বাঙালির নব-নব জাগরণের বৃক্ষপুরুষ

১৯৪৭-এর ১৪-১৫ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদে ভারতভাগ ও সেইসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম অখণ্ড বাঙালি জীবনে এক সার্বিক বিপর্যয় বহন করে আনে। তখনকার সংবাদপত্র, রেডিও আমাদের গতানুগতিকতায় নতুন যে কিছু শব্দ নির্মাণ করে প্রায় অভ্যাসে পরিণত করে দিতে পারে, তা হলো উদ্বাস্তু, শরণার্থী, শরণার্থী শিবির, উদ্বাস্তু শিবির, ত্রাণ, ছিন্নমূল, জবরদখল কলোনি, বাস্তুহারা প্রভৃতি।

‘রিফিউজি’ উদ্বাস্তুর এই যে ইংরেজি অর্থ, তাও আমাদের জিভে সাঙ্গীকরণের মাধ্যমে ক্রমশ যেন বাংলাই হয়ে ওঠে। ‘রিফিউজি কলোনি’ শব্দটিও প্রায় একইভাবে জুড়ে যায় আমাদের লেখা ও বলার সঙ্গে সঙ্গে।

র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদে খাতায়-কলমে ভারত ভাগ হলো। তারপর ধীরে ধীরে পাসপোর্ট, ভিসা, বর্ডার সীমান্ত, নো ম্যানস ল্যান্ড, কাঁটাতার, চোরাচালান, অনুপ্রবেশ, অভিবাসন-ইমিগ্রেশন, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইপিআর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পাকিস্তান রেঞ্জার এসব শব্দ-গাম্ভীর্য ও আচরণে রাষ্ট্র ক্রমশ তার দখলদারি থাবা বিস্তৃত করতে থাকল।

দেশভাগ বাঙালি জীবনের অন্যতম বড় বিষাদালাপ, ভাঙন। সবকিছু ছারখার হয়ে যাওয়ার করুণ বিউগল লাস্ট পোস্ট। অথচ তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে, বঙ্গের পশ্চিমাংশে, খণ্ডিত বঙ্গে তেমন কোনো তরঙ্গাভিঘাত ফুটে উঠল কি সাহিত্যচর্চায়? সিনেমা, নাটক, চিত্রকর্ম-পেইন্টিং, স্কালপচারে?

নিমাই ঘোষ ছিন্নমূল করলেন। সেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা-পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক। আর ঋত্বিক তথাকথিত ‘পাগল-ভৈরব’ ঋত্বিক কুমার বাংলা ভাগ, দেশভাগের বেদনা নিয়ে নির্মাণ করে গেলেন একের পর এক ছবি। মাত্র আটটি পূর্ণফিচার ছবির পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক দেশভাগ, উদ্বাস্তুজীবন, ভাঙা বঙ্গের জন্যে অপরিসীম বেদনা তুলে নিয়ে এলেন। কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো সবেতেই ভাঙা বাংলা, ভঙ্গবঙ্গ দেশের জন্য যন্ত্রণা। এমনকি দুর্বার গতি পদ্মাতেও এই অশ্রুলেখা। পশ্চিম বাংলার উদ্বাস্তু বাঙালির হয়ে যেন একা একা অশ্রুপাত করে গেলেন ঋত্বিককুমার। তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম নাগরিক মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর।

ভারত ভাগের কাঁটাতার বিদ্ধ করে, ছিন্নভিন্ন করে পাঞ্জাবকেও। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র উত্তরপ্রদেশ ও কাশ্মীর ভাগ হয়নি। যদিও পরে খানিকটা কাশ্মীর দখল করে পাকিস্তান তার নাম দেয় ‘আজাদ কাশ্মীর’। ভারতীয় রাজনীতির ভাষায় তা হয়ে দাঁড়ায় পিওকে পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর।

দেশভাগের ছবি ও তার আগেপরে দাঙ্গা, অবিশ্বাস, বেদনা, আর ঘৃণার বাতাসকে সাদাত হোসেন মান্টো, ইসমত চুখতাই, ভীষ্ম সাহানি, কিসান চন্দর, রাজিন্দর সিং বেদি যেভাবে তুলে নিয়ে এলেন, পশ্চিমবাংলায় তা হলো না। কেন হলো না, তার কারণ হিসেবে বেশ কিছু কথা বলা যায়। সেই প্রসঙ্গে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। ‘খোল দো’, ‘টোবা টেক সিংহ’, ‘ঠান্ডা গোশতে’র মতো গল্প অথবা তমস, পেশোয়ার এক্সপ্রেসের উচ্চতার উপন্যাস লেখা হলো কোথায়, এই বঙ্গে? এমনকি লাজবন্তীও তো লেখা হলো কী? একটু চটুল সসি লেখার খুশবন্ত সিংয়ের কলম যে ট্রেন টু পাকিস্তান লিখে ফেলতে পারল, তারও তো একটা বেদনা আছে, জাতিসত্তার বেদনা। সেই রাস্তাতে কি পৌঁছতে পারল দেশভাগ বিষয়ে এই বঙ্গের আখ্যানকারদের নির্মাণ?

যাক সেই প্রসঙ্গ।

দেশভাগ পার্টিশান যে আজো কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের শিল্পে, সাহিত্যে তার প্রমাণ আজো লেখা হচ্ছে খণ্ডিতকরণের সেই ক্রন্দনমালা নিয়ে নিবন্ধ-প্রবন্ধ। আখ্যান।

বাঙালি জাতিসত্তার মস্তিষ্ক, হাত, পা সবই দ্বিখণ্ডিত দেশভাগের পর। বাঙালির অসমাপ্ত ও বিতর্কিত রেনেসাঁসের ভাবনাবোধ খণ্ডিত হলো। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস সবই একে একে এলো ধূম্রনির্মিত লণ্ঠন হয়ে। এই ধোঁয়া-লণ্ঠনের দুঃসহ যাত্রা, কালাতিপাত আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার যাত্রাপথ অনেকটাই চিহ্নিত হলো তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলন, সর্বত্র বাংলাভাষাকে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগের দাবিতে বহু মানুষের আত্মত্যাগে, শাহাদতে শহিদত্ব বরণ করার মধ্যে। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার সেইসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সকলের কথাই স্মরণ করতে হবে এই প্রসঙ্গে।

বাঙালির জিজ্ঞাসাময় বহু প্রশ্নে দীর্ণ অসমাপ্ত, উনিশ শতকীয় খণ্ডিত রেনেসাঁস সত্তর-একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেন নতুন করে প্রাণ পেল। নতুন এক রাষ্ট্র তৈরি হলো ভাষা ও সংস্কৃতি চেতনার রুদ্র পলাশে। বাঙালি জাতিসত্তার এই নব পর্যায়ের যে নবজাগরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই মর্তভূমির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, মূলত তাঁরই নেতৃত্বে রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নামের মহাকাব্য, সেই মহাকাব্যিক রূপরেখাই হয়তো বাঙালির আর-এক নবজাগরণ অথবা পুনর্জাগরণ।

বলতে দ্বিধা নেই আবুল হাসনাত ছিলেন সেই রেনেসাঁস অথবা পুনর্জাগরণের অন্যতম ব্যক্তিপুরুষ। তাঁর জন্ম ১৯৪৫-এ, ভারত ভাগের দু-বছর আগে। প্রয়াণ ২০২০-এর পহেলা নভেম্বর। ৭৫ বছর, এখনকার আয়ুষ্কালের হিসাবে, এমন কিছু দীর্ঘ জীবন নয়। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি বহু কাজ করেছেন, যা দেখলে বিস্ময় লাগে।

তিনি সিপিবি কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ বাংলাদেশেরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাস অনুযায়ী। আমরা অনেকেই জানি অথবা জানি না, মণি সিংহ, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের নেতৃত্বে চলা সিপিবিকে বলা হতো মস্কোপন্থী বা সোভিয়েত পক্ষানুসারী। বিপ্রতীপে মুহাম্মদ তোয়াহা, সিরাজ শিকদার প্রমুখ পিকিংপন্থী রাজনৈতিক পথ ও দর্শনে বিশ্বাসী। পরে তৈরি হয় জাসদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল আবু তাহের। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর, ন্যাপ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা ভাসানী, এঁরাও নিজেদের ভাবনা-দর্শনে তখনকার ‘চীনপন্থী’ বা পিকিংপন্থী। মস্কো-পিকিং ভাগ তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রবল। বহু বছর হলো সোভিয়েত দেশটাই তো নেই। চীনও পুঁজির সাধনায় আদর্শ-ফাদর্শের ওপর ব্ল্যাকটেপ সেঁটেছে, ফলে আজকের পৃথিবীতে আবার সোভিয়েতপন্থী, চীনপন্থী! কথায় বলে না, স্যান্ডো গেঞ্জির আবার পাশ-পকেট! সেই সোভিয়েতও নেই, সেই ‘লাল চীন’ও না।

২০২০-এর ১ নভেম্বর প্রয়াত হলেন বাঙালির মনন ও ভাবনার অন্যতম উজ্জ্বল ধারা আবুল হাসনাত, সে-কথা আগেই লিখেছি। এই কোভিড-কালবেলায় পৃথিবী জুড়েই নিভে যাচ্ছে প্রজ্ঞা, মেধা ও মননের এক-একটি বাতিস্তম্ভ। কালি ও কলম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। আমরা জানি কালি ও কলম বাংলা ভাষা ও বাঙালির জীবনচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে দুই দশক ধরে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘দৈত্য’রাই শুধু নন, সারা পৃথিবীর ‘জায়ান্ট’দের মন ও মননের খবর দেয় কালি ও কলম। এই মাসপত্রটি পড়তে পড়তে মস্তিষ্কগভীরের সমস্ত বাতায়ন খুলে যেতে থাকে এক এক করে নয়, একসঙ্গে। আর চমকে চমকে ওঠে সম্ভাবনার বিদ্যুৎ।

আবুল হাসনাত সংবাদ নামে যে দৈনিক সংবাদপত্র, সিপিবির ছায়ালগ্ন, তার বৃহস্পতিবারের সাময়িকীটি একসময় সম্পাদনা করতেন। বলা বাহুল্য, অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে।

খান সেনার দখল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় তাঁর লেখা নৃত্যনাট্য লালগোলাপের জন্য খুবই উজ্জ্বল ছিল। বিষ্ণু দে, দেবব্রত বিশ্বাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মায়া সেন এই নৃত্যনাট্যটির খুবই প্রশংসা করেন।

কালি ও কলমের একটি সংখ্যায় শামসুর রাহমানের কাব্যকৃতি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি লেখেন,

প্রথম কাব্যগ্রন্থেই শামসুর রাহমানের মার্জিত ছন্দ ও চিত্রকল্পের উদ্ভাবন এ-দেশের কাব্য-আন্দোলনে অনুকূল সাড়া ফেলেছিল। সতীর্থ সৈয়দ শামসুল হক এ-প্রসঙ্গে বলেন, ‘কবিতায় শামসুর রাহমান একজন শামসুর রাহমানই; প্রথম দিকে তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের কিছুটা আলো পড়লেও, কখনো তাঁর কবিতা শেকড় হারায়নি, এই কাব্যগ্রন্থের ‘রূপালী স্নান’, বা ‘তাঁর শয্যার পাশে’ ধরনের ওই সময়ের কয়েকটি কবিতা বাদে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রত্যক্ষ করি বটে, কিন্তু তিনি বাঁক ফেরেন ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের প্রভাবেই। এই বাঁক ফেরার ও বিবর্তনের সঙ্গে শামসুর রাহমান গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন ষাটের দশকের প্রভাবসঞ্চারী আন্দোলনের সঙ্গে; প্রতিদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রত্যক্ষণ ও এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত আবেদন তাঁর কবি সত্তাকে ভিন্নভাবে বিকশিত ও উচ্চমানে অধিষ্ঠিত করে, তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ হয়েছিল এক দশক আগে। তিনি ছিলেন নিম্নস্বরের মৃদু উচ্চারিত নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত কবি, এই আন্দোলনে দুর্মর চেতনা নির্মীয়মাণ প্রয়াসে নবীন ভূখণ্ড-অভ্যুদয় ও বাঙালি সমাজের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার নবীন প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এ অনুধাবনে আমাদের এতটুকু দ্বিধা হয় না। এই সময়ে যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁরা সকলে জানেন কীভাবে তাঁর সময়চেতনা ও দেশচেতনা নিরালোক দিব্যরথে, নিজ বাসভূমে গ্রন্থে প্রকীর্ণ হয়ে আছে। বিষ্ণু দে-কে খুব শ্রদ্ধেয় মনে হয় তাঁর সময়-চেতনায়। এই চেতনারই প্রসার দেখতে পাই পরবর্তী কাব্যগ্রন্থাবলিতে। একই সময়ে বিষ্ণু দে ও তাঁকে ঘিরে সাহিত্যপত্র পত্রিকা মার্কসীয় দীক্ষায় যে-আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং জনজীবনের সঙ্গে সাহিত্যের নিবিড় সংযোগের যে-প্রয়াস গ্রহণ করেছিল তা হয়ে ওঠে শামসুর রাহমানের জন্য ফলপ্রসূ। 

(‘শামসুর রাহমানের কবিতায় সময় ও চেতনা’)

পঁচাত্তর বছরের আয়ুষ্কালে তিনি লিখেছেন খুব কম নয়। সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর অন্যান্য তাঁর একটি প্রবন্ধসংকলনের নাম। পাশাপাশি তিনি নির্মাণ করেন জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন অন্যান্য। শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান তাঁর এই গ্রন্থে আবিষ্কৃত হন অন্যভাবে।

শিশু ও কিশোরদের কথা ভেবে তিনি লিখেছেন ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধ দিনের ধূসর দুপুর, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা। কিশোরদের জন্য সূর্য সেন, জসীমউদ্দীন, চার্লি চ্যাপলিনের জীবনী তাঁর কলম থেকে এসেছে।

তাঁর আত্মজীবনী প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য, হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। শুধু ঢাকা বা বাংলাদেশ থেকে নয়, কলকাতা থেকেও প্রাবন্ধিক অরুণ সেনের সঙ্গে যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি বই। কয়েক মাস আগেই প্রয়াত হয়েছেন অরুণ সেন। আবুল হাসনাতও চলে গেলেন।

সিপিবির অন্যতম নেতা মণি সিংহ তাঁর আত্মকথা লাইফ ইজ স্ট্রাগলে হাজং বিদ্রোহ, টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলনের কথা যেভাবে লিখেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্খ বিবরণে, কিংবা রণেশ দাশগুপ্ত যখন কলকাতায় এসে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস- নামাঙ্কিত বিদ্যালয় নির্মাণ করেন, সেই স্কুল অবশ্য মূলত রাজনৈতিক শিক্ষারই কেন্দ্র, সেইসব কথা মনে পড়তে থাকে একই সঙ্গে আবুল হাসনাতের প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়তে পড়তে, কখনো কখনো।

হাজং বিদ্রোহ নিয়ে এ-বাংলায় খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। মণি সিংহ লিখেছেন।

কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে থাকতেন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় থাকা বিপ্লবী গণেশ ঘোষ ও রণেশ দাশগুপ্ত। বিপ্লবী গণেশ ঘোষ ও রণেশ দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে গেছি বেশ কয়েকবার।

রামকিঙ্কর বেইজও থাকতেন এই উডবার্নেই, তাঁর ব্রেন টিউমার অপারেশনের আগে। লোকসংস্কৃতি-বিশারদ, মন্দির, মসজিদ শৈলী বিষয়ে গবেষক, পুরাতাত্ত্বিক অসুস্থ তারাপদ সাঁতরাও থাকতেন উডবার্ন ওয়ার্ডে। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই সবাই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। কৌশিকী নামে কী চমৎকার, পরিচ্ছন্ন লিটল ম্যাগাজিনে করতেন তারাপদ সাঁতরা। সেসবই স্মৃতি মাত্র।

আবুল হাসনাত তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা, পঠন-পাঠন, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও বোধ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সারস্বত পরিমণ্ডল, জ্ঞানবৃত্ত। সারাজীবন একজন মুক্তবুদ্ধির, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তিনি চর্চা করে  গেছেন বাংলা, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির।

যুক্তবঙ্গের উনিশ শতকীয় বঙ্গীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যে অসম্পূর্ণতাটুকু, তা বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন হয়ে পাকিস্তানবিরোধী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন, স্বতন্ত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নির্মাণের দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্ন স্পর্শের আদিগন্ত সম্ভাবনায় যে আলোকিত উচ্চারণ নিয়ে এসেছিল মুসলমান বাঙালি ও হিন্দু বাঙালির সামনে, সেই নবজাগরণের নবতম দর্পণাভাস ফুটে উঠেছে আবুল হাসনাতের বহু লেখা ও জীবনচর্চায়।

দেশভাগ বাঙালির মস্তিষ্ক, বাহু, পদ ও মননকে খণ্ডিত করেছে। বেদনাদীর্ণ হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সেই অসম্পূর্ণ বঙ্গীয় নবজাগরণের একটা অন্যতর রূপ মাত্র। জাতিবৃক্ষের খণ্ডিত পাকে সংযুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ এই জাতিসত্তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে নিজের পায়ে।

ঘাতক-দালাল বাহিনীর নেতা গোলাম আযমের ফাঁসি, শাহবাগের মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন প্রসারিত করেছে সেই বিশ্বাস ও বোধকে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই ফসল। আবুল হাসনাত সেই চেতনারই অন্যতম ধারক ও বাহক।  তাঁর প্রয়াণ অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধি, বামপন্থী বোধসম্পন্ন একটি ধারার পক্ষে বড় ক্ষতি।