তানভীর মোকাম্মেলের বেহুলা বাংলা ও অন্যান্য কবিতা কাব্যগ্রন্থের শুধু বেহুলা বাংলা সিরিজের কবিতাগুলি নিয়ে আমি এ-আলোচনাটা করব। সেই দশম-দ্বাদশ শতাব্দী থেকে বাংলার প্রাচীন যেসব সাহিত্যনিদর্শন রয়েছে, যেমন চর্যাপদ, সেখানে আমরা নদীর কথা পেয়েছি, পেয়েছি নৌকা বাওয়ার কথা, জেলেদের কথা, মাছ ধরা ও মাছ ধরার নানা উপকরণ এবং মাঝিদের কথা। অর্থাৎ বাংলার প্রকৃতির মাঝে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি সেটি হলো নদী। বাংলার একেবারে দক্ষিণে গেলে সাগর মিলবে। কিন্তু বাংলার নদীগুলি এই জনপদের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ভেতরে-বাইরে, সর্বত্রই প্রবাহিত। তাই এই নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের সাহিত্যে যখন কোনো ধারা তৈরি হয়, তা উপন্যাস হোক, গল্প বা নাটক হোক, অথবা তানভীর মোকাম্মেলের মতো কোনো সংবেদনশীল মানুষ যখন কোনো কাব্যমালা তৈরি করেন, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, এর সঙ্গে একেবারে সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকে আবহমানকালের বাঙালির নদীকেন্দ্রিক জীবনের একটা আলাদা সম্পর্ক রয়েছে, আলাদা একটা ধারা, সেটাকেই যেন তিনি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান।
সপ্তডিঙা মধুকর যে-দেশে গাঙ বেয়ে আজো আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সে-দেশের অন্দরে-বাহিরে, চেতনে-অবচেতনে অবিরামই যেন এক স্রোতস্বিনী নদী বহমান। নদীর সঙ্গে বাংলার জনপদগুলি, তার নিত্যকর্ম থেকে অন্তর্জলী যাত্রা পর্যন্ত, এক সুগভীর বন্ধনে বাঁধা। হাজার বছর আগেও বাংলা সাহিত্যে তাই আমরা নদীর সঙ্গে এ-জনপদের মানুষের সম্পর্কের কথা দেখতে পাই। যেমন চর্যাপদের একটি পদে দেখি :
সাঙ্কমত চড়িলে ডান-বাম ন হই।
একটা কথা সাহিত্যে আমরা প্রায়শই বলি, রি-রিডিং বা পুনর্পাঠ। প্রকৃতপক্ষে যে-কোনো সাহিত্যেরই পুনর্পাঠ হয়, আমি একটা গল্প পড়ি, কবিতা পড়ি বা উপন্যাস পড়ি, সেটা দ্বিতীয়বার যখন ভালো লাগছে তখনই রি-রিডিংটা তৈরি হচ্ছে। সাহিত্য ফর্মটির পুনর্পাঠ হচ্ছে। তানভীর মোকাম্মেলের এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি আমি যখন পড়ছি, লক্ষ করি, লোকজ নায়িকা বেহুলার কথা তিনি যেমন লিখেছেন, এর সঙ্গে সঙ্গে আবহমানকালের বাংলার যে ঐতিহ্য, বাংলার যে সাহিত্যের ধারা, এ-দুটো যেন খুব চমৎকারভাবেই মিশে যাচ্ছে। ভাবনার সেরকম একটা অবস্থান থেকেই আমি কবিতাগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
আমরা দেখেছি যে, সর্পে দংশিত স্বামীর জীবনের আশায় গাঙুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে যায় অনমনীয়, নিঃসঙ্গ বেহুলা। ঘাটে ঘাটে জন্ম নেয় অনেক গল্পকথা, সাক্ষী থাকে অশ্বত্থ, বট, হিজলের ঝোপঝাড়। লখিন্দরের দেহ অবশেষে প্রাণ ফিরে পায়। সর্পদংশিত মানুষকে কলার ভেলায় আজো ভাসিয়ে দেয় গ্রামবাংলা, এক অলৌকিক পুনর্জন্মের প্রত্যাশা নিয়ে। আমি নিজেও এটা দেখেছি যে, এখনো গ্রামাঞ্চলে কোনো শিশুকে হয়তো সর্প দংশন করেছে, তাকে কলার ভেলায় মশারি টানিয়ে পুনঃপ্রাণের আশায় জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই নদীতেই বাংলার বসত, নদীতে ভেসে যাওয়া এবং পুনর্জীবনের সম্ভাবনাও।
বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সময়কালের যে-চিহ্ন ‘মঙ্গলকাব্য’ তার যুগপরিসরের কেন্দ্রে আছে নদী। নদী তাই বাংলা সাহিত্যে কখনো উপকরণ হয়ে এসেছে, কখনো বা নিজেই চরিত্র হয়ে উঠেছে। যেমন আমরা মনসামঙ্গল কাহিনির পদ্মাবতীকে দেখব, যা মনসারই আরেক নাম। তাই মনসামঙ্গল কাব্যেরও অপর নাম পদ্মাপুরাণ। সেখানেও অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপে এসেছে নদী। তবে এ-কাব্যধারাটি শুধু পূর্ববঙ্গের নয়, যদিও ধারাটির শুরু হয়েছিল পূর্ববঙ্গের কবিদের হাত ধরে। যেমন তানভীর মোকাম্মেলের মতো কবি পূর্ববঙ্গের আবেগ দিয়ে বেহুলাকে নিয়ে লিখেছেন; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও এই কাব্যধারাটির উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই।
এখানে আমরা লক্ষ করব যে, মনসামঙ্গল কাব্যের কেন্দ্রে হচ্ছে গঙ্গা, যার সতীন মনসা। কাব্যের সূচনায় তাঁর আচার-আচরণ অনেকটা সাধারণ নারীর মতোই। মনসার জন্ম পাতালে। আমরা দেখব তাঁর আরেক নাম পদ্মাবতী আর তাঁর ভূষণ হলো নানা ধরনের সর্প। বিষধর সব সর্প নিয়ে মনসা সর্বদাই রণসাজে সজ্জিত। দুই সতীন গঙ্গা-পদ্মা, সর্বদাই দ্বন্দ্ব চলছে তাদের মধ্যে। মনসা তাঁর সখী নেতার পরামর্শ গ্রহণ করে জনলোকের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নানারকম ছলাকলা ও কৌশল অবলম্বন করে কিছু রাখাল বালক-বালিকার কাছ থেকে নিজের পূজা আদায় করে ছাড়ে। তবে তাঁর পরম উদ্দেশ্য হলো চাঁদ সওদাগরের পূজা তাঁকে আদায় করতে হবে। আমরা বুঝতে পারি, মনসামঙ্গলের এই গল্পে যেন ফুটে ওঠে বণিকের সঙ্গে সান্ত সমাজের দ্বন্দ্বের রূপটি। ধনী বণিকেরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই অন্যরা যতই পূজা পাঠ করুক, যতক্ষণ না চাঁদ সওদাগরের মতো বণিকেরা তাঁকে পূজা দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মনসার মর্যাদা ঠিক উন্নীত হচ্ছে না।
আমরা এবার দেখব মনসা কীভাবে নানা ছলনায় বা ফাঁদে ফেলে চাঁদ সওদাগরকে বিপর্যস্ত করেছেন। আমরা দেখি যে, চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যে গেছেন গর্ভবতী সনকাকে বাড়িতে রেখে। পথে তাঁর ঘটেছে চূড়ান্ত বিপর্যয়। যখন তিনি ফিরে এসেছেন তখন জন্ম হয়েছে লখিন্দরের। চাঁদ সওদাগরের যে বাণিজ্যতরী ডুবে গিয়েছে বা অন্যান্য ক্ষতি হয়েছে পুত্রের মুখ দর্শন করে সে-দুঃখ কিছুটা যেন তাঁর লাঘব হলো। এরপর আমরা দেখি লখিন্দর বড় হয়, বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং লৌহনির্মিত বাসরঘরে সর্পদংশনে একদিন মৃত্যু ঘটে লখিন্দরের। এরপর বেহুলা স্বামীর মৃতদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে ভেলায় তুলে গাঙুরের জলে ভাসিয়ে নিয়ে রওনা হয় দেবস্থানের উদ্দেশে। এখানে আমাদের গাঁথার সমাপ্তি আর কবি তানভীর মোকাম্মেলের কাব্যের সূচনা।
এবার দেখা যাক তানভীর মোকাম্মেল তাঁর কবিতায় ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, কী ইঙ্গিত করেছেন। আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি কবিতার বই এটি। বাঙালির ঐতিহ্য এবং বাঙালির মনের কথাকে যেন তিনি ধারণা করেছেন তাঁর কবিতায় অনন্য এক গভীরতায়। শুধু তাই নয়, আমাদের যেসব পুরাণকথা রয়েছে, যেমন রামায়ণে সীতাকে নিয়ে যে-মিথ রয়েছে যে, সীতা মানেই দুঃখের এক প্রতিমূর্তি। কবি তানভীরও তাঁর কবিতায় সীতার মতোই, বা তার চেয়ে একটু অন্যরকমভাবে, বাংলা কবিতায় বেহুলাকে সেরকমই দুঃখের প্রতিমূর্তি রূপে আরেকটি মিথ যেন প্রতিষ্ঠা করলেন। এটা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। কেননা যে-বাংলা কবিতায় আমরা এতদিন দুঃখিনী সীতার মিথটিকেই জেনে এসেছি কবি তানভীর সে-মিথটিকে অতিক্রম করে বাংলার একান্ত নিজস্ব লোকজ দুঃখিনী বেহুলার মিথকে নতুনভাবে যেন রূপদান করলেন।
আমরা দেখব কবি তানভীর মোকাম্মেল তাঁর কবিতায় অনবদ্য সুন্দর কতগুলি বাক-প্রতিমা তৈরি করেছেন। যেন কতগুলি ছবিই তিনি তৈরি করলেন। যেমন সতেরো নম্বর কবিতাটি।
দুঃখিনী বেহুলা গাঙুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে চলেছে, রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টি তার গায়ে এসে পড়ছে। কবি এখানে খুব চমৎকার এক চিত্রকল্পে যেন বলেছেন যে, এই যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীগুলি রয়েছে, এরা যেন এক-একটি নারী। বেহুলার সহমর্মী হয়ে তারাও যেন প্রতিবাদ করছে। বাঙালি রমণীরূপী এসব নদী যেন বেহুলার দুঃখে কখনো কখনো রুষ্ট হয়ে উঠছে, কখনো উঠছে ফুঁসে। এখানে নদী যে নারী তা আমরা আগে থেকেই জানি; কিন্তু বেহুলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে তাদের যে-গতিধারা সেটাকেই কবি এনেছেন ভারী চমৎকার নান্দনিকতায় :
সন্ধ্যার কালো জলে এঁকেবেঁকে ঘোরে
মনসার দূতেরা এই ভেজা বাংলায়
পদ্মা মেঘনা যমুনা মধুমতী
যৌবনবতী নদীরা সব কোন্ অভিমানে
ফুঁসে উঠে নিজেকে ছড়ায়;
নতুন এক চিত্রকল্প যেন তৈরি হলো। এবং এর সঙ্গে যোগ করেন :
তাহাদের জলজ কামনা মেটাবে যে সবল পুরুষ
ইতিহাস অপেক্ষায় রয়।
আমরা জানি যে, বেহুলাকে শেষ পর্যন্ত স্বর্গে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে খুশি করতে হয়েছিল তাঁর নৃত্যগীত দ্বারা। তানভীর মনে করছেন, এটা নারীর এক অবমাননাই। বেহুলার তো ইন্দ্রকে মনোরঞ্জক নৃত্যগীত দ্বারাই খুশি করতে হয়েছে, বেহুলার দুঃখ-কষ্ট বা ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখে তো আর ইন্দ্র বর দেননি যে, তোমার স্বামীকে তুমি ফিরে পাবে। পরবর্তী স্তবকটিতে তাই চমৎকার এক তীক্ষèতায় কবি তানভীর মোকাম্মেল বলছেন :
তোমাকে নাচতেই হো’ত ইন্দ্রের
কামুকী সভায়; রমণীর মাংসল হিল্লোল ছাড়া
পুরুষের অব্যর্থ মনোরঞ্জন কবে আর হয়।
কাব্যগ্রন্থটিতে বিষণ্ন সনকাও হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র :
দুইশত, পাঁচশত, হাজার বছর
শ্রাবণে আর আশ্বিনে প্রতিটা বানভাসির পর
খড়কুটো তুলে রুক্ষ এলোচুলে অসহায় সনকা
ছড়িয়ে পা ভেজা উঠানে
কড়ি দিয়ে দিন গুণে যায়।
শবরীর অপেক্ষা আমরা জানি; কিন্তু এই যে সনকার অপেক্ষা, চাঁদ সওদাগর গেছেন বাণিজ্যে, কবে তিনি আসবেন তা অনিশ্চিত। আর চাঁদ সওদাগরের তো তখন ভয়াবহ বিপদ, তাঁর অন্যান্য পুত্র যারা ছিল তারাও বিপর্যস্ত। সনকা তাই কড়ি দিয়ে দিন গুনে যান কবে চাঁদ সওদাগর ফিরবেন ঘরে। শুধু সনকার অপেক্ষা নয়, অপেক্ষমাণ অসহায় চিরন্তন এক নারীমূর্তির ছবিটি তিনি এঁকেছেন খুবই কাব্যিক ছন্দময়তায় :
খড়কুটো তুলে রুক্ষ এলোচুলে অসহায় সনকা।
এই সনকা যেন আমাদের অতিচেনা। গ্রাম বাংলার কোনো এক বৃদ্ধ মা, তার উস্কোখুস্কো চুল, বাড়ির পুরুষেরা হয়তো দূরে কাজে গেছে, কবে ফিরবে জানা নেই। এই যে বাংলার নারীদের অধীর অসহায় প্রতীক্ষা, তার চিরন্তন এক প্রতীক হিসেবেই যেন সনকাকে এখানে আমরা দেখতে পাই।
আবার বাঙালির যে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশত্যাগ, তার যে-রক্তক্ষরণ, তার যে বেদনা ও আঘাত, বেহুলার রূপকে এ-কাব্যগ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন তা ফুটে ওঠে। যেমন একটা কবিতায় দেখি :
বেহুলা নেই পাশে
(বেহুলা এখন রিলিফ ক্যাম্পে ঘোরে
অমরার দেবতারা যদি কিছু দেয়)
একা লখিন্দর নিরুদ্দেশ ভেসে চলে
মান্দাসের পলকা ভেলায়।
এখানেও আমরা দেখি সেই দেশভাগের ক্ষত, মুক্তিযুদ্ধের উদ্বাস্তু জীবনের বেদনা, বেহুলার মতো বাংলার নারীদের জীবনে যা বারবার ঘটে গেছে ইতিহাসে। একজন তরুণী নারী হয়ে মান্দাসের ভেলায় বেহুলা তাঁর স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে, দু-পাশের মানুষজন তাঁকে নানা ধরনের প্রলোভন দেখাচ্ছে, কেউ বা তাকে তার তপস্যা থেকে বিরত হওয়ার জন্য বলছে, কেউ বলছে – তুমি সার্থক হবে না, শুধু শুধুই যাচ্ছ। এরকম নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই বেহুলাকে পৌঁছাতে হচ্ছে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। এছাড়া পথের দু-পাশের নানা রকম বাধাবিঘ্ন তো আছেই। তবে বেহুলা তার শারীরিক এসব কষ্ট-যন্ত্রণাকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। রোদ্দুর, ঝড়-বৃষ্টিতে হয়তো কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে; তারপরও বেহুলা তার সংকল্পে অটল থেকেছে। বেহুলা যেন হয়ে ওঠে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এদেশের সংগ্রামী নারীদের যন্ত্রণাবিদ্ধ বেদনার এক প্রতীক। বেহুলার মতো এখানেও যেন নারীরা অসহায় হয়ে রিলিফ ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেবতারা যেমন দাক্ষিণ্য করেছিলেন বেহুলাকে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা দিয়ে, ঠিক তেমনি যদি রিলিফের কর্তাব্যক্তিরা কিছু খাবার-দাবার দেয়, তবে যেন বেহুলার প্রতীকে প্রাণ ফিরে পাবে রিলিফ ক্যাম্পের অসহায় মানুষেরা।
আবার তাঁর তিন নম্বর কবিতায় তিনি বলছেন –
কতগুলি মারণসাপ এড়াবে তুমি লখিন্দর
যতই গড় নিñিদ্র বাসর
বাঁচাবে তোমায় কেবল প্রেম বেহুলার।’
অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারছি, প্রেম এমন একটি সম্পর্ক যা সমস্ত আঘাত দূর করতে পারে। কালনাগিনী লখিন্দরকে দংশন করেছে, তার মৃত্যু হয়েছে এবং সেই অনিবার্যভাবে মৃত মানুষটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে কেবল বেহুলার প্রেম, ঐকান্তিক সাধনা ও ত্যাগের কারণেই তো।
পদ্মাপুরাণ শেষ হয়ে যায়নি, মঙ্গলকাব্যও ওই পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে শেষ হয়নি। এই আধুনিক কবি, তিনি যদি নতুন করে বেহুলাকে নিয়ে মিথ তৈরি করতে পারেন, বেহুলাকে নিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন অসামান্য সব কবিতা, তাতে আমাদের মনে হয়েছে, এ-যুগেও বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি ভালোভাবেই প্রাসঙ্গিক, এ-গ্রন্থে যা বাংলার দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের যন্ত্রণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, বা ভবিষ্যতে আরো কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে, অসহায়-দুর্গতি বা বেদনা-বিচ্ছেদে বিপর্যস্ত বাংলার নারীকে, বা কবিকেও, আরো সাহস জোগাবে। তাই দেখি কবি তানভীর মোকাম্মেল বলছেন :
হতে যদিও চাও কবি বাংলার
শতবার লিখবে তুমি পদ্মাপুরাণ
শতবার কাটবে তোমায় সর্প মনসার
শতবার গড়বে তুমি বেহুলার স্বপ্নের ঘর;
আজ তাই আর বিবাদ করি না কারো সাথে
শিখিয়েছো তুমি ডানে কিম্বা বামে কী-বা আসে যায়
কাউকে তুচ্ছ পুজে সমস্যার সমাধান
যদি মৃত্যুহীন ভালোবাসায় হয় ॥
এই কবিতা লেখার জন্য কবিকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমরা।
আরো অনেক চমৎকার সব উপমা, চিত্রকল্প ও প্রতীক জড়িয়ে রয়েছে ব্যতিক্রমী এ-কাব্যগ্রন্থে, যেমন বেহুলা তো দিন-রাত্রি, বিভিন্ন ঋতু গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ, ঝড়-জল পার হয়ে যাচ্ছে – কবি তার প্রতি দেখছি বোধ করছেন এক গভীর সহমর্মিতা এবং তা জাগিয়ে তুলছেন আমাদের পাঠকদের মনেও –
বেহুলাকে কোর না চোখের আড়াল
নদীর কিনার ধরে চলো তার সাথে।
এখানে চমৎকার একটি আধুনিক শব্দবন্ধ তিনি ব্যবহার করেছেন ‘চৈত্রের চিতারোদ’; বাঘের ঝাঁজের মতো সেই যে-রোদ যা চোখ একেবারে অন্ধকার করে দেয়, হলুদ কালো চিতাবাঘের শরীরের গঠন যেন তার –
চৈত্রের চিতারোদ ঝরাবে যখন
মুক্তা ঘাম ওই মঞ্জুল মুখে
মেঘ হয়ে ছায়া দাও ওকে।
এখানে ‘চিতারোদ’ উপমাটি আধুনিক এ-কবির একটি মৌলিক ও চমকপ্রদ শব্দবন্ধ।
এ-গ্রন্থের কবিতাগুলিতে এমন আরো কিছু অভিনব শব্দবন্ধ রয়েছে যা আমাদের আবিষ্ট করে, আমাদের মায়া-মমতার বোধকে জাগিয়ে তোলে সুগভীরভাবে। আমরা যেন বেহুলাকে স্বচক্ষে দেখতে পাই, বেহুলা যেন হয়ে ওঠে আমাদের ঘরেরই একজন সংগ্রামী নারী। আমাদের ব্যক্তিজীবনের নানা দুঃখ-শোক বা কোনো আঘাতে বিপর্যস্ত এ-কাব্যগ্রন্থের নারী পাঠিকারা নিজেরাও যেন আমরা কখনো কখনো হয়ে যাই বেহুলা। নারীদের যে আস্তিত্বিক গভীর এক দুঃখবোধ রয়েছে এটা তো সহজে বোঝাবার নয়। কিন্তু সংবেদনশীল এ-কবি একজন পুরুষ হয়েও যে সেটা বুঝেছেন তা নিঃসন্দেহে এক আনন্দের বিষয়। বলছেন :
ঝরঝর শ্রাবণে ভিজবে যখন
ওই দীঘল কালো চুল
মুছে দাও সে অশ্রু অমলার মমতায়
বাঙ্গালী নারীর বিধুর বেদনা
কবি ছাড়া আর কে বুঝবে?
যদি সুখী হতে চাও ছুঁতে চাও মহাকাল
বেহুলাকে মাছচক্ষু করে
বাংলার সব কটি নদীর কিনার ধরে
হেঁটে চলে বিমুগ্ধ পায়ে অনন্তকাল।।
‘মাছচক্ষু’ – এটিও একটি চমৎকার প্রতীকী শব্দবন্ধ। আমরা জানি, মাছের চোখের দিকে তাকিয়ে মহাভারতে একদিন লক্ষ্যভেদ করা হয়েছিল। পুরাণের সেই উপমা কত যথার্থতায়ই না এখানে উঠে এসেছে!
আমি আগেই বলেছি যে, বেহুলাকে নৃত্যের দ্বারা ইন্দ্রের মনোরঞ্জন করে তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল। কবি তার কবিতায় নারীদেহের প্রতি পুরুষের যে চিরন্তন স্থূল কামনা সেটাকে সঠিকভাবেই প্রকাশ করেছেন :
তোমাকে নাচতেই হো’ত ইন্দ্রের
কামুকী সভায়; রমণীর মাংসল হিল্লোল ছাড়া
পুরুষের অব্যর্থ মনোরঞ্জন কবে আর হয়;
তোমাকে ভাসতেই হোত একাকী
মান্দাসের ভেলায়; সতী নারীর পতি ছাড়া
আর কিবা গতি; গলে পচে
ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ বিকৃত শব
ভালোবাসার এত বড় মৃত্যুপরীক্ষা
দিয়েছে কী কখনো কোনো পুরুষপুঙ্গব?
তারপর বেহুলাকে উদ্দেশ করে বলছেন –
তোমাকে জিততেই হোত এহেন লাঞ্ছনা মানবীর
প্রেমের আশীর্বাণী নয় তো শুধু
ছিল আরো এক কঠিনতর যুদ্ধ তোমার
নারীর সম্মান আর মানুষী অধিকার।
নারীকে এই যে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব দেওয়া, নারীকে সম্মান দেওয়া, এ-কাব্যগ্রন্থে এটি চোখে পড়ার মতো প্রশংসনীয়। এই সমাজে পুরুষ হয়েও কবি জানেন নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টির কথা। তবে আমরা নিঃসন্দেহে বলব যে, এটা সামগ্রিক কোনো উচ্চারণ নয়। আমরা জীবনে অনেক পুরুষকে দেখেছি, অনেকের সঙ্গ পেয়েছি, অনেক পুরুষের দ্বারা উপকৃত হয়েছি এবং তাকে ভালোওবাসি। কারণ আমরা জানি, এই পৃথিবীতে নারী-পুরুষ দুজনেরই পরস্পরকে দরকার। কিন্তু আমরা এটাও জানি, পুরুষের যে লোভ বা হাতছানি বা তার যে আরো অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি, যেটার কথা কবি এখানে বলেছেন, তা থেকে সব সময় নারীরা নিজেদের বাঁচাতে পারেনি। তাই কবি এখানে দেবতা বলে ইন্দ্রের যে একটা আলাদা মর্যাদার আসন ছিল সেটাকে পুরোপুরিই ভেঙে দিয়েছেন। প্রথাগত সেই দৃষ্টিভঙ্গি যে, দেবতা মানেই তার সবকিছু মহৎ – এমনটি মনে করার কোনোই প্রয়োজন তিনি দেখেননি। পুরাণে ইন্দ্রের এই লোলুপতার দৃষ্টান্ত আমরা আরো অনেক ক্ষেত্রে পাই। রামায়ণে অহল্যার মিথ আছে, সেখানেও আমরা এমনটি দেখতে পাই। বেহুলাকে আরো মহত্তর এক প্রেক্ষাপটে উপস্থিত করে এরপরেই কবি বলছেন –
তোমাকে আসতেই হোত হৈমন্তীর
এই বাংলায়; আমাদের নগ্ন নগরে ও
খিন্ন গৃহকোণে, কাকভোরে আর বিজন দুপুরে
জ্যোৎস্নাহীন রাতে কিম্বা ধোঁয়াশা সন্ধ্যায়
মানবীর এত বিচিত্র অসম্মান
দুঃখিনী সনকা আর দেখেছে কোথায়?
নারীর এই অসম্মান আমরা কিন্তু দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার ঘরে ঘরে দেখেছি। কিন্তু যুদ্ধোত্তর সমাজও কি আমাদের নারীদের তার যোগ্য সম্মান দিয়েছে? বা যেখানে দাঙ্গা বা যুদ্ধ হয়নি সেখানেও কি নারী নিজ গৃহে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু সবসময় পায়? পায় না। এজন্য পুরুষের দায় আছে, হয়তো দায় আছে নারীদেরও। শুধু পুরুষ বলব না, আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাই যে মানসিকতা তৈরি করেছে সেই জায়গাটাতে নারীর জন্যে সৃষ্টি হয়েছে এক বিচিত্র অবস্থান। সমাজে নারীরা হয়তো কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং নারীদের আপেক্ষিক একটা স্বাধীনতাও রয়েছে বটে; কিন্তু সেটা আর কতটুকু? এই সমগ্র সমাজের সামান্যতম এক অংশই মাত্র সে-সুবিধা পায়। বেশিরভাগ নারীই তো স্বাবলম্বী নন, সম্পদে ও ক্ষমতায় তাদের অধিকার সামান্যই। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও কবির কবিতায় নারীর শক্তিটা তাহলে ঠিক কোথায়? কিছুই তো ছিল না বেহুলার। তবুও তো সে পেরেছে। এক দৃঢ় প্রতিবাদী নারীর চিরন্তন প্রতীক যেন হয়ে ওঠে বেহুলা, সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে যে দাঁড়িয়েছিল একাকী। তাই দেখি কবি তানভীর মোকাম্মেল বলছেন –
নদীর পারে নীরবে দাঁড়ানো বিনম্র বেহুলা
অপরাজিতা রইলে চিরন্তনী
ক্ষমতার অপমান আর প্রেমের অভিমানে
জলজ বাংলার নারী তুমি চিরবজয়িনী।।’
কবি এখানে বেহুলাকে ‘অপরাজিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, চিহ্নিত করেছেন ‘চিরন্তনী’ হিসেবে। তিনি বললেন যে, সমস্ত বাঙালি কবিকেই এই বেহুলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই বেহুলা একটা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়ে যায়নি, শুধু মঙ্গলকাব্যেই তার পরিসমাপ্তি নয়। বেহুলা আধুনিক নারীরও প্রতীক, যে-কোনো প্রতিবাদী নারীরই প্রতীক, সয়ে যাওয়া দুঃখ-বেদনার প্রতীক। এ বেহুলা কালান্তরের, যুগান্তরেরও। তার অস্তিত্ব ও লড়াই আধুনিক কবির কবিতাতেও যে তাই উঠে এসেছে। তানভীর মোকাম্মেলের কবিতায় আমরা এ-বিষয়টাকে খুব বলিষ্ঠভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। ভারী চমৎকার আরেকটি বাক্প্রতিমা তৈরি করেছেন তিনি –
দুয়ার আঁটা রাতে
শেয়ালের যুথবদ্ধ ডাক
চৌকিদারের মেজাজী হাঁক
ভুলে যেয়ে শবযাত্রীদের করুণ মন্ত্রপাঠ
যদি তুমি শিশিরের শব্দ শোনো
আর যদি নাই-ই শোনো
ভোরে কপাটের বাইরে
যদি দেখ ঘাসের উপরে
এক ফোঁটা অশ্রু
জেন বেহুলা এসেছিল
আর কেনই-বা কেঁদেছিল সে।।
এই যে চমৎকার একটা ছবি তৈরি হয়ে যাচ্ছে বেহুলার, যদি আপনার আর কিছু নাও জানা থাকে, তারপরেও যখনই দেখবেন ঘাসের ওপর এক বিন্দু শিশির, সেটি যেন বেহুলার অশ্রুবিন্দু হিসেবেই অনুভূত হবে। এরকম চমৎকার কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতাও আমরা এ-কবির মধ্যে দেখতে পেলাম।
মুক্তিযুদ্ধের অবসানে যেমন একটি নতুন দেশের আলো জ্বলেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, বেহুলার সেই বিজয়িনী রূপ যেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের শত বেদনার মাঝেও বারবার দেখতে পাই। কখনো দেশমাতৃকার রূপে, বা দেশের আদ্যা নারীশক্তি রূপে, বেহুলাকে কবি তাই বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করেছেন। ভারী সুন্দর করে কবি এখানে বলছেন –
আমি ভাষাহারা কবি এক গাঙুরের পারে
আজো শুনি আত্মার নির্জন গভীরে
সজল বাতাসে আর শাপলাভেজা জলের তলায়
কালে অকালে বিলাপের সুরে
কারা যেন বেহুলার গান গায়।।
অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমরা শুনতে পাচ্ছি না, বাইরের হয়তো কেউ সোচ্চারে কীর্তন বা অন্য কোনো ভাবনার মধ্য দিয়ে উচ্চকিত কোনো গান গাইছে না। কিন্তু যে-কোনো সংবেদনশীল মানুষ যদি এই বাংলায় হৃদয় পাতে তাহলে বেহুলার বিলাপের কান্না আজো সে ঠিকই শুনতে পাবে। যেমনটি শুনতে পেয়েছেন এ-কবি।
আবার দেখি বেহুলা বিজয়িনী হয়েছে ঠিকই তবে সে শুধু তার স্বামীর জীবনই ফিরিয়ে আনেনি, স্বামীর অন্য ভাইয়েরা আর যারা ছিল, বা তার সম্পদের যা ক্ষতি হয়েছে, সে সমস্ত কিছুই দেবতাদের কাছ থেকে সে ঠিকই কিন্তু আদায় করে নিয়েছে। কাজেই বেহুলা কেবল একার জন্য সংগ্রাম করেনি, শুধু নিজের স্বামীর কথাই ভাবেনি, সে সকলের মঙ্গলের কথাই ভেবেছে। যূথবদ্ধ দেশপ্রেমের যে-রূপ তারও প্রতীক হিসেবে বেহুলা যেন চিত্রিত হয়ে রয়েছে এ-কবিতায়।
আরেকটি কবিতায় দেখি কবি কীভাবে স্মরণ করছেন বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে –
পশ্চিমের সিঁদুর মেঘ কার ছবি আঁকে
দু’পারে বেহুলা গ্রাম
কীর্তনের কান্নাভেজা সুর ভেসে আসে
দোলে শীর্ণ বাঁশপাতা বিষণ্ন বাতাসে
কার স্বপ্নমায়ায় আছন্ন আজ এ রিক্ত বেলাভূমি
ছলছল নদীর জল কার সুরে কাঁদে;
একাকী বকপাখীটি ঘরে ফেরে সাঁঝে
বৈষ্ণবীর মাধুকরী সুর
সেই কবে হারিয়েছে গোষ্ঠের রাখাল
এ মায়াবী সন্ধ্যা বৃথা অপেক্ষায় সাজে;
তবুও অন্ধ বাউল এক অচিন একতারে
গোপালের বাংলার সুর আজো খুঁজে ফেরে।।
কালচেতনা ও ইতিহাসচেতনা এ-কাব্যগ্রন্থের এক বিশেষ সম্পদ হয়ে রইল।
বেহুলার যে-বেদনা, বেহুলার যে-ক্রন্দন, তা যেন আজো বাংলার প্রতিটি নদীর ঢেউয়ে কান পাতলে শোনা যায়। বাংলার কবি অনুভব করতে পারেন নদীর প্রতিটি ঢেউয়ের মাঝে বেহুলার সেই অব্যক্ত কান্না কেমন করে লুকিয়ে আছে এবং এ-বিষয়টিকে কবি তাঁর কবিতায় নানা উপমা ও রূপকে চিত্রিত করতে চেয়েছেন।
একটি কবিতায় আবার দেখি কত চমৎকারভাবেই না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেহুলাকে একাত্ম করেছেন এ-কবি –
লোহার বাসরঘর গড়তে পারিনি আমরা
কালনাগিনী সে বর্ষাঝরা রাতে চম্পকনগরে
মানুষেরা পড়েছিল ঢলে এক করাল কালঘুমে;
এখানে যেন তিনি এ বঙ্গদেশে ঘটে যাওয়া আরো এক ভয়াবহ মৃত্যুর দিকেই ইঙ্গিত করছেন :
বহুদিন ধরে তৈরী হয়েছে মনসা
মরণছোবল বিষ জমিয়েছে নাগিনী
সাদা বাড়ীতে দেবতারা দেখে গেছে সব
প্রতিবাদ করেনি;
গড়া হো’ল ছিদ্রময় ঘর
অকৃতি হো’ল নাম বিশ্বকর্মার
আজো তাই আমরা স্বজনহারা
কেঁদে ফিরি গাঙুরের এপার-ওপার।
যেন আজো বেহুলার যে-বেদনা, যে-ক্রন্দন, সেটি এ-যুগেরও আরেকটি ঐতিহাসিক মিথে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এ-বিষয়ে কবির প্রত্যয়ও দেখি আমরা –
তবে সেই থেকে আমরা জানি
লোহা নয় অনন্ত সে বাসর গড়া চাই জমাট ভালবাসায়
আর চাই নিñিদ্র প্রেমের প্রহরা প্রতিটা প্রহর;
হারিয়েছি লখাইকে
হারাতে চাই না জীবনদায়ী বেহুলাকে আর।।
এখানে মৃত লখাই যেন হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি কিন্তু দ্বিতীয়বার নিরাপত্তাহীনতার ওই ছিদ্র আমরা আর রাখতে চাই না। নিñিদ্র করব এই বাংলাকে, যাতে আর কোনো কালনাগিনী এদেশের মানুষের ভালোবাসায় ছোবল মারতে না পারে। এখানে কবির যে-দেশপ্রেম তা যেন বেহুলার মিথটির ভাবনার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। অর্থাৎ যেটা ছিল মনসামঙ্গলের একটি অসামান্য গাঁথা, কবি তানভীর মোকাম্মেলের কলমের ছোঁয়ায় সেটি এখানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে আধুনিক দেশপ্রেমে। আসলে মঙ্গলকাব্যগুলির বাইরের আবরণটা দেবতার, কিন্তু মূলত তো সেটা সমাজের কথা, মানুষেরই কথা। কবি তানভীর মোকাম্মেল তাকে নতুন রূপ দিলেন এই বেহুলা বাংলার কবিতায় এবং এই প্রজন্মের তাঁর যে-পাঠক, তাদের তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, বেহুলার যে-কষ্ট, যে-ক্রন্দন, যে-সংগ্রাম, সেটি আজো শেষ হয়ে যায়নি। আবারো নতুনভাবে মনসা ছোবল মারতে পারে আর তার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। শেষে কবির আরেকটি লাইন আমি উদ্ধৃত করব :
ফিরে এস অভিমানী বেহুলা
বাংলার গাছপালা নদী ও মানুষ
এক অনন্ত অনুশোচনায় আজো অপেক্ষায়।।
যা সব ভুল হয়ে গেছে আমাদের ইতিহাসে, যেমন দেশভাগ বা মুক্তিযুদ্ধের সময় নারকীয় সব ঘটনা, আমরা জানি হাজার হাজার মা পুত্রহারা হয়েছিলেন, হয়েছেন স্বামীহারা, নিজেরা হয়েছিলেন ধর্ষিত, বিপন্ন হয়েছে তাঁদের জীবন, সেই পরিস্থিতির জন্য আমাদেরও হয়তো ত্রুটি ছিল। যদি আমাদের দেশপ্রেমে থেকে থাকে কোনো ত্রুটি, কিংবা হয়তো আরো আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার ছিল প্রয়োজন, অনেক কিছুই হয়তো ছিল আরো ভালো মতো বোঝার। সেই ভুল যেন আর না ঘটে আমাদের। কবির সঙ্গে আমাদেরও অনুশোচনা তাই বাংলার সেই সমস্ত দুঃখিনী নারীর জন্যে। প্রতিটা যুগের বেহুলাদের জন্যে।
দেশভাগের সকল যন্ত্রণা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহ সব গণহত্যা, এসবের পরেও কবি তানভীর মোকাম্মেল বাংলার ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ভরসা রাখেন বেহুলার সেই সংগ্রামী স্পৃহারই ওপর, আস্থা রাখেন মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই। ওঁর ভাষায় –
তবুও বেহুলার ভেলা
আজো ভাসে এক অচিন স্বর্গের কামনায়
ঐন্দ্রজালিক বাঁশি এক বেজে চলে কোন্ সে সুদূর
আজো সে বাঁধে পায় আশার নূপুর
চরৈবেতি চলে বুকের গভীরে কে ডাক দিয়ে যায়
কবি তুমি জেন মানুষ ভুল করে
মানবতা শুধরিয়ে যায়।।
কবি শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে চেয়েছেন। আর বাংলার সংগ্রামী নারী বেহুলাই যেন হয়ে ওঠে সেই আশাবাদের প্রতীক ও কারণ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.