সৃজনের মহৎ উদ্ভাসে আলোকিত হৃদয়

সুশীল সাহা
জল বৈঠার কাব্য ফাহিম ফয়সাল কুঁড়েঘর প্রকাশনী ঢাকা, ২০১৫ ২০০ টাকা

ফাহিম ফয়সাল বাংলা কবিতা-অঙ্গনে একান্তই নবীন। পেশায় আইনজ্ঞ, বিচারক। নেশা কবিতাকে বাচিক শিল্পের মোড়কে উদ্বোধিত করে তার সোনামোড়া রূপের বিন্যাস। হয়তো কবিতার সেই রূপময় বিন্যাসে মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজেও কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। রংপুরের নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের উদারমনস্ক সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন তাঁকে লেখালেখির প্রতি এক অমোঘ টানে আবদ্ধ করেছে একসময়। তবে সেসব লেখা ছিল একান্তই নিজস্ব; বলা যায় তা ছিল একান্তভাবে কবি হয়ে-ওঠার এক দুর্মর সাধনা। এসব তথ্য কবির প্রথম বই জল বৈঠার কাব্য থেকে আহরণ করেছি এবং সেই আলোকেই প্রবেশ করতে চেয়েছি তাঁর কবিতাভুবনে।
জল বৈঠার কাব্য এই কাব্যগ্রন্থের ‘বিভাব’ কবিতায় কবি ফাহিম ফয়সালের এক অপরূপ কল্পনাশক্তির পরিচয় আমরা পাই। মাত্র কয়েকটি ছত্রের মধ্য দিয়ে তিনি চমৎকার এক কাব্যময় বাতাবরণ তৈরি করেছেন। এখানে তারই এক ঝলক দেওয়া একান্ত জরুরি মনে করছি। পড়তে পড়তে কবির মনোগহনের এক চমৎকার অনুভব আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। কবি লেখেন, ‘ঝিঁঝিঁ-সন্ধ্যায় কিংবা রাত্রিতে গ্রামের নির্জন পথে, কখনো হাতের মুঠোয়, কখনো বুকপকেটে একটা জোনাক-পোকা আলতো করে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াই, একাকী!’ সতত জ্বলতে থাকা জোনাকির আলোর বিচ্ছুরণ কবির অন্তরে প্রাণস্পন্দনের সঞ্চার করে। সেই সঞ্চরণের প্রবাহে স্নাত হয়ে এক অনন্য অনুভবে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরো লেখেন, ‘মনে হয় শুদ্ধতম বন্ধুর সাথে রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়েছি। উপলব্ধির মৃদু-চঞ্চল হাওয়াগুলোকে কবিতা আর গল্পের বেলুনে পুরে ছড়িয়ে দিই গ্রীষ্মের অলস দুপুরে ভেসে চলা শিমুল তুলোর মতো, যাক, ছড়িয়ে যাক ওরা দূরে, আরো দূরে, আ-রো দূ-রে, একেবারে দিগন্ত ছাড়িয়ে’ – এমন যাঁর অনুভূতির সূক্ষ্মতা, তাঁর লেখায় প্রথম থেকেই এক মহৎ প্রত্যাশা বাসা বোনে আমাদের মনে। আমরা একটু একটু করে প্রবেশ করি তাঁর কবিতাভুবনের রংমহলে।
কবির চিমত্মাচেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, তাঁর চিমত্মাভাবনায় স্বদেশের কল্যাণ, সাধারণ মানুষের সুখে-স্বস্তিতে থাকার স্বপ্ন। তাই যখন তিনি দেখেন তাঁর চারপাশের মানুষের অধোগতি, মুক্তিযুদ্ধের চিমত্মা-চেতনারহিত এক সমাজব্যবস্থা যখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন তিনি ব্যথিত হন, তাঁর আত্মা বিদ্রোহ করতে চায়, তিনি তাই অকপটে লিখে ফেলেন,
ঘুমাও স্বপ্নভুক ঘুমাও
এই পরম অশামিত্মর দেশে,
পরাজিতের যূথবদ্ধ শব্দে
এখন সংজ্ঞায়িত তোমার চেতনা
তোমার বারুদ-রক্তে
ওরা মেটায় শোধের পিপাসা
ঘুমাও মুক্তিপ্রেমিক ঘুমাও
এই ক্ষীণস্মৃতি অপদার্থের দেশে
এই অনুভবের বিস্তার আমরা দেখতে পাই তাঁর ‘রক্ত, এক প্রচলিত মুদ্রা’ শীর্ষক কবিতায় :
রক্ত ছাড়া উর্বর হয় না কিছুই
স্বাধীনতা চাও? রক্ত দাও
গণতন্ত্র চাও? রক্ত দাও
ক্ষমতা চাও? রক্ত দাও
বলা বাহুল্য, এই কবিতা হতাশা থেকে উত্তরণের, জীবনবোধে উজ্জ্বল এক দৃঢ় অনুভবের।
তাঁর চিমত্মাচেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বিভাব কখনো কখনো হতাশার মোড়কে আচ্ছাদিত হয়ে গেলেও তা থেকে তাঁর কবিসত্তা তাঁকে ফিরিয়ে আনে। ইতিহাসতাড়িত তাঁর মন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার আলোকে দেখতে চায় আগামী দিনের সুন্দর একটি স্বপ্নকে, যদিও তিনি জানেন এই অভিযাত্রা অত্যন্ত কঠিন। প্রবল চড়াই-উতরাইয়ের কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁর পথচলা। সত্যদ্রষ্টা মানবের এই যাত্রা ছিল না তেমন কুসুমাসত্মীর্ণ। বড় কঠিন এই যাত্রাপথ, আরো সুকঠিন, সঠিক আদর্শের আলোকে নিজেকে আলোকিত করা। কেননা, তিনি একদা সময়কে জয় করার তৃষ্ণায় নিজেকে বারংবার দাঁড় করিয়েছেন অসভ্য অসময়ের সম্মুখে (‘বিবর্তন পর্ব-২’) ওই একই কবিতার অন্য অংশে তাঁর আর্তি এভাবে ব্যক্ত হয় – ‘হে দেবতা দেখা দাও, অভিসম্পাত দাও পোড়াও, নিঃশেষিত করো এই অসহ্য দাবানল।’ তাই তো তাঁর নিজের ধস্ত দেশের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ায় তিনি কষ্ট পান, তাঁর ক্ষুব্ধ হৃদয় কলম ও কালির অক্ষরে ব্যক্ত করেন। তাঁকে চিনে নিতে কষ্ট হয় না তাঁর এই কবিতা থেকে কবিতার অভ্যন্তরের যাত্রাপথে। হঠাৎ হঠাৎ চোখ আটকে যায় তাঁর স্বতোৎসারিত অনুভবের ছত্রে। কবিতার কাছে সমর্পিত তাঁর কলম তখন কথা বলে। তাঁর ব্যথাদীর্ণ ক্ষুব্ধ হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় অনুভবের পঙ্ক্তিমালা, অনায়াসে তাই তিনি লিখে ফেলেন,
আজকাল তুমি চর্যাপদ
নোনাজলে ভেসে থাকা জলের কলস,
মুখে ছিপি আঁটা;
মৌনতার নৌকো ভাসিয়ে চলো
বেদনার গহীন গাঙ্গে,
ঝড় তোলো নীল তিমি;
আজকাল এভাবেই আসো
না থাকার বারতা নিয়ে।
(‘আজকাল তুমি শূন্যতা’)
ফাহিম ফয়সালের চিমত্মাচেতনার মধ্যে কল্পনার মায়াবী আলো যেমন আছে, তেমনি আছে বাস্তবের এক কঠিন বোধ। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে তাই কঠোর এক বাস্তবের ছায়া মাঝে মাঝেই উঁকি মারে। কখনো কখনো তা কিঞ্চিৎ নেতিবাচক মনে হলেও বোঝা যায় কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে তিনি বেশিদূর এগোতে চান না, কেননা মাঝে মাঝেই তাঁর পথরোধ করে দাঁড়ায় কঠিন বাস্তবের কিছু উপলব্ধি, তাঁকে মনে করিয়ে দেয় তাঁরই ভূয়োদর্শন ও অভিজ্ঞতাজাত কিছু বোধ। তাই তো তিনি অনায়াসে লিখে ফেলেন ‘প্রতিশ্রম্নতি’র কবিতা’র মতো কিছু আত্মোপলব্ধির বয়ান,
প্রতিশ্রম্নতির বন্ধনে কাউকে বাঁধতে নেই
সব কথা রাখবার নয়
সব সন্ধ্যার কাছে নির্জনতা নেই
থাকে না কখনো।
অসংলগ্ন প্রলাপের মতো
প্রতিশ্রম্নতি এক মায়াবী ব্যাধি,
এই অনুভব একজন রঙিন স্বপ্নে বিভোর কল্পনাবিলাসীর নয়, এই বোধ এক কঠিন বাস্তববোধসম্পন্ন কবির, যা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত মনে হলেও এই ভাবনার মধ্যে আছে বহু অভিজ্ঞতায় জারিত একজন দায়িত্বশীল সুস্থ নাগরিকের ভাবনাচিমত্মা, যা শেষ পর্যন্ত এক অমোঘ সত্যের সমীপে নিজেকে সমর্পণ করে। এই সত্য তাঁকে নিয়ে যায় বৃহৎ এক ভাবনার উপকূলে, যেখানে তিনি পান স্বস্তি ও সুন্দরের এক পরম আশ্রয়।
শৃঙ্খলিত আবেগেরা চাপে
শব্দ-ডিঙ্গায়,
নোঙর পায় না খুঁজে তল,
ঝড় ওঠে, বজ্রপাতে যায় পুড়ে যায়
মন-বাড়ি, সাধের বকুল
গাঙ্গের গতরে ঢেউ উথাল-পাথাল,
তবু চলে সপ্তডিঙ্গা
তুমুল লড়াই জলে বৈঠায়!
ব­-র্ব-এর ছোট্ট পরিসরে এ-কটি ছত্রের কবিতাভাষ্য এই কবিকে চিনিয়ে দেয় এক লহমায়। আত্মপ্রকাশের এই সন্ধিক্ষণে তাঁকে স্বাগত জানাতে জানাতে প্রবেশ করি তাঁর কবিতা থেকে কবিতার অভিযাত্রায়। সেই যাত্রা অবাক বিস্ময়ের, অযাচিত প্রাপ্তির।
জল বৈঠার কাব্য প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলেও ফাহিম ফয়সাল কবিতার সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছেন অনেকদিন। পঠন-পাঠনের সূত্রে নামি-অনামি বহু কবির কবিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বাচিক শিল্পের নানা নকশায় একদা তাঁকে তিনি চিত্রিত করেছেন স্বকণ্ঠে। অনুভবের রঙের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর শিল্পিত ভাবনার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি। এই দুর্গম পদযাত্রায় তাঁর ভাবনাচিমত্মার এক সুন্দর প্রতিফলন তিনি ঘটিয়েছেন কালি ও কলমের এক চমৎকার মেলবন্ধনে। জীবনের খেয়া বাইতে বাইতে তিনি নিজেও কখন হয়ে উঠেছেন একজন মাল্লা। জলের সঙ্গে বৈঠার সংগত করতে করতে এগিয়ে গেছেন জীবন-নদীর তরঙ্গভঙ্গে। ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে রাত্রির গভীর বৃন্ত ছিঁড়ে নিতে এসেছেন এক রৌদ্র-ঝলমল সকাল। সেই সকালের গান গাইতে গাইতে তিনি রচনা করেছেন এমন একটি কাব্যগ্রন্থ। কবিতার জগতে তাঁর এই আবির্ভাব বহু কবির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার নয়, বরং এক সুন্দর অনুভূতিমালা তিনি এমনভাবে আমাদের উপহার দিয়েছেন যে, তা মনের মধ্যে স্থায়ী এক অনুরণন তুলতে থাকে।
তাঁর এই কবিতাগুলি তাই আমার বিশ্বাস, সহজে হারিয়ে যাবে না। সহৃদয় পাঠকের হৃদয়ে এর জায়গা হবে চিরস্থায়ী। সুন্দর মুদ্রণ আর চমৎকার কাগজ এই গ্রন্থকে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করেছে। এর অসাধারণ প্রচ্ছদ আর ব্যতিক্রমী পুস্তানি এক বাড়তি প্রাপ্তি বইকি!