নজরুলের সংগীতভাবনা অদ্বৈতবাদী সমন্বয়ের

বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠী – যাদের সুর-তাল-লয় জ্ঞান নেই, আছে কেবল সহজ-সরল ভাষা বোঝার ক্ষমতা, অনুভব-অনুভূতি, মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবনবোধ – যা দিয়ে তারা গানের সরস্বতীকে হৃদয়ে ঠাঁই দেয়, তা দিয়েই ওইসব মানুষ নজরুলসংগীতের প্রতি সবসময় তাদের অকৃত্রিম অনুরাগ প্রকাশ করে এসেছে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের যে-আবেগ, সেই আবেগের মূলে সক্রিয় প্রণোদনা জুগিয়েছে নজরুলসংগীতের সহজ-সরল বাণী।

করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর একযুগের কাব্য-সাহিত্য সাধনার পথ থেকে সরে এসে বাঁক বদলে সংগীতজীবনে বাণী ও সুরের সাধনায় নজরুল আত্মমগ্ন হয়েছেন। এই সময়ে কবিতা তাঁকে একেবারে ছেড়ে গেছে – তা নয়। তবে এরপর প্রায় একযুগ সংগীতেই পরম নিত্যানন্দের সন্ধান করেছেন। নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। কবিতার মতো বিষয়বৈচিত্র্যে-সংগীতভাবনায়ও মানুষই ছিল নজরুলের আরাধ্য, ভাব ও ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গানের রসগ্রহীতাদের জন্য নবপ্রেরণার উৎস এবং তৃপ্তিস্থল ছিল নজরুলের বিষয়বৈচিত্র্যের গান। কেউ কেউ মনে করেছেন, এতে তাঁর কাব্যসাধনার ক্ষতি হয়েছে। গ্রামোফোন কোম্পানির খপ্পরে পড়ে নজরুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু কবির সৃজনপ্রতিভা আগের মতোই জননন্দিত হওয়া প্রমাণ করে, নজরুল নজরুলই থেকে গেছেন। যা হওয়ার, তিনি তাই হয়েছেন। যতটুকু দেওয়ার জন্য তিনি অন্তর থেকে তাগিদ অনুভব করেছেন, ততটুকুই তিনি নির্ভার হয়ে দিয়ে গেছেন। মানুষের অন্তরের সহজ-সরল আবেদন ছিল নজরুলসংগীতের ভাষায়। যে বোঝে এবং যে বোঝে না সুরের রাগ-বৈচিত্র্য, তারও হৃদয়ের ভাষা হতে পেরেছে নজরুলসংগীত। যার জন্যে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে নজরুলসংগীত আদৃত হয়েছে। মানুষের ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম হবে তাঁর গান – এই আত্মবিশ^াস কাজী নজরুল ইসলামের ছিল। ‘জনসাহিত্য সংসদ’ নামে একটি সংস্থার অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে এমন আত্মপ্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন নজরুল :

‘কাব্য ও সাহিত্যে আমি কী দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল তাই আমি সহজভাবে বলেছি।

‘আমি যা অনুভব করেছি তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সংগীতে যা দিয়েছি, সে-সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ-বিশ^াস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই।

‘তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ – (বসু, ২০০০ : ৪৩০)

সংগীতে ‘কিছু দিতে পারা’র আত্মপ্রত্যয় কাজী নজরুল ইসলামের নিষ্ফল ছিল না। শতাব্দীর বাংলা গানের উৎকর্ষের বিচারে পাঁচজন সংগীতজ্ঞের মধ্যে যে-দুটি নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়, তাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এবং অন্যজন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। অন্য তিনজন – দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) ও অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)। এঁদের সঙ্গে নজরুলের গোড়া থেকেই পার্থক্য ছিল। নজরুল এঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। অগ্রজ রবি ঠাকুরের মতো তিনিও মূলত কবি এবং সংগীতসাধক ছিলেন। সাধনার ফলেই তিনি হতে পেরেছিলেন কালজয়ী সংগীতের বাণী-শিল্পী, সুরকার, সংগীত-পরিচালক ও রাগ-সংগীতের স্রষ্টা।

জানা আছে, নজরুল তাঁর কালজয়ী কবিতার জন্য নন্দিত। সে-তুলনায় হৃদয়-সংবেদী গানের জন্যও তিনি অনেক বেশি আদ্রিত ও নন্দিত। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নজরুলের স্বাতন্ত্র্য যেখানে চোখে পড়ে শতাব্দীর বাংলা গানে অনুজ উত্তরসূরির আলাদা হয়ে যাওয়া সেখানেই নিহিত। (ভট্টাচার্য, ২০১৪ : ২৫) একজন অরূপের সাধক, অপরজন রূপের পূজারি। বাণীসমৃদ্ধ  বিষয়বৈচিত্র্য ও সুরবৈশিষ্ট্যের জন্য নজরুল সমসাময়িক অন্যান্য সংগীতরচয়িতা, সুরস্রষ্টাদের তুলনায় নিজের একক ভুবন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন। এত বিচিত্র বিষয়কে অবলম্বন করে এত অধিকসংখ্যক সংগীত রচনার দৃষ্টান্ত বাংলা সংগীতের ইতিহাসে নজরুল ছাড়া দ্বিতীয় আর কারো নেই।

বাংলা গজল রচনার আগে দেশাত্মবোধক গান, উদ্দীপনামূলক-জাগরণী সংগীত, ব্যঙ্গাত্মক বা হাসির গান, নারী জাগরণী গান, জাতীয়সংগীত ইত্যাদি সময়োচিত গান নজরুল স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখেছেন। দ্বিতীয় পর্ব সংগীত সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার পর তিনি অবিরত রচনা করে গেছেন ইসলামি সংগীত, শ্যামা সংগীত, শাক্ত, শৈব, ভজন, কীর্তন, বাউল-ভাটিয়ালি, গণসংগীত ও আধুনিক গান। বাংলা গানের ভুবনে এই পর্বে নজরুলের স্থান, বলা বাহুল্য, স্বতন্ত্রধারার পথিকৃতের। বড় কবি হতে তাঁর যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়নি, তেমনি আনুষ্ঠানিক সংগীতশিক্ষা ছাড়াই সংগীতজ্ঞ হয়েছেন তিনি নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ফলে। লেটো দলে গান শিখেছেন শুনে শুনে, সংগীত-যন্ত্র বাজানো রপ্ত করেছেন নিজের চেষ্টায়। সৃজনশীল জীবনে যতদিন সক্রিয় ছিলেন ততদিন বৃহত্তর লোকমানসের প্রকৃতি ও মানবাত্মার সুর তাঁর শ্রবণেন্দ্রীয় হয়ে মর্মে গিয়ে থিতু হয়েছে। আত্মস্থ করেছেন নিবিড় মনোসংযোগে। তারপর সফল প্রয়োগ করে অনন্য পথ তৈরি করে নিয়েছেন।   

নজরুলের সংগীতপ্রতিভার প্রথমদিকে কাব্য-সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি অনুকূল পরিবেশে বিস্তার ঘটেছে দেশবন্দনা, উদ্দীপনামূলক, জাগরণী গান, গণসংগীত, হিন্দু-মুসলিমের মিলনপ্রত্যাশী অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক গানে। এরপর বাংলা গজল রচনা ও পরিবেশনের সময়ে এসে নজরুলকে পাওয়া গেল সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে, ভিন্নভাবে। এখানে তিনি ছিলেন ঝরনাধারার মতো বেগবান, তবে সংহত। গজলের সহজ-সরল বাণী ও সুরে মাতোয়ারা হয়েছে সমকালে সর্বস্তরের মানুষ। সংগীতপিপাসু শ্রোতার আন্তরিক সমীহ, ভালোলাগার এই পর্বে নজরুল অনাস্বাদিত আনন্দের স্বাদ পেয়েছেন।

বলা হয়েছে, দুই যুগের সাহিত্য এবং সংগীত সাধনা – উভয় ক্ষেত্রে নজরুলের সামগ্রিক প্রেমচেতনা সর্বস্তরের মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এখানে কবির কাবাঘর, মন্দির মানুষের হৃদয়। নজরুলের মানবতাবাদী প্রেম জীবনে ও সৃজনে মানুষের মিলন কামনায় উপমহাদেশের ধর্মীয় বিভেদকে সচেতনভাবে অগ্রাহ্য করেছে। বাংলা গজল রচনার সময়ও ফার্সি গজলের মূলভাব প্রেমকে অবলম্বন করে নজরুল অদ্বৈতবাদী সত্তার প্রার্থনায়, নিবেদনে সকল ধর্মের সাধক, প্রেমিক ও সাধারণ মানুষকে এক করে দেখেছেন। ফার্সি গজলের মূলভাব ঐশী প্রেম, যেখানে হৃদয় হচ্ছে সেই পাত্র, যে-পাত্রে ঠাঁই পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা নিবিড় প্রেম। নজরুলের বাংলা গজলও তাই পরমাত্মা-জীবাত্মার সঙ্গে প্রেমেরই টানাপড়েনের গান হয়েছে। এখানে মানবিক প্রেম জাগতিক সম্পর্ককে ছাড়িয়ে জীবাত্মা ও পরমাত্মার প্রেমে রূপ নিয়েছে। যে-প্রেম আসে ঘুমঘোরে। ঘুম ভেঙে বিচ্ছেদ রূপ নেয় কান্নায়। এ-প্রসঙ্গে নজরুলের একটি বিখ্যাত বাংলা গজল :

মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর                

নমো নম, নমো নম, নমো নম।

শিয়রে বসি চুপি চুপি চুমিলে নয়ন

মোর বিকশিল আবেশে তনু

নীপ-সম, নিরুপম, মনোরম ॥

স্বপনে কী যে কয়েছি তাই গিয়াছ চলি,

জাগিয়া কেঁদে ডাকি দেবতায় –

প্রিয়তম প্রিয়তম প্রিয়তম ॥       (সংক্ষেপিত)    

স্মর্তব্য, ফার্সি গজল রচয়িতা ইরানি কবিরা ছিলেন মরমি। গজলের আপাত অর্থের ভেতরে থাকে গূঢ় অর্থ। মনের ভাব প্রকাশে ফুল, পাখি, শরাব, সাকি, কুঞ্জবন ইত্যাদি উপমা লৌকিক জগৎ থেকে নেওয়া হয় বটে কিন্তু লৌকিক জগৎকে আশ্রয় করে লোকোত্তর জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করাই গজলের মূল নান্দনিক রূপ। যেখানে থাকে অদ্বৈত পরমসত্তা বা পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার বিরহ-মিলনের অপরোক্ষ অনুভবের বাণী। অতীন্দ্রিয় স্বপ্নসুখ। মাটিতে এর জন্ম, কিন্তু দৃষ্টি আকাশে। যার বিস্তৃতি গভীর ব্যঞ্জনাময়। (গোস্বামী : ১৯৯৬ : ১৬৪) প্রেমের ক্ষেত্রে সাধক বা প্রেমিকের কোনো ভেদ নেই, জাত নেই । সে চিরকাল একই সত্তার প্রেমিক, অনন্ত বিরহের মধ্যে থাকে এবং তার মিলনও তাই বিরহেরই নামান্তর। কেননা, মিলনের পরেই বিচ্ছেদ। পরমাত্মার পরশ যখন জীবাত্মা পায়, তখন মিলনে আনন্দ পায়। আবার একই সঙ্গে বিরহের আশঙ্কায় তাঁর মন বেদনায় কাঁদে, চোখ জলে ভরে ওঠে। ফলে বুকের তৃষ্ণা সাত সাগরের জলেও মেটে না। এমন ভাবের প্রচুর জনপ্রিয় গজল নজরুলের রয়েছে। যেমন :

এক.

কেন   কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি।

সদা   কাঁপে ভীরু হিয়া রহি রহি ॥

সে     থাকে নীল নভে আমি নয়ন জল-সায়রে

কাজল করি যারে রাখি গো আঁখি-পাতে,

স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপন অশ্রু-সাথে ॥     (সংক্ষেপিত)

দুই.

এত জল ও-কাজল চোখে

পাষাণী, আনলে বলো কে।

টলমল জল-মোতির মালা

দুলিছে ঝালর-পলকে ॥

বুকে তোর সাত সাগরের জল,

পিপাসা মিটল না কবি

ফটিক-জল! জল খুঁজিস যেথায়

কেবলি তড়িৎ ঝলকে ॥             (সংক্ষেপিত)

তিন.

নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি-জল

মলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল ॥  (সংক্ষেপিত)

চার.

কি হবে জানিয়া বলো

কেন জল নয়নে

তুমি তো ঘুমায়ে আছো

সুখে ফুল-শয়নে ॥

তুমি কি বুঝিবে বালা

কুসুমে কীটের জ্বালা,

কারো গলে দোলে মালা

কেহ ঝরে পবনে ॥           (সংক্ষেপিত)

উপর্যুক্ত গজলের প্রেমিক, সাধক, তাঁর কাছে যিনি পরমাত্মা, অদ্বৈতসত্তা, তিনি চিরকালের অধরা, অচেনা ও অজানা। প্রেমিকা রাধা তাঁকে চোখে দেখতে পায় না, শুধু বাঁশি শুনতে পায়। নজরুলের এই ভাবের একটি জনপ্রিয় গজল, যাতে ‘বিদেশি’ বলতে তিনি সেই অনন্ত সত্তা, পরমাত্মাকে বুঝিয়েছেন। যিনি বাঁশি বাজিয়েই জীবাত্মাকে ডাক দেন। সে ঘুমের ঘোরে জেগে ওঠে এবং সেই সুরে হিয়া কাঁদে। যেমন :

কে বিদেশী বন-উদাসী   বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে ॥

সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে কুসুম-বাগের গুল-বদনে ॥

                       সহসা জাগি    আধেক রাতে 

                       শুনি সে বাঁশি   বাজে হিয়াতে

                       বাহু-শিথানে   কেন কে জানে

                               কাঁদে গো বাঁশির সনে ॥         

                                         (সংক্ষেপিত)

প্রকৃতি অনুসারে নজরুল তাঁর গজলে লোকায়ত ঐতিহ্যের চিরকালের নায়ক-নায়িকা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকেই মানবিক রূপ দিয়েছেন। রূপকের আড়ালে তিনি প্রেমিকের প্রতি প্রেমাস্পদের, পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার, মাশুকের প্রতি আশেকের, স্রষ্টার প্রতি সাধকের বিরহী আত্মার ক্রন্দনকে সহজ মানবিক ভাষায় রূপ দিয়েছেন। সংগীতের বাণীর এই সরলতার গুণের জন্য নজরুলের প্রেমানুভব সারা বাংলার মৃত্তিকাসংলগ্ন মানুষ, শহুরে মানুষ, শিক্ষিত হৃদয় সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। এই শ্রেণির সংগীতে নজরুল ঈর্ষণীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজে। এই ধারার কয়েকটি সংগীত, যেমন :

এক.

বসিয়া বিজনে     কেন একা মনে

পানিয়া ভরণে     চলে লো গোরি।

চলে জলে চল    কাঁদে বনতল

ডাকে ছলছল     জল লহরী ॥        (সংক্ষেপিত)

দুই.

নিশি ভোর হল জাগিয়া, পরান-পিয়া।

কাঁদে পিউ কাঁহা পাপিয়া, পরান-পিয়া ॥

জেগে রয় জাগায় সাথি- দূরে চাঁদ, শিয়রে বাতি,

কাঁদি ফুল-শয়ন পাতিয়া, পরান পিয়া ॥    (সংক্ষেপিত)

তিন.

কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া

প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া ॥

এ ভরা ভাদরে আমার মরা নদী

উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি!

আমার এ ভাঙা-ঘটে

আমার এ হৃদি তটে

       দুকূল ছাপিয়া ॥        (সংক্ষেপিত)

উপর্যুক্ত গজলসমূহের অবয়ব জুড়ে আছে কেবল না-পাওয়া অপেক্ষার কান্না। বেদনায় শুধু যে প্রেমিক কাঁদে তা না, প্রকৃতিও কাঁদে। প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া কাঁদে।

নজরুলের বাংলা গজলে প্রেমিকের, সাধকের যে রূপ, ইসলামি গান ও ভক্তিগীতিতে একই চিত্রকল্প। এখানেও প্রেমাবেদন তীব্র অনুরাগের, অনুভবের। নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিয়ে সৃষ্টিতে মিশে এক হয়ে যেতে চেয়েছেন সাধক নজরুল। সুফিবাদীরা যাকে বলেছেন, ‘ফানা ফিল্লাহ’। অদ্বৈতসত্তার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া। মিলনের এমন নিবিড় অনুভব নজরুলের ইসলামি সংগীতে আছে। যেমন :

ধূলিকণা হবো, আমি ধূলিকণা হবো

(ওগো) নবী পদরেখা যেই পথে আঁকা

        সেই পথে বিছাইব

 পথমুখো হয়ে কদম রসুল

        চুম দিবো অনুরাগে।

ধূলি হ’বো, আমি সেই পথের ওই ধূলি হ’বো

       নবী যে পথ দিয়ে চলেছিলেন।   (সংক্ষেপিত)

অর্থাৎ, প্রেমাস্পদ সৃষ্টিতে মিশে ধূলিকণা হয়ে প্রেমিকের সান্নিধ্যে পেতে চাইছে। যে পথ দিয়ে প্রেমিক গেছেন সেই পথের ধূলিকণা হতে চাইছেন নবীপ্রেমিক নজরুল। তাঁর আধুনিক গানেও আছে এমন অনুভবের আবীর। যে-অনুরাগের চিত্র ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার অবকাশ আছে। যেখানে ব্যক্তিসত্তা নৈর্ব্যক্তিক রূপ পেয়েছে। সাধকের দেহ এবং মন যখন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায় তখন তার ভেতরে ঝরনা প্রবাহিত হয়। প্রাণ-অপ্রাণ ও প্রকৃতিতে কোনো পার্থক্য থাকে না। চিতাবাঘ মিতা, গোখরোর মতো বিষধর সাপ হয় খেলার সাথি। তাই মনের আনন্দে সাপের ঝাঁপি বুকে নিয়ে সুখে রাত কাটানো তখন অসম্ভব হয় না। এই ভাবের জনপ্রিয় নজরুলের একটি গান, যেমন :

আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ 

ঐ পাহাড়ের ঝরণা আমি উধাও হয়ে বই গো

উধাও হয়ে বই ॥

চিতা বাঘ মিতা আমার গোখরো খেলার সাথী

সাপের ঝাঁপি বুকে করে সুখে কাটাই রাতি

ঘূর্ণি হাওয়ার উর্ণি ধরে  

নাচি তা থৈ থৈ ॥  (সংক্ষেপিত)

বস্তুত ইসলামি সংগীত রচনার সময়েও নজরুলের অদ্বৈতবাদী প্রেম-চেতনা তাঁকে সর্বজনীন প্রেম-চেতনায় স্থিত রেখেছে। এ কারণে তাঁর ইসলামি সংগীত যে-কোনো ধর্মের প্রেমিকের ভাবসম্পদ হতে পারে। ইসলাম ধর্মে-বর্ণিত স্রষ্টা ‘আল্লাহ’কে নজরুল প্রভু এবং নিজেকে ভৃত্য না ভেবে প্রেমিক ভেবেছেন। তাই খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকেন। যে-পথে তাঁর মুর্শিদ নবী মোহাম্মদ আসবেন। আর এই নবী মোহাম্মদের নাম যাঁর হৃদয়ে আছে তাঁর সঙ্গে খোদারও আছে গোপন পরিচয়। অর্থাৎ, সুফি সাধকদের মতো নবীকে তিনি মুর্শিদ রূপে অন্তরে ধারণ করে খোদার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি করেন। এমন অনুভবের ইসলামি সংগীত নজরুলের নাতসমূহে স্পষ্ট। যেমন :

১.

খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে

ছেড়ে’ মসজিদ আমার মুর্শিদ এলো যে এই পথ ধরে (হায়)     (সংক্ষেপিত)

২.

আমার মোহাম্মদের নামের ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়

ওগো হৃদয়ে যার রয়।

খোদার সাথে হয়েছে তার গোপন পরিচয় ॥   (সংক্ষেপিত)

দেখা এবং অনুভবের বিষয় হচ্ছে, ইসলামের মহানবীকে নজরুল কেবল মুসলমানদের জন্য প্রেরিত হয়েছেন বলে মনে করেননি। তিনি বিশ^াস করেন, হজরত মোহাম্মদ (সা.) শুধু মুসলমানদের জন্য প্রেরিত হননি, তিনি মুসলিম-অমুসলিম, মানবজাতির মুক্তির জন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন।

উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ভেদ না করে সাম্যের বাণী প্রচার করে গেছেন। তিনি মানবজাতির মহামিলনের, প্রেমের বাণী উচ্চারণ করেছেন, যা আমরা বিস্মৃত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে নজরুল-রচিত দুটি ইসলামি সংগীতের অংশবিশেষ :

১.

লহ সালাম লহ, দ্বীনের বাদশাহ, জয় আখেরে নবী

পীড়িত জনগণে মুক্তি দিতে এলে হে নবীকুলের রবি ॥

তুমি আসার আগে ধরার মজলুম

করিত ফরিয়াদ,  চোখে ছিল না ঘুম,

ধরার জিন্দানে, বন্দি ইনসানে আজাদি দিতে এলে হে প্রিয় আল-আরাবি ॥    (সংক্ষেপিত)

২.

         তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হযরত।

মোরা ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমারি দেখানো পথ ॥

প্রভু  তোমার ধর্মে অবিশ^াসীরে তুমি ঘৃণা না’হি করে

       আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।

      তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি,

        তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী।

          মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা

          সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা,

       বেহেশত হ’তে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত ॥  

(সংক্ষেপিত)

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি সংগীতে নবীপ্রেমের গানের সংখ্যা বেশি। মহানবীকে তিনি স্বর্গ, মর্ত, পাতাল ত্রিভুবনের মোহাম্মদ বলে একাধিক সংগীতে অভিষিক্ত করেছেন।

আচারনিষ্ঠ ইসলামি ভাষ্যকাররা এই চেতনা কখনো সমর্থন করেন না। তাঁরা বেহেস্ত-দোজখ, ইহকাল-পরকাল ধারণা প্রচার করেন ও মানেন। কিন্তু  সুফিবাদী প্রেমিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নজরুল নবী মোহাম্মদকে ত্রিভুবনের প্রিয়, নিখিলের প্রেমাস্পদ বলে বন্দনা করেছেন। এ-বিষয়ে নজরুল-রচিত দুটি ইসলামি-সংগীতের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা গেল, যাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যেমন :

১.

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়

আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয় ॥

আজকে যত পাপী ও তাপী, সব গুনাহের পেল মাফী

দুনিয়া হতে বেইনসাফী জুলুম নিল বিদায় ॥   (সংক্ষেপিত)

২.

বারেক মুখে নিলে যাঁহার নাম, চিরতরে হয় দোজখ

                                                      হারাম,

পাপীর তরে দস্তে যাঁহার কাওসারের পিয়ালা ॥

‘মিম’ হরফ না থাকলে সে আহাদ, নামে মাখা তাঁর শিরিন

                                                           শাহাদ,

নিখিল প্রেমাস্পদ আমার মোহাম্মদ ত্রিভুবন উজালা ॥

আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মুর্শিদ ভাবনা, নবীকে ভালোবেসে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের প্রয়াস, মোহাম্মদ নাম জপমালা করা, নবীকে মধ্যস্থতাকারী মানা দ্বৈতবাদী ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কিন্তু অদ্বৈত সুফিবাদী প্রেমিক, সাধক, আউলিয়া, দরবেশ তাঁরা নবীপ্রেমিক। নজরুলও আশেকে রসুল বলে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন। নবীর আশেক বিশ^াস করেন, আল্লাহকে পেতে হলে নবীকে ভালোবেসেই পেতে হবে। মূল ইসলামের সঙ্গে সুফিদের এখানে বড় ব্যবধান। সুফিবাদীরা প্রেমিক। তাঁরা পীর-মুর্শিদের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পেতে চান। নিম্নে উদ্ধৃত কয়েকটি ইসলামি সংগীত এ-বিষয়ে প্রাসঙ্গিক, যেমন : 

১.

আল্লাহকে যে পাইতে চাহে, হযরতকে ভালোবেসে।

আরশ কুরসি লওহ কালাম, না চাহিতেই পেয়েছে সে ॥

                                              (সংক্ষেপিত)

২.

তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হযরত।

যত চাহি তত কাঁদি, আমার মেটে না হসরত ॥

জাগে আমার মনের কাবা ঘরে তোমারি সুরত –

                  হযরত তোমারি সুরত ॥               (সংক্ষেপিত)

৩.

তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।

ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদায়ী কালাম –  

                  মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম ॥         (সংক্ষেপিত) 

৪.

মোহাম্মদ মোর নয়ন-মনি মোহাম্মদ নাম জপমালা।

ঐ নামে মিটাই পিয়াসা ও নাম কওসারের পিয়ালা ॥

মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি,

মোহাম্মদ নাম গলায় পরি,

চাইনে বেহেশত যদি ও নাম জপতে পাই সদা নিরালা॥   

                                               (সংক্ষেপিত)

৫.

মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।

তাই কিরে তোর কণ্ঠেরি গান, ওরে এমন মধুর লাগে ॥

ওরে গোলাপ নিরিবিলি

নবীর কদম ছুঁয়েছিলি –

তাঁর কদমের খোশবু আজো তোর আতরে জাগে ॥

ওরে ভ্রমর তুই কি প্রথম

চুমেছিলি তাঁহার কদম,

গুনগুনিয়ে সেই খুশি কি জানাস রে গুলবাগে॥

(সংক্ষেপিত)

৬.

ওরে ও দরিয়ার মাঝি! মোরে নিয়ে যা রে মদিনা।

তুমি মুর্শিদ হয় পথ দেখাও ভাই আমি যে পথ চিনি না ॥

আমার প্রিয় হযরত সেথায়

আছেন নাকি ঘুমিয়ে ভাই,

আমি প্রাণে যে আর বাঁচি না রে আমার হজরতের দরশ

                                                     বিনা ॥

(সংক্ষেপিত)

প্রেমধর্মে বিশ^াসী কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সমগ্র সৃষ্টিতে যে-কোনো বিভেদকে অস্বীকার করেছেন। প্রতিবেশী ধর্মের ভক্তিগীতি রচনার ক্ষেত্রেও নজরুল অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েও বৈষ্ণব ও শাক্তসংগীত রচনার দক্ষতা নজরুল ব্যতীত আর কেউ দেখাতে পারেননি। ভক্ত যাঁরা তাঁরা নিজ নিজ ভক্তি আনুসারে ভক্তি-গীতি রচনা করেছেন বটে, তবে একই রচয়িতা শ্যাম এবং শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন এমন দৃষ্টান্ত বিরল। – (ভট্টাচার্য : ২০১৮ : ২৯) সেইসঙ্গে নজরুলের কৃতিত্ব এই, শ্যাম-শ্যামা ভক্তদের মধ্যে যে বিরোধ, তাকে আমলে না নিয়ে প্রেমিকের দৃষ্টিতে তিনি শ্যামা মায়ের কোলে শ্যামকে বসিয়ে দিয়েছেন। শ্যাম সংগীতের কৃষ্ণপ্রেম, শ্যামা সংগীতে মাতৃরূপে উপাসকের বন্দনা এবং ভক্তিমূলক গানে নজরুলের অদ্বৈত প্রেমভাব, দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে মিলনের, সমন্বয়ের।

সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা মুসলমানদের আল্লাহ এবং তাঁর প্রেরিত রসুল ইসলামের মহানবী সৃষ্টি জুড়ে ব্যাপ্ত অস্তিত্বের অধিকারী বোঝাতে নজরুল ‘ত্রিভুবন’ শব্দ ইসলামি সংগীতেও ব্যবহার করেছেন। সেই একই অর্থে ভক্তিমূলক গানে, শ্যাম-শ্যামা সংগীতেও তিনি ‘ত্রিভুবন’ ‘ত্রিজগৎ’ ‘ত্রিলোক’, ত্রিনয়ন’, ত্রিলোচন’, ত্রিশূল’ ইত্যাদি রূপক শব্দ ব্যবহার করেছেন। কোনো ভিন্নতা নেই। এক্ষেত্রে নজরুল একক ভাবনায় মহামিলনের মোহনায় দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিজগৎ আলো করে, যার দ্যুতি আছে তাঁর ভক্তিমূলক গানে । যেমন :

শ্যামা সংগীতে :

১.

আশ্রয় মোর নাই জননী ত্রিভুবনে কোথাও হায়!

দাঁড়াই মাগো কাহার কাছে তুইও যদি ঠেলিস পায়!

                                                     (সংক্ষেপিত)

২.

ত্রিজগত আলো করে আছে কালো মেয়ের পায়ের শোভা

মহাভাবে বিভোর শঙ্কর, ঐ পা জড়িয়ে মনোলোভা ॥

ঐ চরণ শোভা দেখার তরে, যোগী থাকেন ধেয়ান ধ’রে।

ত্রিভুবন ভুলে অনন্তকাল যোগী থাকেন ধেয়ান ধ’রে।

(সংক্ষেপিত)

শ্যাম সংগীতে :

১.

তুমি রাজা, নহ শুধু দ্বারকার,

ত্রিলোকের রাজা তুমি সম্রাট গ্রহ রবি শশী তারকার ॥

ছিলে রাজা মথুরায়, রাজা ব্রজধামে

শ্যাম, রাজা ছিলে তুমি কিশোরী বামে।

তুমি বনে রাজা, তুমি মনে রাজা

শিশু নটরাজ তুমি কোলে যশোদার ॥   (সংক্ষেপিত) 

ভক্তিমূলক গানে :

১.

মৌন আরতি তব বাজে নিশিদিন

ত্রিভুবন মাঝে প্রভু বাণী-বিহীন ॥

ধ্যান-মৌনী মহাযোগী অটল

আপন মহিমায় তুমি সমাসীন ॥    (সংক্ষেপিত)

২.

ব্যথিত প্রাণে দানো শান্তি, চিরন্তন, ধ্রুব-জ্যোতি।

দুখ-তাপ পীড়িত-শোকার্ত এই যাচে তব সান্ত্বনা

                                ত্রিভুবন-পতি। (সংক্ষেপিত)

৩.

প্রভাত বীণা তব বাজে হে

উদার অম্বর মাঝে হে ॥

তুষার কান্তি তব প্রশান্তি

শুভ্র আলোকে রাজে হে ॥

তব আনন্দিত গভীর বাণী

শোনে ত্রিভুবন যুক্ত পাণি

মন্ত্রমুগ্ধ ভাব গঙ্গা নিস্তরঙ্গা লাজে হে’ ॥  (সংক্ষেপিত)

প্রকৃতপক্ষে, এই পৃথিবীতে স্রষ্টার শক্তি, প্রেম প্রকাশে রয়েছে আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গি। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে স্রষ্টার রয়েছে আলাদা নাম। গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, মদিনা, কাবা ভবন কত নামে প্রার্থনার তীর্থস্থান। কিন্তু মূলে স্রষ্টা যে একজন, এই বিশ^াস কেবল প্রেমিকের। প্রেমের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টিকে এক করে দেখার মানসিকতা নজরুলের ধর্মদর্শন। ইসলামি সংগীতে, শ্যামা এবং শ্যাম সংগীতে নজরুলের সমন্বয় চেতনার রূপ তাঁর অন্তরাত্মার মূল সুর। ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েও বাংলার সংগীত ইতিহাসে এত সফল বৈষ্ণব ও শাক্তসংগীত রচনার কৃতিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কারো নেই। এই ধারার সংগীতে ভক্তি ও অনুরাগের পাশাপাশি শাক্ত এবং বৈষ্ণবদের মধ্যে মিলন বা সমন্বয় করার প্রচেষ্টা নজরুলকে সমসাময়িক অন্যান্য সংগীতরচয়িতাদের থেকে মোটা দাগে আলাদা করেছে।

একই ধর্মের মধ্যে ব্যাখ্যা কিংবা মতের ভিন্নতা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে। ভক্তি ও প্রেমের রীতিতে অদ্বৈতবাদী, সমন্বয় চেতনা থেকে নজরুল সকল মত ও বিশ্বাসকে এক পঙ্ক্তিতে ঠাঁই দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মে শিয়া. সুন্নি, কুর্দি, হানাফি, সোহরাওয়ার্দি ইত্যাদি নানা মত ও পথ যেমন আছে, তেমনি হিন্দুদের মধ্যেও শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, ব্রাহ্ম এদের মধ্যে প্রভেদ আছে। হিন্দু ধর্মের মধ্যে উনিশ শতকে কালীভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ‘যত মত তত পথ’ সর্বধর্ম মিলনের যে পথ দেখায়, নজরুলের এই ধারার সংগীতে সেই চেতনারই মহামিলনের মধুর সুর বেজেছে। (ভট্টাচার্য : ২০১৪ : ৩২) যার ফলে নজরুলও সময়ের প্রয়োজনে ভক্তিগীতিতে মুসলিম-অমুসলিমের নিরাকার-সাকার বিভেদ, হিন্দু ধর্মের আন্তঃবিভাজনকে তোয়াক্কা না করে শ্যামা মায়ের কোলে বসিয়ে দিয়েছেন শ্যামকে। শ্যামা সংগীতে, ভক্ত ডাকছে শ্যামা মাকে, সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বৈষ্ণবদেরউপাস্য শ্যাম। যেমন :

১.

শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম

মা হলো মোর মন্ত্রদাতা

ঠাকুর রাধাশ্যাম ॥

ডুবে প্রেম-যমুনাতে

করবো খেলা শ্যামের সাথে

শ্যাম যবে হানবে হেলা

মা পুরাবে মনস্কাম ॥    (সংক্ষেপিত)

২.

শ্যামা বলে ডেকেছিলেম, শ্যাম হয়ে তুই কেন এলি?  

ওমা লীলাময়ী মনের কথা কেমন করে শুনতে পেলি?

শৈলশিরে শিবের সাথে

পূজেছিলাম গভীর রাতে,

হেসে কেন কিশোর হয়ে তুই বৃন্দাবনে পালিয়ে গেলি?

(সংক্ষেপিত )

৩.

ভালোবেসে আমার শ্যামা মাকে

যার যাহা সাধ সেই নামে সে ডাকে,

সেই নামে মা দেয় রে ধরা কেউ শ্যামা কয়, কেহ শ্যাম।

এক সাগরে মিশে গিয়ে সকল নামের নদী,

সেই হরি হর কৃষ্ণ ও রাম, দেখিস তাঁকে যদি।

নিরাকারা সাকারা সে কভু

সকল জাতির উপাস্য সে প্রভু,

নয় সে নারী নয় সে পুরুষ, সর্বলোকে তাঁহার ধাম ॥

                                                 (সংক্ষেপিত)

৪.

আমি  কালি যদি পেতাম কালী রইত না এ মনের কালি।

মোর  সাদা মনের পদ্মপাতায় লিখতাম তোর শ্রীনাম খালি॥

(তোর) কালো রূপের নীল যমুনা বইত যদি মনের মাঝে

(শ্যামা) দেখতে পেত এই ত্রিভুবন কোথায় শ্যামের বেণু বাজে।

তোর কালো রূপের কৃষ্ণ আকাশ পেলে,

(আমি) ময়ূর হয়ে নাচতাম মা তারার পেখম মেলে।

দুঃখে কালো কপালে মোর হাসতো শিশু চাঁদের ফালি ॥   

(সংক্ষেপিত)

নজরুলের অদ্বৈতবাদী সমন্বয় মানসিকতা, একক স্রষ্টাকে সব সৃষ্টির মূলে অনুধাবন সক্ষমতা, প্রকাশের শক্তি ও সাহস নজরুল আত্মস্থ করেছেন একাগ্র নিষ্ঠার সঙ্গে জীবনবাদী সাধনার শক্তিতে। তাঁর সর্বজনীন প্রেমচেতনার মূলে যে একক সত্তার প্রকাশ এবং সমন্বয় চেতনা আছে, তা তিনি ঐতিহাসিক সূত্রে ধারণ করেছেন। ভারতবর্ষে পীর-আউলিয়া, সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে মধ্যযুগে যে-ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, এই ইসলাম স্থানীয় ধর্মীয় আচার-বিশ^াসের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এক ধরনের সহজিয়া রূপ পেয়েছিল। পারস্য থেকে ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে আসা সুফিবাদী ইসলাম আর আরব দেশের প্রচলিত ইসলাম – এই দুইয়ের মধ্যে আচরণগত এবং ভাবাদর্শগত  পার্থক্য ছিল। সেকালে আরবে প্রতিষ্ঠিত মূল ইসলাম হলো দ্বৈতবাদী। আর সুফিবাদী ইসলাম প্রচারকরা বিশ^াস করেন অদ্বৈতবাদে।  অদ্বৈতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই। অভিন্ন। স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক প্রেমের, প্রভু-ভৃত্যের নয়। সুফিরা ‘আমিই সে’, ‘আনাল হক’ এই সাধন তত্ত্ব যে বিশ^াস করেন এর সন্ধান তাঁরা পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের সাধকদের কাছ থেকে।

কাজী নজরুল ইসলাম এই ভারতবর্ষেরই বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক বাঙালি মুসলমান পরিবারের সন্তান। যে-বয়সে মন অনুসন্ধিৎসু হয়, সেই বালকবেলায় ঘরের পাশে হাজি পালোয়ান নামক এক সুফি সাধকের মাজারে তিনি খাদেম ছিলেন। পরিণত বয়সে নজরুল সুফি চেতনায় ঋদ্ধ, লালিত কবিদের সংস্পর্শে গেছেন এবং তাঁদের ‘অদ্বৈতবাদী’ চেতনার দ্বারা প্রাণিত হয়েছেন। সৈনিক জীবনে তাঁদের রচনা চর্চায় অভিভূত হয়েছেন। মুগ্ধ ছিলেন ইরানি কবি হাফিজ, ওমর খৈয়াম, উর্দু কবি মীর (মৃত্যু : ১৮১০), মির্জা গালিব (মৃত্যু : ১৮৭৯), এঁদের কবিতায়, গজলে, শের পাঠে, যাঁরা ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। বলেছেনও নজরুল, আমি বেশি পড়েছি গালিবকে, তাকেই বেশি জানি এবং তার কাব্য ভালবাসি। কিন্তু মীরের কবিতা আমাকে পাগল করে দেয়। পাগল তো আল্লাহর ফজলে আমি আছিই। মীর আমার পাগলামিকে আরো প্রগাঢ় করে তোলে। আমার এক পুরনো পীর (কবি হাফিজ) আছেন, যাঁর শরাবখানার দরজা আমার জন্য খোলা সবসময় থাকে। –

(বতুল : ১৯৯৯ : ২৩৩) 

সংগীতের ভুবনে কাজী নজরুলের ইসলামের বিষয় অনুরাগ মানবতাবাদী সর্বজনীন প্রেমে। সাম্যচেতনার আবহে লালিত এই প্রেম। ইসলামি সংগীতে এই ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে স্রষ্টার বন্দনায়, নবীপ্রেম, নবী-প্রশস্তির গানে। অন্যদিকে ভক্তিমূলক শ্যামা, শ্যামভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেমের গানে। নজরুলের সর্বজনীন সাম্যচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে এমন দুটি ইসলামি গান এবং ভক্তিমূলক সংগীত, যেমন :

১.

হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই।

এক বৃন্তে দুটি কুসুম একভারতে ঠাঁই ॥

সৃষ্টি যাঁর মুসলিম রে ভাই হিন্দু সৃষ্টি তাঁরি

মোরা বিবাদ করে খোদার উপর করি যে খোদকারি।

চাঁদ সুরুযের আলো হে কম-বেশি কি পাই

বাইরে শুধু রঙের তফাৎ ভিতরে ভেদ নাই ॥  

(সংক্ষেপিত)

২.

পাঠাও বেহেশত হতে হজরত পুন সাম্যের বাণী,

(আর) দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি॥

বলিয়া পাঠাও, হে হজরত

যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত,

সকল মানুষে বাসে তা’রা ভালো খোদার সৃষ্টি জানি’-

সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি ॥                           (সংক্ষেপিত)

একই প্রার্থনার ভাষা ও ভাবসত্য নিম্নোক্ত দুটি সংগীতেও আছে, যার প্রথমটি ভক্তিমূলক, দ্বিতীয়টি ইসলামি সংগীত। যেমন :

১.

দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য, হে উদার নাথ,

দাও প্রাণ

দাও অমৃত মৃত জনে,

দাও ভীত-চিত জনে, শক্তি অপরিমাণ।

হে সর্বশক্তিমান ॥ …

দাও পুণ্য প্রেম ভক্তি, মঙ্গল কল্যাণ।

ভীতি নিষেধের ঊর্ধ্বে স্থির,

রহি যেন চির-উন্নত শির

যাহা চাই যেন জয় করে পাই, গ্রহণ না করি দান।

হে সর্বশক্তিমান ॥                                     (সংক্ষেপিত)

২.

খোদা এই গরীবের শোন শোন মোনাজাত।

দিও তৃষ্ণা পেলে ঠাণ্ডা পানি ক্ষুধা পেলে লবণ-ভাত ॥

মাঠে সোনার ফসল দিও

দিও গৃহ ভরা বন্ধু প্রিয়, দিও

হৃদয় ভরা শান্তি দিও – (খোদা) সেই তো আমার আবহায়াত ॥  (সংক্ষেপিত) 

সুফিবাদী প্রেমিক, সাধক, বিশ^াস করে, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে মতপার্থক্য বিভেদের জন্ম দেয় না। বিভেদের জন্ম দেয় অপ্রেমিক সত্তা। যাঁরা প্রেমিক, তাঁরা মূলে একই স্রষ্টার বন্দনা করে। প্রেমিকের হৃদয় জলে ভেজা নরম কাদামাটির মতো, এই হৃদয় যে-কোনো ধর্মের প্রেমিকের হৃদয়ের সঙ্গে সহজে মিলে যায়। নজরুল মানবধর্মের মহামিলনের মোহনায় দাঁড়িয়ে প্রেমভাবে এই এক নিত্য ভগবানের বন্দনা করেছেন। মানুষকে আহ্বান করেছেন। সারা পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য সমান আলো দেয় একটি সূর্য। তার নিচে বসবাস করে সকল মানুষের প্রভেদ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছেন নজরুল। সকল মানুষের জন্য সমান ভালোবাসা নিয়ে সৃজন-সম্ভার জুড়ে তাঁর প্রেমের বাণী এ-কারণেই অদ্বৈতবাদী সমন্বয়ের।

যুগের সন্ধিক্ষণে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব প্রকৃতই ছিল সময়োচিত। যাঁর সৃষ্টির সামগ্রিক চেতনার মূলে মানবতাবাদী প্রেম। মানুষকে তিনি ধর্ম দিয়ে পৃথক করেননি যখন রাষ্ট্র ও সমাজে বিভেদের ষড়যন্ত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়ে ক্রমে ক্রমে আলাদা করে দিয়েছে। প্রেমিক বলেই নজরুল হয়েছেন অদ্বৈতবাদী, সমন্বয়ী এবং অসাম্প্রদায়িক। তাঁর গজল, ইসলামি গান, শ্যাম, শ্যামা সংগীতে, ভক্তিগীতিতে কালের অশনিসংকেত উপলব্ধি করে মহামিলনের সুর বেজেছে। প্রত্যাশা করা যেতে পারে, মানবতাবাদী কবির ‘মানুষ’ কবিতার মানবধর্ম-দর্শন যেখানে মহামানবের মহামিলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবি ঘোষণা করেছেন, 

এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন

বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,

মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,

এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।

এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা (কৃষ্ণ)

এই মাঠে হল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা। (মোহাম্মদ)

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি (বেদ)

ত্যাজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি। (বুদ্ধ)

এই কন্দরে আরব দুলাল শুনিতেন আহ্বান,

এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান।

                    মিথ্যা শুনিনি ভাই

এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোন মন্দির-কাবা নাই।

(‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. নজরুল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩।

২. নজরুল রচনাবলী (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ), নবম খণ্ড, রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫।

৩. জীবন ও সৃজন, কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০১৮।

৪. নজরুল সমগ্র, অষ্টম খণ্ড, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০১৮।

৫. নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, করুণাময় গোস্বামী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৬।

৬. নজরুল জীবনী, অরুণকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০০।

৭. উর্দু ভাষায় নজরুল চর্চা,  কানিজ ই বাতুল, নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকা, জন্মশতবর্ষ সংখ্যা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৯।

৮. ভাষা-সাহিত্য পাঠ, শরদিন্দু ভট্টাচার্য, বর্ষ ৩, ভলিউম ২, সংখ্যা ২ ও ৩, বাংলা বিভাগ, শাবিপ্রবি, ২০১৪।

৯. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, অবসর, ঢাকা, ২০১৬।

১০. তোরা সব জয়ধ্বনি কর (সম্পাদিত), আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৯।

১১. নজরুল ইসলাম কালজ কালোত্তর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮।

১২. জৈষ্ঠের ঝড়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা, ১৪০৫।

১৩. সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূর উল ইসলাম, নজরুল ইনস্টিটিউট, কবি ভবন, ঢাকা, ১৯৯৯।