প্রথম স্মৃতি

মানুষের প্রথম স্মৃতির কথা জানতে চাইলে সবাই একটা ধাঁধায় পড়ে যায়। মনে করতে থাকে প্রথম স্মৃতিচিত্র। অনেক ছবি ভেসে ওঠে সমান মর্যাদায়। প্রথমটা চিহ্নিত করতে বেশ বেগ পেতে হয়। কোনটা প্রথম? সব জড়াজড়ি করে সুপার ইম্পোজড হতে থাকে। আলাদা করা দুষ্কর। সবার মতো আমারো হয়েছে তাই। তবে একরাশ নয়, দুটি দৃশ্য পরস্পর জড়াজড়ি করে উঁকি দিচ্ছে। এরা যদি যমজ হয় হতে পারে; কিন্তু সময় ধরে একটা আগে-পরে করা যায়। প্রথম স্মৃতিটি সন্ধ্যাকালীন – দ্বিতীয়টি সকালের। সুতরাং যমজ নয়। সকাল আর সন্ধ্যার দ্বন্দ্ব।

তখন পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। একদিকে সারাবিশ্ব – অন্যদিকে জার্মান জাতি। হিটলারের নেতৃত্বে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। মনে পড়ে ১৯৪৩-এর দিকে আমরা ছিলাম হাওড়া শহরে। বাবার কর্মস্থল কলকাতায়। হাওড়া ব্রিজ পার হলেই মহানগর কলকাতা। হাওড়ায় বসবাসকারী লোকেরা স্বল্প ভাড়ায় বাড়ি ভাড়া পায়। তাই আবাস। আর কলকাতার শব্দ-দূষণমুক্ত। তাছাড়া গঙ্গার তীর একটা বড় আকর্ষণ। আমাদের পরিবারে বাবা-মা, আমরা পিঠোপিঠি তিন ভাই। আর ছিলেন নানা। ১৯৪৩ সালের কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। থামার নাম-গন্ধ নেই। সবার মুখ ভার। শোনা যাচ্ছে, জাপানি ফৌজ হিটলারের সঙ্গে যোগ দিয়ে বার্মার রেঙ্গুন দখল করে ইন্ডিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্যস্থল কলকাতা মহানগর দখল। সবার মনে অজানা ভীতি।

এদিকে আমার একমাত্র মামা শেখ আবদুল করিম ব্রিটিশ সেনাদলের সদস্য। তিনি আছেন বার্মায়। একেবারে ফ্রন্টে। মামার জন্যে সবার দুশ্চিন্তা। বেঁচে ফিরবেন তো? সবচেয়ে কষ্টে ছিলেন নানা-নানি আর মামি হালিমা খাতুন। আমার

মা-মাসিরাও ছিল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মায়ের পেটের একমাত্র ভাই। আবার সবার বড়। সবাই মনে পাথর চেপে দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে। একা জার্মানি গোটা বিশ^কে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সবার মুখে হিটলারের নাম। তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার।

এদিকে নেতাজি সুভাষ বোসের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ আসামের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। তিনি জাপানিদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এমনকি জার্মানির সঙ্গেও। যুদ্ধনীতিটা হলো, ব্রিটিশের শত্রু আমার মিত্র। ব্রিটিশ সরকারকে ভারতবর্ষে দুই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। একদিকে জাপানি সেনা, অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ। নেতাজি সুভাষের রাজনৈতিক দল হলো ফরওয়ার্ড ব্লক। আমার নানা-মামা সবাই ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষে। বাংলায় এই দলের বড় রকম প্রভাব ছিল ও এখনো বেশ কিছু আছে। এরা বলতে গেলে সম্প্রসারিত সাম্যবাদী দল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাদের আইডল। নেতাজি ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বলে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে, কিন্তু মূলত তিনি ছিলেন ন্যাশনালিস্ট ও সাম্যবাদী ব্যক্তি। ভারত জুড়ে এমন মেধাবী নেতা আর দুটি জন্মায়নি। এখনো সারা ভারতবাসী অতি শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করে।

বার্মায় জাপানি সেনারা অপ্রতিরোধ্য। তারা একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। বার্মা থেকে বাঙালিরা পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে দেশে ফিরতে থাকে। কলকাতা প্রথম আশ্রয়স্থল। এখান থেকে আবার যে যার গ্রামের বাড়ির দিকে যাত্রা।

আমার বছর চারেকের মতো বয়স বা পাঁচ। বাবা আমাদের সাধারণত সন্ধ্যার আগে আগে হাওড়া ব্রিজে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। গঙ্গার শীতল বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যেত।

হাওড়া ব্রিজ সারা বাংলায় নয়, সারা ভারতে তখন ছিল একটা দেখার মতো জিনিস। বাংলার গর্ব। পুরো ব্রিজ স্টিল ফ্রেমে তৈরি।

 একদিন এখানে এক ঘটনা ঘটে।

 রোজকার মতো আমরা বাবার সঙ্গে প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় গেছি হাওড়া ব্রিজে। বাবার খুব প্রস্রাব পেয়েছে। তিনি একটা বিমের আড়ালে প্রস্রাব করে মাত্র উঠেছেন। এমন সময় অদূরে থাকা এক স্যান্ট্রি দেখে ফেলে। এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ। সে ছুটে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এখানে কেন প্রস্রাব করলেন? বাবা দেখলাম কোনো কথা না বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা চকচকে সিকি মানে চার আনা মানে পঁচিশ পয়সা বের করে দিলেন। তখন ছিল ৬৪ পয়সায় এক টাকা। ১৬ পয়সায় এক সিকি, মানে টাকার চার ভাগের এক ভাগ।

স্যান্ট্রি সিকিটা পকেটে রেখে সালাম ঠুকে চলে গেল।

এই দৃশ্য মনে পড়লেই আমরা তিন ভাই হাসতাম। বাকিদের হয়তো এখন আর মনে নেই। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। ঘরে ফিরে এই কথা মাকে শুনিয়েছিলাম কি না মনে পড়ছে না। হয়তো মজার ঘটনা হিসেবে বলে থাকতে পারি।

আমরা হাওড়া শহরে যেখানে থাকতাম তার নাম হার্ড কোর্ট লেন। এখানে তিনতলা বাড়ির তিনতলায় থাকতাম। আর একদিন বাবা আমাদের ব্রিজে নিয়ে গেছেন, দেখি

হাওড়া-ব্রিজের ওপর পেল্লাই পেল্লাই আকারের সব লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের বেলুন উড়ছে। আমরা ভাবি কোনো উৎসব আছে বুঝি। বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ব্যাপারটা তা নয়। প্লেন থেকে যদি ব্রিজের ওপর বোমা ফেলে তা যাতে বেলুনে লেগে ফেটে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, তাই এই কৌশল। যুদ্ধের এ-ধরনের নানা রকম কৌশলকে স্ট্র্যাটেজি বলে। বাবা আমাদের শেখাতে থাকেন এইসব যুদ্ধকৌশল।

এর কয়েক দিন পর কলকাতার খিদিরপুর ডকে জাপানি বোমা এসে পড়ে। এই বোমা পড়ার সময় কলকাতা জুড়ে সাইরেন বাজত। সে আওয়াজ গোঙানির মতো। ভোঁ করে উঠছে-নামছে। তারপর এই গোঙানির পর একটানা সরল সুরে বাজতে থাকে। এর মানে অল ক্লিয়ার। বিপদ আর নেই। অর্থাৎ বোমারু বিমান চলে গেছে। এই বোমা পড়ার পর সারা কলকাতার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পিলপিল করে শহর ছাড়তে শুরু করে। সব যাচ্ছে গ্রামে। আগে তো প্রাণে বাঁচো। তারপর অন্য কথা।

নানা আর বাবা আমাদের নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। গ্রামে যাওয়ার কথা একরকম ঠিক হয়ে গেল। শুধু এখন বেরোতে গেলে ভিড়ের মধ্যে পড়তে হবে, তাই কয়েকদিন অপেক্ষার সিদ্ধান্ত হয়।

আবার একদিন সাইরেন বেজে উঠল। রাত তখন ৮টার মতো। বাবাকে দেখলাম এআরপির ইউনিফর্ম পরে নিলেন। এআরপি মানে পরে জানি যে, এটা হলো এয়ার রেইড প্রিকশন। মানে বিমান আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে সাবধানতা অবলম্বন। আঠারো বছরের ঊর্ধ্বের বয়সী সবাই এই বাহিনীতে যোগ দিতে লাগল। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। বাবা এই বাহিনীর একজন সদস্য। তিনি সাতাশ-আটাশ বছরের টগবগে যুবক। তীরের মতো চেহারা। এআরপির খাকি পোশাক পরলে বাবাকে ঠিক হিরোর মতো মনে হতো। আহা যদি তখনকার কোনো ফটোগ্রাফ থাকত!

এদিকে সাইরেনের গোঙানি চলছে। আওয়াজ উঠছে-নামছে। আমরা সবাই তিনতলা ছেড়ে নিচতলার সিঁড়িঘরের নিচে আশ্রয় নিয়েছি। কানে দেওয়া হয়েছে গ্লিসারিন মাখানো তুলো। অনেকটা ঈদের সময়কার কানে বোজা আতরের মতো। এক সময় অল ক্লিয়ার আওয়াজ শুনে আমরা সিঁড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসি। এর মধ্যে কান থেকে তুলো বের করে আমি চেটে দেখি বেশ মিষ্টি। তখন দু-কান থেকে বের করে লজেন্সের মতো চুষতে শুরু করি। পরে আমার এই কাণ্ড চাউর হয়ে যায়। সবাই খুব হাসাহাসি করে। আমি সবার সঙ্গে বোকার মতো হাসি।

একদিন নানা আর আমরা ঝামটিয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। হাওড়া স্টেশন থেকে বাগনান। এই লাইনকে বলে বিএনআর বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে। এটা রূপনারায়ণ পার হয়ে কোলাঘাটে। তারপর নাগপুর যাত্রা। বিএনআর কথাটা প্রায় মুখস্থ করতাম।

এই বাগনান স্টেশন ছাড়া অন্য আর একটি রেললাইন ছিল, সেটা মার্টিন কোম্পানির। ওটা আমতা অবধি পৌঁছে দেয়। বাগনান বা আমতা দুটির দূরত্ব প্রায় সমান। বাগনান দক্ষিণ থেকে উত্তর যাত্রা আর আমতা উত্তর-পূর্ব থেকে রওনা।  মাঝে পড়ে জয়পুর নামক নামি জায়গা – যেমন বাগনানের মাঝখানে পড়ে খালনা। এখানে বড়খানের চেহারা বেশ নদীর রূপ নিয়েছে। ওপরে কাঠের সাঁকো। খালনার পর খাজুরদহ, আমার বড়মাসি বা বড়খালার শ্বশুরবাড়ি। এর মাঝ দিয়ে ঝামটিয়ার চৌহদ্দি। সরু একটা খাল আছে। জোয়ারে জল ওঠে। মাঝে দু-একটা বাঁশের বাখারি জুড়ে সাঁকোও আছে। তাছাড়া জোয়ান মানুষরা লাফ দিয়েও পার হতে পারে। খাজুরদহ সীমান্তে তালগাছের সার। ঝামটিয়ার দিকে ধানক্ষেত।

জয়পুর দিয়ে এলে যে গ্রামের ওপর দিয়ে আসতে হয় তার নাম সান্না। এখানে একটা শ্মশানক্ষেত্র আছে। আছে দু-একটা বেলগাছ। তারপর ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে কোম্পানির পুকুরপাড় ধরে কিছু ক্ষেত পার হয়ে পড়ে দক্ষিণপাড়া। ভিটে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ভূমি থেকে দশ-বারো ফুট উঁচু। বানে ডোবে। আমি একবার শুধু বাকুলে জল উঠতে দেখেছি। সবচেয়ে বড় বান এটাকেই ধরা হয়। এটা ১৯৪৭-৪৮-এর দিকের কথা। সেই বানে দহলিজটা পড়ে যায়। সেবারই খালনার বন্যানিরোধক কোম্পানির বাঁধ জলের চাপ সহ্য না করতে পেরে ভেঙে যায়। তাই অল্প সময়ে জল বেশ কমে। ঝামটিয়ার রক্ষা। সেবার বানের সময় ঝামটিয়ার দক্ষিণপাড়ায় আমি প্রথম আজানের ধ্বনি শুনি। এছাড়া এখানে আর কখনো আজান শুনিনি। এই আজান দেন জয়নাল মামার বাবা। নানার নামটা মনে আসছে না। এই নানা পাড়ার সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন। গোলগাল বেঁটেখাটো মানুষ। শ্যামলা বরণ। পাড়ার সবাই খুব মান্য করত। ঘরের পাশেই বাঁশের বেড়া দিয়ে খাটা পায়খানায় যখন পায়খানা করতে বসতেন, সারা পাড়া কেঁপে যেত আওয়াজে। মনে হয় হজমের দোষ ছিল। বা বয়সকালের ব্যাপার। আমরা ছোটরা এটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম। মনে হতো বজ্রপাত হচ্ছে বা পাহাড় ভেঙে পড়ছে … এইসব  বলতাম। দুঃখের ব্যাপার, অল্পদিন পর নানা ইহলোক ত্যাগ করেন। আর স্থায়ী আবাস হয় পশ্চিমডাঙ্গায়, যা আঞ্চলিক উচ্চারণে পাচ্চিডাঙ্গা।

নানার বড় ছেলে জয়নাল আবেদিন। আমরা জনামামা বলে ডাকতাম। তিনি মধ্যম উচ্চতার মানুষ। ফর্সা। নানার মতো ভরাট শরীর। গোঁফ রাখতেন। বেশ হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়ে ছিল অনেক। হাসিনাবুবু বড়, তারপর খালেক ভাই, এরপর সিতারা – আমার বয়সী। তারপর আনজু, রেজ্জাক ও সর্বকনিষ্ঠ লতিফ। জয়নাল মামার স্ত্রী বেশ লম্বা ও ভারী চেহারার। খালেক ভাই ছোটখাটো। সিতারা খুব পাতলা। আনজু ছিল ভারী, ফর্সা ও সুন্দরী। রেজ্জাক আর লতিফ মধ্যম চেহারার আর শ্যামলা। রেজ্জাক অবশ্য সংক্ষেপে রেজাকে রূপান্তরিত। এরা ছোট দু-ভাই আমার চেয়ে বেশ কিছুটা বয়সে কম।

পরবর্তীকালে সিতারার বিয়ে হয় আমাদের গ্রামে। বনামাটিয়া আর সবলসিংহপুর গ্রাম দুটি বেশ একটা পরম্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। সবাই ছেলে আর মেয়ে খোঁজ করার সময় এই দু-গ্রামে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী খোঁজ করে।

ঝামটিয়ার ছেলেরা ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করেই চলে যেত কলকাতা। খালনায় উচ্চ বালক বিদ্যালয় থাকলেও সবার বাপ-চাচারা চাকরি করত কলকাতায়, তাই সবাই কলকাতা পাড়ি দিত। আর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা তখন ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারপরই ছিল আলীগড়ের স্থান। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, ইংরেজদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মুসলমানগণ আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং চাকরি ক্ষেত্রে তাদের অনুপাত নগণ্য। বাকি সব কর্ম শিক্ষিত সনাতনধর্মীদের হাতে। সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। ঠেকেছে প্রায় তলানিতে।

ঝামটিয়ার সব পুরুষ ছিল খুব মুক্তমনের মানুষ। নবীন প্রজন্মও তাই। সবাই উচ্চশিক্ষিত ও আধুনিক চিন্তাধারায় দীক্ষিত। মহিলারাও শিক্ষিত। তবে নানাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন বিচারক, অন্যরা এমএ পাশ। মেয়েদের পিছিয়ে থাকার একটা বড় কারণ অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া।

বারো-তেরো-চোদ্দো হলেই বিয়ের তোড়জোড়। লেখাপড়া করবে কী করে! সন্তান এসে গেলেই জীবনের নতুন অধ্যায়। লেখাপড়া করার সময় কোথায়! সংসার-সন্তান সব মিলিয়ে জীবন উদয়াস্ত কেবল কাজ আর কাজে নিমজ্জিত।

জাপানি বোমার ভয়ে আমরা গ্রামে ফিরে এলাম। এর কয়েকদিন পরই শুরু হলো খাদ্যশস্যের অভাব। বলতে গেলে
তেল-চাল-নুন-চিনি সবই মহাজনরা গুদামজাত করতে লাগল। শুরু হয়ে গেল দুর্ভিক্ষ। একে অসাধু ব্যবসায়ী, অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বাংলা থেকে খাদ্যশস্য উত্তর প্রদেশে সরাতে লাগল – পোড়ামাটি নীতি ধরে। যাতে জাপানি দখলে গেলেও শত্রুরা বাংলায় খাদ্যদ্রব্য না পায়। এদিকে শত্রুর আগেই দেশের মানুষ না খেয়ে মরতে লাগল। এই ব্যাপারে বাবাকে বলতে শুনেছি যে, তিনি কলেজে যেতে লাশ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে যেতেন। ফুটপাত জুড়ে মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। বেশিরভাগ বয়স্ক, শিশু আর মহিলা। কঙ্কালসার দেহটি নিথর পড়ে আছে। শতমলিন কাপড়ে জড়ানো সে-দেহ। প্রায় উলঙ্গ বলা চলে। বাবা কথাটি উচ্চারণ করতেন আর ছাড়তেন দীর্ঘশ্বাস। সে-শ্বাস আমাদেরও ছুঁয়ে যেত। আমরা সে-দৃশ্য মানবচক্ষে দেখতে পেতাম। কিন্তু বাবার কষ্টের গভীরতা মাপতে পারতাম না। মানবতাবাদী মানুষটি এভাবে সারাজীবন একের পর এক দুঃখে কাটিয়েছেন। কারণ এই দুর্ভিক্ষের পরই এলো হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও দেশ-বিভাগ। আবার হতভাগ্যদের জীবনে নেমে এলো আঁধাররাত। পূর্ববঙ্গের বাঙালি-হিন্দু সবচেয়ে বেশি কষ্ট বরণ করেছেন। লুট ছাড়াও হয়েছে নারী-নির্যাতন। ১৯৫০ সালের মধ্যে ৯৩ লাখ হিন্দু-নরনারী দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গে। আসামে। সবচেয়ে বেশি ভিড় জমে রেলস্টেশনে। এরপর তেইশ বছর যেতে না যেতে এসে গেল বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১। কোটিখানেক মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করে ইন্ডিয়ায়। কত লোক যে না খেতে পেয়ে ও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার হিসাব নেই। বাংলায় বর্গিহামলা থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষের এক করুণ ইতিহাস বর্তমান। সোনার বাংলা প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছে।

১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের চিত্র অনেক শিল্পী এঁকেছেন; কিন্তু জয়নুল আবেদিনের হাতে এক-একটি চিত্র মুক্তোর দানার মতো দ্যুতি ছড়িয়েছে। অথচ বিষয় হলো – দুর্ভিক্ষ মানবিক বিপর্যয়। স্টেটসম্যান ও পিপলস ওয়ার নামক পত্রিকায় তা ছাপা হয়ে গোটা দুনিয়ায় বার্তা ছড়িয়ে দেয়। বাংলার মানবিক বিপর্যয় সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মহাযুদ্ধ, কে করবে সাহায্য! নির্বিবাদে ৫০ লাখ নর-নারী-শিশু প্রাণ হারায়। মনে পড়ে, সলিল চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গান : ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো … রূপকথা নয় সে নয়, জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা … শিশিরভেজা কাহিনি শোনাই শোনো … ডাকিনী-যোগিনী এলো শত নাগিনী এলো পিশাচেরা এলো রে … আজো যদি তুমি কোন গাঁয়ে দেখ … ভাঙা কুটিরেরও সারি – জেন সেইখানে সে-গাঁয়ের বধূর আশা স্বপনের সমাধি।’

নানার সঙ্গে আমরা সবাই ঝামটিয়ায় ফিরে এলাম।

এখানে একদিন সন্ধ্যাবেলার কথা মনে পড়ছে।

গ্রামেও দুর্ভিক্ষের হাহাকার চলছে। প্রায় পরিচিত সব মুখ দেখতে পাই দুপুরের দিকে আসে। নানির কাছে বলে, দিদি একটু ফ্যান হবে …

 থাকলে নানি দিয়ে দিতেন। পরে কেউ এলেই বিপত্তি। অমুকের মাকে দিয়ে দিয়েছি। তখন সেই হতাশ মুখগুলি আমি দেখতাম আর খুব মন খারাপ করত। তখন আমি বুঝি কাউকে কিছু দিতে পারলে কী যে আনন্দ। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে একটু স্বস্তির ভাব দেখলে সারা মন আনন্দে ভরে উঠত। কাউকে চাল বা খুদ দিলে নানি আমার হাতে দিতেন। নিজে সামনে আসতেন না। তখন একজন খুবই কম আসত। আসত তিন-চারজন।

মামাবাড়ির তিনতলা বাড়িটা সন্ধ্যার পর প্রায় নিশ্চুপ হয়ে যেত। সমস্ত পাড়ায় কোনো আওয়াজ নেই। এই দক্ষিণপাড়া শুধু দুর্ভিক্ষের কষাঘাতের বাইরে আছে। পুরো গ্রাম পীড়িত। সবার ভয়, লুট না হয়। কিন্তু মানুষের নৈতিক চরিত্র তখন এমন ইস্পাতকঠিন ছিল যে কেউ লুট করেনি। নীরবে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দোষের ভাগী যদি কেউ হয়ে থাকে সে ভগবান আর আল্লাহ। কারণ তাদের হুকুম ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না। সাধারণ জনগণ এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী।

 তো একদিন সন্ধ্যায় যে-মেয়েটি পশ্চিমের জানালা ধরে নানিকে ডাকলে, বড়দি একটু ফ্যান দেন।

ফ্যান নেই রে … নানির জবাব।

আমি চিনতে পারি ১৩-১৪ বছরের বীণা। শুকিয়ে কাঠ। বাগদিপাড়ার মেয়ে।

তারপর নানি বললেন, একটু দাঁড়া … বলে ভেতরঘরে গেলেন। দেখি হাতে একটা লাল-আলু – যাকে বাংলায় কোনো কোনো জায়গায় মিষ্টি আলুও বলে। লতানো গাছের শেকড়ে কন্দটি হয়। পুড়িয়ে খেতে খুব মজা।

নানি লাল-আলুটা নিয়ে ছুড়ে দিলেন।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। বীণা আলুটা কুড়িয়ে পেল কি পেল না ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে ও যে চলে গেল তা আমার মনে আছে।

তখন দক্ষিণপাড়ার লোকেরা প্রতিরাতে খুব ভয়ে ভয়ে

থাকত। সন্ধ্যার পরই সব নীরব। বেশিরভাগ ঘরে বাতির আলোও চোখে পড়ত না।

দুর্ভিক্ষের পরের চিত্র গ্রামে কী   ঘটেছিল আমার কিছুই মনে নেই।

বীণা সেই আলুটা পেল, না পেল না সে-ছবির সঙ্গে একটা চিত্র আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আগে-পরের ব্যাপারটা ঠিক করতে পারি না। সেটা হলো : ঝামটিয়া ছাড়া প্রায় সারা হাওড়া-হুগলী জুড়ে একটা প্রবল মৌসুমি ঝড় হয়েছিল – ঘূর্ণিঝড়ের মতো … শুনেছি তা নাকি সারা বাংলাজুড়ে তাণ্ডব চালায়। একে পুরনো লোকেরা এখনো বলে আশ্বনের ঝড়। সেই ঝড়ও প্রায় সত্তর-আশি বছরের পুরনো ঘটনা। মনে রাখার মতো হয়তো কেউ বেঁচে নেই।

এই আশি^নের ঝড়কে কেন্দ্র করে আমার সামনে একটি ছবি ভেসে ওঠে। সেটা ঝড়ের ছবি নয়। সারারাত তাণ্ডব চালিয়ে ভোরের দিকে ঝড় থেমে যায়। সকালে দেখি মামাবাড়ির নিচের ঘরে পশ্চিমের দরজার কাছে কাঁথা-বিছানো পাটিতে আমার মেজভাই হাত-পা ছুড়তে ব্যস্ত। সারা আকাশ পাঁশুটে। বাতাস একেবারে নেই। ঝড় শেষে যেমনটা হয় … তেমন। প্রকৃতি ধূসর আকাশের নিচে ঝিম মেরে আছে।

এইসব ভাবনা থেকে আমার মনে হয়, আমার প্রথম স্মৃতি হাওড়ার ব্রিজ। দ্বিতীয় স্মৃতি বীণার লাল আলু কুড়োনো। তিন নম্বরে আশ্বিনের ঝড়ের রাতের পর আমার ছোটভাই – ক্রম অনুযায়ী মধ্যম ভ্রাতা। নানা যার নাম রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ-ভাগের পর আমরা চট্টগ্রাম এসে গেলে বাবা এই নাম পাল্টে রাখেন আসফাক ওসমান। শেখ পদবিটি ঝরে গেল। বাঙালি মুসলমান মাত্রই নামের আগে শেখ বা সৈয়দ পদবি লাগিয়ে নেয়। অবশ্য মোগল আমলে পদবি পরে আসে বা পরেও হয় : যেমন, তালুকদার, সিকদার, মজুমদার, তরফদার ইত্যাদি। আগে বসত খান বা নবাব বা খান বাহাদুর। এরা অবশ্য অভিজাত পরিবার। সম্রাটের স্নেহধন্য। ইংরেজ আমলেও এসব পদবি অনুসারিত হতো।

বাংলায় ঝড়ের এই আশি^ন মাস পত্রিকার কোথায় স্থান পেয়েছে এটা নিয়ে কিছুটা ধারণা করা যায়। আমার দু-বছর পর মেজভাই-এর জন্ম, সুতরাং ১৯৪২ সাল। এই সালের আশ্বিনের কোনো একদিন হবে – বাংলায় প্রলয়ংকরী সে-ঝড়টি ইতিহাস তৈরি করে গেছে। সেই সময়কার কোনো মানুষ এখন জীবিত নেই। তাই সঠিক সময়টা জানা মুশকিল। তবে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শোনা গল্পকথা তো চলে আসছে যুগ-যুগ ধরে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি লেখা ছিল ‘আশ্বনের ঝড়’ নামে। তবে তা এতদিনের পুরনো হয়ে গেছে যে, খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ধরে নেওয়া যায় সেটি ১৯৪২-৪৩ সালের মধ্যে হবে। এই একটি সূত্র ধরে আমার স্মৃতির একটি প্রমাণ দাখিল করতে পারি। এছাড়া আমার অনুমানকেই প্রাধান্য দিতে হয়।

এই হলো আমার জীবনের প্রথম কয়েকটি স্মৃতি। এরপর যদি কেউ উঁকি দেয়, পরে তখন বিবেচনা করা যাবে।

পুনঃ

আশি^নের ঝড়ের তথ্য আমাকে পাঠিয়েছে জ্ঞাতিভাই মানিক পণ্ডিত। যিনি একাধারে কবি, আলোকচিত্রশিল্পী, সংগঠক ও শওকত ওসমানপ্রেমী।

তার তথ্য : ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসের ১৪ থেকে ১৬ এই চারটে দিনে বিভিন্ন সময়ে উত্তর ভারতের সমুদ্র থেকে সাইক্লোন হয়েছিল। আছড়ে পড়েছিল পশ্চিম বাংলায়। এর ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার কবলে পড়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন।