নিষিদ্ধ হরিবালা

নাগরিক পথ। পথ মানে বড় কোনো সড়ক নয়। আবার ঘুপচি গলিও নয়। মাঝে মাঝে মাছি-ভনভন-করা এঁদো খানাখন্দ। আসা-যাওয়ার অসচ্ছল এক ব্যবস্থা মাত্র। প্রচণ্ড কোলাহল নেই। মানুষের যাওয়া-আসা আছে। তবে সীমিতই বলা চলে। চঞ্চল পায়ে চলতি মানুষগুলি কেউ কাউকে চেনে বলে মনে হয় না। যেন অচেনা অন্যরকম মানুষ। বড় যানবাহন তেমন চলে না ওপথে। রিকশা-ইজিবাইক চলে সন্তর্পণে।

রাস্তার দু-পাশে বিচিত্র বর্জ্যরে স্তূপ। কিছু বেওয়ারিশ কুকুর ময়লা ঘেঁটে বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে। ড্রেনের দুর্গন্ধ বয়ে চলা বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা এই রাস্তায় চলছে তাদের নাকে-মুখে কোনো রুমাল নেই। চোখে-মুখে কোনো প্রতিক্রিয়াও নেই। জানি না তাদের হৃদয়ের ধূপদানিতে কি এমন সুরভি রয়েছে যা ভেদ করে ওই বাজে গন্ধ সুবিধা করতে পারছে না।

প্রবেশদ্বারের পাশেই নগর কর্তৃপক্ষের একটি ছোট্ট অফিসঘর। তারই পাশে অযত্নে জন্ম নেওয়া আমগাছটি নতুন তামাটে পাতায় যেন নবীনকে আহ্বান জানাচ্ছে। গাছকে সীমানা ধরেই ছোট ছোট ঘর। গলির ভেতর গলি। দূর থেকে নির্জন মনে হলেও ভেতরটা বেশ ফুর্তির ফুলকিতে জাঁকালো। ছোট ছোট দোকানে নানা ধরনের প্রসাধনী। সারি সারি ঝুলে আছে গর্ভনিরোধকের প্যাকেট। পরিবেশ জমজমাট করে তুলতে বাজছে ছোট ছোট সাউন্ড বক্সে শরীর-মন উতলকারী বাদ্য-বাজনা। পাশেই পঞ্চাশোর্ধ্ব বিগতযৌবনা এক হরিবালা ক্ষয়িষ্ণু শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে নেশার ঘোরে নেচে নেচে গেয়ে চলছে, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো … পার করো আমারে।

তৈরি পোশাকের দোকানের ডামি পুতুলের মতো রাস্তার পাশে অথবা দোকানে হেলান দিয়ে সাধ্যমতো রঙে নিজেকে রাঙিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে রঙ্গিলারা। বিভিন্ন বয়সী এসব রঙ্গিলা অপেক্ষা করছে রসিকজনের আশায়। কারো বা জুটছে, কারো বা দিনভর খররোদে দাঁড়িয়ে আশার ঘাম ঝরানোই সার। পোড়া কপাল আরো পুড়ে যায় যেন তাদের।

মনের চোখে তাকালেই নিঃস্ব ত্বকে শুধু মরীচিকার বেদনা ঝংকার দিয়ে কেঁদে উঠছে। ওদের ঝাঁকড়া চুলগুলো যতই বাহারি সাজে সাজানো হোক না কেন, দেখাচ্ছে ধুলোমাখা পাটের আঁশের গোছার মতো। তার ভেতর থেকে ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র সুগন্ধ। কেউ বা খোঁপায় পরেছে রকমারি কৃত্রিম ফুল। কারো নাকে নোলক, কারো বা মাথায় সিঁদুর। হেলেদুলে হাঁটছে। হাঁটাতেও বাহারি ঢং। চোখের পাতার স্পন্দনে যে-ভাষাই থাকুক না কেন চোখের আলোয় কেবল খুঁজছে নিধুবনে নিধুয়া বন্ধুকে। নিমন্ত্রণের নিপুণ আহ্বানে যেন কামানল জ্বালিয়ে তোলা সারাক্ষণ। এরই মধ্যে রসিকতা হাসি-তামাসা-ঠাট্টারও কমতি নেই। যতই রসে রসে রসের ফোয়ারা উছলে উঠুক, চোখ কেবল ফিরে ফিরে  খোঁজে রসিকজন।

আসা-যাওয়ার মানুষগুলি চেনা-অচেনায় মেশামেশি। হঠাৎ নতুন মুখের উদয় দেখলেই হার-হাভাতের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওরা ঝাঁকবেঁধে। টানা-হেঁচড়া আর পরস্পরের প্রতি খিস্তি-খেউড়ের ঝংকার তোলে। যেন জীবনের শেষ লড়াই। অথচ ভালোবাসা নেই, কোনো প্রেমের আকর্ষণ নেই, নেই কোনো আবেগ, তবুও নিজ ঘরে তোলার ধূর্ত বিস্ময়কর এক প্রতিযোগিতা। অবশেষে লড়াই থেমে যায়। একজন মাত্র রায়বাঘিনী শিকার কব্জা করে। তখন চারদিকে হঠাৎই যেন ঝড়-থেমে-যাওয়া শান্ত পরিবেশ। পেছন থেকে কেউ একজন উচ্চকণ্ঠে রস করে বলে – ‘যাও গো দুলাভাই যাও, বুবুর কমলাই খাও।’ এ এক বিস্ময়কর বাঁচার লড়াই। বেশ দক্ষতার সঙ্গেই করছে ওরা। এমন দক্ষতা ওরা পেল কোথা থেকে? পশুর সন্তানেরা যেমন প্রকৃতি থেকেই সব শেখে, হয়তো ওরা এই জটিল পরিবেশ থেকেই অর্জন করে এমন কৌশল।

হঠাৎ ওপাশে শুরু হয় হরিবালার প্রেতনৃত্য। রক্তাভ ক্রুদ্ধ চোখের গোলক তার। অগণিত কালনাগিনীর ফণার মতো উচ্ছৃঙ্খল কেশরাশির উত্থান-পতন। ত্রস্ত করাতির করাত টানার মতো একবার এগোয়, একবার পিছিয়ে আসে। ও অমন কেন করছে? কেন এমন রুদ্রমূর্তি তার? সবাই যে যার অবস্থানে বিস্ময়ে স্থির। এমন উটকো দৃশ্য অবাক হয়ে দেখছে সবাই। অবসাদে অবসন্ন ভাঙা শরীরে সে কী তেজ হরিবালার! কাঁধে ঝোলা। পরিপাটি চুল। সুশোভন সাজপোশাক। হরিবালার প্রবল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নিতান্ত এক ভদ্রলোক। কে এই ভদ্রলোক? দেখে মনে হয় সে এই কুঞ্জবনের মধুকুপি নয়। তবে কেন এসেছে এখানে? কী চাই তার? জীর্ণ শরীরের বিগত যৌবনের মøান আলোয় তীব্র তীক্ষè অশ্রাব্য বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছে হরিবালা তার দিকে। লোকটি যেন নিরীহ অপরাধী প্রজার মতো। মহারানীর রোষানল নিবারণে অনুনয়ে স্তুতি করছে। ‘খালা খালা’ বলে আপন পরিচয় বোঝাতে চেষ্টা করছে। তবু মহারানী বলেই চলেছে।

‘হুন হুন, কথা কম। খালা! কিয়ের খালা। জানি জানি কোনো হালাই মামা অয় না। ঘরে যাবি চল। আমার পেটে খিদা আছে, তোর খাই খাই আছে। সব খিদা মিটাইতেই টেহা লাগে। আগে দেও। তারপর চল ঘরে যাই। বুঝছি তুই সাংবাদিক। আরে কত সাংবাদিক দেখলাম। রিপোর্ট লেখব কইয়া ডর দেহায়। কাম কইরা টেহা না দিয়াই যায়গা। সরকারি লোক কামও হাসিল করে আবার ঘরে যা থাহে তাও নিয়া যায়। ভদ্দরলোক! পুরুষ মানুষ আবার বালা মানুষ হয় নাকি! ইডা আমারে কবার আইছোস। কাইট্টা পর, নাইলে টেহা আগে দিয়া ঘরে চল। এহনও আমার গতরের রস ফুরায় নাই। আরো ঘন হইছে।’

হরিবালার কথায় তার জীবনসংগ্রামের গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসছে বুভুক্ষু শ্বাপদের বর্বর চিত্র। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবেসেই হরিবালাদের জীবন। লোকটি কিছু খাবার নিয়ে আসে। খাদ্যের গন্ধে চিত্তের বরফ গলতে শুরু করে। ক্ষুধায় কাতর হরিবালার পেট যেন জ্বলে যাচ্ছে। খাবার খেতে হলে আচরণে শালীনতা চাই। ভোল পাল্টায় হরিবালা। পরিবেশ শান্ত হয়। চারপাশে যারা দর্শক ছিল তারা যে যার মতো সরে পড়ে। লোকটি হরিবালার জীবনের গল্প শুনতে চায়। হরিবালা খাবারসমেত লোকটিকে নিয়ে পাশের এক বেঞ্চিতে বসে পড়ে। খেতে খেতে কথা শুরু করে হরিবালা।

‘আমার নাম আছিল জরিনা। তহন আমার বয়স কত অব – তেরো কি চইদ্দ। কামলা বাপ খাওন দেয় কুনোমতে। কাপড় দিবার পারে না। চায়ে-চিন্তে নিয়া আসে। ছিঁড়া-মিরা দিয়ে বুকটুক বাইর অয়ে যায়গা। কেছরা কেছরা গোলামেরা ইডা-ওডা কয়। বিয়ার ঘরও আইছে দুই-একডা। অভাবে পুইড়া পুইড়া খাইতেছে এহাবারে। এর মইদ্যে একদিন বিল থেইকা হাঁস নিয়া বাড়ি আইতাছি। বেলা যায় যায়। পরচিম মুহি চাইয়ে দেহি আসমানের বুকের মইদ্যে বেইলডা যেন টকটকা লকেটের নাহাল ঝুলতাছে। এইডা না দেইখা মুনডার মইদ্যে চিরিক দিয়া উঠল। যেন নাখে নাখে পোর্জ্জাপতি ঝিলকাইয়া উইড়েল দিয়া উঠল। আমার বিয়ার কথা মনে অইছিল।

গুনার পার হইতেই ঢাহা থেইকা মেলা দিন পরে দুলাভাই আইছে দেইকা খুশিও অইলাম, আবার অবাকও অইলাম। দুলাভাইয়েরে অক্তের নাহাল বেলডা দেহাইয়া কইলাম, আজ বেলডারে এত সুন্দর দেহা যাইতাছে ক্যা? দুলাভাই আমারে এক টানে কাছে নিয়া, প্যাকের মধ্যে টাহি মাছ ধরবার মতো কইরা শইলে খামছাইতে খামছাইতে কয় – তর শইলের মইদ্যে জোয়ার আইছে। ওই ঢেউ তর মনে উছলাইতাছে। তাই তর অবা ঠেকতাছে।

ওইদিন দুলাভাইয়ের ব্যবহার আমার শইল্লের মইদ্যে শয়ে শয়ে ছ্যাঙ্গার মতো মনে হইল। হারা শইল্লে কাঁটা দিয়া উঠল। আমি ছিটকাইয়া সইরা গেলাম। দুলাভাই কয়, অবা করস কে? একটু আদর করলাম। বাইত আয় ভালা খবর আছে।

বাইত যাইয়া হুনি আমারে দুলাভাই নিবার আইছে। দুলাভাই যে অফিসে চাকরি করে ওই সাহেবের বাসায় দিব। বালা খাওন, বালা থাকা, আবার বলে মাসে মাসে টেহাও দিব। সময় বুইজা বালা পোলা দেইখা বিয়াও দিয়া দিব। বাজান-মায় দুইজনেই খুশি।

শেষ রাইতের ট্রেনে ঢাহা যাওয়া ঠিক। আমার ঘুম আহে না। শেষমেশ ট্রেনে চড়লাম। ট্রেন যায় আর আমার বুকটা বাইঙ্গে আহে। হাঁসগুলার কথা, ছোট বাইডা … ছেড়াটা আমারে ছাড়া ঘুমাইত না খাইত না। বাচ্চু কাহার পোলা মতি … মতি আমারে না দেখলে পাগলা হইয়া যাইতোগা। বিলের পার, বাজারের রাস্তার পাশে বিশাল এডা জঙ্গল কত পাহি, কত ফুল, কত ফলই না অই জঙ্গলে। ট্রেন যায় আর মনের মধ্যে এইগুইলে সব ছবির মতন ভাসতাছে। পাহিগুইলে যেন বুকের মধ্যে কাইন্দা উঠতাছে। ঘুম থাইক্যা উইঠা বাইডা কাইন্দে মরব, মতিও খুঁজবো, ওগোরে না কইয়েই আইয়ে পড়ছি।

ট্রেনে যাইতে যাইতে কহন যে ঘুমাইয়া পড়ছি, কিচ্ছু কবার পামু না। একসুম দুলাভাই আচানক ধাক্কা দিয়া কয় – উঠ উঠ কমলাপুর ইস্টিশন আইয়া পড়ছি।

নাইমা দেহি ওমা এত বড় বড় পাক্কা করা ছাতি। ছাতির নিচে হাইরে মানুষ। হাটবারে ছোনটা বাজারেও এত মানুষ দেহি নাই। ইস্টিশন থেইক্যা বাইরাইয়া দেহি আংগর ছোনটার জঙ্গল যেমন বড় বড় তেঁতুলগাছ বটগাছে ভরা, এইডা দেহি পাক্কার জঙ্গল। পাহাড় সুমান পাক্কা করা ঘরবাড়ি-দালানকোঠা। জঙ্গলে যেমন হিয়াল কুত্তা বান্দর হাপ বেজি গিজগিজ করে, এই জঙ্গলেও গিজগিজ করতাছে মানুষ। মানুষই যদি অব তয় দুলাভাইয়ের ব্যাগটা কাইড়া নিল গা কে? হিয়াল জিবা আমার হাঁস খপ্ কইরা নিয়া যায়গা তেমন।

দুলাভাই আমারে নিয়া আইল এক পাহাড় সুমান দালানবাড়িতে। গেইটে খাড়াই আছিল কালা মুছআলা দানবের মতন এক বেটা। আমগোরে ঘরে নিয়া গেল। পরীর নাহাল এডা বেটি আইয়া কয় – নিয়া আইছ আব্দুল। নাম জিগাইলে কইলাম জরিনা। আমারে ছোট এডা কোঠা দেহাইয়া কয়, গোসল কর আর এই কাপড় পর। দুলাভাই কয় – বিবিসাব যা কয় তাই কর, আমি যাই। ওই ঘরে ঢুইক্যা মাথা ঘুইরা গেলগা, মাইজার ওপর এহাবারে ভাত থুইয়া খাওন যাব। আয়না-মায়না কত কিছু। আয়না দিয়া চাইয়া দেহি আমার বেক্ষানি দেহা যায়। আস্তে আস্তে সবই বুঝলাম হিগলাম। একদিন বিকালে বিবিসাব আমারে ডাইক্যা কয়, তোর চোখটা বালাই দেহা যায়, একটা পুরান কাজল দিয়া কয়, নি চোখে দে। কাজল চোখে দিতেই আমার মায়ের কথা মনে অইল। কাঁঠল পাতার নিচে দোয়াতের কালি দিয়া মায়ে কাজল বানাইত। আদর কইরা চোহে দিয়া দিত। দিন ভালাই যাইতাছিল। এত সুখ এত আরামের মধ্যেও ছোট ভাইড্যার কথা, মতির কথা মুনে অয়, বিবিসাব কইছে, ঈদের পর দুলাভাইরে দিয়া বাইত পাঠাইব। তহন মুনডারে সুবর দেই। থাকতে থাহি। খাইদাই বালা বালা। খালা আমারে আদর কইরা দুনিয়ার রান্দন হিগাইতাছে। খালি বাইডার কথা মুনে হয়, আমি বালা খাই বালা পরি, ও যে না খাইয়া আছে, কইলজাডায় চিমঠি মারে। খালু সব বুইজা মধ্যে মধ্যে টেহা দেয় বাইত পাঠাবার জন্যে। সব জমাই। বাইডার জন্য বালা শার্ট কিনা দিলো। মনে অইল আমি বালা জায়গায় পড়ছি। আল্লার রহম আছে।

একদিন খালা আমারে বাসায় থুইয়্যা বাপের বাইত গেল। বেলা পইড়া যাইতেছে। এত বড় বাড়ি খাখা করতাছে। জানালা দিয়া রোইদের ঝাঁজ এহেবারে মুহে লাগতাছে। নিচের দিকে চাইলে গিঞ্জি গিঞ্জি দালান আর দালান। এডা গাছ কি এডা কাকপক্ষিও দেহা যায় না। আমি এলখা। আমার ডর করতাছে। আতাখা বেলডা কেরাং কেরাং কইরা বাইজা উঠলো। দরজা খুইলা দেহি খালু। অসময় খালুরে দেইখ্যা চমকাইয়া গেলাম গা। খুশিও অইলাম। আমার আত্মায় পানি আইল য্যানবড়। খালু ঘরে ঢুইক্যাই সোফার মধ্যে চিত্তর অইয়া শুইয়া পড়ল। কইল – ফ্যান দে। আবার কয় জুতাডা খুইল্যা দে। জুতা খুইলা দিতে দিতেই টাইয়ের ফসকা গির আলগা কইরা কয় – টাইডে খুল। বুতাম খুল। আমি তাড়াতাড়ি সব কাম কইরা আন্দন ঘরে যাই। তারে কেমন অস্থির অস্থির ঠেকতাছে। একটু বাদে ফিরিজ থেইক্যা লিচু বার কইরা ছুলাইয়া আমারে হাদে, আমি নিবার চাই না। মুখে দিবার চায়। কি করমু হাতেই নিলাম। মাথা বেদনা কইল, বড়ি দিলাম – খাইল না। উল্টা আমারে এক পাতা বড়ি দিয়া কয়, প্রতিরাইতেই এডা কইরা খাইস, শইল ভালা থাকব। দেহাইয়াও দিলো, কিবা কইরা খামু। আমি ভাবলাম, খালা বাইত নাই, তাই অবা ছটফট করতাছে। আমি এহন খালুর শইলের চিন্তায় মরি।

আইতে হ¹ল কাম শেষ কইরা ঘুমাইলাম। শইলে কোনো অসুখ নাই, কিয়ের বড়ি খামু। যে বড়ি দিছিল চিপার মধ্যে থুইয়্যা দিলাম। গভীর আইতে খালু আমার বিছনায় শুইয়া কয়, ম্যালা মাথা বেদনা ধরছে, কপালটা টিপা দে। ঘুমের ঘোরে বইয়া কপাল টিপা ধরলাম। আমার ঠেঙ্গের ওপর মাথা তুইল্যা দিলো। কত কথা কয়তাছে, আমারে ভালা বিয়া দিব। বাপ-মায়েরে ম্যালা টেহা দিব। আরো কত কী। হেও দেহি আমারে আদর করে। দু-একবার আত হরাইয়া দিলাম। মানে না, উইঠা বইয়া আমারে কুলে নিল। কুলে নিইয়া হাইরে আদর। গালে মুখে চুমু খাইতে খাইতে পাইজামার মধ্যে হাত ঢুকাইয়া আমারে পাগল বানাইয়্যা ফালাইল। গোলামের বেডাও দেহি হেই বিগার। জামা খুইল্যা হালাইলো। আমার শইল্যের মধ্যে আগুন ধাপাইয়্যা উঠল। আমার শইল-আত্মা দুমড়াইয়া-মুচড়াইয়া চুইসা ছুবরা বানাইয়্যা ফালাইল। শেষে একসুম গুলি খাওয়া বাজপাখির মতো পাহা ছাইড়া দিয়া পইড়া থাকলাম। আর কিছু কবার পামু না।

সকালটা আমার কাছে নতুন লাগতাছে। জীবনডা দরিয়ার মধ্যে হান্দাইল নাকি গায়ের অভাব-অনটন আর না খাওয়ার দিন শেষ হইয়া বেশি খাইয়ে ডাইরিয়া অবার দশায় পড়লাম। ওই বেটা অফিসে গেল গা। শইলডা ঝিমঝিম করতাছে। গুলামের পুত আইতে ঠিকমত গুমাবার দেয় নাই। কতক্ষণ পর খালার পোলা ডাহে। আমি কইলাম, সব টেবিলে দিয়া থুইছি। কয় – পানি দে। উডার আবার মেজাজ বালা না। তাড়াতাড়ি পানি নিয়া গেলাম। কম্পিউটারে কাম করতাছে। আমার মুহি না চাইয়াই ছুডু কাগজের বাক্সের মতো কি এডা আমারে দিয়া কয়, তোর জন্য আনছি। আমি আতে নিয়া দেহি সুন্দর বাসনা। বাক্স খুইল্যা দেহি বেশিয়ার। আমি শরমে ওর টুনার মধ্যে ফালাই দিয়ে দৌড় দেওন ধরতেই আমারে খপ কইরা দইরে কয়, খাড়া আমি পরায়ে দেই। দেহি তোরে কিবা দেহা যায়। আমি আর যাবার পাইলাম না। আমার জামাটা নিচ থিকা দইরা উপুড় মুহি একটানে খুইলা ফালাইল। তারপর বেশিয়ার বুকে লাগাইয়া দিয়ে কয় – তোরে ত নায়িকার চেয়েও ভালা দেহা যায়। বিশ্বাস না অয় দেখ, কইয়া কম্পিউটারের গাড় ঘুরাইয়া দিলো। চাইয়া দেহি ওই কাম করতাছে। নুচ্চার বাচ্চা কতক্ষণ যাইতে না যাইতেই জাবড়াইয়া ধইরা বিছানায় শুয়ায়ে ফালাইল। পুঙ্গার বাচ্চা পায়জামার বান খুলতেই খামছা দিয়ে আমার নাভির নিচে ফাইরে ফালাইছে, তহন বুঝি নাই পরে গুছুলের সময় দেখলাম। কাঠ কাটা কামলার মতন আমারে খালি কুবাইল মুনে অয়। অল্পতেই বিগার থাইম্যা গেল গা। আমার কিচ্চুই অইল না। ওর কাম শেষে আমারে ধমক দিয়া কয় – যা সর। এই শুরু অইল খালা আওয়ার আগ পর্যন্ত। আইতে বাপে, দিনে পুলা আমারে ইচ্ছামত খাইল। আমি কাউরে কিছু কবার পাইনে। বালাও ঠেকে। হাইরে মতির কথা মুনে অয়। মতিরে যুদি এমন কইরা একবার পাইতাম।

এবা করতে করতে পনেরো দিন গেল গা। আইজ খালা আব। আমার উপর আজাব কমবো। আবার টের পাইলে জান থুব না। ডরের চুটে কইলজার কাঁপ থামে না। দুপুরসুম কলিংবেল বাইজা উঠল। জানলা খুইল্যা দেহি খালা আইছে। দরজা খুইল্যা দিতেই ঘরে ঢুইক্যা কইল ব্যাগ-বস্তাগুইল্যা ঠিক কইরা রাখ। এর মধ্যে খালু আইয়ে পড়লো। ‘এক্ক্ষণ আইছ, কি খাইছ। রাস্তায় কোনো অসুবিধা অয় নাই ত।’ এহাবারে পিরিতে বাছে না। আমারে ধমক দিয়া কয়, ‘এই কি দেখতাছস, লেবুর সরবত নিয়া আয়।’ আমি আট্টাস নাইগে গেলাম গা। কাইল কি ব্যবহার, আইজ কি ব্যবহার।  আজ বাপ-পুলা কেউ ধারেকাছে আহে না। খাবার খাইয়া যার যার মতো ঘরে যায়গা, কিছুই যেন অয় নাই।

কয়দিন যায় আমার শইলডাও ভালা না। মাথা ঘুরায়, বমি বমি ভাব। আমি কাম করতাছি। আমার শইল খালি ঘুরতাছে। খালা আমারে দেইখ্যা কয় – তর কি অইছে, এমন লাগতাছে কে। আমি কই এমনি এমনি। কাম করতে করতে দিলাম বমি কইরা। খালা চিলের মতো আমার টুটি চিপা দইরা কয়, এই তর কি অইছে ক। বমি করস কে। খালু ডাক্তারের কথা কইয়া, এই যে বাইর অইল আর আহে না। খালা সব বুইঝা হালাইল। সেন্ডেল জুতা নাইকর যা পাইল মারতে মারতে আমারে শেষ করল। আমি সহ্য করবার না পাইয়া সব কইয়ে দিলাম। খালুর বড়ি ভাইজানের বেশিয়ার দেহাইলাম। খালা ধপ কইরা বইয়া পড়ল, কোনো চেদবেত নাই। কতহন পর ফ্যানের হঙে ফাঁস টানাবার যায়। আমি ফিরাবার গেলাম, নাত্তি মাইরে আমারে ফালাইয়া দিলো। জানডা যেন বাড়ায়ে যাবার ধরল। আমি এহন কি করি। ফাঁসির কথা হুইনা খালু আইলো। ডাক্তারের কথা কইয়া ঘরেই কইবান চোরের মতো পলাইয়া আছিল। খালুরে না দেইখ্যা খালা জংলি হুয়রের মতো হামলাইয়া পড়লো। হাইরে কিয়ামত লাইগে গেল গা।

তারপর দুইডা দিন যে কেমনে গেল কবার পামু না। সকাল বেলাই দুলাভাইরে দেইখা কলজের মধ্যে পানি আইল। তারে আরেক রুমে নিয়া খালা-খালু কত যে গুজুর গুজুর করল। আমি খালি পাছ থিকা হুনলাম। আমি বলে কৈ থেইকে পেট বাজায়া নিয়া আইছি, ওগরে ফান্দে ফালাইয়া মেলা টেহা আদায় করার জন্য। খালু এইডা খালারে বুঝাইছে। রুম থেইক্যা বাইর হইয়া খালু বিশ হাজার টেহা দিয়া দুলাভাইয়ের আত ধইরা ফালাইল। কইল – টেহা লাগে আরো দিব, তাও এই বিপদ থিকা যেন রক্ষা করে। খালা চেঁচাইয়া উইঠা কয় – কিয়ের টেহা, খানকি মাগিরে জবো কইরা নদীতে ভাসাইয়া দেও। দুলাভাই মুনে অয় বোবা অইয়া গেছে গা। খালি ভিজা ভিজা চোখে আমার মুহি চাইল। আমারে নিয়া বাড়ির মুহি রওনা অইল। রাস্তার মধ্যে দুলাভাই কয়, তুই এইডা কি করছস? অহন অবোডা কি? করমুডা কি? আমি কইলাম, ওরা আমার সর্বনাশ করল। ওগর বিচার কর। ছাইড়া দিও না। দুলাভাই কয়, বড়লোকের কোনো দোষ আছে? দোষ সব আংগরে।

বাড়ি আইতে আইতে আইত অইল। চারদিকে জোম আন্দার। বাড়ির গুরো পারা দিতেই মা, বাবা, মতি ভাইডা যেন পুনা মাছের মতো বুকের মধ্যে খলখলাইয়া উঠল। মুনে অয় জীবনডা ফিরা পাইলাম। আবার নারিকেল গাছের পাতা বাতাসে শনশন করতাছে। কদম গাছের ডালে পেঁচাডা চিক্কর মাইরা উঠলো। নিম পাহিডা খালি কুহাইতাছে। আমার কি যে অব কবার পাই না। মাইয়ারে দেইখ্যা চিক্কর থামাবার পাইলাম না। দুলাভাই মুখ চাইপ্পা ধরল। আমি চিপার মধ্যে যাইয়া ছোট ভাইডারে খামছাইয়া ধইরা কান্দন ধরলাম। ও কিছু না বুইঝাই কান্দন ধরল। বাজান-মায় সব কথা হুইন্যা একবার দাও খোঁজে আবার দড়ি খোঁজে নিজেই মরবো, না দুলাভাইরে মারবো, না আমারে – কি যে করবো বুঝতাছি না। মুনে অয় পাগলা অইয়া গেল গা। টেহার থলিডা দুলাভাইয়ের মুখের মধ্যে ঢেল মারল।

মাথা আছড়াইয়া মরার দশা। জেঠির কথায় থামলো। কইল, কেউ যেন কিছু না জানে। গ্যারামে বাড়ি আমার শইল দেইখ্যাই মানুষ বুইজে ফালাইল। কোনো মুহি যাবার পাই না। আমি আইছি শুইন্যা মতি পাগলের মতো আমার কাছে আইছিল। তারে ফাঁকি দিমু হেই সুযোগ আর নাই। মুনেও চাইল না, তারে সব কথা কইলাম। হে কাইন্দে কাইন্দে আমারে কয়, তাও তরে আমি বিয়া করমু। তর আড্ডি থাকলেই আমার অবো। এই কথা হুইন্যা মতির বাপ-মাও মতিরে খুন করবার যায়। মুন্ডল আইয়ে বাপেরে কইল, তোমার মেয়েরে বাইর কইরে দেও। ওরে মুলুবিরে দিয়া মাটির মধ্যে পুঁইত্যা পাত্তর মাইরা মারণ লাগব। গেরামের মধ্যে বিরাট গণ্ডগোল বাইজ্যা গেল গা। আমার জন্য বাজান, মায়, মতি, হ¹ল আত্মীয়স্বজন বিপদে পইড়া গেলগা। আমি দেখলাম আমার এবেও বাঁচন নাই, ওবাও বাঁচন নাই। মরমুই যহন ওগরে ছাড়মু না। একলাই ঢাহা যামু। ওগর কথা দুনিয়ার মানসেরে জানাইয়া ওই বাড়ির সামনে বিষ খামু।

দুপুর আইত। হ¹লে ঘুমে। আস্তে কইরা বাইরে খাড়াইয়া চারদিক দেখলাম। চান তারা গাছ পাহি সবই ঠিহি আছে। খালি আমার জীবনে কিয়ামত লাইগ্যা গেছে গা।

যে পথে জীবনে কোনো দিন যাই নাই, ওইসব নিরালা পথ দিয়া যাইতে শুরু করলাম। বানের জলের নাহাল চোখ দিয়ে পানি ঝরতাছে। মুছতে মুছতে  ইস্টিশনে আইলাম। ইজ্জতের কোনো ডর-ভয় নাই। জানেরও ভয় নাই। ইস্টিশনের এক চিপার মধ্যে বইলাম। যমুনা ট্রেন ধরমু। আমারে একলা দেইখা ইস্টিশনে বখাইটা ছেড়াগুইল্যা হাসে আর পাওরুটি কামুর দিয়া হাদে। ভালা ভালা যাত্রীগুল্যাও আমার আগাপাছা দেহে। আমার কাছে মুনে অয় আল্ল­াহর দুইন্যায় কোনো ভালা মানুষ নাই। এই দুইন্যা চলে ক্যামনে?

এমন সময় মায়ের বয়সের এক বেটি আমার কাছে আইল। মেলা কথা কইল। তার কথা আমার ভালা লাগল। তারে আপন মনে অইল। আমার সব কথা হুইন্যা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। ম্যালা কথার পর আমার বিষ খাওয়ার কথা হুইনা কয়, দুনিয়া থুইয়্যা মরবি ক্যা? নিজে নিজে মরা ত আরো বেশি পাপ। চল, আমার সাথে, আমি তোর সব দায়িত্ব নিমু। অতল দরিয়ার মধ্যে মুনে অয় কলাগাছের ভেলা পাইলাম। তার বাসায় নিয়া দুইদিনের মধ্যে আমার পেট খালাস করল। কয়দিন পর আমারে নিয়া গেল টানবাজার। কইতরের খুপির নেহাল ছোট ছোট ঘর। হরেকরকমের মানুষ আইতাছে যাইতাছে। এহাকটা ঘর থিকা  জুড়া জুড়া মানুষ কি যে আমুদ করতাছে। কি তার শব্দ যেন বাক বাকুম ডাক উঠতাছে। এইডা আরেক দুইন্যা। আমি সবই বুঝলাম। পয়লা পয়লা কয়দিন খারাপ লাগল পরে সব সইয়া গেলগা। টানবাজার, টাঙ্গাইল – পরে এইখানে। কত মানুষ আইল গেল। কত কথা। পয়লা পয়লা মুনে অয় সব দিয়া দিব। কামশেষে পানের পিকের নাহাল পচা অইয়া যায়গা। টেহা দিয়া  হরবার জন্য অস্থির হইয়া পড়ে। অসুখে শইল পুইড়া গেলেও কিছুই যায় আহে না অগর। নজর কেবল শরীলের দিহি।

মতির কথা কি কমু। ভূমিকম্পের মতো যে কোনো সুম মুনডা কাঁপাইয়া তুলে। ওর চাউনিডা এহনও সাদা কইতরের নাহাল মনের মধ্যে উড়াল পাড়ে। খালি মুনে অয় আমার হঙ্গে দেহা অবো। আমার মুহি অবা কইরা চাবো। আমি হাঁস নিয়া যামু, ও পাছে পাছে আবো। আবার নিজেই নিজের মাথার মধ্যে চড় মারি। আমার মতো পাপি লোকের কাছে ও আবো ক্যা?’

কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল হরিবালা। কান্নার স্বরে চেঁচিয়ে উঠল – ‘আমি হরিবালা, আমি হরিবালা, আমি কেন জরিনার স্বপন দেহি।’

আর কোনো কথাই বলে না হরিবালা। ভিতরের দিকে চলে যায়। হরিবালার সঙ্গে কথা বলার জন্য

টাকার যে কন্ট্রাক্ট ছিল তাও হরিবালা নেয়নি।

ভদ্রলোকটি চাতক পাখির মতো খুঁজেও আর পেল না হরিবালাকে। তার মনেও শুরু হয়েছে হরিবালার প্রেতনৃত্য। মনের অজান্তেই বের হয়ে আসছে – নিয়তির চাকায় মানুষ ঘুরছে, না মানুষই নিয়ন্ত্রণ করছে নিয়তির চাকা, বলা কঠিন।