শামসুর রাহমানের কাব্যসমালোচনার অনন্য ধরন : চল্লিশের দুজন কবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পথের সঞ্চয় গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘কবি যেখানে প্রত্যক্ষ অনুভূতি হইতে কাব্য লেখেন সেখানে তাঁহার লেখা গাছের ফুল-ফলের মতো আপনি সম্পূর্ণ হইয়া বিকাশ পায়।’ এরই রেশ টেনে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, এই বিকশিত কাব্য ‘আপনাকে ব্যাখ্যা করে না অথবা নিজেকে মনোরম বা হৃদয়ঙ্গম করিয়া তুলিবার জন্য সে নিজের প্রতি কোনো জবরদস্তি করিতে পারে না।’ তাহলে সে কী করে? – এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন, ‘সে যাহা সে তাহা হইয়াই দেখা দেয়; তাহাকে গ্রহণ করা, তাহাকে ভোগ করা পাঠকেরই গরজ।’ রবীন্দ্রনাথের কথাকে মান্যতা দিয়েই আমরা বলতে পারি, এই গরজটা শুধুই পাঠকের একার নয়, সেটি একজন সাহিত্য-সমালোচকেরও গরজ। কেন এই গরজ? তার উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আবারো রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতে পারি। কেননা, তিনি বিশ^াস করতেন যে, ‘সাহিত্যকে যে ঠিকভাবে দেখে সে মেপে দেখে না, তলিয়ে দেখে।’ একজন সমালোচকের প্রধান কাজই হচ্ছে, এই তলিয়ে দেখাটা নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া। আর সে-কারণেই কবি শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ বারবার প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে। কেননা, তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি, আরো অল্প কিছু কবির মতোই, সাহিত্যকে আজীবন তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।

দুই

আমরা এইটা জানি যে, শামসুর রাহমান কবিতা রচনাতে যতটা আনন্দ পেতেন, অন্য কোনো কিছুতেই ততটা অনুভব করতেন না। নিজের এই প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য যে-কোনো ব্যাপারে আলস্য আমাকে যত বেশী দখল করুক, কবিতা রচনায় আমি এখনো অনলস। সিদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাই না, তা বিচারের ভার পাঠক, বোদ্ধা ও সহৃদয় সমালোচকের ওপর ছেড়ে দিয়ে স্বস্তিবোধ করতে চাই। কবিতা লেখাতেই আমার আনন্দ।’ নিজের সাহিত্যিক উপলব্ধি বিষয়ে তিনি আমাদের আরো জানিয়েছিলেন, ‘যখন সাহিত্যচর্চায় হাতে-খড়ি হয় তখন আমরা নিজেদের রবীন্দ্রস্বর্গ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত করেছিলাম। এ স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পেছনে অবশ্য ছিলো তিরিশের সেই প্রধান পুরুষদের তুমুল আন্দোলনের প্ররোচনা ও কতিপয় বিদেশী ঠাকুরের মহিমার মন্ত্রণা।’ শুধুই তাঁর কবিতার আলোচনায় নয়, তাঁর সমালোচনাকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও এই বিষয়টি আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি। আর সে-কারণেই, আমরা চল্লিশের দুজন প্রতিনিধি-স্থানীয় কবির কাব্যকর্ম নিয়ে, শামসুর রাহমানের তলিয়ে দেখাটা, এখানে খানিকটা পর্যালোচনা করতে চাইছি।

তিন

প্রথমেই সমর সেনের প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। সেদিনের তরুণ কবি সমর সেনের কবিতায় বুদ্ধদেব বসু দেখতে পেয়েছিলেন কাব্য-বিদ্রোহের এক অনন্য ‘ভাব ও ভঙ্গি’। ভঙ্গির কথা বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর [সমর সেন] কবিতা গদ্যে রচিত, এবং কেবলই গদ্যে।’ এ-বিষয়ে তাঁর নিজের ধারণা যে ‘ভুল’ ছিল, সেটি স্বীকার করেই বুদ্ধদেব জানান, ‘আমার ধারণা ছিলো পদ্যরচনায় ভালো দখল থাকলে তবেই গদ্যকবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু সমর সেনের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখলুম।’ এ-বিষয়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তিনি গদ্যে ছাড়া লেখেননি, এবং কখনো লিখবেন এমন আশাও আমার নেই।’ বুদ্ধদেব তাঁর সেই একই প্রবন্ধে সমর সেনের গদ্যছন্দ সম্পর্কে পাঠকদের জানিয়েছিলেন, ‘এখানে এটা বিশেষ করে উল্লেখ্য যে তাঁর গদ্যছন্দ বাংলা ভাষায় অভিনব, রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনো কবির ছাঁচে ঢালাই করা নয়।’ অন্যদিকে, বুদ্ধদেব বসুর গদ্য-রচনা সম্পর্কে শামসুর রাহমান বলছেন, ‘বুদ্ধদেব বসু আমার প্রিয়তম লেখকদের অন্যতম, তাঁর যে কোনও লেখা সুখপাঠ্য; কখনও লগি ঠেলতে হয় না, ছিপছিপে নৌকোর মতো তরতরিয়ে  এগিয়ে যায়। … বুদ্ধদেবের যে কোনও গদ্যরচনা আমি তারিয়ে তারিয়ে চাখতে পছন্দ করি। ‘কালের পুতুলে’র বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি।’ শামসুর রাহমান কালের পুতুলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই আমাদের জানান যে, ‘এই ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থটিতেই আমি সর্বপ্রথম সমর সেনের কবিতা বিষয়ে আলোচনা পড়ি, তাঁর কবিতা না পড়ার আগেই।’ আর সেই প্রসঙ্গ ধরেই তিনি বলেছিলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে অল্পদিনের মধ্যেই সমর সেনের প্রথম কবিতার বই ‘কয়েকটি কবিতা’ সংগ্রহ করতে পারলাম একটি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। চটি বই, একরঙা মলাট। … বইটি দেখতে আদৌ এখনকার অধিকাংশ বইয়ের মতো চিত্তহারী নয়। কিন্তু সেই অনাকর্ষণীয়, অনুজ্জ্বল মলাটের আড়ালে নবীন পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছিল কবিতার জ্বলজ্বলে পঙ্ক্তিমালা।’ সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদকে। শামসুর রাহমান যে ‘জ্বলজ্বলে পঙ্ক্তিমালা’র কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটি এই কাব্যের সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই –

আমার রক্তে খালি তোমার সুর বাজে।

রুদ্ধশ্বাস, কত পথ পার হয়ে এলাম,

পার হয়ে এলাম

মন্থর কত মুহূর্তের দীর্ঘ অবসর;

স্মৃতির দিগন্তে নেমে এল গভীর অন্ধকার,

আর এলোমেলো,

ভুলে-যাওয়ার হাওয়া এল ধূসর পথ বেয়ে :

রুদ্ধশ্বাস, কত পথ পার হয়ে এলাম, কত মুহূর্ত,

শ্রান্ত হয়ে এল অগণিত কত প্রহরের ক্রন্দন,

তবু আমার রক্তে খালি তোমার সুর বাজে।’

(‘স্মৃতি’)

কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (আশ্বিন, ১৩৪২) এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত সমর সেনের কবিতা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘কবিতা কয়টিতে গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে এঁর লেখা ট্যাঁকসই হবে বলেই বোধ হচ্ছে।’ রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণ করে সমর সেনের কবিতা এই এতদিন বাদেও টিকে আছে তার আপন শক্তির জোরে।

চার

সমর সেনের গদ্যছন্দের সম্মোহিত শক্তি আর স্পন্দন শুরুতেই শামসুর রাহমানের নজরে পড়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘তখন মুগ্ধাবেশে অনুভব করলাম এক নতুন ছন্দের স্পন্দন যা এর আগে ধরা পড়েনি বাংলা কবিতায়। প্রথাসিদ্ধ ছন্দ এটা নয়। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত কোনও এলাকাতেই পড়ে না এই ছন্দোস্পন্দ। একেই তো বলি গদ্যকবিতা।’ এই ছন্দের বিশিষ্টতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শামসুর রাহমান জানাচ্ছেন, ‘সমর সেনের আগে গদ্যকবিতা কেউ লেখেননি এমন নয়, খোদ রবীন্দ্রনাথ প্রচুর গদ্যকবিতা লিখেছেন। তিরিশের প্রায় সকল কবিই গদ্যকবিতা রচনা করেছেন। … প্রকৃত গদ্যকবিতা সমর সেন ছাড়া আর কারও হাতেই তেমন খোলেনি।’ সমর সেনের গদ্যছন্দের অভিনবত্ব কোথায়? এর উত্তরে শামসুর রাহমান আমাদের জানিয়েছেন, ‘সমর সেনীয় গদ্যকবিতার বৈশিষ্ট্য হল : তিনি যে গদ্যছন্দ প্রবর্তন করেন তা গল্প কিংবা প্রবন্ধের আওতাবহির্ভূত। গদ্যকবিতার জন্য যেমন ছন্দ জরুরী, ঠিক তেমনি ছন্দের সৃষ্টি করলেন তিনি এবং করলেন এমনই রূপদক্ষ কারিগরের মতো যা গদ্য হয়েও রূপান্তরিত হল প্রকৃত কবিতায়।’ রবীন্দ্রনাথ তো আগেই বলেছিলেন, ‘গদ্যই হোক পদ্যই হোক, রসরচনামাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত।’ এর উদাহরণ হিসেবে আমরা সমর সেনের কবিতা থেকেই উদ্ধৃত করতে পারি –

চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি

সকালে কলতলায়

ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,

খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি;

মাঝে-মাঝে ক্লান্ত হয়ে কী যেন ভাবি –

হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;

আর শহরের রাস্তায় কখনো-বা প্রাণপণে দেখি

ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।

আর মদির মধ্যরাতে মাঝে-মাঝে বলি –

মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,

পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো

হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন।

কলকাতার ক্লান্ত কোলাহলে

সকালে ঘুম ভাঙে

আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে

বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি।

(‘একটি বেকার প্রেমিক’)

এই কবিতা পাঠ করতে-করতেই রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘গদ্যের চালটা চলার, পদ্যের চাল নাচের। এই নাচের গতির প্রত্যেক অংশের মধ্যে সুসংগতি থাকা চাই।’ সমর সেনের কবিতায় চালটা চলার হলেও এর মধ্যে আমরা প্রধানত রবীন্দ্রনাথ-কথিত কাব্যিক ‘সুসংগতি’টাই দেখতে পাই। আর সেটাই সমর সেনের কবিতার অন্যতম প্রধান শক্তি, যা কি না পাঠকের হৃদয়কে আপ্লুত করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছিলেন, ‘কাব্যের লক্ষ্য হৃদয় জয় করা – পদ্যের ঘোড়ায় চড়েই হোক, আর গদ্যে পা চালিয়েই হোক। সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির সক্ষমতার দ্বারাই তাকে বিচার করতে হবে।’ শামসুর রাহমানও সেই সক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনেই সমর সেনের কাব্যশক্তিকে বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। সে-কারণেই বলেছেন, ‘শুধু ছন্দেই অভিনবত্ব আনেননি সমর সেন। চিত্রকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষা রচনায়, বাংলা কাব্যের তপোবনে প্রবেশাধিকার ছিল না যে শব্দাবলির, তাদের কবিতায় ঠাঁই দেয়ার সাহসী প্রচেষ্টাতেও তিনি সাফল্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন।’ আমরা সমর সেনের নানাকথা কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি  –

বৃষ্টিতে মাজা নীল শূন্য;

জানি, করাল অভিশাপে

এ বসন্দের বাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে;

আমাদের এ টুকরো প্রেম, কৃষ্ণচূড়া দিন,

এ বাসরঘর,

শ্মশান কুরুক্ষেত্রে শকুনের কোলাহলে

মোলায়েম বাঁশির মতো।

(‘কয়েকটি মৃত্যু’)

শামসুর রাহমান যথার্থই বলেছিলেন, ‘সত্যি বলতে কী গদ্যছন্দের মুক্তি একজন সমর সেনের অপেক্ষায় ছিল।’ এই মন্তব্যের মধ্যে আর যা-ই থাকুক, কোনো ধরনের অত্যুক্তি নেই। সমর সেনের কাব্য-প্রবণতা সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে সমর সেনই প্রথম নাগরিক কবি। তাঁর কবিতা মূলত শহরকেন্দ্রিক।’ কথাটিকে আরো খানিকটা বিস্তারে নিয়ে গিয়ে শামসুর রাহমান জানিয়েছেন, ‘কলকাতার দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, বিক্ষোভ, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, রোগ-শোক, প্রেম-অপ্রেম, হতাশা ও ক্লান্তি মূর্ত হয়ে উঠেছে বিদগ্ধ কবি সমর সেনের কবিতায়। একটি নগর ও তার নাগরিকদের তিনি রূপায়িত করেছেন কখনও বেদনায় দীর্ণ হয়ে, কখনও-বা ক্রোধ ও শ্লেষের ভঙ্গিতে। ক্ষয়িষ্ণু সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্ত সমাজকে তিনি বারবার ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছেন, সেই শ্রেণীর একজন প্রতিভূ হিসেবে এমনকি নিজেকেও রেয়াৎ করেননি।’ শুধু তা-ই নয়, সমর সেনকে তিনি বলেছেন, ‘চল্লিশের দশকের মৌলিক কবি’। তাঁর প্রথম পর্যায়ের কবিতায় বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনার বিদ্রোহী চেতনা এবং বিষ্ণু দে-র চোরাবালির ‘ব্যঙ্গনৈপুণ্যের প্রভাব’ শামসুর রাহমানের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

পাঁচ

অন্য-অনেক সমালোচক ও পাঠকের মতোই শামসুর রাহমান আফসোস করেছেন, ‘মাত্র বারো বছর কাব্যচর্চা করে, কেন কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন, চল্লিশের দশকের খ্যাতিমান ব্রিলিয়ান্ট কবি?’ এর কোনো সরাসরি বা চটজলদি উত্তর কারোই জানা নেই। তবে সমর সেন নিজেই তাঁর একটি গদ্যরচনায় খানিকটা খেদের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, ‘১৯৪১-এর ২২ জুন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করাতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ রাতারাতি জনযুদ্ধে পরিণত হল। ব্যাপারটা ছকে ফেলতে বিশেষ বেগ পেতে হয়েছিল। … ১৯৪৪-এর জুন মাসে মিত্রশক্তিরা ইউরোপে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলাতে বিবেক হালকা হয়ে গেল, সরকারি চাকরি নিয়ে রেডিও-র সংবাদ বিভাগে ঢুকলাম।’ আর এরপরই বলেছেন, ‘সংবাদের চাপে, দেশের দাঙ্গাহাঙ্গামায় আস্তে-আস্তে কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে এলো – ছক মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।’ এই হচ্ছেন ব্যক্তি সমর সেন, যিনি রাজনীতিতে, সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, বিদেশে অনুবাদ-কর্মে, পত্রিকা সম্পাদনায় – কোথায়ও তথাকথিত ‘ছক’ মিলিয়ে চলতে পারেননি। গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে একেবারেই ভেসে যেতে দেননি। সমর সেনের আদর্শ, তাঁর আপসহীন মনোভাবকে শামসুর রাহমান স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি এই বিষয়ে বলেছিলেন, ‘কোনো-কোনো ব্যাপারে হয়তো আমরা তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে পারব না; কিন্তু তাঁকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাব চিরদিন তাঁর কবিকর্মের জন্যে, তাঁর সাহস ও সততার জন্যে।’ বিশেষ করে নাউ এবং ফ্রন্টিয়ার সম্পাদনার সময় সমর সেন যে আপসহীন-লড়াকু মনোভাব দেখিয়ে গিয়েছিলেন, তা মনে রাখার মতো ঘটনা।

ছয়

চল্লিশের দশকের আরেক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে আলোচনার ভূমিকাতেও, আমরা দেখতে পাই, শামসুর রাহমান মূলত তাঁর স্মৃতির হাত ধরেই পাঠককে স্বাগত জানিয়েছেন। শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘সে এক সময় ছিল আমার পঞ্চাশের দশকের ঊষালগ্নে; তখন তরতাজা তরুণ আমি, শাহরিক পথের ধুলো উড়িয়ে স্যান্ডেলে ভরদুপুরে, বিকেলে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরি প্রায় মধ্যরাতে। সারাক্ষণ কবিতা আওড়াই কখনও সশব্দে, কখনও মনে মনে।’ আর তারপর তিনি অকপটে সেই আগে বলা কথাগুলোই যেন একটু ভিন্নভাবে জানাচ্ছেন, ‘কবুল করতে দ্বিধা নেই, জীবনানন্দ দাশেই সর্বাধিক নিমগ্ন ছিলাম, যদিও তিরিশের অন্যান্য কবির আকর্ষণী শক্তিও কম ছিল না। আমার তারুণ্যের প্রত্যুষে পাকিস্তানী দামামা বেশ জোরেশোরে বেজে চলেছিল পূর্ব বাংলায়। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু তরুণ মার্কসবাদের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।’ এইসব তরুণ কবির মধ্যে যে তিনিও ছিলেন সেটি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না। শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘আমরা যারা তখন তরুণ কবি, তারা বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়েছি মার্কসবাদী কবিদের প্রতি। সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা হয়ে উঠলো আমাদের নিত্যসঙ্গী।’ আর তার সঙ্গে পাঠককে তিনি এটিও জানিয়ে দেন, ‘কারো কারো কাছে সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আমার পক্ষপাত ছিল সমর সেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি।’ কবিতা ছিল শামসুর রাহমানের আদি-অন্ত প্রাণ, কাজেই যথার্থ ‘রত্ন’ চিনতে তাঁর কখনো তেমন-একটা ভুল হয়নি।

সাত

বাংলা কবিতার জগতে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের আগমনটা যেমন ছিল নিঃশব্দে, এর বিপরীত চিত্রটাই যেন দেখতে পাই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বেলায়। শামসুর রাহমান জানিয়েছেন, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কাব্যক্ষেত্রে তুমুল সাড়া পড়ে যায়। বুদ্ধদেব বসু কস্মিনকালেও মার্কস-অনুরাগী হিসেবে খ্যাত ছিলেন না; কিন্তু তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘পদাতিক’ সম্পর্কে এক সুদীর্ঘ আলোচনা লেখেন। সেই আলোচনায় ছিল অকৃপণ প্রশংসা, যা কোনো তরুণ কবির পক্ষে সহজলভ্য নয়।’ খুবই সত্যি কথা। কী বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু? বুদ্ধদেব বসু তাঁর সেই আলোচনায় সেদিনকার এক তরুণতম কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য : প্রথমত, তিনি বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; … দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে।’ যিনি গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন – ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।’ সেই কবির পক্ষে – প্রেমই বলি কি প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাই বলি – কোনো কবিতা লেখাই তো সম্ভব না, যদি তাঁর কবি-চেতনায় বিশ্বাসের ভিত্তিটা শক্ত না হয়। আমরা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি যে, সুভাষের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল।

আট

ঘটেছিল বলেই, বুদ্ধদেব বসুর কথাগুলো মেনে নিয়েও, শামসুর রাহমান সুভাষ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আজ বাংলা কাব্যক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের যে উজ্জ্বল স্থান তা শুধু ছন্দে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য গড়ে ওঠেনি, এর পেছনে তাঁর কবিতার কনটেন্টেরও গুরুত্ব রয়েছে।’ বুদ্ধদেব বসু তাঁর আলোচনা শেষ করেছিলেন এই বলে যে, ‘রাজনীতি’ এবং ‘কবিতা’ এই দুইয়ের মধ্যে যে-কোনো একটি সুভাষকে বেছে নিতে হবে। সেইসঙ্গে এটিও বলেছিলেন, ‘যখন এবং যতক্ষণ তিনি কবি, কবিতার উৎকর্ষই হবে তাঁর সাধনা।’ শামসুর রাহমান এটি মানছেন বটে; ‘কোনো কবি রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠলে তিনি আর কবি থাকতে পারেন না।’ – গ্যোটের এই মন্তব্যটিও মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু সেইসঙ্গে এটি বলতেও দ্বিধা করছেন না যে, ‘আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের কবি তাদের এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এমন কিছু দৈশিক এবং বৈশ্বিক শোষণ ও পীড়নের শিকার হতে হয় যে, কোনো বিবেকী কবি কিংবা শিল্পীর সেসব সমস্যার প্রতি উদাসীন থাকা সম্ভব নয়।’ সে-কারণেই সেই সচেতন কবিকে ‘তখন হয়তো কণ্ঠস্বরকে বজ্রের প্রতিযোগী করে তুলতে হয়, ফলে চিৎকার যতোটা প্রবল হয়, সুর ততোটা ধ্বনিত হয় না। তাই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছেড়ে রাজনৈতিক কাজে ডুবে থাকার ব্যাকুলতা আমি বুঝতে পারি।’ যুগ-বাস্তবতা ও মাত্রাজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে শামসুর রাহমান যেটি বুঝতে পেরেছিলেন, বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে সেটি উপলব্ধি করা আদৌ সম্ভব ছিল না। এর কারণ হচ্ছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুদ্ধদেব ছিলেন ঘোরতর রাজনীতি-বিরোধী। আবার এটিও বলা যায় যে, রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণাটাই ছিল একটা ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর জীবনের একটা পর্বে লেখালেখির চেয়ে রাজনৈতিক কাজে যুক্ত থাকাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর কবি-জীবনে একটা ‘যতি’ নেমে আসে। আমরা যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক বেরিয়েছিল ফাল্গুন ১৩৪৬ (১৯৪০ সাল) সনে, সেখানে তার পরের কাব্যগ্রন্থ অগ্নিকোণ বেরুচ্ছে অক্টোবর, ১৯৪৮ সালে। মাঝখানে প্রায় আট বছরের বিরতি। এই ঘটনার জের টেনেই শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘কিছুকাল সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবির কলমটিকে পার্টি অফিসের দেরাজে তালাবন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু আমাদের বাংলা কবিতার পরম সৌভাগ্য এই করুণ পরিস্থিতি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি ‘যত দূরেই যাই’ নামে সাড়া-জাগানো কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাব্যক্ষেত্রে ফিরে এলেন সগৌরবে।’ এখানে একটু তথ্যগত ‘ভুল’ রয়েছে। শামসুর রাহমান সম্ভবত খেয়াল করেননি যে সুভাষের যত দূরেই যাই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা সন বৈশাখ, ১৩৬৯-এ অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় হিসাবে ১৯৬২ সালে। তার আগে নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদসহ সুভাষের আরো বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

নয়

কাব্যজগতে সুভাষের এই প্রত্যাবর্তনে শামসুর রাহমান খুশি হয়েছিলেন। সে-কারণেই বলেছেন, ‘অক্লান্ত রাজনৈতিক কর্মী সুভাষ মুখোপাধ্যায় এভাবে প্রত্যাবর্তন করলেন প্রকৃত কবিতার দেশে। এই ফিরে আসার সম্ভাবনা, যা কবিতার পাঠকদের পক্ষে তৃপ্তিকর, কবির চরিত্রেই নিহিত ছিল। … পরবর্তীকালে তিনি পার্টির কাজকর্ম থেকে, যতদূর জানি, কিছুটা সরিয়ে এনেছিলেন নিজেকে। হয়তো  ভেবেছেন সাহিত্য সৃষ্টির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড।’ কিন্তু এটিও উল্লেখ করতে শামসুর রাহমান ভোলেননি যে, সুভাষ ‘একজন শিল্পীর দায়িত্ব এবং অঙ্গীকার থেকে নিজেকে কখনও বিযুক্ত করেননি। দেশ এবং মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা অটুট।’ কবির সেই স্থির অথচ আত্মবিশ্বাসী অবস্থানটি আমরা আরো স্পষ্ট দেখতে পাই, যখন তিনি তাঁর ‘আমার কাজ’ শীর্ষক কবিতায় বলেন –

আমি চাই কথাগুলোকে

পায়ের ওপর দাঁড় করাতে।

আমি চাই যেন চোখ ফোটে

প্রত্যেকটি ছায়ার।

স্থির ছবিকে আমি চাই হাঁটাতে।

আমাকে কেউ কবি বলুক আমি চাই না।

কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত

যেন আমি হেঁটে যাই।

আমি যেন আমার কলমটা

ট্র্যাক্টরের পাশে

নামিয়ে রেখে বলতে পারি

এই আমার ছুটি

ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।’

(‘কাল মধুমাস’)

এ-প্রসঙ্গে তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কথা আমাদের মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত, সংগ্রাম আর প্রেরণা; জয়, পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা; খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব ক’টি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না।’ এই কথাগুলি সুভাষের সমগ্র কাব্য সম্বন্ধেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে আমরা ধারণা করি।

দশ

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁর অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘একজন বিবেকী, প্রধান কবি হিসেবে তিনি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন।’ কিন্তু সেইসঙ্গে এই কবিকে নিয়ে তাঁর মনের খেদের কথাও প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। সেটি হচ্ছে, কুখ্যাত স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের আমন্ত্রণে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক কবিসম্মেলনে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করাকে, শামসুর রাহমান ঠিক যেন মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেদিন অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় কবির এই আচরণে।

এক জেনারেলের আমন্ত্রণে সুভাষের সেইবার ঢাকায় আসাকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামানও মেনে নিতে পারেননি। তিনিও সেদিন মর্মাহত হয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘একটু বিষাদের সুরেই বললাম ‘এরশাদের অতিথি হয়ে যাবেন ঢাকায়?’ সুভাষদা বেশ একটু মজার হাসি হেসে বললেন, ‘কতদিন ধরে ভাবছি ঢাকায় যাব। তোমরা এরশাদকে হটাবে, তার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন তোমরা তাকে তাড়াতে পারছ না, আমি আর কতদিন বসে থাকব।’ তাঁর যুক্তির কাছে হার মানলাম একরকম।’

শামসুর রাহমান এরকম ‘হার’ মেনেও সুভাষকে শ্রদ্ধা জানাতে কোনো কার্পণ্য করেননি। বরং ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একে প্রতিভার সাময়িক বিভ্রম ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি এবং আমাদের প্রিয় কবির জন্য আজও ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার দীপ অনির্বাণ রেখেছি।’ শুধুই মানুষ কিংবা কবি হিসেবে নয়, সমালোচক হিসেবেও শামসুর রাহমানের উদারতার চিহ্ন এখানে আমরা নানা স্তরে দেখতে পাই।

এগারো

এই হচ্ছে শামসুর রাহমানের চল্লিশের দশকের দুই আধুনিক কবিকে নিয়ে সমালোচনা-পরিক্রমা। যাকে বলা যায় – সহানুভূতিশীল সমালোচক, শামসুর রাহমান ছিলেন ঠিক তা-ই। হয়তো নিজে একজন বড়োমাপের কবি ছিলেন বলেই, এই সহানুভূতির মনোভাবকে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্জন করতে পেরেছিলেন। আর সহানুভূতিশীল ছিলেন বলেই একজন সমঝদার সাহিত্য-সমালোচক হয়ে উঠতে তাঁর তেমন বেগ পেতে হয়নি। আবার এর উলটোদিকও কিন্তু আছে; যাঁদের কথা আমাদের জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যবসাদার বিচারকও আছে। তাহাদের পুঁথিগত বিদ্যা। তাহারা সারস্বতপ্রাসাদের দেউড়িতে বসিয়া হাঁকডাক, তর্জনগর্জন, ঘুষ ও ঘুষির কারবার করিয়া থাকে; অন্তঃপুরের সহিত তাহাদের পরিচয় নাই। তাহারা অনেক সময়েই গাড়িজুড়ি ও ঘড়ির চেন দেখিয়াই ভোলে। … তাহারা পোশাক চেনে, তাহারা মানুষ চেনে না। তাহারা উৎপাত করিতে পারে, কিন্তু বিচার করিবার ভার তাহাদের উপর নাই।’ আমাদের সাহিত্যে ব্যবসাদার সমালোচকের সংখ্যাই যে বেশি, সত্যের খাতিরে সেটা অস্বীকার করবারও উপায় নেই।

বারো

পরিশেষে আরেকটি কথা আমরা যোগ করতে চাই। সেটি হচ্ছে, শামসুর রাহমানের পড়াশুনার পরিধি ছিল ব্যাপক এবং গভীর। বইপড়ুয়া হিসেবে পরিচিত-মহলে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল। তাঁর এই বিস্তৃত পাঠপরিক্রমা তাঁকে খানিকটা আলাদা ধরনের সমালোচনাকর্মে মনোনিবেশ করতে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছে আমৃত্যু। রবার্ট ব্রিজেসকে লেখা এক চিঠিতে কবি হপকিন্স বলেছিলেন, ÔWide reading does two things — it extends knowledge and it adjusts the judgement.Õ সাহিত্যে বা সমালোচনাকর্মে যে-সামঞ্জস্য বিধানের কথা হপকিন্স বলেছিলেন, শামসুর রাহমানের মধ্যে তার মূর্ত প্রয়োগ দেখতে পেয়ে আমরা শ্রদ্ধায় অবনত হই। সাহিত্যের জগতে তিনি যে একজন আগ্রহী আর নিবেদিতচিত্তের মানুষ ছিলেন – শামসুর রাহমানের কবিতার পাশাপাশি তাঁর এই সমালোচনামূলক গদ্যও আরেকবার সেই সাক্ষ্য দেয়। তিনি ছিলেন ঠিক সেই জাতের সমালোচক, যিনি সাহিত্যকে মেপে না-দেখে বরং তলিয়ে দেখতেন। এটিই তাঁর স্বতন্ত্রতা আর বিশিষ্টতার সমাকীর্ণ সাক্ষী।

১৭ই আগস্ট কবি শামসুর রাহমানের মহাপ্রয়াণ দিবস। কবির স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. বুদ্ধদেব বসু, ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র-৪ (কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৫)।

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের পথে (বিশ^ভারতী : আশ্বিন ১৩৪৩; পুনর্মুদ্রণ : কার্তিক ১৩৯৪)

৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পথের সঞ্চয় (বিশ^ভারতী : ভাদ্র ১৩৪৬; পুনর্মুদ্রণ : জ্যৈষ্ঠ ১৪০৬)।

৪. শামসুর রাহমান, আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ (চট্টগ্রাম : বইঘর, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)।

৫. শামসুর রাহমান, শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ (ঢাকা : শ্রাবণ, ফেব্রুয়ারি ২০০১)।