রূপকথার গল্প

আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মোজাম্মেল। বড় করে একটা শ্বাসও টানলেন। শরীরটা এখন পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে আছে।

হবে না? এতো টেনশনের পরে এতো বড় একটা সাফল্য! যা কি না মানুষের কল্পনারও অতীত, তেমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে একশতে একশ পাওয়ার যে সাফল্য, তার আনন্দ কি কম? নিন্দুক, সমালোচক, খুঁত খুঁজে বেড়ানো মানুষ, যারা নিজেদের বড় সমাজপতি বলে দাবি করে, অথচ সমাজ সংস্কারের ভাবনাকে পাগলামি বলে গা বাঁচিয়ে চলে, সেইসব হাতুড়ে সমাজপতির নাকে ঝামা ঘষে দিতে পারার আনন্দ কি কম? সেই আনন্দে এখন মোজাম্মেলের যেন পাখনা গজিয়েছে। তার শরীর এখন শুধুই পাখির পালক। কিন্তু ওড়ার বদলে স্কুলের মাঠের সবুজ ঘাসে শরীর গড়িয়ে দিলেন মোজাম্মেল। সন্ধের অন্ধকার মাঠ থেকে অনতিদূরের উচ্ছ্বসিত লোকজনের কোলাহল কানে আসছে। সবাই মোজাম্মেলকে খুঁজছে। সবই কানে আসছে তার। কিন্তু আলো আর অন্ধকারের লুকোচুরি খেলাটা এই মুহূর্তে বেশ লাগছে তার। আলোয় থাকলে আঁধারে থাকা লোকজন আর চোখে পড়ে না। তবে অন্ধকার থেকে আলোয় চলাফেরা সবই নজরে পড়ে। কিন্তু মোজাম্মেল আজ যে সুপার এক্সপেরিমেন্টে সফল হলেন, তা কিন্তু আলোয় দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। হ্যাঁ, সেই অসম্ভব দুরূহ একটা কাজই কিন্তু আজ করে দেখালেন মোজাম্মেল হক।

আগামীকাল পুরভোটের রেজাল্ট বেরোবে। ঠিক তার আগের দিন সন্ধ্যায় সত্যিই একটা দুর্ধর্ষ কাণ্ড করে দেখালেন হেডমাস্টার মোজাম্মেল হক। সবাই বোকা ও বোবা বনে গেল। প্রশংসার তুমুল ঝড় উঠল। চমকে উঠে ঘটনার ঘোর কাটিয়ে সবাই সমস্বরে বলল, ‘চমৎকার, সত্যিই একটা অসাধারণ ও অভিনব ব্যাপার হলো।’ কেউ বলল, ‘সত্যিই একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত বটে। সত্যিই তো এভাবে তো কেউ ভেবে দেখেনি! এমন একটা কাণ্ড তো করাই যেতে পারে।’ কেউ বলল, ‘এবার যদি মানুষের হুঁশ ফেরে।’ আবার কেউ বলল, ‘আরে মশাই, এরকম একটা সুন্দর ভাবনা যে কারো মাথায় আসতে পারে, সেটা ভেবেই তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।’

অধ্যাপক মনসুর হুসেন অধ্যাপক সত্যসুন্দর সর্বজ্ঞকে বলছেন, ‘সত্যি সত্যিই এমন একটা দুঃসাহসিক ভাবনা ভাবার জন্য বুকের পাটা থাকা দরকার। এলিতেলি তো কোন ছাড়, চিন্তাবিদদেরও ভাবার সাহসে কুলোত না।’

ভাবনাটা শুধু হেডমাস্টার মোজাম্মেল হকের মস্তিষ্কে চুপচাপ সেঁধিয়ে গিয়েছিল। তার অবাক মনের প্রশ্ন হলো, রাজনীতির মন্ত্র কেন করে খাওয়া হবে? করে দেখাও কেন হবে না? এই প্রশ্নটা তুলে ধরে একে একে সবাইকে পাখিপড়া পড়িয়েছেন মোজাম্মেল। সেজন্য কদিন ধরে ছোটাছুটি, যাকে বলে দৌড়ঝাঁপ, কম হয়নি। পঁচিশ বছর ধরে এই আধা-গাঁ, আধা-শহরের সবচেয়ে বড় আর নামী স্কুলের হেডমাস্টার তিনি। নিজের জম্মোকম্মো সংসারধম্মো সবই এই সোঁদরবাদিয়ায়। সেই সুবাদে সবাই তাকে চেনে, জানে। তার ওপরে বিদ্যাভারতীর মতো বড় ও নামী স্কুলের হেডস্যার বলে এই তামাম এলাকার যত হোমড়া-চোমরা, তালেবর, মাতব্বর, গুণ্ডা, গোঁয়ারগোবিন্দ সবাই তাঁকে সমঝে চলে। সমীহ করে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘বলুন স্যার’, ‘নিশ্চয়ই স্যার’, ‘অবশ্যই স্যার’, ‘এ তো খুবই শুভ উদ্যোগ স্যার’ বলে সায় দিয়েছে। একবাক্যে সবাই একপায়ে খাড়া হয়েছে। সবাই থাকবে কথাও দিয়েছে। হেডমাস্টার মোজাম্মেল শুধু বলেছেন,  ‘মনে রাখবে তোমরা আমার ডাকে আসছ। এতদিন তোমাদের পড়িয়ে মানুষ করেছি। তার পরিচয়টুকু তোমরা দেবে। মনে করবে তোমরা তোমাদের স্যারকে প্রতিদান দিলে।’ স্কুলের কজন ঘাড়ত্যাড়া গোছের মাস্টার আড়ালে ঢাক ঢাক গুড় গুড় করেছেন। সামনে কিছু বলার সাহস হয়নি। হবেও না। সবই কানে এসেছে মোজাম্মেলের। আমল দেননি। মাথা ঠান্ডা রেখে এইসব উজবুকের মোকাবিলা করার জন্যেও কিছু শিক্ষার দরকার হয়। আর তাছাড়া সত্যিকারের সমাজকল্যাণের কাজে নেমে বিরোধিতার হ্যাপা পোহাতে হবে না? বাস্তুঘুঘুরা কি এমনি ছেড়ে দেবে? স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অতো বড় ছবিটা মাথার ওপর বাঁধিয়ে রাখার তো কোনো মানেই হয় না তাহলে।

এবার আর অন্ধকারের আড়ালে থাকতে পারলেন না মোজাম্মেল। তার গিন্নি তাঁকেই খুঁজছেন। মাঠের ঘাসমাটিতে কনুই ঠেকিয়ে বাঁ-হাতের তালুতে

মাথাটাকে ছেড়ে রেখেছিলেন। বেশ আয়েশ লাগছিল। কিন্তু ফাতিমা তাঁকে খুঁজছেন। মোজাম্মেল তাই তড়িঘড়ি উঠে জোর পায়ে হেঁটে আলোয় চলে এলেন। মোজাম্মেলকে দেখেই আবার ভিড় ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর দিকে। আসবেই তো, আজকের নায়ক তিনি। সব আলো তো আজ তাঁকে ছুঁয়েই ধন্য হতে চাইবে। তবে এই আলো এই মুহূর্তে ভালো লাগছিল না মোজাম্মেলের। অনুষ্ঠান শেষ করে মঞ্চ থেকে নামতেই মিডিয়া ছেঁকে ধরেছিল। এড়াতে পারেননি তিনি। তবে নিজের কৃতিত্ব নিয়ে নিজেরই মুখর হওয়া তাঁকে মানায় না। তিনি রাজনীতির লোক নন। তাই মিডিয়ার হাজার প্রশ্নকে তিনি খুবই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। বন্ধুদের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছেন। বন্ধুরা তো বুমের সামনে আসার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। তাঁরা হইহই প্রশংসার বান ডাকলেন মোজাম্মেলের নামে। তখনই পায়ে পায়ে সবার চোখের আড়ালে অন্ধকার মাঠে নেমে গেছেন তিনি। ফাতিমা খুঁজছেন দেখে ফের আলোয় ফিরলেন তিনি। ফাতিমা তাঁকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘কোথায় ছিলে তুমি? শিগগির এদিকে এসো, আমার বন্ধুরা তোমায় কংগ্র্যাচুলেট করবে বলে অপেক্ষা করছে।’ মোজাম্মেলের হাত ধরে একরকম টেনেই নিয়ে গেলেন ফাতিমা। স্বামীর কৃতিত্বে গরবিনী তিনি।

মোজাম্মেলের মনে পড়ে সেই সকালের ছবিটা।

সমরেন্দ্রবাবু এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। ভাবখানা সাতে-পাঁচে নেই। যেন পৃথিবী রসাতলে যাবে – চোখে-মুখে তেমনই অন্ধকার নিয়ে বললেন, ‘ওই ওরা সব বলছিল। মানে বলাবলি করছিল।’ এইসব বলাবলি করা বাস্তুঘুঘুদের দেখে দেখে চোখ হেজে গেছে মোজাম্মেলের। তবু চশমাকে খানিক নাকে টেনে নামিয়ে ফ্রেমের ওপর দিয়ে নজর নিক্ষেপ করলেন তিনি। মনে ঘোট থাকলে মোজাম্মেলের চোখে চোখ রাখা সম্ভব নয়। এমনই দৃপ্ত চাউনি তাঁর। তাই চকিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে ভূগোলের শিক্ষক সমরেন্দ্র সহসা কথা খুঁজে পেলেন না। মোজাম্মেল খুবই নির্লিপ্ত স্বরে বললেন, ‘থাক, আমি জানি, কারা কী বলাবলি করছিল।’ সমরেন্দ্র বললেন, ‘না মানে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত যদি হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো স্কুলেরও বদনাম হবে। এই সবই হলো গিয়ে নানা মুনির নানা মত। না না এসব আমার কথা না।’ শুনে মোজাম্মেলের চোখ-চিবুক শক্ত হলো। খুবই ধীর-শান্ত গলায় তিনি বললেন,  ‘সে নিয়ে আপনাদের দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। নেহাতই যদি তেমন লোকলজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমি আপনাদের হেডমাস্টারিতে রেজিগনেশন দেব। বাড়ি বেচে দিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাব। আমার পরিণতি ভেবে আপনারা রাতের ঘুম নষ্ট করবেন না। বসুন, আপনার জন্য চায়ের কথা বলে আসি।’

‘না না, এই অসময়ে চা নয়। আমি আসছি, আমি আসছি’ – বলে একরকম পালিয়ে বেঁচেছেন সমরেন্দ্র। মোজাম্মেল কব্জি ঘুরিয়ে দেখলেন, সবে সাড়ে এগারোটা। স্কুলছুটির দিন। অনায়াসে আরো এক কাপ চায়ের আবদার করা যায়। চা খেতে খেতে মোজাম্মেল ভাবলেন, এই যুদ্ধে তাঁকে জয়ী হতেই হবে। ফাতিমা চা দিতে এসে খানিক পাখার নিচে সোফায় বসলেন। আঁচল টেনে মুখ ও গলার ঘাম মুছে নিতে নিতে বললেন, ‘উনি চা না খেয়ে চলে গেলেন? আমি ওনার জন্যেও তো জল চাপিয়েছিলাম।’ মোজাম্মেল রঙ্গ করে বললেন, ‘উনি চলে যাননি। বলতে পারো পালিয়ে বেঁচেছেন। টিকটিকি হয়ে আমাকে বাজিয়ে দেখতে এসেছিলেন।’ ফাতিমা বললেন, ‘কী জানি বাপু! তোমার ঘাড়ে যে কী ভূত চাপল।’

‘শোনো ফাতিমা, মানুষের মঙ্গল চাওয়ার ভূত যাদের ঘাড়ে চাপে, তারা খুবই সাংঘাতিক লোক। চিরকালই আমি সেই সাংঘাতিক লোক। বলতে পারো এ আমার এক ধরনের এক্সপেরিমেন্টের নেশা। আমার তো জীবনে এই একটাই নেশা। অন্যেরা যা ভাবতেও পারবে না, আমি তা ভাবব এবং করেও দেখাব। তুমি তো আমাকে চেনো। দেখছো এতোদিন ধরে, তুমিই বলো না, মানুষ যে আমার কাজে এতো ধন্য ধন্য করে, সে কি এমনি করে? আর স্কুলের মতিয়ার, সমরেন্দ্ররা যে জ্বলে-পুড়ে মরে, সে কি এমনি জ্বলে? ঈর্ষায় কাতর হয়ে ওরা শুধু শিখেছে, পাকা ধানে মই দিতে। তুমি বলতে পারো এ আমার এক ধরনের জুয়া খেলা। আর এই জুয়ার নেশাও বড় মারাত্মক। তাছাড়া এখন তো আর ভেবে লাভ নেই। পাশার চাল তো চেলে দিয়েছি। এখন দেখো না কী হয়।’

শুধু ফাতিমা বিবি নন, গোটা শহর দেখল, হেডমাস্টার মোজাম্মেল হক কী করতে পারেন। ব্যাপারটা অনুধাবন করে সবাই হতবাক হয়ে গেল। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই শুরু হলো মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। মোজাম্মেলের নামে যারা একগাল ভাত বেশি খায়, তারাও আমন্ত্রিত ছিল। তারা অবশ্য স্রেফ রঙ্গ দেখতে এসেছিল। ভেবেছিল, চরম হাস্যকর কিছু একটা হবে। বাংলায় যাকে বলে কেলেঙ্কারি। কিন্তু, তারা যে এভাবে সপাটে গালে চড় খেয়ে যাবে, তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। চা-সহকারে অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতেও প্রণবেন্দুবাবু আর মতিয়ারবাবু সারাক্ষণ ফিসফিস করে গেলেন। মুখ টিপে টিপে হাসলেন। সেই হাসির বিজ্ঞাপনের নিঃশব্দ ভাষা হলো, ‘দেখুন না মশাই কেলোটা কেমন হয়।’

কেলো শব্দটা মোজাম্মেলের মাথায় এলো, কারণ, শুভঙ্কর ধরেছিল মাছের বাজারে। বলল, ‘তুই হঠাৎ এসব নিয়ে ক্ষেপে গেলি কেন? আমি তো শুনে অবাক। তুই তো শেষ পর্যন্ত একটা কেলো করে ছাড়বি দেখছি।’ মোজাম্মেলের বাল্যবন্ধু শুভঙ্কর পুলিশের এসআই। ওর মুখের ভাষার কোনো ছিরিছাঁদ নেই। শুভঙ্কর বলল, ‘মাইকও বাজাবি? থানায় গিয়েছিলি পুলিশ পারমিশনের জন্য। সে পারমিশন পেয়ে যাবি। কিন্তু সাড়া পাবি কি? পাবলিক যে কী খতরনাক জিনিস একবার ঘা খেলে বুঝতে পারবি। থানা তো আর তোর এসব প্ল্যানের কথা জানে না। অ্যাপ্লিকেশনে তুই তো ঝেড়ে কাশিসনি। নূর আমাকে বলল তোর এইসব আজগুবি প্ল্যানের কথা।’ মোজাম্মেল বললেন, ‘কত আজগুবি ব্যাপারই তো হচ্ছে চারদিকে। আরো একটা নয় হলো।’

‘দেখ, মোজাম্মেল, হেডমাস্টার হওয়ার মুশকিলটা কী জানিস? তোরা ভাবিস, গোটা পৃথিবীটা একটা ক্লাসরুম।’

‘ঠিক বলেছিস, আমিও তাই ভাবি। আর ভাবি বলেই একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই।’

‘তোর সেই ভাবের ভেলায় ভেসে বেড়ানোটা আর গেল না। দিবাস্বপ্ন! বুঝলি? স্রেফ দিবাস্বপ্ন। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলতে হবে আকাশকুসুম স্বপ্ন। যাকগে, সেদিন তোর ওখানেই ডিউটি নেব আমি। পুলিশ প্রটেকশন পাবি। কী মাছ নিলি? আচ্ছা চলি থানায় তাড়া আছে। ভোটটা তো ভালোয় ভালোয় গেল। পরশু রেজাল্ট। আর কালই তো তোর যাকে বলে সেই মহান এক্সপেরিমেন্টের দিন।’

শুভঙ্করের এই মহান এক্সপেরিমেন্ট কথাটায় একটা নামমাত্র কাঁটার খোঁচা খেলেন মোজাম্মেল। ভাবলেন, হারামজাদা সারাদিন চোর, জোচ্চর, বাটপার, তোলাবাজদের সঙ্গে সংগত করে করে টিপিক্যাল দারোগা হয়ে গেছে। সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাক, তারপর একদিন সুযোগ বুঝে শুভঙ্করের ক্লাস নেবেন। বলবেন, পুলিশও এখন অনেক মানবিক মুখ দেখাচ্ছে রে। আমার বউয়ের ভাই, শুনে রাখ, ওই উর্দিটায় অনেক কিছু করে দেখানোর সুযোগ আছে রে। ভাবলেন, একদিন এসব শুভঙ্করকে শুনিয়েই ছাড়বেন।

কিন্তু শুভঙ্করের ওই আকাশকুসুম স্বপ্ন কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। কথাটা খুবই ধারালো করাতের মতো মগজের কোথায় যেন চেরাইয়ের অনাদি শব্দ তুলেই চলেছে। তাতে ভেতরে ভেতরে মোজাম্মেল যেন একটু দমে যাচ্ছিলেন। কী জানি এ কি সত্যিই আকাশকুসুম ভাবনা? তখনই মোবাইল ফোনের রিংটোন সম্বিত ফেরালো তাঁর। দিগবেড়িয়ার তাপসের ফোন। মোজাম্মেলের কণ্ঠস্বরেও যেন কুয়াশা জড়িয়ে গেছে। শুনে তাপস বললেন, ‘কীরে শরীর খারাপ নাকি?’ মোজাম্মেল গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আরে নারে না না, বল বল।’

‘পরশু ভোটের রেজাল্ট। কালই তো তোর প্রোগ্রাম। শোন, আমরা গুস্তিয়া স্কুলের সবাই যাচ্ছি দলবেঁধে। দারুণ একটা ব্যাপার হবে।’ শুনে এক লহমায় নিকেশ হওয়া খানিকটা অবুঝ দম যেন ফিরে পেলেন মোজাম্মেল।

সত্যিই দারুণ ব্যাপারই হলো। এই অভিনব ভাবনার আমিও একজন শরিক, তা বোঝানোর চেষ্টায় শেষতক হুড়োহুড়ি লেগে গেল। এ ওর সঙ্গে, সে তার সঙ্গে সেলফি তোলার হিড়িক কাকে বলে দেখে যা।

মোজাম্মেলের মগজে ভাবনাটা এমনি আসেনি। আসলে এবার পুরভোটের সময়টাও পড়েছে বেশ জব্বর সময়ে। ফাল্গুন মাস। যাকে বলে নববসন্ত। ভেবেই তার মগজে খেলে গেল ভাবনাটা। খেলেছে তার কারণও আছে। মোজাম্মেলের কথা হলো, ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই মানুষের মনে ভয়, শঙ্কা এসে বাসা বাঁধতে শুরু করে। কেন তা হবে? এই ভোটকে যখন এড়ানোই যায় না। ঈদ আর দুর্গোৎসবের মতো ভোটও যখন ফিরে ফিরে আসে, তখন ভোটকেও উৎসবের আনন্দে মাতিয়ে তোলা যাবে না কেন?

ভোট নিয়ে মোজাম্মেলের অভিজ্ঞতা খুবই মর্মান্তিক। যাকে বলে দুঃস্বপ্নের মতো। একদল জিতলে অন্যদলের ছেলেরা ঘরছাড়া। ছেলেবেলা থেকে ভয়ংকর ছবি দেখে আসছেন মোজাম্মেল। সেই একই ছবি, একই চিত্রনাট্য। তার কোনো রকমফের বলে কিছু নেই। এ-বছর লাল পার্টি জিতল তো সবুজ পার্টি ঘরছাড়া, সবুজ পার্টি জিতলে পাড়াছাড়া লাল পার্টি। মারদাঙ্গা, বাড়ি, পার্টি অফিস ভাঙচুর লেগেই আছে। যুগ-যুগান্ত ধরে এই পাপ আর অনাচার মেনে নেওয়া যায় না। মানুষই তো মানুষের শেষ আশ্রয়। মানুষকে আখেরে ফিরতেই হবে মানুষের কাছে। এমন লেকচার তো ঝাড়ার লোকের অভাব নেই। এই অন্ধকার থেকে বেরোনোর পথ কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। সেই পথ দেখাতেই মোজাম্মেল আবার পথে নেমেছিলেন। এই বাহান্ন বছর বয়সের জীবনে তিনি শেষতক একটা কথাই বুঝেছেন, তা হলো, বেশির ভাগ মানুষই শান্তি চায়।

কড়গোনা কয়েকজন ফিকিরবাজ ভালোমানুষি দেখিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভুলের জালে জড়িয়ে নেয়। তা দেখে যারা বলে, দেশটা গোল্লায় গিয়ে খাবি খাচ্ছে, মোজাম্মেল বারবার তাদেরই মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন। যেমন দিলেন আজ। ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর পরে কী হবে, কী হবে, এই ভয়-ভাবনার মোড়টাকেই ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছেন মোজাম্মেল। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর সেই পরীক্ষাতে সসম্মানেই উত্তীর্ণও হলেন তিনি। প্রচারের জন্য তো এসব করেননি। কিন্তু এখন মিডিয়ার যুগ। কোত্থেকে কানাঘুষো হতে হতে পৌঁছে গেছে মিডিয়ার কানেও। ওবি ভ্যান আর বুম নিয়ে এসে হাজির বড় বড় মিডিয়া হাউজ। দেখেশুনে মতিয়ারদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের শেষে মিডিয়াকে বাইট দিতে এগিয়ে গেলেন অনেকেই। সবার মুখেই হেডস্যার মোজাম্মেলের ভূয়সী প্রশংসা ঝরে পড়ছে। পুলিশ প্রটেকশন দিতে এসে এসআই শুভঙ্করের মুখের সামনেও বুম ধরা হলো। তিনি তাঁর বাল্যবন্ধুর প্রশংসার বান ডাকিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের চোখে এটা দিবাস্বপ্নের মতোই।’ মোজাম্মেল লক্ষ করলেন বুমের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মতিয়ারই বলছেন, ‘উনি শুধু আমাদের স্কুলের গর্ব নন, আমাদের এই সোঁদরবাদিয়া তথা গোটা বাংলার গর্ব।’

দূর থেকে মোটরগাড়ির হেডলাইটের জোরালো আলো দেখা গেল। মোজাম্মেল অবাক হলেন, এই রাস্তায় গাড়ি! একটা নয়। মোটরগাড়ির পেছনে একটা জিপ। পুলিশের জিপ। কী ব্যাপার? গাড়ি থেকে নামলেন স্বয়ং ডিএম সাহেব। তাঁর দেহরক্ষী আগে নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। পেছনের জিপ থেকে প্রায় লাফিয়ে নামলেন ওসি। সঙ্গে রীতিমতো ফোর্স। সবাই ভিড় করে ছুটে গেল সেদিকে। হইহই রব উঠল, ‘ডিএম সাহেব এসচেন, ডিএম এসচেন।’ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মোজাম্মেল। ডিএম ফারুক আহমেদ হেঁটে তার দিকেই এগিয়ে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত মোজাম্মেলের হাত দু-হাতে টেনে নিলেন ডিএম ফারুক সাহেব। তারপর করমর্দন করে বললেন, ‘আই মাস্ট কন্গ্র্যাচুলেট ইউ। আপনি তো মশাই মিরাকল করলেন। এ আপনি করেছেন কী? টিভিতে নিউজ স্ক্রলে সোঁদরবাদিয়া আর সোঁদরবাদিয়া। আপনি এতো বড় একটা কাণ্ড করলেন যে অনুষ্ঠান শেষ হতেই সরাসরি টিভিতে টেলিকাস্ট … অথচ আপনি আমাকে জানালেন না?’ ডিএম ফারুক সাহেবের কণ্ঠস্বরে মৃদু অভিমান আঁচ করেই মোজাম্মেল বললেন, ‘আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। এভাবে সাড়া পাব, আমি কল্পনাও করিনি। আপনি বিশ্বাস করুন। আমি ভেবেই রেখেছিলাম গোটা ব্যাপারটাই আখেরে ভেস্তে যাবে। লোক হাসানো ব্যাপার হলে আমি কোন মুখে আপনার সামনে দাঁড়াতাম, আপনিই বলুন।’

‘না না তা নয়, আসলে আমার ওপরে চাপ আসবে ওপর থেকে। ওপরওয়ালা বলবে, এতো বড় একটা ব্যাপার হলো, আর আপনি জানতেন না? এতে তো ডিস্ট্রিক্টে আমার ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ধামাকা টিভি থেকে ফোন করেছিল। ওরা আপনাকে লাইভ স্ক্রিনে চাইছে।’

‘না না আমি এতো আড়ম্বর চাই না। নিজস্ব ভাবনা নিয়ে নিজেই ঢাক পেটাব? এ অসম্ভব।’ মোজাম্মেলের এই কথায় ডিএম যেন বাঁচার রাস্তা খুঁজে পেলেন। তিনি চোখের ইশারায় বডিগার্ডকে ভিড় পাতলা করার হুকুম দিলেন। নিমেষে লোকজন দূরে সরে গেল। এবার ডিএম ফারুক ফিকিরবাজের মতো হাসলেন। বললেন, ‘আপনার নিজস্ব ভাবনা বলতে আপত্তি থাকলে আপনি বলবেন ডিএম ফারুক আহমেদের পরামর্শেই আপনি এই এমন সুন্দর একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন।’ মোজাম্মেল অবাক চোখে ডিএম ফারুকের চোখে তাকালেন। কী বলবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। মোজাম্মেলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডিএম ফারুক বললেন, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না। তা না হলে আমার সার্ভিস রেকর্ডে একটা ব্ল্যাক স্পট থেকে যাবে। আফটার অল আপনি আমার একজন ওয়েল উইশার। কাল তো সব খবরের কাগজের রিপোর্টাররা হামলে পড়বে। ব্যাপারটা তাহলে আমাকেই ফেস করতে দিন। অল রাইট। মেনি থ্যাঙ্কস। গিন্নিকে নিয়ে একদিন আসুন না আমার বাংলোয়। ভালো লাগবে।’ ডিএম ফারুক আহমেদ হাত নেড়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। ধুলো উড়িয়ে অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি আর জিপের জোরালো হেডলাইট ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সেই ইস্তক বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মোজাম্মেল। ফাতিমা এসে নাড়া দিতে যেন সম্বিত ফিরে পেলেন তিনি। ফাতিমা বললেন, ‘উনি নাকি ডিএম সাহেব? তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন নাকি? বাব্বা! তুমি তো তাহলে সত্যিই এখন ভিআইপির দলে। হবেই বা না কেন? যা কাণ্ড ঘটালে তুমি, সবাই তো একেবারে জাস্ট স্পেলবাউন্ড।’

মোজাম্মেল তখনো ডিএম ফারুকের প্রচারলোভী মুখটা থেকে নজর ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। মোজাম্মেল ভাবছিলেন, তিনি তো একটা মিলনমেলারই আয়োজন করেছেন শুধু। সেই মিলনমেলার সাফল্য নিয়ে শোরগোল তো পড়েছেই। কৃতিত্ব জাহির করতে আকচাআকচিও শুরু হয়ে গেছে।

স্কুলের মাঠে খোলা আকাশের নিচে নামে মাত্র একটা স্টেজ বাঁধা হয়েছে। স্টেজে রবীন্দ্রনাথের একটা বড় ছবি ফুল-মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। মোজাম্মেলের স্কুলের ছেলেমেয়েরাই মঞ্চটাকে সাজিয়েছে। বসন্তের গান বাজছে মাইকে। মোজাম্মেল তাঁর ছোট্ট ভাষণে বললেন, ‘স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আমার প্রেরণা। আমি কবিগুরুর কাছে কৃতজ্ঞ। কবিগুরুর একটি গানই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। ভোটে জেতার পর তো আমরা যে যার নিজের দলের রঙের আবীর মাখি। কিন্তু আমাদের মধ্যে রাজনীতি আলাদা আলাদা হলেও আমাদের সমাজ তো একটাই। তাই আগামীকাল ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগে আজ আসুন আমরা পরস্পরের আবীরের রং বিনিময় করি। সবার রঙে রং মিশিয়ে দিয়ে কবিগুরুর গানকে সার্থক করে তুলি।’ সঙ্গে সঙ্গে মাইকে রবীন্দ্রনাথের গান বেজে উঠল, ‘আজি সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’ সোঁদরবাদিয়ার ৩০টি ওয়ার্ডের সব দলের প্রার্থী, নেতা ও সমর্থকরা ভিড় করে এসেছেন। তাঁরা হাসিমুখে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। আবীর মাখালেন। রূপকথার গল্পের মতোই একাকার হয়ে গেল লাল, সবুজ আর কমলা আবীর। কে যে কোন দলের, তা আলাদা করে আর চেনার উপায় রইল না।