একটি পরিবারের দুই প্রজন্মের শিল্পীদের সৃজনকর্ম নিয়ে ‘পরম্পরা’ নামে পাঁচজনের একটি চিত্রপ্রদর্শনী সম্প্রতি হয়ে গেল। ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের আয়োজনে চার চিত্রশিল্পী ও এক আলোকচিত্রশিল্পীর এ-প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ শিল্পী রশিদুন নবী (১৯১৪-৯৫)। তিনি এ-পরিবারের পিতা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আজীবন নিজের মধ্যে লালন করেছেন শিল্পীসত্তা। সরকারি কর্তব্য পালনের পাশাপাশি ছবি আঁকতেন। শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন, এমনকি যেবার জয়নুল আবেদিন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, সেবার তাঁরও ভর্তির সুযোগ মিলেছিল। কিন্তু প্রথমত পুলিশ কর্মকর্তা পিতার অনিচ্ছা ও তাঁর অকালমৃত্যুর ধকলে সংসারের কর্তব্য পালনের বাধ্যবাধকতা তাঁর সুকুমারবৃত্তি গ্রহণের সুযোগ দেয়নি। তবে নিজের ইচ্ছায় শিল্পের পথে ব্যাপৃত থেকেছেন, ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য গড়েছেন।
এগারো সন্তানের সংসারে জ্যেষ্ঠপুত্র রফিকুন নবী (১৯৪৩)। তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহে ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন ১৯৫৯ সালে। জয়নুলের আগ্রহে সেখানেই তাঁর শিক্ষকতায় যোগদান। এখন সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে সংযুক্ত আছেন। পিতার চিত্রকর্মের সঙ্গে তাঁর অঙ্কনধর্মী কয়েকটি কাজ এ-প্রদর্শনীতে শোভা পেয়েছে। সেইসঙ্গে তাঁর দুই অনুজ তৌহিদুন নবীর আলোকচিত্র এবং রেজাউন নবী ও তাঁর পতœী সোহানা শাহ্রীনের চিত্রকর্ম এ-প্রদর্শনীতে স্থান করে নিয়েছে।
এ-পরিবারের আরেক সদস্য সফিকুন নবী সুপরিচিত একজন ছড়াকার হিসেবে। আরেকজন হেদায়েতুন নবী শিল্প নিয়ে লেখালেখি করতেন। বোন রওশন আরা বেগম ছবি আঁকতেন। সর্বশেষ ভাই সৃজনশীল কারুকলা নিয়ে কাজ করছেন। এক ভগ্নিপতি ড. সৈয়দ আজিজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, দেশের খ্যাতনামা গবেষক ও শিল্প-সমালোচক।
রফিকুন নবী ও তাঁর ভাইবোনদের শিল্পীসত্তাকে বুঝতে হলে তাঁদের পিতার শিল্পীমনের উদ্ঘাটন করা দরকার। তিনি ছিলেন একজন জাতশিল্পী। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যয়নকালেই তাঁর মধ্যে ছবি আঁকার তীব্র ঝোঁক দেখা দেয়। প্রবেশিকা পাশ করে স্বেচ্ছায় কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু পুলিশকর্তা বাবার বিরোধিতায় সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। জয়নুল আবেদিন সেবারই ভর্তি হয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে রশিদুন নবীর বন্ধুত্ব অটুট ছিল আজীবন। বহরমপুর কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এ-সময় পিতার আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর পড়াশোনার ইতি ঘটান।
এরপর ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে মাদ্রাজে (চেন্নাই) গিয়ে ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে ভাস্কর্য শেখায় আগ্রহী হন। মায়ের অনুমতি নিতে বাড়ি ফিরলে বিবাহবন্ধনে আটকে পড়ে পুলিশ বিভাগের চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হন। এভাবেই সেকালে প্রবল সম্ভাবনাময় এক শিল্পীজীবনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার সুযোগ হারানোর ক্ষোভ প্রশমনে ও নিজের শিল্পমানস গড়ার ইচ্ছায় তিনি চাকরিক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরে নিয়মিত ছবি আঁকতেন। সেসব ছবির মাধ্যম ছিল জলরং ও গোয়াশ। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভাস্কর্য বিভাগ খোলার পর সেখান থেকে মাটি সংগ্রহ করে সময়ে সময়ে কিছু ভাস্কর্যও করেছেন। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শতবর্ষ উদ্যাপনকালে তাঁর শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল। সহপাঠীদের অনুরোধে তাঁর অনেক উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম তাঁদের উপহার দিয়েছেন, যার অধিকাংশের হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। মূলত পরিবারের সদস্যদের কাছে থাকা রশিদুন নবীর ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মগুলো থেকে নির্বাচিত ছবি নিয়ে এ-প্রদর্শনীর আয়োজন।
পেনসিলে আঁকা লালবাগ কেল্লার দক্ষিণের তোরণ ও আরেকটিতে খাদ্যান্বেষী পাঁচটি সারমেয় অবয়বের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি। এতে অঙ্কনের পুঙ্খানুপুঙ্খতা, পরিপ্রেক্ষিত, আলোছায়ার যথাযথ প্রয়োগ যেমন ঘটেছে, তেমনি তাঁর রসবোধ ও স্বকীয় শক্তিশালী অঙ্কনক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। জলরঙে আঁকা এক ঘোড়ার ঊর্ধ্বমুখে একাকিত্বের অসহায়ত্ব প্রতিফলিত হয়েছে।
উঁচু থেকে দেখা নদীপাড় ও নদীবক্ষে নৌকার বহর, একটি গ্রামের বসতি ও আলোছায়া-ঘেরা দুপাশের ঘরবাড়ি নিয়ে মিশ্রমাধ্যমে আঁকা কাজটিতে গত শতকের চল্লিশের দশকের চিত্রকর্মের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তাঁর জলরংচিত্রকে প্রধানত কয়েকটি লেয়ার প্রয়োগের জন্য স্বচ্ছ বলা যাবে না। মায়ের কোলে শিশুর যে-চিত্র, সেটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার ব্যগ্রতায় সেটিতে শিল্পী বারবার হাত দিয়েছেন। অদ্ভুত এই যে, তাতে মা ও শিশু-অবয়বের লাবণ্য এতটুকু মøান হয়নি!
নিসর্গকেন্দ্রিক কিছু চিত্রে প্রকৃতির নানা রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। পাতাবিহীন গাছের সারি, কোথাও পত্রশোভিত গাছ দেখা যাচ্ছে। বরফাচ্ছিত শীতল অঞ্চলের গাছপালার এ-রূপ এক ধরনের, আবার আবহাওয়ার উষ্ণতায় এর রূপবদলকে তুলে ধরেছেন শিল্পী। আরেকটি চিত্রে বনভূমির কোলঘেঁষে মানুষের আবাস, জলাশয় ঘিরে দৈনন্দিন গার্হস্থ্যকর্মের গতিময় প্রবাহ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। এমনি আরেকটি চিত্রপটে নারীর গৃহকর্মে ব্যস্ততার চিত্র লালিত ছন্দে বাস্তবসম্মত করে উপস্থাপন করেছেন তিনি। কালি-কলমে ও কালি-তুলিতে অনেক দুর্দান্ত ছবি এঁকেছেন শিল্পী। এসবে তাঁর অঙ্কনের দৃঢ় কুশলতার প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন – ‘বাংলাদেশের নৌকা’, ‘পশুর পাল’, ‘গ্রাম’ শীর্ষক চিত্রগুলো শুধু কালিতে দারুণ মজাদার হয়ে উঠেছে! দুটি রঙে আঁকা বনভূমি তাঁর আরেকটি অনবদ্য প্রাকৃতিক অনুবাদ। তাঁর গড়া ভাস্কর্যগুলোও দর্শকদের বিমোহিত করেছে।
রশিদুন নবী গৃহকেন্দ্রিক বাস্তবতাসহ প্রকৃতিকেন্দ্রিক নানা চিত্রে বাস্তব রূপের মধ্যেই বিচরণ করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ নিজের দেখা ও অভিজ্ঞতার আলোতেই নিজের সৃজনের পথ তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। জনসমক্ষে তাঁর কাজগুলো আরো আগে উপস্থাপন করতে পারলে নিশ্চিত তিনি বাংলাদেশের চারুশিল্পের ইতিহাসে নিজের একটা জায়গা করে নিতে সমর্থ হতেন।
তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শিল্পী রফিকুন নবীর চারুকলায় ভর্তি হওয়ার দুই বছর আগের অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের একটি পেনসিল-ড্রয়িং দেখা হলো এ-সুযোগে। পল্লির গৃহপরিবেশে নারীর প্রসাধন করার এক দৃশ্য। লাঠিহাতে এক রমণীর পেছনে দাঁড়িয়ে আরেকজন তার মাথায় আঙুল দিয়ে বিলি কাটছে। ২০১৮ সালে করা কাঠখোদাই ছাপচিত্র – ‘ভাঙা জানালায় দুটি জালালি কবুতর’ শিল্পীর অসামান্য কাজ। একই বছরের ‘নদীদৃশ্য’ চিত্রে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন নদীতে বিচরণকারী নানারঙের মাছের খেলা। কাগজে চারকোলে আঁকা ‘মা ও শিশু’র ঘরোয়া ছবিটি যেন আমাদের মধ্যবিত্ত কোনো পরিবারের স্নেহনিবিড় পরিবেশকে সার্থক রূপে তুলে ধরেছে।
তাঁর ‘গ্রীষ্মের দুপুর’ গ্রামীণ জীবন ও জনপদের আরেকটি নিবিড় রূপায়ণ। ‘পরিবার’, ‘রাখাল’ও তদ্রƒপ। এ চারটিই ২০২০ সালের একেবারে টাটকা চিত্র!
তৌহিদুন নবী বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের আলোকচিত্রী ছিলেন। থাইল্যান্ড ও ফ্রান্সে ফটোগ্রাফিতে উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন। নিজ দেশে নানা জায়গায় ছবি তুলেছেন আবার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে গিয়েও তিনি মজাদার অনেক ছবি তুলেছেন। এসব ছবির কয়েকটি তিনি এ-প্রদর্শনীতে দিয়েছেন। মিশরের পিরামিড, দিল্লির কুতুবমিনার, ফতেপুর সিক্রি, আগ্রা ফোর্ট, ভুটানের প্রকৃতি, সিঙ্গাপুরের স্থাপত্য, আদিবাসী জীবন – এমন অনেক দৃশ্যকে দর্শনীয় রূপে তিনি আলোকচিত্রের মাধ্যমে আমাদের সামনে আকর্ষণীয়ভাবে হাজির করেছেন।
রেজাউন নবী এ-পরিবারের আরেকজন চিত্রকর। এ পর্যন্ত নয়টি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। অ্যাক্রিলিক ও জলরঙে সিদ্ধহস্ত। তার নমুনা পাওয়া গেছে ‘পরম্পরা’ নামের এ-প্রদর্শনীতে। ‘প্রকৃতি’, ‘বরেন্দ্র-১ ও ২’ শিরোনামে চমৎকার ছবি এঁকে নিজ অঞ্চলের নিসর্গবন্দনা করেছেন। ‘সে’ শিরোনামে সুন্দরী এক ললনার প্রোফাইল এঁকেছেন তিনি।
সোহানা শাহ্রীন চারুকলায় স্নাতকোত্তর ও শিশুদের শিল্পের শিক্ষক। সৃজনশিল্পে আত্মবিকাশে সম্প্রতি তৎপর হয়েছেন। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে তিনি এঁকেছেন ‘চাঁদের প্রতিবিম্ব-১ ও ২’।
গ্যালারি চিত্রকের আয়োজনে এই পরম্পরা প্রদর্শনী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে চলেছে ৪ মার্চ পর্যন্ত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.