ফেনার রাজ্য

হঠাৎ করেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। অল্প একটু আলো ছিল, বাল্বের আলো, আমার পেছনের কোনার দিকের, ফিউজড? উঠে দাঁড়াই। না, বাল্ব না, বিদ্যুৎ চলে গেছে। দেখি, সামনের সিঁড়ির ওপর আলো নেই। এই ঘরে আমি অন্ধকারেও সবকিছু দেখে নিতে পারি; আমার চেনা ঘর, আসবাবপত্র কোনটা কোথায় আমার জানা আছে। অন্ধ মানুষ চেনা জগতে হাতড়ে হাতড়ে হাঁটে না আর এ-ঘর তো আমার চিরচেনা। আমি সামনের কফি টেবিলের বাঁ-পাশ দিয়ে এগিয়ে কিচেনে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখি। ডেন থেকে কিচেন পাঁচ ধাপ ওপরে, মাঝখানে কোনো দেয়াল নেই, তাই, কিচেন ও ডেন দুটোই খোলা। আমি সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত রেখে ওপরে উঠে কিচেনের মাঝখানের টেবিলের ওপর থেকে সেল ফোন তুলে টর্চ জ্বালাই। ফোনটা ওখানেই ফেলে এসেছি, মনে ছিল। রেফ্রিজারেটর খুলে গিনিস বিয়ারের প্যাক নিয়ে ডেনে ফিরে আসি। ফিরে আসার সময় কিচেনের জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের লনে অন্ধকারে প্রায় মিশে যাওয়া অস্ফুট সাদা, ময়লা আলো দেখি। চাঁদের শিশুকাল, রোজকার এ-সময়ের আলোটাও নেই, জগৎ সংসার অন্ধকার।

এ-অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার রীতি নেই। শেষ কবে বিদ্যুৎ গিয়েছিল আমার মনে নেই। আমার বাড়ির একপাশে এমেন্ড আর অন্যপাশে অটো রোড; কোনার এই বাড়ির ল্যাম্পপোস্টে মাত্র একটি বাল্ব, আলো অপর্যাপ্ত, গ্রাম গ্রাম লাগে। সেইসঙ্গে ঝিঁঝির ডাক। এই গ্রাম গ্রাম ভাবটি নিকটের শহর থেকে একটি দূরত্ব রচনা করে। শহরের আলো আর কোলাহলের পরিবর্তে নিবিড় আড়াল-আবাস বলেই এই অঞ্চলে বাড়ির দাম চড়া। আমি অবশ্য চড়া দামে বাড়িটি কিনিনি, বছর তিরিশ আগে এখনকার দামের তুলনায় জলের দামে কেনা।

টিভি নেই, গান নেই, বই নেই, অন্ধকারে বিয়ারের ক্যানই ভরসা। আইরিশ কালো রঙের এই বিয়ার আমার প্রিয়। বছর পঁচিশেক আগে কর্মসূত্রে প্রায়ই আমাকে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে যেতে হতো। আমার এক কলিগ তার পছন্দের এই বিয়ার আমার পছন্দের তালিকায় জোর করে ঢুকিয়ে দিলেও পরে গিনিস ছাড়া অন্য বিয়ারে আমার রুচি হয় না। বিয়ার ছাড়া আমার অন্য কোনো পানীয়তে তেমন আগ্রহ নেই, হুইস্কি একদম না, ওয়াইনে আপত্তি নেই, তবে অনিয়মিত। কিন্তু কালো গিনিসের তুলনা হয় না, গ্লাসে ঢালার পরে ঘন ফেনা ওঠে, ওই ফেনাটা বাড়তি পাওয়া। ফেনিল জল সবাই পছন্দ করে কি না জানি না, দেখতে বেশ লাগে।

আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে নিয়ে, আমি যখন আড়াই ক্যানের মাথায়, ডেনের ফ্রেঞ্চ দরোজায় বাইরে থেকে কেউ টোকা দিলো, একটু অবাক হলেও আমি অনুমান করি, জো হবে। জোর বাড়ি আমার বাড়ির ঠিক পেছনেই, পেছনের পঞ্চাশ ফুট লনের পরেই। আমার বাড়ির চারদিক বেড়া দিয়ে ঘেরা। দু-বছর আগের নরইস্টারের দমকা বাতাস, জোর আর আমার বাড়ির মাঝখানের একফালি বেড়া আছড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। সেই থেকে মানুষের মুখের সামনের পাটির ঠিক মাঝখানের দুটি দাঁত পড়ে গেলে যেমন দেখায়, পুরো বেড়াটিরও একই হাল। বাড়ির কাজে আমার মনোযোগ কম, যেমনটা আছে তেমনটাতে আমার স্বস্তি হরণ হয় না। দরজায় আবার টোকা পড়ল। জো বেড়ার এই ফাঁক দিয়েই কখনো-সখনো আমার এখানে আসে। মানে করোনার আগে আসত। এই দেড় বছর আমরা কেউ কারো বাড়িতে যাইনি। আমি সেলফোনের টর্চ জ্বেলে দরজা খুলি।

এসো, এসো।

আমি জোকে স্বাগত জানাই। টর্চ জ্বেলে রেখেই তাকে ভেতরে আসতে বলি। আমার এই বাড়ির বসবাস ও জোর সঙ্গে আমার পরিচয় সমবয়সী, বন্ধুতাও তারপর থেকেই। আলো ও অন্ধকার আমাদের সাক্ষাতের মধ্যে কোনো বিপন্নতা আনল না, অস্ফুট কোনো দ্বিধাও না। জো ডেনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোমার কাছে মোমবাতি হবে?

এমনভাবে বলল যেন এই অতিমারীর মধ্যেও আমাদের রোজ রোজ দেখা হচ্ছে।

আছে হয়তো, দাঁড়াও, আমাকে খুঁজতে হবে।

তাকে বসতে ইশারা করে আমি কিচেনের দিকে যাই। জো জিজ্ঞেস করল, তোমার স্ত্রীকে দেখছি না …

ও ওপরে। আমি উত্তর দিই।

অন্ধকারে শুধু সেলফোনের আলো। আমি কেবিনেটের একটি ড্রয়ারে মোমবাতি পাই। দুটি মোমবাতি তুলে নিতে গিয়ে ভাবি, আরেকটি নিয়ে নিই, ফরিদার ঘর অন্ধকার। কী ভেবে আর নিলাম না, ফরিদা এখন চোখ বুঁজে শুয়ে আছে, সেলফোনের মনিটরে দেখেছি। বিছানার ওপরের ক্যামেরায় সর্বক্ষণ ফরিদা দৃষ্টির গোচরে থাকে। আমি ফিরে এসে একটি মোমবাতি জোকে দিতে দিতে বলি, একটিতে হবে? আমার আরো আছে, লাগলে বলো।

না না একটিই যথেষ্ট, লাগত না, একটা চিকেন ডিফ্রস্ট হতে রেখেছিলাম সিংকে, এর মধ্যেই আলো চলে গেল। অবশ্য বিদ্যুৎ না এলে ফ্রিজের সবই তো নষ্ট হবে।

কোনো ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, কিছু নেই, বিদ্যুৎ চলে গেল? এক্ষুনি চলে আসবে, ভেবো না। আমি নিশ্চিত হয়েই বলি। বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে বলি, চলবে?

কোনো কথা না বলে জো একটি ক্যান টেনে নিল। গিনিস বিয়ারের সঙ্গে জো আশৈশব পরিচিত। তার পৈতৃক বাড়ি আয়ারল্যান্ডে। আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব যে খুব সহজেই গভীর হতে পেরেছে, গিনিস তার অন্যতম কারণ। বিয়ারে রুচির সমিল আমাদের মনের যাতায়াত সহজ করে দিলো। আমরা করোনার আগে এরকম গিনিস-যাপন করেছি অনেক। করোনার জন্য আমাদের একসঙ্গে বসা হয়নি বছর দেড়েক। আমাদের এখানে করোনার প্রকোপ এখন অনেক কম।

কিছুক্ষণ কোনো কথা হলো না। যেন আমরা বিদ্যুৎ কেন চলে গেল, এর একটা যৌক্তিক কারণ খুঁজছি, বা কোনো কথা এখন নেই – এই যৌক্তিকতাতেই আমরা সমর্পিত। মোমের ক্লান্ত মেটে আলোতে দেখি, জো সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছে। আমি ফোনের মনিটরে দেখি, ফরিদা অনড় শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে না জানি, সে এক হাতের তালুর পেছনটা কপালের ওপর রেখেছে। এরকমভাবে কেউ ঘুমুতে পারে না। ব্যথা হচ্ছে? আমি এই প্রশ্নটা ফরিদাকে এখন আর করি না। শেষবার যখন জিজ্ঞেস করি, খুব ব্যথা হচ্ছে?  সেদিন ক্লান্তস্বরে সে বলেছিল, হু, ব্যথার কথা জানতে চেও না, কতটুকু ব্যথা তা কখনো কাউকে বোঝানো যায় না। তারপরের মুহূর্তগুলো উপর্যুপরি দীর্ণ হয়েছে, আমি ফরিদার পাশে বসে থাকি। মাসতিনেক আগে ডাক্তার বলেছে পাকস্থলীর ক্যান্সার ফরিদার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

জোকে দেখি সে চোখ খুলেছে। জিজ্ঞেস করল, ডিনার হয়েছে?

না। তাছাড়া ডিনার আর কি! এই একটা কিছু খেয়ে নেব। তুমি? ওহহো, চিকেন ডিফ্রস্ট হচ্ছে, বললে তো। আমি উত্তর দিই।

জো আমার কথা শুনল কি না বোঝা গেল না। ক্যানের তলাটুকু ঝেঁকে ঝেঁকে মুখে ঢেলে বলল, আহ। তারপর আরেকটা ক্যান খুলতে খুলতে বলল, পৃথিবীতে গিনিস নেই – এটা আমি ভাবতেই পারি না। তুমি তো ডাবলিনে গিয়েছ, গিনিস ব্রুয়ারিতে যাওনি? কী এলাহী কাণ্ড, ট্যুরের শেষে ওরা যত খুশি তত বিয়ার পান করতে গ্লাস ভরে ভরে দেয়।

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, গিয়েছি।

তারপর যেন সুতোর টানে কথাটি আসে, জো বলল, আমার তখন যৌবন ছিল …

আমি থামাই, বলি, যৌবন ছিল মানে? তোমার যৌবন এখনো আছে।

না না সেই সময়টা নেই। আমি তখন বাতাসের মতো, আমি – তারপর হঠাৎ থেমে ঢক ঢক করে প্রায় পুরোটাই বিয়ার মুখে ঢেলে দিয়ে বলল, লিফি নদীর হাফ পেনি ব্রিজটি দেখেছ নিশ্চয়ই, উঠেছ? হেঁটেছ?

দেখেছি। উঠিনি, হাঁটিনি। আমি একটু হেসে বলি।

তোমার জীবনটাই বৃথা। লিফির জল সমুদ্রের ফেনার দিকে বয়ে যাচ্ছে, ঠিক গিনিসের মতো, তরতর করে সব বুদবুদ উঠে আসে ফেনার শরীরে। তারপর তুমি সেই ফেনায় সব দেখতে পাবে, সব।

আমি বুঝতে পারছি, জো আজ আলাপ চাচ্ছে।

ফেনায় তুমি কী দেখ? প্রশ্ন করে একটু বিব্রত হই, প্রশ্ন করাটা হয়তো ঠিক হয়নি।

কি না! জো কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

কফি টেবিলের ওপর শেষ একটি ক্যান আছে। আমি উঠে দাঁড়াই। আরো একটি প্যাক রয়েছে রেফ্রিজারেটরে। জো এখনি উঠবে না – এটা নিশ্চিত, অনুমান করি। আমি কিচেনের দিকে এগোই, যেতে যেতে জিজ্ঞেস করি, তুমি কাজে যাচ্ছ?

সে তো গেল বছরেই ছেড়ে দিয়েছি। মানে ছাড়তে হয়েছে। ট্যুরিস্ট একদম নেই। ফাঁকা বোট কেন চলবে!

জো ম্যানহাটানে একটি বড়সড় বোটের ক্যাপ্টেন। ম্যানহাটানের চারদিকে ইস্ট রিভার আর হাডসন নদীতে ট্যুরিস্ট নিয়ে চক্কর দেয় সার্কেল লাইন। গত বিশ বছর ধরে জো সার্কেল লাইনে আছে। মানে ছিল, এখন নেই। জিজ্ঞেস করি, ঘরেই থাকছ? আবার বিপন্ন হই, করোনার সময় কে ঘর ছাড়ে। জো সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। চুপ করে বিয়ার পান করছে। নতুন আরেকটি ক্যান খুলে আবারো ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা পান করল, তার মাথা পেছনে হেলান দেওয়া, ঘরে নিঃশব্দের শিশির ঝরছে। জোর মাথায় চুল বিরল, পুরু গোঁফ প্রায় সাদা। জো আর আমি প্রায় সমবয়সী। আজ ওকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। ক্লান্ত আমিও। আমি যে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করি, আমার বাড়ি থেকে দূরে নয়, কাছেই। এজন্যেই এ-শহরে বাড়িটা কিনেছি। তখন এ-অঞ্চলে আমি কোনো বাঙালি দেখিনি। এখন তো বেশ কয়েকজন আশপাশে বাড়ি কিনেছে। আমাদের দুই ছেলেমেয়ে জয় আর মলির জন্মও এই বাড়িতে। ওরা এখন নিজেদের বাড়িতে থাকে। জয় ফ্লোরিডায়, বিয়ে করেছে; মলি ক্যালিফোর্নিয়ায়, একলা। বাড়িটা যখন কিনি, তা-ও কত বছর হয়ে গেল, তিরিশ বছর তো হবেই, ফরিদা বাড়ি দেখতে এসে ডেন দেখে এতো খুশি হলো, আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে বলল, এজন্যই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি।

মানে? আমি ওর চোখে আমার চোখ রাখি।

মানে কী সুন্দর এই ঘরটি, দেখো, লম্বা উঁচু কাচ দিয়ে ঘেরা, ভেতর থেকে বাইরের সবটুকু দেখা যায়। ওই যে ছাতার মতো লাল পাতার ম্যাপল গাছ, তা-ও, কী সুন্দর কী সুন্দর, সব শোভা এই ঘর থেকে – ফরিদা থামছিল না, তারপর কোনো আড়াল কামনা না করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল।

জো আরেকটি ক্যান নিল। ওর কিচেনের সিঙ্কে চিকেন ডিফ্রস্ট হচ্ছে, কে বলবে! আমি করোনা শুরুর পর থেকেই বাড়ি থেকে অনলাইনে অফিস করি। ফরিদার এই সময়টায় আমি কাছে থাকতে পারছি। স্ক্রিনে দেখি ফরিদা এখনো অনড় শুয়ে আছে। ওকে খাবার দিতে হবে, স্যুপ, ওর খেতে কষ্ট হবে না। ফরিদা সারাজীবন আমার কষ্ট আগলে রেখেছে। আমি রোদে পুড়ছি, ছায়া হয়ে ফরিদা দৌড়ে এসেছে। হঠাৎ জো বলল, চোখের সামনে পৃথিবীটা কেমন বদলে গেল। তোমার সন্তানের সন্তানরা জানবে না, কল্পনাও করতে পারবে না, আমাদের এই মহামারির দিনগুলোর কথা, বলো?

না, জানবে না, আমরাই কি অনুভব করে নিতে পারি একশ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু মানুষের জীবনে কী কষ্ট নিয়ে এসেছিল? একদিন নয়, দুদিন নয়, আজ এক বছরের বেশি হয়ে গেল রোজ রোজ মানুষের লাশ, লাশের পর লাশ, কী সর্বনাশ পৃথিবীর – আমার কথা গলায় দলা বাঁধে।

বিয়ার-বিস্তার বাড়ে। ডেনের কাচের দেয়ালের পর্দা খোলা। বাইরের তিরিশ বছর আগের কোমর অবধি উঁচু লাল ম্যাপল গাছ এখন অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। তার পাশ দিয়ে দেখি, হেডলাইট জ্বেলে একটি গাড়ি অটো লেন দিয়ে এমেন্ডে মোড় নিয়েছে। জো আজ আসার পর থেকে এটুকুই জীবন-ব্যস্ততা ফুটল। মানুষ মরলেও পৃথিবীর বাতাস এখন অনেক হালকা; রাস্তায় মানুষ নেই, গাড়ি নেই, তাই ধুলোও নেই। জো আবারো হঠাৎ একটু সামনে ঝুঁকে বলল, যেন স্বগত, হেলেন আর আমি কত লক্ষবার লিফির হাফপেনি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে জলের স্রোত দেখেছি। হেলেন আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা পাশাপাশি বড় হয়েছি। সারা ডাবলিন আমরা একসঙ্গে চষে বেরিয়েছি।

আমি কথা বলি না, শুনি। জো আজ আরো বলবে, আমি নিশ্চিত। বলবে বলেই এতোদিন যা বলেনি আজ তা-ই বলছে।

জো বলল, আমি যখন আমেরিকায় আসি তখন আমার বয়স বাইশ, হেলেন আমার সমবয়সী। হেলেনের সৌন্দর্য বর্ণনা করব – সে-ক্ষমতা আমার নেই, জানো, ওকে দেখলে আমার মনে হতো চাঁদ দেখছি, চাঁদের আলো ঝরে আমি যখন তার পাশে দাঁড়াই, নেশার মতো লাগে।

জো থামে। মোমের আলোয় দেখি তার কপালে ঘাম জমেছে, আমারও গরম লাগছে। এসি নেই, আমি উঠে কয়েকটা জানালা খুলে দিই। বাইরের বাতাস একটু ঢুকল মনে হলো, নিউইয়র্কের জুলাইয়ের রাতের বাতাস, না ঠান্ডা না গরম, তবু আরাম পেলাম।

বিয়ার নিঃশেষ হচ্ছে, সন্ধ্যাও পুরোপুরি অন্তর্হিত। এখন রাত। ফরিদাকে একটু দেখে আসব? জো বলছে, আমার আঙ্কেল আমাকে এখানে আমেরিকায় নিয়ে আসে। চলে আসার সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল হেলেনের জন্য, ওকে কথা দিয়েছিলাম, চাকরি পেয়েই, সবকিছু একটু গুছিয়েই ওকে নিয়ে আসব, বিয়ে করব। হেলেন তৃষিত হয়ে বলল, দেরি করো না।

জো কি অস্ফুট কাঁদল! শুনি বলছে, আমার ফেরা হয়নি, আটকে গেলাম, ব্যস্ততার কাছে, জীবনের কাছে বন্দি হয়ে গেলাম।

আমি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব বুঝতে পারছি না। জো বলল, এদেশে আছি চল্লিশ বছর হলো, কত কী ঘটে গেল পৃথিবীর!

তুমি কখনোই ফিরে যাওনি?

যেতে যেতে পনেরো বছর হয়ে গিয়েছিল।

হেলেনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না?

ছিল, শুরুর দিকে, কিন্তু কেন যেন, কেমন করে সব ঘটে গেল, আমিই ওকে লিখতে অনিয়মিত হই, পরে একদম না। তখন ফোন খুব কস্টলি ছিল, ওর চিঠি আসত, আমার উত্তর যেত না। আমি ভাবতাম, ও তো আছেই, ধরেই নিয়েছিলাম হেলেন তো আমারই, আর একটু গুছিয়েই … কিন্তু আর হলো না। এদেশ আমাকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু …

হেলেনকে আর দেখোনি?

না। ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

জোর হাতে গিনিস, তার হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে, আমিও দেখি ঘরে মোমের আলোও কাঁপছে, কী এক নেশাগ্রস্ত আলো, না আলো না অন্ধকার, অথবা এই-ই আলো, এই-ই অন্ধকার; আলো-অন্ধকারের বিলাপ ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে, জোর দিকে তাকাই, তার ঠোঁটে ঘনঘন বাতিল হচ্ছে আকুলিবিকুলি সবকথা। কিছুক্ষণ পরে জো বলল, কথা শ্লথ হচ্ছে, আমি একটা খারাপ মানুষ, ভাবতে পারবে না, অনেক খারাপ। জানো, আমি যখন এদেশে নতুন নতুন গাড়ি চালাই, সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, হাইওয়েতে দৃষ্টি এগোয় না, আমি চালিয়ে যাচ্ছি, আর কোনো গাড়ি নেই, আমি হঠাৎ কেন ব্রেক কষেছি জানি না, আমার পেছনে একটা গাড়ি ছিল লক্ষ করিনি, রিয়ার ভিউ মিররে দেখি, প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে গাড়িটি তাল সামলাতে না পেরে রাস্তা থেকে ছিটকে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আমি সব দেখেও গাড়ি থামাইনি, যে ড্রাইভ করছিল তাকে সাহায্য করিনি, ভাবতে পারো? লোকটা বাঁচল কি মরল জানি না। আমারই জন্য সে দুর্ঘটনায় পড়ল, আমি সেদিন কোনো সাহায্য করিনি।

জো উঠে দাঁড়াল। ছটফট করে ঘরময় ভাঙা শরীরে এলোমেলো পা ফেলছে। জো বলল, ডাবলিনে ট্রিনিটি কলেজের কাছেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমার বাবা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করত। বাবার টাকা-পয়সা বাড়তি ছিল না, আমাদের চলে যেত। মা আমাদের সবাইকে আগলে রাখত। বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিয়ে খুব আনন্দের জীবন ছিল আমার। কিন্তু আমি, জানো, আমি, অনেক খারাপ কাজ করেছি। আমি তখন বেশ ছোট, মিডল স্কুলে পড়ি, স্কুলে যাওয়ার পথে এক দর্জির কাছে আমার মা আমার জন্য একটি প্যান্ট বানাতে দেয়। মা আমাকে একদিন মজুরির টাকা দিয়ে বলে, প্যান্টটা নিয়ে এসো। আমি ওই টাকা থেকে পঞ্চাশ পেনি সরিয়ে রেখে দর্জিকে বলি, পঞ্চাশ পেনি কম আছে, কাল এসে দিয়ে যাবো। জানো, সেই কাল এখন পর্যন্ত আসেনি। আমি আজো দর্জির কাছে ঋণী হয়ে আছি।

আমি অবাক হয়ে জোর মুখের দিকে তাকাই। ওর মুখে বিব্রত সব রেখা ক্রমশ অসহায় হয়ে উঠছে। জো আজ আমাকে এতদিন আগের কথা, তুচ্ছ সব কথা বলছে কেন? জোর ঘরে জো একলা। কথা বলার মানুষ নেই। জো বিয়ে করেনি, এত বছর পরে হেলেনের কথা কেন বলছে? আমি খেয়াল করি আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। জোর মাথা আরো নুয়ে এসেছে, ভীষণ ক্লান্ত তার কণ্ঠস্বর, আমি মায়ের গয়নার বাক্স থেকে টাকা চুরি করে অনেক মুভি দেখেছি। কখনো ধরা পড়িনি। আমি খুব খারাপ, নষ্ট মানুষ। আমার সব মনে আছে, স্পষ্ট দেখি, আমি আমার পনেরো বছরের ছোট বোনের গালে চড় দিয়ে ক্ষান্ত হইনি, কানও মলে দিয়েছি সে লুকিয়ে প্রেম করছে বলে। আমি ওকে কখনো সরি বলিনি, ভাবতে পারো?

ঘরে এই মুহূর্তে সম্প্রতি বলে কিছু নেই। কী এক অচিন অতীত, বর্তমান হয়ে উঠছে। অচি‌ন, আবার চেনা, অন্যদিনের চেনা দিন; আমি দেখি, ফরিদা একটি বাড়ি পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে। বলল, এবার বাবা-মাকে আসতে বলো, ওঁরা দেখে যান আমাদের সংসার। পরের সামারে বাংলাদেশ থেকে বাবা-মা এলেন, সঙ্গে ছোট বোন। সে কী এক সামার! জয় যখন হবে, ফরিদা বলল, ছেলের নাম রাখব …। আমি ওকে থামিয়ে দিই, বলি, নাম রাখব ‘জয়’। ফরিদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাদের সন্তান জয়ী হবে, জীবনের সকল স্তবকে স্তবকে। এইখানে ফরিদা অনন্য। এমন গুছিয়ে কথা বলে, এমন এমন শব্দে, অবাক হই। মলি হলো, বলল, এটা তোমার মেয়ে, তুমি মেয়ে চাও, একে তুমি স্নিগ্ধ ও তুখোড় করে বড় করো। কোন জীবনের এসব স্বপ্নতাড়িত চাওয়া? ফরিদা বড় নিষ্ঠা আর ভালোবাসা দিয়ে তার সংসার তিলে তিলে গড়েছে। আজ এই সংসারে সে একা, বড় একা, ছেলেমেয়ে থেকেও কাছে নেই, সবাই দূরে দূরে, এমনকি তার স্বামীও। আমিও এই আলো-আঁধারিতে তাকে চোখের আড়াল করে রেখেছি। কেন? আমার বুকের ভেতর হাহাকার বিশাল হচ্ছে, আমি ফরিদার কাছে যেতে উদগ্রীব হই। জো আরেকটা ক্যান খুলে বলল, তুমি তো ডাবলিনে গিয়েছ, পার্কসকোর্ট বলে একটা বাগান আছে সমুদ্র ছুঁয়ে। ঘাসের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, অনেক নিচে; থরে থরে সর্বত্র নানারকম ফুল, শত শত সবুজ বৃক্ষ, ঝরনা, নিচে নেমে গেছে, মনে হবে এক মনোরম পাতালে নেমে যাচ্ছ তুমি, যেখানে এই পৃথিবীতেই তোমার জন্য স্বর্গ রচিত হয়ে আছে। আমার মায়ের খুব পছন্দের জায়গা ছিল।

তারপর জোর কণ্ঠ ভেঙে গেল, কান্না? আমি ঠাহর করে উঠতে পারলাম না, তার মাথা হাঁটু ছুঁয়ে আছে, শুনি –

কাল রাতে আমি মাকে দেখি, ঘাসের সিঁড়িতে পা ফেলে নেমে যাচ্ছে নিচের ঝরনার দিকে। আমি ডেকে বলি, মা মা। মায়ের মুখে হাসি, মা আমার ডাক শুনল কি শুনল না আমি জানি না, আমি কাঁদতে থাকি, কাঁদতে কাঁদতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

জো ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি দেখি মোমবাতির আলো দাপাদাপি করছে, বিয়ারের ক্যানগুলোতে সেই দাপাদাপি অন্তরঙ্গ হয়ে উঠছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব, আমার এই গিনিস-মুহূর্তের চিন্তা-ভাবনা স্পষ্ট নয়, ফস করে বলি, মাকে ফোন করে কথা বলেছো?

জোর মাথা এবার তার দুই হাঁটুর মধ্যে ঢুকে গেল, একটা অস্ফুট ধ্বনির মতো শুনি, মা সপ্তাহ দুই আগে মারা গেছে। করোনা আমার মাকেও নিয়ে গেল।

উত্তর-ষাটের জো শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, অনেক বছর দেশে যাইনি, ফোন করলেই মা বলত, কতদিন তোমাকে দেখি না জো, একবার এসে আমাকে দেখে যাও। ওর মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে পারিনি। বছরের পর বছর যাব যাব করে আর যাওয়া হয়নি। যাইনি তার শেষকৃত্যেও।

তারপর মুখ তুলে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তার জ্যেষ্ঠ সন্তান, কত বছর হয়ে গেল মায়ের কাছে যাইনি। আমি তো পারতাম যেতে, পারতাম, কিন্তু যাইনি। আমার কিছুই হয়ে ওঠে না, কখনোই না। বলো, আমি খারাপ মানুষ নই? খুব খারাপ, আমি নষ্ট, আমি কীট, না না কীটের চাইতেও –

জো মাথা গুঁজে কাঁদছে। আমি চুপ। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। একটা অতল ভারসাম্যহীনতা আমাকে গ্রাস করছে অনুভব করি। আমার চোখ গেল ফোনের মনিটরের ওপর, ফরিদা একটু নড়ল কি? আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ফরিদার জন্য আমার বুক হুহু করে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরেই আমি উঠে দাঁড়াই, দেখি, জোর আসন খালি, সোফায় কেউ নেই, আলো-আঁধারে চোখ ফেলে তাকে ঘরের ভেতর খুঁজি। না, নেই। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে, অন্ধকারের আলোয় দেখি জো নেই, আমার দৃষ্টিপথে কেউ নেই, সব সুনসান; অপরাধবোধের বোঝা, পাহাড় পাহাড় গ্লানির বোঝা নিয়ে জোর শরীর ফেনার রাজ্যে ডুবে গেছে।

আমি আমার বুকের চিড় চিড় শব্দ শুনি। দ্রুত ছুটে যাই, দোতলার সিঁড়িতে পা রাখি, ফরিদাকে আমার বুকে তুলে নেব, আমি ওর পাশে অনন্তকাল বসে থাকব।