মাৎস্যন্যায়

‘মাঝেমধ্যে মন যা চায় তাই করুন, ইচ্ছেমত সময় কাটান’ – ফ্যামিলি ডাক্তারের বলা কথাটা বীথি কাগজে লিখে শোবার ঘরে শাড়ির ক্লজেটে লাগিয়ে রেখেছিল।

মন্ট্রিল শহরটা বছরে চার-পাঁচ মাস বরফে ঢাকা থাকে, তখন  শাড়ি পরার অনেক ঝক্কি। তবু  গ্রীষ্মকালে, বা কোনো উপলক্ষে যখন শাড়ির খোঁজ পড়ে, ওই কাগজটার গায়ে আলতো করে আঙুল বোলায় বীথি। মনে মনে স্থির করে, এবার থেকে ইচ্ছের বাস্তবায়ন করতে হবে, কিন্তু ফিরে এসে ভাঁজ করে তুলে রাখা শাড়ির মতো ডাক্তারের ওই পরামর্শও দেরাজবন্দি হয়ে যায়।

সকাল থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিপাটি রুটিনে বাঁধা বীথির দিনে কোনো হেরফের নেই। বাড়িঘর যেমন

দাগ-ধুলোহীন, তেমনি হাত-পা-মুখের সঙ্গে মনটাকেও সবকিছুতে সহমত হওয়ার ক্ষ্যাপাটে একটা চেষ্টা চালিয়ে যায় সে।

তবে, ইদানীং শাড়ির ক্লজেটের বন্ধ কপাটে চোখ গেলেও মন যা চায় করার ইচ্ছেটা তীব্র হচ্ছে বীথির। নিজেকে বলছে – ‘আর কত!’

প্রথম যেদিন ‘যা মন চায়’ করতে চাইলো সেদিনটা শনিবার ছিল। সামিউল আইস হকি খেলা দেখতে যাবে। অফিস থেকে কমপ্লিমেন্টারি টিকিট পেয়েছে চারটা। তাদের তেরো বছরের ছেলে নুমায়ের তো একপায়ে খাড়া, আগেভাগে স্কুলের কাজ শেষ করে নিল।

আগে হলে বীথি ইচ্ছে না করলেও রাজি হতো। ভাবতো, সামিউল খুশি হবে। কিন্তু সেদিন সে স্থির করে রেখেছে, মলসন সেন্টারের ওই বিশাল স্টেডিয়ামে গিয়ে ‘গো হ্যাবস গো’ করার কোনো ইচ্ছে যে তার নেই, সেটা নির্দ্বিধায় বলে দেবে। কয়েকদিন মনে মনে, বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করেছে। এমন না যে সামিউলকে সে কোনো কিছুতে না বলে না। কিন্তু আজকে না বলার ওপরে যেন কিছু নির্ভর করছে। কী সেটা – সে নিজেও জানে না। মনে হচ্ছে, নিজেকে ফিরে পাওয়ার কোনো একটা অলিখিত বিষয় আছে।

প্রথমে একটু মিনমিন করে মানা করে। ক্রিকেট, ফুটবল হলেও না হয় কথা ছিল। আইস হকি প্লেয়ারদের কাউকেই তেমন চেনে না। কিছুদিন আগে খবরে শুধু একজনের নাম শুনেছে – পি কে সুবান, ক্যানাডাতে জন্মানো জ্যামাইকান ছেলেটা। মন্ট্রিল চিলড্রেন হাসপাতালে দশ মিলিয়ন ডলার ডোনেশন দিয়ে মিডিয়ার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। টেলিভিশনে খবরটা শুনে বীথির মুখ হা হয়ে গিয়েছিল। দ-অ-শ মিলিয়ন! টাকায় হিসাব করে মাথা ঘুরেছে, এই পরিমাণ যদি দান-খয়রাত করে তাহলে আয় করে কত!

সামিউল বলে, ‘ওদের এসব ডোনেশন দিতে হয়। ট্যাক্স রিবেইট পাওয়া যায়, নাম হয়, জনসেবাও হলো। এদের হিসাব আছে, তুমি বুঝবে না।’

– আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা কি বড় অংকের ডোনেশন দেয়?

‘কিসের সঙ্গে কী মেলাও!’ – বলে বীথির কথাকে খারিজ করা হাসি হাসে সামিউল।

তাও সুবান খেললে না হয় বীথি যেত, যদিও কোনটা কোন খেলোয়াড় দর্শকেরা কী করে আলাদা করে কে জানে!

জার্সিতে যেহেতু নম্বর দেওয়া, মুখে গ্রিলঅলা হেলমেট পরে হকিস্টিক নিয়ে বরফে ঢাকা মাঠে সাঁই সাঁই গতিতে বিপরীত পক্ষের গোলপোস্টে বল ঢোকানোর তীব্র লড়াইয়ে ভক্তরা তাদের প্রিয় খেলোয়াড়দের হয়তো চিনতে পারে। কিন্তু ওসব বীথির কর্ম নয়।

স্ত্রীর কথা শুনে সামিউল সামান্য অবাক হয়, তবে কিছু না বলে তার বন্ধুকে ফোন করে। রোকন খুব হইহই করে ওঠে – ‘মলসন সেন্টারের স্টেডিয়ামে খেলার টিকেট, বলিস কী!’ তার উচ্ছ্বাস ফোনের এপার থেকেও বীথি শুনতে পায়। কিন্তু তারপরই স্বর নেমে যায় রোকনের। অন্যদিন হলে নাকি যেত। কিন্তু এই শনিবারে অনেক আগে কনফার্ম করা একটা দাওয়াত আছে।

তারপর দুটো টিকেট আর কাকে দেওয়া যায়, কাকে সঙ্গে নেওয়া যায়?

তাদের বিল্ডিংয়ের তিনতলার যে ছেলেটি, মুন্না, বীথি তার কথা বলে। গত বছর দেশ থেকে এসেছে। মুখচোরা, লাজুক স্বভাব। কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিংয়ের ছাত্র। দেশ থেকে ওর বউকে নিয়ে আসার ইমিগ্রেশনের প্রসেসিং নিয়ে সামিউলের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। একা থাকে বলে ছুটির দিনে ভালো কিছু রান্না হলে সামিউল ছেলেটাকে ডাকে, বা দিয়ে আসে। মুন্নাকে ফোন করলে প্রথমে একটু দোনোমনা করলো। তার বাসায় দূরসম্পর্কের মামাশ^শুর দেশ থেকে বেড়াতে এসেছেন। তাঁকে রেখে যাওয়া কেমন হবে!

যদিও অফিসের কমপ্লিমেন্টারি টিকিট, কিন্তু এর দাম জানে সামিউল, চেনে না জানে না এমন একজনকে নিতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু না হলে টিকিটটা বৃথা যায়, সুতরাং মামাশ^শুর রাজি থাকলে নেওয়া যাবে।

খেলা শুরু সন্ধেবেলা, কিন্তু ডাউনটাউনে এ সময়টায় অনেক রকম অনুষ্ঠান, সেসব ঘুরে দেখবে বলে সামিউলরা দুপুর একটার দিকেই বেরিয়ে গেল।

বীথি সেদিন একা একা বেশ অনেকক্ষণ ইউটিউব ঘেঁটে গান শুনলো। ‘ওই মালতীলতা দোলে’ – বাজিয়ে নাচতে গিয়ে ঢাকায় কিছুদিন শেখা নাচের মুদ্রায় গ্রীবা দোলাতে পেরে ভালোই লাগে। যখন ক্ষিদে পেল তখন অন্য খাবারদাবার থাকলেও সে প্রচুর ঝাল দিয়ে চিংড়ি ভুনা করে ফেললো, সঙ্গে নাগা মরিচের আচার নিয়ে পেটের কোনাকাঞ্চি ভরে ভাত খেল। ঘরে অন্য কোনো মিষ্টি না থাকায় ফ্রিজে রাখা আইসক্রিম বের করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে একটা বার শেষ করে আরেকটা খেল। তারপর দুটো বালিশ উঁচু করে কোলবালিশটা জাপ্টে একটা ঘুম দিয়ে উঠে দেখে পশ্চিমের আকাশে সূর্যের রাগী মুখ সলাজ এবং কমনীয়।

স্বভাবমতো, বীথির প্রথমেই মনে হলো দিনটা নষ্ট হয়ে গেল! বেশি করে খাওয়া ভাত শরীরে কতটা বাড়তি মেদের জোগান দেবে – এ-কথা ভেবে একটু অপরাধবোধও মনের ভেতর সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ছে।

খানিকটা সময় লাগলো, কিন্তু বীথি ধাতস্থ হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বললো – ‘ধরে নাও এই দিনটা বাড়তি। জীবনে যদি পঁচিশ হাজার পাঁচশো সাড়ে সাতষট্টি দিন বাঁচো, তাহলে এর থেকে একশ সাতষট্টি দিন বাদ দিয়ে দাও। প্রতিটা দিন নিয়ে এত হিসাবের কী দরকার?’

তার ঘুমিয়ে ফুলে ওঠা চোখ, বিশ্রামে সতেজ ঠোঁট আর টুবলুপনা গালে পরিতৃপ্তির ভঙ্গি স্পষ্ট। তখন এক কাপ চা নিয়ে জমিয়ে একটা কমেডি সিনেমা দেখতে বসেছিল বীথি।  

আইস হকির ম্যাচ দেখে সামিউলরা যখন ফিরলো তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত একটা। এত রাত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু পাতাল রেলে কী যেন গোলযোগ হয়েছে, বন্ধ ছিল। সঙ্গে বাসও মিস করেছে, রাতের বাস তো অত ঘনঘন নয়।

ক্লান্ত সামিউল ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বীথিকে বলে – ‘মুন্নার মামাশ^শুর তো বেশি বুড়া নয়, আমাদেরই বয়সী বা সামান্য বড়। ভালোই আড্ডাবাজ, সরকারি চাকরি করে। … আচ্ছা  কালকে বাজার করতে তুমি একলাই যেও। আমার ঘুম ভাঙিও না।’

মাছ কিনতে গেলে মেছো গন্ধটাতে সবচেয়ে বেশি গা বমি বমি ভাব হয় বীথির। কানাডা আসার আগে এ-ব্যাপারটা টের পায়নি, কারণ তখন বীথি কখনো মাছ কেনেনি, রাঁধেওনি।

বিয়ে করে বউকে মন্ট্রিয়লে এনে মাছের প্রতি বীথির বিতৃষ্ণা দেখে সামিউল শুরুতে হকচকিয়ে গিয়েছিল।

সংসারের যাবতীয় কেনাকাটায় কোনো সমস্যা নেই, কেবল মাছ কিনতে গেলে মনে হয়, পুরো শরীর গুটিয়ে কোনো কাচের বয়ামে ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো। তার শরীরজুড়ে যেন কাদাভর্তি মাগুর মাছ গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। ভেজা, পিছল আঁশটে গন্ধে হড়হড় করে বমি করে দিয়েছে বীথি।

তারপর দীর্ঘদিন সে মাছ কেনেনি। এ নিয়ে সামিউলের সঙ্গে ঝামেলাও হয়েছে। আরে, শুধু মাছের জন্য আবার আরেকজনকে বাজারে দৌড়াতে হবে? এ কি ঢাকা শহর যে হাত বাড়ালেই যত্রতত্র যা চাও পাওয়া যায়! মাছ লাগবে মাছ – বলে গলি দিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁকে যাবে, তার সঙ্গে মাছ কাটার বঁটি। কেনার পরে বঁটি বিছিয়ে সে মাছ কেটে দিয়ে যাবে! অথবা, গ্রামের বাড়ি থেকে মাসকাবারি মাছের সাপ্লাই এসে যাবে। দেশের তাজা মাছ বরফে ঢেকে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বারো-তেরো হাজার মাইল পার হয়ে এখানে এসে পৌঁছে। সে মাছের স্বাদে যেমন তফাৎ, গন্ধও তেমন তীব্রতা হারায়। গন্ধ কোথা থেকে পায় বীথি?

প্রোটিন হিসেবে মাছই সেরা, মাছ না খেলে চলবে? এসব বলে বলে মোটামুটি বিষয়টা সহজ করে এনেছে সামিউল।

মাছ যেমন সামিউলের প্রিয়, তেমনি নুমায়েরও খুব ভালোবেসে খায়। ইলিশ মাছের ডিম ভেজে দিলে তো কথাই নেই, বলে – পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার।

বীথি তখন নিজেকে ধমকায় – ‘আর কত?’

দিনে দিনে নিজেকে বাধ্য করেছে প্যাকেটের মাছ কিনে ধোয়া-বাছা করে রান্না করতে।   

তবে দেশি দোকানে বাজার করতে একা যেতে অত ভালো লাগে না। মাছের ফ্রিজের কাছটায় এসে মেছো গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিলে আর দাঁড়াতে পারে না, নাক কুঁচকে দ্রুত সরে আসে।

ইদানীং সামিউলের প্রমোশন হয়ে কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বাসা থেকে কাজ করার স্টিমরোলার চালু হওয়ার পর থেকে সেই যে সকাল থেকে দুটো ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকা পড়ে, সন্ধের আগে ছুটি নেই। আগে সপ্তাহ শেষে দুজনে মিলে কাঁচাবাজার সেরে ফেলতো। আজকাল শনি-রোববারে ওর ক্লান্ত হয়ে ঘুমানো দেখে বীথির মায়া হয়।

কথামতো সামিউলকে আজকে আর ওঠায়নি ঘুম থেকে। নুমায়েরকে সঙ্গে আনা যেত, কিন্তু সে স্কুলের প্রজেক্ট ছেড়ে উঠতে চাইলো না। বীথি একাই দেশি গ্রোসারিতে ঢোকে। মাছের সেকশনটাতে গেলে কেন যেন মনে হয় বুকের ভেতর বাতাস কমে গেছে। কোনোরকমে নাকমুখ বন্ধ করে আঙুল দিয়ে নির্দিষ্ট মাছ দেখিয়ে সরে আসে। দোকানের সহকারী লোকটি টুকরো করে কেটে ব্যাগে ভরে গাড়ির ট্রাংকে তুলে দেবে।

ছুটির দিন বলে বেশ ভিড়। লাইনে তার আগের ক্রেতা আস্ত একটি ফ্রোজেন খাসি ইলেকট্রিক মিটকাটার দিয়ে কাটিয়ে নিচ্ছে।

বীথি সরে দোকানের ঢোকার মুখে চলে আসে। দরজার দুপাশে কাচের দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা মালসামানের আশপাশ দিয়েও দিব্যি বাইরে দেখা যায়।  

কোমলগান্ধার সুরের মতো একটা দিন – একটা অকারণ উপমা মনে আসে। রাগসংগীত শুনতে শুরু করেছিল একসময়, মন শান্ত করার থেরাপি। ইতস্তত মানুষ আসছে, যাচ্ছে। জুলাই মাসে মানুষের দেহ-মন খোলতাই হওয়ার রেশ স্পষ্ট। এই দেশি দোকান মেট্রো স্টেশনের কাছে বলে সবসময় ভিড়, বিক্রি বেশি হয় বলে সবকিছু তাজা টাটকা।

তার পছন্দ করা মাছ কাটতে কিছুটা সময় লাগবে। মেট্রো স্টেশন দেখতে বেরিয়ে পড়ে বীথি। মন্ট্রিল শহরের পাতাল রেলের স্টেশনগুলি নয়নাভিরাম। প্রায় সবগুলিতেই দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল। ঠান্ডা পরিচ্ছন্ন বসার বেঞ্চে বসলে মায়ের কথা মনে পড়ে বীথির। মায়ের হাত সারাজীবন বরফশীতল থাকতো। বীথির জন্য ভাবতে ভাবতে জীবনের প্রতি মমতা কমিয়ে দিয়েছিল তার মা। বড় অসময়ে চলে গেছেন। এখানে কতকিছু যে মাকে দেখাতে পারলে ভালো লাগতো!

অনেকদিন পাতালরেলে চড়া হয় না।

নুমায়ের হাইস্কুল শেষ করলে বাস মেট্রো করেই কলেজে যাবে। আর কয়েক বছর। ছেলেটা তরতরিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে!

মেট্রোর নিচে থেকে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সাগরের তলদেশ উঠে আসার মতো মনে হতো বীথির। সামিউল ঠাট্টা করতো – ‘তুমি তাহলে মৎস্যকন্যা!

কী কী যেন মেরামতি চলছে স্টেশনের ভেতরটায়। গত রাতে কি এজন্যই বন্ধ ছিল? একপাশে তারের জাল দিয়ে আটকানো। নেমে যাওয়ার বৈদ্যুতিক সিঁড়ি চলছে না। ওঠার দিকেরটা যাত্রীতে ঠাসা। সম্ভবত কোনো ট্রেন এসে থেমেছে। যাত্রীরা উঠে আসছে। বীথি একটু সরে দাঁড়ায়। হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেউ কেউ। একজন বাস ধরতে দৌড় দিলো। তিনটি মেয়ে বগলের নিচে হাতে হাত গলিয়ে হাসছে, যেন কেউ ওদেরকে গ্লু দিয়ে আটকে দিয়েছে। তাদের পথ দিতেই কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে ‘সরি, এক্সিউজ মি’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাকিয়েই বীথি স্থাণু হয়ে যায়। স্টেশনের রিভলভিং দরজা ঠেলে ঠেলে মানুষ আসছে, যাচ্ছে। বাইরের বাতাস এসে ভেতরের অল্প ঠান্ডা বাতাসের গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। লোকটা পাল্লা ঠেলে বেরিয়ে গেল।

এই লোক এখানে! কী করে সম্ভব!

দরজা ঘুরছে, ভেতরে-বাইরে। বীথির মনে হলো হাওয়ার সঙ্গে হলকা আসছে। জুন মাসের শুরু, শীত কমে গেলেও হলকা ছড়ানো গরমের দেরি আছে।

লোকটা কি তাকে চিনলো? স্কার্ট-টপ পরা, চুলে হাইলাইটস, চোখে রোদচশমার বীথিকে আগেকার দুবলা-পাতলা লম্বাবেণি সালোয়ার-কুর্তির সঙ্গে মেলাতে অসুবিধে হতেই পারে। সেকেন্ডের ধাক্কা আর চোখাচোখিতে  চুল পরিমাণ চেনা ভাব ছিল কি!

কিন্তু বীথির চিনতে একদম ভুল হয়নি। ওই মুখ সে কী করে ভুলবে। এত বছরের বিদেশবাস, দিনের তুচ্ছ ব্যস্ততার  মধ্যেও ওই ঘটনা কতশতবার ঘুরেফিরে তার চুলের গোড়াসুদ্ধ মুচড়ে গেছে। কতদিন সুনসান দুপুরে বোবার মতো বসে বসে ঘেমেছে। 

সিঁড়ি দিয়ে নামছিল নাকি উঠেছে লোকটা? হাফ হাতা শার্ট। মোটা নাকের পাটা। কনুইটা এক ন্যানো সেকেন্ডে বীথির কাছে সিনেমার পর্দায় দেখার মতো বড় আর জান্তব হয়ে গেল। কনুইয়ের কাছে লম্বা কাটা দাগ, তামাটে কুঁকড়ে থাকা খরখরে ত্বক। বীথি চিনে ফেলল। ওই দাগটা যেন নিশানা, একটা অন্ধকার কানাগলির ভ্যাপসা বাতাসের গন্ধ নাকে ঢোকার আগে চেনা যায় এমন।

চোখা কনুইটা বীথিকে ধা করে পেছনে টেনে নিয়ে নাকের ওপর দিয়ে বীথির চোখের কাছে চলে এলো। লোকটার অন্য হাত চেপে বসেছিল বুকের ওপর, যতক্ষণ না সে শক্তি হারিয়ে অবশ হয়ে পড়ছে। কামড় বসাতে চেয়েছিল বীথি, কিন্তু উলটে কামড় খেয়ে নেতিয়ে পড়ছিল। ছিনতাই করার সময় হাতেনাতে ধরে জনতা যেমন গণধোলাই দেয়, তীব্র যন্ত্রণার উঁচু ঢিবির ওপরে বসে বীথির তখন জনতা হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার হাত বাঁধা, মুখে কাপড় ঠুসে দিয়েছে।  

ঘাটের কাছে মাছের আড়ত বিকেলবেলা এমনিতেই খালি হয়ে যায়, তার ওপর সেদিন বিরোধীদলের ডাকা হরতাল। বীথি তবু চিৎকার করে, ডেকে ডেকে মানুষ জড়ো করে। সড়কি, বল্লম, দা নিয়ে শত শত মানুষ জমে যায়।

প্রাক-সন্ধ্যার আলো নদীর পানিতে প্রতিসরিত হয়ে দা, সড়কির ধারের ওপর আলোকসম্পাত করে। সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়িও এসে পড়ে। কিন্তু কেউ বীথির কথা শুনতে পায় না, তার ছোট্ট শরীরটা লোকটা বাঁ-হাতের থাবায় ভেঙেচুরে দিচ্ছে, শক্ত ডান হাত এলেবেলে হয়ে তার শরীরে ঘুরছে। কেউ বীথিকে দেখতে পায় না। আড়তের টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে মেছোগন্ধী  জোলো বাতাস ঢুকে পড়ে থমকে থাকে। বীথি হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। লোকটা তখন ওর মাথা একপাশে ঠেসে ধরে, বীথি দেখে মাটির চাড়িতে বড় বড় মাগুর মাছ গা রগড়াচ্ছে, তাদের স্ফীত চোখ বীথিকে দেখছে। বীথি জ্ঞান হারায়।

সায়মা ম্যাডাম এসে পৌঁছেছিল পরদিন বেলা দুটোর দিকে। এসে তাকে ওঠানোর আগ পর্যন্ত বীথি শুয়েছিল। জেগেছিল, জেগে জেগে দেয়ালের টিকটিকির সঙ্গে অচেনা একটা পোকার চালবাজি দেখেছে। ঘরের মেঝেতে দৌড়ে যাওয়া ইঁদুর আর তেলাপোকাদের দিকে নির্লিপ্ত চেয়ে ঠেকেছে। জ্বরে ব্যথায় গলার স্বর বুজে গেছে।   

সায়মা ম্যাডামের গবেষণা প্রকল্পে ঢাকা শহরের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

নেত্রকোনার জারিয়া-ঝাঞ্জাইলের একটা গ্রামকে স্যাম্পল এরিয়া করায় সেখানে কাজ বাকি। স্থানীয় টিএনও অফিসে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ব্যাগ গুছিয়ে বাসে উঠে বসলো বীথি। সঙ্গে ফায়সাল আবেদীন,  তাদের প্রকল্পের অ্যাডমিন অফিসার। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে বাজার, রান্নার লোক এবং নৌকা বা রিকশা ইত্যাদি যানবাহনের বন্দোবস্ত। তার ওপর কাজ দিয়ে সায়মা ম্যাডাম নিশ্চিন্তে থাকে।  

চওড়া কাঁধ, ছোট করে ছাঁটা চুল, এই প্রথম বীথি দেখলো, সে মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারে।

কথা তেমন জমে না, কলেজ লাইফে বিয়ে করে ফেলা, ছয় বছরের মেয়েসহ বউয়ের বাপের বাড়ি এই এলাকায়ই। সে কারণেই কি স্যাম্পল এরিয়া এখানে!

– ভাবি-বাচ্চাকে এখানে নিয়ে আসেন একদিন। – গল্প করার বিষয় পেয়ে বীথি উৎসাহী।

– দেখি, আনবো। – এরপর আলাপ শেষ।

বাসা ভাড়া করা হয়েছে কংস নদের পাড়ে, বাজার, অদূরে ঘাট, কাছেই বিশাল মাছের আড়ত। সকাল-সন্ধ্যা সেখানে মাছের ব্যাপারীদের হাঁকডাক। তিন কামরার মেঝে পাকা টিনের বাড়ি থেকে সেসব খুব স্পষ্ট। পেছনের দরজা দিয়ে বেরোলে এক চিলতে বারান্দায় বসে নদীর ওপর সূর্যাস্ত দেখা যায় – এটুকু ছাড়া আর কিছু পছন্দ হয়নি বীথির। এত হই-হট্টগোলে থাকতে হবে! সায়মা আপা এসে এখানে থাকতে পারবে?

ফয়সাল গম্ভীর হয়ে বলে –

‘এ-অঞ্চলে এর থেকে ভালো বাসা নাই।’

কোনো সরকারি গেস্ট হাউস বা বাড়ি? সরকারি নির্বাহী, যার সঙ্গে তাদের দেখা করার কথা, বীথি সে-প্রসঙ্গ তুলতে বলে – ‘উনি সন্ধ্যাবেলায় আসবেন’।

– সন্ধ্যাবেলায় আসবেন মানে?

– আমাদের সঙ্গে একটু আড্ডা দেবেন।

বীথি এবার গলা শক্ত করে কথা বলে।

– আমরা কাজে এসেছি। সরকারি অফিসারের সঙ্গে তার অফিসে দেখা করবো। তার তো এই বাসায় আসার দরকার নাই। আর আপনি আমাকে আগে থেকে এসবের কিছুই বলেন নাই কেন?  

লোকটা এলে বীথি সামনে যায়নি। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিল। ফয়সালের সঙ্গে জমে ওঠা আড্ডা, খাওয়াদাওয়ার শব্দ, কথাবার্তা, হাসি সব কানে গেছে।

এমনকি যাওয়ার আগে উঁচুস্বরে বলা – ‘আপনাদের কলিগ এমন অহংকারী কেন? আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিলে কি তার জাত যাবে?’ বাক্যটাও বীথি শুনেছে।

ফয়সাল দরজায় শব্দ করে ডেকেছে – ‘আসেন, অন্তত পরিচিত হন।’

গায়ে শাল জড়িয়ে বের হয়েছিল বীথি। বিশেষত্বহীন পরিচয়পর্ব। সামান্য একটুক্ষণ। তারপর হোন্ডা স্টার্ট দেওয়ার শব্দ মাছের আড়ত পার হয়ে মিলিয়ে গেছে। 

পরদিন সারাদেশে হরতাল, সেইসঙ্গে সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। সমীক্ষার প্রশ্নমালা নিয়ে নির্দিষ্ট গ্রামটিতে যাওয়ার কথা ছিল। হরতালের জন্য রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না – এই মর্মে গ্রামে যাওয়া স্থগিত রেখে ফয়সাল বউ-মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেল।

সারাদিন শুয়ে-বসে কাটিয়ে বিকেলে বৃষ্টি থেমে গেলে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল বীথি। হরতালের কারণে লোকজন নেই। হাট, ঘাট দুই-ই সুনসান।

ঘাটের দিকটায় অন্যান্য দিনে এত সরগরম থাকে যে বেরোতে অস্বস্তি হয়। আজকে বীথি হাঁটে। মাছের আড়তের সামনে দিয়ে  কাঠের পাটাতনঅলা জেটির দিকটায় যায়। কংস নদে বৃষ্টিধোয়া সূর্য ডুবে যাচ্ছে। এমন সূর্যডোবা দেখলে অকারণে বুকের ভেতর হু-হু করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসতে নেয় সে, মাছের আড়তের সামনে দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা পানি-কাদা এড়িয়ে পা টিপে টিপে হাঁটে। তখনই তার সামনে ঘ্যাচ করে মোটরসাইকেলটা থামে।

সায়মা আপা পরদিন দুপুরে পৌঁছে বীথিকে অচেতন পেলেন, গা পুড়ে যাচ্ছে। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বীথিকে নিয়ে গাড়িতে তুললেন, এবং ঢাকা ফিরে এলেন।  

সায়মা আপা পুলিশ কেইস করার পক্ষে ছিলেন। বীথি নিজেও। একজন আইনজীবীর সঙ্গে মিটিং হলো।

আলামত, প্রমাণ কিছু নেই। ঢাকা থেকে গিয়ে মফস্বলের একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ কতটা ধোপে টিকবে, এই নিয়ে সংশয়ের দোলাচল বাড়ে। বীথির শরীর ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে, বিছানা থেকে উঠতে পারে না। জ্বরে মাঝে মাঝে ভুল বকে, অনেকগুলি মাগুর মাছ তার ঘাড়, গলা রগড়ে দিচ্ছে। ঘেয়ো, পিচ্ছিল একটা অনুভূতি নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে বীথি।

এর মধ্যে সায়মা আপা জাপানে একটা স্যাবাটিক্যালে চলে গেলে পুরো বিষয়টা অনিশ্চয়তার সমুদ্রে পড়ে যায়।

তারপর বহুদিন কেটে গেছে – যেসব দিনের কথা কিছু মনে পড়ে না বীথির। শুধু মাছ, মাছের গন্ধ নাকে গেলে বমি পায়। নাড়িভুঁড়ি উলটে আসে।

পরিত্রাণ কেউ খুঁজে দেয়নি। নিরবচ্ছিন্ন রুটিন করে কাজ করে যাওয়াতেই পরিত্রাণ খুঁজেছে এতদিন। বাসায় এত ঘরদোর সাফ করে সে যে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে।

গতকালের আধাবেলা যেমন ইচ্ছে কাটাতে পেরে মন কেমন শান্ত লাগছে। তথ্যটা তার ডাক্তারকে জানাতে হবে, এ-যাবত যাকে অকপটে নিজের কথা বলতে পেরেছে।

বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি পার্ক করে বীথি বাজারের ব্যাগ হাতে গেট ঠেলে লিফটের সামনে এসে দাঁড়ায়। লিফট নামছে নিচে।

তাদের পাঁচতলায় থামলো। আবার নিচে নামছে।

দরজা খুলে গেলে বীথি একপাশে দাঁড়ায়, ওটাই দস্তুর। ভেতর থেকে মানুষ বেরোতে দিতে হবে।

কথা বলতে বলতে মুন্না বেরিয়ে এলো, সঙ্গে ওই লোকটা!

লিফটের সামনে চারপাশ যেন চেপে ছোট হয়ে আসছে। অদৃশ্য কোনো জোঁক এসে বীথির মুখ থেকে সব রক্ত শুষে নিচ্ছে।