নাডিন গর্ডিমারের মহাপ্রয়াণ

আলী আহমদAli-ahmed

গত শতকের ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রকট বর্ণবৈষম্যবাদ সম্পর্কে আমরা প্রথম তীব্রভাবে সচেতন হয়ে উঠি, এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ সে-বিষয় নিয়ে পত্র-পত্রিকায় দু-একটি প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখতে শুরু করে। তখন চলমান ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতি প্রায় সার্বিক মনোযোগ, ও ১৯৬৭-এর সংক্ষিপ্ত আরব-ইসরায়েলিযুদ্ধের ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও, দক্ষিণ আফ্রিকা আমাদের মন থেকে আর সরে যায় না। ওই দশকের শেষার্ধে আমাদের দেশে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার, তার ফলে সৃষ্ট অভূতপূর্ব গণজাগরণ ও পরিশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন গোটা বাঙালি জাতিকে একেবারেই নিজস্ব এক অন্য জগতে টেনে নিয়েছিল। ওই সময়টিতে, বলতে গেলে, জাতি হিসেবে আমরা অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়ার সময় পাইনি। তবে ওই মেয়াদে, এবং তারও পরে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদ এবং তার অমানবিক বহিঃপ্রকাশ পৃথিবীর গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেতে থাকে। আমরাও সে-সম্পর্কে অবহিত থাকি। দেশটি একেবারে আগাগোড়াই আফ্রিকার কালো মানুষদের; আঠারো শতকে প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং তারই হাত ধরে পশ্চিম ও মধ্য ইয়োরোপের অন্যান্য দেশে শিল্প-বিপ্লবের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে, এবং উপনিবেশবাদ নামে নতুন একটি ধারণার জন্ম হয় ও তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ইয়োরোপীয়দের দ্বারা। বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অন্যতম প্রথম শিকার। পর্তুগিজ ও স্পেনীয়রা আমেরিকা মহাদেশের সঙ্গে প্রথম সংযোগ স্থাপনের ফলে ষোড়শ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই সেখানে উপনিবেশ গেড়ে বসেছিল। উনিশ শতকে ইয়োরোপীয় মহাদেশের সাম্রাজ্যসমূহ ভেঙে গিয়ে সেখানে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হওয়ায় তাদের মধ্য অ-ইয়োরোপীয় অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতা তীব্ররূপ ধারণ করে। প্রথমে জার্মানি ও পরে তাদের কাছ থেকে যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিশাল ভূখন্ড দখল করে তার মালিক হয়ে বসে।   

তবে আমাদের এই উপমহাদেশ কিংবা এশিয়ার অন্যান্য যেসব দেশে ইয়োরোপীয়রা উপনিবেশ স্থাপন করে, আমেরিকা ও আফ্রিকায় স্থাপিত তাদের উপনিবেশগুলো তার থেকে একটি মৌলিক বিষয়ে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঔপনিবেশিক লুট, শাসন, শোষণ ও সেখান থেকে নিজ দেশে সম্পদ পাচারের ব্যাপারে সবগুলো ঔপনিবেশিক শক্তিই তাদের নিজ নিজ উপনিবেশে মোটামুটি একই নীতি ও পথ অবিলম্বন করলেও, আমেরিকা মহাদেশে পাইকারি গণহত্যা ও আফ্রিকার মানুষদের ধরে নিয়ে আমেরিকার নতুন উপনিবেশে ইয়োরোপীয় উপনিবেশীদের কাছে তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করা চিরকাল মানবজাতির ইতিহাসে অত্যন্ত ঘৃণিত ও লজ্জাজনক একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণ উভয় মহাদেশেই আফ্রিকার তুলনায় জনবসতি হালকা থাকায় ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে সেখানের মূল অধিবাসীদের নগণ্যসংখ্যক অবশিষ্ট অংশকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে পুরো মহাদেশেরই অবিসংবাদিত মালিক হয়ে বসে উপনিবেশীরা। আফ্রিকায় আমেরিকার মূল অধিবাসীদের তুলনায় জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে বেশি হওয়ায় উপনিবেশীরা অবিসংবাদিত মালিক হয়ে বসতে পারেনি। সেখানে তাই অবলম্বন করেছিল আরেক রকমের কৌশল, এবং নানান রকমের সম্পদে ঋদ্ধ সুবিশাল দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটেছিল তার সবচেয়ে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজি, জার্মান ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষার সংমিশ্রণে Afrikaner নামে একধরনের যে-সংকর ভাষা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচলিত আছে তার একটি শব্দ Apartheid। এই অ্যাপার্টহাইটের অর্থ পৃথক বা আলাদা। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ইয়োরোপীয়দের থেকে অ-ইয়োরোপীয়দের সবকিছু আলাদা করে রাখাই এর মূল কথা। আফ্রিকার মূল অধিবাসী ও অন্য অ-ইয়োরোপীয়দের তুলনায় ইয়োরোপীয় বংশোদ্ভূতরা সেদেশে সংখ্যায় অনেক কম। কিন্তু সেদেশের জমি, খনিজ ও বনজ সম্পদসহ সব রকমের সম্পদের মালিকানা ছিল ইয়োরোপীয়দের হাতে। সব শহরের বিশেষ বিশেষ সুনির্দিষ্ট এলাকায় কালো মানুষদের বাস করতে বাধ্য করা হতো। তারা খনি ও মাঠে শ্রমের জোগান দিত ঠিকই, কিন্তু নির্ধারিত এলাকার বাইরে যাওয়ার কোনো অধিকার তাদের ছিল না। ইয়োরোপীয় যে-কোনো দেশের শাদাবর্ণের মানুষেরা অভিবাসী হয়ে ওই দেশে এলেও ওই একই রকম সুবিধা পেতো।

দেশের এরকম আর্থ-সামাজিক একটি পটভূমিকায় ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখিকা নাডিন গর্ডিমার ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন রাজধানী জোহানেসবার্গের কাছে স্প্রিংস নামক সোনার খনিসমৃদ্ধ ছোট্ট একটি শহরে। কিন্তু তাঁর বাবা-মা দুজনই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। তাঁর ঘড়ি-নির্মাতা ইহুদি বাবা ইসিদোর গর্ডিমার রাশিয়ার জারের শাসনাধীন বর্তমানকালের লিথুয়ানিয়া থেকে চলে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকায়; ইহুদি-খ্রিষ্টীয় মিশ্র পরিবারের সন্তান তাঁর মা, হ্যানা ‘ন্যান’ (মায়ার্স) গর্ডিমার আসেন লন্ডন থেকে। কিন্তু নাডিন ‘সেক্যুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ পারিবারিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেন। পরবর্তী-জীবনে নিজেকে তিনি অবশ্য ‘কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নন’ বলে পরিচয় দিতেন। প্রচলিত বাংলায় একে নাস্তিক বলা হয়, আমরা জানি। তবে লেখালেখি জীবনের বাইরে বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত কর্মব্যস্ত জীবন কাটালেও, নাস্তিকদের কোনো সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত থাকেননি।

অত্যন্ত অল্পবয়সে স্কুলে যাওয়ার সময়ই তিনি শাদা আর কালো মানুষদের পৃথক জীবনধারা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। সহলেখক জাস্টিন কার্টরাইটকে দেওয়া ২০১২ সালে লন্ডনের দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টি তিনি সংক্ষেপে কিন্তু অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলেন। সোনার খনির পাশ দিয়েই তাঁদের স্কুলবাস যেতো; তিনি দেখতেন অল্পবয়স্ক থেকে পূর্ণবয়স্ক নানান রকমের কালো মানুষদের, বাসের মধ্যে বসে বসে। ওই লোকগুলোকে থাকতে হতো শহর থেকে দূরে সুনির্দিষ্ট একটি এলাকার মধ্যে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেও তাদের যাতে শহরের মধ্যে না-যেতে হয় – প্রকৃতপক্ষে, তারা যাতে না-যেতে পারে – সেজন্য খনির সঙ্গেই ওসব প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান সারি দিয়ে বসানো থাকতো। দোকানের সামনের দিকটা লোহার শক্ত জালি দিয়ে ঘেরা থাকতো। প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা জালির ফাঁক দিয়ে বলে, তার দাম জেনে, সেই মূল্য ভিতরে ঠেলে দিয়ে তারা অপেক্ষা করতো পণ্যটির জন্য; এমনি করে হাতে না-আসার আগে যা সে কিনতে চাইতো তা দেখার কোনো উপায় ছিল না। ওইসব শ্রমিকের বসবাসের সুনির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে তারা যেতে পারত না, শহরের মধ্যে ঘোরাফেরা করার তো প্রশ্নই আসে না। নাডিনদের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার শাদা ছেলেমেয়েদের স্কুলে শুধু কালোই নয়, অ-ইয়োরোপীয় কোনো ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করার সুযোগ পেত না। সুতরাং কাছাকাছি থেকে অ-ইয়োরোপীয় কাউকে দেখা কিংবা সামাজিকভাবে তাদের কারো সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে নাডিনের হয়ে ওঠেনি। বিটবাটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Witwatersrand) ভর্তি হয়ে বছরখানেক মাত্র পড়াশোনা করে, স্পষ্টতই স্নাতক ডিগ্রি না-নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে, ১৯৪৮ সালে তিনি জোহানেসবার্গে চলে যান। কারণ হিসেবে তাঁর মা তখন নাডিনের নাজুক হৃৎপিন্ডের কথা বলেছিলেন। এই নাডিন গর্ডিমার অবশ্য নববই বছর বয়সে ঘুমের মধ্যে গত ১৩ জুলাই, ২০১৪, মারা যান, আমরা জানি।

নাডিন গর্ডিমারের লেখালেখির শুরু অবিশ্বাস্য রকমের অল্প বয়সে, তাঁর নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, মাত্র ছ-বছর বয়সে। তবে তাঁর প্রথম গল্পের বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র পনেরো; গল্পসংগ্রহটির নাম Come again tomorrow। আর পূর্ণবয়স্ক পাঠকদের জন্য তাঁর প্রথম বই – একটি গল্পের বই – প্রকাশিত হয় যখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো। তিনি নিজে তাঁর মা-বাবাকে racist বা নিজ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী বলে জানিয়েছেন। তাঁর বাবা নিজ অভিবাসনের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের ব্যাপারে কিছু মনে করেছেন – এমন কোনো প্রমাণ কারো কাছে আছে বলে জানা নেই; কিন্তু তাঁর মা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবেই জড়িত ছিলেন, এ-কথা আমরা জানি। তবে তা হয়তো বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে না-ও হতে পারে। কিন্তু তিনি সরকার তথা পুলিশের যে খুব প্রিয়পাত্রী  ছিলেন না, তা একটি ঘটনা থেকেই অাঁচ করা যায়। নাডিনের কৈশোর না-পেরোতেই তাঁদের বাড়িতে একবার পুলিশি অভিযান চলেছিল, এবং সেবার পুলিশ তাঁর মায়ের বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে গিয়েছিল।

১৯৫১ সাল তাঁর লেখক-জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিখ্যাত ম্যাগাজিন দি নিউ ইয়র্কার ওই বছর তাঁর গল্প A Watcher of the Dead ছেপে তাঁকে প্রথম আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উপস্থাপন করে। এরপর সুদীর্ঘকাল ধরে ওই কাগজে তাঁর গল্প প্রকাশিত হতে থাকে, এবং ইংরেজিভাষী অঞ্চলে লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। তিনি অনেক ছোটগল্প লিখেছেন, এবং একসময় এ-ও বলেছিলেন যে, আধুনিক সময়ে ছোটগল্পই হচ্ছে সাহিত্যের মূলধারা। তিনি অবশ্য উপন্যাস লিখেছেন বেশকটি, এবং তাঁর সাহিত্যকীর্তি ও খ্যাতি ছোটগল্পের চেয়ে উপন্যাসেই বরঞ্চ বেশি অর্জিত হয়েছে বলে মনে হয়। ইতোমধ্যে, ১৯৪৯ সালে, তাঁর আরেকটি ছোটগল্প সংগ্রহ ফেইস টু ফেইস প্রকাশিত হলেও, তাঁর প্রথম উপন্যাস The Lying Days প্রকাশিত হলে লেখক হিসেবে তিনি বলতে গেলে একরকমের প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। নিজের প্রথম উপন্যাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বেশ মজাদার একটি মন্তব্য করেন। সে-বিষয়ে একটু পরেই আসছি।

এর মধ্যে, ব্যক্তিগত জীবনে, ১৯৪৯ সালে, জেরাল্ড গ্যাভ্রন নামের একজন দাঁতের ডাক্তারকে বিয়ে করেন নাডিন, এবং প্রায় বছর তিনেকের মাথায় এই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার আগে তাঁর একটি মেয়ে জন্মায়, নাম ওরিয়ান। ১৯৫৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রাইনহোল্ড কাসিরের নামীয় এক সম্মানীয় শিল্পকলা ব্যবসায়ীকে। ২০০১ সালে কাসিরেরের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের বিবাহিত জীবন অটুট ছিল। ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া ছেলে উগো (Hugo) হলিউডের একজন চিত্রনির্মাতা, এবং নাডিনের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর অন্তত দুটো গল্প নিয়ে উগো দুটো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

নাডিন গর্ডিমার নৈতিক ও বর্ণবৈষম্যমূলক বিষয়কেই তাঁর লেখালেখি ও কর্মজীবনের মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস দি লাইং ডেজের কথা আগেই বলেছি। এই উপন্যাসের কথা বলতে গিয়ে নাডিন খুব চমৎকার একটি কথা বলেছেন : তিনি জানাচ্ছেন যে প্রত্যেক ঔপন্যাসিকই তাঁর প্রথম উপন্যাস কমবেশি আত্মজৈবনিক করে তোলেন, এর মাধ্যমে নিজের ওপর তিনি প্রতিশোধ নেন। সেই ‘প্রতিশোধ’ নাডিনও নিয়েছেন তাঁর এই প্রথম উপন্যাসে। চরম বর্ণবৈষম্যবাদের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে ওঠেন তার ছায়া উপন্যাসখানির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস বার্গার্স ডটার ও জুলাই’স পিপল বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহ। শাদা ও কালো মানুষেরা একত্র হয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, জাতিভেদের বেড়া ডিঙিয়ে শাদাকালোর বিয়ে হয় – এসব তিনি তাঁর এই উপন্যাস দুখানির উপজীব্য করেন। এই উপন্যাসগুলো নিষিদ্ধ করে তার সকল কপি বাজেয়াপ্ত করে বর্ণবাদী সরকার। ১৯৯০ সালে বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় শাদাকালোর সমন্বয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই লিখেছেন তিনি, নানা আঙ্গিকে, নানা পটভূমিকায়, এবং নানা জবানিতে তাঁর উপন্যাসগুলো। সেইজন্য কোনো কোনো সমালোচক তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলোকে পুনরাবৃত্তিমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমার নিজের মত সেদিকেই বেশি ঝোঁকা।

সামাজিক-রাজনৈতিক একজন কর্মী হিসেবেও দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন নাডিন গর্ডিমার। সেদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও শাদাকালোর বিভেদ ঘুচিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের সংগ্রামের পুরোভাগে সর্বদা অবস্থানকারী নেলসন ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস যখন নিষিদ্ধ, এবং ম্যান্ডেলা নিজে আপাত-অন্তহীন কারাবাসে, তখন সেই দলে যোগ দেন নাডিন। তিনি বর্ণবাদবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছেন অনেকবার, আন্দোলনকারী কালো মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন নিজের ঘরে, এবং অনুসন্ধানী পুলিশের জবাবে মিথ্যে বলে তাঁদেরকে লুকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯৬২ সালে, নেলসন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী সরকারের দায়ের করা মামলায় ম্যান্ডেলার আইনজীবীদের সঙ্গে নাডিন বেশ ঘনিষ্ঠ হন। ‘আমি মরার জন্য প্রস্ত্তত’ শীর্ষক নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত বক্তৃতাটি সম্পাদনায় তিনি সহায়তা করেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও তাঁর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কারাবাস থেকে মুক্তির পর ম্যান্ডেলা প্রথম যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি হলেন নাডিন গর্ডিমার। এবং দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা অর্জনের পর, রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনশেষে ম্যান্ডেলার অবসরগ্রহণেরও পর, জোহানেসবার্গের বেশ বড়সড় ধরনের নিজ বাড়িতে যখন তিনি একা থাকতেন তখন  মাঝে-মধ্যেই টেলিফোনে নাডিনের সঙ্গে সময় ঠিক করে নিয়ে নাডিনের বাড়িতে আড্ডা মারতে মারতে রাতের খাবার খেতে আসতেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁদের দুজনের বাড়ি প্রায় হাঁটা-পথের দূরত্বে অবস্থিত। দুজনেই তখন বয়স্ক, নিঃসঙ্গ মানুষ; দুজনেরই পেছনে বিশ্বব্যাপী খ্যাতিময় সফল জীবন; আর দুজনের অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক চেতনা বর্ণবাদমুক্ত, স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘনায়মান নৈরাজ্য, হানাহানি এবং ম্যান্ডেলা-উত্তর শাসকদের ক্রম-অনুদার শাসনব্যবস্থায় হয়তো ক্রমাগত আহত হচ্ছিল। আমার জানা নেই, হয়তো কারোই জানা নেই, কীসব আলাপ তাঁরা করতেন ওইসব সন্ধ্যায়। তাঁরা কি ওইসব বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন?

রাহাজানি, সশস্ত্র ডাকাতি আর হত্যাকান্ড বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। অন্যদের কথা বাদ, বিদেশি কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বাড়িঘরও এসব কার্যকলাপের নিয়মিত শিকার। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের অবস্থাও তেমন কিছু আলাদা নয়। নাডিন গর্ডিমারের নিজের বাড়িতেও সশস্ত্র ডাকাতি হয়েছে একবার। বেশ বড়সড় বাড়িটিতে তিনি এবং তাঁরই মতো বয়স্কা একজন সহায়তাকারিণী নিয়ে তিনি ওই বাড়িতে থাকতেন; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই থেকেছেন। যা হোক, ডাকাত পড়লে সহায়তাকারিণী মহিলাটি ভয়ে চিৎকার শুরু করলে ডাকাতরা ওকে মার দিতে শুরু করে। বাঁধা-অবস্থায় নাডিন যখন বলেন যে, ও তো তোমাদের নানি-দাদির বয়সী, ওকে ছেড়ে দাও। তখন ওরা তাঁর কথা শুনলো। কিন্তু বাড়ির জিনিসপত্র নিতে কোনো কার্পণ্য করল না। এরূপ অসংখ্য ডাকাতের দল নোবেল পুরস্কার কী জানে না; তাদের জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম-করা নাডিন গর্ডিমার কে  তা-ও জানে না; তারা জানে দেশ এখন কালো মানুষদের; তাই তারা যা ইচ্ছে করতে পারে। সে দেশের সরকার নিশ্চয়ই এমন অবস্থা চায় না, কিন্তু তা নিরসনে না-হোক, নিয়ন্ত্রণেও খুব একটা কিছু করছে – এমন মনে হয় না। যাহোক, বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে তিনি বাড়ি না-পালটালেও শেষ পর্যন্ত বাড়ির চারদিকে বৈদ্যুতিক বেড়া বসিয়েছিলেন।

২০০৬ সালে নাডিন গর্ডিমারের একখানি জীবনীগ্রন্থ বেরিয়েছে। বইখানির লেখক হচ্ছেন রোনাল্ড সুরেশ রবার্টস, আর বইয়ের নাম No Cold Chicken। এটি একখানি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ হওয়ার কথা ছিল। সে-কারণে লেখককে তাঁর ব্যক্তিগত, এবং কতিপয় ক্ষেত্রে গোপনীয়, কিছু কাগজপত্রও দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও চলেছিল, এবং তা এগিয়েছিল অনেকদূর পর্যন্ত। কিন্তু জীবনীকার ও গর্ডিমারের মধ্যে দু-একটি বিষয় নিয়ে মতের অমিল দেখা দিলো। গর্ডিমারের দ্বিতীয় স্বামী রাইনহোল্ড কাসিরের মৃত্যুর আসল কারণ ও দুই স্বামী ছাড়া নাডিন গর্ডিমারের আরেকটি প্রেমের কাহিনি জীবনীকার বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে তিনি তাতে রাজি হননি। কিন্তু জীবনীকার এ-ব্যাপারে অনড় থাকলে তাঁর মতো করেই শেষ পর্যন্ত বইখানি লিখে প্রকাশ করলেন, আর নাডিন ওখানিকে আর প্রামাণ্য জীবনী বলতে রাজি হলেন না। গর্ডিমার একে বিশ্বাসভঙ্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, নাডিন গর্ডিমারের কর্মজীবন ও লেখকজীবন দুটোই উৎসর্গ করেছিলেন ঘৃণ্য বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে। সাহিত্যে বুকার পুরস্কার ও নোবেল পুরস্কারসহ পৃথিবীর  বড় বড় প্রায় সব পুরস্কারই তিনি পেয়েছেন। আর নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এবং তাঁরই একজন সহযোদ্ধা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যবাদের অবসান ঘটিয়ে শাদাকালো সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনেও তাঁর ছিল অসামান্য অবদান। কিন্তু এ-কথা স্বীকার করতে দ্বিধা হওয়া উচিত নয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম কেমন যেন ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ ধরনের মনে হতে পারে। মানব-ইতিহাসের অগ্রগতির পথে ঘৃণ্য একটি অধ্যায়ের অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলোর অনেকগুলোই বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু যে-কালোত্তীর্ণতা মহৎ সাহিত্যকর্মের একটি লক্ষ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে অনেক সময়ই বিবেচিত হয়ে থাকে, নাডিন গর্ডিমারের অনেক লেখায়ই তা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সাহিত্য না-হোক দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা দেখে তিনিও যে হতাশ হয়েছিলেন তা মনে করা ভুল হবে না। পূর্বে উল্লিখিত ২০১২ সালে জাস্টিন কার্টরাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘We were naive, because we focused on removing the apartheid government and never thought deeply enough about what would follow…।’ এর সহজ বাংলা অর্থ দাঁড়ায় – অনেক বেশি সরল ছিলাম আমরা, কারণ আমাদের সমস্ত মনোযোগ ছিল তখন বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারকে অপসারণ করার ওপর, এবং যথেষ্ট গভীরভাবে তখন ভেবে দেখিনি যে তার পরে কী ঘটবে। – বাস্তবিকপক্ষে,  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হচ্ছে সার্বিকভাবে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ; তা-না হলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শাসনতন্ত্রও আজ হোক কাল হোক কুচক্রী শাসকগোষ্ঠীর হাতে পড়বেই, এবং অল্পদিনের মধ্যেই গণতন্ত্র ধূলিসাৎ হয়ে সমাজের স্বার্থান্বেষী চক্রের হাতে পড়ে এক ধরনের মাৎস্যন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং সে-অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে ‘রক্ষা’ করার জন্য আরো নিকৃষ্টতর ‘উর্দি’ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। শেষোক্ত অবস্থা একেবারে অবশ্যম্ভাবী নয়। কারণ সরাসরি শাসনক্ষমতা গ্রহণের দুর্নাম কাঁধে না-নিয়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা যদি কড়ায়-গন্ডায় আদায় করে নেওয়া যায়, তাহলে দুর্নামের বোঝা বহন করতে চাইবে এমন বোকার সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে-আসা রাষ্ট্রগুলোর দিকে যদি নজর দিই, তাহলে উপরি-বর্ণিত দুঃশাসনের নজির পাওয়ার জন্য অণুবীক্ষণ কিংবা দুরবিন যন্ত্রের প্রয়োজন হবে না; চোখ খুললেই অমন অসংখ্য নজির দুচোখের মধ্যে হামলে পড়ে অনুসন্ধানকারীকে প্রায় অন্ধ করে ফেলবে।

নেলসন ম্যান্ডেলা, নাডিন গর্ডিমার এবং তাঁদের মতো আরো অনেকের স্বপ্নের বর্ণবৈষম্যহীন, সকলকে নিয়ে-গড়া গণতান্ত্রিক ও শান্তিময় সমাজ দক্ষিণ আফ্রিকায় আজ নেই। তাঁদের সৌভাগ্যক্রমে ওই দুজনের কেউই আজ আর বেঁচে নেই; নাহলে ২০০৩ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার আরেক লেখক জেএম কুটসির (John Maxwell Coetzee or, J. M. Coetzee) [তাঁর নামের শেষাংশটির উচ্চারণ কুটসি কিংবা কূটসী – ‘কোয়েটযি’ নয়] ন্যায় Disgrace-এর মতো আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস লিখে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান সময়ের এক পক্ষপাতহীন চিত্র এঁকে, দ্বিতীয় বুকার পুরস্কার জিতে, তাঁর নিজের প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে তাঁরাও হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় কিংবা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতেন, অথবা তীব্র হতাশায় জীবন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন।

আমরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কামনা করবো এতো শোষণ, এতো নির্যাতন, আর এতো ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতা দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জন্য অর্থবহ হয়ে উঠুক। পৃথিবীর অন্যসব দেশেও তাই হোক।