দ্রৌপদীদের অপমান যুগ-যুগান্তরের

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যখন প্রশ্ন তোলেন ‘আমি কি আমার পূর্বপুরুষদের মতো কবিতার কথা বলতে পারব?’ তখন জাতিসত্তার দীর্ঘদেহী পুত্রগণের নতুনের প্রেরণায় পুনঃপুন প্রশ্ন উত্থাপন অনিবার্য হয়ে ওঠে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নব নব বিনির্মাণে। দ্রৌপদী জিজ্ঞাসার এক নতুন নির্মিতি নিয়ে থিয়েটার (আরামবাগ) নাট্যদল সম্প্রতি মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে। তাঁদের নাটকের নামকরণ করেছেন দ্রৌপদী পরম্পরা। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনায় তরুণ প্রতিভাবান নাট্যকর্মী প্রবীর দত্ত। থিয়েটার (আরামবাগ) নাট্যদলের ৩৯তম প্রযোজনা এটি। নাট্যজন মমতাজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন এ-দলটি একসময় অত্যন্ত কর্মমুখর থাকলেও সম্প্রতি তাদের কর্মকা- দেখা যায় না বললেই চলে। দীর্ঘদিন পর তাঁরা এ-নাটক নিয়ে মঞ্চে আবার উপস্থিত হয়েছেন। নাটকটি গত ২৩ জুলাই শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে মহাভারতের দ্রৌপদী চরিত্রের বিনির্মাণ-প্রক্রিয়া, নাট্য আখ্যানের ধরন, উপস্থাপনার কৌশল, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, শিল্পমূল্যসহ উপযোগিতা অনুসন্ধানে ব্যাপ্ত রয়েছে লেখাটিতে।

দ্রৌপদী পরম্পরা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র দ্রৌপদী। এ দ্রৌপদী মহাভারতের অন্যতম নারী-চরিত্র। তিনি দ্রুপদরাজের কন্যা। স্বয়ংবর সভায় অর্জুন তাকে লাভ করে নিজগৃহে নিয়ে গেলে মা কুন্তি তা পাঁচ ভাইকে ভাগ করে নিতে বলেন। সে-পরিপ্রেক্ষিতে কুন্তিপুত্র পাঁচ পা-বকেই তিনি স্বামী হিসেবে বরণ করেন। দ্রৌপদীকে বলা হয় মহাভারতের চিরঅপমানিত নারী। পঞ্চস্বামী যেমন নারীত্বের অপমানগাথা, তেমনি জীবনের পদে পদে তাকে লাঞ্ছনাই সহ্য করতে হয়েছে। যুধিষ্ঠীর বাজিতে হেরে যাওয়ায় দুর্যোধনের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও ঊরুতে বসার মতো অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, জয়দ্রথ, কীচকসহ নানা অসুরের প্রতিকূলতায় তাঁকে টিকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু পতিপ্রাণা এ-দ্রৌপদী চিরকালই ছিলেন স্বামী-অনুরক্তা। দীর্ঘদিনের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসেও স্বামীদের পাশে ছিলেন নিশ্চল সেবাপরায়ণী, মায়াময়ী এক নারীমূর্তিরূপেই।

দ্রৌপদীকে নিয়ে যুগে যুগে, কালে কালে নানা প্রশ্ন আলোড়িত করেছে মানুষকে। কখনো তা করুণাত্মক, কখনো অনুসন্ধিৎসু, কখনো  নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যে দ্রৌপদী অর্জুনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গভীর মানবীয় আবেগ-ছড়ানো চিঠির প্রতিটি ছত্রে। ভারতের মণিপুরি থিয়েটার তাদের দ্রৌপদী নাটকে পরম্পরায় বহমান দ্রৌপদী সত্তার কষ্টগুলোই তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রীয় অন্যায় নীতির কাছে অবনত না হয়ে আজকে দ্রৌপদীর ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিবাদ দর্শকদের হৃদয়কে করুণরসে সিক্ত করেছে। দ্রৌপদীর নারীত্বের কষ্টগুলো একক অভিনয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে শাওলী মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ-এ। একলব্যের চরিতগাথা নিয়ে রচিত হলেও মাসুম রেজা তাঁর নিত্যপুরাণ নাটকে দ্রৌপদীর ভালোবাসা নিয়ে এক নতুন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধকার আবু সাঈদ তুলুর অনন্ত পথের যাত্রী নাটকে দ্রৌপদী নতুন সভ্যতায়, নতুন জীবনে, নতুন জিজ্ঞাসায়, নতুন ব্যাখ্যার নারীবাদী আলোয় উত্থিত হয়েছেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতির সামগ্রিক অতৃপ্ত ও উপেক্ষিত চরিত্রগুলো অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে এ-নাট্যে। বুদ্ধদেব বসুর রচনায় জয়িতা মহলানবীশ প্রথম পার্থ নাটকে স্বামীত্ব নিয়ে আরেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। যুগে যুগে দ্রৌপদীকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই।

এ দ্রৌপদী পরম্পরা নাটকে দেখা যায় – মহাভারতের ‘দ্রৌপদী’ এ-প্রজন্মের কাছে ফিরে এসেছে নতুন জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে। অতৃপ্ত হৃদয়াকুতির বেদনা নাটকের চালিকাশক্তি। দ্রৌপদীর অপ্রকাশিত কথাগুলোই যেন আজকের সমাজবাস্তবতায় অবশ্যম্ভাবী। অর্জুন কি সত্যিই তাকে ভালোবেসেছে নাকি মৎস্যচক্ষুভেদ খেলার পরীক্ষায় বিজয়ী বীর হতে চেয়েছে? আবার দ্রৌপদীই কেন প্রতিবাদ না করে মঞ্চস্বামী গ্রহণ করেছে। এমনি নানা মানবিক জটিলতা নাটকটির অন্তঃস্রোতে। কিন্তু মহাভারতে জিজ্ঞাসার ঊর্ধ্বে বিরাজ করলেও আজকের বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজনীতি ও দুটো ধর্মের নেতৃত্বে দ্রৌপদী আবার সমকালের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ে। জীবনের নিগ্রহ আবার নতুনরূপে জেগে ওঠে। শেষপর্যন্ত এ-সমাজের কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় –  অতীত ভেঙে-আসা এ-নারী সত্যিই দ্রৌপদী কিনা? দ্রৌপদীকে মুখোমুখি হতে হয় আরেক সত্যের। অতএব, আবার দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হবে। যদি এ-দ্রৌপদী সত্যি মহাভারতের দ্রৌপদী হয় তবে নিশ্চয় কৃষ্ণ এসে বস্ত্র দিয়ে উদ্ধার করবেন। এমনই এক প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায় নারীর সম্ভ্রম। এভাবেই নাটকের কাহিনি এগিয়ে চলে।

উপস্থাপনাটির শুরুতেই মঞ্চে জ্বলে ওঠে অগ্নিশিখা। আলো ও লাল কাপড়ের কারিশমার তৈরি অগ্নিযজ্ঞ থেকে ধীরে ধীরে সুদর্শনা নীলবসনা দ্রৌপদীর আগমনের মধ্য দিয়ে নাট্যের শুরু। তারপর পঞ্চপুরুষের কাছে হস্তান্তরের কোরিওগ্রাফির নৈর্ব্যক্তিকতার মাধ্যমে দ্রৌপদীর নারীজীবনের সমূহ যন্ত্রণার ইঙ্গিত ও পরিচয়কে তুলে ধরেন নির্দেশক। এ যেন কালের ছায়ায় নতুন করে জন্ম নেওয়া দ্রৌপদী। অভিনয়, আলো ও আবহসংগীতের ক্যারিশমায় অত্যন্ত মুখর হয়ে ওঠে দৃশ্যটি। শামীমুর রহমানের আলোর মুন্শিয়ানায় অনবদ্য মায়াজাল তৈরি হয় দৃশ্যে। আজকের বিদ্যমান বাস্তবতায় নতুন এক অনুসন্ধিৎসু ব্যথাহৃদয়ের আবির্ভাব। ধীরে ধীরে কুমারীকে ঘিরে পুরুষ দলের বাড়তে থাকে উচ্ছ্বাস। অধিবাস্তবিক এক আবহ তৈরি হয় কাহিনি ঘিরে। বৈপরীত্য অলংকরণ বা বায়োনারি অপজিশনের ধারায় যেন প্রশ্নবিদ্ধ করে অস্তিত্বকে। ‘আমিই আমার প্রথম আমিই আমার শেষ; আমিই পতিতা এবং আমিই পবিত্রা; আমিই স্ত্রী অথচ আমিই কুমারী; আমিই মাতা এবং আমিই কন্যা; আমি অসম্মানিতা এবং আমিই শ্রেষ্ঠা।’ নাট্যকার-নির্দেশক তখন চিরন্তন দ্রৌপদীর আত্মচেতনাকেই তুলে ধরেন। দূর থেকে যেন কুন্তীর বাণীগুলো আমাদের মর্মমূলে আঘাত হানে – ‘যা এনেছ পাঁচ ভাইয়ে ভাগ করে নাও।’

দ্রৌপদী আত্মকথনে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে অর্জুনের আচরণ। তখনই ঘোষণা বেজে ওঠে – ‘মহাভারতকন্যা দ্রৌপদী দীর্ঘ যুগ পরিভ্রমণ শেষে আমাদের রঙ্গভূমি রাজ্যে অবতরণ করেছেন।’ ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে কাহিনির জটিলতা। রূপক নানা মাত্রা ও চরিত্রের মাধ্যমে দ্রৌপদীর আগমনের যৌক্তিকতা যেন অনিবার্য হয়ে ফুটে ওঠে।

রঙ্গভূমি রাজ্য হয় এক ধরনের রূপক রাজ্য, যা সত্যজিৎ রায়ের হীরকরাজ্যের অনুকূল। সে-রাজদরবারে কৌতুক মহারাজা রঙ্গবাহাদুর সিংহাসনে আসীন। দরবারের কাঠগড়ায় দ্রৌপদী দণ্ডায়মান।  নাট্যকার-নির্দেশক প্রবীর দত্ত রঙ্গভূমি রাজ্যের মাধ্যমে সমকালীন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তার ইঙ্গিতই প্রদান করেছেন। রাজা রঙ্গবাহাদুর চরিত্রে শঙ্কর সরকারের অভিনয় অত্যন্ত প্রাণবন্ত হাস্য-কৌতুকের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ধর্মচেতনাধারী রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় রূপকাশ্রিতভাবে জ্ঞানেন্দ্রিয় ১, জ্ঞানেন্দ্রিয় ২ ইত্যাদি চরিত্র নামে ব্যাখ্যা করেছেন। শুরু হয় দ্রৌপদীর পোশাক নিয়ে নানা কৌতুক। ‘ও তে ওড়না’ পাঠ্যক্রমের প্রভৃতি সংলাপের মধ্য দিয়ে সমকালীন ধর্মবাদী আগ্রাসনকে কৌতুকপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। এ-সময়ে প্রধান দুই ধর্ম – মুসলিম ও হিন্দু এবং রাজনৈতিক ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ে দ্রৌপদী। ইসলামধর্মের জ্ঞানেন্দ্রিয় চরিত্রে তৌহিদুর ইসলাম বাদল ও হিন্দুধর্মের জ্ঞানেন্দ্রিয় চরিত্রে শাহরিয়ার ইসলাম অভিনয়ে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন।

প্রধান দুই ধর্মের নানা দৃষ্টিকোণে কৌতুকপূর্ণভাবে বিশ্লেষিত হতে থাকে দ্রৌপদী চরিত্র। সমকালে আগমনের কারণও নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে তাঁকে। মহাপ্রতিম রাজা রঙ্গবাহাদুর আবার এ দুজন ছাড়া আর পুরুষ চেনেন না। রাজ্যের যত নারী আছে তাদেরকেই শুধু রাজা রঙ্গবাহাদুর চেনেন ও জানেন। ঘনিয়ে ওঠে বর্তমান বাস্তবতার নানা ব্যাখ্যা। এমন সময় অর্জুনের আগমন যেন নতুন আরেক প্রশ্নের আঁধার হয়ে ওঠে। তবে কি প্রকৃতই অর্জুন ভালোবেসেছিল দ্রৌপদীকে। উদ্ধারে ফিরে আসা এ অর্জুন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নির্দেশক প্রবীর দত্ত। ‘তুমি আমাকে অর্জন করে কেন অন্য ভাইদের মধ্যে ভাগ করে দিলে অর্জুন?’ তীরের মতো এ-প্রশ্ন যখন দ্রৌপদীকে ঘায়েল করছিল, তখন অর্জুনও যেন দ্রৌপদীকে দাঁড় করায় আরেক সত্যের মুখোমুখি। ‘দ্রৌপদী কেন তখন পঞ্চস্বামী গ্রহণে একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করল না।’ দ্রৌপদীর অস্তিত্বেও প্রশ্ন নতুন আরেক বিমর্ষতায় ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে।

রঙ্গভূমির রাজ্যে দ্রৌপদী জীবনের নিগ্রহ আবার নতুনরূপে জেগে ওঠে। নারী-লোভ যেন সমাজের অস্তিমজ্জায়। এ-সমাজের কাছেও নতুন জিজ্ঞাসা ঘিরে ফেলে – এ-নারী সত্যিই দ্রৌপদী কিনা? সত্যিকার দ্রৌপদীকে চেনার জন্য অবশ্যই বস্ত্রহরণ করতে হবে। অতএব, নতুন করে আয়োজিত হতে থাকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ উৎসব। কিন্তু কৃষ্ণ নয়, যেন অর্জুনই যুগ যুগ ধরে ভালোবাসা দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছে দ্রৌপদীকে। নারীর সম্ভ্রম যেন পুরুষশাসিত সমাজের এক আনন্দ-উৎসব। এভাবেই নাট্যটি এগিয়ে চলে।

দ্রৌপদী চরিত্রে তিনজনের অভিনয় বেশ শিল্পকুশলতার পরিচয় দেয়। আকেফা আলম, ইউশা আনতারা ও তাহমিনা আক্তার দ্রৌপদী চরিত্রের অভিনয়ে অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন। নিদের্শক দ্রৌপদীর ভিন্ন ভিন্ন রূপকে সুনির্দিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে প্রতিস্থাপিত করেছেন। একধরনের ইন্টারটেক্সচুয়ালি ডিকনস্ট্রাকটিভ ভাবনা তাড়িত করেছে। যুগ-যুগের নারীর ভাবনাগুলো যে ঐক্যবদ্ধসূত্র গাথা এবং দ্রৌপদীর নারীযন্ত্রণা যে চিরন্তন এ-নাটকে, সে-বিষয়েই ঝোঁক পড়েছে। মহাভারতের দ্রৌপদী চরিত্রকে নারীবাদীর ভিন্ন এক ভাবনায় এ-কালের কাছে নতুন প্রশ্নেই গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে দ্রৌপদী পরম্পরা নাটকটি। নাট্যকার ও নির্দেশক প্রবীর দত্ত বয়সে তরুণ হলেও ধ্রুপদ মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন আজকের সমাজ, বাস্তবতা, ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতিকে। নাটকের নামকরণে আজকের সমাজে লুকিয়ে থাকা হাজারো দ্রৌপদীর অস্তিত্বকেই প্রতিভাত করে। কাহিনিবিন্যাসে পরাবাস্তব ধারায় অনবদ্য হয়ে উঠেছে নাটকটি। নাটকটির অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী, রফিকুল ইসলাম ও লেলিন।

নির্দেশক প্রবীর দত্তের মানসিকতা ছিল আজকের ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুনরূপে দ্রৌপদীকে আবিষ্কার করা। দ্রৌপদীর কষ্টগুলো; চাওয়া-পাওয়াগুলোর সমাধান খোঁজা। মহাভারতিক বিশ্বাসে দ্রৌপদীর বস্ত্র নিয়ে কৃষ্ণ রক্ষা করলেও অর্জুনের বস্ত্র প্রদানের প্রসঙ্গ ভালোবাসার বিলক্ষণীয় নতুন এক মানবিক অভিমূর্তিতে মূর্ত হয়ে উঠে এ-নাটক। রাষ্ট্রনীতি যে অন্ধনিষাদে বন্দি তা যেন শাশ্বত। হীরক রাজার দেশের প্রতীকে অনবদ্য কৌতুকের আবহে স্থিতধী চিন্তাগুলো পরম্পরায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নাটকে। সনাতন ধর্ম-দর্শন কিংবা মুসলিম ধর্মের বাইরে নতুন এক নারীবাদী মানবতাভঙ্গিম ভাবনা।

নাট্যবৃত্ত সরলীজাত হলেও বেশ নাট্যকীয় মুহূর্ত তৈরি হয়েছে উপস্থাপনাটিতে। থিয়েটার নাট্যদলের অনেক অনেক অভিনেতা থাকলেও এ-নাটকে দলের অতি নবীনতম অভিনয়কমী অভিনয় করেছে। কারো কারো বচনে দ্রুততা, সুস্পষ্টতাহীনতা, অতিঅভিনয় ও স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব লক্ষ করা গেলেও গল্প, মিউজিক ও কিছু কার্যকর সংলাপ প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আবার কিছু সংলাপ নাট্য বিষয়কে খেলো করার সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। মিউজিক ও আলো নাটকের মুহূর্তগুলো তৈরিতে অত্যন্ত চমৎকার। আইরিন পারভিন লোপার ডিজাইনে তৈরি পোশাকগুলো সহজ-সরল হলেও এক ধরনের ধ্রুপদী ও রাজকীয় জৌলুস তৈরি করেছে। প্রসেনিয়াম মঞ্চে নাটকটির উপস্থাপন। ওড়না, অগ্নিযজ্ঞ ও নানা উপাদান বেশ মঞ্চমায়া তৈরি করে। নানা প্রতীকী ভাবপ্রকাশের চলনগুলো শিল্পসৌন্দর্যের প্রবণতাই তুলে ধরে। দলগত পরিশ্রমী কাজ। এ-নাটকের মাধ্যমে থিয়েটার (আরামবাগ) মঞ্চে আবার নিয়মিত হচ্ছে তা বেশ আনন্দের। আমরা নাটকটির মঞ্চসাফল্য কামনা করি। বাংলাদেশের নাটকের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটুক তা আমাদের সবারই প্রত্যাশা।