পোড়োজমির ভেতর দিয়ে, ভুবনডাঙার দিকে : মাহমুদ আল জামানের কবিতাসমগ্র

আমাদের দেশে কলম-নামের আড়ালে থাকা কোনো কবি বা লেখকের পরিচিতিটা সামনে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে না, যেহেতু কবি-লেখক হিসেবে নিজের নিভৃত ভুবনে তাঁর জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁকে একটা পেশায় স্থিত হতে হয়, তাঁকে সভা-সমিতিতে যোগ দিতে হয়, তাঁর পরিচিতজনের বলয়টাও বড় হতে থাকে। কিন্তু মাহমুদ আল জামান তাঁর বেছে নেওয়া এই নামেই দীর্ঘদিন কবিতা লিখে গেছেন, অনেকেই জানতেন না তাঁর ভিন্ন কোনো নাম বা অস্তিত্ব আছে, অনেকে অবাক হতেন মাহমুদ আল জামানের কবিতা পড়ার পরও তাঁর একটি ছবিও কেন দেখেননি অথবা তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি, তা নিয়ে। তিনিই যে সাংবাদিক-সম্পাদক-রাজনৈতিক কর্মী-শিল্পতাত্ত্বিক-মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসনাত, তা ক্রমশ প্রকাশ্য হয়েছে বটে, তবে পাঁচ বছর আগেও আমি এমন মানুষকে দেখেছি, যারা বিষয়টা জানতেন না। এর কারণ তাঁর এই দুই সত্তাকে পৃথক করে রাখতে আবুল হাসনাতের সংকল্প, তাঁর প্রচারবিমুখতা, আত্মমগ্নতা এবং নিজের স্বস্তিবলয়ের বাইরে বেরুনোতে অনাগ্রহ। খুব আপনজন ছাড়া তিনি আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন না, নীরব শ্রোতার আসনে থাকতেই পছন্দ করতেন। তাঁর কোনো বই নিয়ে আলোচনা করতে কাউকে অনুরোধ করা তো দূরের কথা, কেউ সেরকম কিছু করার প্রস্তাব তাঁকে দিলে তিনি কুণ্ঠা বোধ করতেন। আমার মনে হয়, মাহমুদ আল জামানকে তিনি কবিতার ভুবনেই থাকতে দিয়েছেন, তাঁর কবিসত্তার সার্বভৌমত্বকে যেহেতু তিনি উচ্চ মূল্য দিতেন।

আমি প্রথম জেনেছি মাহমুদ আল জামানকে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে পরিচয় ঘটেছে আবুল হাসনাতের সঙ্গেও। দুজনেরই ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়েছে, তিনি তাঁর কবি-পরিচিতিকে আলাদা করেই রাখতে চেয়েছিলেন। আবুল হাসনাতের সমাজবীক্ষণ, রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শচিন্তা ও নান্দনিকতা অবশ্যই মাহমুদ আল জামানের কাব্যভুবন গড়ে দিয়েছে, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ-হতাশা-কল্পনা-প্রত্যাশাও প্রতিফলিত মাহমুদ আল জামানের কবিতায়; কিন্তু আবুল হাসনাত জানতেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় মানুষ ও সমাজ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন এবং মূল্যবোধের, সভ্যতার ও সুন্দরের চর্চাগুলির পুনরাধিষ্ঠান ও মানবের ঘুরে দাঁড়ানোর তাঁর আশাবাদ পরাহত না হলেও সহজে অর্জনযোগ্যও নয়। এ নিয়ে একজন রাজনৈতিক কর্মী বক্তব্য দিতে পারেন, কর্মসূচিও দিতে পারেন, কিন্তু মানুষের মনে তাঁর স্বপ্ন বা আশাবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি তাঁর জন্য কঠিন। সে-কাজটি একজন কবি করতে পারেন। কবির শক্তিতে তাঁর আস্থা ছিল, রোমান্টিক কবি  শেলির   মতো   তাঁরও   বিশ্বাস   ছিল,   কবিরা   হচ্ছেন   পৃথিবীর  স্বীকৃতিবঞ্চিত আইনপ্রণেতা। কিসের আইন? সভ্যতার, সুন্দরের। আইন না বলে বিধান বলাই ভালো। শেলির মতো মাহমুদ আল জামানও একটা ঝড়ের আশা করতেন, যা ধ্বংস করবে, সবকিছু উড়িয়ে নেবে; আবার নতুন সৃষ্টির বীজও বপন করে দিয়ে যাবে।

আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের; তাঁকে আমি কাছে থেকে দেখেছি, তাঁর কথা শুনেছি, তাঁর সঙ্গে বড় বড় শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, ঢাকা-কলকাতার ছবির গ্যালিরিতে ঘুরেছি, চা খেতে খেতে আড্ডা দিয়েছি, তাঁর সাহিত্যিক পছন্দ-অপছন্দ, তাঁর রাজনীতি, তাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলেছি। বুঝেছি, তাঁর ওপর একটা প্রভাব ছিল প্যালেস্টাইনের বিপ্লবী কবি মাহমুদ দারবিশের। তাঁর থেকে চার বছরের বড় কবির সঙ্গে তিনি একটা আত্মিক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। দারবিশও তাঁর গ্রামকে ধ্বংস হতে দেখেছেন, সভ্যতাকে পোড়োজমি হতে দেখেছেন, প্যালেস্টাইনকে হারানো স্বর্গ হিসেবে দেখেছেন। একজন ব্যক্তি দারবিশ জানতেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী নারকীয়তা তাঁর দেশকে অবয়ব নিতে দেবে না, বরং এর ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে দেবে, কিন্তু কবি দারবিশ স্বপ্ন দেখতেন, প্যালেস্টাইন নামক স্বর্গের একদিন পুনরুত্থান হবে। আবুল হাসনাত ব্যক্তি হিসেবে বাস্তবের পীড়নে হতাশ হতেন, কষ্ট পেতেন, বলতেন, এই দেশ কি তাহলে এলিয়টের পোড়োজমি হয়ে যাবে? কিন্তু মাহমুদ আল জামান জানতেন, পোড়োজমির ভেতর দিয়ে যে-যাত্রা, তা একসময় আমাদের ভুবনডাঙায় নিয়ে যাবে। রফিক আজাদের ছিল চুনিয়া, যা ছিল তাঁর আর্কেডিয়া, মাহমুদ আল জামানের ছিল ভুবনডাঙা, যার মেঘ তাঁকে ‘ছুঁয়ে যায় স্বপ্নে’, এবং ‘জটিল নিঃস্তব্ধতায়/ প্রীতি দেয় বুকে’। এই ভুবনডাঙা যে তাঁর কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ, যে-কোনো পাঠকও তা জানে; কিন্তু ভুবনডাঙায় যেতে হলে পোড়োজমি পার হতে হবে। এই দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য যাত্রার প্রতিটি স্তরে আছে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। তবে ভুবনডাঙার পত্তন যারা করেছিলেন, সেই পূর্বপুরুষেরা আছেন। তাঁর আমাদের স্বপ্নে-জাগরণে একটা নির্ভয়ের নিশানা হয়ে থাকেন। তাঁদের আহ্বান করলে তাঁরা আসেন, কিন্তু সেই আহ্বান জানানোর জন্য চিত্তের সমুন্নতি দরকার। কাজটা কঠিন, তবে সাধ্যের বাইরে নয়। দারবিশের মতো মাহমুদ আল জামানের কবিতাতেও পিতা, পূর্বপুরুষ আর কিংবদন্তি মানুষের উপস্থিতি। ‘পিতা, এই হেমন্তে’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙায়) কবিতায় তিনি জানাচ্ছেন, ‘পিতা, এ শহর ছিল বড়ই মনোরম, পোড়েনি চাঁদ/ কোনোদিন,’ অথচ কত দ্রুত এই শহর থেকে ‘পাখি, কাক, শকুন/ অন্তর্হিত হল’ এবং

স্বপ্নাচ্ছন্ন মানুষের রক্তক্ষরণে

বিবর্ণ ভাতের থালায়

ধরা থাকল আর্দ্র, করুণ চোখ

দুই

কবিতাসমগ্রতে মাহমুদ আল জামানের প্রকাশিত তিনটি কবিতাগ্রন্থ – জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায় এবং ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল এবং কয়েকটি অগ্রন্থিত, অপ্রকাশিত কবিতা অন্তর্ভুক্ত। এটি প্রকাশের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়, কারণ কবির তিনটি বই এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য। তাছাড়া, তিনটি বই ক্রম অনুসারে একই মলাটের ভেতর থাকলে কবির চিন্তার ভাবনার প্রসার, একটি পর্যায় থেকে অন্য একটি পর্যায়ে কবিতার উত্তরণ বা মোড়-ফেরা, এর শৈল্পিক ও আঙ্গিকগত পরিবর্তনের একটা পরিষ্কার ছবি সহজেই ধরা পড়ে। মাত্র তিনটি কবিতাগ্রন্থেই – এবং অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত কবিতায় এরকম উত্তরণ-পরিবর্তনের বেশ কিছু উদাহরণ দেখা যাবে। এবং এ-বিষয়টি বোঝা যাবে, কবিতার নান্দনিকতা বা এর শিল্পসুষমার পাশাপাশি চিন্তারাজ্যে এর অভিঘাত, ও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও সমাজদর্শনের এক অন্তরঙ্গ সক্রিয়তাই মাহমুদ আল জামানের অভিপ্রায় ছিল। তাঁর কবিতার এ যদি একটি দিক হয়ে থাকে, আরেকটি দিক ছিল ব্যক্তির নানা সংকট-প্রেম-অপ্রেম, কষ্ট-বিষণ্নতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা সমীকরণ – এবং তার নিরাবলম্বতা, তার আশা এবং দুরাশাও। মাহমুদ আল জামানের কবিতায় স্বদেশ আছে তার অতীত এবং নিকট ইতিহাস নিয়ে, বিশেষ করে উনিশশো একাত্তরের বিভীষিকা ও মহিমা নিয়ে, সম্ভাবনা এবং সংকট নিয়ে। আবার আধুনিক যে-কোনো কবির মতো সমকাল নিয়েও, মানব এবং সময় নিয়েও তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কবিতাগুলিতে স্থান করে নিয়েছে। অনেক কবিতায় তাঁর সমাজ ও ব্যক্তি নিয়ে হতাশাও প্রবল। প্রস্থানের, চলে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার, নিচে নেমে যাওয়ার বর্ণনা ও চিত্রকল্পও তাঁর কবিতায় প্রচুর, যেমন নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর খেদ। ‘হারিয়ে গেছে বর্ণমালা;/ অক্ষর নেই বুকে’ (‘অক্ষর নেই বুকে’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক), ‘ছেড়ে যাচ্ছে বলে, একাকী দুঃসময়ে/ নিহতের/ শাদা করোটির ভেতর দোল খায়/ হলুদ পাতা।’ (‘ছেড়ে যাচ্ছে’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক),  ‘শ্যামল নিসর্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূর নীলিমায়’ (‘চলে যাচ্ছে’, ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল), ‘এখানে/ হারিয়ে যাচ্ছে ঘরের চাবি’ (‘একটি মৃত্যু’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক), অথবা

নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার গন্তব্য আর স্বপ্নের মায়াবী কাঁথা

নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সন্তের পদচ্ছাপ ও ঈশ্বরের কাছে নতজানু প্রার্থনা

নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিঃশ্বাসের সঙ্গে থাকা রবীন্দ্রসঙ্গীত

নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আনন্দভৈরবী আর ভস্ম হচ্ছে আপাদমস্তক

(‘নষ্ট হয়ে যাচ্ছি’, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়)

মাহমুদ আল জামান নাগরিক কবি, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর মনের ভূগোল জুড়ে উপস্থিত বাংলাদেশ। এই দেশের কৃষক যদিও তাঁর কবিতায় নেই, শ্রমিকও নেই, অথবা এর গ্রামের সবুজ প্রকৃতিও নেই, কিন্তু তাঁর ভুবনডাঙায় একই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান-ভবিষ্যৎ, এর সব সম্ভাবনা ও সৌন্দর্য যে-খোলামেলা অবয়বে দৃশ্যমান, তা না-শহর না-গ্রাম, অর্থাৎ একটা মনোজগতে তাকে স্থান দেওয়া যায়। ভুবনডাঙ্গার বিপরীতে আল জামানের ঢাকাকে যদি স্থাপন করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, একটা বাস্তবধর্মী চিন্তায় তিনি পোড়োজমি-উত্তর বাংলাদেশকে সাজিয়েছেন। একাত্তরের সংগ্রাম, রক্তক্ষরণ, এমনকি সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ও এই বাস্তবধর্মিতার প্রেক্ষাপটটি নির্ধারণ করেছে। কবিতাসমগ্র জুড়ে যে-সুরটি প্রধান. তা হচ্ছে নিরাশার, উদ্বেগের, বিষণ্নতার; কিন্তু আমরা জানি, এই সুরটির সঙ্গে একটা ভিন্ন সুরও বাজে, যা নিরাশা-বিষণ্নতার বিপরীতে দাঁড়ায়। বলা যায়, কবিতাগুলির ভেতর একটা দ্বান্দ্বিকতাকে মাহমুদ আল জামান শুরু থেকে সক্রিয় রেখেছেন, যে-দ্বান্দ্বিকতার একদিকে কালো, অন্যদিকে জোরালো না হলেও একটা সম্ভাবনার আলো; একদিকে ব্যক্তি, অন্যদিকে সমাজ, এবং একদিকে আত্মচিন্তা, অন্যদিকে ভুবনডাঙায় সমগ্রদর্শন।

অন্যভাবে দেখলে, পোড়োজমির ভেতর দিয়ে কবির যাত্রাকে প্রাধান্য দিলে তিনি যে সত্য ও সুন্দরের খোঁজে আছেন, মুখোশের পেছনের মানুষকে খুঁজছেন, আততায়ীর আনাগোনা, কালো বেড়ালের অশুভ সংকেতকে নানাভাবে পড়ছেন, ‌ তাও স্পষ্ট হয়। একসময়, যখন নারী, বিশেষ করে সবিতা হালদার যখন কবিতার পর কবিতায় উপস্থিত হয়ে পাঠককে একটা ধাঁধায় ফেলে দেন, তখন তার পরিচিতি কী, কবির তিনি মানসপ্রতিমা, নাকি হারানো প্রেম অথবা শুধুই তাঁর প্রেম-অপ্রেমের এক প্রতীকী রূপ, তা নিয়ে ভাবতে হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সবিতা হালদার আল জামানের কবিতার এক ভিন্ন মাত্রা খুলে দেন। নিজেকে যে কবি এক নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে রেখে সমাজ-ইতিহাস-সমকাল-দর্শনের কাজটি করে যাচ্ছেন, তিনি সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে একজন সপ্রাণ মানুষ ও প্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হন। অথচ তাঁর কবিতা কোথাও সংরক্ত নয়, দেহ … বিশেষ করে নারীদেহ – নিয়ে এক দূরবর্তী নির্লিপ্ততাও কবিতাগুলিতে দৃশ্যমান। এ-প্রেম কি আদর্শিক, নাকি জীবনের সংঘাতে, ওই নারীর ‘চলে যাওয়া’, ‘হারিয়ে যাওয়া’ বা অবহেলার অভিঘাতে উচ্ছ্বাসবর্জিত, নিষ্কাম?

মাহমুদ আল জামান স্পষ্ট করে কিছুই জানান না। আধুনিক, নাগরিক মানুষের নানান অপ্রাপ্তি, অবদমন আর নিঃসঙ্গতার একটি অনুষঙ্গ হয়ে সবিতা হালদার আবির্ভূত হন এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

তিন

যে দুই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে কবিতাসমগ্রর কবিতাগুলি পড়তে হয়, এবং যারা এদের দ্বান্দ্বিকতার মূল শক্তি তৈরি করে দেয়, সে-দুটি হচ্ছে বর্তমানের পোড়োজমি, যার জন্য দায়ী মানুষের স্খলন, তার নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা এবং তার ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়জুড়ে চলে আসা বীভৎসতা; অন্যটি ভুবনডাঙা, যা অতীতের এবং ভবিষ্যতের, যাতে আছে বর্তমানের খোঁজে মানুষের ভুলে যাওয়া সুন্দর এবং সুস্থতার অতীত ছবিগুলি, যাদের উদ্ধারে মানুষ একবার যাত্রা শুরু করলে সেগুলো জীবন্ত হয়ে উঠবে। এই যাত্রাটি আমাদের পরিচিত, আমরা এর সন্ধান পাই লোকগল্পে, নানান রূপকে, মিথের অঞ্চলে এবং রাজনীতির দর্শনে। আবুল হাসনাত যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন, এবং যার বাস্তবরূপ দিতে তিনি সংগ্রামমুখরও ছিলেন, তাতেও এই যাত্রাটিতে আছে মূল মনোযোগ। এই যাত্রার এক প্রান্তে পুঁজির শাসন, পশ্চিমা উপনিবেশী শক্তির – এবং তাদের অনুসরণকারী পুবের শক্তি-আধাশক্তিদের – অপচর্চা, দ্বিচারিতা; সভ্যতা ও মানবতাকে শেকল পরিয়ে দেওয়া, এবং অন্যদিকে বিপ্লব, মানবমুক্তি, শ্রেণিহীন সমাজ ও সীমান্তহীন বিশ্ব সৃষ্টি। আল জামানের পোড়োজমিতে বাংলাদেশের ও সমকালীন ইতিহাসের ছায়াপাত যতটা আছে, ততটা নেই আবুল হাসনাতের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বাম রাজনীতির ক্রমাগত অক্ষচ্যুতি, আদর্শ হারানো ও মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে নিজস্ব স্রোতটিকে বিলীন করে দেওয়া তাঁকে হতাশ করেছিল। যে স্বপ্ন ও প্রত্যয় নিয়ে তিনি সমাজবদলের সংগ্রামে নেমেছিলেন, তা নিঃশেষ হয়েছে একদিন। এজন্যে তাঁর রাজনীতির কোনো পরিণত রূপ নিয়ে তিনি আর ভাবতেন না, বরং সান্ত্বনা খুঁজতেন যৌবনের চেনা মেটাফর ও ট্রোপগুলিতে – রাজপথের মিছিল, শহিদ মিনার, পুলিশের গুলি, স্লোগান – যেসব ছিল ষাটের দশকের বিভিন্ন সময় ছাত্ররাজনীতিতে নাম-লেখানো প্রায় সকলেরই দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ। মিছিলে যাওয়ার তখন ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, যেহেতু মিছিলে অনেক স্ফুলিঙ্গ একসঙ্গে জড়ো হতো, সেগুলি থেকে একটা বড় অগ্নুৎপাত হবে, সেই নিশ্চিত সকলেরই মনে ছিল। একাত্তরে তা হয়েছিল বটে। কিন্তু এরপর সমাজবদলের জন্য প্রয়োজনীয় দ্বিতীয়টি আর হয়নি। এখন তো হওয়ার সম্ভাবনাও বিলীয়মান। ‘এই ট্রেনে’ কবিতায় আমরা পড়ি ‘ঘুমের মধ্যে জেগে উঠল স্বপ্নময় গান, নগ্নপদ মিছিল আর শহীদ মিনার’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙায়), অথবা ‘ছায়ার সঙ্গে’ কবিতায় সবিতা হালদারের কথা যিনি এখন আছেন অনেক দূরে, অথচ যিনি ছিলেন ‘মিছিলের মুখ, ফেস্টুন কাঁধে জ্বলজ্বলে পতাকা হয়ে নক্ষত্রের মতো জ্বলে ছিল বুকে’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙায়) অথবা ‘সত্য বটে’র অনুধাবন

সত্য বটে নিয়ন্ত্রণে সবকিছু বন্ধ নিরবধি।

খুলে দাও, দেখতে দাও আজ

দীপ্তিতে জ্বলে ওঠা মিছিলের কারুকাজ। (জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

এই তিনটি উদ্ধৃতিতেই আছে মিছিলের শক্তি হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এখন মিছিল হানা দেয় তাঁর স্বপ্নে, মিছিল অপসৃত হয়তো সবিতা হালদারের সঙ্গে, মিছিলকে এখন উদ্ধার করতে হবে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল থেকে। কিন্তু মিছিলের বারুদ থেকে কারুকাজটাই এখন দেখতে হয়। তাহলে মিছিল কি স্থান নিল সময়ের জাদুঘরে? ‘স্বপ্নের কাছে’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙ্গায়) কবিতায় কবির সহজ স্বীকারোক্তি : ‘স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়,’ এবং ‘আর ক্রন্দনের জন্য কিংবদন্তির মানুষ অপেক্ষা করছে/ কিংবা ঘুমহীন ঘুমের ভিতরে/ একা একা হাঁটছে শূন্যতার দিকে।’ স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়া যদি পোড়োজমির প্রেক্ষাপটটি তৈরি করে – পোড়োজমিরও একটা প্রেক্ষাপট থাকে, হঠাৎ করে, একদিনে তা জেগে ওঠে না – তাহলে যে কয়েকটি অপূর্ণতা ও অতৃপ্তি তার পেছনে ছিল তার একটি হলো স্বাধীনতাটা এসেও সম্পূর্ণ ধরা না দেওয়া – ‘রক্তাপ্লুত স্বাধীনতা/ পেয়েও পাইনি তোমাকে।’ (‘পেয়েও পাইনি’) এবং অন্যটি সবিতা হালদারের রূপকে কবির যৌবনের স্বপ্ন ও বিনিয়োগগুলি হারিয়ে যাওয়া।

স্বাধীনতা পেয়েও না পাওয়ার কষ্টটি মাহমুদ আল জামানের অনেক কবিতায়। যেমন, ‘ছুটি, তোমার ছুটি’তে (জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক) ‘তারপর সবকিছু হয়ে পড়ল’র পর ‘যুবকের বুকে তখন যুদ্ধেরই রক এন্ড রোল মিউজিক।’ অথচ যুদ্ধ শেষ হলে

কঙ্কালের শরীর জুড়ে খেলা করে

আধাখানা চাঁদে জোড়াখুন শুয়ে থাকে।

‘অদ্ভুত অর্কিড’-এ (জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক) পুড়ে যাওয়া গ্রামের বিক্ষত নারীর জিজ্ঞাসা ‘স্বাধীনতা তুমি কতদূরে’ কোনো উত্তর পায় না। তবে কোনো একদিন ভুবনডাঙায় গ্রন্থে ‘স্বাধীনতার স্তম্ভে’ শীর্ষক তিনটি গদ্যকবিতাতে এই কষ্টটি অনেক সময় নিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন। প্রথম কবিতায় স্বাধীনতার স্তম্ভে কবি আরো কিছু সহযোদ্ধার সঙ্গে নাম লিখছেন, কিন্তু অনুভব করছেন ‘যৌবনে বার্ধক্যে পীড়িত হতে থাকল তারুণ্য।’ দ্বিতীয় কবিতায় অট্টালিকা ধসে পড়ে, ধাবমান অশ্ব মৃত্যুর বিষাদে নিমগ্ন হয়, ‘রিক্ত শূন্য হেমন্তের মাঠে বন্দির প্রার্থনা কোনো ভাষা খুঁজে পেল না,’ এবং ‘স্বাধীনতার স্তম্ভ হাহাকার করে কানামাছি খেলা দেখল।’ তবে তৃতীয় কবিতায় স্তম্ভটি শক্তি খুঁজে পেল, সাঁইত্রিশ বছর আগের বিজয় ধ্বনিকে দূরে মিলিয়ে যেতে দেখেও তা ‘অনমনীয় এক বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে উঠল।’ স্বাধীনতার স্তম্ভটি একই সঙ্গে বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের প্রতীক। সেই ভবিষ্যৎ, যা কবিকে নিয়ে যাবে ভুবনডাঙায়।

স্বাধীনতার প্রশ্নে এই কষ্ট একজন কবি পুষে রাখতে পারেন না, একটা প্রত্যাশার কাছে এর সমাধান তিনি খুঁজে নেন। সমাধানটি প্রথমত উপহার দেয় স্বদেশ :

যত কিছু হোক থেকে যাবে উর্বর পলিমাটি

যুদ্ধ জয়ের অম্লান স্মৃতি

(‘যত কিছু হোক থেকে যাবে’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

এবং কবি নিজেই। জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক গ্রন্থের ‘পুনরুত্থান’ কবিতায় যে-পোড়োবাড়ির ছবিটি বর্তমান সময়ের এক প্রতীক হিসেবে কবি এঁকেছেন, তা যুদ্ধে ধসে পড়েছিল, অর্থাৎ পোড়োবাড়িটির জায়গায় নতুন নির্মাণের একটি স্বপ্ন ঘোষণা করেছিল, কিন্তু ‘আশা আর নৈরাশ্যে দুলতে দুলতে/ একজন মুক্তিযোদ্ধা/ নিজের উৎকর্ষ’ হারাতে থাকলে একসময় কবি বুঝতে পারেন, উদ্বেগ অন্যত্রও আছে। একজন কবিকেও তিনি ‘খুনি আলবদর’ হতে দেখলেন। ফলে চারদিক কুয়াশায় ছেয়ে এলো। সেই কুয়াশা ভেদ করে আলো ফিরিয়ে আনতে নিজের হাতেই দায়িত্বটা কবি নিলেন :

স্বাধীনতার পরশপাথরের স্পর্শে

কেমন করে জেগে ওঠে শত সহস্র রজনী

হাত ধরে কেন টানে বিনিদ্র নগরী

আমাকে লিখতে হবে এই সবকিছু

সবিতা হালদারের প্রসঙ্গ যখন মাহমুদ আল জামানের কবিতায় আসে – কোনো কোনো সময় অনিবার্যভাবেই – তখন দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন হয় না। একটা বিষাদবোধ, তাকে হারিয়ে ফেলার বেদনা ও তার প্রত্যাবর্তনের অসম্ভবতা সমানভাবেই জেগে থাকে। কয়েকটি কবিতায় বিচ্ছিন্নভাবে উঠে এলেও বেশ একটা অবয়ব ধরেই তিনি আসেন ‘সবিতা হালদার’ (জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক) কবিতায়, যেখানে তিনি এক রহস্যের নাম। দেখা যায় তিনি একজনকে খুঁজে ফিরছেন, কিছু একটা উদ্ধারের জন্য খুঁড়ে চলছেন, ‘নিচু স্বরে’ তিনি একটা প্রার্থনাও করছেন, কিন্তু কার কাছে? তাকে না পেয়েই কি সবিতা চলে গেলেন? মিছিল থেকে হারিয়ে গেলেন? অথচ কবি তার ‘বুকের অনন্ত পিপাসায়’ তার থেকে জল চাইছেন। সেই তৃষ্ণার সঙ্গে কলকাতায় যাপিত এক জীবনের ভগ্নছবিও আছে। তারপর ‘সবিতা হালদারের চিঠি’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙায়) সেই তৃষ্ণা জেগে থাকতে দেখা যায়, যদিও সবিতা ভালো থাকুন, সেই কামনা কবি করছেন, এবং জানাচ্ছেন, তাকে তিনি পান ‘ইমনকল্যাণে আর কোমলগান্ধারে।’ একসময় আমরা জানতে পারি সবিতা ছিলেন ‘অনেকগুলো মুখোশের মধ্যে/ শুধু একটি মুখ। (‘একটি মুখ’, ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল)। ‘সবিতা হালদার’ (ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল) নামের দ্বিতীয় কবিতায় কিছুটা স্পষ্ট করে কবি জানান, কলকাতার ওই ঠিকানায় কোনো এক ‘স্তব্ধ দুপুরে’ একটি পালক খসে পড়েছিল, এবং সবিতা হালদারের – যার মতো ‘এমন শান্ত, এমন স্নিগ্ধ শ্রী’ তিনি কোনোদিন দেখেননি – স্তব্ধ স্মৃতি তিনি খুঁজে চলেছেন। অথচ ‘তবুও রেখে যায়’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙায়) কবি বলেন,

… তোমার কোনো মন নেই

সবিতা হালদার

তোমার কোনো মন নেই।

এরপরও কবি জানান, তিনি মধ্যরাতে সবিতার জন্য কাঁদেন এবং ‘ভুবনডাঙার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, তাকে ‘সর্বদা দুধে ভাতে’ রাখতে (‘ক্ষুধার চিৎকার’ অগ্রন্থিত)। সবিতা হালদার কি তাঁর মিউজ, তাঁর কবিতা লেখার পেছনের শক্তি? তার রাজনীতি? তাঁর সম্ভাবনার ছবি?

কবিতাসমগ্র পড়লে বোঝা যায়, স্বাধীনতা আর সবিতা যে প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেন, তাতে পোড়োজমি মূর্ত হয় প্রধানত নেতির মোড়কে। কিন্তু একসময় কবি নিজেই নামেন তাঁর যাত্রাপথের মানচিত্র হাতে, এবং তাঁর কবিতার শক্তিতে সেই পথ পাড়ি দিয়ে ভুবনডাঙায় পৌঁছাতে। কিন্তু পোড়োজমির যে-ছবিটি তিনি উপহার দেন, তা বড়ই নিষ্করুণ এবং নির্মম। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ভুবনডাঙার অংশটুকু না থাকলে কবিতাসমগ্র হতে পারত তাঁর হতাশাসমগ্র। আবুল হাসনাতকে আমি যতটুকু জানি, তিনি অন্ধকারকে এঁকেছেন আলোর আঁকিবুকি এবং সবশেষে এর বিভাবে উজ্জ্বল করে তুলত। হতাশা তাঁর ছিল, কিন্তু এর সঙ্গে বোঝাপড়াও তিনি সেরেছিলেন।

জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাকের প্রথম কবিতাটিতেই (‘ফিরে যায়’) আছে নিঃসঙ্গতা আর ‘দুঃখ জাগানিয়া বিষাদমগ্নতা’র কথা, এরপর প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই কোনো না কোনো বর্ণনায় আছে ‘দুর্ভাগ্যের আগ্নেয়গিরি’ বৃষ্টি নিষিদ্ধ হওয়া অথবা মানুষের আর্তনাদ, রমণীর চিৎকার, করুণ দীর্ঘশ্বাস, বৃক্ষের ক্রন্দন, শাদা ছিন্ন করোটি, সর্বগ্রাসী বিষাদ, ধ্বংস আর বিনাশ, ছিন্নভিন্ন শহর, মৃত্যুচেতনা, রক্তের প্লাবন, আততায়ীর আগ্নেয়াস্ত্র, ‘প্রেমহীন, প্রীতিহীন জীবনের নিষ্ফলতা’র উল্লেখ অথবা চিত্রকল্প। একই সঙ্গে আছে আরো কিছু চিত্রকল্প, যেগুলি অসুখের, নিষ্পত্তিহীনতার, যেমন হাসপাতাল, বার্ন ইউনিট অথবা অনেকটা জীবনানন্দীয় ভাষায় বলা ‘আমরা কেউ জানি না কবরের ঘাস মরে গেছে কবে।’ (‘সে, এক নারী-তিন’, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়)।

কবিতাসংগ্রহর পোড়োজমির চিত্রমালা জুড়ে আছে মাহমুদ আল জামানের কিছু অনুধাবন, কিছু প্রশ্ন, কিছু হঠাৎ-দর্শন অথবা অভিজ্ঞান :

১. আমি

একজনও

সৎ মানুষের খোঁজ পেলাম না

                              (‘খুঁজে ফিরছি’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

২. দীর্ঘশ্বাসে করুণ

মানুষ কোথায় দাঁড়াবে

                          (‘বিপর্যয়ে ক্লান্তিহীন’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৩. তোমার

ভেতরে আর নিসর্গ নেই

                                 (‘তুমিও সেই’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৪. দ্বিধার মধ্যেই জন্ম নেয়

নৈঃশব্দ্য

                           (‘সবকিছুতেই ক্ষয়’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৫. ভাঙ্গা, যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে সবই শুধু ভেঙ্গে যায়

                                 (‘ভেঙ্গে যায়’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৬. কীর্তির মধ্যেই দূরশূন্যতা

খোঁজে আশ্রয়

                            (‘কীর্তির মধ্যেই’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৭. অন্ধকারের ভেতরে সর্বনাশ ছবি হয়ে বেঁচে থাকে

                          (‘পাথরের আর্তনাদ’, জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক)

৮. আর সেই কালো বেড়াল

দুঃখ দেবে বলে

সাদা দেয়ালে ওঁৎ পেতে আছে

                                      (‘অন্ধকারে – দুই’, অগ্রন্থিত)

তবে পোড়োজমির নেতি একদিন অতীত হয়। সেই একদিন, ‘কোনো একদিন’ (কোনো একদিন ভুবনডাঙ্গায়) ‘… এই বোমার তাপবিকিরণ থেকে জন্ম নেবে/ নীল ফুল/ কোনো একদিন কিংবদন্তি দিনগুলি আবার কথা বলবে।’

এই আশাবাদ ভুবনডাঙার, তবে এটি জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাকে-ও মাঝে মধ্যে উঁকি মারে। এই আশাবাদ থেকে মাহমুদ আল জামান তাঁর শেষ কবিতাগুলির একটি লিখেছিলেন জর্জ ফ্লয়েডকে নিয়ে, আমেরিকার এক শহরে পুলিশের নির্যাতনে নিহত সেই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটিকে নিয়ে, যার মৃত্যু ‘ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার’ আন্দোলনটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আল জামান লিখেছেন,

কালো মানুষ, তুমি হাঁটতে থাকো

আর গান গাও (অগ্রন্থিত)

পোড়োজমির বিপরীতে ভুবনডাঙা কবিকে উপহার দেয় মেঘ আর জ্যোৎস্না, অনাবিল সৌন্দর্য আর ফুলডাঙ্গার ছবি। ভুবনডাঙাযাত্রা তাঁকে শক্তি দেয় – ‘ফুল তুলি, সহাস্যে হাসি ঘৃণার আবর্তে মৃত্যুর ছায়ায়’ (‘কোনো একদিন ভুবনডাঙ্গায়’, ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল), ‘ভুবনডাঙ্গার সানন্দ জ্ঞানবৃক্ষের নিচে’ বসে এক ‘সুদীক্ষিত রমণী’র গান শোনেন (‘তাঁর অলৌকিক উপস্থিতি’, ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল), অথবা ভুবনডাঙায় তিনি দেখেন

খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে

বন্ধ দরোজা

(‘উৎসমুখ’, ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল)

এবং ভুবনডাঙায় এসে তিনি উপলব্ধি করেন

প্রতারিত হতে হতে

এসে দাঁড়ালাম

ভুবনডাঙার খোলা মাঠে

আমি মুক্ত, আমি মুক্ত

(‘এই আমি’, ভুবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল)

চার

মাহমুদ আল জামানের শেষ কবিতাটি – ‘শেষ লেখা’ – তাঁর রোগশয্যায় এক অপূর্ব পরিমিতিবোধে কবিতাসমগ্র-র একটা সারাংশই যেন তুলে ধরেছে।

আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে

কালো মেঘে

হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও

সজীব সবুজ উজ্জ্বলতা

ঘুম নেই চোখে তাকিয়ে থাকি

অক্সিজেনের মিটারে।

সজীব সবুজ উজ্জ্বলতা আজীবন তিনি চেয়েছেন, এবং তাঁর ভুবনডাঙা এই উজ্জ্বলতার চিত্ররূপ হয়ে পাঠকের মনে জেগে থাকবে।

পাঁচ

কবিতাসমগ্রর প্রকাশনাগত একটি বড় ত্রুটি এতে সম্পাদনার কোনো চিহ্ন নেই। একটি ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। তা নেই। তিনটি কবিতাগ্রন্থের প্রকাশকালসহ প্রকাশনার খুঁটিনাটি তথ্য থাকা প্রয়োজন ছিল। নেই। অগ্রন্থিত কবিতাগুলি কোথায় প্রকাশিত, কোন জার্নালে, সাময়িকীতে, তার উল্লেখ থাকা জরুরি ছিল। নেই। শেষ কবিতাগুলির দিন তারিখ নির্দেশ করা যেত। প্রচ্ছদটাও আরো সুন্দর হতে পারত। পরবর্তী সংস্করণে এ অপূর্ণতাগুলি ঘোচানোর অনুরোধ রইল।