ও মানুষ, ও অসুর

লোকটির নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু …।

আমরা আসলে জানি না – লোকটির নাম প্রকৃতপক্ষেই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু – নাকি অন্যকিছু। অন্যকিছু হওয়াই স্বাভাবিক। লোকটির নাম নিয়ে কথা উঠলেই আমাদের মধ্যে, এটা অবধারিত – তর্ক বেঁধে যাবে। আমি হয়তো বললাম, হতে পারে – কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু লোকটির নাম। সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক মৌমাছি আমাকে আক্রমণ করে বসবে। তাই কখনো হয়, নাকি হতে পারে? তিন ধর্মের তিন মহাপুরুষের নাম একত্রে ধারণ করা, বহন করা কখনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি একটি অসম্ভবপর, উদ্ভট, গাঁজাখুরি গল্প হয়ে যাবে। লোকটি সাধু-প্রকৃতির মানুষ, এখানে যতদিন ধরে আছে, আমরা দেখছি তাকে, সারাক্ষণ জপতপ নিয়ে ব্যস্ত। তাই বলে সে একই সঙ্গে কৃষ্ণ কি মুহাম্মদ কিংবা যিশু হতে পারে না …।

তাহলে নাম কী লোকটির? এই প্রশ্ন ওঠে। যদু, মধু, রাম, রহিম; মানুষ যখন, প্রত্যেক মানুষেরই নাম থাকে, আছে; তারও নিশ্চয়ই থাকতে হবে। পৃথিবীতে নামবিহীন মানুষ নাই। মুশকিল যা, লোকটি নিজের নাম বলে না। কেউ জিজ্ঞেস করুক – সাধুবাবা, তোমার নামটি কী, বলো না, জানতে বড়ো ইচ্ছে করে; লোকটি মুচকি হেসে জবাব দেবে – ‘নামে কী এসে-যায়, বাবা? আমি মানুষ। তোমাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ।’ এই, এতদিনে, মানুষ তো তার সান্নিধ্যে – এখন কম আসে না; সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা নাই – মানুষ আসে; পুরুষ-মানুষ আসে, নারীরাও আসে; হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব, জাতকুলের প্রভেদ নাই, সবাই আসে; এলাকায় তার কিছু নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত-অনুরাগীর সৃজন ঘটেছে, তারা রাতে লোকটির আস্তানার সমুখের দূর্বাঘাস-আচ্ছাদিত খোলা মাঠে তাকে ঘিরে বসে; লোকটি কখনো কথা বলে, কখনো দোতারা বাজিয়ে গান গায়, তখনো আসে প্রচুর উৎসুক মানুষ; এই যে মানুষ আসে, তার নাম জানতে চেয়ে সবাই একই উত্তর পেয়েছে – নামে কী এসে-যায় বাবা, কিংবা নাম দিয়ে কী হবে, মা; আমরা মানুষ, এরচেয়ে বড়ো আর কী আছে, দুনিয়ায় …?

লোকটির কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু নামটি আসলে মানুষের মুখে মুখে, কেউ কেউ তো বলে পাখির মুখে ছড়িয়ে পড়েছে …।

বাবা, তোমার নাম কি তাহলে সত্যি-সত্যিই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু – কেউ জিজ্ঞেস করুক, লোকটি মৃদু হেসে, তার ঠোঁটে তো সারাক্ষণই ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ির মতো একটুকরো হাসি লেগেই থাকে, এমনভঙ্গিতে মাথা দোলাবে, এই মাথা দোলানোর কী যে অর্থ, হ্যাঁ নাকি না, তা কারো বোঝার সাধ্য নাই …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর আস্তানা গাঁয়ের দক্ষিণপাশ দিয়ে চিতাবাঘের মতো দ্রুতবেগে ছুটে-চলা শালুক নদী ঘেঁষে, যেখানে একটি ঝুল-ছড়ানো প্রবীণ বটবৃক্ষ বহুকাল ধরে তার গৌরব বিস্তার করে বসবাস করছে, সেই বটবৃক্ষের নিচে। বৃক্ষটির অর্ধেক ছায়া পড়ে নদীতে, অর্ধেক ডাঙায়; শালুকের পেটে ভীষণ ক্ষুধা, আষাঢ়-শ্রাবণে এই ক্ষুধা আরো চার-পাঁচগুণ বাড়ে, ডাঙার মাটি খেতে খেতে বটবৃক্ষটির গোড়ার আধেক মাটিও সে খেয়ে ফেলেছে। বৃক্ষটিকে এখনো খেতে পারেনি। কিন্তু খেতে কতক্ষণ? গাঁয়ের মানুষ বটবৃক্ষটিকে নিজের মা-বাবার মতোই ভালোবাসে। সে-যে মায়ের আঁচলের মতো, বাবার গামছার মতো শীতল ছায়া বিতরণ করে! শালুক নদী বৃক্ষটিকে খেয়ে ফেললে এই শরীরজুড়ানো-মনজুড়ানো ছায়া তারা কোথায় পাবে? কত দূরে ছিল শালুক? চকের মাটি খেতে খেতে এখন বটগাছের নিচে এসে পড়েছে! খাচ্ছে গাছের গোড়ার মাটি। দু-বছর আগে, শ্রাবণের এক ভোরে; রাতভর ঝুম বৃষ্টি ছিল, শালুকের উন্মত্ত গোঙানি, গাঁয়ের মানুষ উদ্বিগ্ন – আজ বুঝি কিছু একটা হয়ে যাবে, বটবৃক্ষটি চলে যাবে শালুকের পেটে; মুন্সি আবদুল আজিজ মসজিদে জলপির খোয়াজ-খিজিরের বন্দনায় জায়নামাজে নত, শালুক যেন তার রাক্ষুসীরূপ প্রকাশ না-করে; বটবৃক্ষটিকে খেয়ে না-ফেলে; পুরোহিত অবনি চ্যাটার্জি মন্দিরে সারারাত জপতপ করে – মা শালুক, বটবৃক্ষটি, তুমি জানোই, আমাদের ছায়াদান করে, পাখিদের খাদ্যদান করে, বৃক্ষটিকে তুমি খেয়ে ফেলো না। সেই ভোরে মুন্সি আবদুল আজিজ ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে, পুরোহিত অবনি চ্যাটার্জি প্রাতঃপূজা করে মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়ে, গন্তব্য বটতলা, বৃক্ষটি টিকে আছে কি নেই, দুজনেই উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত; তখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ছিল, বটপাতা চুয়ে ঝরছিল ফোঁটা ফোঁটা পানি; মুন্সি-পুরোহিত দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ! গাছের গুঁড়িতে বসে আছে সাদা ধুতি, ঘিয়ে-রঙের হাফহাতা গেঞ্জি পরিচিত দীর্ঘাঙ্গী সুদর্শন এক যুবক। হাতের দোতারায় মৃদুলয়ে টুংটাং তাল তুলে গুনগুন করে গাইছে – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় …।’ যুবকটি এখানে কখন এলো? সারারাত ঝুমবৃষ্টি, এখনো ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে, কিন্তু যুবকের পরনের ধুতি-গেঞ্জি, মাথার চুল – সবই তো শুকনো …!

ভাই, আপনার নাম কী? বাড়ি

কোথায়? কখন এসেছেন এখানে …?

দাদা, কী নাম আপনার? কোত্থেকে এসেছেন …?

যুবক একবার তাদের দিকে মুখ তুলে তাকালো মাত্র। একপলক। কিন্তু

কোনো কথা বললো না। সাঁইজির গীতে বিভোর সে –

ধরতে পারলে মনোবেড়ি

দিতাম পাখির পায়…।

ভাই, কথা বলছেন না কেন? কী আপনার পরিচয়? এই ভোরবেলা গাছের গুঁড়িতে বসে আছেন, সারারাত বৃষ্টি পড়েছে, এখনো, অল্পস্বল্প হয়তো, কিন্তু পড়ছে, অথচ আপনার গা-গতর একদম শুকনো। আল্লাহর কোনো কুদরত কী …।

দাদা, জাত-সম্প্রদায়ই বা কী আপনার? দেখে তো মনে হচ্ছে ব্রাহ্মণসন্তান …।

জাত! পুরোহিতের কথা শুনে যুবকের গীতবন্দনা বন্ধ হয়ে গেল। নদীয়ায় যাও – জাত, রাঢ়ে যাও – জাত; উজানে-ভাটিতে যেখানেই যাও – সবখানেই জাত! জাত বিনে যেন মানুষ হয় না। সাঁইজি সেই কবে বলে গেছেন – যুবকের কণ্ঠে আবার গুনগুন –

যখন তুমি ভবে এলে

তখন তুমি কী জাত ছিলে

যাবার বেলায় …

… লালন বলে জাত কারে কয়

এই ভ্রম তো গেল না …।

এখন আর বৃষ্টি নাই। শালুক নদীর ওপার থেকে গোল কাঁসার থালার মধ্যে রক্তজবার মতো লালসূর্যটা ঘোমটা খুলে বেরিয়ে আসছে। পায়ে-হাঁটা পথের বৃষ্টিসিক্ত কাদামাটি, পথের দুপাশের দূর্বাঘাস, কোথাও কোথাও দুধকমল গাছের ডগা – সবকিছুই লালচে, ঈষৎ রঙিন; বৃষ্টির পর পথঘাট যেন এই ভোরসকালে চোখজুড়ানো  সাজে সেজেছে। অন্যদিন হলে মুন্সি আবদুল আজিজ কিংবা পুরোহিত অবনি চাটুজ্যে একাকী কিংবা দুজনে একত্রে ভোরসকালে পথে বেরুলে, পথের এই শোভা ও সৌন্দর্য তারা দুজনেই উপভোগ করতো; মাঝে-মধ্যেই তারা দুজনে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দুই সাধক ভোরের নামাজ ও পূজা শেষ করে পথে পথে একসঙ্গে হাঁটে; নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের গল্প করে। আজ দুজনেই দ্রুত গাঁয়ের পথে হাঁটছে, পথের শোভা-সৌন্দর্য দেখার সময় হাতে নাই; যতটা দ্রুত সম্ভব, গাঁয়ে পৌঁছে খবরটা দিতে হবে – বটতলায় এক অদ্ভুত মানুষ এসেছে; পির-মুর্শিদ কি সাধুসন্ত হবে হয়তো, বৃষ্টির পানিতে কি জলে তার শরীর ভেজে না, পরনের কাপড়-চোপড় ভেজে না …।

মুন্সি ও পুরোহিত দ্রুতপায়ে হাঁটছে বটে, কিন্তু হাঁটতে-হাঁটতেই কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কী অদ্ভুত ব্যাপার! ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। লোকটি এই যুবক বয়সেই, দ্যাখো, কী-রকম আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেছে! সারারাত প্রবল বর্ষণ, তখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, অথচ তার চুল-মাথা, পরনের ধুতি-গেঞ্জি কিছুই ভেজেনি। একটা কথা পর্যন্ত বললো না তাদের সঙ্গে। গুনগুন করে লালন সাঁইজির গীতবন্দনা করলো শুধু। দুজনের মনেই নানা প্রশ্নের কলরব …।

লোকটি হিন্দু-বামুনই হবে, আজিজ ভাই …।

কীভাবে বুঝলেন, অবনিদা …।

ধুতি-গেঞ্জি পরেছে। মুখে দাড়ি নাই …।

তোমায় মাথায় টিকি আর গোবর ছাড়া আর কিছু নাই অবনিদা …।

কেন? কেন তা বলছ আজিজভাই …?

ধুতি-পাঞ্জাবি পরলেই সে লোকটি হিন্দু হয়ে যায়? হয় না। আগের দিনে মুসলমানরাও ধুতি-গেঞ্জি পরতো। আমার দাদাও ধুতি পরতো – নিজের চোখে দেখেছি। … আর দাড়ি দিয়েও হিন্দু-মুসলমান নির্ণয় করা যাবে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখেছ তো? তাঁর মুখে আমার দাড়ির চেয়েও বড়ো বড়ো দাড়ি ছিল। তাই বলে, কী বলো অবনিদা, তিনি কি মুসলমান ছিলেন …?

মুন্সি আবদুল আজিজের ব্যাখ্যা শুনে পুরোহিতের কথা এবং হাঁটা – দুই-ই বন্ধ হয়ে গেল। থমকে দাঁড়ালো সে। তাই তো! মুন্সি প্রকৃত সত্যকথাই বলেছে। পোশাক-পরিচ্ছদ, দাড়ি-গোঁফ দেখে মানুষের জাত-সম্প্রদায় বিচার করা যাবে না। পুরোহিত এমনটাই ভাবছিল, কিন্তু তার মনের ভেতরের খচখচানিটা ছিলই …।

তাহলে লোকটি কি মুসলমান, আজিজ ভাই … ?

হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। জন্মসূত্রে হিন্দু-মুসলমান এমনকি

বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানও হতে পারে। তবে লোকটি যে লালন সাঁইজির ভাবশিষ্য, ভক্ত-অনুরাগী তা বলতে পারি। সাঁইজি জাতপাতের প্রভেদে বিশ^াস করতেন না। তাঁর কাছে মুচি-মেথর-ডোম, চাড়াল-চণ্ডাল, মোল্লা-মৌলবি-ব্রাহ্মণ, ধনী-গরিব – সব মানুষই ছিল সমান। তিনি বিশ^াস করতেন – ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’ পরম সত্যকে পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সাঁইজির একটা গীত আছে –

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি …

এই মানুষ ছাড়া মনরে আমার

পড়বি রে তুই শূন্যকার …।

এই যুবকও যে জাতধর্ম মানে না তা বুঝতে পেরেছি …।

লোকটি যে লালনের

ভক্ত-অনুরক্ত-অনুগামী – কীভাবে বুঝলে … ?

তুমি তার জাত-সম্প্রদায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে, তখনই সে সাঁইজির গীত গুনগুন করলো –

যখন তুমি ভবে এলে

তখন তুমি কী জাত ছিলে

… লালন বলে জাত কারে কয় …।

জাত-সম্প্রদায়ের প্রশ্ন উঠতেই তার মুখে লালনের এই বোল, তারপরও কি বোঝার বাকি থাকে, সে কী জাতের মানুষ …।

আজিজভাই, আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি একটা কাঠমোল্লা, এখন দেখছি …।

ধুরু, কথা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি পা চালাও, খবরটা আগে গাঁয়ের লোকদের জানাই …।

বটতলায় একজন অদ্ভুত রহস্যময় মানুষ এসেছে, বৃষ্টিতে যার শরীর ভেজে না, শরীরের পোশাক ভেজে না – খবরটি গাঁয়ের লোকদের জানাতে হবে, মুন্সি ও পুরোহিত দ্রুত হাঁটছে; কিন্তু তারা

গাঁয়ে-ঘরে পৌঁছার আগেই খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দলে দলে ছুটে আসছে লোকজন। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ; চৌধুরীবাড়ির মানুষ, ঠাকুরবাড়ির মানুষ, ডোম-বাগদিপাড়ার মানুষ, মুচি-মেথরবাড়ির মানুষ – পথে মুন্সি আবদুল আজিজ ও পুরোহিত অবনি চাটুজ্যের সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে গেল। মুন্সি ও পুরোহিত হতভম্ব। তারা দুজন ব্যতিরেকে আর কেউ তো এই লোকটির খবর জানে না। জানার কথাও না। কে তবে গাঁয়ে খবর দিলো? বটবৃক্ষের পাখিরা লোকটির খবর রাষ্ট্র করেনি তো …?

বটবৃক্ষের বাসিন্দা পক্ষীকুলই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর আগমনের খবর রাষ্ট্র করেছে …।

অজস্র পাখপাখালি প্রবীণ এই বৃক্ষে সংসার পেতেছে। হরিয়াল, তিতির, বনমোরগ, সরালী, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, সুইচোরা, কোকিল, ঘুঘু, সারস, কোড়া, গাঙচিল, বাজ, চিল, ঈগল, পানকৌড়ি, মানিকজোড়, শামুকখোল, হাড়গিলা, মদনটাক, নীলপরি, হরবোলা, কাক, কাকতাড়ুয়া, হাঁড়িচাচা, বেনেবউ, ফিঙে, ময়না, শালিক, বুলবুল – আরো নাম-না-জানা কত যে ফল-পতঙ্গ-মৎস্যভুক পাখি! হরিয়ালদের সংসার সবচেয়ে বড়ো। ফলভুক পাখিরা তাদের এই বৃক্ষ-আবাস ছেড়ে অন্যত্র বিচরণ করে কদাচিৎ। ফলের মৌসুমে বৃক্ষটিতে এত ফল ধরে যে, তাদের খাদ্যের সন্ধানে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তারা সারাদিন খায়, গল্পগুজব করে, রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়; রাত কাটায় ঘুমিয়ে। বটফলের অমৌসুমে তারা ভোরবেলা বেরিয়ে দূর-দূরান্তে খাদ্য খোঁজে। দিনশেষে ফিরে আসে নিজেদের নীড়ে। … আর পতঙ্গ ও মৎস্যভুক পাখিরা ঊষালগ্নেই বেরিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দল উদরপূর্ণ করে দুপুরের পরপরই ঘরে ফিরে আসে, কোনো কোনো দল হয়তো ফেরে বিকেলে কিংবা সাঁঝবেলায়। সব পাখিই রাত্রিযাপন করে তাদের এই বটগৃহে। যে-সব পাখি ভোরে গৃহত্যাগ করেছে, তারাই হয়তো কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর আগমনবার্তা জানিয়ে গেছে …।

লোকটি, কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু হোক, কিংবা তার থাকুক অন্য কোনো নাম, লোকটি কিংবা যুবকটি, তাকে যুবক বলাও কঠিন, বয়স ত্রিশের ওপরেই হবে, প্রৌঢ়ও বলা যাবে না; অনুমিত বয়স চল্লিশের কম; দেখতে অবশ্যই সুপুরুষ, কৃষ্ণ কিংবা যিশুর কাল্পনিক, শিল্পী-অঙ্কিত ছবি আমাদের নজরে পড়ে, মুহাম্মদের কোনো ছবি কোথাও নাই, না বাস্তব, না কাল্পনিক; তাহলে যুবকটি কিংবা প্রৌঢ় লোকটি দেখতে ঠিক কোন মহাপুরুষের মতো, তাও বলা যাবে না; কিন্তু যুবকটি কিংবা লোকটি যে খুব ভালো মানুষ – এলাকার কেউ তা অস্বীকার করে না। এই দু-বছরে কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু এলাকায় মহাবতার কৃষ্ণ, মহামানব মুহাম্মদ কিংবা যিশুর মতোই পূজনীয় মানুষে পরিণত হয়েছে। বটতলা, তার আখড়ায় লোকসমাগম লেগেই থাকে সারাক্ষণ …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু, লোকটি আসলে হিন্দু কি মুসলমান; কিংবা অন্য কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ, পথেঘাটে কি এলাকার হাটবাজারে তেমন একটা প্রশ্নও ওঠে না এখন। লোকটি এলাকায় নিজেকে মহাপুরুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে …।

বাবা, তোমাকে আমি কী নামে ডাকবো …?

ঠাকুরবাড়ির সুশ্রিতা দেবী ভোরবেলা স্নান সেরে, তুলসীতলায় পূজা করে প্রায় প্রতিদিনই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর জন্য কলা-ছোলা-মিষ্টান্নের ভোগ নিয়ে আসে। বিদুষী এই নারী গলবস্ত্র হয়ে, গলদশ্রুচোখে লোকটির সামনে বসে। ‘বাবা, দয়া করে অন্নগ্রহণ করো। বলো, কী নামে ডাকবো তোমাকে … ?’

কোজাগরী পূর্ণিমার ঝকঝকে গোলচাঁদের মতো গোলাকার কাঁসার থালায় ছোলা-কলা-মিষ্টান্ন, কাঁসার ঘটিতে জল, সুশ্রিতা দেবী লোকটির সামনে নতমুখে বসা, খাদ্যগ্রহণের আকুতি; কিন্তু কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর মুখে কোনো রা-শব্দ নাই। খাদ্যগ্রহণেও সম্মতি নাই। সে দোতারায় বোল তুলে গুনগুন করে –

একদিন পারের কথা ভাবলি নারে

পার হবো হীরের সাঁকো কেমন করে …।

ওপারের কথাই বা কী, হীরের সাঁকোই বা কেমন – সুশ্রিতা দেবীর মাথায় কিছুই ধরে না। গলগল করে তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। হঠাৎ বটবৃক্ষের মগডালে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির। কিছু একটা নিয়ে হয়তো তাদের মধ্যে ঝগড়া বেধেছে। পাখপাখালির মধ্যেও যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়, তারাও যে চিৎকার-চেঁচামেচি করে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ে; সুশ্রিতা দেবীর এটা জানা ছিল না। সে ওপরের দিকে তাকালো। সত্যি-সত্যিই কি ঝগড়া করছে পাখিরা? এত কলরব! কিন্তু এ কী – সুশ্রিতা দেবীর কানে আসে, পাখিগুলির গলায় ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ রব …!

বাবা, তুমি তাহলে কলিযুগের কৃষ্ণ হয়ে আমাদের মাঝে এসেছ। নিজের পরিচয় কেন গোপন রেখেছ? হাতজোড় করে কপালে ঠেকালো সুশ্রিতা দেবী …।

ভগবান কৃষ্ণ, কথা বলো, একটা কথা অন্তত বলো। এই অভাগিনী-পাপিষ্ঠার মুখের দিকে একবার একটু চোখ তুলে তাকাও …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর মুখে তবু কোনো কথা নাই। সে দোতারায় নতুন সুর তুললো –

বেদ পড়ে ভেদ পেত যদি সবে

গুরুর গৌরব থাকত না ভবে …।

বটবৃক্ষের পাখিরা কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছিল, নাকি তারা যে এই আকালের দিনেও, সেবার দেশে প্রচণ্ড আকাল পড়েছিল, চাল-ডাল, লবণ-কেরোসিন – কিছুই মিলছিল না বাজারে, গাঁয়ের অনেক ধনী-পরিবারের লোকেরাও ঠিকমতো খেতে-পরতে পেত না, গরিবঘরের কেউ কেউ মরছিল অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে; সেই দুঃসময়েও পাখিরা যে খেয়ে-না-খেয়ে বেঁচে ছিল, তারই ঘোষণা দিচ্ছিল চিৎকার-চেঁচামেচি করে, কে জানে; কিন্তু সুশ্রিতা দেবী শুনলো পাখিদের কণ্ঠে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ রব। গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়লো – লোকটি হিন্দুদের মহাবতার শ্রীকৃষ্ণ। সাক্ষাৎ ভগবান …!

জয়নাল শেখের বৃদ্ধা স্ত্রী হামিদুন্নেছা, মুন্সি আবদুল আজিজের বউ রহিমা খাতুন, রাঁঢ়া ফুলমতি – ওরা কেউ না কেউ, দু-একদিন কি দু-চারদিন পরপরই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর জন্য দুধকলা কি আম-পেয়ারা-ডাব কিংবা খিচুড়ি রেঁধে নিয়ে আসে। ফুলমতি আসে ঘনঘন। প্রায় প্রতিদিনই। খাবারের থালা কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর সামনে রেখে গলবস্ত্র হয়ে সজলচোখে বসে থাকে। তার দুঃখের সীমা-পরিসীমা নাই। পাঁচ বছর ধরে বিয়ে হয়েছে। এতদিনেও সন্তানের মা হতে পারেনি। স্বামী-শাশুড়ি, ননদ-ননাসদের গঞ্জনায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। বন্ধ্যত্বের সব দোষ তার। পুরুষ-মানুষের যেন কোনো দোষ থাকতে পারে না। স্বামী রূপচান ফুলমতিকে হুমকি দিয়ে রেখেছে – আর ছয়মাস দেখবে, এর মধ্যে পেটে বাচ্চা না এলে তাকে তালাক দেবে। ফুলমতি কতবার যে ভাবে – গলায় দড়ি দেবে, এই নিষ্ফলা-জীবন রেখে কোনো লাভ নাই, পাপের ভয়ে এখনো ঝুলে পড়েনি বাড়ির পেছনের গাবগাছের ডালে। এখন, এই দয়ালবাবা একদিন কৃপা করে যদি তার মাথায় হাত রাখে, তার ডাকে খোদাতালা সাড়া দিলেও দিতে পারে …।

অকালবিধবা নূরবানুও কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর সান্নিধ্যে কদাচিৎ আসে। লোকটির সামনে চোখের পানি ফেলে একটু শান্তি-স্বস্তি খোঁজে। সে আসে ঠিক মধ্যদুপুরে, যেন কোনো লোকের সমুখে তাকে পড়তে না-হয়। কেউ দেখলেই তাকে বেশ্যামাগি বলে গালি দেবে। ‘দয়ালবাবা, তুমিই বলো, আমার কী করার আছে? আমি কী করতে পারি! রাতে আমার ঘরে লোক আসে, আমি ইচ্ছা করলে তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি; জোরজবরদস্তি করে কেউ আমার কিছু করতে পারবে না, সেই মনের জোর আমার আছে। কিন্তু লোক ফিরিয়ে দিলে, আমার তিন-তিনটা শিশুবাচ্চা, তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারবো না। গাঁয়ের কেউ তো আমাকে দেখে না। দু-চার বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছি, ধানভানার কাজ করেছি, দেখলাম তো – হয় বাড়িওয়ালা, না-হয় বাড়িওয়ালার ছেলে, আমার শরীর খেতে শুরু করে। তখনই তো সিদ্ধান্ত নিলাম, বিনাপয়সায় কাউকে শরীর খেতে দেবো না। মানুষটিকে সাপে না-খেলে, আমি তো অসতী ছিলাম না, কেন ঘরে লোক নেবো। সন্তানদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে ঘরে লোক নিলে কেন পাপ হবে, আমার তো মাথায় ধরে না, দয়ালবাবা …।’

এক দুপুরে, নিরাকপড়া দুপুর, বটতলায় কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর আস্তানায় তখন লোক থাকার কথা না, নূরবানু লোকটির কাছাকাছি যেতেই দেখলো – ফুলমতি তখনো বসে আছে। দয়ালবাবার দোতারার সুর ভেসে আসছে –

কোন সুখে সাঁই করেন খেলা এই ভবে

আপনি বাজায় আপনি বাজে

আপনি মজে সেই রবে …।

ফুলমতি কখন এসেছে, যাবেই বা কখন,

 কে জানে – নূরবানু ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই ডাকল ফুলমতি – ‘ফিরে যাও কেন ভাবি? আসো। আমি দুঃখী মানুষ, তুমিও দুঃখী। আসো – আমরা দুই বোনে একসাথে দয়ালবাবার পায়ে পড়ে কাঁদি …।’

হঠাৎ বটবৃক্ষের মগডালে পাখিদের শোরগোল। কোনো শত্রু পাখির দল আক্রমণ করলো না তো? ইদানীং শোনা যায়, দেখাও মেলে, পশুপাখিদের মধ্যেও নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে মারামারি-কাটাকাটি, যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হয়েছে; একটা সময় যা ছিল কল্পনারও অতীত। হিংসা-বিদ্বেষ, খুনোখুনি, চরদখল, দেশদখল; এইসব ঘিরে সমর-প্রতিযোগিতা – সবই ছিল মানুষের কাজ; এখন জীবজন্তুর মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মানুষের স্বভাব পাচ্ছে তারা। ব্যাপারটা খুবই উদ্বেগজনক। যা হোক – আমাদের বটবৃক্ষের পক্ষীকুল এখনো বেপথু হয়নি। স্বার্থের দ্বন্দ্বে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি তারা। সেদিন ছিল ঈদে-মিলাদুন্নবি। মহামানব মুহাম্মদের (সা.) জন্ম ও মৃত্যুদিবস। পাখিরা এই মহামানবের বন্দনা গাইছিল সমস্বরে – ‘ইয়া মুহাম্মদ, ইয়া মুহাম্মদ’- তাদের এই সমবেত ধ্বনিই শোরগোলের মতো শোনাচ্ছিল। নূরবানুর কানে সঠিক শব্দটিই বেজেছে। সে ফুলমতিকে বললো – ভালো করে কান পেতে শোন তো ভাই, পাখিরা কী বলছে। কার নাম করছে …?

অবাক কাণ্ড ভাবি! পাখিরা বলছে – ‘ইয়া মুহাম্মদ, ইয়া মুহাম্মদ …।’

নিম্নস্তরের জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন বিহঙ্গকুল মুখে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বোল তুলতে পারে কি না, সুশ্রিতা দেবী যেদিন শুনলো – পাখিরা ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ রব তুলেছে মুখে; কেউ প্রশ্ন তুললো না, বিষয়টা কতটুকু যুক্তিপূর্ণ, বিজ্ঞানসম্মত; চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো – লোকটি হিন্দুদের মহাবতার কৃষ্ণ; সেদিনও, নূরবানু-ফুলমতি শুনলো পাখিরা মহামানব মুহাম্মদের বন্দনাগীত গাইছে – ‘ইয়া মুহাম্মদ সালাম আলাইকা, ইয়া মুহাম্মদ সালাম আলাইকা’- কেউ প্রশ্ন তুললো না, পক্ষীসম্প্রদায়ের পক্ষে আদৌ এই শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করা সম্ভব কি না! এলাকার মুসলমানদের বিশ^াস – নূরবানু ব্যভিচারিণী, ফুলমতি বাঁজা, তাতে কী; তারা পাখিদের মুখে সত্যকথাটাই শুনেছে। লোকটি এ-যুগের মুহাম্মদ …!

এলাকার হিন্দুরা বিশ^াস করে লোকটি শ্রীকৃষ্ণ, মুসলমানরা মনে করে লোকটি হজরত মুহাম্মদ (সা.), খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের দাবি – লোকটি মহান যিশু। মানুষের ত্রাণকর্তা। ভাগ্যিস, লোকটি কৃষ্ণ নাকি মুহাম্মদ নাকি যিশু – এ-নিয়ে গাঁয়ে দাঙ্গা লাগেনি। না-লাগার কারণও বিদ্যমান। গাঁয়ে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা, অর্থবিত্ত, লাঠিসোঁটা, সরকি-বল্লম – সবই সমান সমান। দুই সম্প্রদায়ের কেউ কারো থেকে ছোট কিংবা বড় না। দাঙ্গা বেঁধে গেলে দুই সম্প্রদায়েরই সমানসংখ্যক মাথা কাটা পড়বে। … আর গাঁয়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় বাস করে মাত্র পাঁচ ঘর। ওরা বাগদিপাড়ার। স্বাধীনতার পর, যেবার দেশে দুর্ভিক্ষ এসেছিল, কারো ঘরে খাবার ছিল না, পরনের কাপড় কেনার টাকার সংস্থান ছিল না, কুপিবাতি জ¦ালানোর কেরোসিন উধাও হয়েছিল দেশ থেকে, উত্তরবঙ্গে কচু-ঘেচু – অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেত অসংখ্য মানুষ, পথে-ঘাটে পড়ে থাকতো মড়া; মিশনারিরা খাদ্য ও অর্থ দিয়ে, চিকিৎসা-সুবিধা দিয়ে অনেক গরিব-দুস্থ মানুষের মন গলিয়ে ধর্মান্তরিত করেছিল। ডোম-বাগদি, মুচি-মেথর, আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরাই বেশি নিজেদের ধর্মত্যাগ করেছিল, খ্রিষ্টান হয়েছিল। আমাদের গাঁয়ে আদিবাসী গারো, হাজং, সাঁওতাল নাই, ডোম-মুচি-মেথররা না-খেয়ে মরবে, রোগে ভুগে মরবে, তবুও ধর্মত্যাগ করতে রাজি ছিল না; শুধু বাগদিপাড়ার নিতাই, রজত, কানু, সুনীল ও রামের বাবারা, বাইবেল হাতে নিয়ে, সদাপ্রভু যিশুর নামে মন্ত্র পড়ে খ্রিষ্টানধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল।

নিতাই-রজতরা পিতৃসূত্রে খ্রিষ্টান। ওরা ভাবে, লোকটি সদাত্রাণকর্তা যিশুই হবে, রামের বউ সুনেত্রা লোকটির জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে পাখিদের মুখে ‘যিশু যিশু’ রবও শুনেছে; কিন্তু এ-পর্যন্তই। ওদের বিশ^াস ওরা বুকে পুষে রেখেছে, লোকটি যে যিশুই, তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। কারণ, ওরা তো দুর্বল। গাঁয়ে মাত্র পাঁচ ঘর বসতি। নিজেদের ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও লোকবল লাগে, অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন; টাকা-পয়সা তো লাগেই …।

সুনেত্রা শুধু যে পাখিদের মুখে ‘যিশু যিশু’ রব শুনেছে, ঘটনা এ-পর্যন্তই সীমিত থাকলে কোনো কথা ছিল না, সুনেত্রা যেহেতু লোকমুখে শুনেছে, লোকটি কৃষ্ণ, লোকটি মুহাম্মদ; সুনেত্রা তাই লোকটির গলায় ক্রুশচিহ্ন খোঁজে …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু এই দু-বছরে আমাদের এলাকায় দেবতুল্য মানুষ হয়ে উঠেছে, যৌবনোত্তীর্ণ মানুষ, বয়স ৩৫ কি ৪০ হতে পারে। এর বেশি হবে না। এই বয়সের একজন মানুষের দেবতুল্য হয়ে ওঠা বিরল। তবে ব্যতিক্রম তো সবক্ষেত্রেই আছে। কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুও হয়তো ব্যতিক্রম। কথা বলতে গেলে সে বলেই না, দু-চার কথা যা বলে – রাতে যেদিন খোলা মাঠে ভক্তদের নিয়ে বসে। সেখানেও কথার চেয়ে গীতবন্দনা করে বেশি। লালন সাঁইজির গীতই যেন তার কথা। তার বচন। এমনিতে সে বটতলায় তার আখড়ায় বসে সারাক্ষণ গুনগুন করে, কখনো –

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়

কখনো –

ও সে প্রেম করা কি কথার কথা

… … …

… রূপ-সনাতন উজির ছিল

প্রেমে মজে ফকির হলো

লালন বলে এমনি জেনো

প্রেমের ক্ষমতা

কিংবা –

কে বানালো গো আজব শহর-নহর

একঘরেতে জল আর আগুন

রেখেছেন গো নিরন্তর …।

যা হোক, সে নিজের মতো, নিজের ভেতরেই, শামুকের ভেতর মুক্তোদানা লুকিয়ে থাকার মতো থাকে। তার ভক্তরা আসে, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, অচ্ছুত শ্রেণি – কোনো ভেদাভেদ নাই; তারা তার শ্রীচরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। এখন আর কেউ, সে হিন্দু নাকি মুসলমান, নাকি বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, কী তার নাম, কোত্থেকে এসেছে; কারো ফলাহার কি মিষ্টান্ন কিংবা ভাত-খিচুড়ি, ভক্তের নিবেদিত খাবার খায় না কেন – এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। বটবৃক্ষের পাখিরা কিচিরমিচির করে কী বলছে, আর লোকে কী শুনছে, হয়তো যে তাকে নিয়ে যেভাবে কল্পনা করছে, তাকে জিজ্ঞেস করে তার যে-নামটি শুনতে চেয়েছে, সেই নামটিই পাখির মুখে শুনেছে। কেউ তাকে কৃষ্ণ নামে, কেউ মুহাম্মদ কিংবা যিশু নামে ডাকে। কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভাবান্তর নাই। যার যে-নামে ইচ্ছা তাকে সেই নামেই ডাকুক। কৃষ্ণ, মুহাম্মদ, যিশু নামে ডাকলেই সে ধর্মদূত হয়ে যাবে না। হওয়া সম্ভবও না। সে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষই মনে করে। যখন তার নাম-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতো তখনো সে সাঁইজির গীতবন্দনা করতো –

আপন ঘরের খবর নে না

অনা’সে দেখতে পাবি

কোনখানে সাঁইর বারামখানা …।

একরাতে নূরবানু এলো …।

তখন দুপুররাত, ভক্তরা যার যার ঘরে চলে গেছে, ঘুমিয়ে পড়েছে পাখিরাও, কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু সাঁইজির গীতবন্দনা করছে –

ও মন বাতাস বুঝে বাজাও রে তরী

তেহাটা ত্রিবেণীর তোড় তুফান ভারী

একে আমার কাষ্ঠের নাও

তাতে বিষম বদ হাওয়াও

কুপাকে কুপ্যাঁচে পড়ে

প্রাণে মরি …,

নূরবানু এলো আখড়ায়। নতমুখে বসলো কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর পদতলে …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু, আমরা জানি, সচরাচর কথাবার্তা বলে না। কিন্তু নূরবানুকে দেখে মনে মনে বললো – এতো রাতে এই বিধবা নারী এখানে, নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েই এসেছে।

চাঁদ ঘুমুতে গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। পথঘাট কালো ছাইয়ের মতো অন্ধকার। এর মধ্যেও তুমি বোরকা পরে এসেছ। আমি কিন্তু এই ঘন আঁধারেও দূর থেকে তোমার ছায়ামূর্তি দেখেই তোমাকে চিনেছি, নূরবানু আসছে। বলো মা, এই আঁধার-আতঙ্ক উপেক্ষা করে, এতো রাতে কেন এসেছ …?

বাবা, আমি খুব একটা বড় বিপদে পড়েছি। তুমি আমাকে বাঁচাও …। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নূরবানু।

খুলে বলো, কী বিপদ, মা …।

আমার পেটে বাচ্চা এসেছে। ছয় মাস …।

পেটে বাচ্চা! পুরুষ ঘরে নিলে পেটে বাচ্চা তো আসবেই। প্রটেকশন নাওনি …?

প্রটেকশন …!

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে আমরা তো আসলেই কিছু জানি না। না-জানি তার নাম-পরিচয়,

না-জানি সে শিক্ষিত কি অশিক্ষিত। তবে আমরা চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে জানতে পারবো – সে শিক্ষিত মানুষ। শুধু শিক্ষিত বললে ভুল বলা হবে, কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু উচ্চশিক্ষিত। বিদ্বান-পণ্ডিত মানুষ। সে তার গাঁয়ের প্রাইমারি ও হাইস্কুলে পড়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে নিজের শহরের কলেজে। এরপরই সে গৃহত্যাগ করে। ভর্তি হয় ভারতের বিহারের নালন্দা বিশ^বিদ্যালয়ে। বাংলা, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পথে বের হয়। ভারতের অজন্তা, ইলোরা, আগ্রা, দিল্লি, বারানসী – নানা জায়গা ঘুরে ঠাঁই নিয়েছিল স্বদেশের কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইজির আখড়ায়। বেশ ক-বছর ছিল সেখানে। তারপর থেকেই দেশের পথে পথে ঘুরছে …।

‘প্রটেকশন’ শব্দটি শুনে নূরবানু মাথা তুললো। সে কিছুই বোঝেনি …।

প্রটেকশনের অর্থ বোঝনি? মানে, মানুষ যে ঘরে নিয়েছ, তোমার পেটে যাতে বাচ্চা না-আসে, ওই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নাওনি? তুমি জন্মনিরোধক বড়ি খাওনি বা পুরুষ-মানুষটি কনডম ব্যবহার করেনি, তাই তো …?

আমি বড়ি খেতাম। হয়তো হিসাবে ভুল হয়েছিল। পুরুষ-মানুষেরা লিঙ্গে

টুপি-পরা পছন্দ করে না …।

হুম …।

এখন আমার কী হবে, বাবা? তুমি আমাকে বাঁচাও। আত্মহত্যা করে আমি নিজে বাঁচতে পারি। কিন্তু তখন আমার সন্তান তিনটে তো খেতে না-পেয়ে পথে পথে ঘুরে মারা যাবে …।

আমি তোমাকে কীভাবে বাঁচাতে পারি, মা …।

তুমি সাধুপুরুষ বাবা। আল্লাহতালার নেকবান্দা। তুমি আমার পেটে একটা ফুঁ দিয়ে দিলেই মৃতবাচ্চা খালাস হয়ে যাবে …।

মা, মানুষ হত্যা মহাপাপ। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো সাধ্য নাই মানুষ সৃষ্টি করে। সেই মানুষকে কারো হত্যা করার অধিকার নাই …।

তাহলে এখন আমার উপায় কী, বাবা …?

যারা তোমার ঘরে আসে, যাদের ঔরসে তোমার পেটে সন্তান আসতে পারে, তুমি কি তাদের কারো নাম বলতে পারো …?

সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলতে পারবো না। তিন-চারজনের নাম বলতে পারি – যাদের কেউ না কেউ আমার পেটের বাচ্চার বাবা। ইয়াছিন মেম্বার, সওদাগরবাড়ির মেজো ছেলে ওসমান,

সা-বাড়ির অখিল সা …।

তোমার পেটে, মা, কার সন্তান – এটা, এই যুগে প্রমাণ করার সুযোগ আছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ। ডিএনএ টেস্ট করালেই বিষয়টা প্রমাণিত হয়ে যাবে। তুমি অবশ্য এটা, কীভাবে কী করা যায়, করা হয় – তা বুঝবে না। তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলো; ডিএনএ টেস্ট না-করেই ওরা কেউ তোমার অনাগত সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে স্বীকার করে কি না। কেউ দায় না-নিলে তখন আমি বিষয়টা দেখবো, কতটুকু কী করতে পারি …।

নূরবানু অন্ধকারেই এসেছিল, একাকী; অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল। কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু সাঁইজির গীতবন্দনা শুরু করলো –

বাড়ির কাছে আরশিনগর

সেথা এক পড়শি বসত করে

আমি একদিন না দেখিলাম তাঁরে …।

ইয়াসিন মেম্বার, ওসমান ও অখিল সাহা – এই তিনজনের মধ্যে একটা সমঝোতা স্মারক সই করা আছে। তিনজন কখনোই একই রাতে নূরবানুর ঘরে আসে না। ইয়াসিন মেম্বার আসে শুক্রবার রাতে, রোববার রাতে আসে ওসমান; অখিল সাহা আসে বুধবার রাতে। ওরা এতটাই ভদ্রলোক যে সমঝোতা-চুক্তি কেউ ভঙ্গও করে না …।

নূরবানু বৃহস্পতিবার রাতে কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর আখড়ায় এসেছিল। জানে তো – শুক্রবার রাতে ইয়াসিন মেম্বার ওর ঘরে আসবে। মেম্বার আসে রাত বারোটার দিকে – মুচিবাড়ির দারু খেয়ে। ঘরে ঢুকে সময় নিতে পারে না। কাপড়-চোপড় খুলে নূরবানুর বিছানায় যেতে দেরি হলে মেম্বার দ্রব্যগুণে ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য নূরবানু বাচ্চাদের খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে নগ্ন হয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। ঘরের দরজায় তিনটি টোকা পড়লে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়। ঘরের দরজায় ইয়াসিন মেম্বার তিনটি টোকা দেয়। এই তিন টোকার মাহাত্ম্য আছে। ইয়াসিন মেম্বার নিজেই এই মাহাত্ম্য খোলাসা করে। মেম্বারের নাম ইয়াসিন, কোরআনের   একটি সুরার নামও এই ইয়াসিন, নম্বর ৩৬। তার বয়সও ৩৬। ইয়াসিন মেম্বার এই ৩৬ সংখ্যা থেকে ডানের ৬ সংখ্যাটি বাদ দিয়েছে, বাকি থাকলো ৩; মেম্বার নূরবানুকে বলেছে – ঘরের দরজায় তিনটে টোকার শব্দ শুনলেই বুঝবে – ইয়াসিন মেম্বার এসেছে …।

দীর্ঘদিন ধরেই এই নিয়ম চলে

আসছে …।

ওই শুক্রবার রাতে নূরবানু তৈরি ছিল না। ঘরের দরজায় টোকা পড়তেই দরজা খুলে দিলো। নূরবানুকে কাপড়-চোপড় পরিহিত দেখে খেপে গেল ইয়াসিন মেম্বার। ‘কীরে মাগি, রেডি হস নাই যে …।’

বসেন। কথা আছে …।

আগে কাম। কথা পরে …।

না। কথাডা আগে শুনেন। কাম তো করবেনই …।

দ্রব্যগুণে ইয়াসিন মেম্বারের মাথা ঝিমঝিম করছিল। কাম না-করা পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা হবে না। কিন্তু নূরবানুর চেহারা আজ অন্যরকম। বাধ্য হয়েই মেম্বার বললো – ‘ক দেহি, কী কবি …।’

আমার পেটে বাচ্চা ধরেছে …।

বাচ্চা! তুই মহিলা-মানুষ না? মহিলার পেটে বাচ্চা তো ধরবেই। তাতে আমার কী? আমি কী করবো … ?

বাচ্চা তো আপনার …।

কস কী নটিমাগি? বাচ্চা আমার! তর ঘরে আমি একাই আসি নাকি। ওসমান আসে, অখিলসা’ আসে; আরো কোন কোন শালায় আসে তুই-ই জানস। কার জাওড়া তুই আমার ঘাড়ে চাপাবার চাস … ?

ওসমানের বয়স ২৫। বে-থা করেনি। রোববার রাতে সে ঘরের দরজায় দুই টোকা দেয়। তার জন্য নগ্ন হয়ে বসে কি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় না। সওদাগরবাড়ির ছেলে তো, রুচিবোধ আছে। এসেই কুকুরের মতো হামলে পড়ে না। নূরবানুর সঙ্গে গল্পগুজব করে। ঘরে ছেলে আর মেয়ে দুটো খেয়েছে কি না, কী খেয়েছে – এইসব জিজ্ঞেস করে। নির্দিষ্ট টাকার বাইরেও ঈদ, আশুরা, তেড়াবেড়া – নানাপর্বে নূরবানুর হাতে কিছু অর্থ তুলে দেয় ওসমান। নূরবানুকে সে ভাবি ডাকে। নূরবানুর কখনো কখনো মনে হয় – ওসমান বুঝি তার প্রেমিক! ইয়াসিন মেম্বার তার গর্ভের সন্তানের দায় অস্বীকার করলেও ওসমান হয়তো তা করবে না। এতদিনে ওসমানের যতটুকু সে চিনেছে – তাতে সন্দেহের অবকাশ নাই যে, ওসমান সুরুচিসম্পন্ন মানুষ …।

একটা কথা বলতাম, ওসমানভাই …।

বলো ভাবি, কী বলবে? তোমার মনটা তো আজ ভার ভার লাগছে …।

আমার পেটে বাচ্চা ধরেছে। ছয়

মাস …।

বলো কী ভাবি! কার বাচ্চা তোমার পেটে …?

বাচ্চা তো তোমারই, ওসমান ভাই …।

আমার বাচ্চা! মুহূর্তের মধ্যে, সুরুচিসম্পপন্ন মানুষ ওসমান, নূরবানু যাকে প্রেমিক ভাবতো, সেই লোকটি আমূল বদলে গেল। খোলস ছেড়ে সাপ যেভাবে নতুনরূপ ধারণ করে – ওসমানও সেরকম নতুন মানুষ হয়ে গেল। মানুষ হয়তো এরকমই, সময় হলে সেও সাপের মতো খোলস পাল্টাতে পারে…।

বেশ্যামাগি, তুই কী বলছিস? তোর পেটের বাচ্চার বাবা আমি! সওদাগরবাড়ির ছেলে হবে বেশ্যার সন্তানের জনক। তোর ঘরে ইয়াসিন মেম্বার আসে, অখিলসা আসে; দিনের বেলায়ও দেখি – চ্যাংড়া ছেলেরা তোর বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করে …।

বাচ্চা কার, তা কিন্তু প্রমাণ করা যায়, ওসমান ভাই …।

মানে! কে বলেছে তোকে … ?

যেই বলুক, বলেছে। ডিএনএ টেস্ট নাকি কী-একটা টেস্ট করতে হয় …।

ডিএনএ টেস্টের কথা শুনে খুন চেপে গেল ওসমানের মাথায়। তাই তো। টেস্টে সেও তো ধরা খেতে পারে। তখন মান-ইজ্জত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। বাবা ত্যাজ্যপুত্র করতে পারে। তার আগে লোকটা কে, নূরবানুকে যে বুদ্ধি দিয়েছে, তার খোঁজ বের করা দরকার। ওই শালার খোঁজ পেলে ওকেই ফাঁসাতে হবে। ওসমান আচমকা নূরবানুর গলা চেপে ধরলো। ‘ক মাগি, কেরা তরে ডিএনএ টেস্টের কথা বলেছে …।’

ওসমান যে এভাবে নূরবানুর গলা চেপে ধরবে তা নূরবানুর কল্পনার মধ্যেও ছিল না। তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। মৃত্যুযন্ত্রণায় সে গোঁ-গোঁ করতে লাগলো।

নষ্টামাগি, ওই বাইনচোদের নাম ক। নইলে তোকে এখনই মেরে ফেলবো। তোর ছেলেমেয়েরা এতিম হয়ে যাবে …।

ছেলেমেয়েদের মুখ মনে পড়লো নূরবানুর। সে মারা গেলে, তিন সন্তানের খাওয়া-পরা জোগাড় করতেই তো ঘরে লোক নিত, ওরা না-খেয়ে মারা যাবে। নূরবানু বললো – সাধুবাবা বলেছে।

ও! তুই তো ওই ভণ্ডের আখড়ায় যাস। তোর পেটে ওই শালারই বাচ্চা …।

নূরবানুর ঘরে যারা আসে, তাদের মধ্যে অখিল সাহার বয়স সবচেয়ে বেশি। ৫০-৫৫ বছর হবে। শুধু বয়স কেন, অর্থবিত্তও অঢেল। বাজারের বড় তিনটি দোকানই তার। পাইকারি দোকানের গদিতে সে নিজে বসে। অন্য দুটিতে বসে দুই ছেলে। গুড়-চিনি, লবণ-কেরোসিন; এই আক্রার বাজারে, এসব দেশের কোথাও পাওয়া না-গেলেও অখিল সাহার দোকানে পাওয়া যাবে। এই যে এত ধনসম্পদ, কিন্তু অখিল সাহার শরীর-মনে শান্তি নাই। স্ত্রী বিনিতা চিররোগী। কোমরে ব্যথা। হাড় নাকি ক্ষয়ে গেছে। রাতে স্বামীকে উপগত তো দূরঅস্ত, কাছেই ঘেঁষতে দেয় না বিনিতা। তাহলে, সুযোগ যেহেতু আছে, অখিল নূরবানুর ঘরে তো যাবেই …।

অখিল সাহাও তেলচকচকে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে বললো, সে তো নূরবানুর ঘরে একা আসে না, লোক আরো আসে, সে তার পেটের বাচ্চার বাবা হতে যাবে কোন দুঃখে …।

আট মাস ১৭ দিনের দিন প্রত্যুষে পেটের বাচ্চার ঘুম ভেঙে গেল। গোঁয়ার ষাঁড়ের মতো গুঁতো মেরে মেরে পথ বের করে সে অন্ধকার থেকে আলোময় জগতে বেরিয়ে এলো। তারপর শুরু করলো চিৎকার – মা, মা …।

নূরবানুর ঘরের পাশ দিয়েই মসজিদে যাওয়ার পায়ে-হাঁটা পথ। ইয়াসিন মেম্বার মসজিদে যাচ্ছিল। শিশুর কান্নার শব্দ তার কানে আসে। ‘মাগি তাইলে বিয়াইছে …।’

নামাজ-শেষে ইয়াসিন মেম্বার নূরুল শেখকে লক্ষ করে বললো – ‘ইমাম সাব, একটা কথা কইতাম …।’

বলেন। কী বলবেন, বলেন …।

হবির ঘরে নতুন শিশুর কান্না শুইনা আসছি। অর বউয়ে জারজ-সন্তান প্রসব করছে …।

তওবা! তওবা! বলেন কী …!

নূরবানু যে বেশ্যা-মেয়েলোক – এ তো আমরা সবাই জানি। তাই বলে জারজ প্রসব …।

কঠিন বিচার করতে হবে। এই ভ্রষ্টা-মহিলার একার পাপে গ্রাম ধ্বংস হবে – তা হতে দেওয়া যাবে না। আজ বুধবার। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিচার হবে। এখানে যারা আছেন – শুনে গেলেন। মেম্বার সাহেব চৌকিদার দিয়ে গ্রামবাসীকে জানাবেন …।

বুধবার রাতেই নূরবানুর ঘরের দরজায় প্রথমে দুটো, তারপর তিনটি টোকা পড়লো। নূরবানু ভাবলো – ওসমান ও ইয়াসিন মেম্বার আজ একসঙ্গে এসেছে। ওসমান দু-টোকা আর ইয়াসিন মেম্বার তিন টোকা দেয়। টোকার আওয়াজও দু-রকম। নূরবানু দরজা খুলে দিলো। দুজন নয়, ঘরে ঢুকলো তিনজন। অখিল সাহাও সঙ্গে আছে। তিনজনের হাতেই বরফকাটার মতো চকচকে-ধারালো ছুরি …।

ইয়াসিন মেম্বারই কথা তুললো। আমরা জানি নিশুতি শুরু হলে, দুনিয়ার সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, তুই ওই ভণ্ড সাধুর আখড়ায় যাস। তোর এই ছেলে ওই ভণ্ডরই ঔরসজাত। শুক্রবার জুমার পর মসজিদের সামনে বিচার হবে। তুই ওই ভণ্ডের নাম বলবি। আমাদের কথার অন্যথা করলে, এই যে ছুরি দেখছিস, তিনজনের হাতে তিন ছুরি – তিনজনে তোর তিন সন্তানের গলা কেটে লাশ শালুক নদীতে ভাসিয়ে দেবো, মনে রাখিস …।

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নবজাতক চিৎকার করে উঠলো – মা, মা …।

শুক্রবার জুমার নামাজ-শেষে মসজিদের সামনে বিচার-সভা বসেছে। নূরবানুর ঘরে রাতে মানুষ ঢোকে – এটা গাঁয়ের প্রায় সকলেরই জানা, কে কবে তার ঘরে ঢোকে তাও জানে অনেকেই; লোকগুলি প্রভাবশালী, নূরবানুরও টাকার দরকার, তাই এ-নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না; তাই বলে জারজ-সন্তান প্রসব! মসজিদের সামনে খোলা মাঠের চারপাশে উৎসুক মানুষের ভিড়। গাঁয়ের সব পুরুষ-মানুষ তো এসেছেই, অনেক নারীও এসেছে। মেয়েমানুষের ঘরে পুরুষ ঢুকলে, মেয়েটির পেটে বাচ্চা আসতে পারে, এটাই স্বাভাবিক, এ নিয়ে কেউ তেমন কৌতূহলী নয়, সমবেত জনতার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল – নূরবানু কার নাম বলে? কে নূরবানুর বাচ্চার বাবা …!

মসজিদের ইমাম নূরুল শেখ কোমলস্বরে জিজ্ঞেস করলো – বলো মা, তোমার এই ফুটফুটে

ছেলে-সন্তানটির বাবা কে …?

নূরবানু নিরুত্তর …।

বলো মা, লোকটির নাম বলো। তুমি লোকটির নাম না-বললে আমাকে শরিয়তের বিধান অনুসারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে …।

নূরবানু নিরুত্তর। পলকহীন …।

আমরা তো জানি – চোরের মায়ের বড় গলা। ইয়াসিন মেম্বার, সঙ্গে অখিল সাহা ও ওসমান ক্ষেপে উঠলো – এই নষ্টা-ভ্রষ্টা মেয়েলোককে বাঁশডলা দিতে হবে, ইমাম সাহেব। নইলে সে হারামির পোলা হারামির নাম বলবে না …।

নূরবানুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার অবুঝ তিন সন্তানের মুখ এবং তিনটি চকচকে ছুরি। সে বললো – সাধুবাবা …।

সাধুবাবা …!

সাধুবাবা …!

সাধুবাবা …!

ইয়াসিন মেম্বার হুঙ্কার ছাড়লো – কে বলেছে ওই শালা সাধু? শালা একটা ভণ্ড, নোচ্চা। শালার পুতের আখড়া এখনই ভাঙতে হবে। পুইড়া নাড়ার ছাই বানাতে হবে। তারপর ওই ভণ্ড-নোচ্চার হাত-পা-নুনু কাইটা নদীতে ভাসাইয়া দিতে হবে …।

কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু দোতারায় সুর তুলে অন্যদিনের চেয়ে কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরে গাইছিলেন –

যে স্তনের দুধ শিশুতে খায়

জোঁকে মুখ লাগালে সেথায়

রক্ত পায় সে;

অধমে উত্তম, উত্তমে অধম

যে যেমন দেখতেছে …।

একদল লোক বাঘের মতো হিংস্রতা প্রকাশ করতে করতে আখড়ায় ছোটে। তাদের কারো হাতে লাঠিসোঁটা, কারো হাতে রামদা, চাপাতি। উন্মত্ত লোকেরা কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুকে তার আখড়া থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে তার আখড়া ভাংচুর করলো। ওসমান গ্যাস-লাইটার জে¦লে আগুন ধরিয়ে দিলো ছনে-ছাওয়া আখড়ার চালে। দাউদাউ করে আগুন জ¦লে উঠলো। অগণিত লোকের লাঠির বাড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু …।

বটবৃক্ষে আশ্রিত একদল পাখি ক্রন্দন করছে – কৃষ্ণ, কৃষ্ণ …। একদল পাখি ক্রন্দন করছে – মুহাম্মদ, ও আমাদের মরুপুরুষ মুহাম্মদ …।

আরেকদল পাখি ক্রন্দিতস্বরে চিৎকার করছে – যিশু ও আমাদের সদাপ্রভু যিশু …। পক্ষীকুলের এই ক্রন্দিত ভাষা কেউ বুঝলো না …।

ইয়াসিন মেম্বার কয়েকজনকে নির্দেশ দিলো – এই তরা এই ভণ্ড-নোচ্চাকে চিৎ কইরা শোয়াইয়া দে। আমি শালার চোখের সামনেই ওর হাত-পা-নুনু কাটি …।

নূরবানু তার সদ্যোজাত পুত্রসন্তানটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই হুজ্জুতের মধ্যে কেউ হয়তো তাকে খেয়াল করেনি। সে মনে মনে নিজেকেই অভিসম্পাত দিচ্ছিল – কার পাপে কে মরে? পাপ করলো নূরবানু, মরে সাধুবাবা …।

খঞ্জর হাতে সীমার যেভাবে হোসেনের বুকের ওপর চেপে বসেছিল, ইয়াসিন মেম্বারও চাপাতি হাতে সেভাবেই কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশুর বুকের ওপরে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই নূরবানু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো – ‘মিথ্যা, সবই মিথ্যা। আমি মিথ্যা কথা বলেছি …।’

তবে কে, কে নূরবানুর সন্তানের পিতা … ?

বটবৃক্ষে আবার পক্ষীকুলের শোরগোল, কলরব …।

ইয়াসিন মেম্বার, ইয়াসিন মেম্বার …।

ওসমান, ওসমান …।

অখিল সাহা, অখিল সাহা …।

পক্ষীকুলের এই ক্রুদ্ধভাষাও বুঝলো না কেউ। মানুষ কখনোই পাখির ভাষা বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না …।

পাদটীকা

নূরবানুর গর্ভজাত তিনদিনের শিশুটি কোলে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে রক্তাক্ত কৃষ্ণ মুহাম্মদ যিশু। দুর্বৃত্তরা তার দোতারাটি ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। খালি গলায় সে গুনগুন করছে –

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার

নদী কিংবা বিলবাঁওড়খাল

সর্বস্থলে একই সে জল

একা মেরে সাঁই, ফেরে সর্বঠাঁই

মানুষে মিশে হয় বেদান্তর …।

পথে এক গোয়ালিনীকে দেখে সাধু মিনতি করে বললো – দুধের তৃষ্ণায় শিশুটি মারা যাচ্ছে, মা। ওকে একটু দুধ দেবে …।

আহা! কী সুন্দর দেবশিশু! সন্তানটি কার, বাবা …?

সন্তানটি মানুষের। আমার মায়ের …।