তোরাপের তমসুক

হাসনাত আবদুল হাই

দেখতে দেখতে সূর্য মাথার ওপরে উঠে এসেছে, দুরন্ত ছেলের নষ্টামি করার মতো। কিন্তু তার মুখে দুষ্টুমির হাসি তো নেই, রয়েছে গনগনে আগুনে পুড়িয়ে মারার করাল ভ্রুকুটি। চৈত্রের সূর্যের তাপে মাঠঘাট, গাছপালা ঝলসে যাচ্ছে। মাঠ ফেটে ফুটি-ফাটা, গাছের পাতা নেতিয়ে পড়েছে ক্লান্ত জন্তুর জিভের মতো। জলাশয় শুকিয়ে চিমসে, বুদ্বুদ ওঠে শেষ নিশ্বাসের মতো।
সকাল থেকে তোরাপ আর লাঙলে বাঁধা বলদ দুটোর গা থেকে ঘাম ঝরেছে অবিরল ধারায়। এখন তাদের শরীর খটখটে মাটির মতো শুকনো। সেখান থেকে ঘামের পানি ঝরছে না, বের হচ্ছে গরম হাওয়ার তাপ।
মাথার গামছা দিয়ে মুখ আর গলা মুছে তোরাপ একটু দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাঁফ ফেলে। ছাড়া পেয়ে
বলদ দুটো মুখ নামিয়ে আছে, তারাও হাঁফাচ্ছে। তেষ্টায় মাথার ছাতি ফেটে যাচ্ছে তোরাপের, কিন্তু আইলে রাখা বদনার পানি শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন মাজেদার জন্য অপেক্ষা, সে দুপুরের খাবার নিয়ে এলে সঙ্গে পানিও থাকবে।
অশ্বত্থগাছের নিচে যেটুকু ছায়া সেখানে বসে দুপুরের খাওয়া খাবে তোরাপ, পানি খাবে বদনা উপুড় করে। তার আগে বলদ দুটোকে নামিয়ে দেবে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে। সেখানে কয়েকটা মোষ সকাল থেকে মাথা উঁচিয়ে গা ডুবিয়ে থাকে। মোষগুলো জোতদার কফিল উদ্দিনের, ঠেলাগাড়ি টানে, গঞ্জে মালামাল নিয়ে যায়। এখন তাদের কাজ নেই, তাই আয়েশ করে কাদামাখা পানিতে শরীর ডুবিয়ে সূর্যকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।
চৈত্র মাস, গরম মৌসুমের মোটে শুরু। কিন্তু এখনই সূর্যের দাপট দেখে ভয়ে পেট ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়ার মতো। মাথার তালু দপদপ করতে থাকে আকাশ থেকে নেমে আশা গনগনে আগুনের তাপে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে, প্রস্রাবের থলি খালি হয়ে ঝিম মেরে আছে। অন্য সময় হলে তোরাপ গরমে এভাবে জেরবার না হয়ে অশ্বত্থগাছের নিচে গিয়ে একটু বসে বিশ্রাম নিতো। কিন্তু সকালে জোতদার কফিল উদ্দিন এসে তাকে ধমক দিয়ে গিয়েছেন, কড়া কথা শুনিয়েছেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছেন, এক বিঘা জমিটায় এখনো লাঙল দেওয়া শেষ হলো না, অথচ বোরো ধান রোপার সময় চলে যাচ্ছে। পাশের জমিতে বেড়ে ওঠা গাঢ় সবুজ বোনা ইরি ধানের ক্ষেত দেখিয়ে জোতদার বেশ মুখ খিস্তি করেছেন। তোরাপকে সাবধান করে দিয়েছেন, এমন গাফিলতি হতে থাকলে তার পক্ষে তাকে বর্গাচাষি করে রাখা বেশিদিন সম্ভব হবে না। অন্য চাষির খোঁজ করবেন তিনি। এতোদিন যে তা করেননি তা শুধু তোরাপের জন্য দরদ দেখিয়ে। কিন্তু নিজে লোকসান দিয়ে তো আর দয়া দেখানো চলে না। বাধ্য হয়েই তাকে নতুন বর্গাচাষি ঠিক করতে হবে। হুমকির মতো শুনিয়েছে কফিল উদ্দিনের সেই কথা।
তোরাপ ফেটে যাওয়া ফুটিফলের মতো সাদা ধপধপে জমির দিকে তাকায়। এক বিঘা জমি, চৌকোনো, সমান সমতল। সূর্যের রোদে শুকনো হাড়ের মতো ঝলসে যাচ্ছে, তাতিয়ে দিচ্ছে তার শরীর নিচে থেকে তাপ ছড়িয়ে দিয়ে। এই জমিটাও কি এখন কফিল উদ্দিন জোতদারের মতো তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে? এতো সময় নিচ্ছে কেন লাঙল দিয়ে চাষ করে মাটি খুঁড়তে? এমন কড়া মেজাজ নিয়ে শক্ত চোয়াল বের করে তাকিয়ে আছে কেন তার দিকে এক বিঘা জমির মাটি। কতোদিন আর হবে হাতছাড়া হয়েছে, এরই মধ্যে পর হয়ে গেল বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া জমিটা? তাকে দেখে কি চিনতে পারে না এখন? কতো ঘাম ঝরিয়েছে তার দাদা, বাপ আর সে এই জমিতে, সে-কথা কি ভুলে গেল মাটি? ভাবতে ভাবতে তোরাপের প্রায় কান্না পায়। শুকনো খটখটে মাটিতে খালি পা লেগে ভোঁতা শব্দ বের হয়।
কফিল উদ্দিন জোতদার হুঁকোর নল মুখ থেকে সরিয়ে বললেন, আর তো কর্জ দেওয়ার উপায় নাই তোরাপ। হিসেব রাখিছো এই পর্যন্ত কতো টাকা নিছো? বাজারদরে হিসেব করলি পর এক বিঘা জমির যা দাম তার চেয়ে বেশি কর্জ নিছো তুমি। এখন যে কর্জ চাও তার জন্য কী বন্ধক দিবা? তারপর জোতদার মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, না, না। আর কর্জ দেওয়া যায় না। তুমি কর্জ নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
তোরাপ হাত কচলে বলে, এবারের আমন ফসলটা ঘরে তুলতি পারলে কর্জের সব না হলেও কিছু শোধ করি দেবোনে হুজুর। আমারে এট্টু সময় দেন।
লাভ নেই তোরাপ। তুমি কর্জ শোধ করতি পারবা না। এতো টাকা কি একটু একটু করি শোধ দেওয়া যায়? শুধু আসলের কথা ভাবতিছো। সুদের হিসাব করিছো? করো নাই। সে প্রায় আসলের সমান হয়িছে এখন Ñ বলে তিনি জোরে জোরে হুঁকোয় টান দেন।
গেল আমন মৌসুমেই তার এক বিঘা জমিটা নিয়ে নিলেন কফিল উদ্দিন জোতদার। বললেন, বীজ, সার কিছুই কিনতে পারতিছো না। সরেস জমিটা নষ্ট হয়ে যাতিছে। বন্ধকি জমি হিসেবে আমি এইটা নিয়ে নিলাম। এখানে আমনের চাষ হোক, জমিটার সদ্ব্যবহার করা যাক।
তোরাপ শুনে তার পা ছুঁতে গিয়েছিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, হুজুর আমারে বাঁচান। ওই জমি গেলি আমি বাঁচবো কেমন করি? বউ, বাচ্চা ছেলে নিয়ে উপোস করতি হবি।
কফিল উদ্দিন জোতদার পা সরিয়ে নিয়ে বেশ দরাজ গলায় বলেছেন, তোমারে পথে বসাবো না। আমার শরীরে কি দয়ামায়া নাই? তোমার একটা ব্যবস্থা হবে। খেয়ে-পরে থাকার মতো ব্যবস্থা।
কী ব্যবস্থা হুজুর? কেমনে আমার বাঁচার ব্যবস্থা হবি? তোরাপ হাতজোড় করে জিজ্ঞেস করে।
কফিল উদ্দিন জোতদার হুঁকোর নল মুখে দিয়ে গুরুক গুরুক করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন। তারপর প্রসন্নস্বরে বলেন, তুমি ওই জমিতেই চাষ করবা। বর্গাদার হয়ে থাকবা। ফসলের একটা অংশ পাবা। মনে করো ওই এক বিঘা জমি তোমারই থাকলো।
কী কতিছেন হুজুর? নিজের জমিতে মজুর হবো শেষকালে? মজুর হয়ে কাজ করবো? তোরাপ প্রায় ভেঙে পড়ে। তার স্বরে কান্না।
হ্যাঁ তাই করবা? তুমি কি এ ব্যাপারে নতুন? আরো কত চাষি জমির মালিক থেকে বর্গাদার হয়ি গিয়েছে। দেখোনি চোখে? শোনোনি কানে? তারপর স্বর নরম করে বলেন, এইটাই তো নিয়ম মিয়া। ছোট চাষি ঋণ-কর্জ করে কতোদিন চলে, তারপর ঋণ শোধ করতি না পারি মজুর হয়ে যায়। কেউ কেউ বর্গাদারও হয়। তোমারে তো সরাসরি মজুর হতি হবে না। নিজের এক বিঘা জমিতেই চাষ করবা, নিজের বাড়িতে থাকবা। মনে মনে ভাববা জমিডা এহনো তোমারই। ব্যাপারটা খুব খারাপ হবি না তোরাপ। তোমার যে অবস্থা সেখানে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা হতি পারে না।
তোরাপ হাতজোড় করে বলে, আর একবার সময় দিন হুজুর। এই আমন ফসলটা ঘরে তুলতে দিন। দেখবেন কর্জ শোধ করা শুরু করিছি।
সজোরে মাথা নাড়েন কফিল উদ্দিন জোতদার। তারপর বলেন, অনেক সময় দেওয়া হয়িছে তোমারে। তুমি শুধু কর্জের পর কর্জ নিছো, কিছু শোধ করো নাই। এখন করবা কেমন করি? মুখে বললিই তো হলো না। সম্ভব-অসম্ভব বলি কথা আছে না? যাও আর কথা বাড়ায়ো না। আমার মেজাজ খারাপ হতি লাগিছে।
তোরাপ হাতজোড় করে কান্নাভেজা গলায় বলে, হুজুর, পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরব আমি। আমার এমন সর্বনাশ হতে দিয়েন না। কথার শেষে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সর্বনাশ হবে কেন? বললাম না, তুমি ওই এক বিঘা জমিতেই চাষ করবা। তার জন্যি ফসলের ভাগ পাবা। আর পরিবার বলতি তোমার তো বউ আর ছোট বাচ্চা একটা, তাদেরও ব্যবস্থা হবে। তোমার বউ এসে আমার বাড়িতে রান্নাবান্নায় সাহায্য করবে, ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে লাগবে। তার জন্যি তাকে দুবেলা খাওয়া দেওয়া হবি। একজনের খাওয়াতে তোমাদের তিনজনের খাওয়া চলবে। ঈদের সময় তোমার বউ নতুন শাড়ি পাবে, তুমি লুঙ্গি পাবা। বখশিশও থাকবে। পরিবার নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা নাই। সব মিলায়া তোমরা ভালোই থাকবা। বলে তিনি হুঁকোতে টান দেন কয়েকটা। মুখের ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, তুমি কি আমার পর? তোমার দাদা আমার দাদার সময়ে বর্গাচাষি ছিল, তার নিজের জমিও ছিল অবশ্যি। তারপর তোমার বাপ জমি বেচতে শুরু করে। বিপদের সময়ে আমি ছাড়া আর কে আছে এই গ্রামে? সেই জমি আমারেই কিনতে হয়িছে। ঠকাইনি। বাজারদরেই কিনেছি, তারপর তুমি ওই এক বিঘার মালিক হয়ে আমার কাছ থেকে কর্জ নেওয়া শুরু করিছো। কখনো না করি নাই। চাওয়া মাত্র টাকা হাতে পায়িছো। শোধের জন্য চাপ দিই নাই কখনো। ভাবছি সময় হলি দেবা। কিন্তু তুমি কর্জের কিছুই শোধ করতি পারো নাই। তোরাপ মিয়া, এইভাবে তো চলতি পারে না। আমি বুঝে গিয়েছি তুমি ওই এক বিঘা জমি ধরি রাখতি পারবা না, তোমার সে শক্তি নাই। জানি, শুনে মনে তোমার দুঃখ হতিছে, কষ্ট হতিছে। কিন্তু আমি সত্যি কথাই কতিছি। যা কলাম তাছাড়া তোমার আর কোনো উপায় নাই। বর্গাচাষি হয়ি যাও। এক বিঘা জমিটা আমার দখলে আসুক। তাতে তোমারও উপকার হবে, জমিটাও কাজে লাগবে।
তারা কথা বলছে জোতদারের দহলিজের বারান্দায় বসে। কফিল উদ্দিন বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন, পাশে তামাক খাবার হুঁকো। তোরাপ মেঝেতে বসে আছে দুহাত হাঁটুর ওপর বিছিয়ে। মাঝে একটা হাত সে অনুনয়ের ভঙ্গিতে জোতদারের পায়ের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। জোতদার তখন সাপ দেখার মতো সরাৎ করে পা সরিয়ে নিচ্ছেন চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে। দহলিজের মেঝেটা পাকা, পেছনের দেয়াল আর ওপরের ছাদ টিনের। অনেকদিনের পুরনো ঘর, নিয়মিত মেরামত করা হয়, রঙের পোঁচ পড়ে। তাই বয়স বোঝা যায় না। ভেতরের থাকার ঘরগুলো পাকা হলেও পুরনো আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দহলিজ ঘর পশ্চিম দিকে মুখ করে। গায়ে লাগানো কয়েকটা সুপারিগাছ সাদা খাম্বার মতো ওপরে উঠে গিয়েছে। তারপর কয়েকটা আমগাছ, ছোট ছোট আম ধরেছে ডালে। আমগাছের নিচে বসে একটা গরু জাবর কাটছে।
দহলিজের সামনের খোলা জায়গায় কয়েকটা মুরগি আর লাল ঝুঁটিওয়ালা একটা মোরগ খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। মোরগটা মুরগিগুলোর চারপাশে মাঝে মাঝে চক্কর দিচ্ছে। তারপর একসময় খাওয়া বন্ধ করে একটা লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করলো। জোরে ডাক দিলো কক্কর কক। চিৎকার করতে করতেই ঝুঁটিওয়ালা মোরগ পালিয়ে যেতে থাকা মুরগি ধাওয়া করে অন্দরমহলে ঢুকলো। একটু পর মাথা উঁচিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো পাখা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে। জোতদার সেটার দিকে তাকিয়ে হুঁকোয় জোরে জোরে টান দিলেন। শব্দ হলো গুরুক গুরুক।
অশ্বত্থগাছের ছায়া দুপুরে ছোট হয়ে আসে। তার ভেতরে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে তোরাপ। বলদ দুটো ছাড়া পেয়ে তরতর করে নেমে গিয়ে বুজে আসা পুকুরটায় পানি খায়। ডুবে থাকা মোষগুলো মাথা উঁচিয়ে তাদের দেখে চোখ ঘুরিয়ে নেয় অলস ভঙ্গিতে। একটু পর তোরাপ উঠে পাশের জমিতে পানি ঢালতে থাকা শ্যালোর কাছে গিয়ে নিচে পড়তে থাকা পানিতে হাত-মুখ ধোয়, মাথা পানি দিয়ে ভেজায়। গামছাটা ভিজিয়ে মুছে নেয় শরীর। তারপর মাথা নিচু করে দুহাত জড়ো করে পানি খায় ঢকঢক শব্দ করে।
অশ্বত্থের ছায়ায় আবার এসে বসে তোরাপ। মনে মনে মাজেদার ওপর রাগতে থাকে সে। এত বেলা হলো এখনো খাওয়া নিয়ে আসছে না, দূরে দেখাও যাচ্ছে না তাকে। সে কি টের পাচ্ছে না তোরাপের এখন কতো খিদে পেয়েছে? জোতদারের বাড়িতে খুব আরামের সঙ্গে চাকরি করছে, তিন বেলা খাচ্ছে পেট পুরে। তার বেলাতেই শুধু গড়িমসি। দয়ামায়া বলে কিছু নেই যেন।
একহাতে ছেলে লালুকে ধরে অন্য হাতে খাবারের পুঁটলি ঝুলিয়ে মাজেদা যখন সামনে এলো তখন তাকে এক লাথি মারতে ইচ্ছে হলো তোরাপের। সে মুখ বিকৃত করে বাজখাই গলায় বললো, এতোক্ষণে মনে পড়িছে? এদিকে আমি ক্ষুধায় মরি। তেষ্টায় বুক ফাটে। তোমার কি আক্কেল নাই? এতো দেরি করো ক্যান।
মাজেদা হাতের পুঁটলি নিচে নামিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। তারপর পুঁটলি খুলে থালায় ভাত-তরকারি সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, আগে আইতে দিলে তো আমু? একটা কাজ শেষ হইতে না হইতে আরেকটা দেয়। তুমি কি মনে করো আমি জোতদারবাড়ি হুইয়া-বইসা সময় কাটাই? খাটতে খাটতে আমার শরীর জেরবার। নিজে সময়মতো খাইতে পাই না, ছোট পোলাডারেও ঠিকমতো খাইতে দিতে পারি না। এতো কষ্ট আর সয় না।
গোগ্রাসে খেতে খেতে গলায় আটকে যাওয়ার মতো হয় তোরাপের। বদনার পানি ঢকঢক করে খেয়ে বলে, বাড়ির সবাই দুপুরে খায় না?
খায়।
তয় তোরে খাইতে দেয় না ক্যান? তোরাপ তার দিকে না তাকিয়েই বলে।
মাজেদা বলে, হাঁড়ি-বাসন ধুইতে কয়, তারপর কাপড়ের গাট্টি দেয় ধুইতে। এক লহমার লাগি বিশ্রাম নাই। তুমি তো দেহ না, তাই মনে করো আরামে আছি।
মাজেদার কথা শুনে তোরাপের মনের ভেতরের গরম ভাবটা কিছুটা মিইয়ে আসে। সে মনে মনে জোতদারের মুণ্ডুপাত করে।
মাজেদা বলে, একটু ফাঁক পাইলেই খোটা দিয়া কয় Ñ এতো খাওন দিতাছি কামে ঢিলা ক্যান? একজনের খাওন তো না, তিনজনের খাওন পাইতাছো তুমি। তার তুলনায় কী কামডা করো? বলে ছোট বউ মুখ খিস্তি করেন।
কফিল উদ্দিন জোতদার দহলিজে বসে মাজেদাকে দেখেন, আর হাত দিয়ে মুখের দাড়িতে বিলি কাটেন। কতো বয়স হইবো মাইয়া মানুষটার? একটা পোলা হইছে। তাহলি বয়স তিরিশের বেশি হইবো না। গতরটা বেশ শক্ত-সমর্থ, কাজের মানুষের যেমুন হয়। পেছন থেকে লেপ্টে থাকা পুরনো শাড়িটার নিচে নিতম্ব জোড়া হেলতে-দুলতে দেখেন তিনি। খুব মাংসল নয়, গোলাকারও বলা যাবে না, তবে ভরাট। আর চলার সময় দুলুনি আছে। তাকিয়ে থাকার মতো। সুযোগ পেলেই আড় চোখে মাজেদাকে দেখেন কফিল উদ্দিন। তখন মাথার ভেতর একটা কিছু হয়। ঠিক মাথা ঘোরানো না, কিন্তু ঢেউ খেলে যাওয়ার মতো একটা কিছু। আর কী আশ্চর্য যখনি তিনি সঙ্গোপনে মাজেদাকে দেখেন কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসে ঝুঁটিওয়ালা লাল মোরগটা একটা মুরগি তাড়া করে। কক্কর কক চিৎকারে তিনি সম্বিৎ ফিরে পান। ভেতর থেকে বড় বউ হাঁক দেন, ও মাজেদা কই গেলিরে! আয় মাজাডা একটু টিপা দে। মাজেদাকে আর দেখার সময় পান না কফিল উদ্দিন। সে তার পেছনটা দুলিয়ে শোয়ার ঘরে যায়।
কফিল উদ্দিন জোতদার তোরাপের দিকে তাকিয়ে বলেন, মিয়া একটা খবর রাহো?
কী খবর হুজুর? তোরাপ হাত কচলে বলে।
তোমার ভিটাবাড়ি। হেইডাও কিন্তু বন্ধকে আছে।
কন কী হুজুর? কবে বন্ধক দিলাম। তোরাপ যেন আকাশ থেকে পড়ে। তার মুখের হাঁ বন্ধ হয় না।
কফিল উদ্দিন জোতদার হেসে বলেন, তোমার মনে পড়বো ক্যামনে? তুমি তো দাও নাই।
তয়? কেডা দিলো বন্ধক? তোরাপ হতভম্ভের মতো তাকিয়ে থাকে।
তোমার বাপে দিছে।
বাপে আমারে কহনো এই বন্ধকের কথা কয় নাই। তোরাপ ঢোক গিলে বলে।
তোমার বাপে না দিলে তোমার দাদায় দিছে বন্ধক। তাই জানো না। অনেক আগের ব্যাপার তো।
না হুজুর। এইডা হতি পারে না। এতো জবর বিষয় আমার বাপ জানলো না, আমিও এতোদিন জানলাম না। এইডা ক্যামনে হয়? তোরাপের স্বর ফ্যাঁসফেঁসে হয়ে আসে।
হয়। হয়। এমুনভাবেই হয়। আইসো একদিন আমার দহলিজ ঘরে। দেহামু তোমারে তমসুক খানা।
তমসুক?
কর্জের টাকা আর ভিটাবাড়ি বন্ধক দেওয়ার ঋণপত্র। আগে ওইটারে তমসুকই কইতো মাইনষে।
তোরাপ ঢোক গিলে বলে, ক্যামনে বুঝমু দাদা ওই তমসুক না কি কইলেন যেন হেইডাতে সই দিছেন? তার সই চিনি না আমি।
আরে সই দিতে যাইবো ক্যান? বাঁ হাতের বুড়া আঙুলের টিপসই দিছেন। টিপসই মিথ্যা হয় না। কফিল উদ্দিন মিটিমিটি হাসি মুখে নিয়ে বলেন।
তোরাপ ঢোক গিলে বলে, ওইডা যে দাদার টিপসই বুঝুম ক্যামনে?
চোপ! বিশ্বাস হতিছে না আমার কথা? মনে করতিছো মিছা কতিছি আমি? মিছা কওনের অভ্যাস নাই আমার। বাজে কথা কইয়া মাথা গরম কইরা দিও না।
মেজাজ ঠান্ডা হয়ে এলে কফিল উদ্দিন স্বর মোলায়েম করে বলেন, ঘাবড়াইও না। অহনই তোমারে ভিটা ছাড়তে কইতেছি না। থাহো, যেমন আছো। ভিটা ছাইড়া কই যাইবা? আর তো জায়গা নাই। হে কি জানি না আমি? জানি, জানি, শুধু তমসুকের কথাডা মনে রাইখো। তোমার ভিটাবাড়ি অনেক আগেই বন্ধকে বাঁধা আছে। এইডা তোমারে জানায়া রাখলাম। বাড়িতে আইসো একদিন। সেই তমসুক দেখামু তোমারে। তোমার দাদার টিপসই মারা।
কফিল উদ্দিন তোরাপের সঙ্গে কথা বলছিলেন চাষ করা জমির পাশে দাঁড়িয়ে। তোরাপের কাছ থেকে নেওয়া এক বিঘা জমি। মুখে রাজ্যের বিরক্তি এনে তিনি বললেন, হাল দিতে দেরি কইরা ফেলাইলা মিয়া। রোপা বোরোর মৌসুম যায় যায়। দেহো না পাশের জমিতে কেমন ডাগর হইয়া উঠছে বোনা বোরো।
তোরাপ অপরাধীর মতো বলে, হঠাৎ জ্বরে পড়লাম। কয়দিন মাঠে আসতে পারি নাই।
তাতো জানিই। মাজেদা কইছে আমারে। কিন্তু তোমার লাগি কি রোপা বোরো চাষ অপেক্ষা করবো? বৈশাখ মাস আইয়া পড়লো বইলা। তহন আউশ রোপার সময় হইবো। মনে হতিছে এবার এই জমিতে রোপা বোরোটাকেই আউশ কতি হবে। তারপর তিনি ব্যস্ত হয়ে বলেন, তাড়াতাড়ি কাজ করো। বীজতলা থেইক্যা চারাগুলা আইনা রুইপা দাও। শ্যালোর পানি আসা শুরু হইছে। জমি এহন বেশ ভেজা। তাড়াতাড়ি লাঙল চালাও। নিজের জমি মনে করি মেন্নত করো। আসলে তো নিজের জমিই এইডা। খুব চেনাশুনা লাগে না দেখলে? দরদ জাগে না?
সন্ধ্যা হবো হবো করছে। তোরাপ জমি নিড়ানি দিয়ে ভিটায় এসেছে। দাওয়ায় বসে গামছা দিয়ে মুখ আর গলা মুছছে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে। হেলে-পড়া ছনের ঘরটার পাশে বাঁশঝাড়, তারপর একটা ছোটখাটো পুকুর, বৈশাখে পানি শুকিয়ে প্রায় তলের দিকে গিয়েছে। কচুরিপানা জড়ো হয়ে আছে একপাশে। কলমিলতা লতিয়ে উঠেছে নিচ থেকে ওপরে। একটা ঝাঁকড়া বরইগাছ দাঁড়িয়ে আছে। ঘন পাতাওয়ালা গাব গাছটায় বিকেলের আলো অন্ধকারে ডুবে আছে। বাড়ির সামনে বাগানে মিঠা কুমড়ো একটা ধুলোয় ঢাকা। বেগুনগাছে লম্বা লিকলিকে কয়েকটা বেগুন ঝুলছে।
মাজেদা এখনো জোতদারবাড়ি থেকে লালুকে নিয়ে আসেনি। তার দেরি দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছে তোরাপ। দুপুরের মতো খাওয়া নিয়ে আসবে মাজেদা পুঁটলিতে করে। সেই খাওয়া খেয়ে পেটের ক্ষুধা মেটাবে সে। সারাদিন শেষে পেট এখন ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলছে। খাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রার মতো এসে যায় তোরাপের। সে ঝিমাতে থাকে। হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে সে চোখ খোলে, নৌকার পালের মতো একটা সাদা কাপড় দেখতে পায়। মাজেদা এতো পরিষ্কার শাড়ি পরে না, তার নেই। তাহলি? কাছে আসার পর দেখা গেল সাদা কাপড় জোতদার কফিল উদ্দিনের। তিনি চেক কাটা লুুঙ্গির ওপর সাদা লম্বা পাঞ্জাবি পরে তার ভিটের দিকে আসছেন। কাছে আসলে দেখা গেল তার হাতে একটা শাড়ি আর একটা নতুন লুঙ্গি। মুখে দরাজ হাসি।
তোরাপ ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। সন্ত্রস্ত হয়ে ভিটের চারিধার দেখে নিলো। তার সেই চাহনি জোতদারের দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি হেসে বললেন, আরে মিয়া ডরায়া গেলা নাহি আমারে দেইখা? ভাবছো ভিটার দখল নিতে আইলাম। মাথা খারাপ! অমন হারমাদ আমি না। তুমি ভিটাবাড়িতে যেমন আছো পরিবার নিয়া, থাহো। তোমারে অহনি উইঠা যাইতে কইতাছি না। এতো তাড়া কিসের? আমার বাড়িতে অন্যান্য তমসুকের মধ্যি এই ভিটে বন্ধকির তমসুকডাও আছে। থাহুক সেখানে। কেউ তো নিয়া যাতিছে না, আমিও এহনি ব্যবহার করতিছি না। যাই হোক, ভিটাবাড়ি দেহনের লাগি আসি নাই আমি। ভাবলাম দেইখা যাই কেমন আছো। খালি হাতে তো আসন যায় না। তাই একটা শাড়ি আর লুঙ্গি আনলাম। একটু থেমে বললেন, শুধু খাটাই তোমারে, ভালো-মন্দের খবর নেই না। মনিব হইলে মজুরের খবর নেওয়া লাগে। তারাও তো মানুষ। আমরা বলতি গেলে একই পরিবার। জোতদারের স্বর গদগদ হয়ে আসে। তখনই পেছনে পায়ের শব্দ পাওয়া যায়, তাকিয়ে নিয়ে কফিল উদ্দিন বলেন, ওই তো মাজেদা আইয়া পড়ছে। এক হাতে বাচ্চার হাত ধরা, অন্য হাতে খাওয়ার পুঁটলি। কেমন সুন্দর লক্ষ্মী বউ। সুখের সংসার তোমার তোরাপ।
মাজেদা জোতদারকে দেখে মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। জোতদার স্বর মোলায়েম করে তোরাপকে বলেন, রোজ মাঠের কাম কইরা আইসা খাইতে বসো। তারপর ঘুম যাও। কোনো আনন্দ-ফুর্তি নাই তোমার জীবনে। এইডা ভালা না। আমার কি মনে হইতেছে জানো? তোমার একটু ফুর্তি করা বড় দরকার। না হইলে ভাইঙ্গা পড়বা। বলে তিনি তোরাপকে সুচালো দৃষ্টিতে দেখেন। একটা শিয়াল বাঁশঝাড়ের কাছে এসে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে পুকুরের দিকে দৌড়ে চলে যায়। এখন যদিও বিকাল, পুব আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে এসেছে। ছায়া ঘন হয়ে আসতে দেরি হচ্ছে, চারদিকে মোলায়েম আলো। জোতদার তোরাপের দিকে তাকিয়ে খুব দরদের সঙ্গে বললেন, একটা কাজ করো মিয়া। যাও, বাজারে যাও। চায়ের দোকানে বইসা চা-নাস্তা খাও। রেডিওতে মমতাজের গান শোনো। লোকের লগে হাসিঠাট্টা করো, মনটা হালকা হইয়া যাইবো। যাও, কিছুক্ষণ বাজারে কাটাইয়া আসো। নাও এই একশ টাকা দিলাম। যা খুশি খাও গিয়া। বউ-ছেলের লাগিও মিঠাই কিইন্না আইনো। একা একা ফুর্তি করবা ক্যান। আর হ্যাঁ। নতুন লুঙ্গিডা পইরাই যাও। মনে ফুর্তি পাইবা।
তোরাপ নড়তে চায় না। ভিটের মাটি পায়ের নখ দিয়ে আটকে দাঁড়িয়ে থাকে সে। জোতদার তার কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে খুব দরদের সঙ্গে বলেন, যাও মিয়া। যা বলি শোনো। শরীর-মন তাজা কইরা আইসো। খালি কাম নিয়া থাকা ভালা না।
তোরাপ উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা মাজেদা আর তার ছেলে লালুর দিকে তাকায়। লালু তার মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে অন্য হাতের একটা আঙুল চুষছে।
জোতদার কফিল উদ্দিন তোরাপের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওদের লাগি চিন্তা কইরো না। একটা মোড়া দাও। আমি উঠানে বইসা ওদের লগে গল্প করি। তোমার ছেলেরে নিয়া খেলা করি। আমার এহন কোনো তাড়া নাই। তুমি বাজার থেইকা ঘুল্লা দিয়া না আসা পর্যন্ত খুব থাকতে পারুম এইখানে। কোনো অসুবিধা হইবো না আমার। যাও মিয়া। দৌড়াও।
তোরাপের ঘাড়ে হাত রেখে তাকে প্রায় টেনে নিয়ে রাস্তা পর্যন্ত গেলেন কফিল উদ্দিন। তারপর ধাক্কা দেওয়ার মতো তার পিঠে হাত রেখে বললেন, যাও। দেখবা মজা পাইবা। মাঝে মাঝে এমন করবা। কোনো চিন্তা কইরো না। আমি তোমার পরিবাররে দেখতেছি। চান্দির রাইত আইজ। চোর-ডাকাতের কোনো ভয় নাই। আমি আছি না?
তোরাপ বোঝার মতো নিজের শরীরটা টেনে টেনে হেঁটে যায়, ধুলোভর্তি পথ দিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশে গিয়ে সে মুখ ফিরে তাকায় বাড়ির উঠোনের দিকে। তাকে খুব ক্লান্ত আর অসহায় দেখায়।
কফিল উদ্দিন তোরাপের ভিটের উঠোনে এসে মোড়ায় বসে মাজেদার উদ্দেশে বলেন, সারাদিন অনেক খাটছো। সারা গায়ে ঘাম ঝরছে। যাও, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসো। আমি তোমার পোলার লগে খেলতিছি। তারপর মাজেদার ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী নাম? লালু? আইসো লালু, আমার কাছে আইসো। লক্ষ্মী ছেলে তুমি, সে কি আর জানি না আমি। রোজই তো দেখি আমার বাড়িতে। তোমার মায়ে কাম করে, তুমি পেছনে খাড়ায়া থাহো। দেহি দেহি, তোমাদের দুজনরে ভালা কইরাই দেহি। তারপর কফিল উদ্দিন মুখ ঘুরিয়ে মাজেদার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি খাড়ায়া আছো ক্যান? পুকুরে গিয়ে একটা ডুব দিয়া আইসো। সাবান থাকলে নিয়া যাও। শরীর পরিষ্কার রাখা ভালা। অসুখ-বিসুখ হয় না, ঝরঝরা লাগে। মনে ফুর্তি আসে। যাও। লালুর লাগি ভাইবো না। আমি তার লগে খেলতেছি। আর হ্যাঁ, নতুন শাড়িডা নিয়া যাও।
মাজেদা তাদের দাওয়ায় উঠে ঘরে ঢুকে একটা গামছা হাতে বেরিয়ে আসে। কফিল উদ্দিন তার হাতে শাড়িটা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। নিজের বাড়িতে এমনভাবে কাছাকাছি তাকানোর সুযোগ পান না তিনি। অনেকদিন থেকে ভাবছিলেন তোরাপের বাড়িতে আসবেন সময় করে। ভিটেবাড়ি, লাগোয়া সবজি বাগানের জমি, বাঁশঝাড়, তার পাশে পুকুর – এইসব দেখবেন। সবই তার সম্পত্তি এখন, তমসুক তৈরি হয়ে গিয়েছে। একটা টিপসইও পড়েছে সেখানে। ভিটেবাড়িটা দিনের যে-কোনো সময়ই দেখা যেতো কিন্তু ঠিক সন্ধ্যার মুখে এলে মাজেদাকেও দেখতে পাওয়া যাবে মনে করে এই সময়টাই বেছে নিয়েছেন তিনি। কাজ শেষ করে মাজেদা ঘরে ফিরবে। তোরাপও থাকবে। থাকুক, তার সামনে ভালো করে তাকাতে অসুবিধা হবে না। তারপরই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছে কফিল উদ্দিন জোতদারের। বাজারে গিয়ে শাড়ি আর লুঙ্গি কিনেছেন। তোরাপকে ফুর্তি করার জন্য একশ টাকা দেবেন বলেও ঠিক করেছেন।
কফিল উদ্দিনের সামনে দিয়ে শেষ বিকেলের ছায়ামাখা আলোয় মাজেদা শাড়ি হাতে পুকুরের দিকে যায়। তার পেছনটা হিল্লোল তোলে। কফিল উদ্দিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যতক্ষণ না বাঁশঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয় সে।
হঠাৎ খেয়াল হয় লালু তার হাত ধরে নেই। কোথায় গেল ছেলেটা? মায়ের পেছনে পেছনে পুকুরে? তারপর তার চোখ গেল ঘরের দাওয়ার ওপর। সেখানে মাদুরে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। ঘুমাক। তারও বিশ্রাম দরকার।
কফিল উদ্দিন উঠে দাঁড়ান। ভিটেবাড়িটার চারদিকে ঘোরেন ধীরপায়ে হেঁটে। হাঁটতে হাঁটতে এক হাতে দাড়িতে বিলি কাটেন তিনি। বেশ ফুরফুরে মেজাজ এখন তার। প্রসন্ন মনে তিনি ভিটের সামনের সবজির বাগানটাকে দেখেন Ñ কয়েকটা বেগুনগাছ দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মাটির ওপর। লম্বা শুকনো বেগুন ঝুলছে। একটা লাউগাছের লতা উঠে গিয়েছে ঘরের চালে, সেখানে একটা লাউ। বেগুন ছাড়াও বাগানে আরো কিছু সবজির গাছ। জমিটা বেশ সরেস মনে হচ্ছে। তিনি ঘুরে ঘুরে ভিটের চারপাশের জমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেন। তার চোখ চকচক করে।
হাঁটতে হাঁটতে কফিল উদ্দিন ভিটেবাড়ির পাশে বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুরপাড়ে আসেন। ভিটে, ভিটের চারপাশের জমি, বাঁশঝাড়, পুকুর – সবই তার দখলে এসে যাবে, যখনই তিনি চাইবেন। সবই তার মুঠোর ভেতর আসবে। তার ভেতর একটা শিহরণ জাগে। সন্ধ্যা হতে দেরি নেই, দিনের শেষ আলোতে সবকিছু মোলায়েম দেখায়, মন নরম করে দেয়। তিনি একদৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকান। পুকুরটাও তার মুঠোর ভেতর এখন। তার ভেতরের শিহরণ বাড়ে।