শ্রীরেখা মিত্রের চোখে জল। টিভিতে দেখছিলাম। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের প্রযোজিত সিনেমা সম্পর্কে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছিলেন, তখন শ্রীরেখা কথা বলতে গিয়ে একসময় কেঁদে ফেলেন। এ-মাটির টান তাঁকে কাঁদায়। একসময় বলতে থাকেন –

‘মাদারীপুরের জমিদার ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ। বিশাল বাড়ি, পুকুর, খামার। হাজার ঘর প্রজা। সব ফেলে দেশভাগের সময় আমার পিতামহ কলকাতায় চলে যান। মাদারীপুরের জমিদার, কলকাতায় গিয়ে হলেন পথের ফকির। তারপর অবশ্য আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি এবারই একবার মাদারীপুরে যাব। জানি সেসবের কোনো চিহ্ন হয়তো খুঁজে পাবো না। কিন্তু সেই মাটির ওপর গিয়ে দাঁড়াতে পারবো, পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পায়ের ধুলো মাথায় নিতে পারবো।’

আমি দেখছি আর ভাবছি। আমি কৃষকদের মেয়ে। একসময় কবিতা-টবিতা লিখতাম। আমার পিতামহ ছিলেন চারণকবি। তাঁর পিতার তরফ থেকে পাওয়া ভালো জায়গা-জমি ছিল। লোকজন আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলতো, ‘বড় গৃহস্থের মেয়ে। ওদের বাড়িতে বড় বড় ধানের গোলা। ওরা গুড় জ্বাল দেওয়া নৌকার মতো টিনের কড়াইয়ে ধান সেদ্ধ করে। ওর চাচারা

আশি^ন-কার্তিক মাসে ভূমিহীনদের ধান দাদন দেয়। দশ কাঠা নিলে এগারো কাঠা ফেরত দিতে হয়। দাদার মতো মানুষ হয় না। আলাভোলা। সবজির ভুঁইয়ে নাংলা পাচন নিয়ে বসে থাকে বটে কিন্তু গরিবের বউরা সে-পথ দিয়ে ঘাট থেকে ফেরার পথে দাদার কাছ থেকে ঝুড়ি ভরে আনাজ নিয়ে ফেরে। দাদি জানলে কারো রক্ষে নেই।

একবার মুলো, বেগুন আর পালং প্রায় ফুরোনোর দিকে। দাদা আর কাউকে কিছু দিচ্ছিল না। পাশের গ্রামের এক হতদরিদ্র বউ দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় কাঁচুমাঁচু। দাদা বলে –

‘কী সমাচার?’

‘ও দাদা, আমাক একটা মুইলু আর দুইটু বাগুন দিতিই হবে।’

‘কেন কেন? দেখছিস না ভুঁই প্রায় খালি।’

‘আমার মানুষির নাম আর তুমার নাম হইলু এক।’

‘তাতে কী?’

‘ওমা! তে এ এট্টা সুবাদ না?’

দাদা তাকে হাসতে হাসতে দুটো মুলো ধরে দিয়েছিল। দাদার হাতের নাংলা পাচন কোনো কাজে লাগতো না। কেবল ছাগল বেড়া ডিঙালে ওটা তুলে হেস্ হেস্ শব্দ করতো। তাছাড়া ওটা সারাবছরই গোলার চালে গোঁজা থাকতো।

আমাদের পরিবারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা লেখাপড়ায় ভালো ছিল। ছেলেরা বড়জোর ম্যাট্রিক পাশ, বেশিরভাগই ফেল। রাবণের গুষ্টি। আমিসহ আমার আরো দুই চাচাতো বোন ইন্টার পাশ। উচ্চশিক্ষিত চাকুরে ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। এই প্রথম আমাদের বড় গৃহস্থ পরিবারে ওপার থেকে এদেশে আসা ঘটির সঙ্গে সম্বন্ধ। আমার দাদি তো রাজিই না। এদেশীয় গৃহস্থ আর ঘটি তেলে-জলে না মেলার মতো। তো আমার বরের চেহারা দেখে গ্রামের মানুষ, আমাদের আত্মীয়স্বজন তাজ্জব। যেন বামুনদের ছেলে। যেমন গায়ের টকটকে রং, তেমনি চোখা নাক, একমাথা চুল। ফিরানিতে আমার নচ্ছার ফুপাতো ভাই বাড়ির গেটের সামনে দুটো কলাগাছ পুঁতে তার মাথায় দুটো ঘটি বসিয়ে রাখলো। ভাগ্যিস যে আমার বর কিছু বোঝেনি।

আমার বাবার দেওয়া একগাদা

গা-ঝমঝম গয়না পরে শ^শুরবাড়ি গেলাম। শাশুড়ি খুব খুশি। পাড়ার লোকজনকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলেন। মানুষজন একটু পাতলা হলে শাশুড়ি আমার হাতটা ধরে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলেন।

‘শোনো মা, তোমাকে আমার বিয়ের গল্প বলি। আমার বয়স যখন এগারো বছর তখন নবদ্বীপের রিটায়ার্ড গনি মাস্টারের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তখন তোমার শ^শুরের বয়স তেইশ বছর। তিনি আমাদের কৃষ্ণনগরের প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করতেন। সত্যি বলতে কী আমার দাদা-বাবারা জমিদার হলেও হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকলেও তারা তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। স্কুলমাস্টার শাওয়াল মিয়াকে সবার পছন্দ। একেবারে শাওয়ালের চাঁদ। আমাদের ফুপুদের বিয়ে হয়েছিল দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে। সেই সময় দাড়িপাল্লায় একদিকে কনেকে বসিয়ে আর একদিকে সোনার গয়না রেখে সমান সমান ওজন করা হতো। গয়না বরপক্ষ দিত। কিন্তু তোমার শ^শুর, দাদাশ^শুর গরিব মাস্টার। শুধু সোনার নাকফুল দিয়ে বিয়ে করলেন। আমার জমিদার বাবা শিক্ষিত ছেলে পেয়ে ইয়া বড় রুপোর রেকাবিতে ছোটখাটো টিলার সমান উঁচু করে গয়না নিয়ে এলেন। কলকাতা থেকে বাবুর্চি এনে খানা পাকানো হলো। ষোলো বেহারার পালকিতে করে আমার বাবা আমাকে শ^শুরবাড়ি পাঠালেন।’ বলে হঠাৎ করেই থেমে গেলেন আমার শাশুড়ি। কারণ তখন বাড়িতে প্রবেশের টিনের দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ শুনে বুঝলেন তাঁর ছেলে ফিরছেন।

‘নতুন বউ রেখে এত রাতে কেউ ফেরে? তোর স্বভাব কবে বদলাবে খোকা?’

‘তা কী গল্প করছিলে বউয়ের সঙ্গে মা?’

‘কী আর! তোমার গরিব বাবার কথা বলছিলাম।’

‘আমার বাবা গরিব ছিল কিন্তু তোমার বাবা তো জমিদার।’

‘সে এককালে ছিল বটে। এখন থাকার মধ্যে বড় দহলিজে ঝুলানো তোমার নানার তলোয়ারটাই আছে।’

  আমার শ^শুর নাকি ছিলেন সাদামাটা অনুচ্চাকাক্সক্ষী মানুষ। সাতচল্লিশে বিনিময়ের ধারাবাহিকতায় তিনি এদেশে এসে যে জমিটুকু পেয়েছিলেন তা তাঁর একমাত্র ও জ্যেষ্ঠ কন্যার বিয়ে দিতেই বিক্রি করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত থাকার মধ্যে ভিটেবাড়িটা আর পেনশন। ছেলেদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। স্কুলে পড়াবে, নয় পুলিশে যাবে – এর বেশি আর কী? কিন্তু আমার জাঁদরেল শাশুড়ি বললেন, ‘এদেশে টিকে থাকতে গেলে সেরার সেরা হতে হবে। কেউ যেন ঘটি বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে।’

আমার বড়ভাশুর চিকিৎসক, মেজটি আমার বর প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, ছোটটি প্রকৌশলী। একজন   অভিবাসী মায়ের স্বপ্নের চেয়েও অধিক বাস্তবায়ন। এরকম এক মহা গর্বিত শাশুড়িকে একদিন বললাম –

‘মা, আপনার মেজো বেটা ভারতে অফিসিয়াল ট্যুরে যাবে। আমিও সঙ্গে যাব। আমার খুব ইচ্ছে আপনাদের জমিদারির ভগ্নাংশটুকু দেখে আসার। আর সেই তলোয়ারটা।’

‘আমার হাভাতে ভাইপোরা কি কিছু অবশিষ্ট রেখেছে? সব পরহেতো হয়ে গেছে। তবে যদ্দুর শুনেছি, তলোয়ারটায় হাত দেয়নি।’

‘আর সেই ষোলো বেহারার পালকিটা? ওটাতে বসে আমি একটা ছবি তুলবো।’

‘আ মোলো যা! ওটা কি আর আস্ত আছে? ভাইয়ের বেটাকে বলেছিলুম ঘোড়ার জিন একটা রেখে দিতে। কে জানে কোন উচ্ছনে গেছে।’

‘হাতি-ঘোড়া দু-একটা আছে মা?’

শাশুড়ি সন্দেহের চোখে তাকালেন। ঠাহর করার চেষ্টা করলেন, আমি মশকরা করছি কি না। আমার ধারণা, হাতি না হোক, ঘোড়া দু-চারটে থাকতেই পারে। আমাকে হয়তো ঘোড়ার টমটমে করে জমিদারবাড়িতে নিয়ে তুলবে। জমিদারের প্রথম নাতবউয়ের বাড়িতে আসা বলে কথা! আমার ভাশুর তাঁর বউকে নিয়ে এখনো আসেননি। দুজনেই চিকিৎসক। সময় মেলাতে পারেন না। জা কানে কানে বলে দিলো, ‘নানাশ^শুরের জমিদারি থেকে দু-একটা হিরে-মাণিক আমার জন্যও নিয়ে আসিস।’ 

না-দেখা বাড়ি, মানুষ, পরিবেশ নিয়ে আমার ভাবনা চিত্রকল্প তৈরি করতে থাকে। আমার প্রাণের বন্ধুর বাড়ি পাঁচবিবি। ও যখন পাঁচবিবির গল্প করতো আর বলতো, ‘আব্বাকে বলতাম আমি স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবো। আপনার কষ্ট করে আসার দরকার নেই। না, সেই ধুলো-ওড়া স্টেশনে দুই ঘণ্টা আগে গিয়ে বসে থাকতেন। এতো ধুলো, এতো ধুলো যে, ট্রেন চলে গেলে প্ল্যাটফরমের ভাঙা বেঞ্চিতে বসা কালো চুলের আব্বাকে আমার বুড়ো মনে হতো। চুল-গোঁফ ধুলোয় সাদা।’ আমার তখন চোখে ভাসতো ধুলোভরা মাঠের মধ্যে একটিমাত্র বেঞ্চ। স্টেশন ধুধু মরুভূমি। বন্ধুর বাবা যেন লিও তলস্তয়। এটা মনে হওয়ারও কারণ ছিল। তলস্তয়ের একটা গল্পের অলংকরণে ওরকম স্টেশনের একটা ছবি ছিল। আর মনে হতো, পাঁচজন সাঁওতাল নারী পাঁচটি কলস কাঁখে কোমর বেঁকিয়ে ওদের বাজারে ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে থাকে। যেহেতু পাঁচবিবি। বন্ধুর বিয়েতে পাঁচবিবি নামার পর আমার চিত্রকল্প ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়লো জনবহুল রেলস্টেশনের হেরিংবোনের ইটের ফাঁকে।

তেমনি ছোটখালার শ^শুরবাড়ি, আমবাগানে মেজচাচার টিনের দোতলা, আমার না-দেখা গার্লস স্কুলের টেডি খোঁপার হেড মিসট্রেস দেখার পর ভাবনার চিত্রকল্প একেবারে ভোঁজবাজির  মতো বিলীন হয়ে গেল। কিছুতেই আমার ভাবনার হেড আপাকে আর কোনোদিন স্বপ্নেও পেলাম না। আবার কোনো কোনো চিত্রকল্পের বাস্তবতা ভাবনার চেয়েও ভালোলাগা নিয়ে হাজির হতো। এগুলি আসলে লিখে রাখা উচিত ছিল।

তো সাড়ে তিন বছর ধরে শাশুড়ির জমিদারির গল্প শুনতে শুনতে আমার মাথায় যে-ছবি ঘুরতো তা কিন্তু আমার খুব ছোটবেলায় হঠাৎ-দেখা এক রাজপ্রাসাদ। তখন ওটাকেই রাজপ্রাসাদ মনে হয়েছিল। আমার ছোটমামা প্রেম করে একা একা বিয়ে করলে আমার নানা-নানি সে-বিয়ে মেনে নেননি। তখনকার দিনে প্রেম করা ছিল পাপ। প্রেমের বিয়ে ছিল জাহান্নাম; কিন্তু আমার আধুনিক আব্বা বললেন -‘চল ঘ্যানা, আমি তোর বউকে বরণ করে আনি।’    

আমার নানির খুব পছন্দের জামাই ছিল আমার বাবা। বাবা জানতেন, একমাত্র তিনিই এ-অভিমানের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেন। তো সেই ছোটমামিকে নিয়ে ফেরার পথে আমরা একটা টং দোকানে বসে চা-বিস্কুট খেয়েছিলাম প্রায় সন্ধে হওয়ার মুখে। বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি নারকেল গাছের আড়াল থেকে একটা লাল দোতলা বাড়ির দিকে চেয়েছিলাম। ঠাকুরমার ঝুলিতে ঠিক ওরকম সাদাকালো নকশাকাটা রেলিংয়ের ছবি ছিল। অবাক হয়েছিলাম বই থেকে উঠে ও দালানটা ওখানে গজালো কী করে? জিজ্ঞাসা করলে ঘ্যানা মামা বলেছিলেন, ওটা নাকি নতুন মামির দাদার বড় ভাইয়ের। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একবার যদি ‘প্রস্রাব চেপেছে’ বলে বাড়িটাতে ঘুরে আসা যেত। তা হয়নি। আবার মনে হতো, ওখানে কোনো দোতলা লাল দালান আদৌ ছিল না। হয়তো আমার কল্পনা। হয়তো সন্ধ্যায় নারকেলগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্যের আলো আকাশের গায়ে থরে থরে জেগে ওঠা প্রাসাদের মতো মনে হয়েছিল। ঘ্যানা মামা হয়তো কিছু বলেছিল কিংবা বলেনি। কিন্তু বাড়িটা আমার মাথার মধ্যে ছিলই। আমার শাশুড়ির জমিদারবাড়ির গল্পে সেই বাড়িটা নতুন করে কল্পনায় ছায়া ফেলেছিল। মনে হতো, বাড়িটা ওরকম কিন্তু এখন বেশ ভগ্নপ্রায়। রংচটা, রেলিং ভাঙা, জানালার খসে পড়া খড়খড়িতে চড়ুইয়ের বাসা। 

গ্রামের রাস্তায় প্রচুর ধুলো উড়িয়ে রেন্ট করা জিপে চড়ে আমরা শেখপাড়ায় প্রবেশ করলাম। একটা টিনের চালের দোতলা মাটির বাড়ির সামনে আমাদের গাড়িটা বারদুয়েক এদিক-ওদিক করলো। ভাবলাম, বাঁয়ের সরু পথ দিয়ে ঢোকার জন্য ড্রাইভার কসরত করছে। আমি জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে প্রাসাদের চূড়া খুঁজছিলাম। ওরই মধ্যে গাড়ি ঘিরে আবালবৃদ্ধবনিতার কোলাহল। গাড়ির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঘোমটা টানা রঙিন শাড়ি পরা এক প্রবীণা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ধরেই কাঁদতে শুরু করলেন।

‘টিমটিম করে এখনো জ্বলছে। ওই যে দাওয়ায় বসে আছেন। চোখেও ভালো দেখেন না। আল্লাহ জানেন এই দেখাই শেষ দেখা কি না।’

বলছিলেন আমার মামিশাশুড়ি। যাঁর কথা বললেন তিনি মামাশ^শুর। আমরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। তিনি আমাদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন,‘জানুকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। দেখবো যে সে-শক্তিও তো শেষ হয়ে আসছে। কতদিন জানুর হাতের পোস্তর হালুয়া খাইনি।’

জাহানারা আমার শাশুড়ি। ডাকনাম জানু। মাটির দোতলা থেকে নেমে এলেন মামাতো ভাই। আমার বরকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার বর তাঁর বুক বরাবর। স্বপ্নের ঠাকুরমার ঝুলি থেকে প্রাসাদ মুছে যেতে লাগলো গোধূলির আলো মøান হয়ে যাওয়ার মতো। তবে মামাশ^শুর এবং তাঁর ছেলে বেশ রাজপুরুষোচিত দৈহিক গড়ন নিয়ে উদয় হলেন বলে তা প্রাসাদের লুপ্তপ্রায় চিত্রকল্পের বেদনার শরীরে কোমল হাত বুলিয়ে দিলো। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার ব্যবস্থা। মিনিমাম দস্তরখানা জাতীয় কিছু পাতলেও জমিদারির ছিটেফোঁটা ভাব আসতো। না পোলাও, না খিচুড়ি, জাফরানের রং দেওয়া ভাত, মুরগি, বেগুন-বড়ির তরকারি, এক বাটি দেশি মুরগির সিদ্ধ ডিম, আনদাসা, পোস্তর হালুয়া। মামাতো ভাইয়ের বউ ভারি যত্ন করে খাওয়ালো। খেতে খেতে মামাতো ভাই আমার উদ্দেশে বললো, ‘ভাদ্রবউকে গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। গ্রামটা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমার ফুপুআম্মার যে-গ্রামে বিয়ে হয়েছিল সেটার পুরোটাই মুসলমান অধ্যুষিত। ফুপাজি আর তাঁর ভাইয়েরা ভেবেছিলেন দেশভাগের পর তাঁরা বিতাড়িত হতে পারেন, তাই ওপার বাংলায় চলে গেলেন।’ 

আমার মাথায় সেই তলোয়ার বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে। এমনকি ঘোড়ার জিনও। আর কিছুই তো দৃষ্টিগোচর হলো না। শাশুড়ির বর্ণনায় আমার কল্পনার প্রাসাদ মাথা থেকে মোটামুটি উধাও। যেভাবে মনে মনে সাজিয়েছিলাম তা আর কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না – প্রাসাদের কোনদিকে আস্তাবল, কোনদিকে আদালত, কোনদিকে প্রজারা ধানের বস্তা কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো। আঙিনায় একটা গাইগরু বাছুরের গলা ঘাড় চেটে আদর করছিল। পায়ের নিচে গোবর আর কাদায় একাকার। পাশের গ্রামের শ^শুরবাড়ি থেকে মামাতো ননদ এলেন। অবিকল আমার শাশুড়ির চেহারা। আমার বরের হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন। বর মহাশয় একবার আমার দিকে লাজুক চোখে তাকালো, একবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। এই মামাতো বোনটার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল। আমি খুব মজা পেলাম। এপার বাংলায় নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের খুব চল। মামাতো-ফুপাতো-খালাতো-চাচাতো ভাইবোনে দিব্যি বিয়ে হয়। বোনটা এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেও কাঁদলো, যাতে কান্নাটা কোন দুঃখে তা যেন আমি না বুঝি। মামার আরো দুই ছেলে আছেন; তাঁরা দুজনেই পুলিশ। একজন কাশ্মির সীমান্তে, একজন দিল্লিতে। দিল্লির ভাইটার বউ তখন তার বাপের বাড়িতে। আমাদের দেশে যেমন ছোট চাকুরেরাও চাকুরিস্থলে বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করে, এখানে তা নয়। বউরা শ^শুর-শাশুড়ির সেবা করবে, বাচ্চা মানুষ করবে। স্বামী বছরে দু-তিনবার আসবে।

যে-মামাতো ভাইটা কাশ্মির সীমান্তের পুলিশ, তার বউ বাচ্চা কোলে করে এসে আমার গা-ঘেঁষে দাঁড়ালো। ভারি মিষ্টি দেখতে বউটা। চোখেমুখে শিক্ষার আলো। চোয়ালে একটু কাঠিন্য আঁকা। এই বউটিকে সবাই ‘ফুলপুরের বউ’ বলে ডাকছিল। এ-বাড়ির প্রথম প্রেমের বিয়ে বলেই নাকি কে জানে বউটার প্রতি কেউই খুব আন্তরিক নয়। সে আমাকে হাত ধরে মাটির দোতলায় নিয়ে গেল। উঠতে গিয়ে সিঁড়িঘরের নিচু ছাদে মাথা ঠুকে গেল। বউটা বললো – ‘আপনার মতো লম্বা মানুষদের জন্য এসব দোতলা উপযোগী নয়। এর মেঝেতেও আপনাকে ঘাড় নিচু করে হাঁটতে হবে। দোতলা কেবল শোবার জন্য।’ মেঝেতে ছড়ানো বিছানা পাতা। কোনো দেয়াল নেই। বাঁশের রেলিংয়ে একটা পুরনো রংচটা লাল রঙের জরির ফিতে মোড়ানো কাপড় ঝুলছিল। ওটা নির্ঘাত সেই ঘোড়ার জিন। এতো অবহেলায় লটকে আছে রেলিংয়ে? আমি ছুটে গিয়ে ওটা ধরতে গেলে বউটা হা-হা করে উঠলো -‘ধরেন না, ধরেন না, ওটা দিয়ে বাবুর পোটা পুছি। বড়ভাশুরের মেয়ের বিয়েতে ডালা এসেছিল। ওটা ডালার ঢাকনি। কবে থেকে ওখানে ঝুলে আছে!’ 

তাহলে যে বড় দহলিজের গল্প করেন শাশুড়ি নিশ্চয় সেই দালানেই ঘোড়ার জিন আর তলোয়ারের দেখা মিলবে। বউটাকে বলতেই সে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো -‘বাড়ির বউদের দহলিজে ঢোকা বারণ। বাইরে থেকে দেখিয়ে আনতে পারি। তুমি ওপার থেকে এসেছ, বরকে নিয়ে একবার ঢুকে পড়ো। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না।’

বড় দহলিজও কোনো দালান নয়। বড় টিনের চারচালা। সামনের আঙিনাটা পাকা, পাশেই একটা টিউবওয়েল। পাকা জায়গাটিও সাম্প্রতিক মনে হলো।

‘এর ভেতরেই সেই তলোয়ারটা আছে, না? আমার নানাশ^শুরের বনেদি ঐতিহ্য।’

‘হ্যাঁ, দেয়ালে ঝোলানো আছে।’

‘জিনও আছে?’

‘জিন-ভূত থাকতেই পারে। যে-তলোয়ার দিয়ে মানুষ জবাই করা হয়েছে সে-তলোয়ারের আশপাশে অশরীরী আত্মাদের যাওয়া-আসা বিচিত্র নয়।’

‘মানে?’

‘কেন আপনার শাশুড়ি বলেননি

সে-গল্প? আমাদের এই গ্রামে

হিন্দু-মুসলমান সমান সমান ছিল। খুব সম্প্রীতির গ্রাম ছিল সে-সময়। তো আটচল্লিশের দাঙ্গায় পাশের মুসলমানপ্রধান গ্রাম ফুলপুর থেকে ইউনুস কসাই আমাদের গ্রামে ঢুকে হামলা শুরু করে ওই তলোয়ার দিয়ে। আমার শ^শুরকে যা দেখলেন তার ডবল ছিল আপনার নানাশ^শুর। যেমন বলবান তেমনি সাহসী। তিনি হিন্দুপাড়ার মানুষের কান্নার রোল, মাতম, হাহাকার, ছোটাছুটি সহ্য করতে না পেরে দা হাতে ছুটে যান ইউনুস কসাইয়ের সামনে। রক্তাক্ত তলোয়ার নিয়ে কসাই তখন হুঙ্কার দিয়ে দাদাজানের দোস্তের বাড়িতে ঢুকছিল। দাদাজানকে দেখে কসাই খানিক থমকে যায়। ভাবলো, দাদাজান তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই অমন করে ছুটে আসছে। দুটিতে মিলে আরো কচুকাটা করবে। কিন্তু দাদাজান মুহূর্তে ইউনুসের হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে এক কোপে কসাইয়ের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেন। ইউনুসের দু-তিনজন সাথিরও একই পরিণতি হয়। দাঙ্গা থেমে যায়।

‘এই শেখ বাড়িতে আগে বাইরে থেকে কোনো বিয়ের সম্বন্ধ আসতো না। মানুষজন খুব ভয় পেত। আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হতো। অনেকে বলে, দহলিজে যে-তলোয়ারটা আছে সেটা ইউনুস কসাইয়েরটাই। অনেকে আবার বলে, ওটা তলোয়ারের খাপ। ভেতরটা ফাঁকা। কেউ ওটাতে হাত দেওয়ার সাহস পায় না। দাদাজান নাকি তাঁর রামদা দিয়েই কেল্লা ফতে করেছিলেন।’