ফণির পরে

ক্যা   বারে কুটি যাচ্ছু! রমেন মাস্টার বলে জয়নালকে। রমেন মাস্টারের বগলে ছাতা, তার হাঁটার গতি দ্রুত। তার মাথায় টাক, টাকের ওপরে নীল আকাশের নীল, গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ প্রতিফলিত হচ্ছে। জয়নাল গেরস্তি কাম করে, খেতি কাম করে; মানে সে একজন কৃষক; তার পরনে চেককাটা তমন্দ, গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি, তার চোখেমুখে রাজ্যের মেঘের ছায়া! অন্ধকার।

রমেন মাস্টার আবারো বলে, ক্যা বারে জয়নাল, কুটি যাচ্ছু!

ভেঁওত যাই বারে, কাইল সানঝের বেল বাতাস হলো না! তারপর তো বৃষ্টি।

মোর ভেঁও তো দেখা হলো না, কালকা আইতের বেলা মুই আর ঘুমাবার পারোম না। খালি ভাপর লাগে। ধানের ভেঁওটার না জানি কী অবস্থা!

রমেন মাস্টার তার পাশে দাঁড়ায়, গ্রামের কাঁচা রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে কাদাময়  হয়ে গেছে, হাঁটাও মুশকিল; বাটার খুব ভালো জুতা কাদায় গেঁথে যাচ্ছে। চারটা হাঁস রাস্তা দিয়ে প্যাঁক প্যাঁক করে হেঁটে যায়। বৃষ্টি হওয়ায় হাঁসগুলোর মনে বোধহয় বেশ ফুর্তি। একটা ছাগল গা ঝাড়ে। গা থেকে পানির ছিটা পিচকারির মতো ফুলঝুড়ি ঝরায়।

রমেন মাস্টার কাদায় ডেবে যাওয়া তার ডান পায়ের জুতাটা উদ্ধারের জন্য কসরত করতে করতে বলে, বাহে, ফণি হলো না? ওই যে ঘূর্ণিঝড়। ভগবানের আশীর্বাদে ফণি বাংলাদেশের ওপর দিয়া বয়া যায় নাই; কিন্তু বৃষ্টি তো হামার এলাকাতেও হলো। কী করব্যা! ওপরওয়ালাক তবু থ্যাংক ইউ বলা লাগে, ক্ষতি তো আরো বেশ হবার পাইরত! কী কও?

হ বারে। ওকনাই সান্তববনা। ক্ষতি তো আরো বেশিও হবার পারত।

বৃষ্টি ঝরল। ধরো যা গরম পড়ছিল, গরম তো কমল।

জয়নাল বলে, তা কমল। মাস্টর, তুমি কুটি যাচ্ছু?

মাস্টারের আর কাম কী! ছাত্র পড়াবার যাই বারে।

যাও। পড়াও। তোমার ছাত্র হামার ব্যাটার ফল বারাবি নাকি  বেষদবার, কথা কি ঠিক?

হ বারে। তাই তো শুনবার পাচ্ছি।

মাস্টর, হামার ব্যাটার জন্য আশীর্বাদ করো।

তাক ফির কওয়া লাগবি? আশীর্বাদই তো করিচ্ছি। সারাক্ষণ আশীর্বাদই করিচ্ছি।

জয়নালের বড় ব্যাটা জাহাঙ্গীর আলম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল।  রেজাল্ট হবে বৃহস্পতিবার। জয়নালের দুই ছেলে। জাহাঙ্গীর, আলমগীর। আলমগীর ক্লাস সিক্সে উঠেছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। বড়টার মাথা আরো ভালো। ক্লাস এইটের পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল। জাহাঙ্গীর ম্যাট্রিকে যে কেমন করে, আল্ল­vহ জানে। ছেলেটার ব্রেন ভালো। মাস্টারেরা বলে। জয়নাল বাপ হয়ে ছেলের পড়াশোনার খবর নিতে পারে না। নিজে তো লেখাপড়া  বেশিদূর করতে পারে নাই। হাইস্কুলে গিয়েছিল কিছুদিন। শেষ তো করেনি। বাপ ডেকে ডেকে হালে লাগিয়ে দিত। জয়নালেরও হাল বাইতে ভালো লাগত। নিজেকে মরদ মরদ লাগত।

রমেন মাস্টার চলে যায় তার জুতায় আর কাদায় মচমচ শব্দ তুলে। খালি পায়ে জয়নাল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। তার মনটা কেমন কেমন  যেন করছে। বাজে-পোড়া পাকুড়গাছের ভিটায় তার দেড় বিঘা জমিতে  সে বোরো ধান লাগিয়েছে। চৈত্র মাসের শেষেই ধানে শীষ এসেছে, এখন ধান পুষ্টু। চার-পাঁচ দিন সময় দিলেই ধান পেকে সোনালি হয়ে যাবে। খুব ভালো ফলন হবে এবার। জয়নাল মনে মনে ভেবেছিল। কৃষিকাজে লাভ নাই। ফসল ভালো ফললে, ফলন ভালো হলে বাজার পড়ে যায়। আর বাজার ভালো থাকলে ফলন ভালো থাকে না। এখন তো কিষানের মজুরি বেশি। তাও কিষান পাওয়া যায় না। কাটামারির সময় কিষানদের পোয়াবারো। জামাই-আদর করা লাগে কিষানদের। গ্রামে  কেউ থাকতে চায় না। সব গাজীপুর নরসিংদী চলে যায় গার্মেন্টসের কাজে। চট্টগ্রাম না কি কোথায় যায় জাহাজভাঙার কাজে। ঢাকা সিলেট চলে যায় রাজমিস্ত্রির কাজে। গ্রামেগঞ্জে পড়ে থেকে কৃষিকাজ করবে  কে? এদিকে পানির পাম্পে তেল লাগে। সেচের জন্য খরচ লাগে। সার আছে, কীটনাশক আছে। খরচের খাতের কি শুমার আছে বারে!

জয়নাল ভিটার দিকে হাঁটে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে এই সকালে। কাল সারাটা দিন ছিল খোসা ছাড়া লিচুর মতো মেঘে মেঘে ছাওয়া। রেডিও-টেলিভিশনে বারবার করে বলছিল, ঘূর্ণিঝড় ফণি আসছে। এটা নাকি ভয়ংকরতম ঘূর্ণিঝড়। বাজারে বিকালবেলা আলুপুরি খেতে খেতে জয়নালও শুনছিল অন্যদের মতামত : এই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে উড়িষ্যায়। বাংলাদেশে আসতে আসতে দুর্বল হয়ে যাবে। আর বাংলাদেশেও ঢুকবে খুলনা সাতক্ষীরা দিয়ে। চলে যাবে ফরিদপুর ঢাকা হয়ে মেঘালয় আসাম। তাদের এলাকায় ক্ষতি হবে না।

তা কাল রাতে যখন একটু বাতাস হলো, বৃষ্টি শুরু হলো, জয়নাল, তার দুই ছেলে জাহাঙ্গীর আর আলমগীর আর ছেলেদের মা মিলে তখন তারা টেলিভিশন দেখছিল। ভারতীয় বাংলা চ্যানেলে তখন একটা সিরিয়াল হচ্ছিল। বিদ্যুৎ চলে গেল, ঘর হয়ে গেল অন্ধকার, টেলিভিশন  ঘোলা! বাইরে হঠাৎ জোরে বাজ পড়ল, আলমগীর ভয়ে জড়িয়ে ধরল তার মাকে! জাহাঙ্গীর বলল, আলোর গতি শব্দের চায়া বেশি। এ আলমগীর, তুই বাজের আওয়াজকে ভয় পাচ্ছু কিসক, বিজলির আলোক ভয় পা।

তখনি তাদের টিনের চালে বৃষ্টি শুরু হলো।

জাহাঙ্গীর বলল, বাজান, ফণি আস্যা পড়ল।

জয়নাল বলল, হামাঘেরে এলাকাত নাকি আসপি না!

জাহাঙ্গীর বলল, আসপি না মানে ঝড়তুফান হবি না। কিন্তু বৃষ্টি  তো শুরু হয়াই গেল।

জাহাঙ্গীরের মা বলল, হারিকেনটা জ্বলাই। ম্যাচ কুটি থুছি চুলার পাড়তই তো থাকে।

জয়নাল বলল, পাকঘরত যায়া আমি আনা দিচ্ছি, তুমি যায়ো না।  তোমার শরীলডা তো জ্বরজ্বর।

জাহাঙ্গীর বলল, হামি যাচ্ছি। তোমরা নক করা বস্যা থাকো।

১৬‌ বছরের ছেলেটা চট করে ছাতাটা নিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে ছাতাটা মেলে দৌড় ধরল রান্নাঘরের দিকে। দিয়াশলাইয়ের বাক্স আনতে। ওদের মা হারিকেন জ্বালাবেন। কারেন্ট তো আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে। হারিকেন তাই লাগেই। কেরোসিনের খরচও লাগে।

জয়নাল সকাল সকাল বেরিয়েছে ক্ষেত দেখতে। ফণি চলে গেছে। সকালের আকাশ পরিষ্কার। নীল আকাশে সাদার ছিট, আকাশটাকে সুন্দর দেখাচ্ছে, মেঘগুলোকে মনে হচ্ছে একঝাঁক হাঁস, আকাশের নীলে সাঁতার কাটছে।

দুই পাশে ক্ষেতের দিকে তাকায় সে। ক্ষেত তো সব ঠিকই আছে। এই পাশে ধান, পাট, যারা যা করেছে, বৃষ্টির পানিতে ভেজা; কিন্তু ধানগাছগুলো মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। তার নিজের ক্ষেত এখন ঠিক থাকলে হয়।

শিমুলগাছের মোড়টা পার হলো সে। সাইকেল মেকানিক শিবুর দোকান। তিনটা রিকশাভ্যান সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এই কাঁচা রাস্তার মোড় পর্যন্ত এখনো ব্যাটারির টমটম আসে নাই। রিকশাভ্যানগুলো এইখান থেকে যাত্রা শুরু করে পাকা রাস্তায় যায়। আরো দূরে যাওয়া তখন তাদের পক্ষে সহজ হয়। এখন এই কাদা রাস্তাটুকু পার হতে রিকশাভ্যানগুলোর কষ্টই হবে।

পাকুড়গাছটা বাজে পুড়ল। তার ডালপালা শুকিয়ে গেল। তবু গাছটায় কেউ হাত দেয়নি। এই গাছে তেনারা থাকতেন বলে গ্রামে প্রচলিত আছে। বাজ মানে আগুন। তেনারাও তো আগুনের তৈয়ারি।  তেনারা তো আর গাছ ছেড়ে চলে যাননি। কেউ যদি পাকুড়গাছের ডালে হাত দেয় খড়ি করবে বলে, তাহলে তার হাত তো পুড়ে যাবেই, বংশ নির্বংশ হতে পারে।

পাকুড়গাছের তলাটা পার হওয়ার সময় কলেমা পড়ে নিল জয়নাল।

তারপর উঁচু জমিটা পেরিয়ে নিচে তার ধানক্ষেতের দিকে চোখ পড়ল জয়নালের।

সে স্থির হয়ে গেল। ওই পাশে তিনশো-চারশো হাত চওড়া একটা জায়গা জুড়ে যত ক্ষেত আছে, সব শুয়ে পড়েছে। বাতাসের একটা ঝাপ্টা এই জায়গা দিয়ে বয়ে চলে গেছে সম্ভবত। তার নিজের ধানক্ষেতের সব ধান নুয়ে আছে। আশেপাশে সামনে আরো আরো  ক্ষেতের একই অবস্থা। পুবের দিকের জমিতে খয়বার চাচা করলা করেছিলেন, জাংলা ছেড়ে মাটিতে পড়ে আছে সব করলার ডালপালা, ওইদিকে হামেদ মিয়ার কলাক্ষেতেও দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষয়ক্ষতি।

আহা রে, আর পাঁচটা দিন সময় পেলেই ধান পেকে যেত। কাটামারির ফুর্তি লাগত। মামুর কিষান নিয়োগ দিত জয়নাল। ভাই ভাসেত্ম ভাগ্নে যতজন কামলা কিষান আছে, সবাইকে সে আলু লাউ গরুর মাংসের ঘণ্ট দিয়ে দুপুরে ভাত খাওয়াত। সবাই মিলে লেগে পড়ত ধান কাটতে। কিন্তু পাঁচটা দিন সময় দিলো না ফণি। বাতাসটা কিনা তার ক্ষেতের ওপর দিয়েই বয়ে গেল।

এই ধান করার জন্য সে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা  লোন নিয়েছে। ধানকাটা সেরে ধানের দাম কিছুটা উঠলে সে বিক্রি করে দিত ধান। ঋণ শোধ করত। ছেলে তার কলেজে যাবে। মোকামতলা কলেজে। তার জন্য একটা সাইকেল লাগবে। সাইকেলের টাকাও  সে জোগাড় করে ফেলতে পারবে। কলা করেছে কালীতলার ভিটায়।  রোজার মাসে কলার চাহিদা বাড়বে …

জয়নালের চোখের কোণে পানি জমে, আকাশ পরিষ্কার, নীল আরো নীল হয়ে উঠছে। আলোয় আলোয় ভরে উঠছে পুরা পাথার। শুধু তার  চোখের কোণে পানি জমছে। সে কি কাঁদবে। এই সকালবেলা নিজের  ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো দেড় বিঘার জমির শীষে ভরা ধানের জমিকে মাটিতে শুয়ে পড়তে নুয়ে পড়তে দেখে সে যদি কাঁদে, লোকে কি কিছু মনে করবে? কে দেখবে? দেখলেই বা কী!। মনে করলেই বা কী! জয়নালের নিজ হাতে চাষ করা জমিতে, নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে বড় করা ধান নুয়ে পড়েছে, হেলে পড়েছে, মাটির সঙ্গে মিশে আছে, তার অবশ্যই কাঁদা উচিত।

জয়নাল এগিয়ে যায়। মাটিতে বসে। ধানের একটা গোছা হাতে তুলে নেয়। ভেজা ধানের গা থেকে পানি ঝরে। তার হাত ভিজে যায়। মাটিতে পানি জমে আছে। একটা ঢোঁড়া সাপ হলুদ লেজ নাড়তে নাড়তে চলে যায় দূরে, তাকে দেখে, সসম্ভ্রমে। তিনটা চড়ুইপাখি ধানের ক্ষেতের ওপর দিয়ে ঝগড়া করতে করতে পাক খেয়ে ওড়ে।

জয়নাল উবু হয়ে তার ক্ষেতের ধানে হাত বুলায়। ধানের ছড়াগুলোকে হাতে তোলে। ধানগাছগুলোকে সান্তবনা দেয়। বলে, এই  তোরা কি খুব ব্যথা পেয়েছিস?

কী করবে এখন জয়নাল?

জয়নাল দাঁড়ায়। তার পায়ের নিচে পানি। গোড়ালি ডুবে গেছে পানিতে। লুঙ্গিটা তুলে সে হাঁটুর ওপরে ভাঁজ করে বাঁধে। ঘাড়ের গামছা  সে কোমরে বাঁধে। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তার পুরা ক্ষেতের দিকে। পুরাটা ক্ষেতে সবুজ ধান কালো ধান আধাপাকা ধান মাটির সঙ্গে মিশে শুয়ে আছে।

হঠাৎ সে দেখতে পায়, কতগুলো পিঁপড়া তার ডান পা বেয়ে ওপরে উঠছে। একটা ধানগাছে বাসা বানিয়েছিল পিঁপড়াগুলো। তাকে পেয়ে তারা তার পা বেয়ে উঠছে। ছোট ছোট লাল পিঁপড়া। এখন সে কী করবে? এই পিঁপড়া তাকে কামড়াতে আরম্ভ করলে যন্ত্রণার আর অবধি রইবে না। আর যদি সে পা সরিয়ে নেয় পিঁপড়াগুলান বাঁচবে না তো।

এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। পিঁপড়াগুলানকে তার পা বেয়ে উঠতে দেওয়া উচিত। নাকি ঝেড়ে ফেলে দেওয়া উচিত?

সামনে কর্তব্য আছে। আজকালের মধ্যেই ধান কেটে ফেলতে হবে। যে-অবস্থায় আছে সে-অবস্থাতেই। ভালো চাল হবে না। কিন্তু হবে। ভালো দাম পাওয়া যাবে না। কিন্তু পুরাটা তো আর লোকসান হবে না। এখনই ব্যবস্থা করতে হবে। কিষান ডাকতে হবে।

জয়নাল পিঁপড়ার কথা ভুলে যায়।

তারপর সে কর্তব্যের টানে ঘরের দিকে ফিরতে থাকে। কোমরে বাঁধা কাপড়ের ফিতায় তার মোবাইল ফোনের থলে থেকে সে ফোনটা  বের করে। ফোনের নম্বর চেক করে সে ফোন দেয় জামালকে। ক্যা বারে জামাল, ক্যাংকা আছু। হ্যালো, শোনেক, হামার ধানের ভেঁও তো মাটির সাথে মিশা গেছে। ধান পাকতে আরো চার-পাঁচ দিন টাইম দেওয়া লাগত; কিন্তু উপায় তো নাই। কাটাই লাগবি। তুমি পাঁচটা কিষান আন্যা দেও বারে।

বলতে বলতেই পাকুড়তলা পেরিয়ে সামাদের দোকানের পাশে টিউবওয়েলের পাশে এসে সে দাঁড়ায়।

ব্যাগের মধ্যে মোবাইল ফোনটা ভরে সে চাপকলের হাতলে চাপ  দেয়। গলগল করে পানি বেরোতে থাকলে সে তার পা এগিয়ে দেয়।

পায়ে অনেক পিঁপড়া। টিউবওয়েলের পানির স্রোতধারায় পিঁপড়াগুলো ভেসে যেতে থাকে। পিঁপড়াগুলোকে বাঁচানোর কথা জয়নাল ভুলেই গিয়েছিল। খালি যে আকাশের দেওয়া খামখেয়ালি করে, কাউকে বাঁচায়, কাউকে মারে তা নয়, দেখা গেল, জয়নাল নিজেও খামখেয়ালি করে। একটু আগে তার মনে হয়েছিল সে পিঁপড়াগুলোকে বাঁচতে সাহায্য করবে; কিন্তু নিজের ক্ষেতের ধান কাটার ব্যবস্থা করতে গিয়ে সে তার গায়ে আশ্রয় নেওয়া পিঁপড়াগুলোর কথা বেমালুম ভুলে  গেছে।

এখন পানির তোড়ে ভেসে যাওয়ার আগে তিন-চারটা পিঁপড়া তাকে কামড় বসিয়ে দেয়। তখন তার হুঁশ হয় যে পিঁপড়াগুলোকে বাঁচাতে চেয়েছিল।

কিন্তু এর মধ্যে সে পিঁপড়াগুলোকে টিউবওয়েলের পানির ধারায় ভাসিয়ে দিয়েছে।

 

 

দুই দিন পরে ধান কেটে কিষানেরা তার উঠানে পালা করে। কাঁচা ধানের ভেজা গন্ধে উঠান ম-ম করে। ধান মাড়াই করতে হবে।

জাহাঙ্গীরের মা গরুর চাড়িতে মাড় দিতে দিতে ধানের পালাটাকে  দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জয়নাল পরের দিন দুই কিষানকে কামলা খাটানোর জন্য বলবে বলে মোবাইল ফোনে তাদের নাম সার্চ দেয়।

আঙিনায় মুরগি চরছে। একটা নেড়ি কুত্তা শুয়ে আছে আমগাছের ছায়ায়। দূরে একটা গরুর পিঠে দুইটা পাখি পোকা খাচ্ছে। গরুটা আরামে গলা বাড়িয়ে শরীর এলিয়ে দেয়।

হিন্দি গানের সুরে জয়নালের মোবাইল ফোনের রিংগার বাজে।  ফোন করেছে জাহাঙ্গীর। তার ছেলে।

হ্যালো, বাপ, কও বারে।

বাপজান, হামি জিপিএ ফাইভ পাছি।

জাহাঙ্গীর লাফিয়ে ওঠে, ও জাহাঙ্গীরের মাও, শুনছ বারে, তোমার ব্যাটা তো জিপিএ ফাইভ পাছে।

জাহাঙ্গীরের মায়ের হাতে তখন একটা আরএফএলের লাল বালতি। সে সেটা নামিয়ে রেখে ছুটে আসে, কেটা ফোন করিছে?

জাহাঙ্গীর। লাও। কথা কও …

হ্যালো, জাহাঙ্গীর …

মাও। হামি জিপিএ ফাইভ পাছি মাও। আমি আসিচ্ছি, বাপজানক কও, হামাক কিন্তু সাইকেল কিন্যা দেওয়াই লাগপে …

দিবে তো। তোর বাপ টাকা জোগাড় করিচ্ছে বাপ। আয় … বাড়িত আয় …

জয়নাল ধানের পালাটার দিকে তাকায়। আর পাঁচটা দিন পরে যদি ফণিটা আঘাত হানত, তাহলে কয়েক হাজার টাকা বেশি পাওয়া  যেত এই ধান থেকে। আল্ল­vহর মনে যে কী আছে। ফণি আঘাত হানল খুলনা, সাতক্ষীরায়, আর ধানক্ষেত শুয়ে পড়ল তার। কতদূরে থাকে তারা সমুদ্র থেকে।

জাহাঙ্গীরের বাপ, তুমি চিন্তা করিচ্ছ কী? সাইকেলের ট্যাকা হামি  তোমাক দেমো। হামার সমিতিত হামার টাকা জমা থাকিচ্ছে তো। ওঠো। ব্যাটার ফল ভালো হছে, হাসো তো।

চামেলি বলে। জয়নালের বউ। জাহাঙ্গীর আলমগীরের মা।

আলমগীর কোত্থেকে আসে। নীল শার্ট পরা, হাফপ্যান্ট। বলে, মা, হামি পড়বার বসিচ্ছি। ভাইজান ফল ভালো করিছে, হামাকো তো করা লাগবি, না?

চামেলি হাসে। ক্যা বারে আলমগীর, এক বেলা পড়লি ফল ভালো হবি?

আলমগীর বলে, ইস, হামার ফল কী খারাপ? হামিও তো জিপিএ ফাইভ পাছি। পিএসসিত। পাই নাই? কও।

একটা মোরগ অসময়ে ডেকে ওঠে, ক কক কক। কুক কুরু কু।

চামেলি দুধ জ্বাল দেয়। জাহাঙ্গীর এলে দুই ভাইকে একসঙ্গে দুধভাত খেতে দেবে সে।

তার ছেলেরা দুধভাতে বড় হচ্ছে, এটা ভাবতেই তার চোখে পানি চলে আসে।

গ্রামীণ ব্যাংকের লোক তখনই এসে তাদের উঠানে দাঁড়ায়, চামেলি  বেগম আছেন নাকি! এই সপ্তার কিস্তিটা …