পদ্মাপুরাণ

ফেসবুকে পোস্টটা দেখার পর থেকেই বিন্তি ভাবছে ঢাকার কথা। নিউইয়র্কে অনেকদিন থেকে আছে। ঢাকা যাবে দুই মাস পরে। ওর স্বামী বারো বছর নেই। মারা গেছেন। তারায় তারায় সে-মুখ কোথায় যে লুকিয়ে আছে কে জানে। আগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তারা দেখার অভ্যাস ছিল। এখন নেই। পোস্টটা দিয়েছিল হাশিম। পদ্মা ব্রিজের পোস্ট। ‘বাংলাদেশের একটি স্বপ্ন পূরণ’। হাশিম ওর সঙ্গে পড়তো। হাশিম এখনো ফেসবুক করে? ঘটনাটা বেশ মজার। ও নিচে লিখেছিল – ‘ঢাকায় আসছি। পদ্মা ব্রিজ দেখতে যাব। আমাকে নিয়ে যাবে তো?’ সুন্দর উত্তর – ‘ইট উড বি মাই প্লেজার বিন্তি।’ ক্লাসে সে ছিল বেশ সপ্রতিভ একজন। বিন্তির বেশ মনে আছে হাশিমের কথা। মনে থাকার কারণ সহজে মেয়েদের সঙ্গে মেশার মতো কোনো গুণ হয়তো ছিল। কতদিন আগের

কথা। আয়নায় দাঁড়ালে প্রতিবিম্বে এখন আর মাকে দেখে না বিন্তি। আগে নিজেকে দেখতো। তারপর মাকে। এখন? নানি বা দাদি হবে কেউ। অবসরের জীবন। কলেজে পড়াতো। এখন অবসর। এরপর মেসেঞ্জারে আর একটা মেসেজ। ‘ঢাকায় এলে আমাকে ফোন করবে’ – এরপর একটা ফোন নম্বর।

বিন্তি ভাবছে, আবিদ যেসব ব্রিজের কথা বলতো যেমন কান্টিলিভার, সাসপেনশন, আর্চ ব্রিজ, ট্রাস ব্রিজের ভেতরে পদ্মা ব্রিজ কোনটা? গুগল করে জানতে পারে, এই ব্রিজটাকে বলে  ‘মাল্টিপারপাস ব্রিজ। যেখানে থাকে রেললাইনও।’ আবিদ তারাদের দেশে চলে না গেলে পুরো ইতিহাস বলে দিত। মাল্টিপারপাস? মানে রেলগাড়িও যেতে পারবে আরো কত কী। তবে গরুর গাড়ি নয়। গরুও নয়। বিন্তির খালা থাকে ফরিদপুরে। ঢাকা গেলে ব্রিজটা পার হয়ে খালার বাড়ি আলিপুরে যাবে। ‘নিরিবিলি’ নামের বাড়িটা। কি অপূর্ব দেখতে। গাছে গাছে টসটসে পেয়ারা। ছাদ থেকে পাড়া যায়। সেদিন ও ফোন পেল রুবিনার। বলছে – ‘দেখলে তো বাংলাদেশ নিজেদের টাকায় কি কাণ্ড করলো! আট বছর ধরে একটু একটু করে ব্রিজ বানিয়ে ফেললো। অনেক বড়। এই পৃথিবীর একশ বাইশতম লম্বা ব্রিজ।’

‘একশ বাইশতম?’ বিন্তি প্রশ্ন করে।

‘প্রথম বড় তিনটে চায়নাতে। এরপর এখানে-সেখানে। গুগল করলে তুমি পুরো লিস্টিটা পেয়ে যাবে। আমাদেরটা দশ কিলোমিটারের চাইতে একটু বড়। মানে সব মিলিয়ে।’ রুবিনা কথা বলতে ভালোবাসে। বিন্তি দেখলো ও ফোন রাখতেই চায় না। ব্রিজ-নদী করতে করতে প্রায় বিশ মিনিট চলে যায়।

‘এইরকম খরস্রোতা নদীর ওপর ব্রিজ বানানো মোটেই সহজ কাজ নয়।’

‘মোটেই না।’ রুবিনা বলে। তারপর একসময় ওদের কথা ব্রিজ থেকে সিনেমা। সেই যে সিনোমটা ব্রিজ অন দ্য রিভার   কোওয়াই সেই গল্পটা। পিয়ের বুলের লেখা বই। সেটা সিনেমা করেছিলেন ডেভিড লিন। দারুণ সিনেমা। আর সিনেমা থেকে বই। বলে – ‘ডাক্তার জিভাগোও ডেভিড লিনের ছবি। তিনি খুব ভালো ভালো ছবি করতেন।’

‘বাবা! ওর সেই সিনেমা লরেন্স অফ আরাবিয়া। দারুণ।’

‘কবে যাবে ঢাকা?’ প্রশ্ন করে রবিনা।

‘দুই মাস পরে।’

‘এবার কি তোমার কোনো বই বের হবে বিন্তি?’

‘হতে পারে।’

বিন্তি মাঝে মাঝে বই ছাপায়। গল্প, কবিতা, দুটো-একটা উপন্যাস। কতগুলি নিজের গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করে একটি ইংরেজি বইও করেছে বিন্তি। ওর ভালো একটা নাম আছে। তবে বিন্তি নামেই পরিচিত।

খরস্রোতা পদ্মার কথা মনে পড়ছে। হিমালয় থেকে নেমে এসেছে সে-নদী। গঙ্গা থেকে একসময় পদ্মা হয়ে গেছে। গঙ্গার নাম কি একসময় ভাগীরথী ছিল? হবে হয়তো। একসময় সে তার যাত্রা শেষ করেছে বঙ্গোপসাগরে। এসে মিশেছে আরো নানা নদী। কি যেন সেই বইটা? নদী ও নারী। কেন নদীর সঙ্গে নারীর তুলনা? বিন্তি পেছনের বাগান থেকে একটু ঘুরে এসে ওর গল্পের বইয়ের শেষ গল্পটা লিখছে। বইটা ঢাকা থেকে বেরুবে। অনেকটা নদীর গল্প আর জীবনের গল্প। বিন্তি এবার সেই বইটা কাকে উৎসর্গ করবে ভাবছে। নভেম্বর ২০১৪-তে ব্রিজ বানানো শুরু হয়েছিল। ২০২২-এর জুনের ২৬ তারিখে উদ্বোধন হলো। ঘটনা ওর মাথায়  ঘুরছে। কত কিছু যে মাথায় ঘোরে? কেউ যদি ব্রেন স্ক্যান করে একেবারে অবাক হবে।

‘নদীর নামে আমার নাম হলে আমি বেছে নিতাম অন্য কোনো নাম। বিয়াস বা মহানন্দা, না হলে তিস্তা। পদ্মা নয়।’ গল্পের ভেতরে ডুবে যায় বিন্তি। তারপর ভুলে যায় একা থাকা। জুঁইফুলি শব্দগুলি টুপটাপ। আসলে এই করেই পার করে দিয়েছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। কেবল লিখে। সেই যে অসুখে পড়েছিল আদিব। তারপর থেকে বিন্তি এই করছে। এখনো তাই। ল্যাপটপ ওর বন্ধু। ওর আয়না। একমাঠ সবুজ ঘাস। শিউলিঝরা কোনো এক সকাল।

ছেলেটা ক্যালিফোর্নিয়াতে। হঠাৎ আসে। চলে যায়। বলে – ‘লিখতে থাকো। ছেড়ো না মা।’

ঢাকায় যাওয়ার নানা বাজার করে একদিন প্লেনে উঠে বসে। এটা-সেটা নানা জনের জন্য। প্রাক্তন অতিরিক্ত সেক্রেটারি হাশিমের জন্য একটা বই কেনে। কোনো পার্সোনাল গিফট নয়। ওকে যে পদ্মা দেখাবে বলে কথা দিয়েছে। হাশিমের স্ত্রী নেই। কবে যেন মারা গেছে। একদিন ফেসবুকে জানিয়েছিল। বিন্তি কি ভাবছে কে জানে। নদীর মতো ছল ছল কি? হতে পারে। জীবন তো এখন সমুদ্র পাবে পদ্মার মতো। বয়স নিয়ে না ভাবলেও এখন শরীরের এটা-সেটা জানান দেয় বয়সের কথা। বিন্তি চশমার কাচ মোছে। চোখ কখন যে ঝাপসা হয়ে গেছে। কে জানে কোন কারণে। কারণ বোধকরি এখন প্লেনে বসে ওপর থেকে ঘাস, মাঠ নয় কেবল, সারি সারি বাড়ি দেখতে পায়, তাই। আকাশ খেয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। সবুজ চলে গেছে। চোখের আরাম নেই। ঢাকায় দু-একজন আত্মীয় আছেন। বিন্তি আসে একটু বিশ্রাম করতে। একটু জিরিয়ে নিতে। একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট আছে ওর।

বাড়িটা ঝাড়পোছ করেছে কেয়ারটেকার কাম কুক কাম সেক্রেটারি আশরাফ। ও সারাবছর বাড়ি পাহারা দেয়। বিন্তি ওকে সারাবছর বেতন দেয়। যেন ঢাকায় গিয়ে হাবুডুবু খেতে না হয়। আশরাফ ওর জন্য রাঁধে, নাশতা তৈরি করে, এটা-সেটা বানায়। এই লাক্সারি বিন্তির ভালো লাগে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের পর এইসব বিলাসী সময়। তিন ঘণ্টা গান শোনা, বই পড়া, ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি। দুই মাস থাকবে ও। গল্পের বইটা পাবলিশারের হাতে তুলে দেয়। ‘একুশটি প্রেমের গল্প’। ও প্রেমের কি বোঝে? এমন প্রশ্ন শুনতে হয়েছে ওকে। ও তো ভালোবাসার স্তরেই আটকা পড়ে থাকলো। প্রেম-ট্রেম করেছে বলে মনে হয় না। এবার ওর মনে পড়ে যায় ব্রন্টিদের কথা। এমিলি, শার্লট আর অ্যান। যে তিন কন্যা বাবা, পোস্টম্যান, মিল্কম্যান ছাড়া আর কখনো কোনো পুরুষ না দেখেও কতসব প্রেম, তৃষ্ণা আর বিরহের বই লিখেছিল। প্রেম ও প্যাশন। বিন্তির বিয়ে আঠারোতে। আদিব। তারপর তার মৃত্যু। এখন একা। প্রেম জেনেছে নানা সব বই থেকে। হয়তো বা। বা সিনেমা থেকেও। লাভ স্টোরি তো ও সাতবার দেখেছে। আর্থার হিলারের পরিচালনা। আলি ম্যাকগ্রো আর রায়ান ও’নীল। চমৎকার সিনেমা। ‘লাভ নেভার হ্যাভিং টু সে সরি।’ দারুণ কথা। কোটেশন ওর বেশ মনে থাকে।

একবার রুবিনা বলেছিল – ‘এত প্রেম নিয়ে লেখো কি করে তুমি? কয়টা প্রেম করেছো?’

‘তুমি তাহলে বলছো রুবিনা, যে খুন নিয়ে লেখে সে লেখার আগে কয়েকটা খুন করে?’

তারপর ফোনের এপার-ওপার হাসিতে ভরে যায়। এরপর অন্যকথা।

ফোন আসে – ‘এসে গেছো তুমি? কতদিন থাকবে?’ হাশিমের গলা। গলার তেমন বদল হয়েছে বলে মনে হয় না।

সাত দিন চলে গেছে। এরপর আরো সাত সপ্তাহ।

‘কবে যাবে পদ্মা ব্রিজ দেখতে?’

‘যখন বলবে?’ একটু ভেবে বলে – ‘সামনের সোমবার।’ অনেকদিন এই হাশিমকে দেখেনি বিন্তি। কেমন হয়েছে দেখতে কে জানে? ফেসবুকের ছবিটা একটু আগের মনে হয়। পড়াশোনার জীবনের আরো যে-কজনকে মনে আছে তাদের তিন জন মারা গেছে। দুজন দেশের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে প্রেম-ট্রেম হয়নি। সে পড়েছে বিয়ের পরে। হাশিমের সঙ্গে একটা খোলামেলা সম্পর্ক, একটু মুক্ত বাতাস। একটা সংশয়হীন বন্ধুত্ব। বেশ হবে। হাশিম কি ওর চরিত্র পাহারা দেয়? মাথার চারপাশে হ্যালো আছে ওর? সুমতি-কুমতির কথা ভাবে? এই বয়সে যে ফেসবুক করে তার এসব আছে বলে মনে হয় না। দেশে কোনো সহপাঠিনী নেই। পদ্মাযাত্রায় একজনকে পেলে বেশ হবে।

খুশির ফুলঝুরির মতো গাড়িটা ছুটছে। চমৎকার দুই পাশ। টুকটাক দুই পাশে লাল-সাদা বাড়িও দেখে। কেবল নতুন গাছের মতো গজিয়ে উঠছে। ড্রাইভার জয়ন্ত বলে – ‘ওই যে দেখছেন ওটা তারিক আজিজের বাড়ি।’ কোনো এক এমপির বিলাসী বাড়িও আছে। মনে মনে ভাবছে, এমন একটা বাড়ি যদি ওর হতো বেশ হতো। কেবল লিখতো। আর গান শুনতো।

‘কী করে সময় কাটাও তুমি? বাড়িতে একা?’

‘একা আবার কি? কতসব লেখার চরিত্র আছে না? ওদের সঙ্গে কথা বলে। তাছাড়া জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। বিদেশ মানেই তো এই। তুমি কি করে সময় কাটাও?’

‘বই পড়ে। তোমার দুটো উপন্যাস পড়েছি। ময়ূরী যেখানে নায়িকা। আরেকটা মেহেরুন। ভালোই তো লেখো তুমি।’

বিন্তি হাসে। বলে – ‘অনেক ধন্যবাদ হাশিম। এত সহজে কেউ ভালো বলে না।’

‘বলে না? শব্দ নিয়ে অনেকের অনেক কার্পণ্য থাকে। মানে শব্দ ব্যবহারের কার্পণ্য। আমার নেই।’ এরপর বলে – ‘এমনিতে এই ব্রিজ বোধহয় ছয় কিলোমিটার। আর সব মিলিয়ে দশ পয়েন্ট ছয়শো বিয়াল্লিশ কিলোমিটার।’ সেই ব্রিজটার মাঝখানে গাড়ি থামে। বিন্তি আর হাশিমের ছবি ওঠে। নিচে দেখা যায় পদ্মা। কোথাও পানি। আবার কোথাও একটু চর পড়েছে। বাতাস আঁচল নিয়ে খেলে। আর ওর মনে হয়, কোথা থেকে চমৎকার একটা সুবাস ওদের চারপাশে খেলছে, ভালোবাসছে।

ওরা আবার গাড়িতে ওঠে। সবুজ ডাবের পানি ভেতরটা একেবারে স্নিগ্ধ করে দেয়।

এবার হাশিম ওকে ব্রিজটার গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে। বলে – ‘এই ব্রিজের কারণে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল এসব জায়গার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সহজ হয়েছে। এখন এইসব যাত্রা সহজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগার কথা নয়।’ বিন্তি একমুঠো চকলেট হাশিমের সামনে মেলে ধরে। হাশিম বলে – ‘তোমার মনে হয় ডায়াবেটিস নেই?’

‘নেই আবার। একটা চকলেট খাও। বাড়িতে গিয়ে ডায়াবেটিসের একটা বড়ি বেশি খেও।’ ওরা ঠিক করেছে টুঙ্গিপাড়া দেখে তারপর ফিরে যাবে। এসব দেখা তো বিন্তির কাছে স্বপ্ন। জাতির আত্মা! এই নামেই ও বঙ্গবন্ধুকে ভাবে।

রাস্তার চারপাশের সবুজ ল্যান্ডস্কেপ দেখে বিন্তি গুনগুন করে – ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’

হাশিম বলে – ‘ডেফিনেটলি নট। কোথায় পাবে এমন দেশ?’

তারপর একটু মজা করে হাশিম বলে – ‘এবার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। আমি প্রশ্ন করবো তুমি তার উত্তর দেবে।’

‘বলো।’

‘বলো তো এই পৃথিবীর সবচাইতে বড় ব্রিজের কি নাম? এবং তা কোথায়?’ বিন্তি গুগল দেখেছে এখানে আসার আগে। বলে – ‘চিনের ডানিয়ান কুনসান গ্র্যান্ড ব্রিজ। যার দৈর্ঘ্য ১৬৪.৮ কিলোমিটার।’

‘আমাদের এই ব্রিজ করতে কত বছর লেগেছে?’

‘আট বছর।’

‘কাদের টাকায়?’

‘আমাদের। মানে দেশের।’

‘এ ব্রিজ কোন কোন জায়গাকে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করবে?’

বিন্তি বলে এবং আরো বলে – ‘দক্ষিণ-পশ্চিম জায়গাকে উত্তর অঞ্চল আর পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে যোগ করবে।’

‘আট বছরে কতগুলি দিন?’

‘এই ধরো দুই হাজার সাতশো পঁয়ষট্টি দিন।’

‘কি পরিমাণ লোক এতে উপকৃত হবে?’

‘সকলেই মোর অর লেস। তবে ৩০ মিলিয়ন মানুষ ডেফিনেটলি।’

‘অনেকদিন পর আমি ও তুমি যে ব্রিজ দেখতে বেরিয়েছি। তার ফল কী হবে?’

এবার বিন্তি একটু ভেবে বলে – ‘সহপাঠিত্ব থেকে বন্ধুত্ব।’

‘মেইন ব্রিজটা কত লম্বা?’

‘৬.৫ কিলোমিটার। আর পুরোটা দশ কিলোমিটারের একটু বেশি।’

‘কবে উদ্বোধন হয়েছে এবং কে করেছেন?’

‘২৬শে জুন ২০২২-এ এবং উদ্বোধন করেছেন শেখ হাসিনা।’

‘তাঁর সঙ্গে কতজন লোক ছিলেন?’

‘তিরিশ হাজার এবং সতেরো কোটির ভাবনা। মানে যাঁরা সেদিন আসতে পারেননি তবে মনে মনে উপস্থিত ছিলেন। যেমন আমি।’

‘এরপর আমরা কী দেখবো?’

‘ভাবিনি। তবে কিছু একটা।’

‘কতগুলি স্প্যানার ও পিলার আছে?’

‘আমি কি বিসিএসের ভাইভা দিচ্ছি নাকি? ধর দেড়শোটা।’

এবার হাশিম হাসে। ‘একবার রশিদ তোমাকে বলেছিল – তুমি আমাদের ডার্ক হর্স। যাক সেটা আবার প্রমাণ করলে?’

বিন্তি বলে – ‘গুগল। আমি না।’

টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার মাজার দেখে বিন্তি কাঁদে। কি নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করেছে ওইসব দুষ্কৃতকারী। দোয়া করে। তারপর একটু বসে থাকে। যে-বাড়িতে বড় হয়েছেন জাতির পিতা, তা দেখে। লাল রঙের ইটে আজো দাঁড়িয়ে আছে। দেখে বাঘিরা নদী। খেলার মাঠ এবং আর সব। ভাবে, আরো সমৃদ্ধ করতে হবে জায়গাটিকে। যেন পৃথিবীর যেখান থেকেই কেউ আসুক তারা যেন সবটুকু দেখে ফিরে যায়। জাতির পিতার আরো নানা কথা লেখা হোক এখানে-সেখানে। দু-একটা সমৃদ্ধ দোকান হোক। যেখানে পাওয়া যাবে তাঁর জীবন সংক্রান্ত নানা বই। তাঁর নানা রেপ্লিকা। আমাদের কুটিরশিল্পের আরো কিছু স্বাক্ষর। চা আর জলখাবার থাক আরো। ব্রিটেন হলে আরো সব দোকান হতো। তাই তো নেপোলিয়ন বলেছেন – ‘ব্রিটেন হলো দোকানের দেশ। এ নেশন অফ শপকিপার।’

বাড়ি থেকে আনা ঘ্রাণভরা খিচুড়ি আর মুরগি দুজনে ভাগ করে খায়। তারপর ফ্লাস্ক থেকে বেরোয় চা। বিন্তির প্রিয় টেটলি চা। ওপরে ভাসছে এক টুকরো সবুজ লেবু। কাপ দুটো সোনালি বর্ডারে অপরূপ।

ফিরতি পথে যখন বিন্তির চোখ প্রায় ধরে এসেছে প্রশ্ন করে হাশিম – ‘তুমি একা কেন? পথ চলতে আর কাউকে বাছোনি কেন?’

‘তুমিও তো একা। আমার ধরো বারো বছর একা পথ চলা। তোমার তো বিশ বছর?’

‘সে অনেক কথা।’

‘আমারও তাই। সে অনেক কথা। তবে বিয়ে কি সেটা জেনেছি অনেকদিন ধরে। আবার বিয়ে করবো সে কেমন হবে? না থাক, ও-পথে আর না।’

একটা তারার গান বাজছিল। গানটা শেষ হয়। বিন্তি বলে সেই কবিতা যা ইয়েটস লিখেছিলেন – ‘কি ভাবে ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে পর্বতের ওপারে আকাশের তারায় মুখ লুকোয়। আর কেমন করে কোনো একজন বয়সিনী নারীর ভেতর দেখতে পায় একটি ‘তীর্থআত্মা’।’

‘ভালোই আবৃত্তি তোমার? তুমি কি কবিতাও লেখো।’

‘মাঝে মাঝে। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে হয় – ‘কবিতায় আমি কখনো মিথ্যাভাষণ করি না’।’

‘তারপর? পথটা তো একসময় ফুরোবেই। তাই কি সব ভাবনায় আধো ঘুম আধো জাগরণে পথটা ফুরিয়ে যায়।’

গাড়ি থেকে নামতে নামতে বিন্তি বলে – ‘এক বছর পর আসবো। ভালো চাও তো একটা ব্রিজ বানিয়ে রেখো। ব্রিজ দেখতে যাওয়াটা মজার ঘটনা। কারণ কি জানো? ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যায় ছল ছল নদী।’

‘বিন্তি আমরা ইউনিভার্সিটিতে এই নামেই তোমাকে ডাকতাম। ভালো নামটা তোমার বেনারসি শাড়ির মতো বাক্সের তলায় চাপা পড়ে আছে। আমি তোমাকে ধন্যবাদ দেব এই কারণে – তুমি একবারও বলোনি আমি একজন অশীতিপর বৃদ্ধ।’

‘আর আমার কি মনে হয়েছিল জানো? আমি এখনো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে। যখন সবুজ প্রেম করতো বিলুর সঙ্গে। নীনা আর বেদু হাত ধরে ঘুরতো। ফেরদৌসী কোনো এক ইংরেজি বিভাগের ছেলের সঙ্গে ভাব করছে। আর সুলতানা কোনো এক চাচির ভাইকে বিয়ে করে সকলের বকা শুনছে। সম্পর্কে নাকি লোকটা ওর মামা। আর কল্পনা কাউকে প্রেম করার জন্য খুঁজে পায় না। আর বকুল কার ডাকে সাড়া দেবে ভেবে আকুল। আর আমি তখন ক্লাস শেষ করেই বাড়িতে ছুটছি ঘরসংসারের কারণে। আর আমরা ছেলেদের নানা সব নাম দিতে শুরু করেছি।’

‘আমার কী নাম ছিল?’

‘কি জানি মনে নেই। নাও তাহলে এতদিন পর আমি দিলাম তোমার একটা নাম – ‘নির্জন’।’

‘আর আমার কি নাম হতে পেরে?’ প্রশ্ন করে বিন্তি।

‘ভেবে বলবো।’

‘আসি। নতুন ব্রিজটা এক বছরের ভেতর হবে তো?’

গাড়িটা সাঁ করে গেট পেরিয়ে চলে যায়। উত্তর শোনা হয় না।