নিজের কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছি : আবুল হোসেন

আবুল হোসেন চল্লিশের দশকের অন্যতম কবি ও লেখক। জন্ম ১৫ই আগস্ট ১৯২২ সালে খুলনা জেলায়। ২০১৪ সালের ২৯শে জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০২২ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁর শততম জন্মবর্ষ। ১৯৪০ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই নববসন্ত বের হয়। প্রথম জীবনে রচিত ‘ঘোড়সওয়ার’, ‘ডি এইচ রেলওয়ে’, ‘বাংলার মেয়ে’ প্রভৃতি কবিতা তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। যাঁকে বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার পথিকৃৎ হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন। এই ভূখণ্ডের মানুষকে সমকালীন কবিতার সঙ্গে যুক্ত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে তিনি এক কবি-পথিকৃৎ। তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২৬শে আগস্ট ২০১২ সালে, কবির ধানমণ্ডির নিজ বাড়ি ‘সাহানা’তে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও নির্মাতা শ্যামল নাথ।

শ্যামল : আপনার প্রথম লেখা তো কৃষ্ণনগরে পড়া অবস্থায় প্রকাশিত হয়।

আবুল হোসেন : প্রথম লেখা কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়া অবস্থায়। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে। এরপর শেষ লেখা সমকালে, ২০০৮ সালে। আমার লেখা স্মৃতিকথা অপরাহ্ণের স্মৃতি। এবার বের হবে বইমেলায় সূচীপত্র থেকে।

শ্যামল : এরপর আপনি তো কলকাতায় চলে এলেন। কলকাতা জীবন নিয়ে যদি বিস্তারিত কিছু বলেন।

আবুল হোসেন : আমার সৌভাগ্য আমি কলকাতাকে আমার প্রথম জীবনেই পেয়ে যাই। আমাদের সময় কলকাতাই ছিল বাংলা সাহিত্যের তীর্থভূমি। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়তে গেলাম, এরপর হয়ে গেলাম ওই কলেজের রবীন্দ্র সম্পাদক। ওখানে যাওয়ার পর প্রেমে পড়া, রবীন্দ্রনাথকে স্বয়ং চোখে দেখা কিংবা কবিতায় রুচিবোধ, সব বদলে যাওয়া। এসব কি আর কলকাতাকে না পেলে হতো! আর আমি আজীবন শহরে মানুষ। ছোট হোক বড় হোক সব শহরের চেহারা, মেজাজ – গ্রাম থেকে ভিন্ন। গ্রামে প্রায় কখনো থাকিনি। গ্রামের জীবনও তেমনভাবে ভেতর থেকে দেখার কখনো সুযোগ হয়নি। গ্রাম আমাকে তেমন আকর্ষণও করেনি। দুটো কি তিনটের বেশি কবিতা হবে না আমার যার পটভূমি গ্রাম। মনের সংবেদনশীলতাটা যখন সবচেয়ে বেশি, আমার সেই সময়টা কেটেছে কলকাতায়। কলকাতাই ছিল তখন এ-উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শহর, নগর। এর মন ও মানসিকতায় ডুবেছিলাম আমি। আমি নগরে থাকলেও নাগরিকতা বলতে তো শুধু ইট, কাঠ, পাথর, কংক্রিটের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, হোটেল, ট্রাক, বাস, মোটরগাড়ি, ট্রেন, ইলেকট্রিসিটি বোঝায় না। আসলে নাগরিকতাটা মনের, গ্রামের মন থেকে যা ভিন্ন, সেটা ধরা পড়ে বক্তব্যে – এর বিষয় ও ভঙ্গিতে, কথা বলার ধরনে। উপমা, চিত্রকলা আসে নগরের শিল্প-বৈজ্ঞানিক প্রকৌশল যুগের অনুষঙ্গ থেকে।

শ্যামল : আপনার প্রথমদিককার কবিতায় তো সেই ছাপটা দেখতে পাই।

আবুল হোসেন : শ্যামল, তুমি ঠিক ধরেছো। আমার প্রথমদিকের যে কবিতাগুলি লোকের চোখে পড়েছিল যেমন – ‘ডাইনামো’, ‘ট্রেন’, ‘ডি এইচ রেলওয়ে’, ‘ঘোড়সওয়ার’, ‘বাংলার মেয়ে’ – এগুলি কি কলকাতায় কিংবা শহরে না থেকে লেখা যেত? অনেকদিন আগে একটা কবিতায় বলেছিলাম, ‘প্রচুর পয়সা কখনো চাইনি, বিত্তের পিছে ছুটতে যাইনি।’ মানবিকতাবোধকেই জীবনের সারবস্তু বলে গ্রহণ করেছি। শহরের বৈচিত্র্য-বৈষম্য-ঐক্য-অনৈক্য, সঙ্গতি-শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে না উঠলে কি এ বোধে পৌঁছুতে পারতাম? আর আমি সেই ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ সাল থেকেই আধুনিক কবিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাই। কলকাতায় ছিলাম তখন আমি। আমি যদিও সুরেলা কবিতা লিখি না, কবিতা সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা দানা বেঁধে ওঠার পর থেকে অন্তত সেরকম আর লিখিনি, তবু আমি ভুলিনি যে, সব ভালো কবিতায় ছন্দ, ধ্বনি, অনুপ্রাস অপরিহার্য; কিন্তু বেশি মিষ্টি কবিতা ভাবালুতায় ভরে থাকে। আমরা যখন লিখতে শুরু করি, তখনকার কবিরা তা ভুলে বসেছিলেন। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে।

শ্যামল : রবীন্দ্রনাথের বৃত্ত থেকে তো আপনি বেরিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু কীভাবে বেরিয়ে এলেন?

আবুল হোসেন : সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে আমারও অনেকদিন লেগেছিল। তবু আমি খুব ছোটবেলা থেকেই লিখতে শুরু করেছিলাম বলে রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে যখন বেরিয়ে এলাম তখনো আমার বয়স খুব কম। সেই সাহস পেয়েছিলাম তিরিশের কবিদের কাছ থেকে; তাঁদের সান্নিধ্যে। এসব তো আমার কলকাতার স্মৃতি – ভুলি কেমনে। তাঁদের নতুন কবিতার অন্দোলন, আধুনিক বাংলা কবিতা, তখন সবে দানা বেঁধে উঠেছে। মফস্বল শহর থেকে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছি। সমর সেন সেই কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছেন কি বেরোননি। তাঁর লেখা নিয়ে খুব মাতামাতি হচ্ছে। অধ্যাপকরা পছন্দ করছেন না, সুবোধ সেনগুপ্ত, সোমনাথ মৈত্র, গৌরী ভট্টাচার্যরা রবীন্দ্রনাথেই ডুবে আছেন। ক্বচিৎ নজরুলের নাম করেন।

শ্যামল : রবীন্দ্রনাথকে আপনি প্রথম কবে দেখেন এবং প্রথম কথা হয় কীভাবে?

আবুল হোসেন : সেটা ১৯৩৮ সালের দিকে, শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে। তখন কথাবার্তা হয়নি। দূর থেকে দেখেছিলাম। এরপর ১৯৪০ সালে, তখন আমার সঙ্গে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র। আমি ওখানে সম্ভবত ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে বলি। আমার বক্তব্যটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। ওইদিনও কথা হয়নি। এর পরের দিন আবার গেলাম দেখা করতে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আপনারা অদ্দুর থেকে এসেছেন – দরজা ভেঙ্গে এলেন না কেন?’ রবীন্দ্রনাথ খুব নাটকীয় ছিলেন তাঁর কথাবার্তায়। আমি রবীন্দ্রনাথকে বললাম, সাধারণ শিক্ষার অভাবেই আমরা সাহিত্যে পিছিয়ে পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ তখন বললেন – ‘এই পথেই তোমাদের মুক্তি হবে।’

শ্যামল : আপনি তো একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেই লিখে বসলেন।

আবুল হোসেন : ঠিকই বলেছো। আমি কলেজের ম্যাগাজিনে গদ্যে কবিতাকে দুয়ো দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলাম। তারপর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই সরাসরি আক্রমণ। ‘রবীন্দ্রনাথ ও গদ্য কবিতা’ নাম দিয়ে মাসিক মোহাম্মদীতে দু-সংখ্যায় এক দীর্ঘ আলোচনা লিখি। সেই পাকামোর কথা ভাবলে আজ হাসি পায়। কিন্তু মোদ্দা কথাটা একেবারে ভুল ছিল না। লেখাটি রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েছিল। মোহাম্মদীর লেখকের উল্লেখ করে গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন প্রবাসীতে। গদ্য কবিতাকে গাল দিচ্ছি বটে। কিন্তু সমর সেন মনের ভেতর ঢুকে তাঁর কাজ করে গেছেন। গদ্য কবিতা তো রবীন্দ্রনাথ কত আগেই লিখেছেন। কিন্তু সমর সেন একেবারেই আনকোরা। তাঁর ভাষা, ছন্দ, বলার ভঙ্গি রবীন্দ্রনাথ থেকে যোজন যোজন দূরে। তাঁর কবিতায় কাব্য ছিল, কাব্যকল্পনা ছিল না, তাঁর গদ্য কবিতা যে কীভাবে সমগ্র বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সে স্বীকৃতি তাঁর জোটেনি। তবে আমি কারো মতো করে লিখিনি। বরং নিজের কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছি। তবে কলকাতার কথা বিশেষভাবেই আমার কাছে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে হয়। কারণ, দেশ ভাগ না হলে আমি হয়তো আরো ভালো লিখতে পারতাম – সেই আক্ষেপ কি মুছে ফেলা যায়?

শ্যামল : চল্লিশের দশকে আপনার সমকালীন কবিদের মধ্যে কে বা কারা আপনার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ?

আবুল হোসেন : সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় অবশ্যই। তাঁরা অনেক ভালো লিখেছেন। আমার মনে হয়, তাঁরাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

শ্যামল : জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে দেখা বা কথা বলার স্মৃতি কি এখনো আপনার মনে আছে?

আবুল হোসেন : সব মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে জীবনানন্দ একটু বিষণ্ন ছিলেন, কোনো চাঞ্চল্য আমি লক্ষ করিনি। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ নিয়ে আমি আলোচনাও করেছি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, দেখুন আপনার লেখা একেবারে ভিন্ন, অন্যদের চেয়ে আলাদা। আবার মাঝেমাঝে বুঝতে পারি না। জীবনানন্দ আমার কথা শুনে হাসলেন।

শ্যামল : আপনি দেশের বাইরে অনেকবার গিয়েছিলেন। বিদেশি কোন কবিকে আপনার ভালো লেগেছে?

আবুল হোসেন : মনে হয়, মার্কিন কবি থিওডর ওয়াইজের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। জার্মান কবি এসেনবার্গারের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। রুশ কবি ইয়েভতুশেংকোর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এছাড়া আরো অনেকের সঙ্গে সে-সময় দেখা হয়েছিল।

শ্যামল : আপনার লেখা কোন কবিতা আপনার খুব প্রিয়?

আবুল হোসেন : আমার নির্দিষ্ট করে প্রিয় কবিতা একটিও নেই। প্রিয় কবিতা আছে আমার অনেকগুলি। আমি তো কবিতা নিয়ে অবিরাম কাজ করি – লিখে যাওয়ার পরে কাজ করি, পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে কাজ করি এবং বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও কাজ করি। সেজন্যে আমার অনেক কবিতাকে আমি মনে করি এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, তার থেকে একটি শব্দও বদল করা যাবে না। আমার কবিতার মধ্যে সকলেরই প্রিয় ‘ডি এইচ রেলওয়ে’, যেটা আবদুল মান্নান সৈয়দ এই বঙ্গে প্রথম আলোচনা করেছেন এবং আমার সম্পর্কে ব্যাপক লিখেছেন।

শ্যামল : আপনি বলেছেন, আপনার প্রথম কাব্যগ্রস্থ নববসন্তে আপনার প্রথমদিকের লেখাগুলিতে রবীন্দ্রনাথের ধারার প্রভাব আছে এবং ওই প্রভাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টাও করেছেন, সেটা কীভাবে?

আবুল হোসেন : ১৯৩৯ সালের আগে যে-কবিতাগুলি লিখেছি সেগুলিতে রবীন্দ্রনাথের ধারা ছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সাল থেকে লেখায় রবীন্দ্রধারা ছিল না। কবিতা পত্রিকায় ‘নবযুগ’, ‘বাংলার মেয়ে, বাংলার ছেলে’, ‘ট্রেন’ – এসব কবিতা যখন বেরোলো তখনই আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। ১৯৩৯-কে আমি আমার যাত্রা শুরুর কাল মনে করি।

শ্যামল : কবিতা এতো কম লিখেছেন কেন?

আবুল হোসেন : আগে অনেক লিখতাম। কম লেখার পেছনে আবু সয়ীদ আইয়ুবের সতর্কতা কাজ করেছে। আইয়ুব বলতেন, এত লেখেন কেন? বেশি লিখলে কী লেখা ভালো হয়? আমাকে বললেন, কোনো লেখা কখনো পুনরায় বলবেন না। একবার যা লিখেছেন তা আর লিখবেন না। এই বলে জীবনানন্দ দাশের উদাহরণ দিলেন। এখন তো আর লিখতেও পারছি না। বলতেও কষ্ট হচ্ছে।

শ্যামল : কবি হিসেবে আপনি কাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন?

আবুল হোসেন : সমর সেনকে। আমি সম্ভবত কলেজে পড়ি, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা আমার। তাঁর চেষ্টা ছিল কবিতাকে কতটা নিরাভরণ করা যায়। আমি তাঁকে খুব উঁচুদরের কবি বলে মনে করি। সমর সেন যখনই বুঝতে পারলেন, তাঁর বলার কিছু নেই, তখনই কবিতা লেখা থামিয়ে দিলেন।

শ্যামল : আপনার প্রিয় কথাশিল্পী কারা?

আবুল হোসেন : দুজন প্রয়াত লেখকের নাম বলব। মাহবুব আলম ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। মাহবুব আলমকে আমি আমাদের প্রথম আধুনিক গল্পলেখক বলব। ওয়ালীউল্লাহ্ তো অসাধারণ। এরপর রশীদ করিম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হক।

শ্যামল : আপনার সাহিত্যিক ঋণ কাদের কাছে আছে বলে আপনি মনে করেন?

আবুল হোসেন : ঋণের কোনো শেষ নেই। বাংলা ও ইংরেজি কবিতার একটা বড় অংশের কাছে আমি ঋণী। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক প্রফুলচন্দ্র, ডক্টর সুবোধ সেনগুপ্ত, তারকানাথ সেন, ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাক – আরো অনেকেই রয়েছেন। এখন মনে পড়ছে না। এছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা, যাঁর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সাহিত্যালোচনায় কাটিয়েছি। কিন্তু আমি সবচেয়ে ঋণী আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে। তাঁর কাছে পেয়েছিলাম রুচি।

শ্যামল : আপনার পরিবারে কোনো লেখালেখির আবহ ছিল কি?

আবুল হোসেন : না। তবে আমার বাবার গানের শখ ছিল। কিন্তু সেই সময়ে গান গাওয়া নাজায়েজ ছিল। ১৯৭১ সালে ২৪শে এপ্রিল বাগেরহাটে পাকিস্তানিরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। আমি তখন সরকারি চাকরি করতাম। বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। আর আমার ছোট ভাই আমজাদ হোসেন একসময় পাকিস্তানের মন্ত্রী ছিলেন। বাবাকে নিয়ে আমি একটা কবিতাও লিখেছিলাম যতদূর মনে পড়ে।

শ্যামল : আপনি তো দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর, অরণি, পূর্বাশা, নবযুগ, বুলবুলে লিখেছেন। সাহিত্যমানের বিচারে কোন পত্রিকাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?

আবুল হোসেন : আমি অনেক পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে লিখেছি। কিন্তু আমার কাছে দেশকেই সেরা মনে হয়েছে। এর সাহিত্যমান অনেক উঁচু ধরনের। এখন তো আর পড়া হয় না।

শ্যামল : আপনি তো দেশ ম্যাগাজিনের কথা বললেন, দেশের প্রথম প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়; আপনি একসময়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, তাঁর প্রচ্ছদ ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে বা তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো স্মৃতি কি আপনার মনে আছে?

আবুল হোসেন : হ্যাঁ, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়। সত্যজিৎ তো বড় ধরনের নির্মাতা ছিলেন। তাঁর পথের পাঁচালী ছবিটিই তাঁকে বিখ্যাত করে দেয়। যদিও আগে তিনি পেশাদার শিল্পী ছিলেন, পরে চলচ্চিত্রে চলে যান।

শ্যামল : আপনার জীবনে সবচেয়ে কষ্টদায়ক ঘটনা কোনটি?

আবুল হোসেন : আমার মা ও স্ত্রীর চলে যাওয়া। আমার স্ত্রী ১৯৯৪ সালে চলে যায়, আমাকে একা ফেলে। সে যাওয়ার আগে অনেক কথা লিখে যায় আমার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে, যা তারা অনেক নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে। আমি অনেক ভালোই আছি বলা যায়। এছাড়া বাবার কথা বেশ মনে পড়ে। এর বাইরে এমন কোনো কষ্ট আমি পাইনি।

শ্যামল : যে ধারণা বুকের গভীরে লালন করে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, জীবনের এই শেষ পর্যায়ে এসে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?

আবুল হোসেন : ছেলেবেলায় যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, কবিতার ভাষা, ছন্দ, মিল, বিষয় এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা ছিল না। লিখতে ভালো লাগতো তা-ই যথেষ্ট। অনেক বিষয়েই লিখেছি। পরে অনেক ভেবেচিন্তে কবিতাকেই বেছে নিলাম। আমি মানুষের মুখের ভাষার প্রেমে পড়ি। ফলে অপ্রত্যাশিত লাভ হলো। কবিতা সহজ-সরল হয়ে গেল।