মুখোমুখি সিটে বসা ভদ্রমহিলার কপালের ভাঁজে চরম বিরক্তি। ঈশানের দিকে তিনি ঘন ঘন অগ্নিদৃষ্টি হানছেন। দাঁতে দাঁত পিষছেন, ‘উফ! মানুষের কমনসেন্সের এত অভাব!’ ফোনে ঈশানের লাগাতার কথা বলাই ভদ্রমহিলার বিরক্তির কারণ। কিন্তু কিছু করার নেই। কমনসেন্সের চাইতে বাড়িতে লাগাতার যোগাযোগ রাখাটা এখন অধিক জরুরি।  রজব আলীর ছুরির আঘাতে বাবা হাসপাতালে অথচ  তার অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছে না। মা বারবার একই কথা বলছে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। হাসপাতালে তোর বাবাকে নিয়ে আসছি, আর ভয় নেই।’ ভয় নেই মানে? ঈশানের মাথা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। 

রজব আলীর পরিবারের সঙ্গে শত্রুতা নতুন নয়। এর বীজ ঈশানের চার পুরুষ আগে রোপিত হয়েছিল। যখন ঈশানের প্রপিতামহ সোহরাব শিকদার আসাম থেকে এদেশে মাইগ্রেট করে এসেছিলেন। রাধানগরের কেউই সেই সময় উড়ে এসে জুড়ে বসা ভিনদেশি সোহরাব শিকদার বা তার পরিবারকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। রজব আলীর পূর্বপুরুষেরা তো রাধানগর থেকে সোহরাব শিকদারকে উৎখাত করতে ধনুর্ভঙ্গপণ করেছিল বলে ঈশান শুনেছে। 

ইদানীং ঈশানের সব রাগ গিয়ে পড়ে প্রপিতামহের ওপর। কেন তিনি ভারত ছেড়ে এসেছিলেন? কী লাভ হয়েছে তাতে?   

জন্মভূমি ছেড়ে আসা নিয়ে অনেক কাহিনি ঈশান দাদির কাছে বহুবার শুনেছে। যতবার দাদি শেকড় উন্মূলনের গল্প বলেছে ততবারই তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরতে দেখেছে। এই পানি ফেলে আসা মাটির জন্য, নাকি ছেড়ে আসা  স্বজন-পরিজনের জন্য, ঈশান জানে না। তবে আঁচলে চোখ মুছলেই যেসব  মুছে যায় না সে তো দাদি নিজেই প্রমাণ! 

সাতচল্লিশে দেশভাগের ক-মাস আগেও বোঝা যায়নি ভারতের শরীর কেটে অঙ্গ থেকে অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হবে। সাধারণ মানুষ চিন্তায় চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম করবে। অস্ত্রোপচার করার পর খণ্ডিত দেহ  কার অঙ্গে জোড়া দেওয়া হবে সেটিও কারো জানা ছিল না। মানুষের ধর্মকে পুঁজি করে জিন্নাহ আর নেহরু একই মায়ের পেটের ভাই ভাইয়ের বসতবাটি পৃথক করে ভাতের হাঁড়ি আলাদা করে দিয়েছিলেন। এত্তেলা ছাড়াই, পরামর্শ ছাড়াই রাতারাতি মানুষ আপন নিবাসে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল। অথচ সব ছাড়ার আগে মানুষ জানেনি তাকে ছেড়ে যেতে হবে নদী, মাঠ-ঘাট, আশৈশব হেঁটে যাওয়া চেনা পথ, প্রান্তর। পেছনে পড়ে থাকবে ধুধু স্মৃতির ভূমি, স্বজনের কবর আর শ্মশান।

কাছাড়ের কোথাও ছিল ঈশানের পূর্বভূমি। ছেচল্লিশের রায়টে সোহরাব শিকদারের এক ভাই হিন্দু প্রতিবেশীর দায়ের কোপে নিহত হয়েছিলেন। তার রক্তের ছিটে প্রপিতামহের শার্টকেও রঞ্জিত করেছিল। এরপরও কিছুকাল তিনি সংগ্রাম করে জন্মভিটে কামড়ে পড়ে ছিলেন।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা হিসাব-নিকাশ শেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে ভিটেমাটি ত্যাগ করতে হয়েছিল। ধর্ম অনেক সময় যেমন সুবিধার নাম, তেমনি ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিও অশ্লীল। জাতি, বর্ণ, ধর্ম সব নিরিখেই সংখ্যালঘু হয়ে বেঁচে থাকা অলাভজনক, কঠিন যাতনার। ঈশানের ধারণা, সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতেই পূর্বপুরুষেরা দেশত্যাগ করেছিলেন। এদেশে এসে তাঁরা মুসলমানদের সংখ্যা আরো বাড়িয়েছিলেন, সংখ্যাগুরুর তকমাও পেয়েছেন সত্য,  কিন্তু  সব যন্ত্রণার লাঘব হয়েছে কি?  

দাদি সেসব কাহিনি বলতে গেলে  নিজেকে দোষারোপ করেন, ‘বুঝলি দাদা, আমার কারণেই ঘরবাড়ি, নিজের দেশ ছেড়ে এই পরদেশে আসতে হয়েছিল।’ দাদি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। এপার বাংলার সঙ্গেও মেলে না, ওপার বাংলার সঙ্গেও না। দাদি বলেন, ‘তোর দাদা লুকিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিল। সেই বউয়ের বাড়িও কাছাড়েই। প্রায় প্রায় আমাকে রেখে সেই বউয়ের কাছে চলে যেত।’

কথা শেষ না করেই দাদি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। হয়তো সেই সময়ে ফিরে যান যেখানে বালিকাবধূ তার দ্বিগুণ বয়সী স্বামীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে, অন্যদিকে স্বামী প্রবরটি আনবাড়ি। ঈশান কথা বাড়ায় না। বহুবার শোনা গল্প নতুন করে নাই-বা শুনলো। 

তখন রায়ট-পরবর্তী বিনিময় পুরোদমে শেষ হয়ে যায়নি। আসামের আদিবাসী অসমিয়াদের কাছে বাঙালি মানেই অ্যালার্জি আর মুসলমান হলে তো কথাই নেই। মহাশত্রু, গোদের ওপর বিষফোঁড়া। যদিও জন্মজন্মান্তর ধরে আসামই ঈশানদের জন্মভূমি, ঘরদোর, কবরস্থান সবকিছু। 

ধর্মকে ইস্যু করে যেহেতু দেশ ভাগ হয়েছে, ভারত যেমন হিন্দুদের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল, পাকিস্তানের একচ্ছত্র দাবিদার হলো মুসলমানরা। আসাম থেকে তখনো মুসলমানরা দলে দলে দেশত্যাগ করছে। পাশের দেশে নিজের জাতের লোক বেশি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এক নয়, কিন্তু ধর্ম তো এক! সোহরাব শিকদার প্রমাদ গুনলেন। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে হবে। হিন্দুদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে হবে এবং ছেলের সংসার টেকাতে হবে। ইসলামপুরের কাঁসা ব্যবসায়ী অখিল চন্দ্রের ব্যবসা সূত্রে আসামে যাতায়াত ছিল। প্রপিতামহের সঙ্গে বেশ দহরম-মহরম। রায়টের সময় অখিলচন্দ্রের বাড়ি লুট হয়ে যায়। সেটাই শেষ নয়, এদিকের মুসলমানরা বিশেষ করে রজব আলির পিতামহ তার সম্পত্তি হড়কে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন। যে-কোনো সময় খুন হয়ে যেতে পারেন! শোনা যায়, অখিলচন্দ্রই সোহরাব শিকদারকে মাইগ্রেশনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একবার প্রপিতামহ অখিলচন্দ্রের বাড়ি বেড়াতে আসার নামে রাধানগর এলেন। সেবারই তিনি মাইগ্রেশনের বিধিব্যবস্থা করে কাছাড়ে ফিরলেন। এর কিছুদিন পর ঘর-দোর, জমি-জিরাত এমনকি পূর্বপুরুষদের কবরস্থান, মসজিদ সবকিছু হিন্দু অখিলচন্দ্রের হাতে সঁপে দিয়ে মুসলমান মুহাম্মদ সোহরাব শিকদার এদেশে চলে এলেন। আর অখিলচন্দ্র তাঁর সমস্ত জমিজিরাত, পুকুরঘাট, পুজোর ঘর, তুলসীতলা, মন্দির, আশৈশবের স্মৃতি দিয়ে গেলেন মুসলমান সোহরাব শিকদারের জিম্মায়।

সত্যি তো! দেশভাগ কী? সে তো,  যশোরের কৃষ্ণমণ্ডলের ক্লারিয়েটে বেজে ওঠা আর্তনাদ! কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে যার সুর আজো ছড়িয়ে পড়ছে, ট্রেন থেকে পথ-ঘাট শহর-বন্দরে।                                                                         দাদু, বাবা, কাকা এমনকি ঈশান –  সেও তো সেই আর্তনাদের অংশীদার। জীবনের গভীরে নিষ্করুণ সেই সুর কখনো কখনো অনুভব করেছে তাদের সকলেই, এবং কাছাড়ে অখিলচন্দ্রও হয়তোবা!  

বাড়ি থেকে ক্রমাগত ফোন আসছে। একেকজন একেকভাবে ঈশানের ব্রেইনকে উত্ত্যক্ত করছে। ঈশান ফোন বন্ধ করে রাখে। কিছু সময় চুপচাপ থাকতে চায়। সে বাড়ি যাচ্ছে সজীব ছাড়া কেউ জানে না। মা, দাদি, কাকা কেউ বাড়িতে যেতে দিতে রাজি নয়। নিশাও ঘোর বিরোধী। ঢাকায় আটকে রাখার জন্য নিশা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। শেষে রাগ, অভিমান, কান্নাকাটি। তাদের সকলের ধারণা, বাড়িতে গেলে ঈশান খুনোখুনি করবে। খুনোখুনি হলে হবে, কিন্তু বাড়ি তাকে যেতেই হবে।

ট্রেন কেবল গফরগাঁও। ইসলামপুর পৌঁছাতে আরো ঘণ্টা তিন লাগবে। সামনের ভদ্রমহিলা চাপুর-চুপুর করে খেয়েই চলেছেন। দুটো কলা সাবাড় করলেন। ডিমওয়ালার কাছ থেকে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চেক করে বড় দেখে এক হালি ডিম কিনলেন। এখন তিনি সেগুলির খোসা ছাড়াচ্ছেন। ছাড়ানো শেষ হলে নিশ্চয় মা-ছেলে খাওয়া শুরু করবেন। সকাল থেকে ঈশানের ফুসফুসে পাঁচটা বেনসন লাইটের ধোঁয়া ছাড়া পেটে কিছু ঢোকেনি। এক হালি ডিমের ভবিষ্যৎ পরিণতি কল্পনা করে ঈশানের ভেতরটা গুলিয়ে আসছে। ঈশান দ্রুত উঠে বগির বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।

সোহরাব শিকদার জমি বদল করে এদেশে বিশাল তালুক পেয়েছিলেন। সেগুলি কমতে কমতে আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। অখিলচন্দ্রের সম্পত্তি যারা জোরপূর্বক ভোগদখল করতে চেয়েছিল মূলত তারাই সোহরাব শিকদারের সামনে আড়কাঠি হয়ে দাঁড়ায়। এমনও হয়েছে, লাঠিয়াল ভাড়া করে জমি-জিরাত দখল করে নিয়েছে, গোয়ালে আগুন লাগিয়ে গরু পুড়িয়ে মেরেছে। এসব দেখার কেউ নেই।

এ-সবকিছুই ঈশানের বাবা-কাকার কাছে শোনা কাহিনি। বুঝতে শিখে অবশ্য ঈশান টের পেয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে বেশকিছু ক্ষেত্রে তারা আলাদা। ভাষা, শিক্ষা, খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজন। রুবেল, আবিদ, শিহাব সকলেরই নানা কিসিমের

  অনেক আত্মীয়। কিন্তু ঈশানের স্বজন বলতে কেবল দুই ফুপু আর তিন কাকা। বংশের যে একটা শেকড় থাকে সেটি তারা কাছাড়েই ফেলে এসেছে।

এতকিছু করেও সোহরাব শিকদারের উত্তরসূরিদের কিছুই করতে পারেনি তারা। সম্পত্তি দখল করে নিলেও শিক্ষা-দীক্ষা অর্থকড়িতে এলাকায় ঈশানদের সমান কেউ নেই। এই বিষয়টাও স্থানীয়দের চোখে  হুল হয়ে ফোটে।  

খুব ক্লান্ত লাগছে। সিটে ফেরে ঈশান। খাওয়া শেষে মা-ছেলে ঘুমাচ্ছে। ভদ্রমহিলার ঘুমন্ত চেহারায় এখন বিরক্তির লেশমাত্র নেই। বরং খুব স্নিগ্ধ লাগছে। নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সুখী সুখী মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঈশান, পরক্ষণেই নিজের কাছেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।  

ট্রেন ঘাটে ঘাটে ক্রসিংয়ে পড়ছে। লোকজনের হাউখাউ, চেঁচামেচি! খুব বিরক্ত লাগে। ঘণ্টাখানেক বিলম্বে ঈশানের গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছায় ট্রেন। স্পিকারে করপোরেট কণ্ঠে ঘোষিকার ঘোষণা বাজছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন ইসলামপুর বাজার স্টেশনে প্রবেশ করবে। যার যার মালপত্র গুছিয়ে নেওয়ার কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। স্টেশনে নামতে নামতে দিন শেষ। সব আলো শুষে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সবুজ টিনের চালে  সন্ধ্যা নেমেছে।

ঈশান বাড়ি না গিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে অটোতে চড়ে।  মুখোমুখি ছয়জনের মধ্যে একজন বসে থাকে মূর্তির মতো। কিন্তু  মাথায়  চিন্তার নকশার আঁকিবুকি চলছে। হাসপাতালে বাবা কী অবস্থায় রয়েছে তার চেয়ে ভাবনার গ্রাফে কীভাবে রজব আলীকে শিক্ষা দেওয়া যায় তার ডটগুলিকে লাল কালির আঁচড়ে অচেনা কেউ সংযোগ ঘটাচ্ছে। সামনে বসা মধ্যবয়স্ক মানুষটি ঈশানকে  উৎসুক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছেন। হয়তো পরিচিত লাগছে অথবা ঈশানের কপালের কুঞ্জনরেখায় কিছুটা দ্বিধান্বিত! অটোতে বসা বাকি চারজন নির্বিকার, অনুভূতিহীন! তাদের মুখের রেখায় জীবনের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলার অটোগ্রাফ! 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে সজীব অপেক্ষা করছিল। অটো থেকে নামতে সজীব এগিয়ে এসে হাত ধরে।  মৃদুস্বরে বলে, ‘চল।’ ওর পিছু পিছু নিঃশব্দে হাসপাতালের দোতলায় উঠে আসে ঈশান। পুরুষ ওয়ার্ডের সামনে এসে শরীর  একটু কেঁপে ওঠে বোধহয়। ঈশান  থামে। সজীব পিছু ফিরে ডাকে, ‘কি রে দাঁড়ালি যে! আয়।’

ওয়ার্ডের একেবারে শেষ মাথায় বাবার বেড। দরজা থেকেই দেখা যাচ্ছে। মা, তানিশা সঙ্গে আরো কয়েকজন বেড ঘিরে দাঁড়িয়ে, বসে আছে। ঈশান দ্রুতগতিতে সেদিকে এগোচ্ছিল। ঈশানের দিকে মায়ের চোখ পড়তে চমকে ওঠে। মুখ থেকে সব রক্ত সরে গেছে তার। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, ‘ঈশান ঢাকা থেকে তুই চলে এলি কেন? তোকে আসতে নিষেধ করেছি না?’ তানিশা দৌড়ে এসে ঈশানের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাঙা স্বরে বলতে থাকে, ‘ভাইয়া বাবা, ভাইয়া বাবা।’ ঈশান তানিশাকে জড়িয়ে বাবার দিকে তাকায়। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বাবা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, চোখ বন্ধ। সাদা বেডকভারে আপাদমস্তক ঢাকা। ঠিক কোথায় আঘাত  লেগেছে বোঝা যাচ্ছে না। এলাকার রহমত চাচা, হায়দর ভাই, মেম্বার চাচাসহ আরো কয়েকজনের উপস্থিতি দেখে চোখ কুঁচকে ওঠে। এখানে তারা কিসের ধান্দায় এসে বসে আছে বুঝতে বাকি থাকে না ঈশানের। এই লোকগুলি গ্রামের যে-কোনো ঝামেলায় নিজেদের মাতবর সাজিয়ে ঝামেলাগুলিকে আরো তালগোল পাকিয়ে তোলে; তারপর সেখান থেকে ফায়দা লোটে।

অর্ক বাবার পায়ের কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখমুখ শক্ত। বড় ভাইকে দেখে সে কিছুই বলে না। ঈশান ধীরে ধীরে বাবার পাশে গিয়ে চাদরটা সরাতে যায়। মা দৌড়ে এসে ঈশানের হাত ধরে ফেলে, ‘থাক বাবা, দেখতে হবে না। বেশি লাগে নাই।’ বেশ কর্কশ কণ্ঠে ঈশান মাকে ধমকে ওঠে, ‘ছাড়ো তো মা। দেখতে দাও।’

চাদর সরিয়ে আঁতকে ওঠে ঈশান। বাবার বাঁ কাঁধ থেকে ডান বগলের নিচে পর্যন্ত বুক জুড়ে ব্যান্ডেজ। হাতের বাহুতেও ব্যান্ডেজ! অথচ সকালে ফোনে তানিশা বলেছিল ছুরি শুধু হাতে লেগেছে। মাথা ঘুরে ওঠে ঈশানের। বাবার বেডে মাথা রেখে মেঝেতে বসে পড়ে। চোখ থেকে আলগোছে কয়েক ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে।  কিন্তু ঈশান কারো সামনে দুর্বলতা দেখাতে চায় না। কখনোই দেখায় না। চট করে চোখ মুছে ঋজু ভঙ্গিতে উঠে অর্কের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হায়দর ভাই এগিয়ে এসে ঈশানের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘রজব আলী ছুরির পোঁচ দিছে। আল্লাহ্‌ বাঁচাইছে, ছুরি ভিতরে ঢুকে নাই। নাইলে  নাড়িভুঁড়ি বারাইয়া যাইতো। হ্যার বাদেও সিলি পড়ছে কয়েকডি। ডাক্তার বলছে কদিন সময় লাগবো কিন্তু  সাইরা যাইব।’

ঈশানের চোয়াল শক্ত। নাসারন্ধ্র ফুঁসছে। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘হারামির বাচ্চা!’

কথাটি হয়তো কেউ শুনতে পায় না, তবু ঈশানের শরীরের ভাষা উপস্থিত সকলে পড়ে ফেলে।

‘ঈশান বাবা, মাথা ঠান্ডা রাখো। রজব আলী যে অন্যায়ডি করছে এর উপযুক্ত বিচার আমরা করবাম। চিন্তা কইরো না।’

মেম্বর চাচা মাথা ঝাঁকিয়ে বিজ্ঞের মতো রায় ঘোষণা করেন।

‘বিচার করবা তোমরা আমার হ্যাডা।’ ঈশানের মুখ দিয়ে খিস্তি বের হতে যাচ্ছিল কিন্তু বহু কষ্টে সংবরণ করে। মা কাছে এসে ঈশানের হাত জড়িয়ে রাখে। সে ছেলের ভেতরের আগুনের হলকার আঁচে ভীত, সন্ত্রস্ত। এই এক মহিলা! যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি কঠিন হৃদয়ের মানুষ। ঈশান কখনো মাকে ভেঙে পড়তে দেখেনি। বাবা অনেক বছর বিদেশে ছিলেন। সেই সময়টাতে এক হাতে মা সংসার-সন্তান, অন্যহাতে জমি-জিরাত আগলে রেখেছে। মাকে একসময় প্রচণ্ড ভয় পেত ঈশান।  মা এখন ঈশানকে ভয় পায়।

এর মধ্যেই উপস্থিত মাথাগণ সালিশ দরবারের প্রসঙ্গ তোলে। কবে দরবার বসবে, দরবারে-সালিশ করতে কাকে কাকে ডাকা হবে, ঈশানের বাবার জন্য কত টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হবে ইত্যাদি ধরনের আলোচনায় হাসপাতালকে দর কষাকষির বাজারে পরিণত করে তারা। সরকারি হাসপাতাল, দেখার কেউ নেই। ঈশান হ্যাঁ-না ছাড়া কোনো কথাই বলে না। 

একসময় সজীবকে ঈশারা করে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যায় ঈশান। মা পিছু পিছু চিৎকার করে ডাকে, ‘ঈশান কোথায় যাচ্ছিস? বাড়ি যাবি না বলছি। ইনারা আছেন, কিছু ফয়সালা হবে। ফিরে  আয় ঈশান!’ ঈশান পেছনে ফিরে তাকায় না। ওর পিছু পিছু সজীব, অর্ক দুজনেই বেরিয়ে আসে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয় ওরা। অটোতে পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকে। ঈশানের চোয়ালের বন্ধন আরো কঠিন, হাত মুষ্টিবদ্ধ। বাবার যে অবস্থা এখানে রাখা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। জামালপুর হাসপাতালে নিতে হবে। তার আগে একটা বিহিত করা জরুরি।

বহুক্ষণ বাদে পকেট থেকে ফোন বের করে ঈশান। অসংখ্য মিসড কল। তার মধ্যে নিশারই এগারোটা। এই মেয়ে আরেক পাগলি। ঈশান ফোন ব্যাক করে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ঝরঝর করে কাঁদছে নিশা। রাজ্যের অভিযোগ, ‘কেন এমন করো? কেন ফোন রিসিভ করো না? তুমি জানো না, ফোনে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাই? কোথায় আছো? মারামারি করোনি তো?’

ঈশান সব শুনে খুব শান্তভাবে বলে, ‘আচ্ছা শোনো, ফোন সাইলেন্ট ছিল,  আমি সরি। হাসপাতালে বাবাকে দেখে এখন বাড়ি যাচ্ছি।  দোয়া করো।’ এরপর আবার শুরু হয়, ‘বাবা কেমন আছেন? খবরদার গ্যাঞ্জাম লাগাবা না। আমার কসম। কথা বলছ না কেন? আমার কথা মনে রেখো কিন্তু। আমার খুব ভয় হচ্ছে। প্লিজ ঈশান, একদম মাথা গরম করবা না। বাবার কাছে থাকা জরুরি তোমার। তাঁর চিকিৎসা আগে, নাকি রিভেঞ্জ আগে? এমন কেন তুমি?’ 

ঈশান চুপ করে শোনে। এই মুহূর্তে কারো কোনো পরামর্শই মাথায় ঢুকবে না। অন্তঃকরণ স্পর্শ করবে না। নিশার সব কথা কান থেকেই বেরিয়ে বাইরে মিলিয়ে যায়।

গ্রামের চেনা পথ ধরে যাচ্ছে ওরা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অটোর সামনের কিছুটা অংশ কেবল আলোকিত। আগে যেসব কথা খুব একটা ভাবেনি সেসব কথাই আজ বারুদের মতো বুকে আঘাত হানছে।

একবার ক্লাসে মতিন স্যার ভারতের ইতিহাস পড়াতে পড়াতে ঈশানের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ‘এই যেমন ধর, ঈশান কিন্তু প্রকৃত বাংলাদেশি নয়, ও মূলত ভারতীয়। দেশভাগের পর ওর পূর্বপুরুষেরা ওদেশে মার খেয়ে বাড়িঘর  ফেলে এদেশে পালিয়ে এসেছিল।’

অমনি সাব্বির দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আমার আব্বু বলে ঈশানের বাবা ঘটি। ঘটি কেন বলে স্যার? ওরা কি ইন্ডিয়া থেকে বাটিঘটি নিয়ে পালিয়ে এসেছিল?’

সাব্বিরের কথা শুনে স্যার হো-হো করে হেসে উঠলেন আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাস হি-হি-হি হা-হা-হা করে গড়িয়ে পড়ে।

ঈশানের চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। হাসি থামলে মতিন স্যার বলেছিলেন, ‘না না, সেটা হবে কেন? পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছে তাই ঘটি বলে।’ ঈশান অবশ্য ভেঙে বলেনি, তারা পশ্চিমবঙ্গ নয়, আসাম থেকে এসেছে। এরপর থেকেই স্কুলে বন্ধুদের অনেকেই ঈশানকে  ‘ঘটি’ বলে ভ্যাঙাতে শুরু করেছিল।

বাড়িতে এসে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা ঘটি কী? আমাকে কেন ওরা ঘটি বলে?’ মা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। ‘ঘটি বলেছে তাই কী হয়েছে? তোমার গা তো পচে যায়নি। এসব কানে নিও না।’

আজ অবধি পান থেকে চুন খসলে বন্ধুদের কাছে শুনতে হয়, ‘তোদের দেশ তো ইন্ডিয়া। সেখানে চলে যা।’ একসঙ্গে  ক্রিকেট খেলা দেখতে গেলে তো কথাই নেই। তারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করলে দোষ নেই, কিন্তু ঈশানদের কেউ ভারতকে সাপোর্ট করলে নাম হয়ে যায় ‘ভারতের দালাল’।

বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে অটো থেকে নামে ওরা। রজব আলীর বাড়ির দিকে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। ঈশানদের বাড়ির দুই বাড়ি আগেই রজব আলীর বাড়ি। নিশুতি রাত। সকলে ঘুমে কাদা। একটা ঝিঁঝি পোকার ডাকও শোনা যাচ্ছে না। রজব আলীর বাড়ির সামনে খড়ি কেটে ডাই করে রাখা। সেখান থেকে ঈশান একখানা কাঠের চলা হাতে তুলে নেয়। ওর দেখাদেখি সজীব আর অর্ক দুটো চেলাকাঠ তোলে। অর্ক ঈশানের ছোট ভাই হলেও ঈশানের চেয়ে লম্বা, তাগড়া। শরীরে অসুরের শক্তি। সে-ই  প্রথম রজব আলীর টিনের গেটে সজোরে আঘাত করে।

টিনের ঝনঝন শব্দে পুরো পাড়া জেগে উঠেছে। রজব আলীর বাড়িতেও সাড়া পড়ে গেছে। গেট প্রায় ভেঙে ওরা বাড়ির মধ্যে ঢোকে। রজব আলীর ঘরের বন্ধ দরজায় ওদের সম্মিলিত লাথিতে চৌকাঠ ভেঙে পড়ে  যায়। ঘরের মধ্যে ঢুকে হকচকিয়ে যায় ঈশান। সামনে রজব আলীর মা, স্ত্রী আর দুটো বাচ্চা মেয়ে। যে রজব আলীর খোঁজে ওরা এসেছে সে কোথাও নেই। রজব আলীর মা, বাচ্চাগুলি হাউমাউ করে কাঁদছে। আর তার হাফেজা স্ত্রী ঘোমটা টেনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওদের দিকে তেড়ে আসছে। অর্কের মেজাজ চড়া। ও ঘরের ভেতরের ড্রেসিং টেবিল, সেলাই মেশিন ইত্যাদি জিনিসপত্র ওলটপালট করে ফেলে। ওকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ঈশান চিৎকার  করে, ‘আরে মেয়েমানুষের সঙ্গে গ্যাঞ্জাম কইরা লাভ নেই। খানকির পোলা দেখ পেছন দরজা দিয়া ভাগছে। ধর ওরে।’ সজীব দৌড়ে গিয়েও আর রজব আলীর নাগাল পায় না।

ওদের চিৎকার, চেঁচামেচি ও হুমকি-ধমকিতে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। পাড়ার লোকেরা হাতে টর্চ নিয়ে সব জড় হচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎবাতি জ্বলে উঠেছে। বাড়ি থেকে দাদি, কাকা-কাকি সবাই বেরিয়ে এসেছে। সকলেই আতঙ্কিত। তাদের জোরাজুরি আর কাকুতি-মিনতিতে নিজেদের বাড়ি ফিরে যায় ঈশানরা। সবটুকু রাগ ঝাড়তে না পারলেও মন এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। হারামিটা যে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে সেটাও কম কি!

সারাদিন ধকলের পর ঈশান কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়েই শুয়ে পড়ে। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

মানুষের চেঁচামেচিতে খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় ঈশানের। ঘরের বাইরে এসে চেঁচামেচির উৎস খুঁজতে গিয়ে যা শুনলো তাতে ভাষাহারা হওয়ার জোগাড়। রজব আলীর গোয়ালঘরের চাল রাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট-গ্লাস, চেয়ার-টেবিল সবই ভাঙা, এলোমেলো। এবং এর মধ্যে পুরো গ্রামে ঢিঢি পড়ে গেছে যে, রাতে এসব ঘটনা ঈশানেরা কয় ভাই আর ওদের দুই কাকা মিলে ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, রজব আলীর স্ত্রী এবং মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এখন তারা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মানুষ কি ভয়ানক! এতবড় মিথ্যা? অথচ রজব আলীর স্ত্রী একজন হাফেজা। তার মুখ পর্যন্ত কখনো দেখেনি ঈশান। রজব আলী নিজে মাদ্রাসায় আরবি পড়ায়।

প্রমাদ গোনে ঈশান। ওরা যদি নারী সংক্রান্ত মামলা করে, ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। একটা বিশাল ভুল হয়ে গেছে। ঢাকায় থাকতেই মীরা আপা বারবার করে বলেছিল যেহেতু বাবার ওপর জান নেওয়ার হামলা হয়েছে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের অভিযোগ এনে মামলা করতে। কাকাদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপও হয়েছিল; কিন্তু গ্রামের মাতবরদের কথায় কাকা পিছিয়ে

 এসেছে। এখন আর দেরি করা সমীচীন হবে না। ছোটকাকাকে সঙ্গে নিয়ে থানার দিকে রওনা হয় ঈশান আর সজীব। ওদের আগেই মামলা রুজু করা দরকার নইলে পরে কাউন্টার কেস করে লাভ নেই। বাবার ওপর আক্রমণের বিস্তারিত উল্লেখ করে জিডির সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছিল কাকা। মামলা রুজু করতেই যাচ্ছিল, তখন কজন মুরুব্বিকে নিয়ে মেম্বার চাচা থানায় হাজির। তিনি কাকাকে সরাসরি দোষারোপ করে বলেন, ‘ঈশান বুঝলাম পুনাই মানুষ, তুমি কেন এসব মামলার মইধ্যে যাইতেছ আহমদ মিয়া? আমরা কি মইরা গেছি? আমাগো গ্রামে পুলিশ কুনুদিন ঢুকতেয়ারছে? কী করতাছ এইসব মিয়া? গেরামে টিকতে পারবা? ভাইবা দেখ।’

এ তো সরাসরি হুমকি! কাকা আমতা আমতা করতে থাকেন, ‘ওদের পক্ষে আফসার আলী মামলা করতে এসেছে আমরা না করলে তো বিপদে পড়ে যাবো।’

‘দোষ তো তোমার ভাতিজাগো। হ্যাগো কাইল হাসপাতালে নিষেধ করলাম হ্যার পরেও ক্যান রজব আলীর বউ-বাচ্চার ওপরে হাত তুলছে? আমাগো কাছে বিচার পাইতা না?’

ঈশানের মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়। সে  বেশ কর্কশ স্বরে বলে, ‘মেম্বার চাচা, কী বলতে চাচ্ছেন? ওরা মারবে আর আমরা হাত কোলে নিয়ে বসে থাকব? মামলা করতে আসছি করতে দেন, পরের কথা পরে দেখা যাইব। অ্যাটলিস্ট জিডি করে রাখা উচিত। ওরা মিথ্যে মামলা দিতে পারলে আমরা কেন সত্যি মামলা করব না?’

‘ঈশান বাবা, তুমরা সেদিনগার পুনাই, গেরামের রাজনীতি কী বুঝ? আমার কথা হুনো। মামলা, জিডি কিছুই করনের দরকার নাই। হ্যাগো থামাইতাছি, সবুর করো। আমরা এলাকার ময়-মুরুব্বি, একটা উচিত বিচারই করবাম। আর বিচার পছন্দ না হইলে মামলা করো, মারো, ধরো কিছু কইতাম না। নিজেগো মইধ্যে

থানা-পুলিশ একটা শরমের ব্যাপার।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জিডি না করেই বাড়ি ফিরতে হলো। তাদের বিরুদ্ধে গেলে পুরো গাঁ একত্রিত করে বয়কট করে রাখবে। একবিংশ শতাব্দীর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোচ্ছে ঠিকই; কিন্তু এই গাঁয়ের লোকেরা প্রাচীন ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে পড়ে আছে। এখনো ‘দরবার’ বা ‘উঠোন বৈঠকে’র নামে মধ্যযুগের পঞ্চায়েতের ফাঁদ থেকে রাধানগর গাঁয়ের লোক বের হতে পারছে না বা মেম্বার চাচার মতো কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী বের হতে দিচ্ছে না।

থানা থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যায় ঈশান। কাল রাতের ঘটনা আর আজকের মামলার কাহিনি মায়ের কানে ইতোমধ্যে চলে এসেছে। বাবার চোখ আজো নিমীলিত। বাবার পাশে বসে হাতটা আলতো করে ধরে ঈশান! একটু কেঁপে ওঠেন বাবা! আত্মজের স্পর্শ টের পেয়েছেন হয়তোবা। মা বলে, ‘ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। সারাদিন ঘুমিয়েই থাকে।’ পরক্ষণেই নিচু স্বরে নানা অভিযোগ শুরু হয় মায়ের, ‘ছোটবেলা থেকে তুমি আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছ। এখনো দিয়েই যাচ্ছ। আর কত জ্বালাবে ঈশান? দু-চোখ যেদিকে যায়, চলে যাবো। কাল কি দরকার ছিল রজব আলীর মা, বউকে মারার? আমি এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে? ঢাকায় ফিরে যাও তুমি। তোমার কাকারা আছেন, বাবা আছেন, তারা ভেবে দেখবেন কি করা যায়।’

মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় ঈশানের। কী সুন্দর কথা! ওদের কারণে বাবা হাসপাতালে মরছে আর ওদের আদর করবে?

‘তুমিও এই কথা বলতেছ আম্মা? রজব আলীর মা-বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছি কে বলছে তোমারে? তাদের গায়ে একটা টোকাও দেয়নি কেউ।’

‘হাত না দিলে মানুষ বলবে কেন? ছিছি! কোন পাপে এই দিন দেখতে হলো আমাকে?’

কিছু ভালো লাগে না ঈশানের। কার কার মুখ আটকাবে? মায়ের ওপর রাগ দেখিয়েই বা কী লাভ?

ডাক্তারের কাছে বাবার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে ঈশান। ডাক্তার বলেছেন দু-একদিনের মধ্যে বাবাকে রিলিজ করে দেবে।

বাবার চিন্তায় দাদি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। একবার ঈশান, একবার অর্ক আর একবার বড়কাকাকে প্রশ্নজালে জেরবার করে ফেলছেন। সারাক্ষণ ছেলের জন্য মায়ের আহাজারিতে বাড়ির বাতাস ভারী। কোনোভাবেই তাকে বোঝানো যাচ্ছে না যে, বাবা ভালো আছেন। তার প্রশ্ন, ‘ভালো আছে তাহলে কেন মায়ের কাছে আসছে না? তোরা আমাকে কী লুকাচ্ছিস ঠিক করে বল।’

সন্ধ্যা নাগাদ খবর পাওয়া গেল রজব আলী বড় কাকাকে প্রধান আসামি করে মোট তেরোজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তার মধ্যে ঈশানের মায়ের নাম আট নম্বরে। কেসের ধারাও সবগুলি কঠিন। নারীর শ্লীলতাহানি, জোরপূর্বক ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট, ভাংচুর, চুরি। সন্তানসম্ভবা নারীর সন্তান বিনষ্ট। হ্যানো ধারা নেই যেগুলি তারা আরোপ করেনি। এই খবরে ঈশান ঠিক কী অভিব্যক্তি ব্যক্ত করবে ভেবে পায় না। ঈশান বুঝতে পারে ফাঁদে পড়ে গেছে তারা। দুধওয়ালা গাইয়ের গলায় দড়ি বাঁধা শেষ, এখন বাট  চিপে দুধ বের করার পালা।

অগত্যা কাউন্টার কেসই করতে আবার থানার দিকে রওনা দিলো ঈশান, ছোট কাকা আর সজীব।

দুপক্ষের মামলার পরেই শুরু হলো গ্রামের মাতবরদের আসল খেলা। দুই পক্ষেই তাদের যাতায়াতে পায়ের চটির ফিতে ছিঁড়ে যেতে লাগলো। কখনো সবার সম্মুখে, কখনো রাতের আঁধারে দেন-দরবার চলতে থাকে। দুই পক্ষের বাড়িতেই হাঁসের গোস্তের সঙ্গে চালের আটার রুটি বা দেশি মোরগের পাতলা ঝোল রান্না হতে থাকে মাতবরদের খুশি করতে। রাধানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও এসে জুটে যান কখনো-সখনো। দুই পক্ষেই মুফতে পান-সিগারেটের ধুম চলে। দুই পক্ষেরই ইজ্জতের সাওয়াল। টাকা খরচ হয় হোক, গ্রামবাসীর সমর্থন নিজের দিকে টানতে হবে।

ওই পক্ষের নারীরা হাসপাতাল থেকে এখনো বাড়ি ফেরেনি। হাসপাতালে যত বেশি সময় চিকিৎসায় থাকবে মামলার

গাঁথুনি তত বেশি কঠিন হবে। সেই একই চিন্তা করে ঈশানের বাবাকেও হাসপাতালেই শুইয়ে রাখা হয়। রাধানগরের বাজার, মাঠ, রাস্তাঘাট, টং দোকানের চায়ের কাপে একই ঝড়, সোহরাব শিকদারের ভাতিজারা রজব আলীর বউয়ের ইজ্জত মারছে। কেউ এই বয়ানের পক্ষ নিয়ে রং-তামাসা করে, কেউ নরম সুরে প্রতিবাদ জানায়, ‘না না, হ্যারা এত খারাপ পুনাই না। এইতা রজব আলীর বানানী কতাবার্তা। কেইস শক্ত করণ লাগবো, বুঝলা না?’ 

সত্য-মিথ্যা যাই থাকুক, গ্রামের দুই পক্ষের গোলমাল নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে একটা টানটান উত্তেজনা চলছে। তারা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তার মোড়, হালট, চায়ের দোকানেই বেশি সময় অবস্থান করতে থাকে। দুই পক্ষে কী কী ঘটছে, কী কী ঘটতে পারে সেসব

ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের ভাবনার অন্ত নেই। ওদিকে মাতবররা ভীষণ ব্যস্ত। দুই পক্ষকেই মামলা তোলার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের সম্মানের বিষয় জড়িত। সোলেমান শিকদার গং ভার্সেস রজব আলী গং-এর মধ্যে কোন পক্ষ ভারী সেগুলো নিরূপণ করতে, এমনকি কোন দল দরবারে জিতবে সেসব ফল ঘোষণার আগেই ছোটখাটো বাজি ধরাধরি হয়ে যেতে থাকে। কিছু দুমুখো মানুষ এদিকের কথা ওদিকে আর ওদিকের কথা এদিকে চালাচালি করে চা-সিগারেট ফোঁকার ফন্দি আঁটতে থাকে। রীতিমতো জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশের মতো রাধানগর উত্তপ্ত কড়াই। যে-কোনো সময় আগুনে ঘি পড়লে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। এর মধ্যে গ্রামে কেউ কেউ আশঙ্কা ছড়িয়ে দিলো যে, অচিরেই রাধানগর গ্রামে দুই পক্ষে মারামারি হতে যাচ্ছে। দুই পক্ষই লাঠিয়াল ভাড়া করেছে, সড়কি-বল্লম জড়ো করছে। ঘরে ঘরে নারীরাও চিবুকে হাত দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে সেসব গল্প  শোনে আর আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হওয়ার ভান করে চোখ কপালে তুলে ফেলে।

মেম্বার চাচা ঈশানের বড় কাকার কাছে এসে বেশ গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘সোলেমান ভাই হুনেন, তাগো মামলা বড় কঠিন দাগে হইছে। ওয়ারেন বাইর হইলে উপায় নেই কইলাম। আপনাগো ভাই-ভাতিজার

জেল-জরিমানা তো হইবই আপনারেও ছাড়ত না। পুলিশ ছুঁইলে ছত্রিশ ঘা – বুঝলাইন না? বুড়া বয়সে এইতা করতাইন? তার চাইতে আমরা মিলতাল কইরা দেই, টেকা-টুকার উপরে দিয়া গেলে যাক। সম্মান তো বাঁচব। ভাতিজারা যহন একটা অন্যায় কইরাই ফালাইছে।’

কাকা নির্বিকার মুখে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে থাকেন। মেম্বার চাচা এতে কনফিউজড হয়ে যান। কাকার হ্যাঁ বা না-এর মধ্যবর্তী অবস্থানে বুঝে আবারো কথা চালান, ‘আর হুনেন, আপনাগো কেস তো অত শক্ত হইত না। একটু ছুরির টান পড়ছে মাত্র। আর হ্যাগো মাইয়া মাইনষের ব্যাপার, বুঝলাইন না? আপনাগো শিক্ষিত মানুষ বুঝামু কী? ভাতিজাগো শইলে পুলিশের ঘা পড়লে সরকারি চাকরিত যাইত পারত? নাকি বিয়া-শাদির ঘর আইত?’

চাকরির কথায় সম্ভবত কাকার মন দমে যায়। তাই তো কেসে হারলে সরকারি চাকরিতে আবেদনই করা যাবে না। তাছাড়া কেস নিয়ে কে কোর্ট-কাচারি করবে? টাকাও তো প্রচুর খরচ হবে। কাকা মেম্বার চাচার মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বলেন, ‘কী করতে বলেন তাহলে এখন আমাদেরকে?’

মেম্বার চাচার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘আরে কী করতে হইব আমার উপরে ছাইড়া দ্যান। চেয়ারম্যান আমার কাছের লোক। রজব আলী কিছু করতে পারতো না। আমি তাইলে দরবার বয়াইতে কই। কী কন?’

‘জি দেখেন কী করা যায়। আপনাদের কথার বাইরে তো আমরা না। তবে আমাদের দিক খেয়াল রাইখেন।’

‘আরে কী যে কন মিয়াভাই। আপনি আমগো মুরুব্বি মানুষ। সেই খেয়াল আমার আছে। তয় অহন যাই। ঈশান বাবা, তুমি তাইলে আমি যারে যারে কই তাগো বাড়ি গিয়া কইয়া আইবা। আগামী শুক্কুরবার বাদ জুমা জব্বার মোড়লের উঠোনে দরবার বইব। বিশ-ত্রিশজনের খাওন-দাওনের একটা ব্যবস্থা রাইখো বাবা।’

দরবার বসার নামে রাধানগর গ্রামে হুলস্থূল পড়ে যায়। চারদিকে সাজসাজ রব। একদিকে ঈশানদের কয় ভাইয়ের নামে রংঢং করে রসময় গুপ্তের গসিপিং চলে, অন্যদিকে গ্রামের অনেক তরুণের কাছে ঈশান রাতারাতি হিরো বনে যায়। ঈশানকে তাদের আইডল মেনে আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। আড়ালে-আবডালে বলতে থাকে, ‘ব্যাডা একখান! বাপের মাইরের বদলা নিয়া দেহাইয়া দিছে।’ বাজারের দোকানে ঈশানের নামে বাকির খাতাও খুলে ফেলে তারা। 

এদিকে দরবার বসার আগের রাতে মেম্বার চাচা হায়দর ভাইকে নিয়ে হাজির হয়ে যে সংবাদ দিলেন, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। মেম্বার চাচা খুব গম্ভীরভাবে জানালেন, ‘একটা ভেজাল হইয়া গেছে। হ্যাগো ডিমান তো অনেক। তিন লাখ টেকা চাইতাছে ক্ষতিপূরণ। নাইলে কেস তুলতো না।’

‘তিন লাখ? কিসের জন্য? টাকা কি হাতের ময়লা? আমার ভাইকে মারলো তারা আর ক্ষতিপূরণ দেব আমরা? মামলা চলুক টাকা দেবো না।’

উত্তেজনায় বড় কাকার মুখ-চোখ রক্তরাঙা হয়ে গেছে। হার্টের পেশেন্ট কাকা, উত্তেজনা একদম নিষেধ। ঈশান কাকাকে শান্ত করে মেম্বারকে বলে, ‘চাচা তিন লাখ টাকা কেন দেবো আমরা? কী করেছি যে তাদের তিন লাখ টাকা দিতে হবে?’

‘হুন, হ্যারা কইতাছে তাগো মহিলাগো ইজ্জত নিছ তুমরা। রজব আলীর বউয়ের প্যাটের সন্তান লাথি দিয়া নষ্ট করছ। তার ক্ষতিপূরণ চাইতো না?’

ঈশানের মুখে রক্ত উঠে যায়। ছোট কাকা তেড়ে উঠে বলেন, ‘নাউজুবিল্লাহ, এত বড় মিথ্যা? ওর বউয়ের পেটে বাচ্চা ছিল কোনোদিন তো শুনি নাই? আসমান থেকে পয়দা হলো নাকি? জাওরার বাচ্চা জাওরা। হাফেজা হয়ে এই কাজ? আল্লাহর গজব পড়বে না?’

‘অহন হ্যারা যদি টেকা-পয়সা দিয়া সার্টিফেট জোগাড় কইরা কোর্টে দেহায় তুমরার কী করণের আছে কউ।’

খুব অসহায় লাগছে ঈশানের। এ কেমন ফাঁদ!

হায়দর ভাই উঠে ঈশানের হাত ধরে, ‘শুন ঈশান, চিন্তা কইরো না, আমরা দেখতাছি কত টেকা কমানি যায়। এছাড়া উপায় নাই। মামলা না উডাইলে কালকাই কোটত নিয়া ওয়ারেন বাইর কইরা ফালাইব। হ্যাগো হাত অনেক উঁচাত গেছে। টেকাও খরচ করতাছে প্রচুর।’

শুক্রবার রাধানগর জামে মসজিদে সর্বোচ্চসংখ্যক মুসুল্লির সমাগম ঘটে। জুমার আগে-পরে গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে তাদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর চলতে থাকে। ঈশানদের বাড়িতে মা-কাকি সকলে মিলে সকাল থেকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। পুকুর থেকে বড় খ্যাপ জাল দিয়ে বিশাল বিশাল রুই তোলা হয়েছে। রুই মাছের বড় বড় গাঁদা পেটির কড়া ভাজা, মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, রোস্ট, পোলাও, খাসির মাংস, বলতে গেলে পুরো এক বিয়ের আয়োজন। রান্নার ঘ্রাণ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু  ঈশানের নাকে এই ঘ্রাণ ঢাকার পরিবাগের ময়লার ডিপোর দুর্গন্ধকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওর ভেতর থেকে বমির উদ্রেক হয়। হয়তোবা বাবা, কাকা, সজীব, অর্ক সবারই এমনটাই হচ্ছে।

বাবাকে আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে আনা হয়েছে।

ডাক্তার তাকে পনেরো দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। দরবারের বিষয়ে বাবাকে কিছু জানানো না হলেও তোড়জোড়ে  আঁচ করে ফেলেছেন এবং নাছোড় যে তিনি দরবারে উপস্থিত

থাকবেন। পাছে ছেলেদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়!  

জব্বার চাচার উঠোনে গোলাকারভাবে চেয়ার, বেঞ্চ, টুল ইত্যাদি সাজিয়ে দরবারের আয়োজন করা হয়েছে। সাজানো চেয়ারে এক এক করে চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতবর, মুরুব্বিরা এসে বসেন। তাদের চেয়ারের সামনে দুটো কাঠের টেবিল। মেম্বার চাচার একপাশে বড় কাকা, ছোট কাকা এবং ফুফাও আছেন। বাড়ি থেকে ঈশান বাবার ইজি চেয়ারটা এনে দিয়েছে, সেখানে বাবা আধাশোয়া হয়ে আছেন। দরবার শেষে বিচারকদের ভূরিভোজ হবে।

উঠোনের কোনো আসন আর খালি নেই। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের প্রায় সকল পুরুষ সার্কাস দেখতে চলে এসেছে। রান্নাবান্না করা ছাড়া নারীদের বিচারকাজে কোনো ধরনের অংশগ্রহণ নেই। তাদের উপস্থিতিও সম্ভবত অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। তবে ঘরের বারান্দা, আড়াল-আবডালে তাদের হাজিরা টের পাওয়া যাচ্ছে।

দৃশ্যত বাদী এবং বিবাদীর পক্ষের আসন আলাদা হয়ে গেছে। উপস্থিত মানুষগুলির প্রায় প্রত্যেকের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে আনে ঈশান। মাতবর শ্রেণিতে যারা আছেন আর সামনে বাদী-বিবাদী ছাড়া সাধারণ গ্রামবাসী যারা আছে তাদের মধ্যে ঈশানদের বংশের কাকা, ফুফা আর ঈশানেরা কজন ভাই ছাড়া কেউ নেই। অন্যপক্ষে রজব আলীরা  তিন ভাই, ভাতিজারা ছাড়াও প্রায় পনেরোজন আত্মীয়স্বজন, যাদের সবাইকে ঈশান চেনে না। মুরব্বিদের বেশিরভাগই এমনকি গ্রামের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে তাদের পরস্পরের রক্তযুক্ত।

দরবার সঞ্চালন করছে আদিব স্যার। ঈশানদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। উপস্থিত মাতবরদের প্রস্তাবে রাধানগর চেয়ারম্যানকে সভাপতির আসন দেওয়া হলো; কিন্তু তিনি সেটি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে গ্রামের সব থেকে বুজুর্গ এরফান দাদার নাম প্রস্তাব করলেন। ইনি গ্রামের সব থেকে কুচুটে এবং ধান্দাবাজ। ঈশান এরফান আলীকে আড়ালে ‘বৃদ্ধ ঈগল’ নামে ডাকে।

প্রথমেই সভাপতি বাদী ও বিবাদী পক্ষের উদ্দেশে বলেন, ‘আজকের দরবারের যে রায় আমরা দেবো, সেইডা কি আপনেরা মানবাইন? যদি মানেন তাইলে আমরা জুরি বোর্ড গঠন করবাম।’

বাদী রজব আলী গলা উঁচু করে বলে, ‘হ হ আপনেরা যে বিচার করবাইন আমরা মাথা পাইতা নিবাম।’

বড় কাকাও মিনমিন করে সম্মতি জানায়।

এরপর সঞ্চালক বাদীপক্ষের কাছে অভিযোগ জানতে চায়। রজব আলী দাঁড়িয়ে আকস্মিকভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঈশানের বাবার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে। বলে, ‘আমি অন্যায় করছি ভাইজান। আমারে মাফ কইরা দেন। আপনে মারুইন, কাটুইন কিচ্ছু কইতাম না, কিন্তুক আপনে পোলাগোরে বিচার করুইন।’ দরবারের কেউ রজব আলীর এই নাটকের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ঈশান তার চালাকি ধরে ফেলে! স্পষ্টতই সে  দরবারের  সিম্প্যাথি আদায় করে নিল। 

এরপর আরো ভয়ংকর কিছু বাকি ছিল, যেটি প্রকাশ করলো রজব আলীর ভাই আফসার আলী। সে দাঁড়িয়ে বেশ

কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, ‘কী কইতাম ভাই, লইজ্জা লাগে, শরমও লাগে। হেরা তো আমাগো ঘরবাড়ি পুড়াইয়া, ভাইঙ্গা ছারখার কইরাই দিছে, এরপর কয় ভাই মিল্যা আমার ভাবিরে কামড়াইয়া রাখছে না। হ্যার বুক দুইডার মইধ্যে ঘাও কইরালচে!’

আফসার আলীর মুখ থেকে কথাগুলি বেরিয়ে সপাটে আছড়ে পড়ে ঈশানের দুই গালে। এই নির্লজ্জ মিথ্যার প্রতিকার কী? লজ্জা, ঘৃণা আর সম্ভবত ক্ষোভে অর্কের মুখ লাল টকটকে। সজীব চোখমুখে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে। ওর মাথা ঝুঁঁকতে ঝুঁঁকতে বুকের সঙ্গে ঠেকে গেছে প্রায়। ঈশান নিজের ঠোঁট দুই দাঁতের পাটির ফাঁকে চেপে ধরে নোনতা স্বাদে বুঝতে পারে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। হয় আফসার আলী অথবা নিজের মাথায় বাড়ি দিতে পারলে হয়তো কিছুটা শান্ত হতে পারতো। পুরো দরবারের মাথা নিচু। মেম্বার চাচা চিৎকার করে ওঠেন, ‘আফসার আলী চুপ করো। লজ্জার মাথা খাইয়ালচ?’

এরা সকলেই জানে আফসার আলীর কথায় বিন্দু পরিমাণ সত্য নেই। তবু কারো মুখে রা নেই। দরবারের মাঝে কেউ কারো পক্ষ নিতেও পারবে না সপক্ষে যুক্তি দেখানো ছাড়া। ঈশানের একবার মনে হলো চিৎকার করে বলে, ‘শালা তর ভাবিরে এইখানে নিয়ে আয়। সবার সামনে কাপড় খুইলা দেখা কোথায় কে কামড় দিয়েছে।’

বাদীপক্ষে বড়কাকা উঠে নিজের সন্তান আর ভাতিজাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন, ‘যাকগে এর পরেও আমাদের ছেলেরা যদি না বুঝে কোনো ভুল করে থাকে আমি তাদের হয়ে ক্ষমা চাই।’

উফ! মনস্তাপ! কিন্তু মনস্তাপ কী আছে? না ততটা নয়, বরং একধরনের হিংস্রতা কাজ করছে মনে। প্রতিশোধ নিতে না পারার অক্ষমতার জন্যই হয়তোবা।

সভাপতি পাঁচজনের জুরি বোর্ড গঠন করে দিলেন। তারা দরবার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে শলা-পরামর্শ করতে থাকে। তাদের হাত-মুখ নাড়ার ভঙ্গি ঈশানের কাছে অশ্লীল মনে হয়। কীসের শাস্তি দেবে তারা? কোন অন্যায়ের জন্য? যে বিচারই করুক ঈশান মানে না। দেশে কী থানা-পুলিশ কোর্ট-কাচারি কিছু নেই?

কিন্তু না, উপায় নেই। গুমরে গুমরে হজম করতে হচ্ছে সমস্ত রাগ। ওই যে মুরুব্বিরা! ঈশানকে শর্তের বেড়াজালে আটকে ফেলেছে। ফুফা, কাকা, বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘তোমরা একটা কথাও বলবে না।’ আর মা তো মাথায় হাত দিয়ে মরা মুখের ভয়ও দেখিয়ে দিয়েছে। 

জুরি বোর্ডের সদস্যরা ফিরে এসেছে। তারা সভাপতি এবং অন্যদের সঙ্গে নিম্নস্বরে আলাপের পর সভাপতি রায় শোনানোর জন্য উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু ঈশান বিচারকের কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছে না। ওর ব্রেইন শূন্য হয়ে গেছে। ও এখন রাধানগরের কোনো উঠোন বৈঠক বা দরবারে নেই। ওর চারপাশে কোনো মানুষজন নেই। ঈশান এখন দণ্ডকারণ্য, মরিচঝাঁপি বা আন্দামানের কোনো এক ক্যাম্পের শরণার্থী। ওর কোনো দেশ নেই, বাড়িঘর কিচ্ছু নেই। ও যশোর মনিরামপুরের  কৃষ্ণমণ্ডল! যার বুকে  বাজছে কেবল ক্লারিয়েটের আর্তনাদ!