পাসওয়ার্ড

কাজী রাফি

কিন্তু আমার ভেতরের এই রক্তপ্রবাহ কোথায় গিয়ে মিলছে? আমার ভেতরে জমাট রক্ত বরফের এক পাহাড় এতোদিন এভাবে লুকিয়েছিল? অযুত রক্তবিন্দুর ধারা গলগল গলে গিয়ে মিলছে আমারই মাঝে লুকানো এক সাগরে? আমার ভেতর এক সাগর এতোদিন লুকিয়েছিল এভাবে? ঊনত্রিশ পেরিয়ে এসে আজ প্রথম আমি এভাবে ভেতরের স্রোতকে টের পেলাম! কিন্তু এই রক্তস্রোতের কোনটা শ্বেতকণিকা? লোহিত আর অনুচক্রিকাই বা কোনটা? জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে শরীরের বিজ্ঞানভিত্তিক এই শ্রেণিবিভাজন কেমন একটামাত্র শ্রেণিতে গিয়ে মিলেছে। শুধু গলগল তার প্রবাহ! মাথার ভেতরে তার শুধু কলকল প্রতিধ্বনি।
আমি তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি। পকেটের ম্যানিব্যাগের কয়েকটা টাকা আর একটা মোবাইলের জন্য ওরা ড্যাগার দিয়ে কেন কোপ দিলো আমার মাথায়? ভেঙে দিলো আমার রক্তের শ্রেণিবিভাজন? হায়রে শ্রেণিবিভাজন! নিজের ভেতরকে সচল রাখতে তার এতো প্রয়োজন? আমার যে-বন্ধুরা আমার অচেতন শরীর নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ছুটছে হাসপাতালে ওদের মুখগুলো দেখার জন্য এমন অনন্ত পিপাসা আমার! আমার শরীর যত অচেতন হয়ে যাচ্ছে আমার ব্রেনের মেমব্রেনে রক্ষিত কোনো এক অংশ ততোই সচেতন হয়ে উঠছে। তবু শত চেষ্টাতেও আমি দুচোখ খুলতে পারছি না। কেন? এতোদূর থেকে আমার বন্ধুদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে! ওদের থেকে আমার দূরত্ব কত কোটি মাইল? আমি কি ওদের অতিক্রম করে চলে এসেছি সারারাত বিস্ময়ে চোখ মেলে-থাকা আকাশভরা তারাগুলোর কাছে? আমার শরীর কি অতলজলে তলিয়ে, গড়িয়ে-গড়িয়ে পৌঁছে গেছে ডিসকভারি চ্যানেলে দেখা নিঃসীম আটলান্টিক সাগরের গভীর জলের সমুদ্রজীবদের কাছে? ওদের কণ্ঠস্বর সাগরজলের নিস্তরঙ্গ ঢেউ ভেঙে ভেঙে আমার কানের কাছে বাতাসে জেগে ওঠা মর্মর আর ফিসফিস হয়ে যাচ্ছে। আমার করোটির ভেতর রক্ষিত ব্রেনের অডিটরি-নার্ভ  আর অডিওসেন্সরি এলাকা ওদের বাক্যগুলোর শব্দকে কানে পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য এখনো রেখেছে। তা দিয়েই আমি বুঝতে পারছি – আমার কোনো এক বন্ধু অফুরান যানজটে আটকে থাকা আমাকে, বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনে কেউ কর্ণপাত করছে না দেখে আকুল হয়ে শত-শত যানের ড্রাইভারদের কাছে মিথ্যা মিনতি করছে, ভাই প্লিজ গাড়িটা ডানপাশে আর একটু কাটুন… আমাদের অ্যাম্বুলেন্সটাকে আগে যেতে দিন… আমার বন্ধু মারা যাচ্ছে ভাই! প্লি…জ!
এক মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য করুণায় যত গাড়ি পাশ করে দিচ্ছে তার চতুর্গুণ যান সেই করুণার সুবিধা নিয়ে সামনে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ভরে ফেলছে অ্যাম্বুলেন্সের সম্মুখপথ… রাস্তার পুরো ডানপাশ! বন্ধুরা কার কাছে তোমরা আমার জীবনভিক্ষা চেয়ে অমন আকুতি করো?  এতো ভালোবাসো তোমরা আমায়? অথচ সেদিনই, আমার প্রিয় বন্ধু মানাভ; তোর সঙ্গে ঝগড়া করেছি। ‘কেট-উইন্সলেট’কে আমার চোখে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী বলায় তুই ওলটাপালটা কথা বললি। ব্যস, মাথাটা ঠিক রাখতে পারলাম না। আমি এবার সুস্থ হলে কসম খোদার কোনোদিন তোর সঙ্গে আর ঝগড়া করব না। আর তোর সঙ্গে যে নদীতে নামব, বৃষ্টিতে ভিজব অথবা ছাদে শুয়ে পুরো একটা চাঁদনী রাত কাটাব বলে কথা দিয়েছিলাম… দেখিস এবার সব কাজ ফেলে জীবনের এই আশাটুকু আমি চরম মেটাব। ইস্! ফেসবুকে এখনই একটা স্ট্যাটাস দিতে ইচ্ছা করছে – ‘বন্ধু হারিয়ে গেলে, বন্ধুর প্রয়োজন অথবা অপ্রয়োজনে তার অভাব বোঝা যায়।’ সঙ্গে আরো একটা স্ট্যাটাস – ‘আমি জীবনে আর কোনোদিন নিজে যানজটের কারণ হবো না।’ দুঃখ আমার, তোদের এই আকুতিভরা ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার সময় জীবনে আর হয়তো আসবে না।
হ্যাঁ, ফেসবুকে আমার খুবই সক্রিয় একটা অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু আমার এই স্ট্যাটাসে যারা ‘লাইক’ দেবে অথবা মন্তব্যের পর মন্তব্যে আমাকে দার্শনিক বলে বাহ্বা দেওয়ার ফাঁকে একটু টিটকিরি করে নেবে – তারা কি কোনোদিন আমার এই স্ট্যাটাসের সঙ্গে রক্তপ্রবাহের অনুভূতির ক্ষরণটুকু বুঝবে? হায়রে! যে-জগৎ বস্তুত কাউকে বোঝে না… ফাগুনে জন্ম নেওয়া লক্ষকোটি অযুত মশার ঝাঁক তৈরি করে মিথ্যা হাতছানিতে কাছে টেনে কেড়ে নিয়েছে আমার অনেক সময়, প্রতিজ্ঞা করছি বন্ধু, সেইসব স্তুতিবাক্যের চেয়ে তোদের বরং আরো একটু সময় দেবো। তবু ফেসবুকে জন্মদিনে পাঠানো তোদের শুভেচ্ছা, আর নতুন-বন্ধনে আবদ্ধ নতুন সব জুটির ছবি আমাকেও আজকাল স্বপ্ন দেখাত; একদিন আমিও হৃদিকাকে বিয়ে করে বিভিন্ন পোজের সব ছবি আপলোড করব। কী আশ্চর্য! বাবা তুমি? তুমি হাসছ! সেই কবে শেষবার দেখেছি তোমায়! বড় হয়ে কতবার তোমার মুখটা মনে করার চেষ্টা করেছি। পারিনি। অথচ তোমার পুরো অবয়ব আজ আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাবা তোমার দেখা চার বছরের শিশুটি তো আমি আর নেই… ছেলের মনের কোণে লুকানো গোপন কথাটা জেনে গেলে হাসতে হয় বুঝি! পঁচিশ বছর আগে তোমাকে হারিয়েছি, এই পাঁচিশ বছরে তোমার একটুও পরিবর্তন হয়নি আর দ্যাখো আমি কত বড় হয়ে গিয়েছি। হ্যাঁ, মনে পড়ছে… ভোরে ঘুম থেকে উঠে চেয়ারের ওপর দাঁড় করিয়ে ছোট্ট এই আমাকে যখন দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিতে, আমি পানি ছিটিয়ে আমার শিশুকণ্ঠে উচ্ছ্বাসভরে বলতাম, ‘বাবা দ্যাখো, আমি কত বড় হয়ে গেছি!’ আমার শৈশবের এই মুহূর্তগুলো কী অদ্ভুতভাবে আমার সঙ্গে খেলা করছে এখন। আমি কি বড় হয়েছি তোমার কাছে যাওয়ার জন্য? কিন্তু আমার অনুভূতি এখনো পরিপূর্ণ এক যুবকের মতো থাকলেও, শরীর সেই চার বছরের শিশুর চেয়েও যেন ছোট হয়ে গিয়েছে। ওহ! তুমি, আমার কাছ থেকে তোমার সেই ছোট্ট ফুয়াদকে নিতে এসেছ! তাহলে আমার আর কিছু কি থাকে বাবা? আমি তো আমার কাছ থেকেই তাহলে হারিয়ে যাই! তবু… তোমার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি… কত সৌভাগ্য আমার! কিন্তু বাবা তুমি কেমন করে আমার মনের কথা জেনে গেলে? হৃদিকাকে জীবনসঙ্গী করে আমাদের যুগল ছবিগুলো আমি তাড়াতাড়িই আপলোড করব। আমাদের ছবিগুলো দেখার জন্য তোমার কি কোনো অ্যাকাউন্ট সাইনআপ করা আছে? পাসওয়ার্ড মনে পড়ছে না? কী বলছ! ওহ…হ… যাহ! ভুলেই গেলাম। আমার অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটা কী যেন! হৃদিকা পাসওয়ার্ডটা জেনে গিয়েছিল বলে কয়েকদিন আগে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজের উপন্যাসের এক চরিত্রের নাম দিয়ে নতুন পাসওয়ার্ড সেট করলাম। এম… কিউ… তারপর কী যেন? হৃদিকা বিশ্বাস করো, তোমার কাছ থেকে কিছু লুকানোর জন্য আমি পাসওয়ার্ডটা বদলাইনি। সেই কবে আভিয়ানাকে ভালোবেসেছিলাম নিজের সামর্থ্যরে সীমানাটুকু না জেনেই। আর আভিয়ানা আমার স্বপ্নকে আরেকটু পরিসীমার মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়ে বিয়ে করল ধনাঢ্য শব্দকে। আভিয়ানা বুঝতে পারেনি মরা নদীতে ঢেউ জাগে না। আর অনেক অর্থ কারো কারো চাওয়াকে পূর্ণ করতে পারে না। অর্থ বরং আরো অর্থ নিয়ে আসার পথ দেখানোর প্রলোভনে মানুষ প্রাণীদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় তার মূল্যবান সময়। হৃদিকা পাঁচ বছর পর আভিয়ানা আমাকে আকুল হয়ে খোঁজা শুরু করেছিল। ওর স্বামী ওকে রাতে মাঝে মধ্যেই মারধর করত। যে-বিত্তের বিভবে সে সুখে ভাসতে চেয়েছিল সেই ‘অর্থ’ই আভিয়ানার মননকে ভাসিয়ে দিয়েছিল দুঃখের সাগরে। নিজের পছন্দে বিয়ে করার কারণে আভিয়ানার আত্মসম্মান আর কারো কাছে তার জীবনচিত্র জানাতে চায়নি। শুধু কাছে পেয়েও সেদিনের নগণ্য এই আমাকে চিনতে না পারার ব্যাকুলতা থেকে সে আমার কাছে সান্ত্বনা খুঁজে ফিরত। আভিয়ানাকে কেউ মারছে – এটা কেমন কষ্টের তোমাকে কীভাবে বোঝাব? সে এখন প্রতিদিন ফেসবুকে আমাকে মেসেজ পাঠায়… আসলে সে বেঁচে থাকার আশ্রয় খোঁজে। একদিনের নগণ্য এই আমি আভিয়ানার কত আরাধ্য! তোমার সঙ্গে প্রতারণা নয়, আমি এই দুঃখের ঘটনা তোমাকে জানাতে চাইনি। বিশ্বাস করো হৃদিকা, আকাশ থেকে মাটিতে ছড়ানো বাতাসের সব চেনা সুরে তুমি ছাড়া এতো আপন আমার আর পৃথিবীতে কেউ নেই। যেদিন লুকিয়ে এক লোকমা খাবার আমার মুখে তুমি তুলে দিলে – তারপর থেকেই মায়াময় এক আশ্রয় আর শ্রান্তিতে-ক্লান্তিতে জীবনের ‘মানে’ বলতে আমি তোমাকেই বুঝি। কিন্তু… আভিয়ানাকে আমার এই কথাগুলো তোমার বলার প্রয়োজন ছিল। কী জানি প্রতিদিন ফেসবুকে আমাকে মেসেজ পাঠানো তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কিনা? আর তাই, আমার ব্রেনে সংরক্ষিত স্মৃতির অংশ থেকে আমার ফেসবুকের অ্যাকাউন্টের ‘পাসওয়ার্ড’টা খুঁজে ফিরছি। মার্কোজের উপন্যাসের একটা চরিত্রের নাম… কী যেন… কী যে… ন! স্মৃতির এই অংশটুকু অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমার একটা স্ট্যাটাস দিতে ইচ্ছা করছে – ‘আমাদের শক্তিশালী মহান লেখক খুব প্রয়োজন… তাহলে উপন্যাসের চেনা চরিত্রগুলো আমাদের মৃত্যুকে সহজ করে দেয়!’
বলার মতো একটু সুস্থতা ফিরলেই আমার ফেসবুকের অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটা তোমাকে বলে যেতে চাই। হৃদিকা তুমি ‘ফুয়াদ’ সেজে মাঝে মাঝে শুধু আভিয়ানার মেসেজের রিপ্লাই লিখবে ‘এই তো জীবন!’ অথবা ‘সামনেই আসবে ভালো কোনো দিন।’ আহ… হা! আমার মেসেজের আশায় থেকে থেকে শেষমেশ হতাশ হয়ে আভিয়ানা যদি আত্মহত্যা করে! কিন্তু দ্যাখো, আমি কিছুতেই আমার পাসওয়ার্ডটা মনে করতে পারছি না… কী জানি চোখ খুলে আলো দেখতে পেলেই পাসওয়ার্ডটা মনে পড়বে হয়তো। আমি আপ্রাণ আমার দুচোখ খোলার চেষ্টা করছি – অথবা আমার চোখ দুটো খোলাই আছে। কিন্তু কোথায় আলো? চোখের সামনে অতল গহ্বর। সেই অতল গহ্বরে লাল-নীল-বেগুনি আলোকবিন্দুরা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে… ছোট থেকে বড়… আরও বড়। বিশালাকৃতির এক আলোকবিন্দু হঠাৎ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল – লক্ষকোটি বর্গমাইলে। সেই বিন্দুগুলোর বিস্তৃতির ভেতর আমার শরীরের কোষগুচ্ছগুলো ভেঙে-ভেঙে শিমুলতুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। এই অযুত আলোকবিন্দুর প্রহসন থেকে প্রাণপণে আমি আমার কোষগুলোকে একত্র করে পুনরায় সংহত করতে চাইছি। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ধাক্কায় তারা বিজ্ঞানের কোনো এক সূত্র অনুসরণ করে সাইরেনের শব্দের সমানুপাতে আমার থেকে দূরত্ব বাড়িয়েই চলছে। মাঝে মাঝে আলোর বর্ণিল কণাগুলো মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ হয়ে যাচ্ছে। আহ্! আমার মা। কিছুদিন আগে গ্রাম থেকে ঢাকায় এনেছিলাম একমাত্র ছোটভাই আর মাকে। আমাদের বাবা নেই বলে নিজে ছোটভাইটার বাবা সেজেছিলাম। আত্মীয়হীন এই ঢাকায় মা আর ওর জীবন-শিকড় হয়ে আলো-জল বিলাতে চেয়েছিলাম। ওদের এখন কী হবে?
আলোর অসংখ্য কণা মায়ের মুখের অবয়ব নিয়ে কী যেন বলছে। কী বলছ মা? ওহ! তাই তো, বাসায় যাওয়ার সময় সজনে ডাঁটা কিনতে হবে? কিন্তু দ্যাখো মা, সাইরেনের শব্দে আমার ঠোঁটের বিক্ষিপ্ত ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন কোষ আর এক হতে পারছে না। ব্রেনের সামান্য কয়েকটা কোষের এই সক্রিয়তা থেমে যাওয়ার আগে আমার বন্ধুদের আমি চিৎকার করে বলতে চাইছি, ‘আমার নিথর শরীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার আগে মায়ের জন্য সজনে ডাঁটা কিনিস।’ তাই তো মনে পড়েছে, ছোট্টবেলায় এই খাবারটা আমিই খেতে পছন্দ করতাম। সজনেডাঁটার সঙ্গে করলা-কই অথবা মাগুর মাছের ঝোল! কিন্তু কীভাবে কোটি কোটি মাইল বিস্তৃত অসংখ্য আলোকবিন্দুর মাঝে ছড়িয়ে পড়া আমার জিহ্বা আর ঠোঁটের কোষগুচ্ছকে আমি একত্রিত করি, বলো তো মা। শরীরের এতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে ঠোঁট যে এতো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটাই বুঝিনি! এই ঠোঁটে তোমার কত হাজারো চুমো লেগে আছে! জেগে আছে কত স্বপ্ন! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, বৃষ্টিভেজা দিনে… চা আর খিচুড়ির স্বাদ বুঝিয়ে দিয়ে সময়কে প্রাণবন্ত করেছিল এই ঠোঁটই। আর হৃদিকার কানে ফিসফিস করব বলে যত হাজার কথা আর স্বপ্ন লুকিয়ে রেখেছিলাম তা এই ঠোঁটেই ‘বলব-বলব’ খেলায় মেতে থাকত সারাবেলা… সারাক্ষণ! না-বলা এই কথাগুলো হৃদিকাকে বলার জন্য আমার দুঠোঁটের ছড়িয়েপড়া লক্ষকোটি কোষগুচ্ছ কি আর একত্রিত হবে কোনোদিন?
একেকটা আলোকবিন্দুর ভেতর লুকানো অসংখ্য তুমি কি অনেকবার আমাকে ফোন করছ? কীভাবে আমাকে পাবে বলো, সন্ত্রাসীরা হঠাৎ কেড়ে নিল তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগের পাসওয়ার্ড। ইস্… প্রত্যেকের সিম-নাম্বার যদি তার জীবনের পাসওয়ার্ড হতো! আর সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে মানুষের প্রাণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাইন ইন-সাইন আউট করতে পারত! আমার বন্ধুরা তাহলে নিশ্চয়ই এতোক্ষণ সাইন-ইন করে আমার সব ভাবনা আর না-বলা কথাগুলো জানতে পারত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কাছের স্মৃতিগুলো দূরবর্তী স্মৃতির মতো আমার অনুভবের সঙ্গে খেলছে না! অথচ ছোটবেলায় মায়ের থেকে পাওয়া চুমোর আবেশ, তার হাতের রান্নার স্বাদ… বাড়ির পাশের ছোট বনটায় সারাদিন ফড়িংয়ের পেছনে প্রতিটি ক্ষণের উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা সবই ব্রেনের এই সজাগ অংশে কত জীবন্ত! তাহলে আমার ব্রেনের দূরবর্তী স্মৃতিধারণক্ষম অংশটুকু ছাড়া বাকিটুকু কি মাথার খুলি থেকে বের হয়ে গিয়েছে?
কত মন ভালো করা অদ্ভুত সব স্বপ্ন – নতুন একটা উপন্যাস পড়ার, আরেক ফাল্গুন আর পরের বর্ষায় অথবা হেমন্তের নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘের ভেলায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে আগামী একদিনে কোনো নির্জন প্রকৃতির ভেতরে তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া – কিছুই হলো না। আমার তারুণ্যদীপ্ত রক্তকণার পৃথিবীকে নতুন করে দেখার প্রত্যয়ের কাছে মাথানত করে ক্ষমা চেয়ে কি বলব – ‘আমি ঝিনুক হয়ে আবার জন্মাব কোনো পর্বত-সাগরের বালিয়াড়ির ফাঁকে! আবার আসব আমার আঙিনায় লাগানো ঝিঙেফুলটার কাছে। একটা পাখির লেজদোলানো দেখব অবাক হয়ে।’
উফ্! অ্যাম্বুলেন্সটা আবার উলটা ঘুরছে। তাহলে? ব্রেনের আর কোন অংশটুকু এই উলটাঘোরা টের পেল? বন্ধুদের কণ্ঠস্বর আর আশপাশের শব্দগুলো যেন অনেক জলতরঙ্গ ভেঙে আমার কানে এসে একটা একটা করে জোড়া লাগছে। কানের øায়ুসাগরে শব্দগুলো আছড়ে পড়েই তলিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রাণের পাসওয়ার্ড জানা কত প্রয়োজন! ব্রেনের স্মৃতিধারণক্ষম আর অতিভাবুক কোন কোন কোষ কানের এই øায়ুসাগরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা কি এখনো এটা আবিষ্কার করতে পেরেছে? পাসওয়ার্ড দিয়ে আমার ‘প্রাণ’ নামক শব্দটার ভেতর বিজ্ঞানীরা যদি ঢুকতে পারত!
আমার বন্ধুদের কথোপকথনের দু-একটা শব্দের রেশ ধরে বুঝতে পারছি দেশের অনেক বড় এক সরকারি হাসপাতালে আপাতত কেউ আমাকে ভর্তি করিয়ে নিতে চাইছে না। কেন? ওরা কি আমাকে কোনো দলের ভেবেছে? মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষের শ্রেণি বা দল থাকে কি?
হাসপাতালের পর হাসপাতাল – এই মিথ্যা ছুটে চলা! মিথ্যা এক প্রাণ হাতড়ে ফেরা। কী লাভ বন্ধু? দুই হাতের দুই আঙুল দিয়ে যদি আমি আমার দুই কানের ছিদ্র বন্ধ করে দিতে পারতাম! পারতাম যদি ডাক্তারের ভাষায় কমায় থাকা আমার শরীরের সঙ্গে মাথার সক্রিয় অংশকে ছিন্ন করে একাত্ম করে দিতে! হিমালয়সম এক বরফের পাহাড় এসে জমেছে আমার দুই হাতে। হাজার টন শক্তি দিয়েও হাত দুটো আর নাড়াতে পারছি না।
তোমাকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য দুঃখিত মা। দুঃখিত অপু – আমাদের বাস্তুভিটায়, নদীর নিটোল জলের পাশে আমাদের গ্রামটায়; স্বপ্নের বদল আমার নিথর শরীরের কফিন নিয়ে যেতে হবে বলে। ভাই হয়েও আমি তোর কাছে ‘দুর্গা’ বোন হয়ে গেলাম বলে! ট্রেনের যাত্রী হয়ে গেলে মাঠপ্রান্তের শেষে জেগে ওঠা কোনো এক অশ্বত্থ গাছ দেখে যদি তোর চোখভরে জল আসে আর মনে হয়, চিরকালীন সময়ের প্রতীক ওই গাছটার নিচে… তোর যাত্রাপথের দিকে আমি উদাস তাকিয়ে আছি – তাহলে দোষটা আমার চেয়েও বিভূতিভূষণের বেশি। যদি বুঝতাম নিরাপত্তাহীন জগতে স্বপ্ন কুড়াতে হয় না! দুঃখিত হৃদিকা… এক সোনালি কাঁথায় আমাদের স্বপ্নকে মুড়িয়ে রাখার কথা বলে, এভাবে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে গেলাম বলে। আমি তোমার কাছে আসার জন্যই অফিস থেকে বের হয়েছিলাম। আমার অনুভবে ঢোকার পাসওয়ার্ডটা জানলে তুমি বুঝতে, কেমন আকুলতায় আমি একবার শুধু চোখ মেলে তোমার চোখে, মায়ের আর ছোটভাইটার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের দোদুল্যমান চোখে অবাক তাকাতে চাইছি! তোমাকে যদি একবার বলতে পারতাম হাজার কোটি টাকা খরচের মহান ব্রত নিয়ে যারা ওষুধ কারখানা গড়ে তোলে তাদের সেই ব্রত কেমন ব্র্যান্ড-ধারণায় পরিণত হয়। একসময় তারা মানুষের জীবনকে তাদের কোম্পানির প্রয়োজনে একটা ব্র্যান্ডমাত্র মনে করে! আমি জানি ডাক্তার হয়ে অনেক রোগীর মৃত্যু দেখতে দেখতে তুমিও একসময় মানুষকে একটা ‘ব্র্যান্ড’ ভাবতে শিখবে। যেখানে শিশিরভেজা ভোর নেই, বাতাসের ভেতর বয়ে চলে শনশনে মানুষের ফিসফিস জীবনপ্রবাহ বলে কিছু নেই। তুমি হয়তো কোনো ডাক্তারের স্ত্রী-ই হবে। ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের সদ্য আবিষ্কৃত ব্র্যান্ডগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ব্যবহারের উপায় খুঁজবে। হৃদিকা চলে যাওয়ার আগে মিনতি আমার মানুষকে কোনোদিন শুধু একটা ব্র্যান্ড ভেবো না। ভুলে যেও না আমাকে তুমি কথা দিয়েছিলে, দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছাড়া তুমি কিছুই চাও না। হায় রে স্বপ্ন! হ্যাঁ মনে পড়েছে, ইদানীং মাঝে মাঝে আমি স্বপ্ন দেখতাম – গুরুত্বপূর্ণ এক পরীক্ষায় বসেছি। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর জেনেও আমি কিছুই লিখতে পারছি না। আজ যেমন আমার ব্রেনের অন্যান্য অংশকে জেগে থাকা এক অংশ চেষ্টা করেও সক্রিয় করতে পারছে না। ভুলে যেও না, আমাকে তুমি বলেছিলে, ‘তোমার আদরে জড়িয়ে থাকলে চাঁদের আলো ছড়ানো এক প্রান্তরে তোমায় নিয়ে বাস করতেও আমার কষ্ট হবে না।’ আরো বলেছিলে, ‘আমি থাকি বা না থাকি বাতাসে ভেসে ভেসে মর্মর হয়ে তোমার কানের কাছে ফিসফিস করব।’ কবরে কি বাতাস প্রবাহিত হয়? সেখানের বলয় বিস্তৃত আঁধারে যেটুকু বাতাস তারা কি পাতার মর্মরের ফিসফিসকে ধারণ করতে পারে? তোমার ভেজা-ভেজা ঠোঁটে কেমন অদ্ভুত মায়া খেলা করত। তোমার শরীরের লাবণ্যে ডুব দেওয়ার আগেই… ঠোঁটের কোণে লুকানো রহস্যময়তায় হারিয়ে যাওয়ার আগে… সারাজীবন ধরে অন্তরে লালন করা এক বাক্যকে বলার আগেই… আমার মাঝে মাঝেই দেখা সেই এলেবেলে স্বপ্নের মতো আজ আমি জীবন-পরীক্ষায় আমি ফেল করতে যাচ্ছি। বসন্তের শুকনো পাতার মতো ঝরে যাচ্ছ! আর তুমি হয়তো… কী জানি… তুমি কি এখন নিয়াজ মাহমুদের গাওয়া আমার প্রিয় সেই গানটা গাইছ –
তোমার যাবার সময় বুঝি হয়ে যায়
আমার দেবার কিছু বাকি রয়ে যায়
…এভাবে চলে যাবে তুমি?’
তোমার ভেজা ভেজা ঠোঁটের আহবান… প্রায় নিথর হয়ে আসা আমার এই শরীর পাসওয়ার্ডটা আর ভাঙতে পারছে না। আকুল চেষ্টা করেও পারছে না।
অ্যাম্বুলেন্সটা তিন-তিনটা হাসপাতাল ঘুরে এখন স্কয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটছে। আমার মাথার ক্ষত দেখে ডাক্তাররা ধরেই নিয়েছেন আমি কোনো রাজনৈতিক দলভুক্ত মানুষ। অথচ আমার ফেসবুক প্রোফাইলে আমি লিখে রেখেছি ‘আই হেট পলিটিক্স’। ওরা যদি একটু দেখত, আর আমাকে এই অপবাদ থেকে রেহাই দিত! মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের যেখানে দল থাকে, সে-রাষ্ট্রের বাতাসে ভেসে-বেড়ানো ফিসফিস সকল অনুভূতি বড় ভয়ংকর। জানি না ভয়ংকর রাষ্ট্রের একজন মানুষের আত্মার আগমনে স্রষ্টার ফেরেশতারা কোথায় পালাবে! আমার বন্ধুদের মোবাইলগুলো ইথারে আমার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের আকুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কাউকে পাবে না বন্ধু। ওহ, পেয়েছ? না পেলেই ভালো হতো। নিজের জীবনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে ডাক্তারিবিদ্যায় খুব একটা কাজ হয় না – ভদ্রলোক অযথাই পয়সা খরচ করবেন!
অবশেষে আমার বন্ধুদের মানসিক প্রশান্তি আমাকেই আনন্দ দিচ্ছে। তোদের হৃদয়টাকে এমন চিনতে পেরে মৃত্যু আমার কাছে সহজ হয়ে গিয়েছে। এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে চলে যাওয়ার সময় মানুষ কেন প্রিয় মানুষের কাছে চায়। স্কয়ার হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় আমার ‘কমা’য় চলে যাওয়া শরীরটার পাশে এখন শুধু মা ঠাঁয় বসে থাকে। আমার হাত নিজের দুহাতে জড়িয়ে আকুল হয়ে কী যেন খোঁজে। কী খোঁজ মা? তোমার ছোট্ট ফুয়াদকে? ভেজা চোখের এতো টলটল জলে স্রষ্টার কাছে কী জানতে চাও? ওহ্! একটা পাসওয়ার্ড? আমার প্রাণ ফিরে পাওয়ার একটা পাসওয়ার্ড জানার জন্য চোখের এতো জল ঝরাতে হয়? তোমার চোখে এতো সাগরজল জমা ছিল? হৃদিকা আমার ‘কমা’য় থাকা শরীরের পাশে সামাজিক-ভাবনাসহ বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। আমাকে নিয়ে আমি নিজেও ক্লান্ত! তুমি কেন ক্লান্ত হও না? তোমার ক্লান্তি নেই! বন্ধুরা আমার যন্ত্রণা আর দেখতে চায় না। আমার নিস্পন্দ এই শরীরটা তাদের কাছে এখন বোঝা হয়ে গিয়েছে। এই-ই জীবন! যা বহন করা যায় না মানুষ তাকে ফেলে দিয়ে সংগোপনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারা এখন নির্মোহ ভঙ্গিতে আমার আত্মার মুক্তি কামনা করে। আত্মা কী? এই যে আমার ব্রেনের যে-অংশ আমার স্মৃতিগুলো এখনো ধরে আছে… কানের কাছে এখনো শব্দগুলো নিয়ে অনুভূতির সঙ্গে ফিসফিস খেলায় মেতে আছে সেটা কি আমার আত্মা? আমি জানি না। শুধু জানি তুমি আমার হাত ছেড়ে দিলেই সেই অংশটুকুর ব্যাকুলতা কেমন অস্থিরভাবে বেড়ে যায়। অফিসশেষে সেদিন আমার তিন বন্ধু আমাকে দেখতে এসেছিল। ওদের বলা শব্দগুলো কম্পোজ করে নিয়ে আমার আত্মায় প্রোথিত করেছিলাম। একজন বলল, ‘তোর কি ধারণা ফুয়াদ বেঁচে আছে?’ অন্যজন উত্তরে বলল, ‘ডাক্তারি ভাষায় আছে।’ চিন্তিত প্রথম বন্ধু বলল, ‘কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমি পড়েছি ঝামেলায়। যিনি ওর চিকিৎসার খরচ স্পন্সর করছেন তিনি ১০ দিনের বেশি বিল পরিশোধ করবেন না। তিনি নাকি আমাদের আবেগের জন্য অযথা অর্থ খরচ করছেন।’
‘তাই বলে আমরা তো…’
তোমার থেকে শেখা ভাষাটির পাসওয়ার্ড আমার ব্রেনের এই অংশটুকু কেন ভুলে যায় না মা? পৃথিবীতে তো অনেক ভাষা। বাংলা ভুলে সে হঠাৎ হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু অথবা স্প্যানিশ শব্দের ডামাডোলে কেন মাতছে না? তাহলে আমি ভেবে ভেবে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করতাম।
ভাবতে গেলে অনুভবগুলো এতো দ্রুত তরল হয়ে আমার আত্মায় অনূদিত হয়ে আমাকে এতো ব্যাকুল আর করতে পারত না। দিন দিন সবার ‘বোঝা’ হয়ে যাওয়ার আগেই হারিয়ে যেতাম। অনুভবের সঙ্গে সত্তার এই খেলা কেমন কষ্টের মা, যদি তোমায় বোঝাতে পারতাম!
আগামীকাল হাসপাতালে আমার ১৫ দিন পুরো হবে। ১৫ দিনের মাথায় আমার ব্রেন শরীরের কোষে কোষে জেগে ওঠার পাসওয়ার্ড পাঠাতে না পারলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ডাক্তারের বলা কথাগুলো কম্পোজ করে এটুকু বুঝেছি, আগামীকালই সেই দিনটা। কিন্তু নার্সরা আমার শরীরে সংযোগকৃত সব যন্ত্রপাতি এখনই খুলে ফেলছে কেন মা? ডাক্তারের বলা কথাগুলো কম্পোজ করতে আমার এতো সময় লাগল! পৃথিবীর সময়ের সঙ্গে এতো দ্রুত ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে আমার সময়ের? কত লক্ষ-সেকেন্ড পর তোমাদের পৃথিবীর শব্দগুলো আমার কাছে কম্পোজ হয়ে আসছে?
উফ… আবার সেই অ্যাম্বুলেন্স! তুমি আমার এই শরীরকে নিয়ে কী করবে মা? ১৫ দিনে তোমার অশ্র“সমুদ্র শুকিয়ে গিয়েছে, নাকি তুমি তোমার ভাষা ভুলে গিয়েছ? মায়ের চোখের জলও শেষ হয়ে যায়! জীবন এমন তাহলে? বয়ে যাওয়ার তাড়নায় সে সবকিছু অতিক্রম করে যায়। কোথায় যায়? কিছুদিন আগে পড়া এক উপন্যাসে নায়ক চরিত্রের এই হাহাকার আমাকে কাঁদিয়েছিল। মানুষকে অতিক্রম করে মানুষ প্রাণীগুলো যেখানে যায় সেখানে কি বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা আছে?
যে-জানাজায় মিলতে আমি সারাজীবন ভয় পেতাম, সেই আমাকে নিয়েই তেমনি এক মহান যাত্রার উৎসব আজ। গ্রামের মানুষগুলো আমাকে এত ভালোবাসে! কিন্তু যাদেরকে আমি এতো ভালোবাসলাম – ওরা আশেপাশে কেউই কি নেই? একটা দিন, মাত্র একটা দিন কারো পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হলো না? হৃদিকার ব্যাপারটা আমি বুঝি। জীবন আর সমাজের প্রয়োজনে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টা সে ‘চাপা’ দিতে চেয়েছে। যে-মাটির নিচে ‘চাপা’ পড়ে যায়, তাকে বুঝি মাড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ!
যারা আমাকে সমাধিস্থ করছেন তাদের কাউকে শেষবারের জন্য আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা বলে যেতে পারতাম। আমার পক্ষে কোনো একজন যদি শেষবার লিখত – ‘গুড-বাই… শুভ বিদায় বন্ধুরা…’
আর প্রোফাইলটা যদি কেউ শুধু আমার পক্ষে মাঝে মাঝে সাইন-ইন করত! কিছুই না আমি একটা প্রোফাইল মাত্র হয়ে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতাম মানুষের অফুরান ছুটে চলার দিকে। এর শেষ কোথায়, কোথায় এই যাত্রার বিরতিস্থল? আমার স্ট্যাটাসে কেউ কি কোনো কমেন্টস করত? কী লিখত? নাকি শুধু ‘লাইক’ দিয়ে সেই অতিক্রম করে যাওয়া! আভিয়ানাও কি অনেক আগেই মরে গিয়েছিল? তার সাজানো মিথ্যা জীবনকে না জেনেই সবাই শুধু ‘লাইকে’র পর ‘লাইক’ দিয়ে গিয়েছে?
যারা আমার শরীরটাকে এখনই কবরে নামিয়ে দেবে  – ওদের কীভাবে বোঝাই, জীবন শুরুর আগেই ঝরেপড়া এই আমার অনেক কথা বাকিই রয়ে গেল! একবার শুধু চোখমেলে মাকে, হৃদিকা আর ছোটভাইটাকে প্রাণভরে দেখতে পেতাম। আহ্! কী অনন্ত পিপাসা… চোখ মেলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা এই আলোর জন্য আমার এত মায়া!
কবরের অনন্ত আঁধারে আমাকে যারা ডুুবিয়ে দিচ্ছ, তোমাদের আমি চিৎকার করে বলছি, আমি এখনো মরে যাইনি। একটা পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছিমাত্র! আমার শান্ত হয়ে আসা চিরঘুমন্ত ব্রেনের মধ্যে পাসওয়ার্ডটা লুকানো। কয়েকটা অক্ষরের অভাবে আমার শরীর জাগছে না বলে, আমাকে এতো বড় শাস্তি দেবে তোমরা! দ্যাখো, একটা ট্রেনের হুইসেল… মায়ের মুখ… একগ্লাস দুধ হাতে মা আমার পেছনে সারাবাড়ি ঘুরছে… একটা বৃষ্টির ঘোরলাগা দিন… খিচুড়ি… জনশূন্য-বৃষ্টিভেজা-প্রান্তর… বিস্তীর্ণ-মাঠ… কোথাও আর কেউ নেই… শুধু মায়ের চোখ… সব, সব আমার কাছে কত স্পষ্ট!
ছোট্টবেলায় তাল-আম আর বাঁশগুচ্ছের মাখামাখিতে এই বনের শীতল ছায়ার নিঃসঙ্গতা কেমন ভয় পেতাম আমি। জোনাকের আলোকজ্বলা আর রাতপ্রাণীদের আর্তস্বরে নিনাদিত এই স্থানটুকু শেষমেশ আমার ঠিকানা?! ভয়ার্ত অন্ধকার আমার সাথি এখন। মায়ের গর্ভে আমার ভ্রƒণ এমন অনন্ত অন্ধকারেও কেমন স্বপ্নময় আলো খুঁজে পেত। আর এই অন্ধকার ডাকছে অনন্ত ক্ষয়ের দিকে। মাঝখানে মহাকালের বুকে কাটানো আমার ২৯টা বছর! হিমশীতল বরফের অসীম ঠান্ডা আমার কোষে কোষে কম্পন তুলেছে। পায়ের তালু হয়ে হাজার হাজার নেকড়ে পোকা একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে সারাশরীরে। ওরা কি ব্যাকটেরিয়া? ব্যাকটেরিয়া তোমাদের কাছে মিনতি আমার – আমার ব্রেনের ভিজিওমোটর আর ভিজিওসেন্সরির সঙ্গে শ্রবণশক্তির যে-সংযোগ তা সবার আগে তোমাদের খাদ্য হোক। বেঁচে থাকতে পৃথিবীতে শিখেছিলাম ‘অনুভব’ মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মাথার যে-অংশটুকু আমার অনুভব বাঁচিয়ে রেখেছে আমি আর তা বহন করতে পারছি না। উফ… আমার শরীরের ভেতরে এখন বিস্ফোরিত আণবিক-বোমার স্ফীতি… অথচ ঠান্ডা! আর ফরমাল ডিহাইডের কেমন বাজে গন্ধ! ত্বকের নিচে, চুলের গোড়ায়, ক্ষুদান্ত্রের অতল গহ্বরে একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কেমন অদ্ভুত আন্দোলন! শুধু শক্ত করোটির ভেতরে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা আমার ব্রেনের অডিটরি-নার্ভ, অডিওসেন্সরি এলাকার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলছে…। বাইরে কি এখন অনেক রাত? এটা কি আলোয় ভরা অদ্ভুত সুন্দর একটা দিন? হ্যাঁ, এখন আমার কানটা আস্তে আস্তে সংযোগ হারিয়ে ফেলছে আমার নাকের সঙ্গে!
ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ত্বকের গভীরে বয়ে চলা চাষাবাদে ঘাস গজানোর আগে আমার শুধু একটা স্মৃতি… একটা পাসওয়ার্ড … কী যেন… কী যে… ন…! জন্মের সময় কোনো এক অ্যাঞ্জেল আমার কানে কানে ফিসফিস করে একটা পাসওয়ার্ড বলেছিল। পাসওয়ার্ডটার গুরুত্ব না-বুঝেই মায়ের জরায়ুর সাগরে আনন্দে অবগাহন করেছি শুধু। অ্যাঞ্জেলের কথায় ফিক করে হেসেছি আর লাথি দিয়েছি মায়ের সেই অলৌকিক অন্তর্জালের দেয়ালে… সেই পাসওয়ার্ড!
আমার কী যেন ক-রা-র ছিল… ২৯ বছর… একটা ট্রেন … হুইসেল… একটা ফ-ড়ি-ং ধ-রা… দ্যাখো মা তোমার হারিয়ে যাওয়া সেই ‘ট্রে’টা এখানে পড়ে আছে… আকাশের তারাদের সাঙ্গে.. হারিয়ে যাওয়া সেই ট্রে-টার জন্য তুমি আমার গালটায় চড় কষিয়েছিলে… ওহ তাই তো… পাসওয়ার্ডটা এখন মনে প-ড়ছে … এম,কিউ… দিয়ে নয়; ওটা আমা-রই না-মে?
‘এফ… ই-উ…ডি…’
তার-পর? কী… যে-ন! আমার… না-মটা…? কী যে-ন, ম-আ-আ-!মা!