পাশ্চাত্য সাহিত্য-সমালোচনা : রূপরেখা

ঐতিহ্যগতভাবে সাহিত্য-সমালোচনা বলতে বোঝায় সাহিত্যকর্মের যুক্তিবাদী, চিন্তামূলক ও অভিনিবেশী ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের রীতি-পদ্ধতি। সাহিত্য-সমালোচনার মাধ্যমে সাহিত্যের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বিচারের সাধারণ নীতিমালা চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া সাহিত্য অধ্যয়নের তত্ত্ব ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করাও তাত্ত্বিক সমালোচনার কাজ। অ্যাকাডেমিক কাজ হিসেবে সমালোচনা পাঠ বা টেক্সটের আলোকে পাঠকের অনুভব, প্রতিক্রিয়া, চিন্তা, জিজ্ঞাসা ইত্যাদি প্রকাশ করে।

ইংরেজি পৎরঃরপরংস সংজ্ঞার্থটি এসেছে গ্রিক criticism থেকে, যার অর্থ মর্ম অনুধাবন বা বিচারের সামর্থ্য। সংজ্ঞার্থের ব্যুৎপত্তি বিবেচনায় নিয়ে অনেক সমালোচক এই জোরালো দাবি তোলেন যে, সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন সমালোচনার অপরিহার্য উপাদান। তবে কেউ কেউ সমালোচনাকে নেতিবাচক অর্থে দেখেন। তাঁরা মনে করেন, সমালোচনা মানে ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করা। তবে আধুনিককালে সাহিত্য-সমালোচনা বলতে অধিকতর ভারসাম্যমূলক বিশ্লেষণ বোঝায়। কারণ, সাহিত্য-সমালোচকরা যখন বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেন তখন তাঁরা সাধারণত সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষের পাশাপাশি ত্রুটিও নির্দেশ করে থাকেন। এর ফলে সম্যক ও সুচিন্তিত মূল্যায়নে উপনীত হওয়া যায়।

সমালোচনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের কাজটি কখনো কখনো বাজার (এটি কি ক্রয় করার উপযোগী?) কিংবা জ্ঞানের (এটি কতটা উৎকর্ষমণ্ডিত?) ক্ষেত্রে চাহিদার মাত্রা নিরূপণ করে। সাহিত্যকর্মের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ছাড়াও সমালোচনা সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাধারণ মূলনীতির রূপরেখা তৈরি করতে পারে। ষাটের দশক থেকে সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সাহিত্য-সমালোচনা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব পেয়ে আসছে।

সাহিত্যকর্মের যৌক্তিক সমালোচনার সময় নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলির কোনো কোনোটি কিংবা সব পন্থা নানা অনুপাতে বা নানা মাত্রায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে :

১. রূপশ্রেণি অনুসারে সাহিত্যকর্মের শ্রেণিকরণ;

২. সাহিত্যের অর্থ ও তাৎপর্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ;

৩. সাহিত্যকর্মের অবয়ব বা গঠন কাঠামো নিরূপণ ও শৈলী বিশ্লেষণ;

৪. সমগোত্রীয় কাজের সঙ্গে তুলনা করে সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষ বিচার;

৫. সাহিত্যকর্ম যথাযথভাবে বুঝতে পাঠককে সাহায্য করা (এডমন্ড উইলসন, ম্যাথিউ আর্নল্ড);

৬. পাঠকের ওপর সাহিত্যকর্মের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিরূপণ (পাঠকনন্দিত হওয়া বা না-হওয়া);

৭. নীতিবাদী বা বিধিনিষেধমূলক পন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান;

৮. প্রকরণ অনুসারে সমালোচনা সাহিত্যের শ্রেণিকরণ (এইচ এম আব্রাম);

৯. নিজের সাহিত্যকর্মের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন ও ব্যাখ্যা করা (জন ড্রাইডেন, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হেনরি জেমস);

১০. কাল্পনিক সৃষ্টির মূল্যমান সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিলে নিজের সৃষ্টিকর্মের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ (ফিলিপ সিডনি, পার্সি বিশি শেলি, নব্য সমালোচনা);

১১. প্রতিষ্ঠিত মান অনুসারে সাহিত্যকর্ম বিচার (স্যামুয়েল জনসন, টি. এস. এলিয়ট);

১২. মহৎ সাহিত্য বা শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ ও প্রয়োগ (আর. জি. কলিংউড, আই. এ. রিচার্ড);

১৩. স্বতন্ত্রভাবে, রূপশ্রেণি অনুসারে কিংবা সামগ্রিকভাবে সাহিত্যকর্ম উপলব্ধি বা মূল্যায়নের সাধারণ নীতিমালা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

প্রত্যেক সমালোচকের নিজস্ব সমালোচনামূলক অবস্থান থাকে। এজন্য প্রায়শ এটা প্রতীয়মান হয় যে, কোনো সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সমালোচক যা বলেন তা বহুলাংশে নির্ভর করে কোন সমালোচনামূলক অবস্থান (approach) তিনি গ্রহণ করেছেন তার ওপর।

সমালোচনা প্রথমত শুরু হয় পাঠকের প্রতিক্রিয়া থেকে। তারই ফসল প্রতীতিবাদী (impressionistic) সমালোচনা। এতে পাঠকের অনুভবকে তুলে ধরা যায়। কোনো কবিতা পাঠককে কীভাবে অভিভূত করে তা স্পষ্ট হয়। সাহিত্যকর্ম পাঠকের কোন অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে উসকে দেয় তাও এখানে প্রকাশিত হতে পারে।

অ্যাকাডেমিক বা জ্ঞানজাগতিক সমালোচনা অবশ্য এ-ধরনের সমালোচনা থেকে আলাদা; তা অধিকতর বিশ্লেষণমূলক হয়ে থাকে। তাতে থাকে ভাববস্তু ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত এবং পাঠ বা টেক্সট নির্মাণের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা। এই পন্থায় সমালোচনা সম্পৃক্ত হয় সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় ভাববস্তু চিহ্নিত করায়। কীভাবে পাঠ উপস্থাপন করে ভাববস্তুকে বিকশিত করা হয়েছে সমালোচনায় তাও নির্দেশ করা হয়। বৃহত্তর অর্থে পাঠটিতে কোন বিষয়ে এবং কোন ধরনের অভিজ্ঞতা, অনুভব ও সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে সেটা নিরূপণ করা সমালোচকের প্রথম কর্তব্য। এরপর সমালোচক সচেষ্ট হন কীভাবে পাঠ সাহিত্যকর্মের বিষয়কে জীবন্ত করে তোলে তার স্বরূপ নির্ণয়ে। এভাবে পাঠের বিষয়কে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সহজ হয়। পাঠ-এর একান্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমালোচক দেখান কীভাবে রচয়িতা/ লেখক সাহিত্যকর্মকে সার্থক করে তোলেন। এক্ষেত্রে নানা অনুষঙ্গ ব্যবহার ও ভাষিক কুশলতার প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সমালোচককে আলোকপাত করতে হয়। এভাবে সমালোচনামূলক বিবরণ নিছক সার সংক্ষেপ বা বর্ণনা না হয়েও গুরুত্ববহ  হয়ে ওঠে।

পাঠ হচ্ছে অসীম অনুমান, যুক্তি ও বিতর্কের উৎস। কী বিষয়ে পাঠবস্তু – এই ব্যাপারটি সাহিত্য অধ্যয়নকে যুগপৎ কঠিন ও আকর্ষণীয় করে তোলে। শিক্ষার্থী যখন সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করে তখন প্রায়শই শিক্ষক কিংবা প্রভাষক পাঠবস্তুর অর্থ ও পদ্ধতি সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট নির্দেশনা দেন। এক মুহূর্ত ভাবলে তা থেকে বোঝা যায় যে, তা কেবল একজন ব্যক্তির বিশ্লেষণ। কোনো পাঠের কেন্দ্রীয় ভাববস্তু (theme) হয়তো অন্য আর একজন পাঠকের কাছে অন্যরকম হবে। কিংবা কেন্দ্রীয় ভাববস্তু সম্পর্কে অভিন্ন মত পোষণ করলেও অন্য শাখায় তিনি অন্য একটা দিকে জোর দেবেন। এবং এতে পাঠ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভিন্নতর সামগ্রিক প্রতীতীতে পৌঁছানো যেতে পারে। এই দিক থেকে এটা প্রতীয়মান হতে পারে যে, সমস্ত সমালোচনাই পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর (subjective), কারণ প্রত্যেক পাঠক অভিন্ন পাঠকে আলাদাভাবে তাঁর নিজের মতো করে দেখেন। তবে মনে রাখতে হবে, সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া সেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গনির্ভর যে সামাজিক প্রতিবেশে বইটি পঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরো আঠারো শতক এবং এর আগে সাহিত্যের মূল দিগ্দর্শন ছিল ‘আনন্দদায়ক পাঠদান’ আর সমালোচকের কাজ ছিল পাঠকের ওপর পাঠ কী ধরনের নৈতিক প্রভাব ফেলে তা দেখা। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগে এই গুরুত্বের বদল ঘটে। রোমান্টিকরা জোর দেন ব্যক্তির গুরুত্বের ওপর এবং তারই ফল হিসেবে রোমান্টিক সমালোচনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি রচয়িতা কী বলতে চান তার ওপর আলোকপাত করা হয়। একে বলা চলে সাহিত্যের প্রকাশবাদী তত্ত্ব, তা কেন্দ্রীভূত হয় লেখক কী বলেন বা প্রকাশ করেন তার ওপর। এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বহুলভাবে অব্যাহত।

সাহিত্য-সমালোচনার শ্রেণিকরণ

সাহিত্য-সমালোচনার অনেক বিদ্যাশাখা বা শ্রেণি রয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলতে পারেন, যত জন সমালোচক আছেন তত রকমের সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষ করে সত্তরের দশকের পর থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় সমালোচনার নানা তত্ত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এ-কথা প্রযোজ্য। এক ধরনের সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঠের অন্তরঙ্গ ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। অন্য এক ধরনের সমালোচনায় লেখকের জীবনীমূলক প্রেক্ষাপট কিংবা রচনাকালীন প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। আরো এক ধরনের সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে পাঠকের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া বিচার্য। সমালোচনার প্রতিটি বিদ্যাশাখা বা রূপশ্রেণি কোনো না কোনো দিককে অন্য দিকগুলির চেয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেই সঙ্গে তা সুনির্দিষ্ট পঠনের বা ব্যাখ্যার বিশেষ কৌশল অনুসরণ করে থাকে।

বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা বিভিন্ন সমাপতনমূলক (overlapping) বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। যেমন : তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক, প্রতীতীমূলক কিংবা বর্ণনামূলক। সমালোচনার সঙ্গে জড়িত লেখকের/ রচয়িতার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কখনো কখনো প্রকাশমুখী (expressive)। এর জন্ম উনিশ ও বিশ শতকের সমালোচনামূলক লেখার প্রাধান্য বিস্তারকারী রোমান্টিকতাবাদ থেকে। তবে তার প্রবণতা বস্তুনিষ্ঠ (objective) সমালোচনার জন্য পথ করে দেওয়া। কিংবা মূল কাজকেই আলোকপাত করা – যেমনটি দেখা যায় নব্য সমালোচনা (new criticism) ও অবয়ববাদে (structuralism); কখনো মনোযোগ পাঠকের দিকে নিবদ্ধ করা যেমনটি পাঠক প্রতিক্রিয়া (reader response) সমালোচনায় দেখা যায়। সমালোচনার সুনির্দিষ্ট ঘরানাও রয়েছে। সেগুলি ইতিহাস, রাজনীতি, লিঙ্গ, সামাজিক শ্রেণি, পুরাণ, ভাষাতত্ত্ব কিংবা মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে সাহিত্য বিচারে প্রয়াসী।

ঐতিহাসিকভাবে সাহিত্য-সমালোচনার একটি সাধারণ দ্বিবিভাজন হচ্ছে : প্লাতীয় বনাম আরিস্তোতলীয় সমালোচনা।

প্লাতীয় সমালোচনা

Platonic criticism

গ্রিক মনীষী প্লাতোর নামে নামাঙ্কিত এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা শিল্পকৃতির অন্তর্গত মূল্যের চেয়ে বহিরারোপিত মূল্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। মূল কর্মের চেয়ে সাহিত্যকর্ম দ্বারা সাধিত হতে পারে এমন বাইরের উদ্দেশ্যকে (নৈতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ইত্যাদি) তা প্রাধান্য দেয়। এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা আরিস্তোতলীয় সমালোচনার বিপরীত। কারণ আরিস্তোতলীয় সমালোচনা সাহিত্যকর্মের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করে।

প্লাতীয় সমালোচনায় সাহিত্যকে দেখা হয়েছে নৈতিক ও উপযোগিতামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে। সমাজে সাহিত্যের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্লাতো সাহিত্য সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছিলেন যে, কাব্য (এর দ্বারা তিনি সব ধরনের সাহিত্যকর্মকে বুঝিয়েছিলেন) মূল্যহীন; কারণ তা যথার্থ সত্যকে তুলে ধরে না (অনুকরণবাদী সমালোচনা)। তাছাড়া তা যুক্তিবোধকে শাণিত না করে বরং ক্ষতিকরভাবে জনগণের আবেগকে উসকে দেয় (প্রয়োগমুখী সমালোচনা)। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে প্লাতোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সংকীর্ণ ও ভ্রান্তিজনক।

আরিস্তোতলীয় সমালোচনা

Aristotolean criticism

গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) তাঁর বিখ্যাত কাব্যতত্ত্ব বা পোয়েটিকস গ্রন্থে আরোহী প্রণালিভিত্তিক বিশ্লেষণী সাহিত্য-সমালোচনার যে রীতি প্রবর্তন করেন তা আরিস্তোতলীয় সমালোচনা রীতি নামে পরিচিত। সমকালীন সাহিত্যকর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা করে আরিস্তোতল প্লাতোর অভিমতের জবাব দেন। তিনি সাহিত্যকর্মের সব উপাদান বিচার করেন এবং সমগ্র কর্মের অংশ হিসেবে প্রতিটি উপাদান কীভাবে কাজ করে তার বিবরণ দেন। তিনি সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু (সাহিত্যকর্ম জীবনের যে দিকটি অনুকৃত করে), উপস্থাপনার রীতিপন্থা এবং দর্শক বা পাঠকের মনে তার প্রভাব ইত্যাদি বিবেচনায় নেন। এভাবে তিনি সেকালে প্রচলিত প্রধান প্রধান প্রতিটি রূপশ্রেণির (ট্র্যাজেডি, কমেডি ও মহাকাব্য) বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা নিরূপণে সক্ষম হন। এটাই তাঁকে স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের ভিত্তি দেয় এবং তিনি বিভিন্ন রূপশ্রেণির মধ্যেকার সাদৃশ্য ও অভিন্নতা এবং সেগুলির মধ্যেকার পার্থক্য দেখাতে পারঙ্গম হন। তিনি সাহিত্য সম্পর্কে প্লাতোর নিন্দাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এবং তাঁর অভিযোগ খণ্ডন করে সাহিত্যের পক্ষাবলম্বনে এগিয়ে আসেন।

আরিস্তোতলীয় সমালোচনা ছিল যুক্তিনিষ্ঠ ও রূপাশ্রিত (formal)। সাহিত্যের পক্ষে অবস্থানের ক্ষেত্রে আরিস্তোতল তিনটি মৌলিক ধারণা তুলে ধরেন :

১. সাহিত্য হচ্ছে জীবনের অনুকৃতি (মাইমেসিস)। বাস্তব ঘটনার হুবহু বর্ণনার চেয়ে বিশ^জনীন মনোজগতের সত্যের সঙ্গে সম্ভাব্য ঘটনাকে যুক্ত করে সাহিত্য জীবনকে অনুকৃত করে (অনুকরণবাদী সমালোচনা);

২. সাহিত্যকর্মের মূল ভিত্তি হলো প্লট (মিথোস)।

সূচনা-মধ্য-অন্তবিশিষ্ট প্লটকাঠামো মনকে ধরে রাখে এবং পরিতৃপ্ত করে (প্রয়োগমুখী সমালোচনা);

৩. জনগণের আবেগকে উসকে না দিয়ে সাহিত্যের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জনগণ আবেগের বিমোক্ষণ ঘটায় (প্রয়োগমুখী সমালোচনা)।

সাহিত্যের পক্ষে আরিস্তোতল যে-অনুকরণবাদী সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন তা পুনরায় অঙ্গীভূত হয়ে আধুনিক বাস্তববাদের সৃষ্টি হয়েছে।

আপেক্ষিকতাবাদী ও নিরঙ্কুশতাবাদী সমালোচনা

সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি দ্বিবিভাজন হচ্ছে আপেক্ষিকতাবাদী (relativist) বনাম নিরঙ্কুশতাবাদী (absolutist) সমালোচনা।

আপেক্ষিকতাবাদী সমালোচকরা সাহিত্যকর্ম বিচারে যে-কোনো বা সব ধরনের মূল্যবিচারকে প্রয়োজনমতো কাজে লাগাতে চান। অন্যদিকে নিরঙ্কুশতাবাদী সমালোচকরা সাহিত্য মূল্যায়নে এক, অভিন্ন ও যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণে ব্রতী। আপেক্ষিকতাবাদী সমালোচনার অবস্থান দ্বৈতবাদী ও বহুত্ববাদী দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পক্ষান্তরে নিরঙ্কুশতাবাদী সমালোচনার সঙ্গে অদ্বৈতবাদী দর্শনের সামঞ্জস্য দেখা যায়।

তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সমালোচনা

সাহিত্য-সমালোচনায় আরেকটি দ্বিবিভাজন হচ্ছে তাত্ত্বিক (theoretical) সমালোচনা বনাম ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক (practical/ applied) সমালোচনা। তাত্ত্বিক সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে, সাধারণ মূলনীতিতে উপনীত হওয়া। অন্যদিকে ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক সমালোচনার কাজ হচ্ছে, বিশেষ কোনো সাহিত্যকর্মের মূল্যবিচার। (এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য ৫.১ ও ৫.২ দেখুন)

ব্যক্তিনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা

সমালোচনার তৃতীয় ধরনের দ্বিবিভাজন হচ্ছে মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ (subjective)  সমালোচনা বনাম বস্তুনিষ্ঠ (objective) সমালোচনা।

মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা

Subjective criticism

মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা পাঠক প্রতিক্রিয়া সমালোচনার একটি রূপবিশেষ। এ-ধরনের সমালোচনা অনুসারে পাঠকের ব্যক্তিত্বই পাঠ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাঠক প্রতিক্রিয়া সমালোচনার অন্যান্য রূপের চেয়ে এটি আলাদা। এ-ধরনের সমালোচনা সাধারণ পাঠকের চেয়ে সুনির্দিষ্ট পাঠকের পঠনকেই তুলে ধরে। মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ সমালোচনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা মার্কিন সাহিত্যতাত্ত্বিক ডেভিড ব্লিচ। এ-সংক্রান্ত তাঁর গ্রন্থ হচ্ছে রিডিং অ্যান্ড ফিলিং : অ্যান ইনট্রোডাকশন টু সাবজেকটিভ ক্রিটিসিজম (১৯৭৫)। এছাড়াও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলো নরম্যান হল্যান্ডের ফাইভ রিডার্স রিডিং (১৯৭৫)।

বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা

Objective criticism

বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাবে দেখে এর অন্তর্জাত বা সহজাত গুণাগুণের ওপর আলোকপাত করে। এ-ধরনের সমালোচনায় সাহিত্যকর্মটির রচয়িতা বা পাঠকের দিকটি কিংবা রচনা বা পঠনের পরিবেশ ইত্যাদিকে বিবেচনায় না নিয়ে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় সাহিত্যকর্মের ওপর। অর্থাৎ এ-সাহিত্যকর্মকে দেখা হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজস্ব জগৎ হিসেবে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচকরা সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেন বাইরের মানদণ্ডের চেয়ে অন্তর্নিহিত মানদণ্ডের ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাহিত্যকর্মটি কীভাবে পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে বা হবে সে-বিচারে তাঁরা উৎসাহী নন। রচয়িতার জীবনের সঙ্গে সাহিত্যকর্মের সম্পর্ক, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, যে-কালে তা রচিত হয়েছে সেই কাল এবং পাঠকের ওপর এর প্রভাব ইত্যাদিকে তাঁরা গুরুত্ব দেন না। এর পরিবর্তে তাঁরা সাহিত্যকর্মের উপাদানগুলি পরস্পর ঘনিষ্ঠ ও সংহত কি-না তা বিচার করেন। পাশাপাশি সেই সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য নিরূপণকেই তাঁরা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সাহিত্যকর্মের স্বকীয় বা অন্তর্নিহিত গুণাগুণ ও মানদণ্ডের বিচারই এক্ষেত্রে মুখ্য। অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনায় সাহিত্যের রূপগত, গাঠনিক, প্রতীকী, চিত্রকল্পীয় কুশলতা ইত্যাদিকে সাহিত্যগুণ বিচারের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার অনেক প্রবক্তা স্পষ্টতর অভিব্যক্তি পেয়েছেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক অব ইসথেটিক জাজমেন্ট (১৭৯০) গ্রন্থ থেকে।

বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাকে বিশ শতকের ব্যাপার বলে গণ্য করা চলে। এর ব্যাপক প্রসার ঘটে কবি ও সাহিত্য-সমালোচক টি. এস. ইলিয়ট, নব্য সমালোচক গোষ্ঠী ও রুশ রূপবাদীদের হাতে। তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তবে যাঁরা কোনো তত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খুব পছন্দ করেন না, তাঁরা এই পদ্ধতি বেশি প্রয়োগ করে থাকেন।

অভিমুখিনতা অনুসারে শ্রেণিকরণ

মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক এইচ এম আব্রামের শ্রেণিকরণের অনুসরণে অভিমুখিনতা অনুযায়ী সাহিত্য-সমালোচনাকে প্রধানত চারটি মৌলিক রূপশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে দেখা চলে। এক্ষেত্রে সাহিত্যকর্ম ব্যাখ্যা, বিচার ও বিশ্লেষণের কাজটি পাঠ (text) না প্রসঙ্গ (context), লেখক না পাঠক কার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত সেদিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। এই চার মৌলিক প্রবণতার অধীনে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা শাখাকে নিচের মতো করে বিন্যস্ত করা চলে :

১. পাঠ-অভিমুখী সমালোচনা

Text oriented criticism

পাঠ-অভিমুখী সমালোচনা মূলত সাহিত্যকর্মের মূল পাঠের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুথি বা পাণ্ডুলিপির সংস্করণ, ভাষা ও শৈলী বিশ্লেষণ, সাহিত্যকর্মের রূপবিচার ইত্যাদি এ-ধরনের সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত। এ জাতীয় সমালোচনার মধ্যে পড়ে :

১.১ পাঠ (textual) সমালোচনা;

১.২ অলংকারবাদী (rhetorical) সমালোচনা,

১.৩ রূপবাদী (formalist) সমালোচনা;

১.৩.১ রুশ রূপবাদী (Russian formalist) সমালোচনা;

১.৩.২ নব্য সমালোচনা (new criticism);

১.৩.৩ শিকাগো সমালোচনা (Chicago school of criticism);

১.৪ সংরূপগত (genre) সমালোচনা;

১.৫ অবয়ববাদী (structural) সমালোচনা;

১.৬ বর্ণনামূলক (descriptive) সমালোচনা;

১.৭ তুলনামূলক (comparative) সমালোচনা;

১.৮ বিনির্মাণবাদী (deconstructionist) সমালোচনা। 

২. লেখক-অভিমুখী সমালোচনা

Writer oriented criticsim

লেখক-অভিমুখী সমালোচনা মূল গুরুত্ব দেয় লেখকের ওপর। সমালোচক সচেষ্ট হন লেখকের জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে সাহিত্যকর্মের সম্পর্ক নিরূপণ করতে। এ-ধরনের সমালোচনার মধ্যে পড়ে :

২.১ জীবনকেন্দ্রিক (life-centered) সমালোচনা;

২.২ মনোবিশ্লেষণী (psychoanalytical) সমালোচনা;

২.৩ প্রকাশবাদী বা অভিব্যক্তিবাদী (expressive) সমালোচনা;

২.৪ অস্তিত্ববাদী (existential) সমালোচনা;

২.৫ নৈতিকতাবাদী (moral) সমালোচনা।

৩. প্রসঙ্গ-অভিমুখী সমালোচনা :

Context oriented criticism

প্রসঙ্গ-অভিমুখী সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে বিচার করে ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রেক্ষাপটে। এ-ধরনের সমালোচনার ঘরানাগুলির মধ্যে রয়েছে :

৩.১ অনুকরণবাদী (mimetic) সমালোচনা;

৩.২ মিথাশ্রয়ী বা আদিরূপগত (mythic) সমালোচনা;

৩.৩ ঐতিহাসিক (historical) সমালোচনা;

৩.৪ মার্কসবাদী (Marxist) সমালোচনা;

৩.৫ নারীবাদী (feminist) সমালোচনা;

৩.৬ সাংস্কৃতিক (cultural) সমালোচনা;

৩.৭ উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা (post-colonial criticism)।

৪. পাঠক-অভিমুখী সমালোচনা

Reader oriented criticism

পাঠক-অভিমুখী সমালোচনা পাঠকের মনে সাহিত্যকর্ম পাঠের যে প্রতিক্রিয়া হয় সে-সম্পর্কে আলোকপাত করে। সাধারণ পাঠকের ওপর পাঠের প্রভাবকে এতে নিরূপণ করা হয়। এ-ধরনের সমালোচনা পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা নামে পরিচিত।

৪.১ পাঠক প্রতিক্রিয়া (reader-response) সমালোচনা।

৫. অন্যান্য রূপশ্রেণির সমালোচনা

এছাড়াও সমালোচনা সাহিত্যে আরো কিছু রূপশ্রেণির ব্যবহার রয়েছে। যেমন :

৫.১ তাত্ত্বিক (theoretical) সমালোচনা;

৫.২ ব্যবহারিক বা প্রয়োগিক (practical) সমালোচনা;

৫.২.১ প্রতীতিবাদী (impressionistic) সমালোচনা;

৫.২.২ বিশ্লেষণাত্মক (analytical) সমালোচনা;

৫.২.৩ যুক্তিবিচারিক বা বৈধী (judicial) সমালোচনা;

৫.৩ অভিজ্ঞতাবাদী (pragmatic criticism)  সমালোচনা।

এই শ্রেণিকরণের মাধ্যমে সাহিত্য-সমালোচনার সবচেয়ে মৌলিক প্রবণতাগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, এগুলিকে একেবারে নিখাদ নিটোল হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এগুলির কোনো কোনোটিতে অন্য রীতির ওপর সমাপতিত হওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। এখানে সমালোচনার বিভিন্ন শ্রেণি বা রীতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।

১. পাঠ-অভিমুখী সমালোচনা

Text oriented criticism

পাঠ-অভিমুখী সমালোচনার ঘরানাগুলি প্রধানত সাহিত্যকর্মের রূপ (পাঠ ও আখ্যানের গঠনকাঠামো, দৃষ্টিকোণ, প্লটের ধাঁচ ইত্যাদি) এবং শৈলীর (অলংকার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, ছন্দ) ওপর আলোকপাত করে।

সাহিত্য-সমালোচনা চর্চার ক্ষেত্রে আধুনিক বিদ্যাশাখা ও পদ্ধতির অনেকগুলিই পাঠ-অভিমুখী অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এদের কাছে প্রধান গুরুত্ব পায় সাহিত্যকর্মের মূল পাঠ।

পাঠ-অভিমুখী সমালোচনায় পাঠ-অতিরিক্ত উপাদানগুলি ­ যেমন লেখক/ রচয়িতা (তাঁর জীবনকথা ও অন্যান্য কাজ), পাঠক (জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, বয়স, শিক্ষা ইত্যাদিগত ভেদ), কিংবা ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বৃহত্তর প্রসঙ্গ – বিশ্লেষণের আওতায় আসে না। তবে মনে রাখতে হবে, পাঠ-অভিমুখী সমালোচনার ব্যাখ্যান পদ্ধতিতে পাঠবস্তু আলোকপাতের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও কোনো কোনো সমালোচনার ঘরানা অন্যান্য দিককেও (যেমন : লেখকের জীবন-তথ্য, সাহিত্যকর্ম সম্পর্কিত পাঠ-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি) গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে পাঠ-অভিমুখী সমালোচনা ঐতিহাসিক ও সহজাতভাবে পাঠকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। মূলত পাঠের রৌপিক (ভড়ৎসধষ) ও গাঠনিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করাই পাঠ-অভিমুখী সমালোচনার কাজ। এক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বকে বিশেষভাবে কাজে লাগানো হয়। কারণ ভাষার বস্তুগত উপাদান বিচারে ভাষাতত্ত্ব কাজে লাগে। অন্যদিকে অলংকার শাস্ত্র ও শৈলীবিদ্যার সাহায্যে পাঠের ভাব ও অর্থ প্রকাশের উপায়কে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা হয়। তাছাড়া রূপবাদী-কাঠামোবাদী বিদ্যাশাখা (রুশ রূপবাদ, অবয়ববাদের প্রাগ বিদ্যাশাখা, নব্য সমালোচনা, বিনির্মাণবাদ ইত্যাদি) পাঠের সাধারণ ধাঁচ বা প্যাটার্ন নিরূপণ করতে সচেষ্ট।

১.১ পাঠ সমালোচনা

Textual criticism

পাঠ-অভিমুখী সমালোচনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে পাঠবস্তু সমালোচনা। এ-ধরনের সমালোচনা প্রামাণ্য বা নির্ভরযোগ্য পাঠ বা সংস্করণ বা ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করার পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টার সঙ্গে য্ক্তু। এদিক থেকে পাঠ-অভিমুখী সমালোচনা সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচার করে না, এর মূল কাজ সাহিত্যকর্মের অভ্রান্ততা যাচাই, প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য মূল বা আদি পাঠ আবিষ্কার, পাঠ প্রতিস্থাপন ও পাঠের সুসংবদ্ধ রূপ প্রদান।

রচয়িতা সাহিত্যকর্মের যে-পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন তার লিখিত অংশকে বলা হয় পাঠ। প্রাক্মুদ্রণ যুগে লিপিকররা হাতে নকল করে পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি তৈরি করতেন। লিপিকরদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ফলে পাণ্ডুলিপির পাঠে নানারকম অশুদ্ধি ও পাঠবিকৃতি ঘটত। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে যে পাঠভেদ দেখা দেয় তা অপনোদন করে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য পাঠ নির্ণয়ের প্রয়াসে ব্রতী হন পাঠ সমালোচকেরা। এদিক থেকে পাঠ সমালোচনার প্রাথমিক লক্ষ্য পাঠ প্রতিষ্ঠা। জে পি পোস্টেজ তাঁর কমপেনিয়ন টু ল্যাটিন স্টাডিজ গ্রন্থে পাঠ-সমালোচনাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘বিশুদ্ধ পাঠ নির্ণয়ের জন্যে মানব মনীষার সুনিপুণ ও পদ্ধতিগত প্রয়োগ’ বলে।

বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিনষ্ট হওয়ার ফলে বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আদিপাঠ পাওয়া যায় না। লেখকের অভিপ্রেত কিংবা তাঁর নিকটবর্তী পাঠ নির্ণয়ের জন্য তাই পাঠ সমালোচক প্রচলিত বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি কিংবা বিভিন্ন লভ্য সংস্করণের মুদ্রিত পাঠ সংগ্রহ করেন। পাণ্ডুলিপির কোনো খণ্ডাংশ বা খসড়া টিকে থাকলে তিনি তাও সংগ্রহে সচেষ্ট হন। অনেক সময় পাণ্ডুলিপির ভিন্ন ভিন্ন প্রতিলিপি বা সংস্করণে ভিন্ন ভিন্ন পাঠ বা পাঠভেদ লক্ষ করা যায়। পাঠ সমালোচক রচনার কাল বিবেচনায় নিয়ে এসব পাঠভেদ তুলনা করে লেখকের অভিপ্রেত পাঠ বা মূল পাঠ বা আদি পাঠ পুনরুদ্ধার বা পুনর্গঠনে ব্রতী হন। পাশাপাশি সমালোচক লিপিকর বা মুদ্রকের প্রমাদগুলি চিহ্নিত করে পাঠের ভ্রান্তি নিরসন করেন এবং কোনো ধরনের পাঠবিচ্যুতি বা প্রক্ষেপ থাকলে সেগুলি চিহ্নিত করে ও অপ্রামাণ্য সংযোজন বর্জন করে পাঠ সংশোধন তথা পুনর্গঠন করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের প্রথমদিককার নাটকের পাণ্ডুলিপির অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছিল। সেসব নাটকের মুদ্রিত পাঠেও ছিল প্রচুর ভিন্নতা। লভ্য সংস্করণগুলির পাঠের তুলনা করে ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সেগুলির পাঠ পুনর্গঠন করা হয়। এভাবে পাঠ সমালোচনার সময়ে ভাষাতত্ত্বের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এদিক থেকে পাণ্ডুলিপির মূল পাঠ সম্পাদনা ও পাঠ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান অপরিহার্য।

পাঠ সমালোচনার মৌলিক পদ্ধতি হচ্ছে পাঠের ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। রেনেসাঁস পর্বে পাশ্চাত্যে প্রাচীন লেখকদের রচনা পুনরাবিষ্কার, পাঠের শুদ্ধ সংস্করণ প্রকাশের আকাক্সক্ষা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে ভাষাতত্ত্বের ব্যবহার গুরুত্ব পায়। সাম্প্রতিককালেও এর গুরুত্ব কমেনি।

এক কথায়, পাঠ সমালোচনা হচ্ছে প্রামাণ্য পাঠ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ। আমেরিকান গ্রন্থবিশেষজ্ঞ ফ্রেডসন বাউয়ারের মতে, পাঠ সমালোচনার চারটি মৌলিক লক্ষ্য রয়েছে। এগুলি হলো:

১. বিদ্যমান পাণ্ডুলিপির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ ও বিশ্লেষণ;

২. পাণ্ডুলিপিকে মুদ্রণযোগ্য করার লক্ষ্যে পাণ্ডুলিপির হারিয়ে যাওয়া অংশ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা;

৩. পুনর্মুদ্রিত পাঠের রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিরূপণ;

৪. প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত পাঠ জনসমক্ষে তুলে ধরা।

পাঠ সমালোচনার ইতিহাসের সূচনা ধ্রুপদী গ্রিক ভাষাবিজ্ঞানের যুগে – গ্রিক ও লাতিন পাণ্ডুলিপির পাঠ উদ্ধার, পুনর্গঠন ও সম্পাদনার সূত্রে। রেনেসাঁসের সময়ে পণ্ডিতরা পাঠ সমালোচনার মাধ্যমে ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যের আদিরূপ নির্ধারণে সচেষ্ট হন। পরবর্তীকালে আধুনিক সাহিত্যেও তা প্রযুক্ত হয়। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ জেমস জয়েসের ইউলিসিস (১৯২২) গ্রন্থের সাধারণভাবে গৃহীত সংস্করণের বিশ^াসযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক। আশির দশকে গ্রন্থটির অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সেগুলির প্রতিটিই নির্ভরযোগ্য পাঠ বলে দাবি করা হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে পাঠ সমালোচনা ও ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।

পাঠ সমালোচনা এভাবে সাহিত্যকর্মের ভাষাতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। তাতে পরবর্তী গবেষণা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রকাশনার  ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া তুলনামূলক, ঐতিহাসিক ভাষা-সাহিত্য চর্চা এবং মুদ্রণবিদ্যার অধ্যয়নে পাঠ সমালোচনা কাজে লাগে। সাহিত্যকর্মের পাণ্ডুলিপির পাণ্ডিত্যপূর্ণ সংস্করণের প্রকাশনা (টীকা ভাষ্য ও নির্ঘণ্ট সমেত) পাঠ সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োগিক দিক।

১.২ অলংকারবাদী সমালোচনা

Rhetorical criticism

এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনার মূল লক্ষ্য সাহিত্যকর্মে ব্যবহৃত রচয়িতার ভাষা-বৈশিষ্ট্য নিরূপণ। রচয়িতা যেসব পন্থায় সাহিত্যকর্মকে ঋদ্ধ করে পাঠকের মন জয় করেন সেসব কলাকৌশল, উপকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর এ-ধরনের সমালোচনা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সাধারণত অলংকার ব্যবহার করে লেখক সাহিত্যকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলেন এবং তাঁর মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। সে-কারণে অলংকারবাদী সমালোচকেরা সাহিত্যকর্মে লেখকের অলংকার প্রয়োগের কৌশল, বৈশিষ্ট্য ও নৈপুণ্য বিচার করে থাকেন। এ-ধরনের সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের অভিধার্থ ও ব্যঞ্জনার্থ উপলব্ধির কলাকৌশল চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা এবং ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিরূপণের ওপর জোর দেওয়া হয়।  সাহিত্যকর্ম (বা রচয়িতা) পাঠকের ওপর কীভাবে ও কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা বিচার করতে গিয়ে আলংকারিক সমালোচনা ব্যবহারিক সমালোচনার সগোত্রীয় হয়ে পড়ে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে অলংকারবাদী সমালোচনার চর্চা চলে আসছে ধ্রুপদী কাল থেকে। প্রায় দু-হাজার বছর ধরে তা মূলপাঠ সংক্রান্ত প্রধান বিদ্যাশৃঙ্খলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। সেই প্রাচীন গ্রিক-রোমক যুগ থেকে দক্ষ বিরচন ও শক্তিশালী বাগ্মিতার ক্ষেত্রে অলংকারশাস্ত্র বেশ কিছু নিয়মকানুন ও কৌশল উদ্ভাবন করেছে। প্রাথমিকভাবে সেগুলি বাগ্মিতার সঙ্গে যুক্ত হলেও ক্রমে তা সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়।

আলংকারিক সমালোচনা পাঠভিত্তিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক ও বিশ্লেষণমূলক উপাদান যুক্ত করেছে। সেকালেও অলংকারশাস্ত্র সুনির্দিষ্ট পাঠের নমুনাকে বিশ্লেষণ করেছে বিশুদ্ধ পাঠ নির্মাণের নিয়ম নিরূপণ করতে। তাতে পাঠবিন্যাসের কাঠামোগত ও শৈলীগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাত্ত্বিক সন্ধান চালাতে গিয়ে সাহিত্যের উপকরণ ও অলংকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানকালের পাঠ-অভিমুখী সমালোচনার অনেক কিছুই প্রথাগত অলংকারশাস্ত্র থেকে এসেছে।

রচয়িতা যেসব পন্থা অবলম্বন করে সাহিত্যকর্মকে আকর্ষণীয় ও চিত্তগ্রাহী করে তোলেন সেদিকেই মূলত দৃষ্টি থাকে আলংকারিক  সমালোচনার। এ-ধরনের সমালোচনার উদ্দেশ্য রচনার কলাকৌশল, শৈলী, অলংকার ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। এক্ষেত্রে আলংকারিক সমালোচনা অলংকার প্রয়োগের সেইসব উপায় চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে যেগুলির সাহায্যে সাহিত্যের অভিধামূলক ও ব্যঞ্জনামূলক অর্থ – দুই-ই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়। সেইসঙ্গে সাহিত্যকর্মের মর্মবস্তু ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা যায়। এ-ধরনের সমালোচনা পাঠের শৈলী ও অলংকার ছাড়া অন্য কিছু বিচারে আগ্রহ দেখায় না। তবে যেহেতু সাহিত্যে অলংকার ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠককে জ্ঞাপন করা তার প্রতীতি অর্জনের জন্যে আবেদন সৃষ্টি সেদিক থেকে এ-ধরনের সমালোচক লেখক ও পাঠকের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া অধ্যয়ন করেন এবং পাঠবস্তুকে বিবেচনা করেন এদের মধ্যে যোগাযোগের উপায় হিসেবে।

সাহিত্যকর্ম বা তার রচয়িতা পাঠকের ওপর কতটা, কীভাবে ও কী ধরনের প্রভাব ফেলে তার ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে আলংকারিক সমালোচনা প্রয়োগবাদী সমালোচনার সমগোত্রীয় হয়ে পড়ে। এ-ধরনের সমালোচনার চর্চা হয়ে আসছে সেই ধ্রুপদী যুগ থেকেই। রোমক কবি হোরেস তাঁর রচিত আর্টস অফ পোয়েট্রিতে (খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক) এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, কবির উদ্দেশ্য পাঠককে হয় আনন্দ দেওয়া, না-হয় শিক্ষা দেওয়া এবং ভালো হয় দুটো হলেই।

পাঠকের ওপর প্রভাব বিস্তারের উপায় হিসেবে সাহিত্যকর্মকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি ধ্রুপদী যুগের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত সাহিত্য-সমালোচনায় মুখ্য তত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এরপর এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। সে-জায়গা দখল করে নেয় অভিব্যক্তিবাদী সমালোচনা। তা সাহিত্যকর্মকে বিচার করতে থাকে লেখকের আবেগ-অনুভূতি, মেজাজ-মর্জি ও চিন্তা-চেতনার প্রকাশ হিসেবে। আলংকারিক সমালোচনা উনিশ শতকে আরো থিতিয়ে পড়ে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার অগ্রযাত্রার প্রেক্ষাপটে। তা সাহিত্যকে বিচার করায় ব্রতী হয় লেখকের ইচ্ছানিরপেক্ষ, পাঠকের প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বস্তু হিসেবে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার উত্থানের ফলে সাহিত্য-সমালোচনায় আলংকারিক বিবেচনার গুরুত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। সাম্প্রতিককালে পাঠক-প্রতিক্রিয়ামূলক সমালোচনা ও পাঠক-অভিমুখী সমালোচনার সঙ্গে জড়িত সমালোচকদের কাজের সূত্রে আলংকারিক সমালোচনার পুনরুত্থান ও চাঙা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে সাহিত্যকে লেখক ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগের ধরন হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে নতুন করে আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়। ফলে আলংকারিক সমালোচনার রীতি নতুনভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। ষাটের দশকে তা অলংকারের চেয়ে পাঠকের ব্যাখ্যামূলক জটিল প্রতিক্রিয়ার ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে এবং পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা নামে অভিহিত হয়।

আলংকারিক সমালোচনার সীমাবদ্ধতা এই যে, তা সাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে বিচার করে না। সাহিত্যের ভাব ও মর্মবস্তু, বিষয় ও প্রতিবেশ, লেখকের চিন্তাভাবনা ও উদ্দেশ্য এ-ধরনের সমালোচনায় উপেক্ষিত ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

১.৩ রূপবাদী সমালোচনা

Formalist criticism

সাহিত্যকর্মের গঠন বা আঙ্গিকের রূপ বিচার তথা

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই রূপবাদী সমালোচনার বৈশিষ্ট্য। শৈল্পিক কাঠামো ও গঠনরূপের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণের দিকেই মূলত রূপবাদী সমালোচকের দৃষ্টি থাকে নিবদ্ধ। মূল পাঠের নিবিড় পঠনের মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের রূপের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সার্থকতা নিরূপণই এ-ধরনের সাহিত্য-সমালোচনার রীতিগত ভিত্তি। রূপবাদী সমালোচকরা রচয়িতার ভাবানুভূতি, পাঠকের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া, বাস্তবতার প্রতিফলনের স্বরূপ, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ ইত্যাদির ব্যাপারে আগ্রহী হন না। সাহিত্যের বিষয়বস্তুর প্রকৃতি বিচার কিংবা সত্য ও নৈতিকতার মানদণ্ডে তার উৎকর্ষ বিচারও এ-ধরনের সমালোচনার লক্ষ্য নয়।

রূপবাদী সমালোচকেরা সাহিত্যকে মূলত দেখেন ভাষার বিশেষায়িত ধরন হিসেবে। ভাষার সাধারণ ব্যবহার ও কাব্যিক ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে তাঁরা এই অভিমত পোষণ করেন যে, সাধারণ ভাষার মূল কাজ হচ্ছে তথ্য, সংবাদ ইত্যাদি জ্ঞাপন। সাহিত্যের ভাষা তা থেকে একেবারে আলাদা। তাকে হতে হয় বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির বাহক। সেটা সম্ভব হয় ভাষায় সাহিত্যগুণ যোগ করার মাধ্যমে।

সাহিত্যকর্মের অন্তর্জাত প্রকৃত রূপ ও গঠনরূপের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ রূপবাদী সমালোচনাকে অন্যান্য সমালোচনা-রীতি থেকে বিশেষ করে উনিশ শতকীয় রোমান্টিক ভাবনা ও জীবনীমূলক সাহিত্য-সমালোচনা থেকে পৃথক করেছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সাহিত্যের পাঠবস্তুকে পাঠ-বহির্ভূত বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা নাকচ করতে গিয়ে কিংবা ব্যক্তিবাদী সাহিত্যতত্ত্বের বিরোধিতার সূত্রে রূপবাদী সাহিত্য-সমালোচনার উদ্ভব। পাশ্চাত্যে এর সূচনা  বিশ ও ত্রিশের দশকে এবং তা জোরালো হয়ে ওঠে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে।

রূপবাদী সমালোচক তাঁর বিশ্লেষণে বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকেন। সাহিত্যকর্মের বাইরের যে-কোনো বিবেচনাকে পরিহার করে তিনি মূল সাহিত্যকর্মের ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

সাহিত্য-সমালোচনার বেশ কয়েকটি ঘরানা রূপবাদী অভিমুখিতাকে হয় গ্রহণ করেছে না হয় এর বিভিন্ন ধারণাকে কাজে লাগিয়েছে। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য রুশ রূপবাদী সমালোচনা, মার্কিন নব্য সমালোচনা। শিকাগো ঘরানাকেও এই অর্থে রূপবাদী বলে গ্রহণ করা চলে যে, সাহিত্যকর্মকে এঁরা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেন স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে ধরে নিয়ে। তবে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুতে তাঁদের আগ্রহ স্পষ্টতই রূপবাদী নয়।

১.৩.১ রুশ রূপবাদী সমালোচনা

Russian formalist criticism

প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময়ে রাশিয়ায় এ-ধরনের

সাহিত্য-সমালোচনার সূচনা হয়। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তা প্রাধান্য বিস্তার করে। এই রীতির প্রবক্তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য রুশ সাহিত্য-সমালোচক ভিক্তর শক্লোভস্কি, রুশ রূপবাদী সমালোচক রোমান জ্যাকবসন ও লোকসাহিত্যের বিখ্যাত রুশ বিশ্লেষক ভøাদিমির প্রপ। এঁদের মধ্যে রোমান জ্যাকবসন সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যধর্মিতা ও অসাহিত্যধর্মিতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণ করেন।

রুশ রূপবাদীরা সাহিত্যকে বাস্তবের প্রতিফলন কিংবা আবেগের প্রকাশ হিসেবে না দেখে মূলত তাকে দেখেছেন বাচনিক শিল্প বা শব্দশিল্প হিসেবে। তাঁরা সাধারণভাবে ব্যবহৃত ভাষা ও সাহিত্যের ভাষার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে মনোযোগী। সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণে তাঁরা বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর এবং সেই সঙ্গে প্রতীকবাদ ও ভবিষ্যবাদের আবেগের প্রভাব থেকে মুক্ত। সাহিত্য-সমালোচনাকে মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস ইত্যাদির মতো ক্ষেত্র থেকে আলাদা করে তাঁরা সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করায় উদ্যোগী হয়েছেন এবং তাকে অভিহিত করেছেন ‘সাহিত্যগুণ’ (ষরঃবৎধৎরহবংং) বলে। জ্যাকবসন উল্লেখ করেন, সাহিত্যিক দক্ষতার ভিত্তি আসলে সাহিত্যের সামগ্রিকতায় নয়, বরং সাহিত্যগুণে, অর্থাৎ সেই গুণ যা কোনো কাজকে সাহিত্য পদবাচ্য করে।

সাহিত্যগুণের অনন্য বৈশিষ্ট্য সন্ধান করতে গিয়ে রুশ রূপবাদীরা আত্মা, স্বজ্ঞা (সহজাত জ্ঞান), কল্পনা ও কাব্যপ্রতিভা ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমস্ত ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমালোচনার রূপতাত্ত্বিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে গিয়ে তাঁরা উপেক্ষা করেছেন সাহিত্য ব্যাখ্যার ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক, জীবনীমূলক ও মনস্তাত্ত্বিক রীতি-পদ্ধতিকে। সেই সঙ্গে নিয়েছেন সাহিত্যকর্মকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি।

রুশ রূপবাদীদের মতে, অন্য ধরনের  বিষয়ের সঙ্গে সাহিত্যের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, সাহিত্য নিজস্ব মাধ্যমের দিকেই নজর দাবি করে। আর তা হলো : রূপগত উপকরণ, বিন্যাসের জটিল বুনন এবং এর অনুষঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত পদ্যরূপনির্মাণ, শৈলী, বর্ণনাকাঠামো ইত্যাদি। তাই প্রচলিত বহির্কেন্দ্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে রুশ রূপবাদ ধ্বনি, ছন্দ, মাত্রা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়েছে সাহিত্যের স্বাধীন অর্থবহ উপাদান হিসেবে।

রুশ রূপবাদী সমালোচকরা সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যেমন বলা চলে, তাঁরা আখ্যান (প্লট) ও গল্পের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে দেখিয়েছেন, ঘটনাগুলি যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাই হলো আখ্যান, আর ঘটনাগুলি কালানুক্রমিকভাবে পুনর্বিন্যস্ত হলে তা হয়ে দাঁড়ায় গল্প। সাহিত্যের নানা করণকৌশলের সাহায্য নিয়ে লেখক গল্পকে আখ্যানে রূপান্তরিত করেন এবং গল্পের মৌলিক রূপান্তর ঘটান। রুশ রূপবাদীরা এটাও দেখিয়েছেন যে, অনুপ্রাস ও ছন্দের মাধ্যমে ছন্দোগত ও ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। তা ভাষাকে পুনর্গঠিত হতে সাহায্য করে।

রুশ রূপবাদী সমালোচনা ত্রিশের দশকে অব্যাহত ছিল। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের শাসন-আমলে রুশ রূপবাদকে দমন করা হয়। তখন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি সমালোচনা রীতি হিসেব গ্রহণ করা হলে রাশিয়ায় রূপবাদী আন্দোলনের অবসান ঘটে। সে-সময়ে প্রাগ-ভাষাতাত্ত্বিক ঘরানা রূপবাদী সমালোচনার বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে গ্রহণ করে। মার্কিন শৈলীতত্ত্ব (stylistics)

ও আখ্যানতত্ত্ব (narratology) রুশ রূপবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মার্কিন নব্য সমালোচনাও রুশ রূপবাদী সমালোচনা দ্বারা প্রভাবিত। রুশ রূপবাদীদের প্রবর্তিত সমালোচনাতত্ত্বের দুটি সংজ্ঞার্থ এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি হচ্ছে – ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশন বা পাঠকের স্বাভাবিক প্রত্যাশাকে ভেঙে দেওয়া এবং ফোর গ্রাউন্ডিং বা সম্মুখন তথা মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে ভাষা ব্যবহার।

১.৩.২ নব্য সমালোচনা

New criticism

 নব্য সমালোচনা রূপবাদী সাহিত্য-সমালোচনার একটি ধরন। ইংরেজ ও মার্কিন সমালোচনার এই ঘরানা সাহিত্যকর্মের ঘনিষ্ঠ পঠনকে জনপ্রিয় করে তোলে – বিশেষ করে গীতিকবিতার পঠন। এছাড়া সাহিত্য-সমালোচনায় প্রতীক, চিত্রকল্প, শব্দের মধ্যেকার সম্পর্কের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ইত্যাদি এই ধারায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

নব্য সমালোচনা কথাটি এসেছে ইংরেজি নিউ ক্রিটিসিজম’-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে। ইংরেজি পরিভাষাটি নেওয়া হয়েছে মার্কিন সমালোচক জন ক্রো র‌্যানসমের দ্য নিউ ক্রিটিসিজম (১৯৪১) গ্রন্থ থেকে।

নব্য সমালোচকেরা মনে করেন, সাহিত্যকর্মের শিল্পগুণ সন্ধান করতে হবে এর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। আর সেই জন্যে নব্য সমালোচকরা সাহিত্যকর্মকে দেখতে চান জীবনের সঙ্গে সাহিত্যকর্মের সম্পর্কের বাইরে। তাই নব্য সমালোচনার মূল নীতি হচ্ছে, সাহিত্যকর্ম বিচারে তার উৎকর্ষের ভিত্তি লেখকের অভিপ্রায় কিংবা পাঠকের অভিজ্ঞতার মধ্যে খুঁজলে চলবে না, তা সন্ধান করতে হবে সাহিত্যকর্মের মূল পাঠের মধ্যে। নব্য সমালোচনাপন্থীদের মূল উদ্দেশ্য সাহিতকর্মকে শিল্পবস্তু হিসেবে গণ্য করে তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতি তন্বিষ্ঠ – কখনো সাহিত্যকর্মের উৎস-ইতিহাস বা অন্যান্য নেপথ্য বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়।

নব্য সমালোচকেরা সাহিত্যকে বিশেষ করে কবিতাকে দেখেন স্বাধীন সত্তা হিসেবে। সাহিত্যকর্মের রূপের ওপর আলোচনায় তাঁরা আগ্রহী। তাঁরা সাহিত্য-সমালোচনাকে বিশুদ্ধ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখতে চান। রচয়িতার উদ্দেশ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক  প্রেক্ষাপট, পাঠকের ওপর প্রভাব ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে তাঁরা আদৌ আগ্রহী নন। সেজন্যে তাঁরা সাহিত্য-সমালোচনাকে উৎস, জীবনবৃত্তান্ত, পাঠ-প্রতিক্রিয়া, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বাহ্যিক বিষয়বস্তু থেকে একেবারে আলাদা করে দেখায় আগ্রহী। তাঁরা অন্তর্গত অধ্যয়ন বা নিবিড় পাঠ এবং অন্তর্জাত বিশ্লেষণের পক্ষে। নব্য সমালোচনার পদ্ধতি নাটক বা কথাসাহিত্যের চেয়ে গীতিকবিতা বিচারেই বেশি সফল। এই ধারার সমালোচকরা কবিতা বিচারে মূল পাঠকেই কেবল গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ কবিতা তৈরি হয় ভাষার অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ভিত্তিতে। কাব্যিক রূপ অধ্যয়নে সাহিত্যিক উপাদানগুলি (চিত্রকল্প, প্রতীক, আলংকারিক প্রয়োগ, রূপশ্রেণির বৈশিষ্ট্য, শৈলী, সুর ইত্যাদি) বিশেষ মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাঁরা সাহিত্যের রস উপলব্ধি করতে চান।

নব্য সমালোচকরা মনে করেন, প্লট বা চরিত্রের তুলনায় শব্দ, চিত্রকল্প, প্রতীক ইত্যাদি উপাদান বিশেষ বিশেষ অর্থের দ্যোতক এবং এগুলির সঙ্গে মূল ভাববস্তু বা থিমের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রয়েছে। এগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে ভাববস্তু পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাঁরা আরো মনে করেন, সাহিত্যের গঠন-কাঠামোর সঙ্গে তার অর্থের জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে যেগুলির সামগ্রিক ঐক্য প্রায়শ নির্ভর করে কূট অর্থ, বিরোধাভাস ও শ্লেষের ওপর। তাই অবয়ব বা কাঠামোকে তার অর্থ থেকে আলাদা করে দেখা চলে না। লেখকের অভিপ্রায়ের মধ্যে অর্থ খোঁজাকে তাঁরা অভিপ্রায় ভ্রান্তি (intentional fallacy) হিসেবে এবং পাঠকের অভিজ্ঞতার মধ্যে অর্থ খোঁজাকে তাঁরা আবেগীয় ভ্রান্তি (affective fallacy) বলে গণ্য করেন।

নব্য সমালোচনায় সমালোচক যেসব দিক তুলে ধরেন সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

১. গঠন কাঠামোর মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের ভারবস্তু ফুটিয়ে তোলার উপায় বিচার;

২. সাহিত্যকর্মের রূপ ও বিষয়বস্তু পরস্পরের কতটা পরিপূরক তা নিরূপণ;

৩. সাহিত্যকর্মকে ব্যঞ্জনাময় করে তোলার ক্ষেত্রে উপমা, প্রতীক, অলংকার ইত্যাদি ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত;

৪. বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্রের (যদি থাকে) স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা।

নব্য সমালোচনায় সাহিত্যের ভাষাকে সাংবাদিকতা, দৈনন্দিন কথাবার্তা, বৈজ্ঞানিক রচনা ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ভাষা থেকে আলাদা করে দেখা হয়। কারণ, দৈনন্দিন ভাষা সরাসরি জ্ঞাপনের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা নান্দনিক ভাষা।

নব্য সমালোচনার উদ্ভব বিশ ও ত্রিশের দশকে। এর ভিত্তি হচ্ছে ওই কালপর্বে রচিত কয়েকটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। বিশেষ করে এর সূত্রপাত আই এ রিচার্ডসের প্রিন্সিপলস অব লিটারারি ক্রিটিসিজম (১৯২৪) এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজম (১৯২৯) প্রকাশের পর। প্রথমটি ছিল সমালোচনার তাত্ত্বিক কাঠামোকেন্দ্রিক। আর দ্বিতীয় গ্রন্থে কবিতা বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়েছে অনুপুঙ্খ ভাষা অধ্যয়ন। ইংল্যান্ডে সাহিত্য-সমালোচক উইলিয়াম এমপসনের সেভেন টাইপস অব অ্যামবিগুইটি (১৯৩০) নব্য সমালোচনার ধ্রুপদী গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। তাতে রয়েছে রিচার্ড-প্রবর্তিত নিবিড় পাঠের মনকাড়া উদাহরণ। রিচার্ডের পর নব্য সমালোচনার ধারা বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন টি. এস. এলিয়ট। তাঁর দ্য ফাংশনস অফ ক্রিটিসিজম (১৯৩৩) গ্রন্থে নব্য সমালোচনা রীতি অনুসৃত হয়েছে।

নব্য সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাধান্য বিস্তার করে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে। তা অনুসৃত ও বিকশিত হয় একদল মার্কিন কবি ও সমালোচকের হাতে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : মার্কিন সাহিত্য-সমালোচক আর পি ব্ল্যাকমুর, ক্লিন্থ ব্রুকস, মার্কিন কবি প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক জন ক্রো র‌্যানসম, রবার্ট পেন ওয়ারেন, উইলিয়াম কে উইমস্যাট প্রমুখ। ষাটের দশকে তা বিদ্যায়তনিক অ্যাকাডেমিক সমালোচনা হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায়। তা মার্কিন কলেজগুলিতে সাহিত্য অধ্যয়নে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিবেচনা পরিত্যক্ত হয় এবং কট্টর রূপবাদ প্রাধান্য পায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নব্য সমালোচনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, সাহিত্যের স্বাধিকারের নামে এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহৃত হচ্ছে গোপন উদ্দেশ্যে। আর তা হলো প্রথাগত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে লালন করা। নব্য সমালোচনার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয় বিট ও প্রজেকটিভিজম আন্দোলন, পঞ্চাশের দশকে মিথাশ্রয়ী সমালোচনা, ষাটের দশকের ছাত্র-আন্দোলন। এই প্রেক্ষাপটেই সত্তরের দশকে তত্ত্বীয় সমালোচনার উদ্ভব।

নব্য সমালোচনার ক্ষীয়মাণতা সত্ত্বেও সাহিত্য-সমালোচনায় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য – বিশেষ করে সাহিত্যের নিবিড় পাঠের ক্ষেত্রে।

১.৩.৩ শিকাগো সমালোচনা

Chicago school of criticism

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ^বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সমালোচনার এই শাখা গড়ে ওঠে। এরা প্রায়শ ‘আরিস্তোতলীয়’ তথা ‘নব্য আরিস্তোতলীয়’ নামে পরিচিত। এর কারণ সাহিত্যের অবয়ব ও রূপশ্রেণি নিয়ে এদের গভীর সংশ্লিষ্টতা। এরা পাঠ বিনির্মাণে লেখকের সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেন।

রোনাল্ড ক্রেইন-সম্পাদিত ক্রিটিকস্ অ্যান্ড ক্রিটিসিজম : এনশিয়েন্ট অ্যান্ড মডার্ন (১৯৫২) গ্রন্থে শিকাগো সমালোচনার ধারা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা রয়েছে। এই ধারায় সাহিত্য-সমালোচকদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য : রিচার্ড ম্যাককেয়ন, এলডার ওলসন, রোনাল্ড ক্রেইন, বার্নাড ওয়েনবার্গ, নবম্যান ম্যাকলিয়ন প্রমুখ। এঁদের হাতে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিকাগো সমালোচনা বিকশিত হয়।

১.৪ সংরূপগত সমালোচনা

Genre criticism

এই পদ্ধতি আলংকারিক সমালোচনা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত সমালোচনা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যকর্মের সংরূপ বা রূপশ্রেণি নির্ধারণ করা হয় এবং নির্ধারিত সংরূপের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এই সংরূপের মধ্যে রয়েছে : সংরূপগত প্রত্যাশার গুচ্ছ, প্রচলিত প্রথা এবং বিধিবদ্ধতা যা সাহিত্য নির্মাণ বা ব্যাখ্যাকে চালিত করে।

সংরূপগত সমালোচনায় সাহিত্যকর্মকে তার কালের বিচারে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। সাহিত্যকর্মের শ্রেণি বিচারে কোনো অস্পষ্টতা থাকলে তা নিরূপণ করাও সংরূপগত সমালোচনার লক্ষ্য।

অলংকারে সংরূপবাদী তত্ত্ব সাহিত্যকর্মের রূপগত, বাস্তব ও প্রসঙ্গ নির্ভর শ্রেণিকরণ ও তুলনার উপায়গুলির জোগান দেয়। সাহিত্য-সমালোচকরা সাহিত্যকর্ম শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে সংরূপবাদী ধারণাকে ব্যবহার করেছেন সেই আরিস্তোতলের কাল থেকে।

আধুনিককালে রুশ দার্শনিক মিখাইল বখতিন প্রমুখ সাহিত্য-সমালোচক সংরূপকে বিবেচনা করেছেন যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে।

১.৫ অবয়ববাদী সমালোচনা

Structural criticism

সাহিত্য-সমালোচনার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে অবয়ববাদী সমালোচনার উদ্ভব অববয়ববাদী ভাষাবিজ্ঞান ও অবয়ববাদী নৃবিজ্ঞান থেকে। এর মাধ্যমে সাহিত্যকে বিচার করা হয় অবয়ব বা কাঠামো হিসেবে। কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্যকর্ম কোন গুণে বা বৈশিষ্ট্যে অনবদ্য হয়ে ওঠে অবয়ববাদীরা তা দেখায় আগ্রহী নন। তাঁরা বিচার করেন অন্যান্য সাহিত্যকর্মের সঙ্গে সেটির অবয়বগত সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য। তাঁরা সাহিত্যে এমন সব সংকেত (কোড) ও প্রচল (কনভেনশন) সন্ধান করেন যা কোনো রূপশ্রেণির সবগুলিতেই বিদ্যমান। যেমন : রুশ লোকসংস্কৃতিবিদ ভøাদিমির প্রপ তাঁর মরফোলোজি অব ফোকটেলস (১৯২৮) গ্রন্থে রুশ লোককথার অসংখ্য চরিত্রকে চারিত্রিক ভূমিকার মানদণ্ডে একেবারে সীমিত সংখ্যায় নিয়ে আসেন। যেমন : নায়ক, প্রতিনায়ক, সহায়তাকারী ইত্যাদি। এভাবে তিনি এই উপসংহার টানেন যে, গল্পের এসব উপাদান ব্যবহার করে যে-কোনো লোককাহিনির সারকথায় উপনীত হওয়া যায়।

অবয়ববাদী সমালোচনার পরবর্তী পর্যায়কে উত্তর-অবয়ববাদী সমালোচনা হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। উত্তর-অবয়ববাদী সমালোচকরা সাহিত্যকর্মকে রচয়িতা কিংবা পাঠকের চেতনা থেকে আলাদা করে দেখতে চান না। তবু তাঁরা কোনো কোনোটির ওপর আলোকপাত করে থাকেন। নানা ধরনের সাহিত্য-সমালোচনাকে ধারণ করে সত্তরের দশকে এগুলির উদ্ভব। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিনির্মাণ, পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা। আরো রয়েছে মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা ও নারীবাদী সমালোচনার কিছু রূপভেদ। ফরাসি নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক ক্লোদ লেভি স্ত্রোস, রুশ ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য-সমালোচক রোমান জ্যাকবসন, কানাডীয় সাহিত্য-সমালোচক নরথ্রপ ফ্রাই প্রমুখের রচনা এই সমালোচনারীতি বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

১.৬ বর্ণনামূলক সমালোচনা

Descriptives criticism

বর্ণনামূলক সমালোচনার লক্ষ্য সাহিত্যকর্মের তথ্যগত বিবরণ প্রদান এবং গুণাগুণ বিচার। এ-ধরনের সমালোচনায় সাহিত্যকর্মের গঠনকাঠামো বর্ণনা করা হয়। এই প্রসঙ্গে সাহিত্যকর্মের কাহিনি বর্ণনা, চরিত্রায়ণ, প্লট বিন্যাস, কাহিনি ও চরিত্রের আন্তঃসম্পর্ক ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়। অনভিনিবেশী পাঠকের চোখে হয়তো সাহিত্যকর্মের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিক এড়িয়ে যেতে পারে। বর্ণনামূলক সমালোচনায় অনেক ক্ষেত্রে সেসব দিকে পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।

বর্ণনামূলক সমালোচনার আর একটি বৈশিষ্ট্য তা অংশের সঙ্গে অংশের এবং অংশের সঙ্গে সমগ্রের সম্পর্ককে তুলে ধরে।

ইংরেজি মহৎ সাহিত্যকর্মের ভিত্তি বর্ণনার মূলনীতিগুলি আবিষ্কার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন সাহিত্য-সমালোচক স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, দার্শনিক আর ডি কলিংউড, সাহিত্য-সমালোচক আই এ রিচার্ডস প্রমুখ।

১.৭ তুলনামূলক সমালোচনা

Comparative criticism

তুলনামূলক সমালোচনায় প্রধানত সমজাতীয় সাহিত্যকর্মের বিষয় বিন্যাসের কিংবা একাধিক ভাষা, জাতি বা কালপর্বের সাহিত্যের উপাদানের তুলনা করা হয়। এতে সাহিত্যের বা রচয়িতার গুণগত উৎকর্ষ বা অপকর্ষ ধরা পড়ে। এই ধরনের সমালোচনায় কখনো একজন লেখকের সঙ্গে অন্য লেখকের, কখনো কোনো লেখকের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে অন্য লেখকের সাহিত্যকর্মের, কখনো একই লেখকের বিভিন্ন সময়ের সাহিত্যকর্মের তুলনা করা হয়। কখনো দেশি-বিদেশি সাহিত্যকর্মের তুলনা হয়ে থাকে। এভাবে তুলনামূলক সমালোচনার মাধ্যমে পাঠক বিশে^র বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। উপরন্তু এর মাধ্যমে অন্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়, সংকীর্ণ জাত্যান্ধবাদ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

উনিশ শতকে বিভিন্ন ইউরোপীয় পণ্ডিত তুলনামূলক সাহিত্য-সমালোচনার তত্ত্ব ও পদ্ধতির বিকাশ ঘটান। এইসব পণ্ডিতের মধ্যে ছিলেন ফরাসি রাজনীতিক ও সাহিত্যিক আবেল-ফ্রাঁসোয়া ভিলমাঁ, ফরাসি সাহিত্য-সমালোচক সান্ত ব্যুভ (ঝধরহঃব-ইবাঁব), ফরাসি ইতিহাসকার ও সমালোচক হিপোলিত তেইন (ঐরঢ়ঢ়ড়ষুঃব ঞধরহব), ফরাসি লেখক ফের্দিন্যান্দ ব্রুনেতিয়ের (ঋবৎফরহধহফ ইৎঁহবঃরবৎব) প্রমুখ। সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সাহিত্য আজকাল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করায় তুলনামূূলক সাহিত্য-সমালোচনাও অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে।

১.৮ বিনির্মাণবাদী সমালোচনা

Deconstructonist criticism  

বিনির্মাণবাদী সমালোচনার রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি ফরাসি চিন্তাবিদ জাক দেরিদার ভাষা দর্শনভিত্তিক মতবাদ ও রীতিপদ্ধতি। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তঁভর তিনটি বইয়ে (Of Grammatology, Writing and Difference এবং Speech and Phenomena) তিনি বিনির্মাণ তত্ত্বের বুনিয়াদ দাঁড় করান। বিনির্মাণবাদী সমালোচনা পাঠককেন্দ্রিক তত্ত্বকে কাজে লাগায়, তা রচয়িতার অভিপ্রায়ের প্রসঙ্গকে উপেক্ষা করে এবং যে-কোনো পাঠের ‘শুদ্ধ’ ব্যাখ্যা কিংবা চূড়ান্ত/ সুস্পষ্ট অর্থের সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে। বিনির্মাণবাদী সমালোচনা অসংখ্য পরস্পরবিরোধী অথচ ‘অমীমাংসিক’ অর্থকে সম্ভব করে তোলে। বিনির্মাণের তত্ত্বে দেখা যায়, ভাষার শব্দসম্ভারের মুক্ত ক্রীড়ার ফলে যুগ্ম বৈপরীত্যমূলক শব্দের স্থির ধারণা বদলে দেওয়া সম্ভব। স্থির ও বদ্ধ অবয়ব কাঠামো অনুসারে ‘ভালো’র অবস্থান ‘মন্দে’র ওপরে। ঈশ্বরের অবস্থান ‘মানুষে’র ওপরে। কিন্তু বিনির্মাণ তত্ত্বে ‘মন্দ’ উঠে আসে ভালোর ওপরে; মানুষ হয়ে যায় ‘ঈশ^রে’র চেয়ে মহান। বিনির্মাণবাদী সমালোচনা সত্তরের দশকে প্রথম গুরুত্ব পায় এবং তা পরে উত্তর-অবয়ববাদী (post structuralism)  সমালোচনার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

বিনির্মাণ দেখায় যে, প্রত্যেক পাঠের অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী অর্থ নিহিত থাকে যা একক, নিশ্চিত কোনো পঠনের প্রচেষ্টায় ধরা পড়ে না।

বিনির্মাণ বলতে ধ্বংস বোঝায় না – বাস্তবে এটা ‘বিশ্লেষণ’ শব্দের আদি অর্থের অনেক কাছাকাছি, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘নাকচ করা’। কোনো পাঠের বিনির্মাণ যথেচ্ছ সন্দেহ বা খেয়ালখুশিমাফিক বিনাশের মাধ্যমে অগ্রসর হয় না, বরং পাঠের অন্তর্গত তাৎপর্যের পরস্পরবিরোধী অর্থকে সতর্কভাবে জট ছাড়িয়ে আলাদা করে। যদি বিনির্মাণ গঠনে কোনো কিছু ধ্বংস হয়, তবে তা পাঠ নয়, বরং তা কোনো রীতি-পদ্ধতির ওপর অন্য তাৎপর্যপূর্ণ রীতি পদ্ধতির দ্ব্যর্থহীন আধিপত্যের দাবি নাকচ করে।

দেরিদা এই যুক্তি উত্থাপন করেন যে, পশ্চিমা সংস্কৃতি   সবসময় দ্বিবিভাজক বৈপরীত্যের (binnary opposition) (যেমন : পুরুষবাচক/ স্ত্রীবাচক) মাধ্যমে চিন্তাকে প্রকাশ করে। তাতে একটিকে উন্নততর (superior) এবং অন্যটিকে হীনতর (inferior) হিসেবে দেখা হয়। দেরিদা এই বৈপরীত্য মুছে ফেলতে চাননি। তিনি এই দুয়ের মধ্যেকার সীমান্তকে অস্পষ্ট করে দেন। এভাবে তিনি প্রচলিত শ্রেণিকাঠামোর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন।

সাহিত্য-সমালোচনার এই বিশেষ পদ্ধতিতে পাঠ-এর ভেতরকার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে দেখানো হয় যে, যে-কোনো পাঠ-এর একমাত্র অর্থ অসম্ভব। লেখকের ভাবনা ও কথনে এমন অনেক চিন্তা ছিল যা লেখনে স্পষ্ট নয় : পাঠ অনুপুঙ্খ করে বিচার করে ধরা পড়ে লেখনের অধিবিদ্যার উপস্থিতি। পাঠের তন্নতন্ন বিচারে টুকরো অংশের শব্দ অথবা সমার্থক শব্দের থেকে পাওয়া শব্দ পরস্পরবিরোধী চাপে পাঠকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায়। এক কথায়, পাঠের প্রতিপাদ্য ও পরিকাঠামোর অন্তরালে যে উপপাঠ্য বস্তুর বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে বিরোধী অর্থের চাপে সেই পাঠ নতুন অর্থমণ্ডিত হয়ে ওঠে। জাক দেরিদা একে বলেছেন বিনির্মাণ। অর্থাৎ পাঠকে ভেঙে ভেঙে তন্নতন্ন করে বিচার করে মূল অর্থের পাশাপাশি বিপরীত অর্থ বা ইঙ্গিতকে তুলে ধরে নতুনভাবে নির্মাণই বিনির্মাণ।

এক কথায়, বিনির্মাণ হচ্ছে পাঠ ও তার অর্থের মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপণের একটি পদ্ধতি। পাঠের বিচারমূলক অনুসন্ধানের এই পদ্ধতিতে সাহিত্যকর্মের ভাষার অভ্যন্তরীণ অবয়ব উপলব্ধির চেষ্টা করা  হয়। এক্ষেত্রে ভাষার প্রকাশিত অর্থ ও অব্যক্ত অর্থ যাচাই করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি পাঠের প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত অর্থের বিপরীত বা বিরুদ্ধ চিন্তা বোঝায় সহায়ক হয়।

দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্বে অধিবিদ্যার বিরোধিতা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বসূরি জার্মান দার্শনিক এমানুয়েল কান্ট, ফ্রিডরিখ নিৎসে ও মার্টিন হাইডেগার প্রমুখের অবদান ও ভূমিকাকে কাজে লাগিয়েছেন।

পাশাপাশি দেরিদা প্রাগ বিদ্যাশাখার ভাষাবিদ ফের্দিন দ্য স্যসুর-এর অবয়ববাদী (structuralist) ভাষাতত্ত্ব, মনোবিশ্লেষণের পুরোধা অস্ট্রিয়ান স্নায়ুতত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও ফরাসি মনোবিশ্লেষক জ্যাক লার্কার মনঃসমীক্ষণকেও গুরুত্ব দিয়েছেন।

সহায়ক রচনাপঞ্জি

১.         অমিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সমালোচনার কথা, তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৭১।

২.        ধীমান দাশগুপ্ত-সম্পাদিত পরিভাষা কোষ, কলকাতা, ২০১৩।

৩.        বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য-বিচার : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, কলকাতা, ২০০৬।

৪.        সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য সাহিত্যের সমালোচনার ধারা, কলকাতা, ১৯৬৬।

৫.  Jhon Peck and Martin Coyle, Literary Terms and criticcism, new edition, 1993.

6.  M. H. Abrams and Geoffrey Galt Harpham, A Glossary of Literary Terms, first Indian Print, 2012.

7.  Bullock Alan and others, The Fontana Dictionary of Modern Thought, second edition, 1988.

8.  Piyas Chakrabarti, Anthem Dictionary of Literary Term and Theory, Anthem Press, 

      second edition, 2010.

9.  Peter Childs and Roger Flower, The Routledge Dictonary of Literary Terms, second Indian print, 2009.

10. Chris Baldick, Oxford Concise Dictionary of Literary Terms, Oxford university Press,

      1996.

11. Martin Coyle and others, Encyclopedia of Literature and Criticsim, Routledge, London, 1990.

12. J. A. Cuddon, The Dictionary of Literary Terms and Literary Theory, 1999.

13. J. A. Cuddon, The Penguin Dictionary of Literary Terms and Literary Theory, Penguin Books,1995.

14. William Harmon and C. H. Holman, A Handbook of Literature, Prentice-Hall, 7th

      edition, 1995.

15. C. Hugh Holman, A Handbook to Literature, Macmillan Publishing Co, New York, fifth edition, 1986.

16. Barbara Johnson, The Critical Difference : Essays in the Contemporary Rhetoricc of

      Reading, 1980.

17. Vincent B. Leitch, general editor, The Norton Anthology of Theory and Criticism, W. W. Norton of Company, lnc, New York – London, 2001.

18. David Macey, The Penguin Dictionary of Critical Theory, Penguin Books, 2000.

19. Ross Murfin and Supryia M. Ray, The Bedford Glossary of Critical and Literary

      Terms, Second Edition, 2003.

20. Joseph Shipley (edited), Dictionary of Literary Terms, first Indian print, 1993.

21. Julie Rivkin and Michel Rayan (edited), Literary Thory : an Anthology, Oxford,

      Blackwell Publishers, 1998.

22. Lois Tyson, Critical Theory Today, Routledge, 2008.

24. Patrica Waugh, Literay Theory and Criticism, Oxford University Press, 2006. (চলবে)