বাংলা ভাষার বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি

এক মাস হয়ে গেল পিতৃসমতুল্য একজন অভিভাবকের প্রস্থান হলো। জাতি হারাল একজন শিক্ষাবিদকে, যিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ১৪ মে ৮৩ বছর বয়সে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয় সিএমএইচে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শরীরে করোনার উপস্থিতি ছিল। মানে করোনা ভাইরাসই কেড়ে নিল বাঙালি জাতির এই জাগ্রত মানুষটিকে।
স্যার যে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাসায় গিয়েই বুঝতে পারি। এরপর দেখা হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি খন্দকার রাশিদুল হকের দেওয়া ঢাকা ক্লাবে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। আবার দেখা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে। কিন্তু সেই দেখাই যে শেষ দেখা হবে, কখনো ভাবিনি।
স্যারের শরীর ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। মার্চের শেষদিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিতই খোঁজ রেখেছিলাম। সিএমএইচে যেদিন স্থানান্তর করা হলো, সেদিন তীব্র একটা কষ্ট অনুভব হওয়ায় ভাবিকে ফোন করলাম। ভাবির সঙ্গে কথা বলে ৯ মে ফেসবুকে তাঁর শরীর খারাপ নিয়ে একটা পোস্টও দিই। এরপর ১৩ মে ভাবির সঙ্গে কথা বলে ফেসবুকে আবার আপডেট দিই। ভাবি বলেছিলেন, তাঁদের মেয়ে স্যারকে দেখে এসেছেন। তিনি কিছুটা ভালোর দিকে। প্রার্থনা করতে বললেন আমাদের। বললাম, ‘ভাবি, আমি কেন, বাংলাভাষী সব মানুষই স্যারের জন্য প্রার্থনা করছেন। আপনি ভালো থাকবেন।’ ২৪ ঘণ্টাও পার হলো না। স্যারকে আমাদের হারাতে হলো।
ব্যক্তিগতভাবে অনেক স্নেহ, অনেক উপদেশ পেয়েছি স্যারের কাছে, বহুভাবে আমি ঋণী হয়ে থাকব। দীর্ঘ পথযাত্রায় মুক্তধারার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর অনেক স্মৃতি। আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রতি ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। তাই বারবার যোগ দিয়েছেন বইমেলাসহ আমেরিকার বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সম্মেলনগুলোতে। মুক্তধারার প্রতি ছিল তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা।
যতদূর মনে পড়ে, ১৯৮৫ সালে স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় পুঁথিঘর-মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহার ৭৪ ফরাশগঞ্জের বাড়িতে পয়লা বৈশাখের ভোজে। স্যার তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভোজের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বরেণ্য লেখকদের প্রায় সবাই যোগ দিতেন। তখন বাংলাদেশের সাহিত্য ও প্রকাশনা বলতে মুক্তধারাকেই বোঝাত। চিত্তরঞ্জন সাহার লেখকদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল, তার টানেই সবাই সেই ঐতিহাসিক আড়াইতলা বাড়িতে উপস্থিত হতেন। সে-সময় মুক্তধারায় সার্বক্ষণিক সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও আমীরুল ইসলাম। জহর লাল সাহা, প্রভাংশুরঞ্জন সাহা, অজিত রঞ্জন সাহা, মিন্টু রঞ্জন সাহা ও স্বপন সাহারা তখন চিত্তরঞ্জন সাহার কর্মযজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। ’৮৪ সালের শেষদিকে আমি, শ্যামল দত্ত, অশোক নাগ, যুবরাজ দাস, ভবরঞ্জন দাসসহ একঝাঁক তরুণ কর্মী মুক্তধারায় যোগ দিই। মূলত সে-সময় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয়-সম্পৃক্ততার শুরু।
১৯৮৭ সালে মোস্তফা জব্বার-সম্পাদিত সাপ্তাহিক আনন্দপত্রের ঈদসংখ্যার দায়িত্ব পালনকালে লেখা সংগ্রহ করার সুবাদে ড. আনিসুজ্জামান, আবু ইসহাক, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তারপর তো এরশাদের পতন হওয়ার কিছুদিন পরই ১৯৯১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আমি আমেরিকায় চলে আসি। আসার পর নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাসীতে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আমেরিকায় প্রথম বাংলা বইয়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুক্তধারা নিউইয়র্কের কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয় জাতিসংঘের সামনে শহিদ মিনার স্থাপন করে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রথমবারের মতো ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আমেরিকায় বাংলা বইমেলার গোড়াপত্তন। বাংলাদেশে অনেক দিন যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
১৯৯৫ সালে নিউইয়র্ক বইমেলার দ্বিতীয় দিন স্যারকে নিয়ে এলেন তাঁর ভায়রা মোবারক হোসেন শাহ নিউজার্সি থেকে। আমাদের সে কী আনন্দ। আমরা জানতামই না স্যার যে নিউজার্সিতে এসেছিলেন বেড়াতে। স্যারকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো একটি আলোচনা অনুষ্ঠান। সে-বইমেলায় যে-কথাটি বলেছিলেন, আমেরিকায় অভিবাসী বাঙালিরা যে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করছে, তা তো ভাবাই যেত না। যেখানে একটি বাংলা শব্দ শোনার জন্য সপ্তাহের ছয়দিন অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে বাংলা বইমেলা হচ্ছে, সাহিত্য চর্চা হচ্ছে – এটা একটা বিশাল পাওয়া। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার ফলেই কিন্তু বাংলাভাষী মানুষেরা আজ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে বইমেলা করছেন। আগে এটা ছিল না। এর একটা ভালো দিক হলো, দেওয়া আর নেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যে-সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করবে। স্যার সেবার এক বিকেল ছিলেন নিউইয়র্কে। রাতে ফিরে গেছেন নিউজার্সিতে।
আবার চার বছর পর দেখা হলো ১৯৯৯ সালের ৬ জুন টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরে। সেখানকার সংগঠন ‘অবাকে’র উদ্যোগে সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। স্যারের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরো এসেছিলেন আহমদ ছফা ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদার। লন্ডন থেকে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। মুক্তধারার বইয়ের স্টল নিয়ে আমিও তখন অবাকের আমন্ত্রণে সে-অনুষ্ঠানে যোগ দিই। অনুষ্ঠানশেষে আনিসুজ্জামান স্যারসহ সবাই নিউইয়র্কে বেড়াতে আসেন। মুক্তধারার উদ্যোগে আমরা আয়োজন করি লেখক-পাঠক আড্ডা।
১৯৯৯ সালে আমি আমেরিকায় আসার পর প্রথম বাংলাদেশে গেলে সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয় উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্তধারা নিউইয়র্ক শীর্ষক সেমিনার। সেই অনুষ্ঠানে কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেনসহ আরো অনেক লেখক-সাহিত্যিক আলোচক ছিলেন। ২০০১ সালে মুক্তধারা নিউইয়র্ক-প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র উদ্বোধনেও তিনি ছিলেন।
আর ২০০৭ সালের কথা তো কখনো ভোলার নয়। বইমেলা উপলক্ষে পুরো এক মাস তিনি ভাবিসহ আমাদের সঙ্গে আমেরিকায় কাটিয়েছেন। সে-বছর আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা আমেরিকার চারটি শহরে অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্কের লাগোয়ার্ডিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত বইমেলা উদ্বোধন করেন গোলাম মুরশিদ। ডালাস কনভেনশন সেন্টারের বইমেলা উদ্বোধন করেন ড. আনিসুজ্জামান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্যার বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের কথা বলেন। বলেছেন, এখানকার অভিবাসী সমাজের জীবনযাপন নিয়ে রচিত লেখাই একদিন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে। এখানে জন্ম হওয়া পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাকে মূলধারায় তুলে ধরবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বইমেলা উদ্বোধনের সময় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন। লস অ্যাঞ্জেলেস বইমেলা উদ্বোধন করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নিউজার্সির বইমেলা উদ্বোধন করেন সমরেশ মজুমদার। সেবার বইমেলায় চারজন উদ্বোধক ছাড়াও আরো যোগ দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, ফেরদৌস ওয়াহিদ, হাবিব ওয়াহিদ, মাহমুদুজ্জামান বাবু, কুদ্দুছ বয়াতি, কৌশিকী চক্রবর্তী, প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, মহিউদ্দীন খান খোকন প্রমুখ। বাংলাদেশ থেকে আরো এসেছিলেন অনেক শিল্পী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা।