পরিরাও নরকে বসবাস করে

পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণের মধ্যমণি নারী সীতাকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয় অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে। সীতার সেই অগ্নিপরীক্ষা সর্বজনবিদিত।

রামচন্দ্র সর্বসমক্ষে পত্নীকে বলেছিলেন, তুমি রাবণের অঙ্গে নিমজ্জিত হয়েছ, এখন যদি তোমাকে পুনর্গ্রহণ করি, তবে কি করে নিজের মহৎ বংশের পরিচয় দেব?

[বাল্মিকী রামায়ণ – সারানুবাদ – রাজশেখর বসু – পৃ-৩৮১

সীতাকে শেষ আশ্রয় নিতে হলো বসুমতীর কোলে

(তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমইতি)

(বাল্মিকী রামায়ণ, অনুবাদক – রাজশেখর বসু, পৃ ৪৬৮)

মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেলে ভাবতেই থাকে সে। কারণে-অকারণে, ঘুমাতে গেলে কিংবা অপরাহ্ণের অলস বেলায়।

কেন অমন হলো? এমন হওয়া কি উচিত? ছোটবেলা থেকে লেখালেখির অভ্যাস আছে বলেই বুঝি এমন হয়।

দুদিন আগে খবরের কাগজে সংবাদ বোরোল – উপার্জনক্ষম সন্তানরা মাকে কমলাপুর রেলস্টেশনে ফেলে এসেছে।

অন্য সংবাদটিও ভয়াবহ, পাঁচ বছরের মেয়েশিশুকে পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী লোক নিপীড়ন করেছে। শিশুটি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বুক মন্থন করা নিশ^াস ফেলে নওশিন। আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি?

চায়ের টেবিলটি জমজমাট এখন। শ^শুর মোবারক সাহেব, স্বামী মনোয়ার, দুটি ছেলে রিমো আর মিমো অনর্গল কথা বলছে।

শুক্র-শনিবার দুটি ছুটির দিনে খুব হইচই হয় বাড়িতে। দস্যি ছেলেদুটো পড়ার বই ছুঁয়েও দেখে না। শুধু হুটোপুটি করে বেড়ায়, দাদাজানের সঙ্গে গল্প করে। সপ্তাহের কটি দিন ব্যবসা সামলে শ্রান্ত থাকায় ছুটির দিনটি রিল্যাক্স করে কাটায় মনোয়ার।

বাড়িটা আজ বেশ জমজমাট। বেশ লাগে নওশিনের। অন্যদিন দুপুরে রান্না হয় হালকা খাবার, ডিনারে শুধু একসঙ্গে বসে খাওয়া।

সকালবেলা ছোটাছুটির অন্ত থাকে না নওশিনের।

রিমো-মিমোর টিফিন রেডি করা, স্কুলব্যাগ গোছানো,

বই-খাতা-পেনসিল-ইরেজার খুঁজে খুঁজে জেরবার হয়ে যায় ও। তাড়াহুড়োতে মেয়োনিজ ছোঁয়ানো টোস্ট, ডান হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে নিয়মের ব্রেকফাস্ট সারে।

তবে ছুটির দিনটা অন্যরকম। আরাম-আয়েশে গড়িয়ে চলে সারাদিন। মোবারক ধীরেসুস্থে ফেলে আসা গাঁয়ের বাড়ির কথা, নিজের জীবনের কথা বলেন। ছেলে-নাতিরা তাঁর সঙ্গ উপভোগ করে। নওশিনের ভালো লাগে ছুটির দিনটিতে কোনো তাড়া নেই বলে।

সবাই একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করা কম আনন্দের নয়। মেন্যুতেও ভ্যারাইটি থাকে। দুটি দিন জেবু আর পেয়ারারও নিশ^াস ফেলার সময় থাকে না। হাতা-খুন্তির আওয়াজের সঙ্গে বাবুর্চি খোরশেদ গুনগুনিয়ে গান গায়। বাড়ির পরিবেশটাও বেশ আনন্দময় হয়ে ওঠে।

সময়টা চমৎকার। ফেব্রুয়ারির প্রায় মাঝামাঝি। ফাগুন মাস। শীত কমে এসেছে, গরম এখনো জেঁকে বসেনি। মনোরম স্নিগ্ধ হাওয়া চারপাশে খেলা করে। নিয়মিত পরিচর্যা করা টবে ডালিয়া-জিনিয়া-সুইট পি, গাঁদা আর নয়নতারা ফুলের বাহার। মাধবীলতা আর অপরাজিতার লতানো গাছদুটি নকশা করা গ্রিলকে জড়িয়ে রেখেছে।

এ-সময়টাতে এমনিই মন ভালো হয়ে যায়।

প্রিয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব দেশের বাইরে যারা থাকে শীতের এ-সময়ে ওরা দেশে ফেরে। অনেক লেখক বইমেলা টার্গেট করে এলেও নতুন বছর উদ্যাপন করেই ওরা ফিরে যান। এ-সময়টাতে প্রতিবছর নওশিনের বাড়িতে গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়। অলিখিত রেওয়াজ যেন।

মোবারক ডিম পোচ খেতে খেতে বলেন, এবার তোমার বন্ধুদের ডাকবে না সানা?

– হ্যাঁ আব্বা, এবারও ডাকব।

মনোয়ার বলে, ও তো পত্রিকার খবর পড়ে, টিভির নিউজ দেখে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। আমি তো সব সময়ই বলি – কাম আউট অব দিস রাট। মন খারাপ করা ব্যাপারগুলি ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়।

মোবারক সস্নেহে বলেন, বউমা সেনসিটিভ মেয়ে। তারপরও তোমার মনে রাখতে হবে সানা – এ-বছরটা তোমার জন্য লাকি ইয়ার। সৌভাগ্যের বছর এটি। দুটি বই এসেছে মেলায়, সেলিব্রেট করা উচিত তোমার।

পার্টি থ্রো করতে বরাবরই পারঙ্গম মনোয়ার। বলে, তোমার মালবিকাদি, গালিব সাহেব, আইরিন আপা ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। সবাইকে ডাকো এবার, গ্র্যান্ড পার্টি হবে।

শ^শুর আর স্বামীর উৎসাহে পলকে মগজের ভেতর থেকে বিষণ্ন আর ধোঁয়াটে মন খারাপ করা ব্যাপারগুলি সরে যায়। লাজুক মুখে বলে, বলছো?

– অফ কোর্স। প্রতিবছরই তো কজনকে ডাকো। এবার অনেককে ডাকবে। এ-বছর হলো স্পেশাল ইয়ার। তোমার দুটো বই বেরিয়েছে সানা। গ্র্যান্ড পার্টি না হলে হয়?

– খুব ভালো আইডিয়া। মোবারক বলেন, আমাদের সময় বেড়াতে যাওয়ার খুব রেওয়াজ ছিল, তখন দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যেত সবার সঙ্গে। এত ট্র্যাফিক জ্যাম তো ছিল না। প্রাইভেটকার কটাই বা ছিল। বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল খুব আনন্দের।

মনোয়ারের চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। – বড়ফুফু, ছোটফুফু, খালামণিদের বাসায় কত গেছি। মোবারক স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। – প্ল্যান করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। খুব আনন্দ হতো।

দশ বছরের মিমো আর আট বছরের রিমো অবাক হয়ে বলে, আমরা তো বেড়াতে যাইনি কোনোদিন। আজ কিন্তু বিকেলে রুমিন আন্টির বাড়িতে যাব।

নওশিন বলে, দূর বোকা, গুলশান থেকে চামেলিবাগ যাওয়া? জ্যামে আটকে থাকতে হবে সারাদিন। মিমো বলে, ও কে – বেড়াতে যাব না ঠিক আছে, কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলবে তো?

মোবারক নাতিদের জড়িয়ে ধরে বসেন। বলেন, গল্প শুনবি? বেড়ানোর গল্প?

– অব কোর্স। দু-ভাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে।

– জানিস, কোথাও বেড়াতে গেলাম, আমাকে দেখে কী আনন্দ!

– কেন কেন? এ কি সারপ্রাইজ ভিজিট নাকি? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যেতে না?

– দূর ব্যাটা, কিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট? ইচ্ছে হলো – সকালে নাশতা করেই চলে গেলাম বেড়াতে। প্রথমে যাওয়ার পর আসত শরবত। এটা অবশ্য সামারে, উইন্টার সিজনে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চা।

মিমো অবাক হয়ে বলে, কফি? কফি খেতে না?

মনোয়ার-নওশিন নিজেদের কাজে চলে গেছে।

– কফি? কফি সার্ভ করা হতো না?

দাদাজান বলেন, তখন কিন্তু কফির চল ছিল না। হয় চা, নয় শরবত।

রিমো বলে, শরবত? ইউ মিন বেভারেজ? ওহ্ হাউ নাইস দাদাজি।

– হ্যাঁ, লেবু-চিনি-নুন দিয়ে শরবত বানানো হতো, এর তুলনা ছিল না। খুব যত্ন করে বানানো হতো। এখনকার মতো কোক-স্প্রাইট? উঁহু, তা মোটেও নয়। দোকানের কোকা-কোলা খাও কেন?

মিমো বিজ্ঞের মতো বলে, সে তুমি বুঝবে না দাদাজি। দোকানে যাও, কিনে নিয়ে এসো, কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই।

রিমো বলে, লিভ দিস টপিক, গো অ্যাহেড। আগে বাড়ো। এরপর কী হতো?

– কী হতো মানে? এরপর হতো এলেবেলে গল্প। যার বাড়িতেই যাও কিছুতেই ছাড়বে না। প্রথমে যাওয়ার পর  চা-নাশতা খাওয়া। এরপর শুরু হতো দুপুরের রাঁধাবাড়া। কী আনন্দ সবার! দুপুরে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না।

খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়িতে ফেরার কথা বললেই বলত, না না – বিশ্রাম করো, রেস্ট নাও। ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে চা-নাশতা খেয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। এর আগে কিছুতেই ছাড়ছি না। শুনেছো এই মেহমানদারির গল্প?

– ইস্! কী মজার দিন ছিল!

দাদাজির সঙ্গে থাকলে দুজনই খুব ভালো থাকে। নওশিন নিশ্চিন্তে টুকিটাকি কাজকর্ম করে। ও ভাবে, বাড়িতে দাদা-দাদি কিংবা বয়স্ক মানুষ থাকলে ছোটদের নিয়ে আর চিন্তায় থাকতে হয় না। কেন যে মানুষ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখে, নয়তো স্টেশনে ফেলে রেখে নিজেদের বোঝা কমায়, কে জানে! কিন্তু তারা যে সংসারের অ্যাসেট তা কি ওরা বোঝে না? রাতে খেতে বসে মোবারক বলেন, সানা মা, কাকে কাকে পার্টিতে ডাকবে লিস্ট করে নাও। সবার সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগবে। আগে থেকে লিস্ট না করলে কাছের মানুষও বাদ পড়ে যাবেন।

মনোয়ারের উৎসাহের কমতি নেই। ও এমনই, খুব হুজুগে আবার ভীষণ

শর্ট-টেম্পারড।

মোবারক মাঝেমধ্যে বলেন, ও এত রগচটা কী করে হলো সানা?

নওশিন হাসে। তবে, এও এক কথা। আব্বা ঠান্ডা মানুষ। ধীরেসুস্থে কথা বলেন, সবার মতামতকে গ্রাহ্য করেন। কাউকে কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলেন না, খুব ভালো মানুষ।

তবে মনোয়ার আলাদা একজন মানুষ, সে অন্যরকম হতেই পারে। নওশিনের যে-ব্যাপারটি খারাপ লাগে তা হলো, যা চাই তা তক্ষুনি পেতে হবে, অন্যের মতামতের তোয়াক্কা না করে। অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম না দিয়ে নিজের চাওয়াটা পূরণ করা।

অনেক সময় স্বামীর এই স্বভাবের কথা ভাবতে গিয়ে ভীষণ অসম্মানিত বোধ করে সানা। তাহলে কি এই সংসারের আমি শুধুই সুপারভাইজার? শুধুই তত্ত্বাবধান করা? সংসারে কি আমার কোনো অধিকার নেই?

ছুটির এই দুদিনে মনোয়ার

ভীষণ পাল্টে গেছে। যখন-তখন তার উল্লসিত গলা।

– সানা ইজ আ রাইটার, এজন্য অবশ্যই সেলিব্রেশন হবে। তাই তো আব্বা?

– আমি তো আগে থেকেই বলছি মনু। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কী জানো – বড়দের জন্য সবাই লেখে, সানা যে ছোটদের জন্য প্রথম বইটা বের করেছে, এই পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখলে মনে হয় – শি হ্যাজ ডান আ গুড জব। নামটিও কী চমৎকার! ‘লাল গালিচার ফুলঝুরি’। অন্য বইটির নাম ‘আগুনের ভোর’। বইটি বড়দের জন্য, নামটি কী চমৎকার মনু।

রিমো-মিমো চেঁচিয়ে – ওয়াও বলে মাকে জড়িয়ে ধরে।

– আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বউমা।

বড্ড ইমোশনাল নওশিন। আব্বু নেই, শ^শুর বড় স্নেহ করেন – এই অনুভূতিতে ওর দু-চোখ ভিজে যায়।

উৎসবের রাত

বন্ধুবান্ধব আর প্রিয়জনদের উপস্থিতিতে সন্ধেটা মধুর হয়ে ওঠে।

বিজনেস ম্যাগনেট, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পরিবেশবাদী, অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ফুটবলার, ক্রিকেটার, সংগীতশিল্পী – কে নেই?

মনোয়ার খুব সোশ্যাল, সব ফিল্ডেই তার পরিচিতজনরা রয়েছেন।

গমগম করে ওঠে হলঘরটি। চোখ-ধাঁধানো প্যাকেটে গিফট, ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে অতিথিরা আসছেন।

সিডনি থেকে আসা রুমিন বলে, তোমার বাড়ির নামটি কী মিষ্টি সানাপু। ব্যাচমেট গালিব সানার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, নামটি আনকমন।

নিউইয়র্ক থেকে এসেছে

শামীম-আইরিন দম্পতি।

– অবভিয়াসলি।

আইরিন সব জানতে চায়, বুঝতে চায়। বলে, ইস্ – তোমার বাড়ির নেমপ্লেটটা চোখ এড়িয়ে গেল কী করে বলো তো? চোখে পড়া উচিত ছিল। বাড়িটার নাম কি?

রাতের এই গেট-টুগেদারে কথা বলার লোকের অভাব নেই। পরিজনরা তো রয়েছেনই, ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে বিদেশ থেকে এসেছেন কজন।

কথায় কথায় মনোরম হয়ে উঠেছে ফাল্গুনী রাত। কাইজার বলেন, সানাভাবির বাড়ির নাম হলো গোধূলি।

– বাহ্, দারুণ নাম তো, মানেটা কী সানাপু?

আলমগীর বলেন, বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়টাকে গোধূলি বলে।

গায়িকা রিনি বলে, ইংরেজিতে এই সময়টাকে  টোয়াইলাইট বলে, তাই তো?

নওশিন বলে, ঠিক বলেছেন। এ-সময়টাকে আওয়ার অব কাউ-ডাস্ট বলে। আমার ছোটবেলাটা মহকুমা শহরে কেটেছে। স্কুলের ছুটিছাটায় গাঁয়ের বাড়িতে নিয়ে যেতেন আব্বু। বৌলাই নদী, শান-বাঁধানো ঘাট, মেঠোপথ – খুব টানত আমাকে।

শিক্ষাবিদ সুলতানা বলেন, খোলা মাঠ বলে এখন কিছু আছে নাকি? একটুখানি জায়গা পেলেই স্কাইস্ক্র্যাপার তৈরি হয়। ছেলেমেয়েরা খেলবে কোথায় শুনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা কেউ কি ভাবে?

তানভীর বলে, কাম টু দ্য পয়েন্ট অ্যান্টি। গোধূলি নামের ব্যাখ্যাটা শোনা যাক।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করে তানভীর। রিনি বলে, রাইট রাইট, আপনি বলুন নওশিন আপা। নওশিন বলতে থাকে। চোখদুটি তার স্বপ্নালু হয়ে ওঠে। – কেউ ভাবতেও পারবেন না গাঁয়ে কত খোলা মাঠ, গাছগাছালি রয়েছে। সেই সময় আমি দেখেছি, মাঠে গরু চড়াত রাখাল। রোদে-পোড়া মাঝদুপুরে বাঁশি বাজাত রাখাল ছেলে। কী অপূর্ব সেই বাঁশির সুর!

কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, ছুটিছাটা হলেই গাঁয়ের বাড়িতে চলে যেতেন? বাহ্ – দারুণ তো।

– হ্যাঁ, আব্বু বলতেন – রুটকে ভুলতে নেই। শিকড়কে মনে রাখতে হয়।

মোবারক বলেন, আমার বেয়াই সাহেব পুষ্পবিলাসী মানুষ ছিলেন, অনন্য মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর খুব হৃদ্যতা ছিল।

রুমিন বলে, ন্যাচার লাভার। তাঁর মেয়ে বলেই তো আপনার বউমার চমৎকার দুটি বই মেলায় এসেছে।

নওশিনের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে গালিব বলে, ছুপা রুস্তম। নওশিনের কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।

রুমিন বলে, স্যরি, অফুলি স্যরি, গো অ্যাহেড আপা।

আগের কথার জের ধরে স্মৃতিকাতর নওশিন বলে, প্রকৃতির মধ্যেই আমার বড় হয়ে ওঠা। রাখাল ছেলের কথাটিই বলি। সন্ধ্যার আগে ছেলেটি গরু নিয়ে ঘরে ফিরত।

– হাই অ্যান্টি, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই রাখাল ছেলে?

সরফরাজ সাহেবের নাতি গুড্ডু জিজ্ঞেস করে।

– কাউবয়, গুড্ডু।

– ওহ্, আই সি।

– শোনো গুড্ডু, গরুগুলি ঘরে ফিরতে থাকে শেষ বিকেলে। ওদের পায়ের খুরের ধুলো উড়ে শেষ বিকেলটা আবছা হয়ে আসে। সূর্য অস্ত যায় তখন। সূর্যের নিভে যাওয়া সোনার আলো আর ধুলো-ওড়া সময়টাকে গোধূলি বলে। হায়দার সাহেব চনমনে হয়ে ওঠেন।

– ফ্যান্টাসটিক, সিম্পলি ফ্যান্টাসটিক। চমৎকার। এই বাংলা শব্দটি আমরা অনেকেই জানি না। থ্যাংক গড। আপনার বাড়ির নাম আমাদের অন্য জগতে নিয়ে গেল।

বিষণ্ন সুরে নওশিন বলে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কী!

টেবিলে কাচের সারি সারি বাটিতে রাখা কাজু

পেস্তা-আখরোট-কিসমিস। ছোট্ট ছোট্ট গ্লাসে রাখা ডাবের শাঁস, ঘন দুধ আর রোজ সিরাপ মেশানো ঠান্ডাই।

জমে ওঠা গল্পের মাঝে ঠান্ডাইয়ে রেলিশ করে চুমুক দিয়ে সাংবাদিক জাহিদ বলেন, কাইজার সাহেব, আপনি একজন সফল ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেন, চারপাশে অজস্র ফ্যান, পায়ে বল পেয়ে কী চমৎকার খেলেন – এর সিক্রেটটা কী – বলুন তো?

বোখারি বলে ওঠেন, ইন্টারভিউ লে রাহি হ্যায় মি. জাহিদ, ক্যায়া?

– এত কাছে পেয়েছি উনাকে, জেনে নিতে ক্ষতি কী? প্লিজ মি. বোখারি ইন্টারাপ্ট করবেন না।

কাইজার দু-হাত তুলে বলেন, শান্তি শান্তি। শুনুন তাহলে, আমার আব্বুর ফুটবলে ভীষণ অ্যালার্জি ছিল। সারাক্ষণ বলতেন, একটা বলের পেছনে পাগলের মতো সবগুলান দৌড়ায়, এটা কোনো খেলা হলো?

রিমি বলে, আংকেল ঠিকই বলতেন।

সম্মিলিত হাসির কলরোল কাইজার মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করেন।

– টুর্নামেন্ট খেলতে গেছি বাড়ি থেকে একটু দূরে। খেলার পরে ফিরে এলে আম্মা আস্তে করে দরজা খুলে দেবেন। তখন আমরা মফস্বলে থাকি। টেবিলে ভাত ঢাকা থাকবে, আমি চুপচাপ খেয়ে নেব। বিছানায় পাশবালিশ লম্বা করে রেখে কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখতেন আম্মা।

আব্বা বারবার চেঁচিয়ে বলতেন, খোকার পড়া শুনতে পাচ্ছি না কেন?

আম্মা বলতেন, ওর একটু ঠান্ডা লেগেছে, শুয়ে আছে। আব্বা একদিন বললেন, ওর জ¦র তো প্রায়ই হয় দেখছি, কত জ¦র? থার্মোমিটার দাওনি?

আম্মার তাৎক্ষণিক জবাব, আপনের যেমন কথা। থার্মোমিটার দিতে যাব কেন? কপালে হাত দিয়ে নয়তো গাল ছুঁয়ে জ¦র পরখ করা যায়।

রিমঝিম জিজ্ঞেস করে, খালাম্মা কোনোদিন ধরা পড়েননি?

– পড়েনি আবার, এ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। একদিন আব্বা কাঁথা সরিয়ে দেখেন আমি নেই। ব্যস হয়ে গেল। আব্বা হুংকার দিলেন, মা-বেটা দুজনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।

দাদি তখন বেঁচে ছিলেন। ঝগড়া আরো জমাট বাঁধুক সে কারণে দাদি বলেছিলেন, ছোটরা মিথ্যা কথা বললে মাফ করে দেওয়া যায়, মা মিথ্যা বলে – এ আমি প্রথম শুনলাম। আম্মাও হারার পাত্রী নন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনারা তো ওকে খেলতে দেবেন না, খোকার ভালো লাগার জায়গা এটা, আমি মিথ্যা বলেছি ওর ভালোর জন্য।

উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে বলেন, জননীদের জয় হোক। ড. দেবদূত বলেন, নাউ ইউ আর এ সাকসেসফুল প্লেয়ার।

– থ্যাংকস, হাসিমুখে কাইজার বলেন, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, আব্বা এখন আমার খেলার ফ্যান। আমার ছোট ভাই টিটো ক্রিকেট খেলে, তাকেও ব্যাট দিয়ে পিটিয়েছেন আব্বা। এখন সব ঠিকঠাক।

মনোয়ার বলে, কাইজার সাহেব, কথাগুলি বলতে পেরেছেন সফল হয়েছেন বলে। ফেইলিওর হলে বলতে পারতেন না।

– একজেক্টলি।

বোখারি আচমকা মন খারাপ করে বলেন, কোভিড নাইনটিন আয়া, বহুত খতরনাক বিমারি। চায়না সে আয়া, খোদা জানে ক্যায়া হোগা।

আড্ডায় এমনই হয়। একটির পর একটি কথা চলতেই থাকে। ঠিক মেঘের পর মেঘের মতো। বোখারির কথায় মলিন এক ছায়া নেমে আসে ঝলমলে আলো আর অগুনতি হাসিমুখের মাঝখানে।

 কোভিড নাইনটিন সবে পা রেখেছে। ধীরে ধীরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই ভাবছে, চীনের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাসটি মহামারণ রোগ হয়ে আমাদের দেশে চলে এলো কেন?

মুহূর্তের জন্য আতঙ্কে শিরশির করে ওঠে সবার শরীর। কথার ফুলঝুরি হঠাৎ করেই থেমে যায়।

সবে ফাল্গুন মাসের শুরু। বসন্ত ঋতু শেষ হবে, আসবে বৈশাখ মাস। নতুন বছর। বুনো ষাঁড়ের মতো ধেয়ে আসবে সুনামি রিটা, নার্গিস, ক্যাটরিনা, ফাইলিন – এই ভয় আর আতঙ্কের মাঝেই মানুষের বেঁচে থাকা। হাসি-গান, দুঃখ-বেদনা নিয়েই তো মানুষের জীবনযাপন।

স্তব্ধতা ভাঙেন সাংবাদিক ইয়াসিন।

– এই টপিকটা বাদ দাও তো। প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম আমাদের দেশে হয়তো ভাইরাসটি আসবে না। যা  হোক এখন বাদ দিন তো। আলোচনা করার মতো কত টপিক তো রয়েছে। শেয়ারবাজারে ধস, ব্যাংকের অনিয়ম, বাংলা গানের শব্দচয়ন, টিভির সংলাপ – এসব নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারি। লেট্স স্টার্ট। সংগীতশিল্পী লাবীবা বলে, আরে তাই তো – মন খারাপের কথা বলো না গো। ভাইরাসটির কথা ভুলে থাকতে চাই। ডেঙ্গুও কি কম জ¦ালাচ্ছে বলো!

রিনি সায় দিয়ে বলে, আমরা বিউটি কনটেস্ট নিয়ে কথা বলতে পারি। অসুখের কথা বললে ভীষণ ভয় করে আমার।

গালিব বলে, দ্যাটস আ গুড পয়েন্ট। সৌন্দর্যের প্রথাগত ভাবনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোজোবিনি টুনাজি সেরা সুন্দরীর শিরোপা জিতেছেন। ওর কিন্তু তোমার মতো ফেয়ার কমপ্লেকশন নয়।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, মালবিকা বলেন, ২০১৯-এ নব্বইজন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বিজয়ীর মুকুট পরেছিলেন ছাব্বিশ বছরের এই তরুণী। সত্যি, কত পরিবর্তন এসেছে  পৃথিবীতে, সৌন্দর্যের ডেফিনিশনও বদলে গেছে।

পরমা বলেন, প্রথাগত সৌন্দর্যের বিচার এখন আর হয় না। শুধু ফর্সা রং নয়, মেয়েদের এখন বুদ্ধিমত্তা দিয়েও বিচার করা হয়।

হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে তরুণ সাংবাদিক জাফর।

– এই এলেন লেটকামার। আপনি কখনো টাইমলি আসেন না।

বিব্রত হয়ে জাফর বলে, আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি তো, একটা নিউজ কাভার করতে গিয়েছিলাম। সবাইকে স্যরি বলছি।

– নিউজটা কী শুনি?

সবাই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন শোনার জন্য। জাফর বলতে থাকে,  ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে নেত্রকোনার কলমাকান্দায় আত্মীয়বাড়ি যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। পথে নেত্রকোনার সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর বিসিক এলাকার খাবার হোটেল একতারাতে নামেন তারা। মহিলাটি হোটেলের টয়লেট থেকে বের হলে তাকে হোটেলের ব্যবস্থাপকের সহায়তায় এক কর্মচারী ডেকে নিয়ে রেপ করে। পরে আরো পাঁচজন উপর্যুপরি রেপ করে। ক্যান ইউ ইমাজিন?

– মাই গড! এ কোথায় আমরা বাস করছি জাফর?

জাফর বলে, মেয়েটির সঙ্গে ওর স্বামীও ছিল।

– স্বামী প্রতিবাদ করেনি?

– অফকোর্স করেছে। বিষয়টি টের পেয়ে ওর হাজব্যান্ড প্রতিবাদ করেছে। ফল কী হয়েছে জানেন? ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর রাত ১১টায় ওই দম্পতিকে ছাড়ে।

লাবীবা মলিন মুখে বলে, একা মানুষটি করবে কী বলো তো? তাছাড়া ভালো মানুষ সব সময় কিন্তু খারাপ মানুষদের কাছে হেরে যায়।

কাইজার বলেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার! মেয়েরা একা নিরাপদ নয়, স্বামী বা পুরুষসঙ্গী থাকলেও নিরাপদ নয়। আমরা তাহলে করবটা কী?

সন্ধ্যারাতের এই আনন্দ-উৎসবে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে মেয়েদের এই অসহায়ত্বের ঘটনা।

বিপন্ন-বিষণ্নতার মলিন ছায়া পড়ে আনন্দ-উৎসবে। মালবিকা নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেন, মেয়েদের ওপর নির্যাতন কবে হয়নি বলুন তো! পৌরাণিক যুগ থেকে এগুলি ঘটেই চলেছে। সীতাকে রাবণ হরণ করেনি? রজস্বলা দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে সম্ভ্রমহানি করেছে দুর্যোধন, দুঃশাসন। যে-কোনো রেভল্যুশনে মেয়েদের নিপীড়ন করা, তাদের সম্ভ্রম লুট করা খুব সহজ ব্যাপার। কুরুর সঙ্গে পাণ্ডবের রেষারেষি, অথচ এই রাজনীতির শিকার হলেন দ্রৌপদী। ওর স্বামীরা কাপুরুষ-ভীরু, মাথা নিচু করে বসে রইল। যুধিষ্ঠির সত্যবাদী, অর্জুন বীরযোদ্ধা, ভীম বলশালী, শাস্ত্রজ্ঞ নকুল-সহদেব দুজন তো ছিলেনই। তারপরও কুলবধূর লাঞ্ছনা হলো। বিদুর ছাড়া কেউ কোনো প্রতিবাদও করল না।

বোখারি বলেন, নেহি, ইয়ে বাত সাচ্ নেহি হ্যায়। উনলোগ কাওয়ার্ড নেহি, টিমিড ভি নেহি। আচ্ছে লোগ ডরতে নেহি হ্যায়। লেকিন বুরা আদমির কাছে আচ্ছে আদমি হার যাতে হ্যায়।

জাফর মন খারাপ করা সুরে বলে, ময়মনসিংহের ঘটনাটি দেখুন, স্বামী প্রতিবাদ করেছে বলে হোটেলে তাকে বেঁধে রেখেছিল।

বিতর্ক জমে ওঠার মুখে আইরিন বলেন, এই তো কিছুদিন আগে নামী এক ম্যাগাজিনে কবিতা বের হলো। দারুণ কবিতা, নামটি ছিল – ‘মায়ের কাছে খুকুর খোলা চিঠি।’

আকবর হোসেন বলেন, শুনি তো সেই খোলা চিঠির কথা। গোপন কিছু নেই তো এতে?

অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, গোপন কিছু হতে যাবে কেন মি. হোসেন? মেয়ে মাকে বলছে অনেক দুঃখ-সুখের কথা। এর মধ্যে একটি পঙ্ক্তি ছিল দারুণ!

বাবাও তো পুরুষ মানুষ

সে কেন মা অন্যরকম হয়? –

– বাহ্, লাইনটি দারুণ তো। সত্যি বাবারা অন্যরকমই হন। তাদের স্নেহ-মমতা আর আদরের তুলনা নেই।

ঋতু বলল, মেয়েদের পথ চলতে যে শতেক বাধা, এর প্রমাণ আমি নিজে। নারায়ণগঞ্জের দুশো বেডের হাসপাতালে তখন আমার ছোটবোনের পোস্টিং। বাসে এক ঘণ্টার জার্নি, জ্যাম থাকলে একটু বেশি সময় লাগে।

– উহু, দেড় ঘণ্টা, দু-ঘণ্টাও লেগে যায় অনেক সময়।

আলমগীর বলেন, ঋতুর অভিজ্ঞতাটা শুনি। আপনারা বড় ইন্টারাপ্ট করেন, ঘটনাটি শুনি।

ঋতু বলল, বাসে বসে আছি, পেছন থেকে কে যেন সুড়সুড়ি দিয়েই যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি মায়ের কোলে কচি একটি বাচ্চা। বাচ্চাটিকে আদর করে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। ওমা, সুড়সুড়ি দেওয়া আর শেষ হয় না। অসহ্য মনে হয় এক সময়। পেছনে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাটি মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেছে। এতক্ষণ তাহলে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল ওদের সঙ্গে আসা বুড়ো লোকটি। আমি তাজ্জব। কল্পনা করুন, ঘণ্টা দেড়েক ধরে বুড়ো লোকটি আমাকে টাচ করে যাচ্ছিল।

হাসির কলরোল জাগে।

– বেবি নয় ঋতু আপু, বেবির দাদাজান। দারুণ ইন্টারেস্টিং।

গালিব বলে, আমরা যতই হাসিঠাট্টা করে ব্যাপারগুলি উড়িয়ে দিই না কেন, নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে ভাইরাসের মতো, এতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।

ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটিতে মনোবিজ্ঞান পড়ান ড. বেলায়েত হোসেন।

তিনি বলেন, কী অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব! পাড়ায় বাইক চালিয়ে হুংকার দেয় মুরগি মিজান। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে, – ওই আসছে ডন। মিজান একদিন দেখে, ছাপোষা ব্যাংক চাকুরে হুমায়ুন সাহেব, ওর মেয়ে মিমি বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। এ-ব্যাপারে বখাটে ছেলেটির মনে দুটি পয়েন্ট কাজ করে।

মেহেরুন্নিসা বলেন, ইগো তো কাজ করে অবশ্যই।

– হ্যাঁ, একটি হলো – আমার দাপট, আমার ক্যারিশমাকে হারিয়ে দিলো একরত্তি মেয়ে? তাহলে আমার আর রইল কী? আরেকটি ব্যাপার হলো – পিচ্চি মেয়েটি তো টেক্কা দিয়ে পুরুষ মানুষদের চেয়ে এগিয়ে গেল, এ হতে দেওয়া যায় না। ইয়ে কভি নেহি হো স্যাক্তা – এটিই হলো মেন্টালিটি।

মনোয়ার বলে, আরেকটি ব্যাপার আছে বেলায়েতভাই। ঘরে-বাইরে কিন্তু মেয়েদের নিগৃহীত হতে হয়। ইভটিজিংয়ের শিকার হলে মেয়েরা বাড়িতে বলতে পারে না। মা-বাবা কিংবা বাড়ির বড়রা সবাই বলতে থাকেন, শুধু তোমাকেই টিজ করে কেন? অন্যদের তো করে না; – এই আত্মগ্লানিতে মেয়েটি শেষ হয়ে যায়।

মনস্তত্ত্ববিদ বেলায়েত বলেন, তুমি ঠিক বলেছো মনোয়ার। তাছাড়া দ্যাখো, ধর্ষিতা হলে মেয়েটিকে পেট্রোল-কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে দুষ্কৃতকারীরা। এরপরও যদি বেঁচে থাকে, একে কি বাঁচা বলে? এই ঘটনার চাপ সামলে মেয়েটিকে আবার স্বাভাবিক করে তোলা শুধু পরিবারের নয়, সমাজেরও দায়িত্ব। মেয়েটি স্কুলে বা কলেজে আগের মতো যেতে পারে কি না – সে-ব্যাপারটি আমরা মোটেও ভাবি না।

মোবারক সাহেব এতক্ষণ শ্রোতা হিসেবেই ছিলেন, এবার বলেন, আশার কথা কি জানো – মেয়েরা এখন মুখ খুলছে। লজ্জায় এখন আর ওরা মুখ ঢেকে রাখে না, প্রতিবাদ করে।

সরফরাজ বলেন, ইয়ে হুয়ি না বাত।

গালিব বলে, আসল কথা হলো, মেয়েরা শক্তিময়ী হয়ে উঠলে পুরুষতন্ত্র হারিয়ে যাবে। সমস্যা এখানেই – কী বলেন মনোয়ার?

– একজেক্টলি সো।

কথা শুনতে শুনতে মালবিকা ভাবেন, মেয়েরা কালিকুলি মাখা কিচেনে রাঁধতেই থাকুক, সেখানে তো সব স্বাধীনতা ওদের দেওয়াই আছে। পোলাও-বিরিয়ানি-কোরমা-শুক্তো রাঁধতে তো কেউ মানা করেনি।

 মোবারক বলেন, সানা মা, এবার খাবার সার্ভ করো, নটা বাজে।

গল্পের আসর থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেবদূত বলেন, ব্যাপারটি হলো, মেয়েদের উত্থানে বিপন্ন হবে পিতৃতন্ত্র। জুডিশিয়ারির মজাটা কি আর পুরুষ ছাড়তে পারে?

– কেয়া বাৎ।

ডাইনিং টেবিলে ডিমের খোসার মতো ডিনার সেটে সাজানো মটরশুঁটি ছড়ানো জুঁইফুলের মতো পোলাও, ডিমের ডেভিল, মুরগির মখমলি কোরমা, ঝাল মাটন, ভেটকি মাছের বাটার মাসালা, ডেকোরেটেড স্যালাড।

পরমা বলে, ওয়াও – এ যে দেখছি সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা।

অ্যালেক্স জিজ্ঞেস করে, হ্যালো পারামা, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আন্নাপূরনা?

মালবিকা হাসিমুখে বিশ্লেষণ করেন, আন্নাপূরনা নয়, ইট ইজ অন্নপূর্ণা। শি ইজ এ হিন্দু গডেস, হু ইজ সেইড টু ফিড দ্য ওয়ার্ল্ড।

অ্যালেক্স সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, ওহ্, আই সি।

নওশিন বিব্রত মুখে বলে, হয়েছে হয়েছে। স্টপ ইট, এত বলো না তো, খুব লজ্জা লাগছে আমার। সামনাসামনি এত প্রশংসা নেওয়া যায় না। রোজ তো নয়, একটা দিনই শুধু খাবে।

গালিব ঠাট্টা করে বলে, দিন নয়, রাত বলো সানা।

জাহিদ প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বলে, আজ সবকিছু একটু একটু করে নেব, ইয়ামি ইয়ামি লাগছে।

লাবীবা জিজ্ঞেস করে, চপে কী স্টাফিং দিয়েছো ভাবি?

– চিজ দিয়েছি। খেয়ে দ্যাখো লাবীবা, ভালো লাগবে।

বেলায়েত বলেন, মাছও করেছেন দেখছি, গুড।

– হ্যাঁ, ওভেনে বাটার মাসালা করলাম। আব্বা খুব পছন্দ করেন।

এক ফাঁকে নওশিন শ^শুরকে বেড়ে দিয়েছে মুরগির স্টু, মাছ আর হাতে গড়া ব্রাউন আটার রুটি। রিমঝিম বলে, হোস্ট এমনই হওয়া উচিত। সবদিকেই তোমার তীক্ষè নজর সানাভাবি। আজ থেকে তোমার ফ্যান হয়ে গেলাম।

সরফরাজ খেতে খেতে বলেন, আওরাতদের ফ্রিডম নিয়ে কথা বলছিলেন তো, এই যে মিসেস মনোয়ার ভেটকি ফিশ ওভেনে দিয়েছে, ওর সওহর তো মানা করেনি। তুমহারে দিল চাহে তো পাকাও। কিচেন মে এতনা লিবার্টি, মজাসে পাকাও – ম্যায়নে ঝুট বোলা?

– লিবার্টি শুধু কিচেনে থাকবে, আর কোথাও নয়? ক্যায়া বোলা আপ সরফরাজ সাহাব? তেতে ওঠে আইরিন।

মালবিকা বলেন, মেয়েরা এগিয়ে গেলে, পুরুষের সমকক্ষ হলে, আপনাদের অসুবিধেটা কোথায়? ওরা শুধু খানা পাকাবে, পালক-গোশত, ভিন্ডি গোশত আর শামি কাবাব রাঁধবে?

দেবদূত দু-হাত তুলে বলেন, না না মালবিকাদি, কথাটি সরফরাজ সাহেবের সিøপ অফ টাং। ছেড়ে দিন।

রিমঝিম গরগর করে, তোমরা শুধু রেলিশ করে খাবে। খুব মজা – তাই না?

কাইজার বলেন, শান্তি শান্তি। সবকিছু স্পোর্টিংলি নিতে হয়।

– ওকে ওকে।

ডেজার্টের বাটি হাতে নিয়ে সবাই খুশি।

– এই না হলে সুইট ডিশ?

পেস্তা-বাদাম-কিসমিস মেশানো ঘন দুধে ঘিয়ে ভাজা মালপোয়া। বেলায়েত খেতে খেতে বলেন, নওশিন শুধু ভালো রাইটারই নন, রন্ধনপটিয়সীও।

আইরিন বলে, অফকোর্স শি ইজ আ গুড কুক, বাট অ্যাবাভ অল শি ইজ আ রাইটার।

করতালিতে ভরে ওঠে ডাইনিং স্পেস। শেয়ারবাজারের দরপতন, ব্যাংক নিয়ে অর্থনীতিবদদের ভাবনা,  আরো নানা বাস্তব সমস্যা, নারী-নিপীড়নের নিষ্ঠুর ঘটনা উঠে এসেছিল এতক্ষণ, তা যেন বহুদূরের তামসী আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে।

এখন ঝলমলে ‘গোধূলি’ বাড়িটি মিষ্টি হাসির কলরোলে ভরে গেছে।

ঋতু বলে, ড্রামস্টিক ফ্রাইগুলি এত ক্রাঞ্চি হলো কী করে? ডিমের গোলায় ডুবিয়ে ব্রেডক্রাম্ব মাখিয়ে আমিও তো ফ্রাই করি, এত ক্রাঞ্চি তো হয় না। জানি বাবুর্চি রেঁধেছে কিন্তু সুপারভাইজার, ইনস্ট্রাকটার তো আপনি। ওকে, রেসিপিটা পরে জেনে নেব।

অধ্যাপক রোহান বলেন, আরে বাবা, রান্না তো এখন আর রিজিড নয়। তোমার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই করো।

মনোয়ার বলে, রোহান ঠিকই বলেছেন, রাঁধার এখন আর ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনুন, আমার ফুফু শ^শুরবাাড়িতে গেছেন, রান্নায় ছিলেন একদম আনাড়ি। শাশুড়ি রাঁধতে বলেছেন বউমাকে, কী আর করা। আগে তো বাটা মসলা ইউজ করতো সবাই। মুরগিতে

হলুদ-মরিচ-জিরে দেওয়ার পর ফুফু অনেকটা সর্ষে বাটা দিয়ে দিলেন।

শাশুড়ি অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে বললেন, এ কী করেছো বউমা? গোশতে কি সরিষা দেয়? তোমার মা মুরগি রাঁধাও শেখায়নি?

সালমা ফুফু একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে জবাব দিলেন,  কেন আম্মা, আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই সর্ষেবাটা দিয়ে মুরগি রাঁধা হয়।

 মেহেরউন্নিসা বলেন, মনোয়ারের গল্পটা সিগনিফিকেন্ট। এখন তো আমরা সর্ষে ইলিশের মতো সর্ষে মুরগিও খাই।

হাসিতে-গল্পে-বিতর্কে-গসিপে কেটে যায় আনন্দসন্ধ্যা।

সবাই একে একে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেছে একটু আগে।

ফুলের গন্ধমাখা শূন্যঘরে সানা একা বসে রইল। মনে শুধু জেগে থাকে  এতক্ষণকার নারী-যন্ত্রণার কথাগুলো।

কোথাও কোনো সাড়া নেই এখন। কিচেনে পেয়ারা আর জেবু ক্রোকারিজগুলি ধোয়া-মোছা করছে – তারই টুকটাক আওয়াজ। খাবারের মিশেল সুঘ্রাণ আর ফুলের ম-ম গন্ধ উন্মনা করে তোলে নওশিনকে।

‘বাবাও তো পুরুষ মানুষ।/ সে কেন মা অন্যরকম হয়? -’ পঙ্ক্তিটি ওর বুকের ভেতরে কড়া নাড়তে থাকে। এর সঙ্গে মেহমানদের টুকরো-টুকরো

কথা-হাসি-গান দু-কানে ঝমঝম করে বাজছে যেন এখনো।

এমনি করেই কোনো পারিবারিক উৎসবে, চায়ের আড্ডায়, কফির আসরে কিংবা শীতের রাতের জমায়েতের মাঝে আলোচনায় উঠে আসবে সাম্প্রতিক নানা ঘটনা। শেয়ারবাজারের ধস, ব্যাংকের অনিয়ম, চীন দেশের ভাইরাস, মেলায় আসা নতুন বইয়ের আলোচনা, অ্যাডোলেন্স পিরিয়ডের অবাধ্যতা, মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্বহীনতা নিয়ে কথা বলতে বলতে উঠে আসবে নারী-নিপীড়নের কথা। দৈনন্দিন জীবনের হাজারো ঝুট-ঝামেলায় তা আবার হারিয়েও যাবে।

মোবারক-মনোয়ার, রিমো-মিমো গভীর ঘুমে ডুবে আছে। কারো সাড়া নেই এখন। কিচেন থেকে শুধু ভেসে আসছে কল থেকে পানি পড়ার কলকল আওয়াজ।

গিজারের সুইচ অন করে নওশিন ভাবে, ফ্রেশ হয়ে কফিতে চুমুক দিলে ভালো লাগবে। জেবুকে বলার জন্য কিচেনের দিকে পা বাড়ায় সানা। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। এতজন গেস্টকে সুচারুভাবে এন্টারটেইন করা সহজ নয়।

– শইলে হাত দ্যান ক্যা? খবরদার কইতাছি শইলে হাত দিয়েন না।

এ সময় কিচেনে জেবু আর পেয়ারা ছাড়া আর কারো থাকার কথা নয়। এসব হচ্ছেটা কী?

নওশিনের নজরে পড়ে বেসিনে প্লেটগুলি ধুয়ে র‌্যাকে রাখছে জেবু। ঝাঁকড়া চুলো খোরশেদ বাবুর্চি, মাথায় লাল গামছার ফেট্টি বাঁধা – দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

সানার পা দুটি আটকে থাকে টাইলসের মেঝেতে। খোরশেদের এ-সময় বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। অসহায় ক্রোধে শরীর কাঁপতে থাকে নওশিনের। অসভ্য জানোয়ার একটা।

কী অদ্ভুত এই পৃথিবী। একটি মেয়েকে একদঙ্গল পুরুষ নিপীড়ন করবে, এরপর শ^াসরোধ করে মেরে ফেলবে। প্রমাণের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে সেই শরীর।

তাহিরপুর গাঁয়ের এই জেবু – জেবউন্নিসার ব্যাপারটিও তাই হয়েছিল। প্রাণে বাঁচা মেয়েটিকে কোনো রকমে আম্মা ঢাকায় ওর বাসায় নিয়ে এসেছিলেন।

দোয়া করে বলেছিলেন, তোর ভালো হবে রে সানা, দেখিস। নিরাপদে থাকবে তোর বাড়িতে। দু-মুঠো ভাত খেতে দিবি, ওর মান-ইজ্জত যেন বেঁচে থাকে জেবু।

সত্যি প্রচুর খাটতে পারে মেয়েটি। পুরনো বয়স্ক বুয়া পিয়ারা তো আছেই। এ-বাড়িতে পেট ভরে খেতে পায়। বিশ^াসী এই জেবু ওর ডান হাত হয়ে উঠেছে।

আত্মতৃপ্তিতে এতদিন বুঁদ হয়ে থেকেছিল সানা। ‘গোধূলি’ নামের ডুপ্লেক্স, যে-বাড়িটি গুলশানের তিন নম্বর রোডে দাঁড়িয়ে আছে – এখানে নির্যাতিত জেবউন্নিসাকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পেরেছে, এই ভেবে বড়

আত্মতৃপ্তিতে ছিল সে।

নিরাপদ আশ্রয়! কী শূন্যগর্ভ এ দুটি শব্দ। জেবুর তীক্ষèস্বর শোনা যায়, কাম করনের উছিলায় যহন-তহন বুকে হাত দ্যান ক্যা?

– আরো দিমু, কী করবি তুই? পেয়ারা খালারে ডাকবি? বেগম সাবরে কইবি? ক গিয়া, কেউরে আমি ডরাই না।

খোরশেদ এমনভাবে আস্ফালন করে যেন জেবুর শরীরে হাত দেওয়া ওর জন্মগত অধিকার।

আচমকা নওশিনকে অসময়ে কিচেনে এসে দাঁড়াতে দেখে চমকায় খোরশেদ।

কঠিন গলায় নওশিন বলে, বাড়ি যাও খোরশেদ, সকালে চলে এসো।

আজকের সান্ধ্য আসরে মালবিকা সত্যিই বলেছেন, সেই পৌরাণিক যুগ থেকে শুরু হয়েছে নারী-নিপীড়ন। সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরও রামচন্দ্র স্ত্রীকে মেনে নেননি, বসুমতী দু-ভাগ হয়ে দুঃখিনীকে আশ্রয় দিয়েছেন।

বুক মন্থন করা নিশ^াস ফেলে নওশিন। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে থাকে। হায়! দুর্গের মতো সুরক্ষিত ডুপ্লেক্সেও মেয়েরা নিরাপদ নয়।

ভাবনার এই মুহূর্তে মনোয়ার এসে আচমকা জাপটে ধরে ওকে।

চারপাশে হালকা সবুজ আলো-আঁধারি ছায়া। স্বামীর আগ্রাসী চুম্বনে নিশ^াস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে ওর।

কাম অন ডিয়ার – বলে প্রায় টেনেহিঁচড়ে বিছানায় আছড়ে ফেলে।

– কী করছো মনোয়ার? আর ইউ আ ডেড ড্রাংক?

 প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়,

মায়া-মমতা-স্নেহ একবিন্দুও নয়, এ-অধিকারে আছে শুধু পৌরুষের অহংকার।

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো নির্মম হাতে মনোয়ার ছুড়ে ফেলতে থাকে পরনের কাফতান। লঁজারি ছুড়ে ফেলে মেঝেতে।

ফোর্সিবল সহবাসের আরেক নামই তো রেপ। সম্মতিবিহীন শরীর ভোগ করাও ধর্ষণ।

তাহলে জেবু আর ওর মাঝে তো কোনো তফাৎ নেই।

অনেকটা সময় ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইল নওশিন। শরীরের

শিরায়-উপশিরায় বয়ে যাওয়া ক্রোধ-ক্ষোভ-দুঃখ আর অভিমানের উষ্ণতা কিছুতেই কমছে না।

কিছুক্ষণ পর হালকা নাইটি পরে বেডরুমে পা রাখে।

মনোয়ার ঘুম-জড়ানো আদুরে স্বরে বলে, ঘুমোতে এসো সানা।

বিছানার দিকে তাকিয়ে বমির ভাব হতে থাকে তার।

ফুলের গন্ধমাখা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় ও। মধ্যরাত। শুল্কপক্ষ এখন আকাশে সোনালি থালার মতো চাঁদ। ঢলেপড়া রাতে ওর মনের দুঃখ-বেদনা নিয়ে স্ট্রিট লাইটগুলো হলদে আলো ছড়াচ্ছে।

 কোথাও হঠাৎ বুঝি কোকিল ডেকে উঠল। রাতের স্তব্ধতার মাঝে এ সুর যেন বয়ে নিয়ে আসে বহু দূর থেকে আব্বুর স্বর, – মাই ফেয়ারি কুইন।