ঠিক মনে নেই, বেশ কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর বাসায় কফি পানের সময় কাপটা চোখে পড়ে ফজলের। এটা অরিজিনাল কফিকাপ। বিশ^খ্যাত কোনো এক কোম্পানির কফি, তারা নিশ্চয় স্যুভেনির হিসেবে দিয়েছে। কাপটি চারকোনা। সাধারণত কাপ হয় গোল, এ-ধারার গড়ন ব্যতিক্রম। কফি কোম্পানি সেই ব্যতিক্রমটির শরণাপন্ন। আর এ-কথা সত্য যে, মানুষ মাত্রই নতুনের প্রতি আগ্রহী। সর্বজনীন। কাপটা শুধু গড়নেই চমৎকার নয়, রংও নয়ন-উদ্দীপক – টকটকে লাল। কালচে নয়। উজ্জ্বল। চিত্রকরদের ভাষায় ভার্মিলিয়ন। লালের যে কত স্তর আছে তা রঙের কারবারি ছাড়া অন্যরা বুঝবে না। সংগীতের রাগ-রাগিণীর মতো। একটা স্বরের এদিক-ওদিক হওয়া মানে ভিন্ন দ্যোতনা। শুদ্ধ – কড়ি ও কোমলের মারপ্যাঁচ। তখন থেকেই ফজলের বাসনা অমন একটা কাপ তার প্রয়োজন। সকালে সে কফি পান করে গ্লাসে। এখন বন্ধুর হাতের কাপটা দেখে তার নিজের কফিপানকে কেমন যেন একটু পানসে মনে হয়। কাচের গ্লাস কি কফির স্বাদ বদলে দেয়? তা তো নয়। নাকি কফির কাপে কফি পান করলে তার স্বাদ বেড়ে যায়? তবে সে সিদ্ধান্তে আসে যে, গুণগত মানের হেরফের না হলেও মানসম্মত একটা উপলব্ধি আছে। মূল কফিকাপে কফি পান করলে আমেজ একটু যে বৃদ্ধি পাবে তাতে সন্দেহ নেই। অন্তত তার বুঝে। 

এরপর থেকে মূল কফিকাপের খোঁজ করে চলেছে ফজল। ঢাকার নিউমার্কেটে অনেক বিপণি। কফির অভাব নেই। তবে সবই শুধু কফি … কাপের গন্ধ নেই। সে অনেক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা, কোম্পানি আপনাদের কাপ দেয় না? আমি তো আমার বন্ধুর বাসায় কাপ দেখেছি।

না, আমাদের দেয় না, দোকানদারের উত্তর। তবে হ্যাঁ, ইন্ডিয়াতে নাকি একশ বা দুশো গ্রাম কফি কিনলে অনেক সময় মগ দেয়। তবে সব সময় নয়।

এটা তো বিক্রির একটা নীতি। একটা কিনলে একটা ফ্রি বা সঙ্গে কিছু উপহার।

আপনারা কখনো কোম্পানিকে বলেননি, আমাদের যেন দেয়।

আমরা বলেছি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

ইন্ডিয়ায় দেয়।

স্যার, ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা হয় না।

ফজল চুপ করে যায়। দোকানদার তার চেয়ে অনেক বাস্তববাদী। সে কফিকাপের চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চায়, কিন্তু পারে না। তার মাথায় ভাবের উদয় হয়, ছোটভাই মানিক তো আনতে পারে! ওর তো আগামী মাসে আসার কথা।

ইউরেকা, বলে সে আর্কিমিডিস হয়ে যায়।

দু-মাস পর জ্ঞাতিভাই মানিক তার ইচ্ছা পূরণ করে। একশ গ্রাম কফি, সঙ্গে লাল মগ।

সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। আনন্দ দেখে কে! তার হাতে একটা মূল কফিকাপ। সে নিজেকে বি^াস করতে পারে না। সিরামিকসের পাত্র, তবু সে শুঁকে দেখে … যে-কোনো নতুন জিনিসের একটা গন্ধ থাকে। কাপ নাকে কফির গন্ধ ঢালে। আর কি-ই বা হতে পারত। একশ গ্রামের কফির প্যাকে গন্ধ তো কফিরই হবে। তবু নতুনত্ব বলে একটা কথা আছে। সবকিছুই পুরোনো হয়ে যায়। সময়ের প্রলেপে। এবং একসময় নতুনও থাকে। নতুন-পুরনো এক সুতোয় গাঁথা।

কাপটার প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেল ফজলের।

ব্যবহার না করে বইয়ের র‌্যাকের সামনে রেখে দেয়। আর মানিককে নির্দেশ, আবার যখন আসবে দুটো কাপ যেন আনে। সৌভাগ্যক্রমে তিন মাসের মধ্যে মানিক আবার আসে আর অগ্রজের মনোস্কামনা পূর্ণ করে। মোট তিনটে কাপ নিয়ে ফজল আত্মহারা। কিনে ফেলে একটা কাপ রাখার স্ট্যান্ড। অবশ্যই প্লাস্টিকের। ছটি দণ্ড খাড়া। তার মধ্যে তিনটিতে সাজায়। কিন্তু তার মন ভরে না। কেমন যেন খালি খালি লাগে। গ্রাফিক ডিজাইনের জ্ঞান তাকে পীড়া দিয়ে চলে। কোনোমতেই খালি ভাব ভরাতে পারে না। অগত্যা এই প্রচেষ্টাকে জলাঞ্জলি।

মানিককে স্পষ্ট উচ্চারণ।

শোন মানিক, আরো তিনটে কাপ চাই।

তথাস্তু।

ভক্ত দেবতাকে আশ^াস দেয়।

এসে গেল করোনা। ভয়ানক এক ছোঁয়াচে রোগ। প্রাণঘাতী। কোনো ওষুধ জানা নেই। ত্রাণকর্তা একমাত্র

ড্রাগিস্ট-কেমিস্ট। উন্নত-অবনত সারাবিশে^ তোড়জোড়। ভ্যাকসিন চাই, ভ্যাকসিন।

রোগটি প্রথম ধরা পড়ে চীনে; উহান প্রদেশে। উড়োজাহাজ সারাবিশে^ বাহক হয়ে দাঁড়ায়। অল্পদিনে করোনা বিশ^-মহামারিতে রূপান্তরিত। ম্যালেরিয়া-কলেরা-প্লেগের মতো, যা এশিয়ান ফ্লু’র সঙ্গে তুলনীয়। তবে এটা মারাত্মক শ^াসকষ্ট জন্ম দেয়। প্রাণঘাতী।

মানিকের অনুপস্থিতি গেল প্রায় তিন বছর। ফজলের আশা অপূর্ণ। অনেকটা নিষ্প্রভ। শখ কতদিন টাটকা থাকে। বরফ দেওয়া মাছের মতো ফ্যাকাসে ও স্বাদ হারাতে থাকে।

এমন সময় মানিকের ফোন। সে কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা আসবে। বিশেষ কিছু লাগলে জানাতে অনুরোধ।

ফজল এক নিশ^াসে বলে, দুটো কফিকাপ।

ঠিক আছে দাদা।

ফজল খুশিতে চঞ্চল। চাই আরো তিনটে কাপ! ভাবা যায়! তার মিশন পূর্ণ হতে চলেছে। হতে চলেছে কেন, হয়েই গেছে বলতে গেলে। বয়স বেশি, না হয় নাচত।

দাদা, আর কিছু?

না, আর কিছুর দরকার নেই।

তিনদিন পর মানিকের উপস্থিতি। তার ট্রলি খুলে প্রথমেই তুলে দেয় কফিকাপ আর দুটি একশ গ্রামের কফির কৌটো।

ফজল পরিচ্ছন্ন কাপ দুটো তোয়ালে দিয়ে মোছে। তারপর স্ট্যান্ডে বাকি  তিনটের পাশে রাখে। বেশ ভরাট লাগে স্ট্যান্ডটা। তবু একটা খালি। এখন যেন এই খালিটা বেশি বড় হয়ে দেখা দেয়।

আচ্ছা মানিক, তুমি আবার কবে আসবে?

দাদা, মাস তিনেক পর। একটা ব্যবসার কথা চলছে পার্টির সঙ্গে।

আচ্ছা।

মনে স্বস্তি। ফজল ভাবে, যাক তিন মাস পর তার কফিস্ট্যান্ড পূর্ণ হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে যাবে। তিন মাস মানে তো নব্বই দিন। শুরু হলে শেষ হতে আর কদিন। এক, দুই, তিন, একুশ, বাইশ … আশি, একাশি, বিরাশি … নব্বই … কফিকাপের স্ট্যান্ড পূর্ণ।

আর একটা নতুন ভাবনা পেয়ে বসে। আচ্ছা, এই স্ট্যান্ডটা পূর্ণ হলে কী করবে? আর কি কাপ আনাবে না? কিন্তু সে তো নিত্য কফি পান করে। তখন ঢাকা থেকে কফি কিনবে … গ্লাস নেই। ঝামেলাও নেই। কিন্তু ঢাকার তুলনায় কলকাতায় দাম অর্ধেক। মানে কাপসমেতই অর্ধেক। তাহলে মানিকের ওপর দুশো চাপালে একসঙ্গে অনেকটা আসছে। হচ্ছে সাশ্রয়, আর ফাউ কাপ; কিন্তু স্ট্যান্ড তো ছ’টির।

আচ্ছা স্ট্যান্ড ভরুক তারপর অন্য চিন্তা। ঠিক তিন মাস পর। মানিক উপস্থিত। সঙ্গে একটি কফিকাপ ও বোতল। কফিপূর্ণ। ফজল কাপটা সটান স্ট্যান্ডে রাখে।

দেখ মানিক, স্ট্যান্ড পূর্ণ।

বাহ্! বেশ মানিয়েছে।

তাহলে উদ্বোধন হোক। গৃহকর্মী আলোর মায়ের প্রতি হাঁক : জল গরম, কফি … দু-কাপ … মানিকের অনারে …

সারাঘর কফির গন্ধে ভরে ওঠে। এ-গন্ধ চায়ের চেয়ে অধিক। কফিচাঙ্গা। কাফি হ্যায়। হিন্দুস্থানি ঝাড়ে ফজল।

না দাদা, আমাকেও দেখি কফি ধরতে হবে। এর সুগন্ধটাই আলাদা।

তাছাড়া তোমাদের : হোলি হ্যায় … তো এসেই গেল … এবার কফি হ্যায়, বলে ঝাঁপিয়ে পড়ো।

তাহলে দাদা চায়ের কী হবে?

তা-ও তো বটে আমরা-তোমরা সবাই চা খাই, আর বেচি। কফি শৌখিনতাতেই সীমাবদ্ধ থাক।

ঠিক বলেছেন।

ভরাট স্ট্যান্ডটা ফজল বারবার দেখে। আশ মেটে না। এবার একটা কাপ আছে, যাতে আছে ঢাকনি। আর এর আকার গ্লাসের মতো গোল। এটা কফি খেতে খেতে উঠে গেলে ঢাকনি দেওয়ার জন্যে। যাতে গরম থাকে। বেশ বড়সড়। চারকোনা কাপের চেয়ে ঢ্যাঙা। তবে ওগুলির চেয়ে এলিগেন্ট নয়। প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে সৌকর্য কিছুটা হারিয়েছে।

 বেশ ভালোই কাটছিল ফজলের। কফিকাপের বাসনা পূর্ণ।

এই সময় আলোর মায়ের এক ননদ আসে। সঙ্গে চার বছরের সন্তান দুলাল। দুলাল একমাত্র সন্তান তাই খুবই আদরের। সবার ছোট বলে আদর পায় বেশি। থাকে জয়দেবপুরে। ভাড়া বাড়িটা দুলালের জন্যে ছোট। দৌড়ানোর জায়গা কম। ফজলের ফ্ল্যাটে সে মনের আনন্দে দৌড়ায়। দৌড়ায় নতুন কেনা গাড়ি নিয়ে। গাড়ি যত না চলে তার চেয়ে গর্জায় বেশি। গানও হয়। একঘেয়ে পপ সুর। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ফ্ল্যাট। ফজল উপভোগ করে। বাড়িতে সব বড়রা। হঠাৎ শিশু জীবন ফুটিয়ে তোলে। নতুন জীবন।

ওদের থাকা খুবই অল্পদিনের।

দুদিন পরই দুলালের বাবা তাদের নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় অবশ্য দুলাল জেদ ধরে, সে এখানে থাকবে। যাবে না। ঘ্যানঘ্যান করে মা-বাবার সঙ্গে লিফটে ওঠে। রাস্তা খালি পাওয়ার জন্যে ওরা দশটার মধ্যে রওনা দেয়।

সন্ধ্যায় আলোর মা একটা নিখোঁজ সংবাদ শোনায় ফজলকে।

একটা কফিকাপ দেখতে পাচ্ছি না।

চমকে ওঠে ফজল।

খাবার টেবিলের পাশে রক্ষিত কফিকাপ স্ট্যান্ডে দেখল এককোনা ফাঁকা।

কী হতে পারে?

সবার মনেই একই প্রশ্ন।

আচ্ছা, আমরা যখন ছিলাম না, দুলালের ধাক্কায় ভেঙে যায়নি তো! বলে আলোর মা।

কিন্তু ওর মা তাহলে তো আমাদের জানাত। সুমি তো খুব সৎ মেয়ে। লুকিয়ে রাখত না। বলে ফজল।

তারপর সে গোয়েন্দাগিরিতে লাগে। কোনো টুকরো পড়ে আছে কি না র‌্যাকের ওপরে ও নিচে পর্যবেক্ষণে লাগে।

না, তেমন কিছু পাওয়া গেল না।

মনটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেল ফজলের। সে আলোর মাকে বলে, আলোর মা, তুমি ওই ঢাকনিঅলা কাপটা পছন্দ করেছিলে, ওটা তোমাকে দিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালে সে ছোট ভাইপো রূপেনকে ফোন করে।

: হ্যাঁ, বড় চাচা কেমন আছেন?

: ভালো। তুমি একবার আসতে পারবে?

: হ্যাঁ, পারব। কী ব্যাপার!

: এলে বলব।

বাকিটা কি আর বলার আছে? ফজল তার এক হালি কফিকাপ ভাইপোর হাতে তুলে দেয়।