নতুন ধরনের কাব্যপ্রয়াস

সরকার মাসুদ

ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮-তে বেরোল জুননু রাইনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ এয়া। আজকাল দেখতে পাই, কবিযশঃপ্রার্থী তরুণরা সাত-আট বছর লিখতে না লিখতেই বই প্রকাশ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, অনেকের গ্রন্থ প্রকাশিতও হয়। জুননু রাইন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। লেখা শুরুর পর প্রায় দেড় যুগ অপেক্ষা করলেন তিনি। আমি দশ-বারো বছর ধরে তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইতোপূর্বে তাঁর কিছু কবিতা পড়েছি। তাতে ভালো করে কিছু বোঝা যায়নি। এয়া আদ্যোপান্ত পড়ার পর জুননুর কবিস্বভাবটি আমার কাছে পরিষ্কার হলো।

অসংখ্য তরুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমাকে হতাশ করেছে। যদি তাতে চল্লিশটি রচনা থাকে, দেখা যায়, তার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটিই পাঠের অযোগ্য। পক্ষান্তরে জুননুর কাব্যগ্রন্থটি আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পেরেছি কৌতূহলের সঙ্গে। মনে হয়েছে, সমপ্রজন্মের অন্যদের চেয়ে জুননু অনেক বেশি কবিতামনস্ক। তাঁর বিচিত্র অনুভব আকার পেয়েছে নানাভাবে ও ভঙ্গিতে। সেসব পঙ্ক্তির ভেতর ‘কবিতা’ আছে নানা মাত্রায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেবো।

১. জোছনায় ধোয়া শীতল বাতাসে/ গল্পগুলো কান পাতলো ইতিহাসে (রাজা)

২. প্রতিটি স্বপ্নকে আতঙ্ক জাপটে ধরে ঘুম পাড়ায়/ প্রতিটি ঘুম বাতাসের পোড়া গন্ধ হয়ে উড়ে যায়/ প্রতিটি পাখি মানুষকে অনিশ্চিত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা শেখায়। (অনিহাকে অদৃশ্য হুমকি)

৩.  জোনাকির মরা আলোয়/ থোকা থোকা অন্ধকারে। (এয়া-৭)

৪. আমি কোনো মানুষ দেখি না যাদের হাতে চোখে রক্ত নেই। অথচ আমি/ হাসির মতো জীবন ভালোবাসি। অশ্রম্নর মতো জীবনের অর্থ ভালোবাসি। (ব্যর্থতাগুলোর গভীর সফলতা)

৫. একদিন ঘরের মধ্যের পাহাড়ে তোমাকে দেখব/ বুকের মধ্যে তোমাকে দেখব প্রিয় বাঘ একদিন তোমার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বো/ মৃত্যুর শান্ত পুকুরের আশ্চর্য ডুব (এয়া-২৮)

চৌষট্টি পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সতেরোটি কবিতার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। বাদবাকি কবিতাগুলো এয়া শিরোনামে। এয়া নামের ভার্সনগুলো একটি দীর্ঘ কবিতার স্বাদ উপহার দেয়, যার প্রধান থিম প্রেম বা অপ্রেম। আমার এমনও মনে হয়েছে, প্রেম ও অপ্রেমের মধ্যবর্তী এক ধরনের আধোচেনা অনুভবও সাকার হয়ে উঠেছে অনেক কাব্যখ–। এসব রচনায় এমন কিছু পঙ্ক্তি আছে, এমন ধরনের উচ্চারণ আছে, যা আমরা সচরাচর একজন কৃতী কবির সার্থক কবিতায় প্রযুক্ত হতে দেখি। মনে হয়, ওই কবিতাগুলো পড়ার পর পাঠক শুধু তৃপ্তই হবেন না, এই কবির প্রতি আশাবাদীও হয়ে উঠবেন।

ক. এখনও তোমার অভিমান/ রাতের মিনারে নীল নামে ফোটে/এখনও তোমার নামে পাখির গানেরা/ পাহাড়ের বোবা সুরে রটে।

খ. … তোমার কবিতায় আমার গল্প লেখা আছে/ যেখানে সাপেরা নীরবতা খেয়ে খেয়ে বাঁচে

গ. দূরের আধমরা নদীতে রাত্রিটার শুয়ে পড়া শেষে/ এখানে-ওখানে তোমার মৃত্যুতে ভেসে ওঠা দেশে/ আমি খুব একা/ একা বন/ একা পাখিদের উড়াল/ একা সবুজের ঢেউ।

ঘ. আমার মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অভিযোগে/ ঘুরে ঘুরে ফিরে আসা গত কয়েকটি দিন/ কী যেন বলতে চায়!

ঙ. একদিন এখানে এসো, বসো – / দেখো, একটি টিয়ে উড়বে পাহাড়ে/ পাহাড় ভরে উঠবে তোমার উড়ালে/ চলে যাওয়ার দাগে, স্মৃতিতে।

এই বইয়ের কবিতাগুলো ছোট ছোট। আট থেকে বারো কিংবা চোদ্দো লাইনের মধ্যে শেষ হয়েছে। বোধ করি জুননু রাইন এরকম সংক্ষিপ্ত কবিতায় অভ্যস্ত। তা ছাড়া যদি অল্প কথায় বক্তব্য শেষ করা যায়, বাকবিস্তারের প্রয়োজন কী? বাকবিস্তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে; ব্যঞ্জনা ব্যাহত হয়। এটা আমরা শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ওমর আলী, রফিক আজাদ প্রমুখ খ্যাতিমান কবির মধ্যেও দেখেছি। এঁদের পরিণত বয়সের কবিতাও এই ত্রম্নটি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বলছি না, জুননুর কবিতার মধ্যে শব্দবাহুল্য নেই। আছে কোথাও কোথাও। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই কবি এখনো তরুণ এবং এটা তাঁর প্রথম কবিতার বই।

সমৃদ্ধ চিত্রকল্প, ব্যতিক্রমী শব্দপ্রয়োগ, পরোক্ষভাষণ, অপ্রচল উপমা এবং কূটাভাসদীপ্তি আধুনিক কবিতার একেকটি বড় সম্পদ। জুননু সাধ্যমতো এসব ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। ‘কাকতাড়ুয়া’ এবং ‘বিশ্বজিৎ’ নামে পাঁচ লাইনের দুটি কবিতা আছে গ্রন্থে। দুটিই তুলে ধরেছে কবিতার সংহত রূপের ঋদ্ধ চিত্র। বিশেষ করে  ‘কাকতাড়ুয়া’ কবিতাটি অতুল; আরম্ভও হয়েছে চমৎকারভাবে – ‘একা থাকার জন্য সে ছেড়েছিল রক্ত মাংসের জীবনের স্বাদ।’ ‘বিশ্বজিৎ’কে আমি দেবো ৭০ শতাংশ মার্কস। কেননা লেখকের মৃত্যুচেতনা এখানে এক হূদয়গ্রাহী চিত্রকল্পের চেহারা অর্জন করেছে। কবির আরো কিছু উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তি এরকম –

ক.   … জানো তো, দুপুর খুব হমত্মারক! আমার নিরীহ পাখির ডাকগুলো/ শুষ্ক করে দেয়।

খ. আমার কচুরি ফুলে ঢেউ ভাঙে, সামান্য কম্পনে/ পৃথিবী জেগে ওঠে তুমিহীনতার সহিংসতায়।

গ. তোমার ইচ্ছের মতো খাড়া হয়ে আছে বিশ্বাসের সবুজ মিনার/ তোমার ‘কিছু জানি না’র হলুদ গল্পে গেঁথে আছে সহস্র ইতিহাস।

ঘ. আমার পাখিগুলো ভিজে গেলে, ভীষণ শীত আসবে/ তখন ভালো লাগবে না আমার কচুরি ফুলের/ ভালো লাগবে না  

আমার কাশফুলের, হাস্নাহেনার/ একা হয়ে যাবে শিউলি-বকুল, পলাশ আর তোমার জুঁই/ তোমার আকাশ খুলে দাও, আমি একবার আমাকে ছুঁই।

একটি কবিতায় জুননু বলেছেন, ‘তোমার বিকেল বিছিয়ে বসে  থাকার গাছ থেকে সমুদ্র ঝরে ঝরে যায়।’ কেমন গাছ? ‘বিকেল বিছিয়ে বসে থাকার গাছ।’ আরেকটি কবিতায় লিখেছেন, ‘ঠান্ডা সাপের গতিতে বাতাস ঢুকবে হূদয়ে।’ বাতাস কোথায় ঢুকবে? ‘হূদয়ে।’ অভিনিবেশী পাঠক নিশ্চয় প্রকাশভঙ্গির এই বিশিষ্টতা লক্ষ করবেন। অন্য এক জায়গায় লেখক বলেছেন, ‘তোমার মৃত্যুতে ভেসে ওঠা দেশে/ আমি খুব একা।’ দেশের যে কাব্যিক বর্ণনা এখানে পাচ্ছি তাও স্বাতন্ত্র্যলিপ্সু কবি-মনের পরিচায়ক। উপলব্ধির বৈপরীত্যও কখনো কখনো সুফল বয়ে আনে কবিতার জন্য। সেরকম একটি স্তবক তুলে দিচ্ছি – ‘এখানে কোনো পথ রাখবো না তোমাকে পাবার/ এখানে কোনো পথ থাকবে না তোমাকে হারাবার/ এখানে কোনো পথ নেই তোমাকে পেরুবার।’ এই কাব্যগ্রন্থে কয়েকটি নিটোল কবিতা আছে, যেগুলো সম্বন্ধে ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’ কথাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। আছে উদ্ধৃতিযোগ্য আরো কিছু পঙ্ক্তি। জুননু রাইনের কল্পনায় চমৎকারিত্ব আছে, ক্ষেত্রবিশেষে আছে অস্বচ্ছতাও। বেশি না হলেও কয়েকটি স্থানে শব্দের ব্যবহার জুতসই মনে হয়নি। এসব সত্ত্বেও আমি বলব, এয়া যতখানি কাব্যসামর্থ্য প্রকাশ করতে পেরেছে, তা সচরাচর কোনো তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায় না। বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লেখক তাঁর ত্রম্নটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলেই মনে করি। জুননুকে অভিনন্দন।