বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

আমার চারপাশে পাহাড়ের স্তব্ধতা। এই স্তব্ধতা কেউ ভেঙে দিক আমি চাই না। সকালবেলা, রোদ যখন গাছের পাতা রঙিন করে। আমি এক কাপ কালো কফি নিয়ে গরুর ঘণ্টার পিছু পিছু পাহাড়ের ঢালে চলে আসি। আমাকে ঘিরে ধরে পাহাড়ের স্তব্ধতা, কিন্তু পাহাড়ের মধ্যে নানা শব্দ আছে, সে সকল শব্দ কখনো পাখির ডাক। সে সকল শব্দ কখনো পাখির ডাক, কখনো পাহাড়ের বাজনা, কখনো পাহাড়ে বাতাসের বাজনা, কখনো গরুর পায়ের আওয়াজ, কখনো প্রজাপতির নড়াচড়া হয়ে যায়। আমি শব্দকে এভাবে ভিন্ন ভিন্ন করতে থাকি। আমি শান্ত হয়ে যাই।

তখন তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। তুমি এসেছ তোমার দেশ থেকে পালিয়ে, আমিও এসেছি আমার দেশ থেকে পালিয়ে।

আমি বললাম, সেই একই কাজ। গ্যারেট সাফ করলাম, কয়লা তুললাম।

কিচেন সাফ। কিচেন সাফ করলাম।

 

লেখোনি কিচেন সাফ করলাম।

লেখোনি কিছু।

না।

কেন লেখো না। লিখলে তো অতীতটাকে খুঁজে পাও।

আমি কোনো জবাব দিই না। ঠান্ডা লাগে, আর একটি পুলওভার গায়ে চাপাই। কিচেনে গিয়ে চা বানাই, ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসি রুটি ডাল, দুধের বোতল, চিনি। চা খেতে খেতে আমরা নিঃশব্দ হয়ে যাই। আমরা ফিরে যাই নিজের নিজের অভিজ্ঞতায়।

যেদিন তোমার মুড ভালো থাকে, সেদিন কিংবা সেসব দিনগুলিতে তুমি বলতে তোমার ওয়ার্স শহরের কথা, তোমার প্রিয় শহর।

তুমি বলতে টমাসের কথা। তোমাদের প্রিয় কাফে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। টমাস সবসময় দেরি করে আসত। কাফের কাছে যেই ট্রাম আসত, কাচের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকত, যে-কোণে তোমরা সবাই, এক কোণে, সেখানে এসে মাফ চাইত দেরির জন্য। মারী কাউন্টারের পেছনের মেয়েটিকে চেঁচিয়ে ডাকত, এক পেস্নট মাশরুম ফ্রাই করো।

মানুষ কেন পাথর? হয়? তুমি কি তা খুঁজে পেয়েছ? কিংবা আমি?

মনে আছে আমরা যখন একত্রে থাকা শুরু করি। তুমি বলতে নিষিদ্ধ ইশতেহার যেভাবে আমি পড়ি সেভাবে নাকি আমি তোমার দিকে তাকাই, সেই একাগ্রতা নিয়ে তোমার দিকে তাকাই, সেই একাগ্রতা নিয়ে আসলে আমাদের দুজনের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিষিদ্ধ ইশতেহার গেঁথে আছে।

তুমি কাজ সেরে সারাদিন পর ফিরে আসতে। তুমি কাজ নিয়েছিলে পাড়ার লাইব্রেরিতে। তুমি ফিরে এলেই বলতাম, চা?

হ্যাঁ, বলেই ক্লোকটা ছুড়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে।

কেটলি বসিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসতাম তোমার কাছে। তোমার চুলে হাত বুলোতাম। দেয়ালের ময়লা ওয়ালপেপার বাতির আলোয় কদর্য হয়ে উঠত। আমার নাকে আসত কেন জানি পচা ফুলের গন্ধ।

ততক্ষণে তুমি উঠে বসেছ। একটু হেসে জিজ্ঞাসা করতে, কী করলে সারাদিন?

আমি বলতাম, সেই একই কাজ।

কথা বলত জোরে, হাসত জোরে, যদিও কখনো বলোনি, আমি বুঝতাম টমাস তোমাকে প্রেম করত সমগ্র সত্তা দিয়ে।

টমাসের কথা যখন বলতে চোখে পৃথিবীর যত শরমের সব শরম ভর করত।

মাশরুমে কামড় দিয়ে টমাস একদিন বলেছিল, দ্যাখো সবই আমার মনে আছে : আজ সকালে মা চিঠি পেয়েছেন সেন্ট্রাল কমিটি থেকে বাবাকে রিঅ্যাভিলেট করা হয়েছে। চিঠি পড়ে মা শুধু বললেন, তোর বাবাকে এখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, সব তছনছ করে যায় : এমনকি তোর বাবার ফটোগ্রাফ পর্যন্ত। তখন থেকে আমার আছে কান্না আর চুপ করে থাকা। এখন এই চিঠি নিয়ে আমি কী করব। তোর কাছে রাখ।

টমাস পকেট থেকে বের করে চিঠি দিয়ে দিয়েছিল তোমার দিকে। তুমি চিঠিটি নিয়ে ভাবছিলে, তাই না?

টমাসের বাবা গমুলকার সহকর্মী ছিলেন। রুটির রায়টে গমুলকাকে সরানো হলো। সেই সঙ্গে টমাসের বাবাকে প্রতিবিপস্নবী কর্মে দায়ী করে তাকে দেওয়া হলো সশ্রম কারাদ-। জেলেই তিনি মারা যান। জানুয়ারির কোনো এক সকালে মৃতদেহ তাদের বাড়িতে পৌঁছতে পেরেছিল, কবরস্থানে বরফ আর বরফ। কিছু নেই, কিছু ছিল না। না পাখি, না পাতা, না কোনো শব্দ। জানুয়ারির ছ তারিখ, দ্যাখো তারিখটা পর্যন্ত আমার মনে আছে।

তুমি টমাসের হাত চাপ দিয়ে বলেছিলে, ছিঃ মন খারাপ করে না।

টমাস ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, চিৎকার শুরু করেছিল, মন খারাপ করব না। ভদ্রলোক, বন্ধু, সহকর্মী, কমরেডরা বলুন আমি মন খারাপ করব না। আমার বাবাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তবু আমি মন খারাপ করব না। বলুন তবু আমি মন খারাপ করব না। বলুন কমরেডরা, বন্ধুরা, সহকর্মীরা আমার মন খারাপ করা উচিত কি না।

টমাসের চিৎকার শুনে তাদের অনেকেই হতবাক, রেগুলারদের অনেকেই বিল চুকিয়ে ততক্ষণে রাস্তায়। শুধু তুমি চুপ, আর কাউন্টারে মারী নির্ধারিত গস্নাস ধুচ্ছে।

ততক্ষণে টমাসের রাগ পড়ে গেল। আসেত্ম আসেত্ম বলেছে, মাপ করো লক্ষ্মীটি, মাপ করো লক্ষ্মীটি, মাপ করো। বাবার কথা মনে পড়ায় বাবার পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটেছি। বাবার বিশ্বাসের মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। আমাদের দেশে শোষণহীন সমাজ তৈরি হবে সে সত্য, তেমন সত্য ওয়ার্স শহর কিংবা ক্রেকাও শহরের দুর্গ।

বাবার ডায়েরিতে একটা নোট পড়েছি, যদি মুক্ত ব্যক্তিদের সম্ভব তাহলে মুক্ত ব্যক্তি-রাষ্ট্র এই সম্বন্ধ রচনা করতে পারে।

টমাস কথা বলছে, থেমে যাচ্ছে, ফের বলছে। তুমি তাকিয়ে টমাসের দিকে, কিংবা নয়। তুমি হয়তো ভাবছিলে ভিস্ত্তলা নদীতে স্রোত কেমন ফুলে উঠছে, হয়তোবা ভাবছিলে, নদীর পাড়ে লিনডেন গাছের তলায় আগের জন্মে টমাসের পাশে বসে জন্মদিনের উৎসবের কথা। পুরনো দিন পুরনো দিনের মতন ধূসর, কতদূরের তাই নয়? যেখান থেকে স্বপ্নের শিস শোনা যায়।

টমাস তখনো বলছে, স্বনিযুক্ত এলিটরা ক্ষমতা ও সুবিধা কতদিন অগণতান্ত্রিক উপায়ে ধরে রাখবে। নিশ্চয়ই শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন ফের দেখা দেবে, মুক্ত ব্যক্তিরা ফের সমাজ তৈরি করবে। নচ্ছার সংবিধান খানখান হয়ে যাবে, গাডানস্কের লেনিন শিপইয়ার্ডের শ্রমিকরা প্রচলিত বিধিনিষেধ ভেঙে ফেলবে, আমরা ফের মানবসমাজের কেন্দ্রে, শেষ মানুষটি অবধি তিক্ত, সে অবধি আমরা আসব।

জানালা নিয়ে ভেসে ওঠে আমার শহর, যেখানে গণতন্ত্র ফের পর্যায়ক্রমে গণতন্ত্র ফের সামরিকতন্ত্র লেফট রাইট। আমি উঠে কিচেনে গিয়ে কেটলি বসাই, রুটি কাটি। আমি উবু হয়ে বসি : চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ আর আমার চোখ তোমার ওপর নিবদ্ধ।