পাঠকের অন্বেষণ

দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা l পিয়াস মজিদ l পাঠক সমাবেশ l ঢাকা, ২০২০ l ২৫০ টাকা

কবিতা ও চিত্রকর্ম অনেকটা টাকার মতো। যখন যার হাতে তখন তার। অথবা বলা যায় এই দুই গোত্রের শিল্পকর্মের বহু জন্মদায়িনী। যেমন : বনলতা সেন কিংবা মোনালিসা – জীবনানন্দ দাশ আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মানসজাত। অথচ বোদ্ধাগণের ব্যাখ্যায় বিচিত্র ভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত এই শিল্পকর্মের নবতর জন্ম হচ্ছে। কবিতা, চিত্রকলায় যুক্তির চেয়ে আবেগের আতিশয্য বেশি। তাই কোনো কবি বা শিল্পী কখনোই চূড়ান্ত করে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না আসলে তিনি এখানে কী বলতে চেয়েছেন। কারণ যুক্তি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আবেগ মিশে যায় শিল্পকর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আবেগের সেই অদৃশ্য ঘনত্বকে অতিক্রম করা কোনো শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব নয়।

দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ নিয়ে কবি পিয়াস মজিদ নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কথাটা সম্ভবত ছিল কবিতা ও মধ্যাহ্নের অর্থাৎ শাব্দিক সম্ভার ও সময়ের দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে যোগ-সংস্থাপন বা তুলনা প্রসঙ্গে। আমি সেদিকে যাবো না। পাঠক হিসেবে নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েই শুরু করবো। বইটি হাতে নিয়েই আমার লেখকসত্তা সবার আগে আচ্ছাদনের শুষ্ক শাখার জটিলতা আর দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতার মধ্যে অদৃশ্য একটা যোগসূত্র অনুভব করে। মানুষী জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রহর মধ্যাহ্ন। তা চব্বিশ ঘণ্টা বা একদিনের মাপকাঠিতে হোক আর জীবন-বয়সী সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করলেও সবচেয়ে দীর্ঘতম কালক্ষেপণ মধ্যবয়সটা। অর্থাৎ দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা দিয়ে কবি যদি কবিতার দৈর্ঘ্য আর কবির মানসভাবনার দীর্ঘ পথকে বোঝাতে চান, তবে সে যোজন অসম্ভব কিছু নয়।

কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির ‘সমাধিবিতান’ নামের অভিনবত্বে মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে ভেতরটা উন্মোচনে। কবি সমাধির সঙ্গে বিতানের সংযোগ ঘটিয়েছেন। কেমন যেন বৈসাদৃশ্য-সাদৃশ্য। কিন্তু প্রথম পঙ্ক্তিতেই ওই প্রভেদ পাঠ স্পষ্ট হয়ে গেল, যখন কবি নিজস্ব বয়ানে মগ্ন –

স্বপ্ন আর বাস্তবের দ্বন্দ্বে ভুলেছিলাম ফাল্গুনও এক বাস্তব যেমন স্বপ্নও আরেক পরম বাস্তব।

এই স্বপ্ন-বাস্তবের যৌক্তিকতা খুঁজতে গিয়ে কবির তীব্র উপলব্ধি –

কিন্তু বেঁচে থাকতে গিয়ে দেখলাম মানুষ মূলত অদ্ভুত শুধু পক্ষ খোঁজে

কাউকে জয়টিকা দেয় সে অপর কাউকে পর্যুদস্তের বাসনায়

কবিতার শুরুতেই হুমায়ুন আজাদের কবিতার ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবতা যেন পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কবি পিয়াস মজিদ ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।’

আসলে ‘সমাধিবিতানে’র প্রথম পঙ্ক্তি ধরেই কবি স্বপ্ন-বাস্তবকে স্পর্শ করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব জীবনাভিজ্ঞতায় এই একবিংশ শতাব্দীর জীবনবাস্তবতার মনোজগৎ ব্যবচ্ছেদের প্রয়াস নেন। চিরন্তন মানুষ ভাবনা কবিকে হোর্হে লুই বোর্হেসের মানস-সহচর করে দেয়। সমাজ তখন বিস্ময় উৎকণ্ঠার নেপথ্যে ঈর্ষান্বিত কবিকে নিয়ে, আর পরিজন স্নেহার্দ্র ভাবকাতর Ñ

আমার বন্ধুদের বিস্ময় কী করে আমি

                    এতো সুস্থ স্বাভাবিক

আমার পরিবার স্বজনদের দুঃখ আমি

                 ছেলেটা কেমন পাগলধারা!

তারপর পাঠকের উদ্দেশে কবির প্রশ্ন, আবার প্রশ্নও নয়। এ এক ধরনের মনোসংযোগ। যখন তিনি বলেন – ‘কী করব বলুন?’

এভাবে কবি দ্বিমুখী দৃশ্যপটের মুখোমুখি হয়ে তাঁর মানসদ্বন্দ্বের কথা বলে যান। অতঃপর এই মনোদ্বন্দ্বের সমাধান নিজেই দেন –

ঝু

  লে

   থাকি

     ত্রিশঙ্কু

এই ঝুলে থাকার ‘শব্দচিত্র’ অবচেতনেই যেন পাঠকমনে ত্রিশঙ্কু জীবনবাস্তবতার দৃশ্যপট খোদাই করে দেয়। শব্দ আর বোধের এ এক অভিনব সজ্জা!

না অন্ধকার। না আলো

ঝুলে থাকি শুধু

এই আলো-অন্ধকারের বিভ্রান্তি আর ঝুলে থাকার শূন্যবোধে যেন কবিতাপ্রেমিক পাঠক চকিতেই জীবনানন্দের আলো-অন্ধকারকে খুঁজতে শুরু করবেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর যুবক কবি পিয়াস মজিদ, উনিশ শতকের আলো-অন্ধকারের ধোঁয়াশাবোধকে ছাপিয়ে নতুন এক জীবনের হাতছানিতে যেন অন্য এক ভ্রমের জালে আটকে যান। শেষ পর্যন্ত স্মৃতি তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘বহ্নিজল’। এ যেন কবির জগতে দৃশ্যমান মিথুনরত বহ্নি আর জল! এই ত্রিশঙ্কুর ধূম্রজাল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কবি দ্বারস্থ হন শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাছে। যুদ্ধকালীন জীবন ও রাজনীতির বাস্তবতা কবিকে সমাধান ধরিয়ে দিলেও অস্থির সময়ের পথিক কবি, সূর্যবংশীয় রাজার মতন নিজেও ‘ত্রিশঙ্কু’ অবস্থা থেকে মুক্তি পান না। মনোসংকট, বিভ্রান্তি আবারো ভর করে তাঁর জাগতিক চেতনায়। আত্মঘাতী কবি সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে তিনিও বলেন, ‘Dying is an Art’; কিন্তু মানিকের গল্পের মতন ‘আত্মহত্যার অধিকার’ তিনি পান না। জীবনানন্দের ‘সোনালি ডানার চিল’ নয়, বরং একবিংশ শতাব্দীর আবহে উড়ন্ত, কবির নিজস্বজন ‘ফিরোজা চিল’কে তিনি প্রশ্ন করেন –

হায় চিল, ফিরোজা চিল!

বল তো কোথা যাই?

এভাবে ক্রমাগত পথ খোঁজার ফেরিওয়ালা কবিমানস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’-এ পথের সন্ধান পেয়েও নতুন মোড়ে বাঁক নেন যৌবনের শাপগ্রস্ত দায় এড়াতে, মুক্তি খোঁজেন শব্দের ভাঁজে, কবিতার আত্মায়-মুখবন্ধে। রূপকথার ঠাকুরমার ঝুলি, বিনোদিনী কুঠি – কোথাও শেষ পর্যন্ত কবি স্বস্তি পান না। তাঁর মন ‘সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে ভেসে যেতে চায় দূরদেশে’; কিন্তু অতঃপর স্বপ্নাসক্তিহীনতা কবিতে স্মরণ করিয়ে দেয় – ‘বাজার পৃথিবীতে সমুদ্রকল্লোল পর্যন্ত অবিক্রীত নয়’ এবং ‘আমি জগতের মূল্যবান ক্রেতাগুণরিক্ত’ – এই উপলব্ধি কবিকে আত্মপ্রশ্নবিদ্ধ করে –

কোথায় পাব তারে

বেঁচে থাকার নন্দনকে?

সিলভিয়া প্লাথের আত্মবিনাশের পথ ছেড়ে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যন্ত্রণাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অনিকেত ভূমির অশান্ত, বিভ্রান্ত সন্তান, কবির শিল্পমানস তবু শব্দের বেসাতি থেকে মুক্তি পায় না, যদিও সে জানে বিশ্বম্ভরের ‘জলসাঘরে’র বেলোয়াড়ি ঝাড় ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে সেই কবে! আবারো মরণবাসনা ভর করে কবিমনে। আত্মপ্রশ্নবিক্ষুব্ধ কবি, ‘মরে গেলে বেঁচে গেলে?’ কিন্তু নির্মম পুঁজিবাদী পৃথিবীর মুমূর্ষু গদ্য, ত্রিশঙ্কু কবির পদ্যকে ঝুলিয়ে রাখে অগ্নিশূন্যে। কারণ মরে যেতে যেতেও কবি জানেন –

তোমার বর্ধিষ্ণু পুঁজি শীঘ্রই কিনে নেবে সমাধি আমার।

এভাবেই কবি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মানসজগৎ পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে এক দয়াহীন জীবনসত্যের মুখোমুখি হন, আর তা হলো মৃত্যুও তাঁর নিজস্ব নয়। বেঁচে থাকাও অন্য কারো! ‘Waste land’-এর মতো ‘সমাধিবিতানে’র জমিনেও কবি সমাধির চাঁদোয়া বিছিয়ে জীবনের ধূসরতার ছবি আঁকেন। সবশেষে ঠিক তার মধ্যিখানে ‘ত্রিশঙ্কু এক আত্মা’ হয়ে ঝুলতে থাকেন।

শব্দের পিঠে শব্দ-ইটের গাঁথুনি, মাঝখানে পর্যাপ্ত আলো-হাওয়ার পরিসর রেখে বানানো পিয়াস মজিদের দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ। তার ঠিক মধ্যিখানে শব্দার্থ আর ভাবার্থের ঠাসা বুননে তৈরি কবি পিয়াসের কাব্যের সুদৃঢ় পিরামিড। প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দ স্পর্শ করে করে চূড়ায় পৌঁছাতে হয়। এ অনন্য কৌশল কবির নিজস্ব শক্তি, যা পাঠকের মনোজগৎকে গভীর আসক্তিতে টেনে ধরে।

যখন কবির কাছে ‘জীবনানন্দ : আমার অসুখ ও আরোগ্য’ তখন তিনি রোগমুক্ত হয়ে জীবনীশক্তি অন্বেষণ করেন ‘অপুষ্পক উদ্ভিদের ছায়া’য়। সেখানে কথোপকথনের শব্দশিল্পে নারী খোঁজে পুরুষের কাছে ‘জীবনমৃত্যুর শ্রেষ্ঠতম অর্কেস্ট্রার শুদ্ধতম সুরতরঙ্গ’।

‘গোলাপের অভিঘাত’ কবিতায় কবি ‘একটি গীতিময় মৃত্যুর মোহে কাটায় গদ্যধূসর জীবন’; কিন্তু সে-জীবন কি আদৌ তিনি পান? কুয়াশা আর আলোর আলাপনের প্রক্ষেপণে অনবদ্য এক কবিতা ‘কুরুক্ষেত্রের আলোকুয়াশা’। ‘ফুল্লরা’র বিরহের বারমাস্যা গীতের মিলনমধুর রেশ দিয়ে যেন শুরু এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘মেঘের মঞ্জিল’। মিলন মধুর বিরহ যাপনের লগ্নেও এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দেহখণ্ড কবিকে জানান দেয় – ‘আমার আমির কাছে কতটা অচেনা, সঙ্গহারা নেহায়েত এই আমি।’

তথাপি কবি সুন্দরকে দেখেন, আনন্দে মন ভরান, জীবনের অফুরানকে আলিঙ্গন করেন। তারপর, ‘মৃতদের ঠেলে আজিমপুর থেকে আমি জোরপূর্বক ঢুকে পড়ি জীবনের দিকে’। এবং ‘সমাধিবিতানে’র চাঁদোয়া সাজাতে সাজাতে শেষ পর্যন্ত কবি বেঁচে থাকে মৃত্যুর নীল আভার উৎকণ্ঠা নিয়ে নয় বরং অনন্য উজ্জ্বল জীবনাভ নিয়ে।

কবি পিয়াস মজিদের দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতার দীর্ঘতম ব্যবচ্ছেদ করে অবশিষ্ট পঞ্চ কবিতার মূল নির্যাসটুকুর শুধু মুখোন্মোচন করেছি। রসাস্বাদনের ওই সূত্রটুকু ধরে গভীরে ঢুকলেও পাঠক বঞ্চিত হবেন না। তবে সত্যিকথা বলতে হলে বলবো, আসলে ওই সূত্র ধরে প্রবেশ করলেও যার যার মানুষীবোধ মন-মনন আপন গতিতেই চলবে। সেখানেই অনায়াসে স্রোতের খোঁজ পাবেন। স্থবির হবেন না। কবির দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা নামক কাব্যগ্রন্থের বস্তুগত দেহখণ্ডটি ছিমছাম, অকপট, নির্ভার। প্রকাশক পাঠক সমাবেশের প্রকাশনা ঘরে চিত্রশিল্পী সেলিম আহ্মেদের মনোগ্রাহী প্রচ্ছদ, স্নিগ্ধ কবি-ছবি, সার্বিক অঙ্গসজ্জা, বানান, বাঁধুনীসহ মুদ্রণের, নির্মাণের সর্বত্র নিবিড় পরিচর্যার ছাপ সুস্পষ্ট। গ্রন্থটির আরেকটি অপূর্ব বিষয় হচ্ছে, ছয়টি কবিতার পৃথক পৃথক নির্যাসলব্ধ ছয়টি দৃষ্টিনন্দন সাদা-কালো চিত্রকর্ম। এই নান্দনিক চিত্রগুলোর আবেদনে সংবেদনশীল পাঠকের অন্তর্সত্তায় অনুভূত হবে কবিতার শব্দ-শরীরের চিত্রকল্পরূপময় দৃষ্টিগ্রাহ্য, স্পর্শমাখা তীব্র অনুভূতি। মনুষ্যজীবন, মনোদেহের জরা, ক্ষয় দিয়ে কবিতার পথচলা শুরু হলেও আশাবাদী কবি পিয়াস মজিদ যাত্রার সমাপ্তি টেনেছেন জীবনের অনন্য জয় দিয়ে। দুপুরের মতো দীর্ঘ কবিতা কবিতাপ্রেমীদের দুপুরের অবসাদ ঘুচিয়ে প্রভাত তথা জীবনের উজ্জ্বল উদ্ধারে উদ্দীপ্ত করবে – এ আমার পরম বিশ্বাস।