প্রিয়জন ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে কেটেছে আমাদের এবারের ঈদুল ফিতর। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই এমন একটা সময়ের কথা কল্পনাও করতে পারেনি এবং আমার মনে হয় তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে এ-কথা আরো বেশি সত্য। এমন একটা সময়ে যখন আমাদের প্রয়োজন পড়ে যা কিছু ভালো ও শুভ তা এবং যা কিছু বা যে-কোনো মানুষ, যিনি আমাদের আশার বাণী শুনিয়ে উদ্দীপ্ত করেন, তাঁকে আঁকড়ে ধরার, সেই সময়ে আমরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছি অন্ধকারের আরো গভীরে তলিয়ে যেতে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে যে-শূন্যতা আজ সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর কৃতি, সাফল্য ও অর্জন এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর যে তা অল্প কথায় তুলে ধরা সম্ভব নয়; এভাবে তাঁর অর্জনের প্রতি সুবিচার করাও যাবে না। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের মনেই তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। আমি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি যে, মানুষের পক্ষে তাদের জীবনে বড় অর্জন কঠিন কোনো ব্যাপার নয়; কিন্তু সেসব কৃতিত্বের সঙ্গে সঙ্গে একজন মহৎ মানুষ হয়ে ওঠা যথার্থই বিরল ও জটিল বিষয়। তবুও, আনিস মামা ছিলেন তেমনই একজন মানুষ, যাঁর মধ্যে এই দুয়ের পুরোপুরি সম্মিলন ঘটেছিল। আমি তাঁকে চিনি আমার বাল্যকাল থেকে।
তিনি যে কেমন ব্যতিক্রমী ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। অন্যদের প্রতি তাঁর সহৃদয়তা ও সুবিবেচনা সবসময় তাঁর কাজে ও চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বিশ্বাস ও সততা এবং মানবিক গুণাবলির কথা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন এমনই একজন নিখুঁত পরিশীলিত মানুষ, যিনি নিজের বিনয়কে ধারণ করেছেন গর্বের সঙ্গে। তাঁর চারপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতিসূচক ব্যবহার ও সৌজন্য অথবা কুশল বিষয়ে অকৃত্রিম অনুসন্ধান।
সারাজীবন আমি এমন অভিভাবকদের সাহচর্য পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি, যাঁরা ছিলেন আমার নির্ভরযোগ্য প্রেরণা, পরামর্শদাতা ও পিতৃতুল্য ব্যক্তি। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের পর স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন আমার সেই বিজ্ঞ পরামর্শদাতা এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা। প্রায় বিশ বছর আগে আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম এবং এরপর থেকে তিনি ছিলেন আমার এই যাত্রার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তিনি সবসময় আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা যেসব কাজ করেছি তার একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি সবসময় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সব উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছেন এবং এর মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরীর জন্য ছিলেন উৎসাহের এক বড় উৎস। তিনি ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের একজন ট্রাস্টি এবং শিল্প-সাময়িকী যামিনী, শিল্প ও শিল্পী এবং সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যপত্রিকা মাসিক কালি ও কলমের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি। আনিস মামা ছিলেন পরম আন্তরিক একজন মানুষ এবং নিজের দায়িত্ব পালনে পরিপূর্ণভাবে নিবেদিত। তাঁর কাছে কালি ও কলম ছিল অত্যন্ত প্রিয় ও বিশেষ অর্থবহ। তিনি এর প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ দিতেন এবং সব লেখা বিস্তারিতভাবে পড়তেন। তিনি সবসময় এই সাহিত্য মাসিকটির সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের পারিবারিক বন্ধু হিসেবে তিনি ছিলেন তাঁর একজন ভক্ত ও অনুসারী। তিনি জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের কাজের প্রতি আস্থাবান এবং এর বোর্ডের একজন ট্রাস্টি ছিলেন। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে এর বন্দোবস্তকারী বা সেটলর মনোনীত হয়েছিলেন। এতেই বুঝতে পারা যায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কোন মাপের মানুষ ছিলেন এবং তাঁর ওপর ট্রাস্টের কতখানি আস্থা ছিল। অধ্যাপক রাজ্জাকের গভীর আস্থা ছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পাণ্ডিত্যের ওপর এবং তিনি তাঁর ও তাঁর কর্মক্ষমতার অত্যন্ত প্রশংসা করতেন। আমার নিজের ও আমার পরিবারের সবার কাছে আনিস মামা ছিলেন পরিবারের একজন সদস্য। আমার মা ছিলেন তাঁর বোনের মতো এবং আমার খালু এ জেড এম আবদুল আলী (খোকন খালু – আমার মায়ের ভগ্নিপতি) ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তাঁরা দুজনে একসঙ্গে কালি ও কলমে কাজ করেছেন। বস্তুত আমার খালুর মাধ্যমেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার আট বছর বয়সে। আমার মায়ের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এবং আমার বোনেরা ও আমার ভাই এবং তাদের স্বামী ও স্ত্রীর প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমার ছেলেমেয়েরা ছিল তাঁর নাতি-নাতনির মতো। তিনি সবসময় তাদের (ও তাদের ছেলেমেয়েদের) ভালোবাসা ও স্নেহের সঙ্গে আদর করতেন। আর একইভাবে তা করতেন বেবী মামি। যখনই আমি কিংবা আমাদের কারো সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, আমরা তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা ও আমাদের সবার প্রতি তাঁর স্নেহ অনুভব করেছি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এই উষ্ণতা ও ভালোবাসা আমাদের সকলের দিক থেকেও একই রকম।
আনিস মামা ছিলেন নীতিনিষ্ঠা ও দৃঢ় বিশ্বাসের একজন মানুষ, কিন্তু তবুও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্রস্বভাবের ও কোমলচিত্তের অধিকারী। শুধু তাঁর উপস্থিতিই, তা সে যত দ্বিধাপূর্ণই হোক না কেন, সবসময় আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে নিত। তাঁর অধ্যয়নের পরিধি ছিল বিস্তৃত ও গভীর এবং প্রায় সব বিষয়েই তিনি অবহিত ছিলেন। তিনি যদিও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত, কিন্তু ইংরেজি ভাষায়ও গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদাশয় ও বিনয়ী একজন মানুষ এবং কোনো অনুরোধের প্রতি না বলা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। এমনকি ২০১৬ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটার পরও আমন্ত্রিত হলে তিনি যে-কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্মত হতেন এবং এই সম্মতি আসত মূলত তাঁর সৌজন্যবোধ থেকেই। তিনি ছিলেন জীবনে তাঁর বেড়ে ওঠার এক নিখুঁত প্রতিফলন।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যু জাতিকে বজ্রাহত ও মর্মাহত করেছে। এর প্রথম কারণ হলো, এই ক্ষতি অপূরণীয়। তাঁর মতো মানুষদের মৃত্যু আমাদের জাতি ও দেশকে আরো বেশি দরিদ্র করে তোলে। তাঁর প্রজন্মের আরো অনেক মানুষ আমাদের মাঝে এখনো আছেন এবং আমি কখনো কখনো ভাবি – তাঁদের কাছ থেকে যা কিছু আমাদের শেখার আছে তা আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি কি না। এই জাতি এবং এর সুশীল সমাজের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান অসামান্য।
আমি বিশ্বাস করি যে, আমরা যে মনীষীদের হারিয়েছি এবং যাঁরা এখনো সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মাঝে আছেন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের কাজ ও আদর্শের বিবরণালেখ্য তৈরির চেষ্টায় পদক্ষেপ আমাদের নেওয়া উচিত, যাতে করে তরুণ প্রজন্ম তাঁদের জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেসব আদর্শ তাদের জীবনে রূপায়িত করার মাধ্যমে নিজেদের জীবনের পথ তৈরি করে নিতে পারে।
যদিও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি, তবুও এ-কথা না বলে আমি পারছি না যে, আমরা প্রায়শ মানুষকে তাঁর জীবদ্দশায় প্রাপ্য যথাযথ স্বীকৃতি ও সম্মান দিই না। আমি মনে করি, সাম্প্রতিককালের অপূরণীয় ক্ষতিগুলো আমাদেরকে আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মানুষদের জন্য আরো কিছু করার শিক্ষা আমাদের দিয়েছে।
আনিস মামা অথবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমরা স্মরণ করছি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে। তাঁর মতো এমন আরেকজন মানুষ আমরা কখনো পাব না – সে তিনি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, পণ্ডিত, শিক্ষক, পরামর্শদাতা, দার্শনিক, অ্যাকাডেমিশিয়ান (শিক্ষাব্যক্তিত্ব) বা চিন্তাবিদ, যা-ই হোন না কেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে – তাঁর মতো এমন আরেকজন মানুষ কখনো পাওয়া যাবে না। তাঁর অনুপস্থিতি আমরা কষ্টের সঙ্গে স্মরণ করব এবং ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে আমরা মনে রাখব।