বইয়ের ভুবন : বিশ্বের দর্পণ

একটি শতাব্দীর সেতু পেরিয়ে গেল শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি, প্যারিসের ইংরেজি বইয়ের দোকান। নামেই আছে যার ভিনটেজ মহিমা। জন্মদাত্রী নিউজার্সির প্রিন্সটনের সিলভিয়া বিচ। জন্মকাল ১৯১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। ভুবনজোড়া খ্যাতি এই বইবিপণির। প্যারিসের সেইন নদীর বাম কূলে দুটো স্বতন্ত্র ইংরেজি বইয়ের দোকান ছিল। প্রথমটির প্রতিষ্ঠাতা সিলভিয়া বিচ। ঠিকানা প্যারিস ছয় এলাকার ৮ রু দুপইথঁ (Rue Dupuytren), পরে বড় পরিসরে দোকান  স্থানান্তরিত করা হয় ১৯২২ সালে একই এলাকার ১২ রু দ্য লদেয়ঁ (Rue de L’Odéon)-তে। সিলভিয়ার বইবিপণি ছিল বহু যশপ্রার্থী লেখকের সমবেত হবার স্থান। এজরা পাউন্ড, হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস, দজুনা বার্নেস, ফোর্ড মাডক্স ফোর্ড প্রমুখ। ১৯৪১ সালে নাজি অধিকৃত প্যারিস। দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। হিটলার বাহিনী প্যারিস থেকে বিতাড়িত হবার পরে আর খোলা হয়নি দোকান। দ্বিতীয় বইয়ের দোকান পাঁচ এলাকার ৩৭ রু দ্য লা বুশরি (Rue de la Bûcherie)। ইতিহাসের গন্ধমাখা বই এবং বইয়ের দোকান। ফেলে আসা সময়ের দলিল। দোকানের জন্মদাত্রীও কিংবদন্তি পর্যায়ে। প্যারিস শহরের দশটি দ্রষ্টব্য স্থানের তালিকায় আছে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি। যুদ্ধের সংকট, অনিশ্চয়তা, কালের উপেক্ষা, সময়ের হিমকে অগ্রাহ্য করে টিকে আছে মানুষের অমৃত সঙ্গ এই বিপণি।

সিলভিয়া বিচের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১৪ মার্চ মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে। আসল নাম ন্যান্সি উডব্রিজ বিচ। বাবা ছিলেন প্রিন্সটনের গির্জার ধর্মযাজক। ১৯০১ সালে তাঁর বাবা প্যারিসের আমেরিকান গির্জার যাজক পদসহ আমেরিকান স্টুডেন্ট সেন্টারের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। কৈশোরে পরিবারের সঙ্গে প্যারিস ছিলেন সিলভিয়া (১৯০২-১৯০৫)। নিউজার্সি ফিরে যান ১৯০৬ সালে। ২১ বছর বয়সে ইউরোপভ্রমণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার চেয়ে ভ্রমণে অর্জন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। দু-বছর স্পেন এবং এক বছর সার্বিয়াতে আমেরিকান রেড ক্রসের সঙ্গে কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবকরূপে। যুদ্ধশেষে প্যারিসে ফিরে আসেন কনটেম্পোরারি ফরাসি সাহিত্য পড়তে।

লাইব্রেরিতে পড়ার সময় ফরাসি সাহিত্য জার্নালে লেন্ডিং লাইব্রেরি এবং বইয়ের দোকান ‘La Maison les Amis des Livre’ সম্পর্কে অবগত হন। অল্পবয়স থেকে ছিলেন গ্রন্থভূক বা বিবলিওফিলিক (Bibliophilic)। মনের গভীরে স্বপ্নবীজ নিউইয়র্ক বা লন্ডনে বইয়ের দোকান খোলার। প্যারিসে আদ্রিয়েন মনিয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর পরিকল্পনার পরিবর্তন। ‘La Maison des Amis des Livre’ বইবিতানের কর্ণধার মনিয়ের। ফ্রান্সে গ্রন্থবিতানের প্রথম মহিলা প্রতিষ্ঠাতা। সিলভিয়া মনিয়েরের ল্যান্ডিং লাইব্রেরির সভ্য হন; নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন সাহিত্য আসরে। নিউইয়র্কে বইয়ের দোকানের শাখা খোলার ইচ্ছে অপূর্ণ থাকে আর্থিক সংকটে। পরিবর্তে প্যারিসে স্বপ্ন পূরণ করেন। বইবিপণির নাম শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি। আদ্রিয়েন দোকান খোলার চার বছর পর শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির জন্ম। সিলভিয়া এবং আদ্রিয়েন এই সমপ্রেমী জুটির সম্পর্ক অটুট ছিল দীর্ঘ ছত্রিশ বছর। ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন ঘুমের ওষুধ খেয়ে আদ্রিয়েনের আত্মহত্যার পূর্ব পর্যন্ত।

প্রকাশক হিসেবে অভিজ্ঞতা ছিল না সিলভিয়ার। ১৯২২ সালে প্যারিসে ইউলিসিস প্রকাশ এখন সাহিত্যের ইতিহাস। ফরাসি কবি অঁদ্রে স্পির বাড়ির ডিনার পার্টিতে আলাপ জয়েসের সঙ্গে সিলভিয়ার ১৯২০ সালের জুলাই মাসে। তারপরই জয়েসের সিলভিয়ার ল্যান্ডিং লাইব্রেরিতে পদার্পণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী জয়েসের লেখা মোটা বই ইংল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডের কোনো প্রকাশকই ছাপতে সম্মত হয়নি। ‘অশ্লীল বই’ তকমা সেঁটে। সিলভিয়া বিচ সেটা প্রকাশ করলেন জয়েসের চল্লিশতম জন্মদিনে। মাত্র এক হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। হেমিংওয়ের প্রথম বই থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস (Three Stories & Ten Poems) বিক্রির জন্য ছিল দোকানে। ১৯২১ সালের মে মাসে স্থানবদল। বইয়ের দোকানের নতুন ঠিকানা ২২ রু দ্য লদেয়ঁ (Rue de L’Odéon); আদ্রিয়েনের বিপণির উলটোদিকের রাস্তায়। ইউলিসিস প্রকাশের কল্যাণে দোকানের যথেষ্ট সুখ্যাতি। ১৯৩০ সাল নাগাদ আমেরিকার এক্সপ্রেস বা ট্যুর বাসগুলোর পর্যটকদের ভ্রমণতালিকায় দর্শনীয় স্থান ছিল এই বইয়ের দোকান। তিরিশের দশকে অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ১৯২৯ সালে পৃথিবীখ্যাত ওয়ালস্ট্রিটের ঘটনাবলি। শেয়ারবাজারে ধস, অর্থনৈতিক ডিপ্রেশন, বিশ্বব্যাপী মহামন্দায় স্বল্পসংখ্যক দেশত্যাগী প্যারিসে। অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে প্যারিসের স্বজন-বন্ধুরা মৈত্রীর হাত বাড়ালেন। অঁদ্রে জিদ শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির বন্ধুসভা করলেন। ছোট বইয়ের দোকান বলে সভ্যসংখ্যা সীমিত রইল দুশোজনে। সিলভিয়ার ছিল নিজস্ব প্রিয়তর বন্ধুবলয়। সমকালের শক্তিশালী অনেক কণ্ঠস্বর পাঠ-আসরে অংশগ্রহণ করেছেন। অঁদ্রে জিদ, পল ভ্যালেরি, টিএস এলিয়ট, এমনকি হেমিংওয়েও। তিনি সমাবেশে পাঠ করতেন না। শর্ত দিলেন স্টিফেন স্পেন্ডার যদি পড়েন। এলিয়টের বন্ধু স্পেন্ডার সম্মত হলে এই দুর্লভ পাঠ-আসরে অংশগ্রহণ করেন হেমিংওয়ে।

বইবিপণি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সিলভিয়া ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে। নাজিদের দখলে শহর। এক জার্মান সেনা অফিসার জেমস জয়েসের বিচিত্র ভাষা ও ভঙ্গিমায় লেখা ফিনেগানস ওয়েক চাইলেন। একটি মাত্র কপি থাকায় সিলভিয়া রাজি হলেন না। বিরক্ত জার্মান অফিসার চলে যাবার আগে বলেন, তিনি বিকেলে এসে দোকানের সমস্ত জিনিস বাজেয়াপ্ত করে দোকান বন্ধ করে দেবেন। সিলভিয়া সমস্ত বইপত্র ও অন্যান্য জিনিস লাইব্রেরির ওপরতলার একটি খালি অ্যাপার্টমেন্টে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সিলভিয়াকে ছয় মাস আটক রাখা হয় ভিতলে (Vittle)। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকান শিল্পসংগ্রাহক ও শিল্পব্যবসায়ী টুডোর উইলকিনসন (Tudor Wilkinson)-এর সহযোগিতায় তিনি মুক্তি লাভ করেন।

যুদ্ধশেষে ১৯৪৪ সালে হেমিংওয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দোকানের দ্বার উন্মুক্ত করেন। কিন্তু ব্যবসায়িক লক্ষ্যে বইয়ের দোকানটি আর আলোর মুখ দেখেনি। প্যারিসের সাহিত্যজগতে এখনো প্রণম্য সিলভিয়া বিচ। বাস করতেন দোকানের ওপরতলার অ্যাপার্টমেন্টে। ১৯৬২ সালে নিজ বাসভবনে মারা যান। সমাহিত হন প্রিন্সটনে। পল ভ্যালেরি এবং অঁরি মিশোর কবিতা অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন স্মৃতিকথা শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথায় আছে নিজের শৈশব থেকে আন্তঃযুদ্ধের সময়কালীন প্যারিসের সংস্কৃতি, জীবন ও পরিবেশের কাহিনি। সমসময়ের প্রামাণ্য নথি। হেমিংওয়ে বক্সিং রিং থেকে ফেরার পথে বই নিয়ে যেতেন, জয়েস দুপুরের আগে দোকানে আসতেন না, টাকা ধার নিতে। দীর্ঘকায় গারত্রুদ স্টেইনের সঙ্গী সাদা কুকুর শাবক, ফায়ার প্লেসের কাছে বসে সুন্দরী দজুনা বারনেস নিজের লেখা উপন্যাস নিয়ে টিএস এলিয়টের সঙ্গে কথা বলছেন। রোদে বসে পড়তেন ফিৎজারল্যান্ড। দুনিয়া জুড়ে সৃজনসুখ হন্যে মানুষের অনাবিল চারণভূমি শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি। অনির্বাণ উত্তাপে মুখর। দোকানের আরেকটি নাম ছিল জেমস জয়েসের দেওয়া স্ট্রাটফোর্ড-অন-ওদেয়ঁ (Stratford-on-Odeon)। জয়েসও তাঁর সব কাজকর্ম করতেন দোকানে। এই কল্লোলমুখর সৃজনকালের কথা লেখা আছে হেমিংওয়ের A Moveable feast বইতে। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় নিষিদ্ধ বই সিলভিয়ার দোকানে কেনা বা পড়ার জন্য ধার নেওয়া যেত।  ডিএইচ লরেন্সের বিতর্কিত বই লেডি চাটারলি’স লাভার (Lady Chatterley’s Lover)-ও ছিল দোকানের সংগ্রহে।

দ্বিতীয় ইংরেজি বইয়ের দোকান প্যারিসের পাঁচ এলাকায় – ‘লো মিস্ত্রাল’ (Le Mistral)। ১৯৫১ সালে আমেরিকান জর্জ হুইটম্যান দোকানের গোড়াপত্তন করেন। কয়েকশো গজ দূরে সেইন নদীর চলিষ্ণু জলপ্রবাহ, নতরদাম গির্জা নদীর ওপারে আর দোকানের বিপরীত দিকের রাস্তার পাশে ছোট ছোট খুপরি। পুরনো বই-পোস্টার বিক্রি হয়। ‘লো মিস্ত্রাল’ পরে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’ নতুন নামে অভিষিক্ত হয়। সম্ভবত বইবিপণন জগতের সবচাইতে বিখ্যাত স্বতন্ত্র বইবিপণি।

জর্জ হুইটম্যানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নিউজার্সিতে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে ম্যাসাচুসেটসের সালেস শহরে। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক বাবা ওয়াল্টার হুইটম্যান চীনের নানজিং (পরে মানকিং) বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-বছরের জন্য শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পেলে সপরিবারের নানজিং যান। উনিশ বছর বয়সী জর্জের শৈশব ও যৌবনের উন্মেষের দিনগুলো কাটে বইজগতের উষ্ণ সাহচর্যে। আকর্ষণ ছিল দূরপ্রাচ্যর, বিশেষ করে চীন দেশের, প্রতি। ১৯৩৫ সালে বসন্তে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম মহাসমরের দামামা স্তিমিত হলেও সমাজ-অর্থনীতিতে তার তামসিক ছায়া। কাজ পাওয়া ছিল দুরূহ। সংবেদী মন ভিন্ন কিছু করার আকাক্সক্ষায় ওয়াশিংটনে সহকারী রিপোর্টারের চাকরি নেন। পুত্রের বিবেচনায় প্রীত মা গ্রাস। সে-বছরই জুলাইতে একুশ বছর বয়সে সুদূরপিয়াসী তরুণ বিশ্বদর্শনে বেরিয়ে পড়েন। দু-চোখে নিখিল বিশ্বের মানচিত্র; পরিব্রাজক পা, মন চঞ্চল অজানার টানে। জর্জের ভাষায় ‘Hobo adventure’। হিচ হাইকিং, হেঁটে ট্রেনে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ। যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পেটের পীড়ায়। জনমানবহীন ইউকাতান জঙ্গলে। দুর্ভেদ্য বনে হেঁটেছেন বাধ্য হয়ে; খাদ্য-পানীয়র অভাব। দেখা পান মায়ানদের একটি উপজাতির। তাদের শুশ্রƒষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। দারিদ্র্য, ক্লেশদীর্ণ, কল্যাণমুখী মানুষগুলোর মাঝে দেখেছিলেন বন্ধুত্ব ও উদারতার এক বিস্তীর্ণ নভোলোক। পরবর্তী জীবনে এই নিঃশর্ত সহমর্মিতার ঘটনা হয়ে ওঠে জীবনের মৌলিক দর্শন : ‘give what you can, take what you need’।

১৯৪১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীতে নিবন্ধনের পাশে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিন আমেরিকান স্টাডিজ অধ্যয়ন ১৯৪২ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। সেনাবাহিনীর ডাকে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করেন চার বছর। পরে ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট জাহাজে সমুদ্রযাত্রা। গন্তব্য প্যারিস। যুদ্ধে অনাথ শিশুদের ক্যাম্পে কাজের ইচ্ছা। কিন্তু প্যারিস পৌঁছে জানতে পারেন ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে।

নতুন চিন্তার রাজধানী প্যারিস। ভর্তি হন সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি এবং সাইকোলজি অধ্যয়নে। থাকতেন সিতে ইউনিভার্সিটির আবাসিক ভবনে। সুফি সংস্কৃতির উদারমনস্ক ধ্যান-নিবিড় ভাব ছিল জর্জের। বইয়ের দোকানেও লেখা আছে বইপ্রেমী জর্জের নিজস্ব বন্দিশ –

Be not inhospitable to strangers

Lest they be angle in disguise.

বান্ধবী জিসেলকে নিয়ে প্রথম একটি ল্যান্ডিং লাইব্রেরি খোলেন ’৪৭ সালের জুন মাসে। নিজের সংগ্রহের গ্রন্থসমূহ দিয়ে। নাম ‘লাইব্রেরি ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান’। প্যারিস আট এলাকার বুলভার্ড কুরসেল-এ। ১৯৪৮ সালের পর জর্জের আবাসস্থল ছিল হোটেল সুয়েজ। ঘরের নম্বর সাত। উত্তরে অনতিদূরে প্রবাহিত সেইন নদী। সুয়েজে থাকার দিনগুলোর স্মৃতির রোজনামচা : ‘ইন্দোচীন, আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র এবং গোটা বিশ্বের অক্ষাংশ। মনে হচ্ছে আমি সভ্যতার হৃদয়ে। ফ্রান্স ছাড়া আর কোনো দেশ নয়, প্যারিস ছাড়া আর কোনো শহর নয়, বুলভার্ড সাঁ মিশেল ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নয়, সুয়েজ ছাড়া অন্য কোনো হোটেল নয়, সাত নম্বর ঘর ছাড়া সুয়েজের অন্য কোনো ঘর নয়।’ 

১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট জর্জ নিজের বইয়ের দোকান কেনেন। ঠিকানা ৩৭ রু দ্য লা বুশেরি (Rue de la Bûcherie)। বিদ্যুৎবিহীন খুব সাধারণ, শ্রীহীন সংকীর্ণ পরিসর। নিচতলায় রেলের বগির মতো পরপর তিনটে ঘর। পনেরো ফুটের বেশি প্রশস্ত নয়। ঘরে একটি মাত্র জানালা দিয়ে দৃশ্যমান অদূরে সেইন নদীর ওপারে গথিক স্থাপত্যের নতরদাম ক্যাথিড্রাল। দোকানের পেছনে পাথুরে রাস্তা, মধ্যযুগীয় মনুমেন্টসমৃদ্ধ কারতিয়ে লাঁতা (Latin) বা ল্যাটিন কোয়ার্টার। দুই মহাসমরশেষে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কালপর্ব। চেনা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলাতে থাকে দ্রুত। পঞ্চাশের দশকে অর্থ উপার্জনের পথ কঠিন হয়ে পড়েছিল। অনিশ্চয়তায় ডোবা ব্যক্তিজীবন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জটিল ঘূর্ণি ফ্রান্সেও। অসংখ্য দোকান তখন বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল। আত্মার অবিনাশী স্বপ্ন পূরণে জর্জ হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন উপযুক্ত স্থান বইবিতানের জন্য।

’৫১ সালের জুলাই মাস। বাসার কাছে পার্কে বই পড়ার সময় আলাপ হয় আলজেরিয়ার মুদিদোকানির সঙ্গে। ব্যবসায়িক মন্দায় দোকান বিক্রি করে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাবেন। দোকানের বিক্রয়মূল্য পাঁচশো ডলার। ব্যবহার-অযোগ্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল ১৮৭০ সালে নির্মিত ভবনটিকে। ফলে ভবনের দোকানঘর ক্রয়ে জর্জ দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে আরো কয়েক দশক বসবাসের যোগ্য ভেবে কেনার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধোত্তর লগ্ন বিড়ম্বিত কাল দিশেহারা সময়। বিশেষ করে ল্যাটিন কোয়ার্টার এলাকার মলিন দশা। রাস্তার দু-পাশে ঘনবসতি, থিয়েটার, সং, প্রতারক, জৌলুসহীন সস্তা হোটেল, ছোট ধোপাখানা, সুই-সুতোর দোকান। আবর্জনার ভাগাড় গলির সর্বত্র।

ল্যাটিন কোয়ার্টার নামের উৎপত্তি মধ্যযুগে ল্যাটিন শব্দ থেকে। বারো শতকের পর দার্শনিক পিয়ের আবেলা এবং তাঁর ছাত্ররা এই তল্লাটে থাকতেন। ল্যাটিন ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আশেপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। অনতিদূরে প্যারিসের পুরনো গির্জা। তেরো শতাব্দীতে নির্মিত। গির্জার সামনে প্যারিসের সবচাইতে প্রাচীন বৃক্ষ; রোপণ করা হয়েছিল ১৬০১ সালে। একই বছর বইয়ের ভবনটি নির্মাণ করা হয়। পঞ্চাশের দশকে ল্যাটিন কোয়ার্টার ছাত্রদের পদচারণায় মুখর থাকত। ছাত্রদের অধিকাংশই থাকতেন স্বল্প দামের তারকাচিহ্নহীন হোটেলে। পাশের এলাকা শ্রমজীবীদের বাসস্থান। লেখক শিল্পী, সমকামী, সংগীতশিল্পী, ড্রাগসেবনকারী পরিকীর্ণ পরিবেশ।

স্মৃতির সহায়ক, জ্ঞানের উৎস বই। জর্জের গোটা জীবনের মুগ্ধ সঞ্চয় বই। ব্যক্তিগত সংগ্রহের এক হাজার বই নিয়ে দোকানের দ্বার উন্মোচন করেন। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মী হিসেবে জিআই (GI) ভাতা পেতেন। ১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা প্রাক্তন সেনাসদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য এই বিলে স্বাক্ষর করেন। প্রাক্তনীদের জন্য পড়াশোনা, বাড়ি, রেশনের খাবার ভাতা ছাড়াও বই কেনার জন্য ভাউচার পেতেন। ‘লো মিস্ত্রাল’ (Le Mistral) জর্জের দোকানের নাম। প্রাক্তন প্রেমিকা না, ভূমধ্যসাগরীয় বাতাস না, চিলির কবি গাব্রিয়েল মিস্ত্রালের স্মরণে এই নামকরণ। এ-বিষয়ে জর্জ রহস্যময় নীরবতা পালন করেছেন, কৌতূহলী সাংবাদিকদের প্রশ্নে। বইবিপণি খোলার দু-মাস পর বোন মারিকে চিঠি লিখেন :

সকালে আমার ঘুম ভাঙে মুখের ওপর পড়া সূর্যের আলোতে এবং সা-জুলিয়েন-লো পভ্র বাগানের গাছের শীর্ষে ভাসমান চিমনির পটগুলো দেখে। রাতে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি নতরদাম গির্জার আলোকসজ্জিত চূড়াগুলো। এই বইয়ের দোকান, যার স্বপ্ন দেখেছি সবসময়।

তিন ঘরের দোকান। দূরের ঘরটির পরিসর পড়ার উপযোগী করেছেন। পুরনো ধোঁয়াটে ঘরের নাম দিয়েছেন হোটেল দ্য সুয়েজ। সম্ভবত এ-কারণেই যে, এ-ঘরটিতে জানালা নেই। আছেন অসংখ্য ধূমপায়ী। জর্জ নিজেই একনিষ্ঠ ধূমপায়ী। সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডির ছাত্র লরেন্স ফেরলিংয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৪৬ সালে সুয়েজে, পরে তিনি বিখ্যাত হয়েছিল লরেন্স ফেরলিংঘেটি নামে, সানফ্রান্সিসকোর বইবিপণি সিটি লাইটস (City Lights)-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। Howl ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থের প্রকাশক। আমেরিকার বিখ্যাত কবিদের একজন অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেটি সাহিত্যের এক একজন অ্যানার্কিস্ট। তাঁরা শুধু কবিতাকে আমূল পরিবর্তন (রেভলিউলানাইজ) করেননি, সামাজিক ধারণাও পালটে দিয়েছেন। জর্জের বোন মারি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী। লরেন্সের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তাঁর কাছেই শুনেছেন জর্জ সম্পর্কে। লরেন্সের মনে হয়েছে, কোলরিজের ‘রাইম অব এনশিয়েন্ট মেরিনা’ কবিতার সেই প্রাচীন নাবিকের কথা। যার গলায় ঝুলেছিল আলবাট্রস পাখি অভিশাপ হয়ে। রোমান্টিক, খেয়ালি, ভ্রমণপিপাসু জর্জ, অনিবারণীয় ঘোরে তিনিও বহন করে চলেছেন সেই অভিশাপ। জর্জের বোঝা বই। হোটেল দ্য সুয়েজের জানালাবিহীন গ্রন্থোষ্ণ ঘরটিতে ছাদ ছুঁয়ে যাওয়া বইয়ের তাক। নির্জন নীরব বইয়ের জ্যোর্তিময় ভুবনে মগ্ন জর্জকে দেখে লরেন্সের উপলব্ধি – জেমস জয়েসের এ পোর্ট্রেট অফ দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ংম্যান (A Portrait of the Artist as a young man) বইয়ের গ্রন্থোন্মাদ, গ্রন্থপ্রেমী স্টেফান দেদালাসের প্রেতাত্মা।

বই দিয়ে গড়েছিলেন স্বর্গ। জর্জকে তখনই লরেন্সের মনে হয়েছে মিস্ত্রাল বিবলিওম্যানিয়া – ‘গ্রন্থকীট। গ্রন্থ সংগ্রহের বাতিক।’

দোকানের মাঝের ঘরের দেয়ালের রং সোনালি, যদিও নাম দেওয়া হয়েছে নীল ঝিনুক চা-ঘর (Blue Oyster tearoom), আছে সোফা-বেড। জর্জের ঘুমাবার শয্যা। পরে জায়গাটা বরাদ্দ হয় লেখক-শিল্পীদের জন্য। আমেরিকা, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ভ্রমণকালে আতিথেয়তা পেয়েছেন। উপলব্ধি করেছেন মানুষ ও সংস্কৃতির সংযোগ, সম্পর্কের খতিয়ান। প্রভাবসঞ্চারী সেই অভিজ্ঞতা; তার মধ্যে ঘটে গভীর বোধের জাগরণ। ভূগোল, নৃতত্ত্বের ইতিহাসের ঊর্ধ্বে মানুষের বিশ্বাস। চরিত্রের ঔদার্য্যে এক অনিবার্য দার্শনিক জর্জের ছিল এক মরমিয়া দর্শন। বিশ্বাস করতেন, ‘আমরা সবাই বাস্তুহারা। ‘I believe we’re all homeless in a way’।

জর্জ অতিথিদের বলতেন ‘টাম্বলউইডস’ (Tumble weeds)। উত্তর আমেরিকার মরু অঞ্চলের এক প্রকার বৃক্ষ টাম্বলউইডস। রাত কাটাতে পারেন টাম্বলউইডসরা এই অতিথিশালায়। শয্যা বা মেঝেতে থাকার বিনিময়ে দোকানের কাজে মাঝে মধ্যে সাহায্য করা। অতিথি সংখ্যা বেড়ে গেলে ১৯৫২ সাল নাগাদ জর্জ নিজের এবং পোষ্য পুকুরের জন্য দোকানের কাছেই ছোট্ট ঘর ভাড়া নেন। দোকানের সামনের ঘর থেকে দৃশ্যমান নতরদাম গির্জা, ছোট্ট স্টোভের চুলায় রান্না, বিদ্যুৎবিহীন ঘরে ডিনার খেতেন মোমবাতির আলোয়। ক্যান্ডল লাইট ডিনার! চতুর্দিকে বই; কিছু বই বিক্রির জন্য, কিছু বই গ্রাহক হয়ে পড়ার জন্য। নামমাত্র ফ্রাঁ মূল্য। যদিও জর্জ প্রায়ই লেখক, শিল্পী, ছাত্রদের বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দিতেন। দোকানে আগতদের অনেকেরই ছিল সীমিত সামর্থ্য। প্রাথমিক চাহিদা খাদ্য, বাসভাড়া, সিগারেট ক্রয় ছাড়া অন্য কোনো ব্যয় বহনের উপায় ছিল না। উন্মুক্ত, অনুসন্ধানী জর্জের সত্তা পূর্ণ ছিল মানবিকতার স্নিগ্ধ সৌরভে। বিনা দক্ষিণায় দোকানে আশ্রমিক হিসেবে থাকা, বই পড়া বা লেখার কাজ করতে বা শুধুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন অনেকেই। জড়তাহীন, স্বাচ্ছন্দে মুক্তসঞ্চরণ ছিল তাঁদের গ্রন্থযাপন।

কোনোদিন প্রত্যাশিত অংকের বই বিক্রি না হলে দোকান বন্ধ করে চলে যেতেন। সঙ্গী আমেরিকায় নিষিদ্ধ হেনরি মিলারের একগুচ্ছ বই। ১৯৫২ সালের বসন্তে মারলিন (Merlin) জার্নালের আত্মপ্রকাশ। উদ্যোগী একদল আঁভাগার্দ বোহেমিয়ান। প্রকাশক আলিস জান লগি, সম্পাদকমণ্ডলী আলেকজান্ডার ট্রসি, ক্রিস্টোফার লগ এবং রিচার্ড শিভার ছিলেন অন্যান্যদের মধ্যে। একদল মুক্তবিহঙ্গ (Hobo), ছিলেন প্রকৃত সৃজনশীল। ব্যাংকার বাবার দেওয়া কিছু অর্থ পেতেন জান, সে-অর্থ দিতেন প্রেমিক ট্রেসিকে; মারলিন প্রকাশনার জন্য। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে জান দোকানের মেঝে পরিষ্কার করতেন। পত্রিকার কাজও হতো দোকানেই। মাঝে মধ্যে দোকানে পাঠ-আসর করতেন। মারলিন পত্রিকায় – জঁ জেনে, ইউজেন আয়নেস্কো,  জঁ পল সার্ত্রের লেখাসহ সেই সময়ে স্বল্পপরিচিত স্যামুয়েল বেকেটের লেখা প্রকাশ করেছে।

অভিনব যাত্রিক জর্জের নৈতিক আনুগত্য ছিল ভাববিনিময়ে, প্রত্যক্ষভাবে জীবন পর্যবেক্ষণে :

My philosophy is sharing, my love is

literature, my home, like minded company.

মুক্তচিন্তা ও বৌদ্ধিক সততার প্রতি দায়বদ্ধ,জর্জ কর্মময় দিনযাপন করেছেন। লেখক-শিল্পীদের ওয়ার্কশপ, আলোচনা ছাড়াও ছিল শিক্ষার বিশেষ সান্ধ্যকালীন ক্লাস। বুধবার সন্ধ্যায় রাশিয়ান ভাষা এবং ইতালিয়ান ভাষা শিক্ষার ক্লাস। থাকত সোশিও সাইকোলজিক্যাল রিসার্চ সেমিনার প্রকল্প।

বইয়ের ভুবন হয়ে উঠল বিশ্বের দর্পণ। জর্জের মেধাবী মনন লক্ষ্মীর আরাধনার চেয়ে সরস্বতীর বন্দনা করেছে। বইপাগল পাঠককে সাদরে গ্রহণ করে কফি পরিবেশন করেছেন। অচেনা আগন্তুক ইংরেজ তরুণী, ভিয়েনার চিকিৎসক, স্থপতি, দক্ষিণ আফ্রিকার অভিবাসী বা ল্যাটিন আমেরিকার কবি – সবার জন্য উন্মুক্ত বিপণি। মধ্য পঞ্চাশে গ্রন্থের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর দোকানের ওপরতলার অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নেন। বিদ্যুৎও সংযোজিত হয়েছে। নতুন জায়গা বরাদ্দ শুধু ল্যান্ডিং লাইব্রেরির জন্য। প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং শিল্পীদের পদচারণায় মুখর পরিবেশ : জুলিও করতাজার, রিচার্ড রাইট, উইলিয়াম সারোইয়ান, তেরি সাউথার্ন এবং উইলিয়াম স্টিরন ছাড়াও থাকতেন দ্য প্যারিস রিভিউ (The Paris Review) পত্রিকার পিটার মাতিয়েসেন, রবার্ট সিলভার এবং জর্জ প্লিমটনের মতো বিদগ্ধজন। জর্জের উদ্যোগকে সম্মান করেছেন, তাঁর মুক্তচিন্তার উদ্ভাসকে মান্যতা দিয়েছেন। তাঁদের সান্নিধ্যধন্য জর্জও। ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে জর্জের গ্রন্থযাপন। আফ্রো-আমেরিকান লেখকরা যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নিপীড়নে দেশত্যাগ করে প্যারিসে শরণার্থী। তাঁদের প্রাণবন্ত মনীষার কিরণ বইবিপনিকে আলোকিত করেছে। লেখক রিচার্ড রাইটের প্যারিসের জাতিবিদ্বেষহীন পরিবেশ মনে হতো অবাস্তব। সর্বোপরি প্যারিস তাঁর কাছে মনে হয়েছে উদার, মানবিক, অমায়িক।  জঁ পল সার্ত্রসহ ফরাসি সাহিত্যজগতের সৃষ্টিশীল নক্ষত্ররা রাইটকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। সিলভিয়া বিচের সহৃদয় সহযোগিতাও পেয়েছেন। জর্জের দোকানে রাইটের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও থাকতেন, খুব অতিথিবৎসল সিলভিয়া। ছিলেন দোকানের অন্যান্য ক্রেতাও। লেখক রাইট তাঁকে বলতেন, প্যারিসে তিনি আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম জননী।

পশ্চিমী দুনিয়ার সব বুদ্ধিজীবী সৃজনপ্রয়াসী পদার্পণ করেছেন দোকানে। ইতিহাসের দুরবিনে চোখ রেখে দেখা যায় দিকপাল লেখকসহ নবীন শিক্ষার্থীদের। লরেন্স ডারেল-এর দি আলেকজান্দ্রিয়া করেতেত উপন্যাসের প্রথম খণ্ড জাস্টিন (Justine); গ্রন্থের স্বাক্ষর লগ্ন হয়েছিল দোকানে ১৯৫৭ সালে। এই বছরেই প্যারিসে বিটদের আগমন। বিট জেনারেশন বা বিটনিক কবি, শিল্পী, গায়করা সব রকমের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছিলেন। এলিট ঐতিহ্য নস্যাৎ করে অনাড়ম্বর জীবনযাপনে বিশ্বাসী বিটনিকরা। নিজেদের ভাবাদর্শে, সংস্কৃতির উত্তেজক প্রবাহে অবগাহন করেছেন। প্যারিসে বিটদের আগমন ১৯৫৭ সালে; প্রথম গ্রেগরি করসো, পরে অ্যালেন গিন্সবার্গ, পিটার অরলভস্কি এবং উইলিয়াম বারোজ। থাকতেন বইয়ের দোকান থেকে কয়েক রাস্তা দূরে বেনামি সস্তা হোটেলে। মালকিন মাদাম রাসু লেখক-শিল্পীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। অনেক সময় অর্থাভাব হলে তারা শিল্পকর্মের বিনিময়ে পরিশোধ করতেন। হোটেলের অতিথিরা প্রকাশ্যে সমকাম উদ্যাপন (যা তখন নিষিদ্ধ ছিল), ড্রাগ, মদপান, রাতের পার্টি করতেন অনায়াসে। বাঁধনছাড়া এলোমেলো বিন্যাসের জীবন। প্রচল ভেঙে বেরিয়ে আসা মেধার বিকিরণ, বৈদগ্ধ্যদের মাতলামির উত্তাপে মুখর থাকত রাতের সরণি।

করসো দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন জর্জের দোকানে। লেখাপড়া আর অবসরে আড্ডায়। বারোজ থাকতেন নিয়মিত রবিবার বিকালের চায়ের আসরে। উপন্যাস ন্যাকেড লাঞ্চ (Naked Lunch) পরিমার্জনার সময় মাঝে মধ্যে দোকানের মেডিক্যাল সেকশনের গ্রন্থ থেকে তথ্য নিতেন। ১৯৫৯ সালে প্যারিসের অলিম্পিয়া প্রেস থেকে পেপারব্যাক প্রকাশ করেন মরিস জিরোডিয়া ন্যাকেড লাঞ্চের (Naked Lunch)। গিন্সবার্গের হাউল অ্যান্ড আদার পোয়েমস (Howl and other Poems) প্রকাশিত হয় লরেন্স ফেরলিংঘেটির প্রকাশনা সংস্থা সিটি লাইটস (City lights) থেকে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল বইটি। শোনা যায়, কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। বই প্রকাশের পর অশ্লীলতার অপরাধে ফেরলিংঘেটিকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারক রায় দেন, কবিতাগুলো অশ্লীল নয়। বহুল আলোচিত এবং আলোড়িত এই ঘটনায় তিরিশ বছর বয়সী কবি রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছেন। গিন্সবার্গ কাডিসও লেখা শুরু করেন প্যারিসেই। হাউল কাব্যগ্রন্থের পাবলিক রিডিং হয় শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং বইবিতানেই। করসোসহ আরো কয়েকজন কবির কবিতাপাঠ আসর হয়েছিল ১৯৫৮ সালের ১৩ এপ্রিল। অনুষ্ঠানের প্রচারপত্র বিলি করা, দেয়ালে লাগানোর সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছেন অরলোভস্কি। দোকানের নিচতলাসহ সামনের খোলা প্রাঙ্গণ পূর্ণ লোকসমাবেশ। এই পাঠ-আসর সম্পর্কে বলেছিলেন গিন্সবার্গ হ্যারাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার কলামিস্ট আর্থার বুচওয়াল্ডকে। আসরে প্রথম পাঠ করা কবিতা ছিল সাদামাটা আবেদনহীন। অনেকেরই ভালো লাগেনি। করসো পাঠের সময় বলেন : ‘I protested it wasn’t real poetry. Someone asked me what I meant by real poetry. So I took off all my clothes and read my poems naked …’। সঙ্গে দেহরক্ষী হিসেবে তাঁর দুজন শ্মশ্রুমণ্ডিত বন্ধুর উল্লেখ করে সতর্ক করে দেন, কবিতা পড়ার সময় কেউ আসর ত্যাগ করতে চাইলে তাকে দৈহিকভাবে হেনস্থা করা হবে।

পরে গিন্সবার্গও নগ্ন হয়ে কবিতা পড়েন। তবে তিনি কিছুটা মাতালও ছিলেন। গায়ক, গীতিকার রামলিন জ্যাক এলিয়ট সংগীত পরিবেশনের পর সদ্য প্রকাশিত জ্যাক কেরুয়াকের উপন্যাস On the Road থেকে পড়েন। বারোজ প্রথম পাঠ আসরে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে সম্মুখ সারিতে বসা লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক এক তরুণকে দেখে মুগ্ধ আবেশে প্রথমবারের মতো পাঠ করলেন অপ্রকাশিত ন্যাকেড লাঞ্চ থেকে। এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে জর্জের কথা … ‘কেউ বুঝতে পারছিলেন না হাসবে, না অসুস্থ হবে। অসাধারণ কিছু ছিল।’

একই বছর আগস্টে আসেন জেমস জোনস স্ত্রী গ্লোরিয়াকে নিয়ে। জনের সাহিত্যিক খ্যাতি তুঙ্গে। সাহিত্যজগতের নক্ষত্র। উপন্যাস From here to Eternity  ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। চলচ্চিত্রায়নও হয়েছে উপন্যাসের।  জর্জ তাঁদেরও উষ্ণ অভ্যর্থনা দেন। ডিনার পার্টি ছিল বইয়ের দোকানে। সিলভিয়া বিচ ডিনার পার্টিতে ছিলেন, ছিলেন জয়েস গবেষক ক্লিভ হার্ট (পরে তিনি জেমস জয়েস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি হয়েছিলেন)। হার্টের ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণের স্মৃতিচারণ : পার্টিতে সিলভিয়া সংক্ষিপ্ত ঘোষণায় জানান, তিনি জর্জকে পুরনো শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি  নামটি দিতে চান। বলাই বাহুল্য জর্জ উল্লসিত। যদিও জর্জের দোকানের নাম পরবর্তী ছয় বছর অপরিবর্তিত ছিল। সিলভিয়ার শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি – রাইটার্স গেস্ট হাউস’  খচিত তামার ফলকটি দোকানের সামনের জানালায় প্রদর্শনের জন্য রাখা ছিল। শেক্সপিয়র কোম্পানির প্রকাশনা ইউলিসিসের একটি মূল সংস্করণও পাশে রাখা হয়েছিল। সিলভিয়া ভাবতেন, এই বইয়ের দোকান তাঁর নিজের ‘আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি’ (Spiritual Successor)।

একুশ বছরের তরুণ ইয়ান সমারভিল ক্যামব্রিজে গণিতের ছাত্র, গ্রীষ্মকালীন টাম্বলউইড। দোকানের দোতলার লাইব্রেরিতে পড়ছিলেন। তাক থেকে একটি বই তাঁর মাথার ওপর পড়ে। বইটা ছিল ন্যাকেড লাঞ্চ (Naked Lunch)। কয়েকদিন পর একই ঘটনা ঘটে। তবে বিপরীতভাবে। সমারভিল একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে তাকে রাখার সময় বইটি পড়ে নিচে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির মাথায়। ব্যক্তিটি ছিলেন উইলিয়াম বারোজ। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দুজনের প্রেম। সমারভিল পরে ১৯৫৯ সালের এই ঘটনা দোকানের গেস্টবুকে লিখে রেখে গেছেন।

১৯৩০ সালে হেনরি মিলার আমেরিকা থেকে আবার প্যারিসে আসেন। তার আগে ১৯২৮ সালে কয়েক মাস কাটিয়ে গেছেন এই শহরে। তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত গ্রন্থ, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ট্রপিক অব ক্যান্সার লেখার পর্ব চলছে। প্রাক্তন বন্ধু লরেন্স ডারেল তাঁকে বইবিপণিতে নিয়ে আসেন, রাত দুটার সময়। তন্দ্রামগ্ন রাতের শহরে বন্ধুর প্রত্যাবর্তনের আনন্দ উদ্যাপন করেছিলেন ডারেল। নিজেদের বিকশিত করার নির্ভরভূমি জর্জের দোকানে। এক বোতল ওয়াইন পানরত অবস্থায় তাঁদের অনুপমেয় কথাবার্তায়  ঘুম ভাঙে টাম্বেল উইডসের অতিথিদের। গভীর রাতে উদ্দীপিত মিলার বইবিপণির অমৃতসঙ্গে। মিলারের মন্তব্য – ‘গ্রন্থের এক বিস্ময়কর ভুবন।’ অনির্বচনীয় আনন্দে প্লুত রেখেছিল সারাজীবন জর্জকে মিলারের প্রশস্তি।

ষাটের দশকে জর্জের দোকানে বইয়ের সংখ্যা বিশ হাজার। ঘরের মেঝে, কোনায়, তাকে বইয়ের স্তূপ; ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যে-কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাণিজ্যিক মুনাফার প্রত্যাশা ছিল না কখনোই। ফলে সংগ্রহের তালিকায় স্থান পেয়েছে নতুন নতুন বই। রে ব্রাডুবরি, ইটালো ক্যালভিনো, ম্যারি ম্যাকার্থী, আইরিশ মারডক, জে-ডিসালিনজার, ভøাদিমির নবোকভ, জ্যাক কেরুয়াক ছাড়াও ভার্জিনিয়া উলফ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, গারত্রুদ স্টেইন, ক্যাথেরিন আন পোর্টার প্রমুখ শব্দসাধকের গ্রন্থ। ইংরেজি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান, ইতালিয়ান ভাষায় – কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, শিশুতোষ গ্রন্থের অনন্য সংগ্রহ। অপ্রতুল পরিসর, স্থান সংকুলানের জন্য ১৯৬০ সালে দোকানের পাশেই একটি ছোট্ট জায়গা কিনে নেন। দোকান নিয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক জর্জের। এক বন্ধুকে লিখেছিলেন – ‘একটা টি-রুম খুলতে চাই, যেখানে বিকেলে প্লেয়ারে সিম্ফনির আর সন্ধ্যায় বাজবে গিটারের সুর, থাকবে গয়নার প্রপাতের মতো বয়ে যাওয়া একটা ফোয়ারা আর একটা ছোট্ট জলাশয়ে দুটো শিশু সিল। দোকানটি তখনো অনাড়ম্বর এবং অবাণিজ্যিক থাকবে। তবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ বইয়ের দোকান হবে।’

দোকানের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে অভ্যন্তরীণ বিন্যাসের সংস্কার করেছেন। নতুনভাবে সজ্জিত অতিথিশালা এবং নিচতলার প্রসারিত পরিসরের উদ্বোধন উপলক্ষে ধারাবাহিক সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন জর্জ। ১৯৬০ সালের ৭ মে লরেন্স ডারেলের প্রকাশিত নতুন বই ক্লিয়া-র (Clea) স্বাক্ষর-অনুষ্ঠান,  জেমস জনসের পাঠের আসর ১৪ মে এবং ২১ মে গ্রেগরি করসো স্বাক্ষর করেন দি হ্যাপি বার্থডে অফ ডেথ (The happy birthday of death), কবিতা সংগ্রহে। বইবিতানে পাঠকের একজন লেখককে ব্যক্তিগতভাবে দেখার সুযোগ ঘটে স্বাক্ষর-অনুষ্ঠানে; এই মনোরম প্রথা সম্পর্কে লিখেছেন আমেরিকার ঔপন্যাসিক নেলসন আলগ্রেনকে, দার্শনিক-লেখক সিমোন দ্য বোভোয়ার প্রাক্তন সখা। পঞ্চাশের দশকে এই যুগল জর্জের বই দোকানের প্রতিবেশী ছিলেন।

ষাট দশক ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঘটনাবহুল। আমেরিকার মিলিটারি খবরের কাগজ স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস (Stars and Stripes) জর্জের বইয়ের দোকানের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। স্বাভাবিকভাবেই জর্জ আনন্দিত ছিলেন। ১৯৫০ সালে আমেরিকান স্টাইলের গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ অন্যান্য দেশে প্রয়োগের জন্য কৌশলে গোপন প্রচারণা শুরু করে। রাশিয়ার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার অ্যান্টি কমিউনিজম বাতাবরণ হিস্টিরিয়ার রূপ নিয়েছে।  সাম্রাজ্যবাদীদের দুরভিসন্ধি প্রশ্নাতীত। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পশ্চিম ইউরোপীয় সাম্যবাদী ভাবধারায় আস্থাশীল শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীরা। সিআইএ (CIA) সঙ্গোপনে শিল্পীদের এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অর্থ প্রদান করত। উদ্দেশ্য, আমেরিকার সংগীত, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার। ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধে রাজনীতির অনিশ্চিত, সন্দেহজনক আবর্তের দিনগুলোতে প্যারিসে কার্যত প্রত্যেক আমেরিকার নাগরিককে হয় সিআইএর এজেন্ট মনে করে সন্দেহ করা হতো, নয়তো তারা সিআইয়ের নজরদারিতে থাকত।

The Paris Review পত্রিকার সম্পর্কে রটনা ছিল সিআইএর সঙ্গে সংযোগের, যা কিছুটা হলেও সত্য ছিল। কয়েক দশক পর সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার মাতিয়েসেন স্বীকার করেন যে, সিআইএর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় গোপন করার জন্যই তিনি ম্যাগাজিনটি প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। তবে পত্রিকা কোনো কার্যক্রমে জড়িত ছিল না। কেউ কেউ জর্জকেও সিআইএর বলে সন্দেহ করতেন। বাস্তবে ওই সংস্থার সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ ছিল না। কিংবা বইয়ের দোকানও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ গ্রহণ করেনি। তবে জর্জ এবং তাঁর বইবিপণি পেয়েছে সিআইএর অযাচিত, অনাবশ্যক মনোযোগ।

১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে জর্জ তাঁর সংশয় অবহিত করেন সাইরাস এস ইটনকে। ইটন সফল ব্যবসায়ী, সমাজসেবীও। সুপরিচিত ছিলেন বিশ্বশান্তির সমর্থক তথা যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধ নীতির কড়া সমালোচক হিসেবে। জর্জ দোকান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে জানান; বিনামূল্যে ল্যান্ডিং লাইব্রেরি এবং ইংরেজি গ্রন্থসমূহ বিপণনে উৎসাহিত করাসহ প্যারিসে একমাত্র আমেরিকান প্রতিষ্ঠান স্নায়ুযুদ্ধবিরোধী। ফলে বিভিন্ন সংস্থা থেকে আশাব্যঞ্জক প্রণোদনার পাশে হয়রানির শিকারও হতে হয়েছে। দোকানের পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল প্রতিদিন ডজনখানেক গুপ্তচরের উপস্থিতিতে। বাধ্য হয়ে জর্জ উদারপন্থী সাপ্তাহিক লেক্সপ্রেস (L’Express)-এর  শরণাপন্ন হন; তাদের গ্রাহকদের জন্য আইনি পরিষেবার পরামর্শ নিতে। কোনো আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে না পারলেও ল’ এক্সপ্রেস সাপ্তাহিক একটি ছোট রচনা প্রকাশ করে ‘Refuge for writers’ নামে।

গুপ্তচর সংস্থার অনৈতিক প্রয়াস উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন জর্জ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। রবিবারের পত্রিকাগুলোতে দোকানের ছবি প্রকাশ করে প্রচারণার পাশে স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস দু-পৃষ্ঠা জুড়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ব্যাপক প্রচারের ফলে অচিরেই বিশ্বের নানা দেশের সাংবাদিকরা জর্জের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। দোকান খোলার পর থেকেই নজরদারিতে ছিল; কিন্তু ম্যাগাজিন প্রকাশের আগে কল্পনা করতে পারেননি কত এজেন্টে পরিকীর্ণ ছিল দোকান। সম্পাদকীয় বোর্ডের জন্য তাদের প্রার্থিতা পেশ করার পাশে জর্জের আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা করেছে। এমনকি ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় নীতির ভবিষ্যৎপন্থা ঠিক করা বা পরিবর্তনে সচেষ্ট থেকেছে। বিদেশি হিসেবে জর্জের বিচ্ছিন্নতা বা ভিন্নতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ছোটখাটো কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয়ে। বিতর্কিত বইগুলো অপসারণ করার জন্য নিয়ত চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।

১৯৬৪ সালে বিরাজমান রাজনৈতিক চাপা উত্তেজনার পাশে নাগরিক দিনযাপনেও তার প্রভাব পড়ে। তরুণ, উদারমনস্ক প্রজন্মের সঙ্গে রক্ষণশীল প্রবীণদের নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের পার্থক্য; প্রশ্নবিদ্ধ উপলব্ধি, আস্থাও। অংশত পরিস্থিতির কারণেই বসন্তের রোদভরা শহরে দোকান সংস্কারের জন্য বন্ধ করে দেন। নতুন নামে দোকান খোলা হয় সংস্কারের পর ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে। শেক্সপিয়রের চারশোতম জন্মলগ্ন উদ্যাপন উপলক্ষে নতুন নামে অভিষিক্ত করেন ‘লো মিস্ত্রাল’-এর ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’। প্রয়াত সিলভিয়া বিচের স্মরণে ও সম্মানে দোকানের প্রথমতলার নামকরণ করেন ‘সিলভিয়া বিচ মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’। দোকানের সামনের দরজার ওপরে চিত্রিত ‘লাইব্রেরি লো মিস্ত্রাল’ (Librane Le Mistral)।

সময়ের সরল কখনো বঙ্কিম সরণি পেরিয়ে চলার বিচিত্র কাহিনি জড়িয়ে আছে এই বইয়ের দোকানে। ফরাসি সরকার ১৯৬৬ সালে দোকানের বৈধ কাগজপত্র যাচাই প্রক্রিয়া শুরু করে। জর্জের কখনোই  তিনি ফ্রান্সেই থাকতেন তখন। বিয়ে করেছিলেন লেখক ফিলিপ ও’কনোরকে। জর্জের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় পান্নার আর্থিক সহযোগিতায়। ঞযব চধৎরং গধমধুরহব (জর্জের ভাষায় দরিদ্রের প্যারিস রিভিউ) প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে। জঁ পল সার্ত্রের নিবন্ধ ভিয়েতনামে আমেরিকার যুদ্ধ বিষয়ে, ছিল পাবলো নেরুদা এবং অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা এবং ঔপন্যাসিক মার্গরিত দুবাসের সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম সংখ্যায়।

অগ্নিগর্ভ সত্তর দশক। বাঁধনছাড়া বিপ্লবী সংস্কৃতি। ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হলেন বুদ্ধিজীবীরা। তার আগে ’৬৭-তে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ। তারই ধারাবাহিকতায় ৬৮ ছাত্র-আন্দোলন। বিক্ষোভের উদ্গিরণে কেঁপে ওঠে ফ্রান্স। প্যারিসের অদূরে নন্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী কিছু ছাত্রের বহিষ্কারের হুমকির প্রতিবাদে সমাবেশ হয় প্যারিসের সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৩ মে। নন্তের ক্যাম্পাসের ছাত্র-আন্দোলনের নেতা তেইশ বছরের দানিয়েল কোন বাঁদি। সরবোর্নের রেক্টরের অনুরোধে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সরবোর্নের সাতশো বছরের ইতিহাসে এই প্রথম পুলিশের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ। ক্রোধে বিস্ফোরিত অসংখ্য ছাত্র বিক্ষোভে যোগদান করে। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ, মারমুখী পুলিশের আচরণ। ছয়শো ছাত্র গ্রেফতার, আহত অনেকে; বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ৬ মে শিক্ষকরাও ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা করেন পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে। ফরাসি রায়ট পুলিশ ঈজঝ হঠাৎ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। পরবর্তী কয়েকদিন লাতিন কোয়ার্টার এলাকা পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। ব্যারিকেড ভাঙা, গাড়ি উলটে ফেলা, মলটেভ ককটেল ছোড়া, রাস্তায় আগুন, দিশেহারা সময়, শহর, সরণি। শতাধিক গ্রেফতার, আহতও শতাধিক। 

বেশিরভাগ সংঘর্ষ বইয়ের দোকানের নিকট রাস্তা বুলভার্ড সাঁ-মিশেল এবং সাঁ-জাকে। পুরো এলাকা জুড়ে পুলিশ, দেখামাত্রই গ্রেফতার। সহিংসতার মাঝে বইয়ের দোকান ছিল নিরাপদ। গল্প, উপন্যাস, কবিতার নিরীহ বর্ণমালার জগতে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিয়েছিল অনেক ছাত্র। জর্জ সারারাত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সঙ্গ দিয়েছেন। বিক্ষোভের খবর দেশব্যাপী প্রচারিত হয়েছে রেডিও, টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে, সংবাদপত্রের সচিত্র খবরে। ফলে ফ্রান্সের শ্রমিকরাও এই বিক্ষোভে যোগ দেয়, পুলিশের আক্রমণের প্রতিবাদে ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। পাশাপাশি তাদেরও দাবি ছিল শ্রমের উপযুক্ত পরিবেশ ও ন্যায্য মজুরির। ১৩ মে দশ লক্ষ মানুষ প্যারিসের রাস্তায় বিক্ষোভ করে। প্রধান ট্রেড ইউনিয়নগুলো সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। দ্রুতই দেশব্যাপী এক কোটি লোক আন্দোলনে শরিক হয়। প্রায় দুই সাপ্তাহ কার্যত ফ্রান্স অচল ছিল। পেট্রোলের স্বল্পতা, ট্রাফিক পুলিশবিহীন রাস্তায় আবর্জনার পাহাড়। রাষ্ট্রপতি দ্য গল ক্ষমতা হারানোর পথে। গোপনে জার্মানিতে পালিয়ে যান তিনি। আবার দ্রুতই প্যারিসে ফিরে এসে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন। উত্তপ্ত পরিস্থিতির অবসান হলেও জানা যায়নি আসলে জেনারেল দ্য গল জার্মানিতে কী করেছিলেন। শ্রমিকরা কাজে ফিরে যায়, ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় জুন মাসে। বামদল বিভক্ত, বিজয় লাভ করে দ্য গলের ডানপন্থী দল। প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে পার্লামেন্টে প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ডানদল। 

’৬৮-র ছাত্র-আন্দোলন এখন ইতিহাস, ইতিহাসবিদদের চর্চার বিষয়। দ্য গলের জাতীয় সংসদ জয় সত্ত্বেও ছাত্রদের অবদমনের প্রতিবাদ ও আন্দোলন ছিল ফরাসি সংস্কৃতির প্রাথমিক দিনবদলের উৎস।  তরুণ প্রজন্মের স্পৃহা, আদর্শের উজ্জীবন। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অযুতধারায় বিকশিত। এই আন্দোলন ফরাসি সমাজ-রাজনীতির চিন্তা-চেতনায় বিপুল পরিবর্তন এনেছিল।   জর্জের সম্পর্কে প্রশাসনের সন্দেহের শৈত্য শিথিল। জুলাইয়ের ৪ তারিখে অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বিদেশিদের কাজ করার বাণিজ্য কার্ডসহ বই বিক্রির অনুমতিপত্র পান। অথচ দোকান বন্ধ থাকার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তিনি। সমস্ত সঞ্চয় ব্যয় হয়েছে লাইব্রেরি ও টাম্বেল উইড অতিথিশালা খুলতে। বাধ্য হয়ে তিনি দোকানের প্রথমতলার ঘর ভাড়া দিয়েছেন ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। কোনো কর্মচারী রাখারও সামর্থ্য ছিল না।

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে অন্তত সাত হাজার টাম্বলউইড বইয়ের দোকানে ঘুমিয়েছেন। আগ্রহীদের অনুরোধে শয্যাসংখ্যা বাড়িয়েছেন। তিনটি বিধান যুক্ত করেছেন সঙ্গে। [যা এখনো প্রযোজ্য] প্রতিদিন বইয়ের দোকানে এক বা দুই ঘণ্টা কাজ করতে হবে, আত্মজীবনীর এক পাতা জমা দিতে হবে আলোকচিত্রসহ এবং প্রতিদিন একটি বই পড়তে হবে প্রত্যেক অতিথিকে।

বইপ্রেমীদের অমৃত সঙ্গ এই বইয়ের দোকানে সংকীর্ণ মনোভাব নিয়েও কেউ কেউ এসেছেন। এমন একজন আগন্তুক ১৯৭৪ সালে জর্জকে লিখেছেন : তিনি দোকানে এসেছিলেন কোটের পকেটে বই লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরিবর্তে নিজেকে আবিষ্কার করেন জর্জের চেয়ারে বসে, জর্জ যখন দোকানের বাইরে গিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলেই পকেট এবং ব্যাগ ভর্তি বই নিতে পারতেন। কিন্তু জর্জকে দেখে তার মনে হয়েছে যেন জীবনের কবিতা। কিছু একটা যা হয়ে উঠল ‘উধু ঃড় ধ ংড়হম’। দোকানে আগত আরেকজন চিঠিতে লেখেন – ডিয়ার স্যার আপনার প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম কয়েক সপ্তাহ আগে এবং আপনাকে দেখলাম এমন উদ্ভট অভব্য … পরের বার প্যারিস এসে ইচ্ছে আছে আপনার সমস্ত সংগ্রহে ক্রিম চিজ ছড়িয়ে দেবার।’

বইয়ের দোকান আক্ষরিক অর্থে এক স্বর্ণযুগের আখ্যান। সংস্কৃতি নিবেদিত নির্লোভ মানুষ, সৃজনপ্রয়াসী লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ আধুনিক সময়ের চিন্তক ও স্রষ্টরা। ভাবনার জগতে সমীহ করার মতো সব নাম : পাবলো নেরুদা, ডরিস লেসিং, হাওয়ার্ড জিন, ফ্রঁসোয়া ত্রুফো, জাক শিরাক, রোল্যান্ড বার্থোস, ব্যারনার মালামুদ, লুই আরাঁগ, জ্যাক হাসমনি, রবার্ট ব্লাই। এসেছেন জাকলিন কেনেডি ওনাসিসও; অতিথিখাতায় তাঁর মন্তব্য : ‘জর্জ হুইটমানের জন্য, যাঁর উদারতা বহু মানুষকে সুখী করেছে।’

দুটো ফিচার ফিল্মের শুটিং করা হয় এই বইয়ের দোকানে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে। প্রথমটি হুগো সান্তিয়াগোর Les Autres

। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র পোলিশ চলচ্চিত্রকার আঁদ্রে জুলাস্কির L’important c’est d’aimer

সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যরে উদ্যাপন ছিল বইয়ের দোকান। তরুন সাংবাদিক গেসেপ্পে রেক্কিয়া।  মিলান থেকে প্যারিসে আসেন ১৯৬৮ সালে। তাঁর স্মৃতির মন্তাজে ধরা আছে এক সময়চিত্র। ’৬৮-র উত্তাল দিনগুলোতে পুলিশের লাঠিচার্জ থেকে পালিয়ে বইয়ের দোকানে আশ্রয় নেন। জর্জের উষ্ণ সম্ভাষণ, আন্তরিকতায় দোকান হয়ে যায় কর্মের জগৎ। তাঁর হাত ধরে ইতালিয়ান কবিতা ফ্রান্সে ফিরে আসে। প্রতি সোমবার সাহিত্য আসর। অনুষ্ঠানে প্রথমদিকের শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক, অভিনেতা এবং মূকাভিনয়শিল্পী জাক তাতি। দার্শনিক ও কবি জঁ পিয়ের ফে লেখক এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা আভর্গাদ সাহিত্য পত্রিকা Tel Quel-এর ফিলিপ সোলার। আসতেন জঁ পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বোভোয়া। বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রঁসোয়া শাতলে থাকতেন অভিনেত্রী ও লেখক স্ত্রী পোয়েল জসপাঁ সহ অভিনেতা অ্যালান দলোঁ, জঁ পল বেলমন্দো, আলবার্তো মোরাভিয়ার পাঠ-অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেকবার এসেছেন দোকানে। পরিদর্শন করেছেন ভুবনমোহিনী ব্রিজিত বার্দোতও একবার এই গ্রন্থতীর্থ। বিশ্বসংস্কৃতির অনপনেয় সব স্রষ্টা এসেছেন দোকানে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মিশেল দগি, জুলিয়া ক্রিসলেভা, জিল দ্য লুগ এবং জাক দেরিদারও অপ্রত্যাশিত আগমন ঘটেছে দোকানে। একদিন রাত এগোরোটায় ইতালির কালভিনো এবং পাবলো নেরুদার অপ্রত্যাশিত আগমন। কালভিনোর আগ্রহে তাৎক্ষণিক পাঠ-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। নেরুদা প্রথমদিকে শান্ত ছিলেন, পরে মুখর আলোচক হয়ে যান। লেখক এবং নারীবাদী কেট মিলেটের অনুষ্ঠানে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। বেশিরভাগই মহিলা। স্বর্ণকণ্ঠী মারিয়া কাল্লাসও এসেছেন বহুবার দোকানে। দোকানে উপস্থিত সবাই অটোগ্রাফপ্রত্যাশী। জর্জ ব্যতিক্রম। তাঁর মন্তব্য, মারিয়া খুব বেশি অলংকার পরেন।

দোকানে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ফিরে আসেন, ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন দরিয়া পেরিয়ে স্বপ্নের মাটি স্পর্শের আনন্দ নেবার। অ্যালান সিলিটো শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানিতে এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে, স্ত্রী কবি ও লেখক রুথ ফেনলাইট এবং তাঁদের বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে। বাইশ বছর বয়সী সিলিটো টাম্বেলউইড ছিলেন ১৯৫০ সালে। তাঁর বহুল প্রশংসিত প্রথম উপন্যাস Saturday Night and Sunday Morning এবং গল্পসংগ্রহ The Landlines of the Long Distance Runner প্রকাশের বহু বছর আগে।

মাত্র এগারো বছর বয়সে ডায়েরি লেখা দিয়ে সাহিত্যচর্চার শুরু। ১৯৬৬ সালের আগে পর্যন্ত কোনো জার্নাল প্রকাশিত হয়নি আনায়েস নিনের। সাহিত্যজগতে অপরিচিতা। তাঁর পরিচিতি ছিল লেখকদের বন্ধু বা বিখ্যাত লেখক হেনরি মিলার, এডমুন্ড উইলসন গেরে ভিদালের প্রেমিকা হিসেবে। নিজের লেখা ছোটগল্প এবং ডিএইচ লরেন্সের ওপর লেখা একটি বই লোকজন কদাচিৎ পড়ত। নিন বিখ্যাত এবং ফ্যাশনদুরন্ত ছিলেন তরুণীদের মাঝে। ১৯৭৪ সালের ১২ নভেম্বর প্রকাশিত জার্নালের পঞ্চম ভলিউমে তাঁর স্বাক্ষর-অনুষ্ঠান হয় বইয়ের দোকানে। বিশাল লম্বা লাইন হয়েছিল শুধু নিনের স্বাক্ষর পেতে  অনুরাগী ভক্তদের। নিন আর জর্জের পরিচয় ১৯৫০ সালে। তখন প্রায়ই যেতেন তিনি বইয়ের দোকানে। জার্নালের পঞ্চম ভলিউমে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’  সম্পর্কে লেখা আছে। আছে জর্জের বিষয়। বহু বছর পর জর্জ আনায়াসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন – আমি হয়তো আনায়েসকে ভালোবাসতাম একসময়। নিনের পাঠ-আসর নিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর ফরাসি টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠান ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশেষ করে গ্রামে বসবাস করা অল্পবয়সী তরুণী বিপুল উদ্দীপনায় বাড়ি পালিয়ে রাজধানীতে এসেছে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি’তে থাকতে। এমন পরিস্থিতিতে জর্জ তাঁদের বাড়িতে ফোনে জানাতে বলতেন, তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে অভিভাবককে নিশ্চিত করতে।

অন্যান্য দেশের মতো ’৭০ সালে ফ্রান্সে নারীর অধিকার বিষয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের রক্ষণশীলতার অনড় বিধানের কিছু সংস্কার করা হয়। নারীর অস্তিত্ব সম্পর্কিত নিজস্ব কিছু সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মান্যতা পায়। ১৯৬৭ সালে গর্ভনিরোধ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বৈধ আইন গৃহীত হয়। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আরেক ধাপ উন্নতি; গর্ভপাতও আইনি স্বীকৃতি পায়। নতুন আইনকে অধিকাংশ মহিলা বৈষম্য রেখা লীন হয়ে অগ্রগতির সূচক বলে ভেবেছেন। তবে তাঁদের অনেকেই নিজেদের ‘নারীবাদী’ ভাবতেন না। বরং ছিলেন ‘Soft feminists’ নারীর মা পরিচিতি অতিক্রম করে তার প্রাথমিক সামাজিক ভূমিকা বা নারীত্বের মর্মার্থ উপলব্ধি করেননি। নিনকে বলা হতো ‘Soft feminists’।

মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি – সব মিলিয়ে পর্যুদস্ত ’৭০ সালের ফ্রান্স। ’৬৮ সালের ছাত্র-আন্দোলন আমেরিকার সংস্কৃতি-প্রভাবিত বলে অনেকের ধারণা ছিল। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকার একগুচ্ছ নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে। অসম্ভব হয়ে পড়ে কর্মহীন বিদেশিদের বৈধভাবে কাজ পাওয়া। নতুন আইনে কর্মহীন বিদেশিদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ হতে হবে ফ্রান্সের ন্যূনতম বেতনভাতার সমমানের। তাছাড়া ব্রিটেন এবং আমেরিকার পাউন্ড ও ডলারের বিনিময়ের মান হ্রাস পেয়েছে। স্বল্পসংখ্যক ইংরেজিভাষী লেখক ছিলেন প্যারিসে। উইলিয়াম বারোজ, জেমস বল্ডউইন, লরেন্স দারেল, জেমস জনস ফিরে গেছেন স্বদেশে। যাবার সময়ই প্রায়ই লেখকরা তাঁদের বই বিক্রি করে দিতেন জর্জের কাছে।

আইনের বাঁধন থাকলেও প্যারিসে স্বল্প সময়ের জন্য পর্যটক আসা বন্ধ হয়নি। বই, পাঠক ও মালিকের ত্রিমুখী সঙ্গম বইয়ের দোকান। বইপড়ুয়া, সৃজন-অনুরাগীর কাছে উপাসনালয়ের মতো ছিল এই গ্রন্থবিতান। দেবালয় বা বিগ্রহ নেই। জাতপাত লিঙ্গবৈষম্যহীন ধর্মীয় গোষ্ঠীবদ্ধতামুক্ত মানুষের বেঁচে থাকার সতেজ অস্ত্র বই। গ্রন্থউন্মাদ জর্জের কি বিপুল সমৃদ্ধ এক চির ব্যতিক্রমী ভুবন। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি তিন অক্ষরের উপন্যাস – বলতেন জর্জ। টাম্বলউইডসদের অনেকে পরে কৃতিমান কবি, লেখক হয়েছেন। আগন্তুক, ব্রাত, প্রতিষ্ঠিত অতিথির মিছিলে অনেক মুখ। ২৩ বছরের ব্রিটিশ তরুণ অ্যান্থনি হরোউৎজ প্রথম উপন্যাস লেখার কাজ করেছেন লাইব্রেরি ওপরতলার ঘরে। এমি কিশোরী বয়সে দোকানে এসেছিলেন। বিটস কবিদের ভাবনায় সমাচ্ছন্ন ভাবতেন, জ্যাক কেরুয়াক তাঁর বাবা। বিখ্যাত লেখক হবার পরে সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এমি মিখায়েল হোমস। লেখক হানিফ কোরাইশিও বিট কবিদের প্রভাবে আর হেনরি মিলার ও ফেরলিংঘেটির টানে এসেছেন দোকানে। অর্থনৈতিকভাবে ভালোই চলেছে। তবে মুনাফা-বাণিজ্যের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, কেউ যদি বই না কিনে শুধু বসে বই পড়ে, তাতে তার কাজ কমে যায়। তবে অনেকেই বই কেনার জন্য গোঁ ধরে, এটা পাগলামো।

জর্জ বহু বছর অবকাশ যাপনে যাননি। ১৯৭৬ সালের জুলাইতে বিস্তৃত ভ্রমণে আমেরিকা যান। ইস্ট কোস্টে পরিবারের স্বজনসান্নিধ্যে সময় কাটানো আর টাম্বলউইডসের প্রাক্তনদের সঙ্গে দেখা করা। জর্জের অনুপস্থিতিতে দুজন কর্মী চিপ এবং নিকেলে ছিলেন দোকানের দায়িত্বে। জর্জের অনুপস্থিতিতে বাহুল্য বলা Antiquarian Ulysses চুরিসহ নানা অপ্রীতিকর, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৯ সালে ট্রপিক অব ক্যান্সার, পুয়েরতো রিকা, পানামা খাল, তাহিতি, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় ভ্রমণ করেছেন। দীর্ঘ পর্যটনের কালে তিনি প্রাক্তন টাম্বলউইডসের বাড়িতে গিয়েছেন পূর্বঘোষণা ছাড়াই। ক্ষণকালের বিরতি ছিল বালিতে, পরের গন্তব্য চায়না। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির এশিয়ার শাখা খোলার প্রস্তাব পান চায়না সরকারের। কিন্তু বেইজিংকে আন্তর্জাতিক বইয়ের দোকান খোলার যথার্থ স্থান মনে হয়নি জর্জের। পরিবর্তে প্যারিসের দোকান তৃতীয়তলা এবং গ্রাউন্ড ফ্লোর ক্রয়ের মনস্থির করে, অর্থ সংগ্রহে সচেষ্ট হন। লুই আঁরাগের কাছে ঋণ নেবার কথা ভেবেছেন। ভাই কার্লকে এ-সম্পর্কে চিঠিতে লিখেছেন : লুই আঁরাগের বয়স এখন বিরাশি, তাছাড়া শ্রবণসমস্যা রয়েছে। পরে অবশ্য জর্জ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অর্থ দিয়ে জায়গা দুটো কিনে নেন। দোকানের বাইরে টানানো ওয়াল্ট হুইটমানের কবিতার পদাবলি ফরাসি অনুবাদে কবির ছবিসহ।

‘Étranger qui passe, tu ne sais pas

avec quel désir ardent je te regarde’

ÔTo a strangerÕ KweZvi Bs‡iwR :

Passing Stranger! You  do not know

How longingly I look upon you,

You must be he I was seeking

Or she I was seeking.

     (It comes to me as dream)

জর্জের একমাত্র সন্তানের জন্ম ১৯৮১ সালের ১ এপ্রিল।  বইয়ের দোকানের কাছে সেইন নদীর ওপারের এক হাসপাতালে। ৬৭ বছর বয়সী বাবার মনোবাসনা ছিল ছেলে হলে নাম ওয়াল্ট রাখবেন। ওয়াল্ট হুইটমানের নামে। পরে মেয়ে হলে নাম রাখেন সিলভিয়া। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির আদি জননীর নামে। বিয়ে করেছেন একবারই। স্ত্রী ফেলিসিটি লেং-এর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর অনেক ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক হয়েছে। তিনতলা অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের ঘরে সিলভিয়ার ঘুমাবার বাঙ্কবেডের ব্যবস্থা করা হয়। নিচের তলায় বাচ্চাদের বিভাগের ওপরে সিলিং কোঠা নির্মাণ করা হয়েছিল, যা লাল ভেলভেটের পর্দা দিয়ে সুশোভিত। পর্দা সরালে ছোট পরিসরের নাম ‘মিরর অফ লাভ’। আগত দর্শনার্থী, কৌতূহলী অনুরাগীরা তাদের বার্তা রেখে যেত জর্জের জন্য ভালোবাসার দর্পণে। একজন লিখেছেন : ‘তিরিশ বছর আগে এখানে আমাদের দেখা হয়েছিল। আর এখন ফিরে এসেছি আমাদের দু-সন্তানের সঙ্গে।’ এক ইতালিয়ান মায়ের কথা : ‘প্রিয় মিস্টার হুইটমান আমার ছেলে জেরি বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিল এক সপ্তাহ। এখন বুঝতে পারছি সে আপনার লাইব্রেরিতে ঘুমিয়েছে, যা সে খুব ভালোবাসে। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই যে-কাউকে আপনার সাহায্যের জন্য।’

ছোটবেলায় সিলভিয়ার প্রথম বড়দিন কেটেছে অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেটি, গ্রেগরি করসোর মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে। ছোট্ট সিলভিয়ার পার্কে বেড়ানোর সঙ্গীও টাম্বলউইডস কোনো আবাসিক। তাঁর জন্মের আগে পর্যন্ত অজানা ছিল বইয়ের দোকানের পরবর্তী মালিকানা কার হবে। তাছাড়া জর্জ তাঁর বইয়ের দোকান অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়ার কথা কল্পনাও করেননি। যদিও বেশ কয়েকজন তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনের প্রচেষ্টায় ছিল। ফেরলিংঘেটি পরে এ-প্রসঙ্গে বলছেন : ‘মনে হয়েছিল বহু লোক চারপাশে গুঞ্জন করছে, হার্পিজের মতো প্রস্তুত তাঁর দোকানটি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে।’ [গ্রিক এবং রোমান মিথলজিতে হারপি (বহুবচনে হারপিজ) কিংবদন্তি প্রাণী; যার দেহ অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক পাখির। নামের অর্থ লুটেরা বা ছিনতাইকারী।]

কবি পল এলুয়ার বেদনার রাজধানী প্যারিস জর্জের কাছে ‘সিটি অফ ডিজায়ার’। স্পৃহার নগরী প্যারিস। আমাজনের যুগেও সমান আবেদন শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির। কয়েক দশকেরও বেশি সময়কালে প্রায় তিন হাজার যশপ্রার্থী লেখক-শিল্পী দোকানে দিন কাটিয়ে গেছেন। ত্রিভুবন, ৩উ ইতিহাস এই বইবিপণি। অতীত জীবন্ত, প্রবহমান; বর্তমান ধাবিত ভবিষ্যতে। ফেসবুকের যুগে যারা ভাবেন বইয়ের দোকান গুরুত্বহীন তাদের প্যারিসে আসা উচিত।  তরুণ, বৃদ্ধ, ধনী, দীনহীন, নিঃস্ব লেখক-পাঠক-সমঝদার – সব শ্রেণীর বইপ্রেমী পৃথিবীর ভিন্ন গোলার্ধ থেকে আসেন বন্ধুদের নিয়ে; বন্ধুত্ব তৈরি করতে, বন্ধু পেতে। বই কেনা, লাইব্রেরিতে বসে দিনভর বই পড়া, কফি পান, কবিতাপাঠের আসর … সব মিলে স্বগৃহ ছেড়ে দূরে নতুন নিবাস খুঁজে পাওয়া। বাণিজ্য আর সৌহার্দ্যরে সহবাস দোকানের পরিবেশে। জর্জ বিশ্বাস করেন : ‘গ্রন্থ বাণিজ্য জীবনের বাণিজ্য।’ (The business of books is the business of life)

১৯৮১ সালের ফ্রান্সে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ফ্রঁসোয়া মিঁতেঁরা; পঞ্চম প্রজাতন্ত্রে গত বাইশ বছরের ইতিহাসের প্রথম বাম সরকার। সে-বছর আগস্ট মাসে মিতেরা সরকার লং আইন (খধহম খধ)ি পাশ করেন ফ্রান্সে বইয়ের বাঁধা মূল্য নির্ধারণ করার লক্ষ্যে। দোকানগুলো প্রকাশকদের কভার দামের চেয়ে পাঁচ শতাংশের বেশিতে সংস্করণগুলোর ছাড় দিতে পারত না। এতে বড়মাপের খুচরা বিক্রেতাদের পাশে ক্ষুদ্র, স্বতন্ত্র বিক্রেতাদের বাজারে টিকে থাকার পথ সুগম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশে এ-জাতীয় আইনের সুবিধা ক্ষুদ্র, স্বতন্ত্র বিক্রেতাদের জন্য নেই। ফ্রান্সে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম সুষ্ঠু, সুদক্ষ, বৈচিত্র্যপূর্ণ বইবিপণির সংস্কৃতি। বর্তমানে লং আইন যে শুধু প্রচলিত তা নয় এটি সম্প্রসারিত হয়েছে ২০১১ সালে ই-বুকের মূল্য সুরক্ষা করতে এবং ২০১৩ সালে অনলাইন বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে।

জর্জের সংকল্প ছিল এক শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নির্মাণের। তিনি বলেছেন : বইবিক্রেতারা হলো বার্তাবাহক, লেখক এবং পাঠকের। সিলভিয়া বিচও প্রায়ই বলতেন, তিনি শেক্সপিয়রের অনুগত বার্তাবাহক (Errand boy)| The Paris Magazine

পুনর্জন্ম ১৯৮৪, ষোলো বছর পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল একটি মাত্র সংখ্যা। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা স্বপ্নের বইবিপণির জন্মকথা লেখার। ১৯৮৪ সালে চার মাসের অবকাশযাত্রায় অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইয়েমেন, মিশর পর্যটনের সময় লেখার চেষ্টা করেছেন। বইয়ের শিরোনাম The Rag and Bone of the Heart। ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘দি সার্কাস অ্যানিমালস ডিসারশন’ (‘The Circus Animals’ Desertion’) কবিতার শেষ দুটো চরণ থেকে নেওয়া। পরের বছর বসন্তের শুরুতে প্যারিস ফিরে আসেন। বলাই বাহুল্য লেখার অগ্রগতি হয়নি কোনো। ’৮৮ সালে প্রকাশ করেন The Tumbleweed Hotel (আত্মজীবনীসমগ্র বইয়ের দোকানের অতিথি ছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের), The Paris Magazine তৃতীয় সংখ্যা, এন্ডু ওকের কবিতার বই Children of Hunger

গ্রন্থবিপণিতে প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৮৭ সালের গ্রীষ্মে। দোকানের সামনে টেবিলে রাখা ঝুড়িতে বইয়ের সম্ভার। মূল্যহ্রাস চলছিল। কিনেছিলাম গাব্রিয়েল মার্কেজ আর সিমোন দ্য বোভোয়ার ইংরেজিতে অনূদিত দুটো বই। বইয়ের প্রতি অবসেশন, বই নিয়ে উন্মাদনার বিশেষ নাম বিবলিওম্যানিয়া। বইপ্রেমী পড়ুয়া আর বই সংগ্রাহকদের নিয়ে আরেকটি শব্দ বিবলিওফিল। তাঁরা জর্জের মতোই যেকোনো বই সংগ্রহ করেন। হয়তো সব বই পড়া হয়ে ওঠে না। পেপারব্যাক, বোর্ড বাঁধাই, পুরনো বইয়ের ভুবায়নের ব্যাপ্ত পরিসর। বইয়ের গন্ধেরও সুন্দর একটি শব্দ বিবলিয়োস্মিয়া (Bibliosmia) বাংলায় অনুবাদে ঠিক ভাব প্রকাশ অসাধ্য।

জর্জের দোকান উন্মুক্ত সবার জন্য। কেউ ভালোবেসে পড়েন, সংগ্রহ করেন। কেউ মোহগ্রস্ত হয়ে বই কেনেন। বইভুবনে

প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার মহত্তম মুহূর্তগুলো অনুভব করেন। দিনের দুটো মুহূর্ত ছিল খুব প্রিয় জর্জের। সকালে দরজা খুলে নতুন এবং প্রাক্তন বন্ধুদের স্বাগত জানানো আর মধ্যরাতে দোকান বন্ধের পর ছয়টা বই  নিয়ে বিছানায় যাওয়া। বইগুলো ছিল তার মণি-মানিক্য। জর্জ খনিশ্রমিকদের মতো বইয়ের জগৎ ফুঁড়ে আবিষ্কার করতেন মহার্ঘ্য জহর।

বিকেল পাঁচটা ১৮ জুলাই ১৯৯০। দোকানের প্রথমতলা এবং নিচতলার সামনের ঘরে ভয়াবহ আগুন লাগে। জর্জসহ শত লোক রাস্তায় স্বপ্নসৌধ ভস্মীভূত হওয়া দেখেছেন। নিরুপায় জর্জ। অগ্নিনির্বাপণের সময় দুজন নির্বাপককর্মী মারাত্মক জখম হন। যদিও জানা যায়নি আগুনের উৎস। ধারণা, অসাবধানতাবশত কোনো ক্রেতার সিগারেট থেকে দুর্ঘটনার সূত্রপাত। শ্রমলব্ধ দুর্লভ সঞ্চয় নিমিষেই ছাই। বিহ্বল জর্জ নিচতলার অ্যান্টিকোয়ারিয়ানে ঘুমাতে চলে যান। দোকানের সর্বত্র কাদা, চূর্ণ কাঁচ; বিদ্যুৎ নেই। পরদিন সকালে জর্জ যেন দুঃসাহসী সৈনিক। আমেরিকার শ্রমিক-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং গীতিকার জো হিলের (Joe Hill) সুর জর্জের গলায় – শোক করো না, সংঘবদ্ধ হও (Don’t Mourn, organize)। বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাক্সক্ষীদের সহযোগিতায় পরিচ্ছন্নতার কাজ চলে। রাইটার রেসিডেন্সি ক্রিস্টোফার সোইয়ের লোকান্নও (Christopher Sawyer-Lauçanno) এবং টাম্বলউইড রিচার্ড হলওয়ার্ড (Richard Hallward) বইভুবন পুনর্নির্মাণের অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনায় বিভিন্ন শহরে সাহিত্য-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আমন্ত্রিত লেখকরা লেখা পাঠ করেছেন, শ্রোতারা অর্থ চাঁদা দিয়েছেন। মাত্র তিন মাস পর ১৯৯০ সালের অক্টোবরে একই সঙ্গে বোস্টন, লন্ডন, নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো এবং প্যারিসে সাহিত্যপাঠের আয়োজন, সবমিলে একশ চল্লিশ জন লেখকের অংশগ্রহণে পাঁচ হাজার শ্রোতা-দর্শক উপস্থিত ছিলেন সংহতি প্রকাশ করে। নিউইয়র্কের একদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজক অ্যালেন গিন্সবার্গ। লেখক ও কবিদের স্বতঃস্ফূর্ততায় এক রাতের অনুষ্ঠান বাড়িয়ে তিন রাত করতে হয়েছে। সানফ্রান্সিসকোতেও লরেন্স ফেরলিংঘেটি এবং সিটি লাইটস বুকস্টোর সাহিত্যপাঠের অনুষ্ঠান করেছেন, তহবিলের জন্য। বোস্টনে ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের আয়োজক সোইয়ের লোকান্ন। লন্ডনেও টানা একুশ ঘণ্টার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সি কে উইলিয়াম, টেড জোনস, জঁ ফানশেট ছাড়াও স্থানীয় কবি, শুভার্থী এবং টাম্বলউইডসরা। পেয়েছেন দূরের সুহৃদ বন্ধু এবং হিতৈষী টাম্বলউইডসদের অপ্রত্যাশিত অর্থসাহায্য। একজন ব্যক্তি মার্ক টোয়েনের প্রথম সংস্করণের দুটো বই উপহার দেন। প্যারিসে কানাডার বইয়ের দোকান ‘The Abbey’ দিয়েছিল প্রথম সংস্করণ Ulysses। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রকাশনা, অনুরাগী বন্ধুদের সহায়তায় সম্ভব হয়েছে, জর্জের স্বপ্নসৌধ পুনঃগঠনে। শুরুর দিকের টাম্বলউইডসদের একজন, বন্ধু কবি দেসমন্দ ও গ্রান্ডি জর্জকে নিজেদের বয়সের কথা স্মরণ করে লিখেছিলেন চিঠিতে – You and I age now; কিন্তু শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানি কখনো বৃদ্ধ হবে না। চিরশ্যামল বৃক্ষের মতো প্রতিবছর প্রস্ফুটিত হবে।

সুহৃদ অ্যালান গিন্সবার্গের অনন্তলোকে যাত্রা ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে। চার মাস পর আগস্টে উইলিয়াম বারোজ। আনায়াস নিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ১৯৭৭ সালে। তাঁর বইয়ের পাঠ-অনুষ্ঠানের তিন বছর পর। একে একে নক্ষত্র পতন – ১৯৮০-তে হেনরি মিলার, জেমস বল্ডউইন ১৯৮৭, লরেন্স ডারেল ১৯৯০। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে ফেরলিংঘেটি আর করসোসহ বইবান্ধব কয়েকজন সতীর্থ সময় আর স্মৃতিকে ধারণ করে বেঁচে আছেন।

১৯৮১ সালের নভেম্বরে প্যাশন (Passion) পত্রিকায় জর্জ পঁয়ত্রিশ বছর প্যারিসযাপনের মুগ্ধবোধের কথা লিখেছিলেন। ‘মাই প্যারিস, মনামুর’ (My Paris, Mon Amour) শিরোনামে।

জেমস জয়েস প্যারিসকে বলেছেন – A lamp for lover hang in the wood of the world – আর জর্জের কাছে প্যারিস ‘A City named desire’। নিবন্ধের শেষ অধ্যায়ের কয়েক পঙ্ক্তি – ‘রবিবার দুপুরগুলোতে লাতিন কোয়ার্টারে বোদলেয়্যর আর বালজাকের প্রেতাত্মার সঙ্গে হাঁটি। সন্ধ্যায় গোধূলিতে আমার কুকুর বাস্কারভিলকে সেইন নদীর পাড়ে হাঁটাই। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুঘর লুভ্র পার হয়ে, বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবাদপত্র ‘লো মঁদ’ (Le Monde) নিতে থামি – আর পৃথিবীর অদ্ভুত বইয়ের দোকান শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির ঘরে ফিরে আসি।’

জর্জের পরিব্যাপ্ত কর্মযজ্ঞের কর্ণধার বর্তমানে মেয়ে সিলভিয়া হুইটমান। ২০০০ সালের এপ্রিলে বিশ বছরের জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন একটি পুরনো প্লাস্টিক ব্যাগ। খুলে পেয়েছিলেন দুর্লভ একটি বই। জর্জের নিজের সংগ্রহের ইউলিসিসের প্রথম সংস্করণ।

১২ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে জর্জের ৯২তম জন্মদিন অনুষ্ঠানে বলেন – মধ্যযুগে প্রতিটি আশ্রমে একজন frère lampier থাকতেন, যার দায়িত্ব ছিল দিবাবসানে বাতি জ্বালানো। আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে কাজটি করে যাচ্ছি। এখন আমার মেয়ের পালা।

জীবনে যশ-বিত্ত নিয়ে ভাবেননি। চাননি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের জালে আবদ্ধ হতে। সুকৃতির স্বীকৃতিও পেয়েছেন ২০০৬ সালে। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অফিসিয়ের দ্য লা’অর্দ দে আর্ত এ দে লেত’ (Officier de L’ordre des Arts et des Lettres) সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ। ব্যক্তিগত সম্মান গ্রহণ জর্জের স্বভাববিরুদ্ধ, অহেতুক মনোযোগ আকর্ষণে অনীহা বলে পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানেও যেতে চাননি। সিলভিয়া স্মরণ করিয়ে দেন, এই স্বীকৃতি বইবিপণির। জর্জ আর বইয়ের দোকান অবিচ্ছেদ্য। অনুষ্ঠানে জর্জকে সার্টিফিকেট ও অলংকৃত মেডেল দেওয়া হয়। পরদিন দুপুরে সিলভিয়া পুরস্কারের সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে জর্জের শোবার ঘরের দেয়ালে টানিয়ে রাখেন। রাতশেষে সকালেই তা অদৃশ্য দেয়াল থেকে। মাসখানেক পর খালি, ভাঙা ফ্রেম পাওয়া যায় জর্জের কাগজের স্তূপের নিচে। সার্টিফিকেট কোথাও রাখা আছে।

বিশ্বনাগরিক জর্জ, ছিলেন আদর্শের এক মুক্ত উদ্ভাস। নানা দেশ, নানা মুদ্রার এক দ্বীপ শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানিতে তিনি সম্প্রীতির ব্যালাড গেঁথেছেন। গর্বাচভকেও চিঠি লিখেছিলেন ভ্রাম্যমাণ (Floating) বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের জন্য। শান্তি এবং মৈত্রীর বাণী নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণের পরিকল্পনায়।

জর্জের আর্কাইভে আছে হাজারেরও বেশি টাম্বলউইডদের আত্মজীবনী, থ্যাঙ্কইউ নোট, অতিথিদের বৃত্তান্ত, বই প্রকাশের প্রচারপত্র, অগুণতি কাগজপত্রের ক্লিপিং। অ্যালান গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেটি, পল বাউলস, ক্যারোলিন কাসাদি, গ্রাহাম গ্রিন, নওম চমস্কি, লরেন্স ডারেল প্রমুখ গুণী-মনীষীদের জর্জকে লেখা চিঠি, আছে বিচিত্র সব বিষয়ের নথিপত্র। অডিও ক্যাসেট, ঠঐঝ টেপ, সিডি, ডিভিডি। হাজারখানেক বিজনেস কার্ড, জর্জের পারিবারিক চিঠিপত্র, প্রেমপত্র, ডায়েরি। অগুণতি আলোকচিত্র। জর্জকে লেখা মায়ের চিঠি, যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার জন্য। আছে ভ্রমণ-জার্নালও।

এই বইয়ের দোকান নিয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনিও। কারো ধারণা, উইলিয়াম শেক্সপিয়র দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, জেমস জয়েসকে ভূগর্ভের কুঠুরিতে সমাহিত করা হয়েছে, জর্জ ওয়াল্ট হুইটমানের অবৈধ সন্তান। ২০১৬ সালে বই দোকান নিয়ে বেরিয়েছে সুখপাঠ্য গ্রন্থ A history of the Rag and bone shop of the heart, মোট আটটি অধ্যায়। কালের ঘটনাবলির এক অনুপুঙ্খময় চিত্র। ত্রিস্টা হালভারসনের সম্পাদিত ইতিহাস অতিক্রমকারী বইতে আছে মানুষ, সংস্কৃতি, ভূগোল, ইতিহাসের অনুষঙ্গে জর্জের ব্যক্তিগত পুরাণ। সময়ের সেপিয়া ছবি উঠে এসেছে তাতে। জর্জ বলতেন – যেভাবে উপন্যাস লেখা হয় ঠিক সেভাবে বইয়ের ভুবন সৃষ্টি করেছেন। ভুবনের প্রতিটি কক্ষ এক-একটি অধ্যায় আর তিনি মানুষের জন্য যেভাবে দ্বার উন্মুক্ত করেন, ঠিক একইভাবে তারা বই উন্মোচন করুক।

জর্জ মারা যান ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ সালে। ৯৮তম জন্মদিনের দুদিন পরই দোকানের ওপরতলায় নিজের শয়নকক্ষে। রাতের শহরে অচঞ্চল সেইনের জলে নতরদাম গির্জার ছায়া। বর্ণমালার মতো নক্ষত্রখচিত আকাশ, মধ্যরাতে চরাচরের অসারতায় ছড়িয়ে থাকে নির্জন সৌন্দর্য। প্যারিসের সমাধিক্ষেত্র পের লা-শেইজে নিবিড় নীরবতায় গ্রন্থপ্রেমী জর্জ চিরনিদ্রায়।

জর্জের মেয়ে সিলভিয়া বর্তমানে দোকানের কর্ণধার, সঙ্গে সঙ্গী দাভিদ দ্য লানে। বাবার বইবিপণির আদর্শ ও ঘরানা শতভাগ অক্ষুণ্ন রেখেছেন। রবিবারের চায়ের আসর, লেখকদের ওয়ার্কশপ, সাপ্তাহিক বিভিন্ন কার্যক্রমসহ। ২০১০ সাল থেকে সিলভিয়া আয়োজন করে আসছেন সাহিত্য উৎসব, ‘Fesitavaland Co’। দোকানের কাছেই পার্ক স্কয়ার রনে ভিভিয়ানিতে। একই বছর প্রবর্তন করেন অপ্রকাশিত উপন্যাসের জন্য সাহিত্য পুরস্কার; গ্রুট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে। প্রথম প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন রোজা রানকিন জি। বইটি পরে প্রকাশিত হয় ভিরাগো প্রকাশনা থেকে। লন্ডনের সম্পাদক ফাতেমা আহমেদ পুরনো বইয়ের দোকানে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত পারি ম্যাগাজিন খুঁজে পান। তাঁরই আগ্রহে ম্যাগাজিনের আরেকটি সংখ্যা বের করেন। নতুন সংস্করণে লুক সন্ত, লরেন্স ফেরলিংঘেটি, ফরাসি লেখক মিশেল ওয়েলবেক, মারি নিদিয়ায়ে সহ নবীন দুজন লেখকের লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বইবিপণির পাশেই আছে কাফে। ২০১৫ সালে খোলা হয়, ১৯৮১ সাল থেকে পরিত্যক্ত একটি গ্যারাজে। জর্জের ১৯৬৯ সাল থেকেই ইচ্ছে ছিল একই জায়গায় একটি লিটেরারি কাফে খোলার।

তথ্যঋণ : সিলভিয়া বিচের স্মৃতিকথা। বিভিন্ন পত্রিকার নিবন্ধ। গ্রন্থ : A history of the Rag and Baneshop of the heart (২০১৬ প্রকাশকাল)।