বলরামের চেলা তুমি চে গুয়েভারা

মফিদুল হক

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের জনবিরল স্থান লা হিগুইরাতে আহত ও ধৃত চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর এই মৃত্যু বড়ই করুণ। প্রায় এক বছর আগে তিনি বলিভিয়া এসেছিলেন গোপনে, অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। তাঁর দল ছিল ছোট কিন্তু স্বপ্ন ছিল বিশাল। কিউবার বিপ্লব সফল করে তুলেছিল মুক্তির স্বপ্নতাড়িত এমনি এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, ‘গ্রানমা’ জাহাজে করে মেক্সিকো থেকে এসে যাঁরা নেমেছিল কিউবার উপকূলে এবং গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশের সম্পদের ওপর দেশবাসীর কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনে, শুরু করে নতুন সমাজ নির্মাণের অভিযাত্রা। যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় এমন বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাবার প্রক্রিয়ায় তারা ভালোভাবেই জেনেছিল সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতার দাপট ও তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। বিজয়ী কিউবা অনুপ্রাণিত করেছিল দেশে দেশে অযুত মানুষকে, আর বিজয়ী বীর চে গুয়েভারা চেয়েছিলেন লড়াইয়ের এ-ধারা অব্যাহত রাখতে। বিশ্বব্যাপী প্রসারিত সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যে-বেড়াজাল, তা ছিন্ন করতে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামই তো প্রয়োজন। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের সংগ্রাম তখন দুনিয়াজুড়ে অগণিত মানুষকে উদ্বেলিত করেছিল। চে চেয়েছিলেন লাতিন আমেরিকায় আরো কতক ভিয়েতনাম তৈরি করতে এবং সেই সংঘাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদকে পরাভূত করতে।

এই পটভূমিকায় অল্প কয়েকজন সাথি নিয়ে বলিভিয়ায় গেরিলা আন্দোলন গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে সূচিত হয় চে গুয়েভারার অভিযান। কিউবার বিপ্লবের সাফল্যে অবগাহন করে বাকি জীবন স্বচ্ছন্দে পার করে দিতে তাঁর কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু কিসের ডাক শুনে তিনি আকূল হয়েছিলেন, কোন বাঁশির সুর তাঁকে ঘরছাড়া করেছিল? তিনি চেয়েছিলেন সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, সবচেয়ে শোষিত দুর্ভাগা দেশ বলিভিয়ার এই আন্দোলন লাতিন আমেরিকার অন্য দেশেও প্রসারিত হবে। ঘরের কাছের বিপ্লবী জাগরণ ঠেকাতে আমেরিকা আরো বেশি করে তাঁবেদার সরকারের পাশে দাঁড়াবে, প্রত্যক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপ দেশে দেশে জাতীয় প্রতিরোধ জোরদার করে তুলবে এবং লাতিন আমেরিকাজুড়ে সৃষ্টি হবে এক, দুই, তিন অনেক ভিয়েতনাম। বিশ্বজনীন তীব্রতর সেই সংগ্রাম বয়ে আনবে নতুন পরিবর্তন, নতুন পৃথিবীর উদ্গাতা হবে বৈপ্লবিক এ-জাগরণ।

মনে হবে, কী অসম্ভব কল্পনা! সাফল্যের সম্ভাবনা তিল ভাগও নেই, তবু কোন সর্বনাশামন্ত্রে মেতে ওঠা! মনে জাগবে রবীন্দ্রনাথের গানের পঙ্ক্তি – পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে জেগে ওঠা মন মানুষকে নিয়ে যায়, ‘চেনাশোনার কোন্ বাইরে, যেখানে পথ নাই নাই রে, সেখানে অকারণে যায় ছুটে।’ দৃশ্যত কোনো কারণ ছাড়া ছুটে যেতে চায় মন, যেখানে পথ নেই সেখানেই খুঁজে ফিরে পথ। কার্যকারণ তো হিসেবি চেতনার সন্তর্পণ পথচলার অবলম্বন, তারপরও আটঘাট বেঁধে সবরকম প্রস্ত্ততি নিয়ে আপন স্বার্থরক্ষা না হোক, অন্তত আত্মরক্ষার আয়োজন-সংবলিত  সংগ্রাম-পথের যাত্রী রয়েছেন অনেক, তবে তার বাইরেও রয়ে যান কিছু মানুষ, চে গুয়েভারা ছিলেন সেসব বিরলজনের মধ্যে অগ্রগণ্য। বিশ্বস্ত কতক সঙ্গী নিয়ে বলিভিয়ার কৃষকদের ওপর ভরসা করে যে-বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন তার বাস্তব ভিত্তি সম্পর্কে অনেক সংশয় থেকে যায়, কিন্তু মানবমুক্তির লক্ষ্যে ঘরছাড়া হয়ে সর্বস্ব-পণে তো কোনো খাদ ছিল না। ঘরে আর ফেরা হয় না এই মানুষদের, ‘ঘরের মুখে আর কি রে/ কোনো দিন সে যাবে ফিরে।’ পথহীনতার মধ্যে পথ খোঁজার তাগিদে তারা যখন ঘরছাড়া, তখন তাদের সামনে থেকে সরে যায় বাধার দেয়াল, ‘দেয়াল যত সব গেল টুটে\’

স্বপ্নে মাতাল মানুষদের কথা যখন বলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর প্রকৃতি পর্যায়ের এই গান আর প্রকৃতি-বন্দনা নয়, হয়ে ওঠে মানব-অস্তিত্বের অন্যতর আকুতিবহ সংগীত। বৃহত্তর জীবনের প্রতি প্রবল টান যে-মানুষদের করে স্বপ্নতাড়িত, একত্র ও সক্রিয়, তাদের সঙ্গে জুটে আরো কতক সাথি, একই রকমভাবে মুক্তির তাগিদে উন্মাতাল, যেমন দেখি গানে, ‘আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে যত মাতাল জুটে – যত মাতাল জুটে।’ বৃষ্টি-নেশাভরা এমন প্রদোষকালেই নিজেকে বুঝি মনে হয় বলরামের চেলা।

কী ছিল চে গুয়েভারার স্বপ্ন, আর কোন মাতালদল তাঁকে ঘিরে হয়েছিল নৃত্যপর? বন্দি চে-র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন তিনি এসেছেন বলিভিয়ায়? চে-র পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কি বলিভিয়ার কৃষকদের জীবনের করুণ দশা দেখতে পাচ্ছেন না? তাদের অবস্থা প্রায় বর্বর যুগের মানুষদের মতো, দারিদ্র্যপীড়িত এমন এক জীবন যা হৃদয়কে উদ্বেলিত করে। একটি মাত্র ঘর, সেখানেই থাকা-ঘুমানো-রান্নাবান্না, পরবার মতো জামা তাদের নেই, প্রায় পশুবৎ এই জীবন।’

প্রশ্নকর্তা তাকে বলেছিলেন যে, কিউবার চাষিদের অবস্থাও তো প্রায় একইরকম। জবাবে চে বলেছিলেন, ‘সেটা এখন আর সত্যি নয়। আমি অস্বীকার করছি না যে, কিউবাতে দারিদ্র্য নেই, তবে চাষিরা অন্তত জীবন পাল্টাবার আশা ফিরে পেয়েছে। অন্যদিকে বলিভিয়ার কৃষকদের জীবন আশাহীন এক অস্তিত্ব, জন্মেই যে-অন্ধকার তারা দেখে, মৃত্যুও ঘটে সেই অন্ধকারে।’

তাঁর দলে বিদেশি যোদ্ধা রয়েছেন এমন অভিযোগের উত্তরে সহবন্দিদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চে বলেছিলেন, ‘কর্নেল, এদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জীবনে যা চাইবার কিউবায় সবকিছুই তাদের ছিল, কিন্তু এখানে তারা এসেছে কুকুর-বিড়ালের মতো মৃত্যুবরণ করতে।’

এসব মাতাল-দলে ছিল উইলির মতো বিপ্লবী, ছায়াসঙ্গী হয়ে চে-র পাশে সদা-বিরাজমান, এমনকি মৃত্যুতেও তাঁর সাথি; ছিল খাপ-খোলা তরবারির মতো তানিয়া, জার্মান-আর্জেন্টিনিয়ান বংশোদ্ভূত যে-তরুণী হয়েছিল গেরিলা কমান্ড্যান্ট, যাঁর ছিন্নভিন্ন দেহ হয়ে পড়েছিল শনাক্তের অযোগ্য হয়ে, চে-র মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে যিনি বরণ করেন শাহাদাৎ। অপার এক ভালোবাসায় সকল কিছু ত্যাগে এরা হয়ে ওঠে একেবারেই বেপরোয়া, অনন্য।

বাঁ-পায়ের হাঁটুতে গুলি লেগে চলৎশক্তি হারিয়েছিলেন চে, তার কারবাইন গুলির আঘাতে হয়ে পড়েছিল অকেজো, আগেই খুইয়েছিলেন পিস্তলের ম্যাগাজিন, এই অবস্থায় বন্দি হলেন তিনি, তাঁকে নিয়ে আসা হলো লা হিগুইরার চালাঘর, স্থানীয় বালক-বালিকাদের স্কুলগৃহে। চে গুয়েভারা ধৃত হয়েছেন, গোপন এই বার্তা পেয়ে চুটে এসেছিল বলিভিয়ার সেনা কর্মকর্তা ও সহযোগী সিআইএ এজেন্ট। চে-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি কিউবান না আর্জেন্টিনিয়ান?’ তাঁর জবাব ছিল, ‘আমি কিউবান, আর্জেন্টিনিয়ান, বলিভিয়ান, পেরুয়ান, ইকুয়েডিরিয়ান… বুঝতে পারলেন তো।’

পাহাড়ি গ্রামে যে কয়েক ঘর মানুষের বাস, তারা এসে ভিড় করেছিল চে গুয়েভারাকে দেখতে। স্বপ্নতাড়িত এই বন্দি তো যা না পাওয়ার তার প্রত্যাশাতেই লড়াই করেছেন। আগতদের মধ্যে ছিলেন স্কুলের তরুণী শিক্ষয়িত্রী জুলিয়া কর্টেজ। তাকে স্কুলঘরের ব্ল্যাকবোর্ড দেখিয়ে চলৎশক্তিহীন মৃত্যুপথযাত্রী চে বলেছিলেন, বোর্ডের লেখায় ব্যাকরণে ভুল রয়েছে। আরো বললেন, শিশুদের শিক্ষাদানের ঘর এমন করুণ ও হতশ্রী হওয়াটা লজ্জাজনক। এই যৎকিঞ্চিৎ কথোপকথন মৃত্যু-দুয়ারি গেরিলা যোদ্ধার প্রত্যাশা ও দায়িত্বশীলতা, স্বপ্ন ও কর্মের এমন মাত্রা মেলে ধরে, যেখানে সামান্যের মধ্যে অসামান্যতা আমরা খুঁজে পাই, নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছাপিয়ে যায় স্বপ্নতাড়িত প্রত্যাশা, ‘যা না চাইবার তাই আজি চাই গো/ যা না পাইবার তা কোথা পাই গো।’ এই চাওয়া এবং না-পাওয়া যখন দূর বলিভিয়ার গ্রামের দরিদ্র চাষির পুত্র-কন্যাদের সুশিক্ষার সুযোগ ঘটাবার প্রত্যাশার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং সেই প্রত্যাশা যখন সব সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলে শোষণ ও পীড়নের আন্তর্দেশীয় নব্য-সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও পুঁজির শাসনের মহা-আয়োজনে, তখন আমরা বুঝি চে গুয়েভারার আকুতি তো রবীন্দ্রনাথের গানের শেষ পঙ্ক্তির মতো মরে অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে। কিন্তু অসম্ভব জেনেও মাথা কুটে মরতে প্রস্ত্তত যে-মানুষ, তিনিই তো অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার বাণীমন্ত্র শোনাতে  পারেন, তিনি আমাদের কালের বলরাম, সর্বকালের সর্বদেশের মুক্তি-মন্ত্রদাতা চে গুয়েভারা।

বলরামকে বলা হয় অনন্ত-অবতার, শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তিনি, গদাযুদ্ধের ন্যায়নিষ্ঠ বীর। পুরাণে কথিত আছে মৃত্যুকালে তাঁর মুখ থেকে রক্তবর্ণ সহস্রমুখ সর্প-নির্গত হয়ে সাগরশয্যা গ্রহণ করে। বলরামের চেলা হয়েই কি বিশ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন চে গুয়েভারা, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে সহস্রফণা নাগস্বরূপ যার বিস্তার?

সেই নাগ আজ কি বশীভূত হয়ে পড়বে বাজার অর্থনীতির সর্বগ্রাসী বিস্তারের কাছে? পণ্যভোগী সমাজমানস জোরদার করে তুলতে আইকন ও ব্র্যান্ডিংয়ের যে-ব্যবহার তার বশংবদ কি হয়ে পড়বে চে গুয়েভারা? রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরে মানবতার যে শাশ্বত বাণী শ্রুত হয়, চে গুয়েভারার জীবনও মানবমুক্তির সেই আকুতির গীতিরূপ, অনন্তনাগ হয়ে যা রক্ষা করবে মুক্তির স্বপ্ন, দানবের প্রবল আধিপত্যকারী বর্তমানের বাস্তবতা পেরিয়ে।