঞ্জন, রূপান্তরণ ও কল্পনার ব্যবহারে এক নতুন মাত্রা অর্জন করতে যাচ্ছিল মনে হয়। লোকচিত্রকলার দার্ঢ্য ও প্রাণবন্ত বলশালিতাকে যেন স্পর্শ করতে সমর্থ হচ্ছিল তাঁর সর্বশেষ পর্বের রেখাচিত্রগুলো।

যেসব বৈশিষ্ট্যকে আমাদের আধুনিক শিল্পী সেকেলে বলে পরিত্যাগ করেছিলেন সেসবকে পুঁজি করেই কামরুল হাসানের যাত্রা শুরু। অথচ আজ দেখি সেসব উপাদানকেই ভেঙে-মুচড়ে-নিংড়ে কামরুল হাসান এমন এক চিত্রভাষা তৈরি করেছেন, সেটি যেমন শক্তিশালী, তেমনি আধুনিক, তেমনি তার নিজস্ব রূপ ও দেশীয় মেজাজ। কামরুল হাসানের চিত্রে তাই একদিকে যেমন পাই শাশ্বত বাংলার রূপকল্প, অন্যদিকে তেমনই সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিত। তাঁর সময়কালে তিনিই বোধহয় একমাত্র শিল্পী যাঁর কাজে একই সঙ্গে দেশীয় প্রেক্ষাপট এবং আধুনিক মেজাজের সঠিক সম্মিলন ঘটেছে। সবচেয়ে যেটি জরুরি কথা সেটি হচ্ছে, সেগুলো সেøাগানসর্বস্ব পোস্টার হয়ে ওঠেনি, অধিকাংশ সময় শৈল্পিক সার্থকতাও অর্জন করেছে। 

ছবির মধ্যে তাঁর যে সচেতনতা বোধ তা দিয়েই তিনি তাঁর শিল্পীর দায়িত্ব সারতে পারতেন; কিন্তু কামরুল হাসান আপসহীন যোদ্ধা, নীরব দর্শকের ভূমিকায় তিনি থাকতে রাজি নন। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরই এসেছে সবচেয়ে বেশি হামলা। তাই দেখি কামরুল হাসান আপসহীন বাঙালি – পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে। বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু – তার যত রকমের কারুকর্ম, উৎসব-আচার-ব্রত-মেলা – এসবের চুলচেরা খোঁজ রাখতেন তিনি, ভালোবাসতেন অন্তর থেকে। বাঙালির অধিকার আদায়ের যত আন্দোলন-সংগ্রাম তার প্রথম সারিতে শামিল না হয়ে তাঁর পক্ষে হয়তো থাকা সম্ভব ছিল না। সে ঊনসত্তরের গণআন্দেলনের সময় অক্ষর-বৃক্ষের পরিকল্পনা খাড়া করে হোক অথবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্তর্ভেদী ঘৃণাজাগানিয়া খুনি ইয়াহিয়ার প্রতিকৃতি অঙ্কনের মাধ্যমেই হোক। 

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর যখন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো আস্তে আস্তে অপসৃত হতে লাগল, তখন তাঁকে দেখতে পাই ঝুঁকি নিয়েও অপ্রিয় সত্যটি বলার দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নিতে। তাঁর ছবিও এ-সময় আস্তে আস্তে পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে – হয়ে উঠতে থাকে অধিকতর প্রতীকী, আকৃতিসমূহে আসতে থাকে প্রবল ভাংচুর, দুঃসময়ের প্রতিভূ যেন। রেখা হয়ে উঠতে থাকে সংক্ষিপ্ত, তীক্ষè, শ্লেষধর্মী ও বক্তব্যময়। যে-কামরুল হাসান শুরু করেছিলেন যামিনী রায়ের ঢঙে টলটলে গ্রামজীবন, ঢলঢল রমণী ও পাখপাখালির স্বপ্নীল জগৎ নিয়ে, শেষজীবনে তাঁর ছবি হয়ে উঠেছিল সময়ের আর্তচিৎকার – ভয়াল-বিকৃত-প্রতীকী আকৃতিসমূহের উপস্থাপন। বস্তুতপক্ষে কামরুল হাসানের ছবি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে মনে হয় নতুন একটি উৎকর্ষে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছিল এবং এ-ভাষায় কামরুল হাসান লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন এই ছিন্নভিন্ন সময়ের করুণাহীন দিনলিপি। অকালমৃত্যু এসে সে-উত্তরণটি ঘটতে দেয়নি।