পূর্ব বাংলার সাময়িকীর ইতিহাস-পাঠের অন্তর্বয়ান

বলতে দ্বিধা নেই, মানসম্মত সাময়িক পত্রপত্রিকা একটি আলোকিত সমাজের রূপনির্ণায়ক। সমাজের ভালো-মন্দ, ভাঙাগড়া, চড়াই-উতরাই ইত্যাদি প্রতিফলিত হয় সমকালীন পত্রপত্রিকায়। সেই বিবেচনায় কেদারনাথ মজুমদার-সম্পাদিত ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত মাসিক সৌরভ এমনই একটি সাময়িকপত্র, যা উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের সমাজমানসের এক উজ্জ্বল দর্পণ। সংবাদপত্র যেমন ধারণ করে প্রতিদিনের সংবাদচিত্র, তেমনি সাময়িকপত্র ধারণ করে সমকালীন চিন্তাভাবনা, সমাজচিত্র, সাহিত্যের রুচিপ্রকৃতি ইত্যাদি। এ-প্রসঙ্গে স্মর্তব্য ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গদর্শন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাসী, প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত ইত্যাদি শিল্প-সাহিত্য সাময়িকীর কথা। উনিশ ও বিশ শতকের এসব সাময়িকপত্র আমাদের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির রুচি নির্মাণে পালন করেছে প্রভাবসঞ্চারী ভূমিকা। সাময়িকপত্র সৌরভও পূর্ববঙ্গের শিল্প-সাহিত্যের রুচি গঠনে পালন করেছে প্রভাবকের ভূমিকা।

প্রাবন্ধিক ও লেখক খান মাহবুব সংকলিত ও সম্পাদিত বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত নির্বাচিত সৌরভ নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে সৌরভ সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার সম্পর্কে কিছু কথা বলা আবশ্যক। কেদারনাথের জন্ম ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠ কিশোরগঞ্জের কাপাসটিয়ায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই জেলার গচিহাটা গ্রামে। সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর আগ্রহ স্কুলজীবন থেকেই। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২৭ বছর বয়সে তাঁর পরিচালনায় প্রকাশিত হয় কুমার পত্রিকা। তারপর ময়মনসিংহ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দে বাসনা এবং ১৩০৭ বঙ্গাব্দে আরতি নামে দুটি মাসিক পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেন। বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলন ও প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর ও শেরপুরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী তো ছিলেনই পাশাপাশি ছিলেন সমাজকর্মী, লেখক ও গবেষক। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় তাঁর অবদান সুবিদিত। তাঁর লেখা ময়মনসিংহের ইতিহাস (১৩১২) একটি আকর গ্রন্থ। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ঢাকার বিবরণ (১৩১৬), সাময়িক সাহিত্য (১৩২৪), রামায়ণের সমাজ (১৯২৭), শুভদৃষ্টি (১৩৩০), সমস্যা (১৩৩১), গদ্য সাহিত্য (১৯০১), চিন্তা (১৩১৩), ময়মনসিংহ সহচর (১৯০৮), ময়মনসিংহের বিবরণ (১৩১১) ইত্যাদি।

কেদারনাথ মজুমদার-সম্পাদিত মাসিক সৌরভ পত্রিকা তাঁর অমর কীর্তি। ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক (১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর) মাসে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। একাধারে তিনি এ-পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেন। কেদারনাথ-প্রতিষ্ঠিত ‘রিসার্চ হাউস’ ছিল সৌরভ পত্রিকার আঁতুরঘর। সৌরভের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার ‘আভাষ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে সাময়িকপত্রটির প্রকাশনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে – ‘ময়মনসিংহের শিক্ষিত সমাজের অন্তরে অন্তরে থাকিয়া যে দেবী সাহিত্য চর্চ্চার প্রেরণা করিতেছেন, আমরা তাঁহারই আদেশ শিরোধার্য্য এবং তাঁহারই কৃপা ভরসা করিয়া আগমনীর আনন্দ উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘সৌরভ’ লইয়া উপস্থিত হইলাম। বঙ্গ সাহিত্য-কাননে বহু কুসুম বিকশিত হইয়াছে; কুসুম-সৌরভ বিতরণ করিতেছে। এ কুসুম ক্ষুদ্র এবং ইহার সৌরভ স্বল্প হইতে পারে, কিন্তু ভরসা – সরস্বতী অকিঞ্চনকে কখনও উপেক্ষা করেন না।’

সম্পাদকীয়র এই মর্মবাণী পাঠ করে এ-কথা সহজেই অনুমেয় যে, ময়মনসিংহের সুসন্তান কেদারনাথ মজুমদার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি প্রবল দায়বোধ থেকে গভীর অভীপ্সা নিয়ে সৌরভ প্রকাশে ব্রতী হন। আলোচ্য নির্বাচিত সৌরভের সংকলক ও সম্পাদকের সৌরভ প্রসঙ্গে শীর্ষক মুখবন্ধ থেকে জানা যায়, পত্রিকাটি প্রথম পাঁচ বছর ঢাকার ২৬ বেচারাম দেউড়ির জগৎ আর্ট প্রেস থেকে সতীশচন্দ্র রায়-কর্তৃক মুদ্রিত হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চম বর্ষের ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে সৌরভ ময়মনসিংহ শহরের লিলি প্রেস থেকে মুদ্রিত হতে থাকে। লিলি প্রেসে মুদ্রণকালে মুদ্রক হিসেবে শ্রী রামচন্দ্র অনন্তর নাম পাওয়া যায়। তবে পত্রিকা মুদ্রণে নিজস্ব প্রেস স্থাপনের তাগিদ কেদারনাথের শুরু থেকেই ছিল। অবশেষে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কেদারনাথ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহে তাঁর নিজগৃহে একটি প্রেস স্থাপন করেন। এর নাম রাখেন ‘সৌরভ প্রেস’। সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজের পাশাপাশি তিনি অনেক সময় নিজেই সৌরভের অক্ষরবিন্যাস করতেন। সৌরভের আখ্যাপত্রে লেখা থাকত ‘সচিত্র মাসিকপত্র ও সমালোচন’। প্রথমে পত্রিকাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হলেও পরে ম্যাগাজিন আকারে ছাপা হতো। সৌরভের প্রথম সংখ্যা ৩২ পৃষ্ঠা হলেও পরে এর অবয়ব বেড়ে ৪৫ পৃষ্ঠা হয়েছিল। বছরশেষে সৌরভের বারো মাসের সংখ্যা একত্র করে একটি অখণ্ড সংখ্যা প্রকাশ করা হতো। প্রতি সংখ্যার নির্ধারিত মূল্য ছিল চার আনা। সৌরভের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে ছবির ব্যবহার এবং সেটা প্রথম সংখ্যা থেকেই। সেসময় ঢাকার সব প্রেসে ছবি মুদ্রণের ব্যবস্থা ছিল না। তবে ঢাকার আশুতোষ প্রেসেই সৌরভের ছবি মুদ্রণের কাজ করানো হতো। জানা যায়, সৌরভের ছবির অনেক ব্লক কলকাতায় তৈরি হতো। এর সাদাকালো ছবির পাশাপাশি ঝকঝকে রঙিন ছবি এখনো বিস্ময়ের উদ্রেক করে। 

সৌরভ-পাঠে আপাত মনে হতে পারে, এটা ইতিহাসনির্ভর পত্রিকা এবং আঞ্চলিক সাহিত্যচর্চার জন্যেই এর জন্ম। কিন্তু ভালোভাবে তলিয়ে দেখলে এর বিপরীত চিত্রও চোখে পড়ে। রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে বসবাস করলেও কেদারনাথ মজুমদারের বিশ্ববীক্ষণ আমাদের নজর এড়ায় না। বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে ময়মনসিংহবাসীর পরিচয় ঘটানোর লক্ষ্যে সৌরভের প্রয়াস ছিল অব্যাহত। এমনকি উন্নতমানের কাগজে আলাদা করে মুদ্রিত হতো নানা শিল্পীর আঁকা ছবি। প্রসঙ্গত বিখ্যাত শিল্পী হেমেন মজুমদারের ‘নগ্নিতা’র কথা বলা যেতে পারে।

এবার নির্বাচিত সৌরভের আলোচনায় ফেরা যাক। প্রাবন্ধিক ও লেখক খান মাহবুব নির্বাচিত সৌরভ সংকলন ও সম্পাদনা করে কেবল ব্যক্তিগত দায় শোধ করেননি, তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন জাতীয় দায়ও। বাংলা একাডেমি এ-গ্রন্থটি প্রকাশ করে প্রকৃত অর্থেই ধন্যবাদের দাবিদার।

ময়মনসিংহের মতো একটি মফস্বল শহর থেকে টানা উনিশ বছর সৌরভের মতো একটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করা আজকের বাস্তবতায়ও চাট্টিখানি কথা নয়। এটি সম্ভব হয়েছিল কেবল কেদারনাথ মজুমদারের প্রবল নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের ফলেই।

এতক্ষণে আমরা জেনে গেছি সৌরভ হচ্ছে একটি শতাব্দীপ্রাচীন পত্রিকা। কিন্তু আজ আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে নির্বাচিত সৌরভে। শুরুতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই সংকলনটির সূচিপত্রে। আর এতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে নির্বাচিত সৌরভের অন্তর্গত বিষয়-আশয়। সংকলনে লেখাগুলো সাজানো হয়েছে বিষয়ভিত্তিক। আর এটি করতে গিয়ে সংকলককে যে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তা সহজেই আঁচ করা যায়। ৬৬৮ পৃষ্ঠার সংকলনটির সূচিবিন্যাস এরকম : ‘ভাষা ও সাহিত্য’, ‘সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘ইতিহাস ও সভ্যতা’ , ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা’, ‘গল্প’, ‘কবিতা’, ‘সৌরভ ও কেদারনাথ প্রসঙ্গ’, ‘পুস্তক পরিচয়’, ‘সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গ’, ‘বিবিধ’, ‘পরিশিষ্ট’, ‘নির্বাচিত আলোকচিত্র’।

শুরুতেই রয়েছে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগটি। এর পরিসর ১-১৩০ পৃষ্ঠা। ভাষা ও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচিত লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে বিভাগটি। বিভাগের প্রথম লেখা চন্দ্রকুমার দে-রচিত ‘দস্যু কেনারাম’। চন্দ্রাবতীর গীত অবলম্বনে রচিত ‘দস্যু কেনারামে’র কাহিনি পড়ে পাঠক বেশ মজা পাবেন। এর পরেই রয়েছে অক্ষয়কুমার মজুমদার-রচিত ‘বাঙ্গালা ভাষায় প্রাদেশিকতা’। সাধুভাষায় রচিত এ-লেখাটি নাতিদীর্ঘ হলেও বেশ উপভোগ্য। মৈমনসিং গীতিকা নিয়ে রয়েছে তিনটি লেখা। ‘টাঙ্গাইলের প্রাচীন সাহিত্য’ শিরোনামে লিখেছেন রসিকচন্দ্র বসু বিদ্যাবিনোদ। এ-লেখাটি বেশ বড়। প্রায় ২৬ পৃষ্ঠা পরিসরের এ-লেখায় উঠে এসেছে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ও যোগ সাহিত্যের পূর্বাপর আলোচনা। কালিকাপুরাণ, কালিকামঙ্গল, ভাসানযাত্রা, ধর্মপাঁচালি, যাত্রাগান ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। যতীন্দ্রনাথ মজুমদার-রচিত ‘ময়মনসিংহের প্রাচীন পল্লী-সাহিত্য’ ছোট রচনা হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ। বীরেন্দ্রকুমার দত্তগুপ্ত-রচিত ‘বাঙ্গালার লেখক’ শীর্ষক রচনাটিও গুরুত্ব বহন করে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখকদের উদ্ধৃতিসহ সাহিত্যের নানা তাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ এ-লেখার উপজীব্য। সুধাংশুভূষণ রায়ের ‘পল্লীগীতিকায় উপমা’ও একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ‘কাব্যিক হেঁয়ালি’ শিরোনামে লিখেছেন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী। লেখাটি ছোট হলেও বেশ মজার। চন্দ্রকুমার দে-র ‘প্রাচীন সাহিত্যের অন্বেষণে’ শীর্ষক লেখাটি অভিভাষণের ঢংয়ে রচিত। ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগের শেষ লেখা ‘সাহিত্য ও জাতীয়তা’। দু-পৃষ্ঠার রচনা হলেও লেখাটি চিন্তাজাগানিয়া।

গ্রন্থের পরবর্তী বিভাগ ‘সমাজ ও সংস্কৃতি’। এর পরিসর ১৩১-২৬৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। এ-বিভাগে গ্রন্থিত হয়েছে ২৫টি লেখা। তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির নানা বিষয়-আশয় এসব লেখায় উঠে এসেছে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে যদুনাথ চক্রবর্ত্তী-রচিত ‘বিবাহ পণে বালিকার আত্মবলি’, কালীপ্রসন্ন চক্রবর্ত্তীর ‘বাঙ্গালী সমাজে বীমা’, অনঙ্গমোহন লাহিড়ী-রচিত ‘মুসলমানী উপাধির বিশ্লেষণ’ ও ‘বাঙ্গলার পল্লী’,  বিজয় নারায়ণ আচার্য্যরে ‘ময়মনসিংহে কবিগান’, প্রিয়গোবিন্দ দত্তের ‘ধর্ম্ম ও দর্শনের ধারা’, রঞ্জনবিলাস রায় চৌধুরীর ‘বাঙ্গালার সমাজ’ ইত্যাদি। এসব লেখায় সে-সময়ের সমাজ ও সংস্কৃতির অনুধাবনযোগ্য চিত্র উঠে এসেছে।

সংকলনের তৃতীয় অধ্যায়ে উঠে এসেছে ‘ইতিহাস ও সভ্যতা’ বিষয়ক রচনাগুলো। এ-পর্বের পরিসর ২৬৯-৩৮৬ পৃষ্ঠা অবধি। এ-অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য-রচিত ‘সুসঙ্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা’ ও ‘অগুরু সিন্দূর বা এগারসিন্ধু’, নরেন্দ্রনাথ মজুমদার-রচিত ‘সোমেশ্বর ও সোমেশ্বরী’, শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরগা’, সুরেশচন্দ্র সিংহের ‘ইশা খাঁ’, রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তীর ‘মুসলমানদের সংস্কৃত শিক্ষা’ ইত্যাদি। কেদারনাথ মজুমদারের ‘সেকালের ডাকের ব্যবস্থা’ একটি শ্রমসাধ্য রচনা। এ-লেখায় একদিকে যেমন উঠে এসেছে সেকালের ডাক-যোগাযোগের সাধারণ চিত্র, অন্যদিকে উঠে এসেছে সেকালের ডাকমাশুলের অনুপুঙ্খ বিবরণও। একই লেখকের ‘কোম্পানীর আমলের শিক্ষার অবস্থা ও ব্যবস্থা’ শীর্ষক রচনাটিও বেশ দীর্ঘ। এ-রচনায় সে-সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার একটি সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে।

এর পরের অধ্যায়ের শিরোনাম ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা’। এ-অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে পাঁচটি রচনা। সব লেখাই তথ্যনির্ভর। প্রথম রচনা ‘বাঙ্গলার প্রথম মুদ্রাযন্ত্র ও সাময়িক পত্র’। রচনাকারের নাম মুদ্রিত নেই। ধারণা করা যায়, এটি সৌরভ-সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের হতে পারে। পরের রচনাটির শিরোনাম ‘সেকালের বাঙ্গালা সাময়িক পত্রিকা ও বঙ্গসমাজ’। এর লেখক কেদারনাথ মজুমদার। এ-লেখায় সে-সময়ের বাংলা সাময়িকপত্র ও বাঙালি সমাজের একটি রূপরেখা উঠে এসেছে। এ-অধ্যায়ের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘উইলিয়ম কেরি’। রাজেন্দ্রকিশোর সেন-রচিত এ-লেখায় মহাত্মা উইলিয়ম কেরির জীবনচিত্র চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজেন্দ্রকিশোর সেনের আরো একটি রচনা মুদ্রিত হয়েছে এ-অধ্যায়ে। এর শিরোনাম ‘সেকালের বাঙ্গালা মুদ্রিত গ্রন্থ’। সে-সময়ের বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের একটি সামগ্রিক ধারণা এ-লেখায় উঠে এসেছে।

সংকলনের অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল অংশ এর ‘গল্প’ ও ‘কবিতা’ অধ্যায়। সংকলিত পাঁচটি গল্প ও আটাশটি পদ্যে উঠে এসেছে সেকালের কবি-গল্পকারদের সাহিত্যভাবনার বাস্তব চিত্র। এসব রচনার সাহিত্যমূল্য বিচারে না গিয়েও বলা যায়, ঐতিহাসিক কারণেই এসব রচনার সংকলনভুক্তি। 

এবারের আলোচ্য পর্ব ‘সৌরভ ও কেদারনাথ প্রসঙ্গ’। এ-পর্বে উঠে এসেছে সৌরভ ও এর সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারকে নিয়ে নানা মূল্যায়ন ও স্মৃতিতর্পণ। আঠারোটি রচনা গ্রন্থিত হয়েছে এ-পর্বে। সৌরভ সম্পাদনা ও প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে কেদারনাথ মজুমদার কী প্রাণান্ত শ্রমই না দিয়েছেন তার একটি বিশ্বস্ত চিত্র এসব রচনা। 

‘পুস্তক পরিচয়’ অধ্যায়টি খুবই ছোট। এর পরিসর মাত্র আট পৃষ্ঠা। এর পরের অধ্যায় ‘সংবাদ ও সাময়িক প্রসঙ্গ’। এ-অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নানা রকম সংবাদ যেমন সাহিত্য-সংবাদ, পদকপ্রাপ্তির খবর, শোক সংবাদ, বিজ্ঞাপন, চিঠিপত্র, ভ্রম সংশোধন ইত্যাদি। ‘বিবিধ’ অংশে স্থান পেয়েছে সৌরভে প্রকাশিত একটি কার্টুন, শান্তিচন্দ্র মজুমদার-রচিত ‘ময়মনসিংহের কৃষিকথা’ ও নীরদভূষণ রায়-রচিত ‘বন্যা অঞ্চলে একদিন’ শীর্ষক রচনা। 

পরিশিষ্ট অধ্যায়টি বেশ বড়ই বলতে পারি। এর পরিসর ৫৭১-৬৪৪ পৃষ্ঠা অবধি। নিঃসন্দেহে এ-অধ্যায়টি নির্বাচিত সৌরভের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সৌরভ প্রকাশনার প্রথম বর্ষ থেকে ঊনবিংশ বর্ষ পর্যন্ত প্রকাশিত অধিকাংশ সংখ্যার সূচি এখানে সংকলিত হয়েছে। 

সংকলনের সর্বশেষ অধ্যায় ‘নির্বাচিত আলোকচিত্র’। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সৌরভের বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত কিছু রঙিন ও সাদাকালো আলোকচিত্র, শিল্পীদের আঁকা কিছু রঙিন শিল্পকর্মসহ সৌরভের প্রচ্ছদ, রঙিন আখ্যাপত্র ও সৌরভে ব্যবহৃত অলংকরণ। মুদ্রিত হয়েছে সে-সময়ের জনহিতৈষী নবাব-জমিদারদের আলোকচিত্রও। সবশেষে যুক্ত শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের আঁকা ‘চন্দ্রহার’ শিল্পকর্মটির কথা না বললেই নয়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, সৌরভের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে আর সৌরভ-সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার মৃত্যুবরণ করেন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ। টানা ১৪ বছর তিনি সৌরভ সম্পাদনা করেন। কেদারনাথের মৃত্যুর পর সৌরভ সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁর ছোট ভাই নরেন্দ্রনাথ মজুমদার। নরেন্দ্রনাথ দায়িত্ব গ্রহণ করেই অগ্রজ কেদারনাথের প্রয়াণ উপলক্ষে প্রকাশ করেন সৌরভ ‘কেদার স্মৃতিসংখ্যা’। চতুর্দশ বর্ষ আষাঢ়, ১৩৩৩ সংখ্যা থেকে তাঁর সম্পাদনায় সৌরভ নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। নরেন্দ্রনাথের হাতে সৌরভ মোট কতদিন ও কয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও সংকলনের পরিশিষ্টে দেখি ঊনবিংশ বর্ষ, চৈত্র, ১৩৩৭ সংখ্যার সূচিবিন্যাসও। এ থেকে ধারণা করা যায়, কেদারনাথের মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথের হাতে প্রায় পাঁচ বছর সৌরভ প্রকাশিত হয়েছিল।  সবশেষে লেখাটির সমাপ্তি টানতে পারি এই বলে যে, সৌরভ সম্পাদনা করে কেদারনাথ মজুমদার পূর্ব বাংলার সাময়িকীর ইতিহাসে যে অবদান রেখে গেছেন, তা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। সৌরভ ও কেদারনাথ এক অভিন্ন সত্তা। আর খান মাহবুব সংকলিত ও সম্পাদিত নির্বাচিত সৌরভ ভবিষ্যতের অনুসন্ধানী গবেষকের কাছে এক অমূল্য গবেষণা-উপকরণ হয়েই থাকল।