সম্পাদকীয়

জীবনের বহুমাত্রিক দিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছোটগল্পে। বাংলা সাহিত্যের এই ধারায় বিস্তৃত পরিসর ও পটভূমি নিয়ে মানবজীবনের নানা অনুষঙ্গ প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পে মননধর্মিতার সঙ্গে সাধারণ লোকজীবন-উপলব্ধিকে প্রসারিত চেতনায় বিস্তৃত করেছিলেন। তাঁর হাতেই বাংলা ছোটগল্প সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের চেতনাধারায় স্নাত হয়ে গল্পের ভুবন আরো সমৃদ্ধ ও বিচিত্র বৈভবে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে বেশ কয়েকজন গল্পকারের গল্প ছিল জীবনচেতনার দিক থেকে অতলস্পর্শী এবং নবীন জিজ্ঞাসার বিচ্ছুরণে দীপ্ত।

বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্প নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে যেসব ছোটগল্প রচিত হয়েছিল তা প্রধানত  ছিল জীবনের উত্তাপলগ্ন। এসব গল্পের মধ্যে গ্রামীণ ও নাগরিক মানুষের বৃহত্তর জীবনসংগ্রাম ও বেঁচে থাকার আর্তি প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রেম, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছিল। সামরিক শাসন, প্রথার কর্তৃত্ব এবং বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতা কথাসাহিত্যের সৃজনধারাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ-অঞ্চলের নদী, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছোটগল্পকারদের নিবিড় সংযোগের ফলে এবং জীবনবোধের প্রয়োগে ছোটগল্প তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানাভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

ষাটের দশকে এই অঞ্চলের বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও বাঙালিত্বের সাধনা যখন স্বদেশনির্মাণের আকাক্সক্ষায় উদ্বেল, তখন থেকে তাঁদের হাতে ছোটগল্পের ধরনও পাল্টাতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জীবনের নানা সূক্ষ্ম সংবেদনশীল জিজ্ঞাসার উন্মোচন পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। মনন ও শিল্পের দিক থেকে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় ছোটগল্পে। জীবন-অভিজ্ঞতার মনোগ্রাহী দলিল হয়ে ওঠে সাহিত্যের এই ধারা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের ছোটগল্পকারদের মানসভুবনকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে তাই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ছোটগল্প রচিত হয়।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভুবনে বর্তমানে নবীন বেশকিছু শক্তিশালী গল্পকারের আবির্ভাব আমাদের অবশ্যই আশান্বিত করে। সমকালীন জীবনচেতনা ও সংগ্রাম এবং জীবনোপলব্ধির নতুন বিন্যাস প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁদের সৃষ্টিতে।

কালি ও কলম জন্মলগ্ন থেকে যত্নের সঙ্গে নানান ধারার ছোটগল্পের পরিচর্যা করে আসছে। বাংলাদেশের নবীন গল্পকারদের সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াসকে উৎসাহিত করার জন্য যথাসম্ভব কাজ করেছে।

বর্তমান সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের সেই চর্চা ও সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে চেয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করতে। বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে নবীন ছোটগল্পকারদের রচনার প্রতি। তাঁদের মধ্যে যে-প্রাণশক্তি, বিশ^স্ত জীবনচেতনা, সমাজ-অঙ্গীকার ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রমণের ঐকান্তিক প্রয়াস আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা আমাদের গল্পের ভুবনকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলবে – এ আমাদের প্রত্যাশা।

এই সংখ্যাটি বিংশ বর্ষ দ্বিতীয়-তৃতীয় যুগ্ম সংখ্যা (মার্চ-এপ্রিল ২০২৩) হিসেবে প্রকাশিত হলো।