বাসনার তেল ও সোনামুখী নদী

একটা বাসনার তেল আইনেন, মেলা দিন অইচে চুলে কোনো তেল দেই না, চুলগুলা জট বাইন্দা যায়, আঁচড়াইতে গেলে চুল ছিঁইড়া যায় – সামনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আবদার জানায় জরিনা।

পানমুখে পিক ফেলতে ফেলতে উঠোনে নামে জহির আলী, এক কাঁধে মাছ ধরার জাল আর এক কাঁধে বৈঠা। স্ত্রীর আবদারে ফিরে তাকায়। জরিনা তাকিয়ে আছে। জহির মুখে হাসি এনে ঘাড় কাত করে, আইচ্চা।

জহিরের হাসিতে জরিনার মুখেও হালকা হাসি ফোটে, তাড়াতাড়ি আইবেন। হারাদিন নদীতে থাইকেন না।

জহির আবারো পেছনে ফিরে তাকায় এবং সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। কিন্তু সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জহিরের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। বড় আশা করে জরিনা বাসনার একটা তেল চেয়েছে, দিতেও রাজি হয়েছে, কিন্তু কীভাবে দেবে? অনেকদিন কেনা হয় না বাসনার তেল। দাম কেমন? চারদিকে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে! একটা দীর্ঘশ^াস বের হয়ে আসে জহির আলীর নাক চিরে। বিয়ের সময়, তাও দশ-বারো বছর হবে, নতুন কাপড়, গয়না, সাবান, জুতোর সঙ্গে একটা বাসনার তেলের বোতলও দিয়েছিল। সেই প্রথম এবং শেষ। আর কেনার মুরোদ হয়নি। জরিনা খুব লক্ষ্মী মেয়ে, সংসারের টানাটানি দেখে কখনো কিছু চায়নি। এতদিন পরে একটা বাসনার তেল  চেয়েছে … বুকটার মধ্যে কেমন একটা

ইঁদুর-বিড়ালের কামড়াকামড়ি যন্ত্রণা অনুভব করে জহির আলী। সিদ্ধান্ত নেয়, যা থাকে কপালে আইজ একটা বাসনার তেল আনবোই বউয়ের লাইগা।

প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হতে হতে চলে আসে জহির আলী সোনামুখী নদীর পাড়ে। বাড়ি থেকে সোনামুখীর দূরত্ব হাঁটাপথে বিশ-পঁচিশ মিনিটের। নদীর তীরে আসতেই চোখে পড়ে নিবারণ কর্মকার আর জলিল মৃধার নৌকা তৈরি হচ্ছে। তীর থেকে পাড় ভেঙে নামছে পাশের গ্রাম ইছাপুরের মমিন। মমিন মাঝারি আকারের হলেও নদীতে জাল আর নৌকা নিয়ে বের হলে মাছ পাবেই, অন্যরা না পেলেও। লোকে বলে, মমিনের জন্ম মাছের গোনে। উজানগাঁও গ্রাম, আশপাশের গ্রামের মহাজন জেলেরা চায় মমিনকে নিজের নৌকায়। চাহিদার কারণে মমিন নিজের দাম বাড়িয়েছে – প্রতিদিন দুশো টাকা। মাছ পেলেও দুশো, না পেলেও দুশো।

নিজের নৌকাটা জহিরের অনেক পুরনো, আলকাতরা-গাবের কষ মেখে মেরামত করা দরকার। কয়েক জায়গায় ফেটে গেছে। একটু পরপর পানি সেচতে হয়। কিন্তু কীভাবে কী করবে ভেবে পায় না, মাছ তো আজকাল পাওয়া যায় না জালে। জীবনে জাল আর মাছ ধরা ছাড়া কিছুই শেখায়নি বাপ ফজর আলী।

কই আহো! নৌকায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেয় নেয়ামত কলু।

উজানগাঁওয়ের পাশের গ্রাম ভাটিরগাঁওয়ে নেয়ামত কলুদের বাড়ি। ওরা নামের সঙ্গে কলু পদবিটা পছন্দ করে না; কিন্তু মানুষজন পছন্দ করে।  নিয়ামতের বড় ভাই মকবুল কলুকে কলু বললেই চিৎকার করে ওঠে, ওই হুমুন্দির পুত আমরা কবে কলু আছিলাম? আমাগো বংশ হইলো চকিদার।

মানুষ আরো হাসে, আরে বেটা তুই নানার বংশ লইয়া টানাটানি করো ক্যান?  তোর নানায় আছিল চকিদার। কিন্তু তোর দাদায় আছিল কলু।

আরো চেতে যায় মকবুল, কলু না হয় আছিল দাদায়। আমরা তো না – আমরা তো এহন সোনামুহি গাঙ্গে মাছ ধইরা খাই। আমাগো কলু ডাহো কেনো?

এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। থাকে না। মানুষ মজা পায় ওরা যখন কলু বংশের প্রতিবাদ করে, সেই মজার কারণে যখন-তখন ডাকে কলুর ভাই কলু। নেয়ামত কলুর ডাকে দ্রুত নিচে নেমে আসে জহির আলী। নৌকার কাছে এসেই কাঁধের জাল নৌকায় রেখে পাছা তুলে বসে। পায়ের কাদা পানির তোড়ে ধুয়ে ওপরে পা তুলে বসতে বসতে নৌকা ছেড়ে দেয় নেয়ামত কলু। নৌকার মাঝখানে বসে জালের ছেঁড়া-ফুটা সেলাই করছে নবীন ঘোষ। নবীন ঘোষ নৌকায় নতুন। গতকাল থেকে আসছে নৌকায়। উজানগাঁও গ্রামের শেষ প্রান্তে নবীন ঘোষের বাড়ি। বাবা নেই – মা আর একটা বোন নিয়ে সংসার।

– নবীন? 

– জে কাকা! কচি মুখ তুলে তাকায়।

– জাল সেলাই বন্ধ রাহো। নদীর জোয়ার আইতেছে – দাড় বান্দো, হালকা স্বর জহির আলীর।

– আইচ্চা।

সেলাই রেখে নৌকার পেছনে বসে দাঁড় টানতে শুরু করে নবীন ঘোষ। নৌকা মাঝ কচা নদীর দিকে ছোটে। সূর্য মাথার ওপর উঠছে, জোয়ারের স্রোতও বাড়ছে, জাল ছাড়তে শুরু করে নেয়ামত কলু আর জহির আলী। দাঁড় বাইছে নবীন ঘোষ। জাল নদীতে ছাড়ছে আর তলিয়ে যেতে যেতে ভাসমান প্লাস্টিকের ফাঁপা বেলুনের জন্য সরাসরি জাল তলিয়ে না গিয়ে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকে জলের স্রোতে। জাল ছাড়া শেষ হলে অনেক জালের নৌকার সঙ্গে ধীরলয়ে দাঁড় বাইতে থাকে নবীন।

– দাদা? ঝিমুচ্ছিল জহির আলী।

– কী রে নবীন? ছেলেটাকে কেমন যেন মায়া লাগে ওর। পেটের দায়ে পড়ালেখা ছাইড়া মাছের নায়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

– সোনামুহি নদীটা নাহি আরো বড় আছিল?

একটা দীর্ঘশ^াস বেরোয় জহির আলীর বুক চিরে, আছিল তো। আমিই নদীর এই পার দিয়া ওই পারে কিছু দেহি নাই। ধুয়া ধুয়া লাগতো। নদীর মাঝখানে একখান চর আছিল নামার দিকে। শীতকালে সেই চরে যাইতাম আব্বার লগে ফাঁদ পাইতা বক মারতে। চরের পানি হুকাইয়া গেলে অনেক মাছ পাইতাম – সেবা জালে। সেই চরও নাই – নদীও নাই। যে সোনামুহি নদী দেখতে পাইতেছো নবীন, আমার ছোটকালে দেহা নদীর অর্দেকেরও কোম। হাসি ফোটে জহির আলীর মুখে, এইডারে এহন আর নদী মনে কয় না। খাল কইলে ভালো অয়।

নবীন ঘোষের মাথায় ঢোকে না, সেই এত বড় নদী গেল কই? নদী কী নদীরে খাইয়া হালায়? লোকমুখে শুনেছে এই নদীর পানি কৈলাস পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে। কোথায় কৈলাস পাহাড়, কোথায় নদীর বাড়ি-ঘর-ঠিকানা কিছুই জানে না, কিন্তু নদীর দিশাহারা জলের স্রোত খুব অবাক হয়ে দেখে নবীন ঘোষ – কোথা থেকে আসে এত জল?

– তাইলে  নদীটা চিকন হইলো কেন?

দীর্ঘশ^াস বের হয় জহির আলীর, রাজনীতির কারণে অইচে রে, রাজনীতির কারণে। রাজনীতি আমাগো খাইয়া  ফেলতেছে।

নবীনের মাথায় ঢোকে না, নদীর লগে রাজনীতি মেলে ক্যামনে?

– আমাদের এই সোনামুহি নদী আসছে ভারতের ভেতর দিয়া, অনেক নদীর লগে মিলমিশে। কিন্তু ভারতের সরকার ফারাক্কা নামক একটা জায়গায় অনেক বড় বাঁধ দিচে। বাঁধ দিলে নদীর পানি থাইমা যায়, নিচের দিকে আইতে পারে না। পানি নিচের দিকে না আইতে পারলে কী অয়? স্রোত কমে যায়, নদীর গতি হারাইয়া যায়। মাছ কমে যায়। খালি সোনামুহি নদী না, ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের দেশের অনেক নদীর এখন মরণদশা। বিরাট পদ্মা নদী  পেরায় মইরা গেচে। নদী মইরা গেলে মানুষও মরে – দেকতেছো না চোখের  সামনে, যেমন মরতেছি আমরা।

বিড়িতে লম্বা টান দিতে দিতে পাছায় হাল ধরা নেয়ামত কলু হাসে, ভাই তুমি এই কচি পোলাডারে কী বুঝাইতেছো? ও কি বোঝবে? অর তো মাতাডা আউলাইয়া যাইবে। নাও, একটা বিড়ি ধরাইয়া টান দাও।

বিড়িটা হাতে নিয়ে জহির আলী টান দেয়। লম্বা টানের ধোঁয়া উগড়ে দিতে দিতে বলে, নেয়ামত! তোমার কতাটা ঠিক না। রাজনীতিটা আমাগো বোঝা উচিত। আমার আব্বা কিন্তু  নদী, পানি ও মাছের রাজনীতিটা বোঝাইতে চাইছিল আমাগো, কিন্তু আমরা বুঝতে চাই নাই। হের কতায় কান দেই নাই। মানুষটারে লোকে পাগল কইতো। আমার এহন কষ্ট অয়।

অনেক দূর থেকে দেড়তলা একটা লঞ্চ আসছে। লঞ্চটা পাশ কেটে চলে যাওয়ার সময়ে ঢেউয়ে নৌকাটা দুলতে থাকে। দুলুনিটায় মজা পায় নবীন। হাসে।

– দেখচেন জহিরভাই?

– তাকায় জহির, কী দেখমু?

– লঞ্চটা বোঝাই যাত্রী। যদি ডুইবা যায় … শেষ করে না নেয়ামত, নৌকায় পাছায় বসে বৈঠা আগলে ঢেউয়ের

ধাক্কা সামলায়।

– ডুইবা গেলে তো সবাই মইরা যাইবে, নবীনের গলায় উৎকণ্ঠা।

ঢেউ অনেকটা কমে আসে, নৌকার দুলুনিও নেই। পায়ের গোড়ালি দিয়ে বৈঠা আটকে রেখে নেয়ামত বিড়ি ধরায়, সুখে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া উগড়ে দেয়, নবীন মোরা তো জন্মাইচি মরার জন্য। বাঁইচা আছি, তোমারে কেডায় কইচে? মইরা বাঁইচা আছি। আর লঞ্চ ডুইবা মরলে অসুবিধা কী? মরলে জনপ্রতি একটা ছাগল তো পাওয়া যাইবে। বলতে বলতে হাসে খিখিখি – একটা মানুষের জীবনের বিনিময়ে একটা ছাগল! কী চমৎকার দ্যাশ আর দ্যাশের রাজনীতি গো!

– নেয়ামত?

– কও ভাই।

– বাসনার তেল কই পাওয়া যায়?

থমকে যায় নেয়ামত কলু, বাসনার তেল?

– হ, বাসনার তেল।

– কিন্তু হেইডা আবার কী?

– বাসনার তেল অইলো মাথার চুলে দেয় যে তেল। মিষ্টি গন্ধ আসে। আমার মহুয়া দিদি মাথার চুলে বাসনার তেল দেয় – নিজে নিজে বলে নবীন ঘোষ।

হিহিহি হাসে নেয়ামত, বুঝতে পারছি  বাসনার তেল কারে কয়। ভাত জোটাইতে পারি না, বউ মাথার চুলে মাখবো বাসনার তেল! নিজের নিপীড়িত রসিকতায় আরো হাসে নেয়ামত কলু।

– নবীন, কও তো  বাসনার তেল

কোথায় পাওয়া যায়?

– উজানগাঁও বাজারের মতি মিয়ার দোকানে পাওয়া যায় কাকা। তয় দাম বেশি নেয় একটু। ভান্ডারিয়া  যে তেলের বোতলের দাম আঠারো টাহা, মতি মিয়া হেই বোতলের দাম রাহে বাইশ টাহা, জহিরের প্রশ্নের উত্তরে নবীন।

– ওই জহির মিয়া, মাছের খবর কী? নৌকার সামনে দিয়া মাছের ব্যাপারী জয়নাল ছোট্ট নৌকায় যেতে যেতে প্রশ্ন করে।

– জাল তো ফেললাম, ভাটার মুখে টান দিমু। আইসেন –

– আইচ্ছা! ছোট নৌকায় নিজের মনে বাইয়া চলে যায় সামনের নৌকায়, যদি অন্য নৌকায় মাছ পাওয়া যায়।

– জানো, আব্বার লগে এই জয়নাল মিয়ার অনেক খাতির আছিল, দুপুরের সূর্য মাথার ওপর থেকে কিছুটা পশ্চিমে হেলান দিয়েছে। ফুরফুরে বাতাস সোনামুখী নদীতে – গল্পে পেয়ে বসে জহির আলীকে, তোগো মনে নাই নেয়ামত, তুইও তহন ছোট। মওলানা ভাসানী ফারাক্কা নদীতে বাঁধের বিরুদ্ধে বিশাল মিছিল করছিল। আব্বায় এই এলাকা দিয়ে অনেক মানুষ লইয়া যোগ দিছিল। কইতো, এহন বুঝতে পারতেছো না; কিন্তু এই ফারাক্কার বাঁধ একদিন মরণফাঁদ অইবে। নদীর পানি শুকাইয়া যাইবে। নদীতে চর পড়বে। মাছ কুইম্ব্যা যাইবে। মুহে ভাত জোটবে না। ফারাক্কার বাঁধ ফেরাইতে অইবে।

– মাইনষে তো ফজর চাচারে পাগলা ফজর কইতো!

– হ্যাঁ বাপটা আমার একটু পাগলা কিসিমেরই ছিল। নদীর পানিতে কোনোদিন প্রস্রাব করে নাই, কইতো কত মানুষ নদীর পানি খায়, হেই নদীতে প্রস্রাব করি কেমনে? প্রস্রাব লাগলে পাড়ে নৌকা ভিড়াইয়া কুলে উইঠা প্রস্রাব কইরা আবার নৌকায় উঠতো – বাপের স্মৃতির জালে ঢুকে যায় জহির আলী। কিন্তু ওই রহম মানুষ আর কই? বাঁইচা থাকনের সমায় বাপটারে বুঝতে পারি নাই। মাইনষের লগে গলা মিলাইয়া আমিও কইচি, পাগলা ফজর! গলাটা ধরে আসে জহিরের, মনটা উদাস হয়ে যায়। শালার ধুইন্না পাতার জীবন রে, ধুইন্না পাতার জীবন … এই জীবনরে রাইখা তুমি কোতায় যাও যৌবন …। জহির ভাঙা গলায় টান দেয়।

– আপনের বাপে তো গান গাইতো!

নবীনের কথায় পাল্টা প্রশ্ন করে, তুমি কেমনে জানলা?

– মায়ে কইচে। প্রত্যেক ভরা পূর্ণিমার রাইতে নৌকায় গান গাইতো আপনের বাবা। লগে আমার বাবাও থাকতো।

হাসে জহির আলী, খালি তোমার বাপ হরিহর কাকা একলা না, গ্রামের

পনেরো-বিশজন নৌকায় চইড়া সারা রাইত গান করতো, হাসতো, ঢোল বাজাইতো – নাওয়ের দুই পাশে বইসা পাও ডুবাইয়া গান গাইতো – ওগো  মোর মন দরিয়া … কোথায়  যাও ভাসিয়া …।  সেইসব দৃশ্য দেখলে মনটা কেমন যে কইরা উঠতো – সোনামুখী নদীর মাঝ দিয়া যাইতেছে জালের বিরাট নৌকা, আসমানে খলবল কইরা হাসতেছে চাদের মিহিন আলো – নদীটা তখন বিছানা অইয়া যাইতো। আমি কয়েকবার লগে ছিলাম। মায়ে আইতে দিতে চাইতো না, আব্বা জোর কইরা আনতো – কইতো মানুষের লগে, জলের লগে, জোছনার লগে থাকতে দাও। পোলার মনটা বড় অইবে …।

জহিরভাই, তুমি ভুইলা গেছো, আমিও আইছিলাম নৌকায়, জোছনা রাইতে। ইলিশ মাছ আর চাইল রান্না করছি আমি … স্মৃতির ভেতর স্মৃতির পসরা নিয়ে ঢুকে যায় নেয়ামত কলু। জীবনে অনেক ইলিশ মাছ রানছি, খাইচি  কিন্তু ফজর কাকার নৌকায় জোছনা রাইতে জোছনার মইধ্যে হেই ইলিশ মাছের স্বাদের কোনো তুলনা নাই। মুখে সেই স্বাদ লাইগা রইছে।

জানো, আমি যহন আব্বার লগে নৌকায় থাকতাম – কত কতা যে কইতো। কান ঝালাপালা অইতো – খুব বিরক্ত অইতাম। এহন বুঝি – আব্বা আমারে না, আমার লগে দুনিয়ার মানুষ, গরু, পশু, পাখি, নদী, নদীর জল, মাছ, গাছপালা সবই ভালোবাসতো। কইতো, বাজান দুনিয়ার একটা ছোট ঘাসও ফেলনা না, কারণ ছাড়া একটা ঘাসও ছিঁড়বা না। ছিঁড়লে ঘাসেরা কিন্তু কান্দে – ব্যথা পায়।

আমি হাসতাম, আপনারে কেডা কইচে ঘাসেরা ব্যথা পায়? কান্দে?

ঘাসের যদি পরান না থাকতো, শক্ত মাটির বুক চিইরা ওঠে কেমনে? তনতনা সবুজ রং কই পায়? জীবন না থাকলে অইতে পারে না বাজান – আরো একটা বিষয়ে প্রায়ই কইতো আব্বা,আমরা তো কাটাইয়া গেলাম জীবন হাইসা-খেইলা। চিন্তা তোমাগো লাইগা!

– আমাগো লাইগা চিন্তা ক্যান?

– বাজানরে, পরিস্থিতি যা অইতেছে, সেটা মারাত্মক। বাড়ির সামনের এই নদীর পানিতে টান ধরছে, খেয়াল করচো?

– টান ধরছে মানে?

– সোনামুহি নদীর স্রোতের লাগাম টাইনা ধরছে ফারাক্কা। আগের চাইয়া স্রোত কম। মাছও কম পড়তেছে। দিনে দিনে সোনামুহি নদী ছোট অইয়া যাইবে, মাছ কুইমা যাইবে – আমাগো মুহে  আগের মতোন খাবার দিতে পারবে না সোনামুহি।

– দূর আব্বা! কি যে কও তুমি? এত বড় নদী ছোট অইবে ক্যামনে?

দীর্ঘশ^াস ছাড়েন ফজর আলী, বাজান উজানের দেশ যদি শক্তিশালী অয়, তারা পানি না দিলে কী করবা? চেঁচামেচি করা যায়, মিছিল করা যায়, সেøাগান দেওয়া যায় – কিন্তু কামের কাম কিছু অয় না। তুমি দেখতে পাইতেছো না – অনেক দূরের নদী, খাল, বিলের পানিতে টান ধরছে – যে-বিলে বুকসমান পানি, সেই বিলে পানি এহন হাঁটুর সমান। সামনে বড় দুর্দিন জলের মাছের মানুষের।

– এহন তো ফজর চাচার কতাই সত্য মনে অইতাছে, দূরে সোনামুখী নদীর স্রোতে দৃষ্টি রেখে আপন মনে বলে নেয়ামত কলু।

ঢেউ ছাড়া শান্ত নদীতে হঠাৎ নৌকাটা দুলে ওঠে। চমকে তাকায় নেয়ামত আর নবীনের মুখের দিকে। ওরা নির্বিকার। হঠাৎ জহির দেখতে পায়, সোনামুখী নদীর মাঝখানে মাছ ধরা নৌকায় বসে তামাক টানছে পিতা ফজর আলী। শরীরে ফুল হাতার সাদা গেঞ্জি। মাথায় কালো কুচকুচে চুল। শরীরের তুলনায় ঘাড়টা একটু ছোট।  আগাগোড়া দোহারা শরীর। মুখে স্মিত হাসি। দুপুরের পরের সূর্যের আলোয় নদীর পানিতে একটা মেটে রং ধরেছে, সেই রঙের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে দাঁড়ায় জহির আলী – নবীন? নেয়ামত?

ওরা চমকে ওঠে, কী অইচে ভাই?

– দেখচো? দেখচো বাজানে নৌকায় আইছিল!

– কী কও তুমি? মাতা খারাপ অইচে তোমার? চাচায় মরছে কমসে কম বারো বছর – আর তুমি কও সোনামুহি নদীতে তোমার নৌকায় আইচে এহন ফজর চাচা?

– আরে! আমি নিজের চোখে দেখলাম – নৌকার মাঝখানে বইসা পা ঝুলাইয়া দিয়া হুঁকা টানতেছে আব্বা গুরুম গুরুম গুরুম …। এক মুখ ধোঁয়া ছাইড়া আমারে কইলো, আমার কতা তো তহন বিশ^াস করো নাই বাজান, এহন কেমন লাগতেছে?

– বুঝতে পারছি!

– কী বুঝতে পারচো?

– বাপের স্মৃতি তোমাকে পাইছে ভালো কইরা। নবীন, জাল টানার গোন অইচে, টান দে –

নেয়ামত কলু আর নবীন ঘোষ নদীর বুক থেকে ধীরে ধীরে জাল টেনে তুলছে। জাল টেনে টেনে নৌকার পাটাতনে রাখে। মোট জালের অর্ধেকের বেশি টানা শেষ – ছোট ছোট দুটি ইলিশ জালে ধরা পড়েছে। পেছনে বসে জহির আলী বাজপাখির চোখে তাকিয়ে জালের দিকে, জাল ভরে মাছ উঠলে মাছ বিক্রি করে জরিনার বাসনার তেল কিনে বাড়ি ফিরবে ফজর আলীর পুত্র জহির আলী। জাল টানছে, জহির আলীর দৃষ্টি প্রখর থেকে প্রখর হচ্ছে – কিন্তু মাছ আর উঠছে না। জালের শেষ প্রান্তটুকুও টেনে তোলে নবীন আর নেয়ামত।

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। বিষণ্ন বিকেলের সঙ্গে মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা কাক উড়ে যায়। উড়ে যেতে যেতে কাকগুলি খুঁজছে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া মরা। সেই মরা হতে পারে মানুষের বা হতে পারে কোনো প্রাণীর কিংবা হতে পারে একটা বাসনার তেলের বোতলের। যে বাসনার তেল এলোচুল ছড়িয়ে মাখবে কোনো এক জরিনা।