দুই জীবনকাহিনীর যুগলবন্দি

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সিদ্দিকা জামানের লেখা আলোচ্য বইটি পড়তে পড়তে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, এমন অনুপম গদ্যরীতি তিনি আয়ত্ত করলেন কী করে, তাঁর প্রথম লেখা বইটিতে? আরো আফসোস হচ্ছিল এ-কথা ভেবে, এই অনবদ্য লিখনশৈলী নিয়ে তিনি আত্মগোপন করে পাঠককে বঞ্চিত করলেন কেন এতো দিন?

এসব আক্ষেপ-আফসোস-দীর্ঘশ্বাস সরিয়ে রেখে দেখার চেষ্টা করা যাক বরং নয়টি সুবিন্যস্ত অধ্যায়ে সাজানো তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের স্তর-স্তরান্তর, এবং পাঠকের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কোথায় এবং কতখানি।

গ্রহণযোগ্যতা তো অবধারিতভাবেই আছে, কেননা বইটিতে যাঁর কথা বারবার আছে তিনি হলেন বাংলাদেশের বাতিঘর প্রয়াত (২০২০ সালে ১৪ মে) ড. আনিসুজ্জামান। বইটি আসলে স্বামী-স্ত্রী, এই দুজনের জীবনকাহিনির যুগলবন্দি। সিদ্দিকা স্বয়ং অর্ধনারীশ্বর হয়ে দুজনের জীবনের সারাৎসার একই সুতায় গেঁথে দিয়েছেন।

সে-কারণে এমন আত্মজীবনী বস্তুত দুর্লভ। বিখ্যাত ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যজীবনের অনুপুঙ্খ ধরা আছে তাঁর বোন ডরোথির তথ্যানুসন্ধানী এবং কৌতূহলসঞ্চারী লেখায়। তেমনি মেরি শেলি পরম আপ্তসহায়কের মতোই যেন কবি শেলির কাব্যরচনার পশ্চাৎপট উপহার দিয়েছেন; কিন্তু তাঁরা কেউই আত্মজীবনী লেখেননি।

বইটির সঙ্গে বরং তুলনা করা চলে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী জীবনের জলচ্ছবির। আবার বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনীতেও পরিপূরকতা রয়েছে এর। অনুরূপ সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হকের আত্মজীবনীও স্বামী-স্ত্রীর কথায় ওতপ্রোত। স্বামী-স্ত্রীর বা স্ত্রী-স্বামীর গতানুগতিক বয়ান পরিবেশন করলেই তাকে পরস্পর-পরিপূরক বলা যাবে না-মনে রাখতে হবে, পরস্পর পরিপূরকতার আরেক উজ্জ্বল উদাহরণ সত্যজিৎ রায়-জায়া বিজয়া রায়ের আত্মজীবনী আমাদের কথা।

বইটির ভূমিকায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যা বলেছেন, তা আমাদের মতকেই সমর্থন করে, ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের শিরোনামে আছে যে পৃথিবী, সিদ্দিকা জামান তাঁর স্মৃতিকথায় তাঁকে নিজের করে নিয়েছেন, বইটির নাম দিয়েছেন আমার বিপুলা পৃথিবী। এই পৃথিবীটি অবশ্যই তাঁর, কিন্তু এর মাঝখানে আছেন আনিসুজ্জামান।’

সিদ্দিকা তাঁর গ্রন্থটি শুরু করেন একেবারে শেষ থেকে, ‘প্রায় ৫৯ বছরের বিবাহিত জীবন আর ৬১ বছরের পরিচয়ের মায়া কাটিয়ে আমাকে একাকী করে আনিসুজ্জামান চলে গেল ২০২০-এর মে মাসে’ (১৪ মে)। এরপর সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো পর্যায়ক্রমে তিনি মেলে ধরবেন তাঁর স্বনামধন্য স্বামী ও তাঁর পরিবার-পরিজন, স্বসময়ের কথা। অবশেষে সম্  –  এ এসে থাকবেন তিনি ওই ২০২০-এর ১৪ মে’তে। প্রায় নিপুণ ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটনার বিবৃতি দিয়ে গেছেন তিনি। যেন মহাভারতের উদ্গাতা জনমেজয়। কখনো তিনি জনমেজয়, কখনো সঞ্জয়, আবার কখনো বৈশম্পায়ন।

আবেগ ও নির্লিপ্তির দ্বৈত কারুকাজ লক্ষ করি তাঁর লেখায়। নির্লিপ্তি বলছি এই কারণেই যে, গোড়াকার মাত্র তেরোটি বাক্যের মধ্যেই আনিসুজ্জামানের সঙ্গে লেখিকার ফুফাতো ভাইয়ের মাধ্যমে দুজনের পরিচয়, একজন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন, আর অন্যজন ইডেন কলেজের ছাত্রী, কিছুদিনের মধ্যে পূর্বরাগপর্ব, যার শুরু নাজিমুদ্দিন রোডের রেডিও অফিসের সামনে এবং দুই বাসাতে টেলিফোন থাকায় তার সুযোগ গ্রহণ করা, অল্প হলেও চিঠি-চালাচালি, আর ১৯৬১-র পয়লা অক্টোবর তাঁদের বিয়ে, সব এক নিশ্বাসে, আবেগহীন, নিরলসকৃতভাবে বলে ফেললেন। এখানে তিনি পাঠককে ভাবনার পান্থশালায় দাঁড় করিয়ে তুমুল মজা উপভোগ করছেন মনে হয় : আচ্ছা, প্রথম দর্শনের দিন কালনিরবধি বা আমার একাত্তর যিনি লিখবেন, তাঁর পোশাক কী ছিল? তাঁর হাতে কি নিরেট ক্লাসনোটস না পুষ্পস্তবক, নিদেন একটি ফুল ছিল? টেলিফোনে কথোপকথন কখনো কি অভিভাবকবিঘ্নিত হয়নি? চিঠি! আহা, উভয়ে উভয়কে কী বলে সম্বোধন করতেন চিঠিতে? এ-মতো ভাবনার ভাস্কর্য আমাদের ঘিরে ধরে। আনিসুজ্জামান কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন গল্পও। (তাঁর একটি অন্তত ’৫৩-র সংকলনে ধরা আছে), সারাজীবন চিঠি তো তাঁকে লিখতে হয়েছে প্রচুর। সেসবের হদিস আছে হয়তো প্রাপকের কাছে। সিদ্দিকাকে লেখা চিঠির বেহাগ ও মন্দাক্রান্ত কি আমাদের কল্পনা দিয়েই ভরাতে হবে?

 বইটির প্রথম পৃষ্ঠাতেই সিদ্দিকা গৃহস্থা-শ্রমে এসে পড়লেন। আসলে দুজনের জীবনের যৌথ যাত্রারম্ভ দিয়েই গ্রন্থসূচনা। গ্রিক পুরাণোক্ত আফ্রোদিতি জন্মেছিলেন প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে। এখানেও লেখিকা শুরু করলেন নিজের দাম্পত্য ও সংসার যাপন দিয়ে। যদিও পরে তাঁর অতীতচারিতায় তাঁর প্রাক্-বিবাহিত জীবনের কিছু বার্তা পাব। তবে এখানে কিছু কৃপণতা আছে তাঁর।

খুব ঘরোয়া মেজাজে ঘটনার বয়ান দেন তিনি। উপস্থাপনায় কোনো জড়তা নেই, বরং অনায়াসে পাঠকসন্নিভ হয়ে ওঠেন তিনি একেবারে গোড়া থেকেই।

জন্মেছিলেন প্রগতিশীল পরিবারে। সিদ্দিকার পিতা ছিলেন ঞযব ঝঃধঃবংসধহ নামীয় কলকাতা থেকে প্রকাশিত সম্ভ্রান্ত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটির সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে যুক্ত, যে-পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহও বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন। রক্ষণশীল পরিবার হলে ওঁদের গান্ধব বিবাহ এতো কুসুমাস্তীর্ণ তো হতোই না, মাত্র আঠারো বছর বয়সে গার্ল গাইডসের সদস্য হয়ে ম্যানিলায় যাওয়ার ছাড়পত্রও বাড়ি থেকে মিলত না। ইডেন কলেজে পড়া, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি ও পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের চাকরি তাঁকে যে নির্মিত দিয়েছে, তারই পূর্বাপরতায় তাঁকে দেশ-বিদেশে স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণে সহজ, সাবলীল ও সহযোগী হতে দেখি। এই পরিশীলন আর সতত সারস্বতচর্চা ছিল বলেই আত্মজীবনী লেখার মধ্য দিয়ে তা সুফলপ্রসূ হয়েছে।

বাঙালি নারীর আত্মজীবনী। রচনার তালিকা নিতান্ত কম নয়। বাংলায় প্রথম আত্মজীবনী লিখলেনই তো এক নারী  –  রাসসুন্দরী দাসী। ঠাকুরাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী আত্মজীবনী লিখেছেন এবং সেই তালিকায় স্থান পাবেন সরলবালা সরকার, মানদা দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, নটী বিনোদিনী।

 শৈল্পিক বিচারে সিদ্দিকা জামানের এই গ্রন্থকে বিশিষ্ট এবং সম্ভ্রান্ত পর্যায়ে ফেলার যথার্থ একটি কারণ রয়েছে। আত্মজীবনী মাত্রই সমার্থক নয়, কী পুরুষের, কী নারীর। কেবল বাঙালি মেয়েদের আত্মজীবনীর কথাই যদি ধরি তো দেখব, ব্যক্তিমানুষের সামগ্রিক উপস্থিতি সব জায়গায় নেই। আবার এমন লেখাও রয়েছে, যেখানে জীবনের অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বাদ দিয়ে গেছেন আত্মজীবনীকার, সমনস্কতার অভাবে। প্রতিভা বসুর বিস্তৃত আত্মজীবনীতে তাঁর স্বামী বুদ্ধদেব বসুর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পারম্পর্য অনুপস্থিত, যা আত্মজীবনীকার  –  মাত্রেরই একটি দায়বদ্ধতা। জ্ঞানদানন্দিনী লেখেননি, রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যু, এই দুটিই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা ছিল এক দুর্লভ ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।

হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক যে, কোনো কোনো আত্মজীবনী আংশিকভাবেই লিখিত হবে, এমন সংকল্প নিয়েই লেখা হয়। মণিকুন্তলা সেনের আত্মজীবনীতে যেমন তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শই স্থান পেয়েছে। রানী চন্দর জেনানা ফাটক লেখিকার বিয়াল্লিশের আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবাসের অভিজ্ঞতার মধ্যেই সীমায়িত আর বৃহত্তর পরিসরে আত্মকথা লিখতে গিয়ে তিনি লিখলেন আমার মা-র বাপের বাড়ি। বীণা ভৌমিকের শৃঙ্খল ঝঙ্কার, মীনাক্ষী সেনের জেলের ভেতর জেল অথবা জয়া মিত্রের হন্যমান এই হিসেবেই, পরিকল্পিতভাবেই একরৈখিক। জাহানারা ইমামের ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসকেও এই পর্যায়ে ফেলতে পারি। অন্যভাষী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বইটিও এর অনুধর্মী। অন্যদিকে নূরজাহান বেগমকৃত আগুনমুখার মেয়ে অনেক বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী।

সিদ্দিকা জামানের বইটি তুলনীয় প্রতিভা বসু এবং তারও দীর্ঘকাল আগে লেখা মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীর সঙ্গে। যেখানে একজন নয়, দম্পতি ওতপ্রোত হয়ে আছেন। এটিকে একটি বিশিষ্ট মবহৎব বলতে চাই।

সহজ কথা যায় না বলা সহজে। কথা সত্য। আবার যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে, এ-ও কম সত্য নয়। সিদ্দিকা তাঁর এই গ্রন্থকে বহু আয়তন এনে দিয়েছেন, যদিও তাঁর অন্তঃস্থ কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাঁর স্বমহিম স্বামী। অতি সহজে, কোনো রকম উচ্চকিত না হয়ে তিনি আনিসুজ্জামান নামক একজন ক্ষণজন্মা মানুষের বীরগাথা রচনা করেছেন, অথচ আপাতপাঠে তা বীরগাথা বলে মনেই হয় না। তিনি আনিসুজ্জামানের আজীবনের কোনো মহৎ কৃতিকেই অনুল্লেখ্য রাখেননি সাল-তারিখের অনুপুঙ্খতাসমেত, আর পাঠক হিসেবে মাঝে মাঝে থমকে যেতে হয়, রূপকথার মতো লাগে তাঁর সঙ্গে ১৯৯০-এর শেষদিকে দিল্লিতে ‘সদ্য কারামুক্ত কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা’র সাক্ষাৎ। সে-যাত্রায় আনিসুজ্জামানের ‘ঘনিষ্ঠভাবে কিছু সময় তাঁর সঙ্গে ব্যয় করার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল’ (পৃ ৭৯)। এর আগে ১৯৮৮-তে আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে আনিসুজ্জামান দিল্লি যান, সেবার সে-প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে পৃথিবীর ৫০টি দেশের হাজারখানেক প্রতিনিধির অন্যতম ছিলেন আনিসুজ্জামান। সহসভাপতির সম্ভ্রান্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এসব বর্ণনা করছেন সিদ্দিকা। নিতান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায়, যেন পাড়ার কোনো ফুটবল ম্যাচে রেফারির দায়িত্বে ছিলেন আনিসুজ্জামান।

এই বিনয়ী সংবচন তাঁর লেখাকে মহত্ত্ব দিয়েছে। আবার আমাদের প্রতিতুলনায় যেতে হচ্ছে। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লেখা বইতে বিজয়া রায়ও তথ্যানুগ, অনুপুঙ্খ, দরদি, অন্তরঙ্গ এবং ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিñিদ্র; কিন্তু পদে পদেই তিনি আবেগাপ্লুত এবং সত্যজিৎকে নিয়ে, এমনকি নিজ পুত্র সন্দীপকে নিয়েও বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছ্বাসপ্রবণ। এই ত্রুটি সিদ্দিকার লেখায় একেবারেই নেই, যদিও স্বামীর সঙ্গে পুত্র-কন্যাদের জীবনকথা সলমাচুমকির মতো সুনিপুণভাবে গেঁথে দিয়েছেন তিনি। তাঁর দুই কন্যা রুচি ও শুচি আর একমাত্র পুত্র আনন্দের কথা একটুও বাদ যায়নি, কিন্তু কী সংহত আকারে। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক আনন্দের উচ্চ মাধ্যমিকে ১৮তম স্থান লাভ করা নিয়ে। প্রথমে জানা গিয়েছিল আনন্দ ফার্স্ট ডিভিশনে পাস। পরে কাগজ পড়ে ১৮তম হওয়ার সংবাদটি জানা যায়। সমগ্র ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে সাংবাদিকসুলভ নির্লিপ্তি নিয়ে, মাতৃত্বসুলভ আবেগ নিয়ে নয়। এতে বোঝা যায়, সিদ্দিকার বোধিতে একটি সুস্থির ও সার্থক ভারসাম্য বজায় আছে।

এ-আত্মজীবনী তাঁর পরিবারের ঘটনায় যেমন পূর্ণ, তেমনি একদিকে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন, তাঁর প্রতিবেশীদের জীবন আর প্রবণতা-মাহাত্ম্যকেও চিনিয়ে দেয়, যা অন্য গ্রন্থপাঠে অর্জন করা সম্ভব হয় না আমাদের।

দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে লিখছেন সিদ্দিকা, ‘আমার তাড়াহুড়া আর উনার প্রবল স্নেহের বশে উনি-ই উল্টো আমার রুটিতে মাখন লাগিয়ে দিতেন।’ আরো, ‘কখনো কখনো আবার নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমাকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে নামিয়েও দিতেন মুনীরভাই।’ মুনীর চৌধুরীর এহেন বদান্যে কাহিনি তাঁর কোনো জীবনীগ্রন্থেই পাব না আমরা। এমনকি মুনীর চৌধুরী রচনাবলির সম্পাদক আনিসুজ্জামানের বিদগ্ধ আর গভীরসঞ্চারী ভূমিকাতেও নয়। সিদ্দিকা পরে আক্ষেপ করে লিখছেন, আনিসুজ্জামান ‘বাসায় ফিরে আমাকে জানাল মুনীরভাই ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর লাশটা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি’ (পৃ ৩০)। সংগত আক্ষেপ। এই মোফাজ্জল চৌধুরীর ছেলে সুমনের সঙ্গেই ওদের মেয়ে শুচির বিয়ে হবে, আর অকালপ্রয়াত হবেন সুমন (পৃ ১২১)। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পথে বিমানেই হার্ট অ্যাটাক হয়, বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তার। নিজের সম্পর্কে এ-পর্যায়ে লিখছেন কেবল, ‘আমি এই কদিন এবং পরের কিছুদিন কী করেছি, তার কিছুই বলতে পারব না।’ ব্যক্তিগত শোকের এমন সংহত প্রকাশ আমাদের সম্ভ্রম জাগায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে বেগম সুফিয়া কামাল হারিয়েছিলেন তাঁর জামাতাকে। একাত্তরের ডায়েরিতে সেই ঘটনা বর্ণনায় সুফিয়ার লেখনীতে নেমে এসেছিল যে আবেগ আর স্মৃতিমেদুরতার যুগলবন্ধন, আমরা তারও সুনিবিড় মর্মগ্রাহী।

আত্মকথনের মধ্য দিয়ে দেশের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশও যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে এ-লেখায়। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের খুব নিকটে বাস করতে হয়েছে তাঁকে, তাঁর পরিবার এবং দেশবাসীকে। একুশের যুগান্তকারী ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কেটেছে ইডেন কলেজে পড়া তাঁর ছাত্রজীবন। মিছিলে অংশ নেন তিনি। কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু মেয়েদের যে-মিছিল দেখে (অবশ্য এ-মিছিল নয়) এই ভেবে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন যে, মেয়েরাও অংশ নিয়েছে যখন, তখন এ-  আন্দোলনের সার্থক পরিসমাপ্তি না হয়ে যায় না।

মিছিলে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল, যা ভাষা-আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। লেখিকার ভাষাতেই তা পেশ করা যাক, ‘১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট চলছিল, তখন তার ঢেউ আমাদের স্কুলেও এসে পড়েছিল। নীলুফার আপা ও পারুল আপার (অলি আহাদের বোন) নেতৃত্বে বিশাল মিছিল নিয়ে আমরা কামরুন্নেছা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে বের হই। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের মেয়েরাও তখন আমাদের স্কুলে পড়ত। সেদিন তাদের সঙ্গী করে আমরা মিছিল নিয়ে রওনা হই। মিছিলের অনেক সেøাগানের মধ্যে একটা ছিল ‘নূরুল আমিনের কল্লা চাই, কল্লা চাই।’ মিছিলের অংশ হওয়ায় তাঁর মেয়েদেরও সেই একই সেøাগান উচ্চারণ করতে হয়েছিল’

(পৃ ৮২-৮৩)। এরপর লেখিকার সংবেদনশীল মন্তব্য, ‘তবে তা দেখে আমার খারাপ লেগেছিল।’

মুনীর চৌধুরীর বদান্যের পাশাপাশি আনিসুজ্জামানের সুজনতার একটি সজীব ছবি এঁকেছেন তিনি, যা অন্য এক আনিসুজ্জামানকে চিনিয়ে দেয়। ‘একবার পাড়ার কোনো ভাবির রুটির দরকার হলে আনিসুজ্জামান নিজে গিয়ে দোকান থেকে রুটি এনে দিল।’ এমনিতে তিনি সম্ভবত হাটবাজারে খুব দক্ষ ছিলেন না, কেননা চট্টগ্রাম থাকাকালীন বাজারে গিয়ে তাঁর গরুর গোশত কিনে আনার সংবাদ পাচ্ছি কেবল, ‘আনিসুজ্জামান বাজার করার মধ্যে শুধু গরুর গোশত কিনতে যেত। বাকি বাজার শহরে গিয়ে করতাম আমি।’ (পৃ ২২) দেশ-বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই মানুষটি নিজের ছেলেমেয়েদের পাঠদানের ব্যাপারে মোটামুটি ঔদাসীন্যই দেখিয়েছেন।

ভালো মানুষের তালিকায়, সজ্জনের কাতারে আরো একজনের কথা বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন সিদ্দিকা। তিনি হচ্ছেন অজিত (গুহ) বাবুর জেঠিমা। তাঁদের বাড়িতে গেলে ‘আমাদের বসিয়ে রেখে লোকজনদের দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরিয়ে, পরে সেই মাছ ভাজা ও রান্না করিয়ে খাইয়েছেন। অজিত বাবুর মৃত্যুর পরেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।’

(পৃ ৪৪) কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সিদ্দিকা অকৃপণ।

সমকালীন দেশের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাই বাদ পড়েনি তাঁর এই অনতিবৃহৎ আত্মজীবনীতে। যেমন বাহান্নর কথা পাই এখানে, আছে ১৯৭০-এ পরিপ্লাবী ঘূর্ণিঝড়ের কথা, যা চট্টগ্রামে বসে বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছিলেন তাঁরা, যখন ‘বেশ কিছুদিন কাটালাম পানি-বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়।’ (পৃ ২৩) এবং এর পরপরই এসেছে ’৭০-এর নির্বাচনের কথা। আনিসুজ্জামানকে প্রিসাইডিং অফিসারের কাজ করতে হয়েছিল। তার পরবর্তী ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত। লেখিকা কেবল দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন। ‘মার্চের ২ তারিখে বাংলাদেশের পতাকা উঠল, ৬ তারিখ থেকে ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’ না বলে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ বলা শুরু হলো।’ (পৃ ২০)

সেই বেপথু সময়ে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না তাঁদের। নয় মাসের এক মর্মন্তুদ, উৎকণ্ঠাভরা/ নিশ্চিত, আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটানো শরণার্থী জীবন, ২২ জন মানুষ মিলে কখনো কখনো থাকতে হয়েছে দুখানা মাত্র ঘরে। এই বিপর্যয়ের মধ্যেও আনিসুজ্জামান ফিরিয়ে দিয়েছেন বন্ধু ব্যারি মরিসনের আহ্বান, সপরিবারে কানাডায় চলে যাওয়ার। সে-প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আনিসুজ্জামানকে আরো অন্য মাত্রায় চেনা গেল। এ-সময় কলকাতায় থেকে একাধিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কার্যপরিচালনার পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরূপে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের পাশে থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সেই সূত্রে প্রতিনিধিদলের হয়ে দিল্লিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ১১ জ্যৈষ্ঠ চালু হলো (২৭.৫.১৯৭১) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ এবং নজরুল নিয়ে আনিসুজ্জামান বক্তব্য দেন বেতারে। ছদ্মনামে নয়, একেবারে নিরঙ্কুশ স্বনামে! অবস্থাবিপর্যয়ে এই মানুষটিকেই স্বাধীন দেশে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে পড়ে নিজ গৃহে সার্বিক ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিতে হয়। আরো বেদনার কথা, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেওয়া আনিসুজ্জামানকেও রাষ্টদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ যে গণআদালত বসে, তাতে নেতৃত্ব দেওয়া ২৪ জনের অন্যতম ছিলেন তিনি। এই ছিল তাঁর অপরাধ। এজন্য তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্ধুদের উদ্বেগের কারণে আত্মগোপনে পর্যন্ত চলে যেতে হয়েছিল। সাধে কি আর কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ শামসুর রাহমান, ড. আহমদ শরীফসহ অনেকের বিরুদ্ধেই সে-সময় বা আগে-পরে, এরশাদের স্বৈরশাসনের আমলে, মৌলবাদীদের জিহাদ ছিল অথচ একটি স্ববিরোধিতা লক্ষ করছি এর পাশাপাশি। এরশাদ পুরোদস্তুর সাধু ব্যবহার করতেন আনিসুজ্জামানের সঙ্গে।

একুশে পদক পেলেন তিনি ১৯৮৪-তে। একটি নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সে-বছর, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে একুশে পদক দেওয়া নিয়ে। এরশাদ সরকার তাঁকে এই পদক দিতে দ্বিধান্বিত ছিল। গাফ্ফার চৌধুরী সে-সময় সরকারবিরোধী লেখা লিখছিলেন অবিরাম। অন্যদিকে ‘যাঁর গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির ভোর হয়, তাঁকে একুশে পদক না দিতে পারা লজ্জার বিষয়’ বিধায় তাঁকে পদক দেওয়া হলো। আর তাঁর সঙ্গে আরো একজনকে, বাংলাদেশের নন্দিত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। কাইয়ুম এবং কামরুল, বাংলাদেশে চিত্রশিল্পের ইতিহাসে যেন দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক। কামরুল হাসানের মৃত্যুচিত্রটি লেখিকা এঁকেছেন এভাবে, ‘১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কামরুল হাসান মঞ্চে বসে স্বৈরাচার এরশাদের বিশ্ববেহায়ার ছবি আঁকছিলেন এবং সেখানেই হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।’

কোনো কোনো ঘটনা বা ব্যক্তি হঠাৎ আলোর ঝলকানি হয়ে আবার মিলিয়ে গেছেন। যেমন ’৭১-পর্বে কলকাতায় তাঁদের সঙ্গে মুনীর চৌধুরীর ছেলে ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে দেখা হওয়া, বা বাড়ির সহায়তাকারী কোরবানের কথা। কোরবানকে তিনি ‘বাড়ির সহায়তাকারী’ বলছেন, যেজন্য সিদ্দিকা সাহেবা আমাদের কাছে অতিরিক্ত শ্রদ্ধেয়া হয়ে ওঠেন।

আনিসুজ্জামান সিগারেট খেতেন একদা। তিনি সকালে পরোটা আর ডিমের ওমলেট খেতে ভালোবাসতেন। ১৯৭৮ সাল লেগে গিয়েছিল তাঁদের, বাড়িতে টিভি আসতে, তা-ও সাদা-কালো। সবচেয়ে কম বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি করা আনিসুজ্জামান মোট দশবার ভাড়া বাড়ি পাল্টেছেন, ১৯৬৬-তে নীলক্ষেতের ফ্ল্যাটপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে।

পিতৃকুল ও শ্বশুরকুল, কৌলীন্য ছিল দুই পরিবারেই। তাঁর শ্বশুর অর্থাৎ আনিসুজ্জামানের পিতা ছিলেন নামী হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, যিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকেরও ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি নিজে যেমন ভোজনরসিক ছিলেন, মানুষজনকে খাইয়েও তৃপ্তি পেতেন খুব। তাঁর খাদ্যরসিকতার নমুনা পেশ করছেন লেখিকা এভাবে, ‘রান্নায় নারকেলের ব্যবহার ছিল খুবই প্রবল। অনেক সময় পোলাও-ও রান্না হতো নারকেলের দুধ আর ছোলার ডাল দিয়ে। চিংড়ির মালাইকারি ছিল তাঁর খুব পছন্দের খাবার।’ এর চেয়েও আশ্চর্যকর সমাচার, ‘তাঁকে এমনও দেখেছি যে শরীর ভালো লাগছে না বলে বিরিয়ানি আনিয়ে খাচ্ছেন।’ ১৯৭৫-এ প্রয়াত হন তিনি, পরিণত বয়সেই।

সিদ্দিকার পিতা, আগেই বলা হয়েছে, সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৭১ নিয়ে তাঁর বইটিই ইংরেজিতে লেখা সে-বিষয়ে প্রথমতম। আর আনিসুজ্জামানের পূর্বপুরুষ শেখ আবদুল রহিম ছিলেন উনিশ শতকে প্রকাশিত বিখ্যাত ঐতিহ্যশালী পত্রিকা মিহির ও সুধাকরের সম্পাদক, যে-পত্রিকাটি মুসলমান বাঙালির সৃজন ও মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল, এবং যার হাত ধরে পরবর্তীকালে আমরা সওগাত, বুলবুল বা মাহে নও-এর মতো দিশারি পত্রিকাসমূহের সামীপ্যে আসি।

সিদ্দিকার চাচা আবদুল আহাদ ছিলেন আইনজীবী, ‘অরডিগনাম’ নামে একটি ল’ ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথিতযশা আইনজ্ঞ। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহিদ হন। ষাটের দশকে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আবদুল আহাদের সঙ্গে আনিসুজ্জামান-সিদ্দিকার ছিল স্নেহনিবিড় সম্পর্ক। এছাড়া খুলনার বিশিষ্ট শিল্পপতি সৈয়দ আলী হোসেন ছিলেন তাঁর মেজ নন্দাই। অতএব দুই পরিবারের মূল্যবোধ, আদর্শ এবং আভিজাত্যের সমবায়ে গড়ে উঠেছিল দুজনের জীবন। আনিসুজ্জামান তাঁর কাল নিরবধি উৎসর্গ করেন সিদ্দিকাকে আর সিদ্দিকার গ্রন্থটি নাম উহ্যে রেখে আনিসুজ্জামানকে উৎসর্গিত। দুজনকে রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আলোকছায়া শিবশিবানী’।

আনিসুজ্জামানের ক্রমোত্তরণের ইতিবৃত্ত নিপুণ নিষ্ঠায় তুলে ধরেছেন সিদ্দিকা। তাঁর মাথায় একের পর এক যে শিরোপাগুলো স্থান পেয়েছে, তার যাবতীয় তালিকা পেয়ে যাই আমরা বইটিতে। ১৯৬৪-এ পেলেন কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, গেলেন লন্ডন। এই সালে তিনি বিবিসিতেও কাজ করতেন। সিদ্দিকাও সঙ্গে এবার, এবং স্বভাবতই ছেলেমেয়েরাও। ঘোরা হতো লিডসে, অক্সফোর্ডেও। সেখানে ছিলেন ড. কামাল হোসেন। ’৮৪-তে পেলেন একুশে পদক, আর স্বাধীনতা পদক পান ২০১৫-তে। পদকপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় আনিসুজ্জামান, ‘দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পুরস্কার পেয়ে আমরা গর্বিত, তবে তা এক সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছিল।’ কথাটি মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজ ভাষণেও উদ্ধৃত করেন।

আনিসুজ্জামানের মুকুটে একটি বিশেষ পালক ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ। ২০১৪-র ২৫শে জানুয়ারি ভারত সরকারের অনুরূপ ঘোষণা আনিসুজ্জামানের তো বটেই, তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং দেশবাসীর পক্ষেই আনন্দসংবাদ। ২৯শে মার্চ সস্ত্রীক তিনি এ-পুরস্কার গ্রহণ করতে দিল্লি যান, ৩১শে মার্চ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাত থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ  –  প্রসঙ্গে আমরা ক্ষোভের সঙ্গে জানাতে চাই, বাংলাদেশের ১২ জন গুণী মানুষ এ পর্যন্ত ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেলেও যথেষ্ট যোগ্যতা সত্ত্বেও আনিসুজ্জামানকে এই পুরস্কার কখনো প্রদান করা হয়নি।

ভারতের কত বিশ্ববিদ্যালয়ই না তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট প্রদান করেছে। সিদ্দিকা সেসব তালিকার কোনোটি পেশ করতে বাদ রাখেননি। এর ফলে আমরা জানতে পারি, ২০০৫-এ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৩-তে নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আর ২০১৭-তে আসানসোলের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।

এক্ষেত্রেও আমাদের আক্ষেপ রয়েছে। যিনি পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কবির জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রবন্ধ সম্পাদনার দুঃসাহস দেখান, পরবর্তীকালে রবীন্দ্র জন্মসার্ধবর্ষেও যাঁর সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন বের করে বিশ্বভারতী গ্রন্থণ বিভাগ, তিন মাস ভিজিটিং প্রফেসর হন যিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে (ওঁরা মূলত পঞ্চবটীতে ছিলেন। পঞ্চবটীতে ‘আমাদের জন্য এসি, টিভি, ফ্রিজ, চুলো এবং সংসারের যাবতীয় জিনিস সব নতুন কেনা হয়েছিল’, পৃ ১১২), তাঁকে বিশ্বভারতী কেন যে দেশিকোত্তম দিলো না!

তবে আনিসুজ্জামানের শান্তিনিকেতনপর্ব সমুজ্জ্বল হয়ে আছে আরো একটি মহান ঘটনায়। শান্তিনিকেতনে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন উপলক্ষে এক বিরাট দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যান। ২০১৮ সালের ২৫শে মে’র সেই শুভদিনে আনিসুজ্জামানও যান সেখানে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা, যার সাক্ষী ছিলেন আনিসুজ্জামান।

একটি কথা এখানে না বললেই নয়। তিন খণ্ডে রচিত আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী সমাপ্ত হয়েছে ২০০০ সালে এসে। পরবর্তী যে-২০ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, তার তথ্যনির্ভর দলিল সিদ্দিকার লেখা থেকেই আহরণ করতে পারবে ভবিষ্যতের পাঠক। তাই এ-বইতে ২০০০-পরবর্তী ঘটনাসমূহ অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। লেখিকার প্রতি আহ্বান, পরবর্তী সময়ে আরো বিশদ আকারে তিনি তাঁর এবং আনিসুজ্জামানের জীবনে ২০০০-পরবর্তীতে ঘটা তথ্যগুলো লিখুন। ২০০৩-এ এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেন আনিসুজ্জামান, তখন তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় কেমন করে, শান্তিনিকেতনে তিনি যে-ক্লাস নিতেন, সেখানে কী কী পড়াতে হতো তাঁকে, ছাত্রছাত্রী কারা ছিলেন, অধ্যাপকদের সঙ্গে মতবিনিময়, এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বয়ান কিন্তু অপেক্ষিত হয়ে আছে, সিদ্দিকা যার প্রত্যক্ষদর্শী। আবার ২০০৭-এ নিউইয়র্কের বইমেলা উদ্বোধন এবং বেশ কিছুদিন তাঁদের সেখানে কাটানোর বিশদ ইতিহাস জানতে চাই আমরা, যদিও অনেকটা তথ্যই আমাদের জানিয়েছেন ‘মুক্তধারা’র কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা।

অন্যান্য পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত ‘জগত্তারিণী পদক’ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ‘পদ্মভূষণ’ অনেক বড় পুরস্কার হলেও সাহিত্যজগতে জগত্তারিণী পদকের মূল্য অপরিসীম। ‘… ১৯২১ সালে প্রবর্তিত এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তী সময়ে শরৎচন্দ্র, নজরুল  –  এঁরাও সম্মানিত হয়েছিলেন এই পদকে।’ (পৃ ৩৫-৩৬) প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আনিসুজ্জামানকে ‘সরোজিনী বসু পদক’ও প্রদান করে।

বইটিতে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যা, এই দুজনের কিছু উজ্জ্বল চিত্র আঁকা হয়েছে, যা পাঠ করে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। ১৯৬৯-এ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন আনিসুজ্জামান, নিজেই গাড়ি চালিয়ে, পথে সড়ক দুর্ঘটনা। পুলিশের কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (তাঁর খ্যাতিমান পুত্র হুমায়ূন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তাঁকে ও সঙ্গীদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কুমিল্লায় পাঠান। আনিসুজ্জামান চিকিৎসাশেষে ঢাকায় ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তাঁকে দেখতে যান। ’৬৯-এর সেই গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে শতব্যস্ততার মধ্যেও তিনি যে দেখতে এসেছিলেন ইতিমধ্যেই বরেণ্য এবং পাকিস্তানের শোষণের প্রতি দ্রোহী এক সুশীল ব্যক্তিত্বকে (তাছাড়া আনিসুজ্জামান তো ছিলেন আবার বঙ্গবন্ধুদুহিতা শেখ হাসিনার বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক), এ-ঘটনা বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে অন্যতম আলো দেয়। তাজউদ্দীন আহমদও এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। বঙ্গবন্ধুর ’৭১-এর ৭ই মার্চে দেওয়া ভাষণ শোনা হয়নি আনিসুজ্জামানের, কেননা তিনি অধ্যাপনা সূত্রে তখন চট্টগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ১৯৭২-এর ভাষণ তিনি শুনেছিলেন। ফলে ‘এবার তার দুঃখ কিছুটা লাগব হলো। ফিরে এসে আমাকে বলল, বঙ্গবন্ধুর শরীর কিছুটা দুর্বল হয়েছে বটে, কিন্তু কণ্ঠের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি।’ (পৃ ৩১)

শেখ হাসিনার মূল্যবোধের অনুপম একটি চিত্রও পাই। আনিসুজ্জামান-সিদ্দিকার জামাতা সুমনের মৃত্যুর পর সুমনকে দেখতে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। সুমনকে দেখতে আসার কারণ, তিনি আনিসুজ্জামানের জামাতা এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্র। দুজনেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনার শিক্ষক! রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আনিসুজ্জামান শেখ হাসিনা এখানে যেন এক ধারায় মিশে যান। মোফাজ্জল শান্তিনিকেতনের উজ্জ্বল ছাত্র, যাঁকে আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন ডাকতেন ‘মুখোজ্জ্বল’ নামে। ’৭১-এ শহিদ। আনিসুজ্জামান, রবীন্দ্রনাথ নিয়ত যাঁর ধ্যানে। শেখ হাসিনা : বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ করতে কলকাতা-দিল্লি নয়, নির্বাচন করেন শান্তিনিকেতনকে। অপূর্ব ত্রিবেণীসঙ্গম।

রূপকথার মতো মনে হয় কখনো কখনো এ-লেখা পড়তে গিয়ে। রূপকথার রাজপুত্র রাজপুরুষরাই এমনটা পারে। কী রকম? ২০১০। দ্বিতীয়বার অস্ট্রেলিয়াযাত্রা আনিসুজ্জামানের, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনির আমন্ত্রণে ‘ঞযব ইবহমধষর ওহফবহঃরঃু’ শীর্ষক বক্তৃতা দিতে। তা এর মধ্যে রূপকথার সম্পর্ক? আছে। ‘যাবার আগের দিন আমেরিকা থেকে ফিরল। আনন্দ পরে হিসেব করে বলল, আব্বা ৮৫ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৫০ ঘণ্টা প্লেনে-এয়ারপোর্টে কাটিয়েছে।’ আনিসুজ্জামানের তখন ৭৩ চলছে। রূপকথা নয়? মোজেজা নয়?

সারাজীবন দেশে-বিদেশে কতবার যে বক্তৃতা দিতে যেতে হয়েছে তাঁকে, যা প্রমাণ করে সেই আপ্তবাক্য, ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্য।’ ১৯৭৮-কিয়োটো, জাপান। ১৯৭৯-মেক্সিকো। ১৯৮১-আলজিয়ার্স। ১৯৮১-কুয়েত। ১৯৮২-প্যারিস ও লন্ডন। ১৯৮৮-দিল্লি ও লন্ডন। ১৯৯৫-হায়দরাবাদ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় তিনবার। ২০১৪ দিল্লি (উপলক্ষ জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মদিন)। ২০১৭ পুনশ্চ দিল্লি। ৩.৬.২০১৭ সাবেক ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব ও হাইকমিশার মুচকুন্দ দুবে ‘আনিসুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানালেন … ওঁর অনূদিত ও সম্পাদিত বই লালন শাহ ফকিরের গীত গানের প্রকাশনা উৎসবে।’ (পৃ ১৩৫) ২০১৩ কলকাতা, আন্তর্জাতিক বইমেলা উদ্বোধনের জন্য। ২০১৯ থিম্পু, সার্ক পুরস্কার নিতে। ‘কী মনে করে আনিসুজ্জামান আমাকে বলল, এই আমার শেষ বিদেশ যাত্রা। হলোও তা-ই। এবং বিদেশে পাওয়া শেষ পুরস্কারও ছিল এটি।’ (পৃ ১৩৯)

জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়া, এরশাদের পতন, এসবও ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছেন সিদ্দিকা। তবে গুরুত্ব পেয়েছে দীর্ঘ প্রবাসশেষে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা। হাসিনা এ-পর্যায়ে তাঁর গণসংযোগ শুরু করার সূত্রে চট্টগ্রাম এসে দেখা করে গেলেন সে-সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত আনিসুজ্জামানের সঙ্গে। ‘ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর আবেগ দেখে আমরাও আপ্লুত না হয়ে পারিনি। এই দেখা আর আগের দেখার সময়ের মাঝে কত কিছুই না বদলে গেছে।’ (পৃ ৫৩)

বদল তো আরো ঘটবে। ২০২০ সালে বইমেলার উদ্বোধনশেষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখার সময় আনিসুজ্জামানকে হাঁপাতে দেখে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠেছিলেন, ‘স্যার, আপনি আর হেঁটেন না।’ তাঁর ক্লান্তির সমুচিত কারণ নির্দেশ করেছেন সিদ্দিকা, ‘৮৩ বছরের একজন মানুষ যদি সকাল ৯.৩০টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১১.১৫-তে বাসায় ফেরে, তাহলে তার এ অবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক।’ (পৃ ১৪০)

প্রচুর গুণীজন সান্নিধ্য ঘটেছে তাঁর, অমর্ত্য সেন, ক্লিনটন বি সিলি, তপন রায় চৌধুরী, রমিলা থাপার, অনিরুদ্ধ রায়, গ্যারি মরিসন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এঁদের মধ্যে কয়েকজন। তেমনি রোগব্যাধিও কম আক্রমণ করেনি তাঁকে। হার্টের সমস্যা ছিল, পরে তো মেরুদণ্ডের সমস্যা দেখা দিলে অস্ত্রোপচার করতে হলো। আর কালান্তক করোনা শনাক্ত হলো যখন, তখন তো জীবনের জবফ তড়হব  –  এই পৌঁছে গেছেন।

তবু আনন্দ জাগে। সিদ্দিকার চোখ দিয়ে আমরা কেবল আনিসুজ্জামানকেই দেখিনি, দেখেছি তো মূলত সিদ্দিকাকেই, যিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন ‘প্রকৃতির সৌন্দর্য আর প্রাণের প্রাচুর্য দিয়েই তৈরি শান্তিনিকেতন।’ (পৃ ১১৬)

দু-দুবার আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্তি, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিত ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বর্ণফলক লাভ করা মানুষটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক, জাতীয় অধ্যাপক, বাংলা একাডেমির একাধিকবারের সভাপতি (মৃত্যুকালে তিনি এই দুই পদে ছিলেন) আনিসুজ্জামানের প্রকৃত মাহাত্ম্য কিন্তু অন্যখানে খুঁজব। মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একদিন এক ভদ্রলোক আনিসুজ্জামানকে বললেন, ‘আমার জীবনের সব সঞ্চয় আপনার চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছি।’ (পৃ ১৩৩) এইখানেই আনিসুজ্জামানের চিরজীবিতা নির্ধারিত হয়ে গেল, মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন বলে। সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ, তাই না? এই ঘটনার কাছে বাকিংহাম প্রাসাদে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে তাঁদের দুজনের দেখা হওয়া (‘বাকিংহাম প্যালেস থেকেও দাওয়াত এল একদিন, কমনওয়েলথ ডে উপলক্ষে। সেই সুবাদে দেখা হলো রানির সঙ্গে’, পৃ ৩৪) বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

রঙিন ও সাদাকালো প্রচুর ছবি বইটির অনুপূরক হয়ে উঠেছে। তবে দুটি অভাব। এ-বইয়ে দরকার ছিল ব্যক্তি পরিচিতি আর দরকার ছিল নির্ঘণ্ট (ওহফবী) দেওয়া। ক্লিনটন বি সিলি অথবা রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তথ্য প্রদান অপেক্ষিত ছিল।

প্রথমবার আনন্দ পুরস্কার পান যে নরেন বিশ্বাসের সঙ্গে, তাঁর সম্পর্কে আরো বিস্তারিত হওয়া যেত।

প্রকাশককে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিলেও কম হবে, কেননা যে-বইটি তিনি লেখালেন সিদ্দিকাকে দিয়ে, তার মূল্য শাশ্বতকালীন।

‘উৎসগর্’তে যে রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি তাতে কিঞ্চিৎ ভুল আছে। ওটা হবে ‘তুমি যে তুমি-ই ওগো, সেই তব ঋণ আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধি চিরদিন।’

আনিসুজ্জামানের জীবনের শেষ পর্বে তিনি যখন একের পর এক মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতায় জর্জর, সে-সময়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলার সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন আবুল খায়ের। একাধিকবার তাঁকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, এজন্যে উদারহস্তে অর্থব্যয় এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এবং এর সঙ্গে যুক্ত হবে কালি ও কলম পরিবারের লুভা নাহিদ চৌধুরীর নাম, যিনি দিনের পর দিন ব্যক্তিগত সাহচর্য দিয়ে আনিসুজ্জামানকে রোগমুক্ত করার প্রয়াসে ব্রতী ছিলেন।