বাঙালির সংস্কৃতি ভাবনার শেকড়ের সন্ধানে

‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল’ এর থেকে জীবনের নির্যাস নিয়ে; এই ভূখণ্ডে গড়ে-ওঠা আবহমান সংস্কৃতির উদ্দীপনাকে প্রাণে ধারণ করে; ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’য় মুখের বুলি ফুটিয়ে; ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ যে জাতিকে দেখে ‘এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’ – তা হলাম আমরা এই বাঙালিরা। বাঙালিকে বুঝতে হলে জানতে হবে তার চিন্তা-চেতনা, ভাব-বিশ^াসের উৎস; বুঝতে হবে তার যুক্তি, মূল্যবোধ, বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিমূল। প্রবহমানকালের সূত্র ধরে এই সবকিছুকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাঙালির এক অনন্যমাত্রিক মনন আর মানস, যা কি না বাঙালির একান্ত নিজস্ব দর্শন, তার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলমান সংস্কৃতির নিয়ামক, এর অন্যতম প্রধান অনুঘটক। বাঙালি আবেগপ্রবণ, ভীরু, দুঃখবিলাসী, পরলোকমুখী, তাই বলে কিন্তু বাঙালির চির প্রবহমান মনন আর মানসে দার্শনিক মনোবৃত্তির উপস্থিতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই কোনোভাবেই। কালের চক্রে, ‘দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে’র প্রক্রিয়ায় সংকর জাতি বাঙালির দার্শনিক মননেও সন্নিবেশ ঘটেছে নানান মতের, নানান পথের। সেই দর্শনে সমাপতন ঘটেছে ধর্মেরও। অধ্যাপক-গবেষক ক্ষিতিমোহন সেন একে বর্ণনা করেছেন এই বলে যে, ‘এখানে ধর্মে ও দর্শনে হরিহর আত্মা, দর্শনে কাব্যে গলাগলি।’ বাঙালির দর্শনে যেমন সমন্বয় ঘটেছে ধর্ম ও দর্শনের, তেমনি করে ভাববাদ আর বাস্তবতাবাদ এসে মিলেছে এখানে, আবার প্রচলিত ও লব্ধ সামাজিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্মিলন ঘটেছে ব্যক্তিগত মেধা, মনন, প্রজ্ঞা আর দৃষ্টিভঙ্গির।

আর এমন দর্শনকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রজন্মপরম্পরায় উদ্ভূত সাধারণ বাঙালির যাপিত জীবনের উপচার, উপাদান, পদ্ধতি, আচার, বিশ^াস, নীতি-নৈতিকতা, রুচি, শিল্পবোধ নিয়েই গড়ে উঠেছে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি। যাকে কি না সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ গোপাল হালদার ‘পল্লিপ্রধান বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন। এই  ‘পল্লিপ্রধান বাঙালি সংস্কৃতি’র পরিধি বিশাল ও ব্যাপক। একদিকে যেমন ‘এখানে ধর্মে ও দর্শনে হরিহর আত্মা…’, অন্যদিকে একান্ত গ্রামভিত্তিক সাধারণ, ছাপোষা মানুষের জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি এই সংস্কৃতির নিয়ামক। বাংলা নামক এই ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্র যদি হয় বাংলার গ্রাম, তাহলে সেই গ্রামই বাঙালির প্রবহমান সংস্কৃতির উৎস, লালন ও বিকাশের ক্ষেত্র। বাঙালির শেকড়ের খোঁজে, তার আত্মানুসন্ধানে তাই বারবারই ফিরতে হবে তার লোকজ জীবনের যাপিত ধারায়, তার লোকধর্ম এবং লোকায়ত দর্শনের ভিত্তিমূলে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আহমদ শরীফের উক্তিটি স্মরণ করা বড় যথাযথ হবে, ‘বস্তুত বাঙালীর ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসংগীতের ও লোকবিশ^াস-সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম।’

সংস্কৃতি কোনো স্থির, নিশ্চল বিষয় নয়, বরং তা বহতা নদীর মতো। কালক্রমে, প্রজন্মপরম্পরায় এর গতিপথ পাল্টায়, ঘটে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, রূপান্তর, উত্তরণ। মার্কিন দার্শনিক রিচার্ড ভেল্কলির মতে, সংস্কৃতির সত্যিকারের মানে হচ্ছে আত্মা বা মনের কর্ষণ। আর বাঙালি অধ্যাপক, দার্শনিক, লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি’ হিসেবে। সে-কারণেই একটি জাতির যাপিত জীবনের বিভিন্ন উপচার আর উপাদান মিলে যেমন তার নিজস্ব, অনন্যমাত্রিক কিন্তু চিরপ্রবহমান সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি তার আরেক অনিবার্য তথা অপরিহার্য উপাত্ত হলো মূল্যবোধ। আর তাই মূল্যবোধের সংযুক্তিতে জনপদের সংস্কৃতি তার নিজস্ব জনগোষ্ঠীকে সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়, আত্মানুসন্ধানের পথ দেখায়, সূক্ষ্ম জীবনের সুলুক সন্ধান দেয়। ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী খুব সোজা কথায় একে ব্যক্ত করেছেন  – সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে  সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও  মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা, গল্পকাহিনীর মারফতে, নরনারীর বিচিত্র  সুখ-দুঃখে বাঁচা, ভ্রমণকাহিনীর মারফতে, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা; ইতিহাসের মারফতে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

আর বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি এই জনপদের মানুষের সহজ, অনাড়ম্বর যাপিত জীবনের ‘প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা’র নিরন্তর প্রয়াসের মূর্ত এক রূপ। এই সংস্কৃতির ভিত্তি রচিত হয়েছে এই ভূখণ্ডের লোকায়ত জীবনদর্শনকে কেন্দ্র করে। চিরচেনা কৃষিভিত্তিক সমাজ, চারপাশের প্রকৃতি, যাপিত জীবনের পরিচিত, দৈনন্দিন অভ্যাস, আচারকে ঘিরে সাধারণ, গ্রামীণ মানুষের যে একান্ত ভাবনা, তার মূল্যবোধ, সূক্ষ্ম অনুভূতি – এসবের সন্নিবেশই হলো লোকায়ত বোধ। এই বোধ, এই মনন, এই জীবনদর্শন নিত্যকার আটপৌরে যাপিত জীবনের অতিচেনা সব জাগতিক উপাদান বা বস্তু; ঐহিক সব অনুভূতি; বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার সকল সংগ্রাম, সংঘর্ষ, প্রয়াস আর প্রাপ্তির আকাক্সক্ষাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এর সৃষ্টি, প্রচার আর প্রসার – সবেরই ভিত্তিমূলে রয়েছে একেবারে খেটে-খাওয়া, গ্রামীণ, ছাপোষা মানুষের সহজ, সরল, আড়ম্বরহীন আর বাহুল্যবর্জিত ইহজাগতিক চিন্তা আর পার্থিব জ্ঞান। আর প্রবলভাবে, গভীরভাবে রয়েছে ‘সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে’ বাঁচার তাড়না আর সেই তাড়না থেকে নিজেকে খোঁজার আর জানার পরম স্পৃহা। জীবন সম্পর্কে, কখনো বা যাপিত জীবন থেকে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবকে নিয়ে,  কখনো আবার এর থেকে উত্তরণের যাচনার প্রয়াসকে ঘিরে সাধারণ মানুষের নিবিড় উপলব্ধিই এর সারবস্তু।

লোকজ সাধক-কবি চিরচেনা জাগতিক আলংকারিক উপমার প্রয়োগে আর সহজিয়া ভাষায় লোকায়ত এই উপলব্ধির বারংবার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আর এটাই শাশ্বত চিরন্তন বাঙালির দর্শন, যার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে, কালে কালে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালি জাতিসত্তার মনের কর্ষণ হয়েছে; বাঙালি উন্নততর জীবনবোধের খোঁজে আত্মানুসন্ধানে নেমেছে। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিভাবনার গোড়ায় তাই রয়েছে সেই নিজেকে জানার, নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর এক অদম্য গভীর বাসনা। পরমাত্মার খোঁজ আর নিজেকে জানার বাঞ্ছা তাই একাকার হয়ে যায় বাংলার চিরকালীন সাহিত্য, দর্শন তথা সার্বিক সংস্কৃতিতে।

বাড়ির কাছে আরশী নগর, সেথা এক পড়শী বসত করে,

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।

গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা নাই তরণী পারে,

বাঞ্ছা করি দেখব তারে, কেমনে সেথা যাই রে …

(লালন সাঁই)

কে এই পড়শী? কীভাবে পৌঁছানো যাবে তাঁর কাছে? তাঁকে ছুঁয়ে দেখার, অনুভবে নেওয়ার, চোখে দেখার কী উপায়? তাঁকে পাওয়াই বা যাবে কীভাবে? এই ‘তিনি’ কিন্তু কোনো অপরিচিত বা সুদূর দেবলোকে বাস করেন না, বাস করেন ‘বাড়ির কাছে আরশী নগরে’ই। আর তাই তাঁকে ‘একদিন’ও দেখতে না পাওয়ার জন্য আক্ষেপ হয়। তাঁকে ছুঁয়ে দেখার অদম্য স্পৃহা হয়। আবার সাধারণ মানুষ তার অক্ষমতা আর সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে যেভাবে অপ্রাপ্তির আক্ষেপে সান্ত্বনার প্রলেপ দেয়; ঠিক তেমনি বাড়ির কাছের পড়শীকে একবারের জন্যও দেখতে না পাওয়ার খেদ ভুলতে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেন মরমি কবি। অগাধ পানি পার হওয়ার জন্য নৌকা নেই, তাই পড়শীকে দেখার ইচ্ছে পূরণ হয় না কিছুতেই। সহজ কথা, অতিপরিচিত চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে নেওয়া সরল রূপকল্প। কিন্তু কী অদ্ভুত গভীরতা, কী অতল দার্শনিকতা, কী বিশাল বোধ লুক্কায়িত আছে এর মাঝে। এখানে সত্যিকার অর্থেই ‘দর্শনে কাব্যে গলাগলি’ আর এটাই বাঙালির চিরন্তন মনন আর মানসের মূর্ত রূপ। এর চিত্রকল্প লোকজ, এর প্রেক্ষাপট গ্রামীণ, এর ভাবনা লোকায়ত; কিন্তু এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনীন।

এখন শেকড়ের সন্ধানে নেমে লোকায়ত ভাবনা বা দর্শনের ব্যুৎপত্তি নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। আমাদের চারপাশের চেনা এই জগৎকে যদি ‘লোক’ বলে ভাবি, তাহলে এই জগতের যতটুকু আমাদের দৃষ্টির গোচরে পড়ে, ততটুকু জুড়েই ‘লোক’-এর পরিসর, তার পরিধি আর পরিব্যাপ্তি এবং সেটাই লোকায়ত। ‘লোকেষু আয়ত = লোকায়ত’ এই বলে প্রাচ্যবিদ্যা ও সংস্কৃত বিশারদ এবং ইতিহাসবেত্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, ‘লোকের মধ্যে যা সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে বা পরিব্যাপ্ত হয়েছে তাই লোকায়ত’। আবার আরেক সংস্কৃত পণ্ডিত ও দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়ত শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘জনসাধারণের মধ্যে যার পরিচয় পাওয়া যায়।’ খুব সাধারণ, সাদামাটাভাবে বলতে গেলে, সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনই লোকায়ত জীবন।

লোকায়ত চিন্তার ভিত্তিমূলে আছে বস্তুবাদী ভাবনা, যেখানে বস্তুই প্রধান। বস্তু থেকেই সবকিছুর সৃজন আবার বস্তুতেই তার লয়। বস্তুই জগতের সব প্রাণের আধার। আর সাধারণ মানুষের কাছে তার সবচাইতে চেনা, একান্ত নিজের যে বস্তু, তা হলো, তার দেহ বা শরীর। বাঙালি মরমি কবি তাই বলেন, ‘সকলের সার হয় আপন শরীর/ নিজ দেহ জানিলে আপনে হবে স্থির।’ এই দেহে প্রাণ বা চেতনা প্রতিষ্ঠা হলে নতুন মানুষ সৃজন হয়, তার যাপিত জীবনের চলমানতার সূত্রপাত হয়, আবার একসময় প্রাণ তথা চেতনা বিয়োগে চলমান যাপিত জীবন লয়প্রাপ্ত হয়। অন্যভাবে বললে, দেহের বিনাশের মধ্য দিয়ে তার চেতনাও অবলুপ্ত হয়। এই প্রাণ বা চেতনা দেহেরই গুণ। সুতরাং দেহ ও চেতনা মৌলিকভাবে আলাদা কিছু নয় – ‘যাহা আছে দেহ ভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।’ তাই বাঙালির লোকায়ত ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানবদেহ আর অজড়, অনিত্য, শাশ^ত পরমাত্মার বাসও সেই মানবদেহেই। এই দেহকে নিয়ে, একে ঘিরে যে যাপিত জীবন আর জীবনের উদ্যাপন – সেটুকুই পরম আর চরম সত্য। এটুকুই আমাদের দৃষ্টির গোচরে পড়ে বলে আমাদের ‘লোক’-এর পরিধি আর পরিসর জুড়ে আছে তা। দেহের মাঝেই ব্রহ্মাণ্ডকে পাওয়া যায়। পরলোক, পরপার, স্বর্গ, নরক এসব অধরা, অদেখা আর তাই এসব নিছক কল্পনা মাত্র।

পরম আরাধ্য যে জীবনদেবতাকে মানুষ হন্যে হয়ে তালাশ করছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে আদি-অনন্তকাল ধরে, বাঙালির লোকায়ত ভাবনায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে এই ‘আটকুঠুরী’র মাঝেই। দেহখাঁচায় বন্দি আছে যে পরমাত্মা সে এক ‘অচিন পাখি’। তাঁকে ধরা বড় কঠিন। আর তাই তো একবার ধরতে পারলে মন-বেড়ি পরিয়ে তাঁকে বশে রাখার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু না পারার আক্ষেপ থেকেই যায় আজীবন।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়।

তারে ধরতে পারলে মন-বেড়ি, দিতাম পাখির পায়ে।

আট কুঠুরী নয় দরজা আটা, মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।

তার উপরে সদর কোঠা, আয়না মহল তায়।

(লালন শাহ)

কত সহজ কথা, কী সহজ তার রূপকল্প, কিন্তু কী গভীর তার বাণী। আট কুঠুরি, নয় দরজা নিয়ে তৈরি নশ^র এই দেহরূপী খাঁচার ভেতরে যে পাখিরূপী পরম আত্মা, সে তো বাঁধন মানে না। আর তাই তো তা থেকেই আমাদের যাপিত জীবনের সকল ভাব আর ভালোবাসা, দুঃখ আর যন্ত্রণা, সুখ আর শোক সব কিছুর উদ্ভব ঘটে। এই আত্মা বা চেতনা আছে বলেই দেহধারী এই মানুষের যেমন জীবনাভূতি আছে, আবার অন্যদিকে এই আত্মা বা চেতনার টিকে থাকার জন্য, তার উত্তরণের জন্য প্রয়োজন আছে জীবনাভূতির।

আমাদের লোকায়ত ভাবনা আমাদের প্রাণিত করে নিজের মাঝেই পরম আরাধ্য জীবন-দেবতার খোঁজ করতে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উচ্চকিত প্রচার আর প্রসারেও বাঙালির চিরন্তন লোকায়ত ভাবনা, লোকজ সংস্কৃতি জুড়ে ব্যক্ত হয়েছে পরমেশ্বর বিধাতাকে নিজের ভেতরেই খোঁজার নানান মত আর পথ। তাই মরমি কবি বলেন, ‘নদনদী হাতড়ে বেড়াও অবোধ আমার মন/ তোমার ঘরের মাঝে বিরাজ করে বিশ্বরূপী সনাতন॥’এর মাঝে একই সঙ্গে গভীর অধাত্ম্যবাদ এবং অনাধ্যাত্মিক জীবনবোধের অনন্যমাত্রিক সমন্বয় ঘটেছে। পরমাত্মা আসলে মনের মানুষ। দেহের খাঁচার ভেতরে যে মন, সেই মনের মাঝে তাঁর বাস। তাই নিজেকে খোঁজা আর জানার প্রয়াসের মাঝেই পরমাত্মার অন্বেষণ হয়। নিজের এই ‘দেহ’ তাই বাঙালির আবহমান লোকায়ত ভাবনায়, আমাদের লোকজ সাহিত্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সাধক কবি এই অন্বেষণে বড় পুলকিত বোধ করেন। আর এই ‘মনের মানুষ’ যেহেতু দূরবর্তী অচেনা কেউ নন, বরং নিজের ভেতরকার একান্ত আপনজন, তাই তাঁর রূপবর্ণনাতেও থাকে খুব সহজিয়া, চিরচেনা ভাব আর আন্তরিক উচ্ছ্বাস।

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে

আমার মাঝ’তো বাহির হইয়া দেখা দিলো আমারে

… নূরের বদনখানি যেন কাঞ্চা সোনা

আপনার রূপ দেখিয়া আপনি যে ফানা।

(হাছন রাজা)

‘মনের মানুষ’কে নিজের মাঝেই অন্বেষণের সেই একইরকম ভাবনা কিন্তু রবিঠাকুর কিংবা নজরুলের গানেও এসেছে বহুবার। রবিঠাকুর যখন বলেন, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি/ বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি’ কিংবা নজরুল যখন গান বাঁধেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/ খুঁজি তারে আমি আপনায়’, তখন আসলে সেই একইরকম ভাব প্রতিফলিত হয়। ‘মনের মানুষ’কে খুঁজতে আর কোথাও তাকানোর প্রয়োজন নেই। দরকার কেবল অন্তর্দৃষ্টির, যা দিয়ে ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়ে’ থাকা ‘আপনার চেয়ে আপন’জনকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আর এটাই বাঙালির চিরকালীন লোকায়ত সংস্কৃতিভাবনার গোড়ার কথা আবার এখানেই তার সমকালীন প্রাসঙ্গিকতাও নিহিত আছে।

এই নিজেকে জানা, চেনার মধ্য দিয়ে যে আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস, তা বাস্তবিক অর্থেই এক অন্তহীন যাত্রা। এই যাত্রার আদি নেই, অন্ত নেই। পথ জানা নেই, পাথেয় সঙ্গে নেই। তবু মরমি সাধকেরা এই দুস্তর যাত্রায় নামার জন্য ইন্ধন দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। এই অন্বেষণে ভরসা মেলে, শান্তি মেলে একমাত্র আন্তরিক সর্বৈব সমর্পণে। ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ – যেই ‘মনের মানুষ’-এর খোঁজে এই নিরন্তর যাত্রা, সেই দয়াময় পার করবেন কারণ ‘আমি যে পথ চিনি না’।

আমি অপার হয়ে বসে আছি, ও হে দয়াময়

পারে লয়ে যাও আমায়

… আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে না দেখি উপায়।

নাই আমার ভোজন সাধন, চিরদিন কুপথে গমন,

নাম শুনেছি পতিত পাবন, তাইতে দিই দোহাই।

(লালন সাঁই)

সংসাররূপী ভবসাগর পার হওয়ার রাস্তা সাধারণ সাদামাটা ছাপোষা মানুষ জানে না, শিখে উঠতেও পারে না সারাজীবনে। সমর্পণেই মেলে তার শান্তি আর স্বস্তি। সেই দয়াময় ‘তরাবেন’ এই ভরসার মাঝেও যেমন একদিকে আছে গভীর আধ্যাত্মিকতা, অন্যদিকে আছে অনন্য অনাধ্যাত্মিক জীবনবোধ। আর এই সমন্বয় বাঙালির দর্শন আর সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক সুবিশেষ মাত্রিকতা।

বাঙালির লোকায়ত মনন আর মানস, লোকজ সংস্কৃতি, লোকায়ত জীবনের যাপন ও উদ্যাপন প্রকৃতপক্ষে বহুবছরের নানান ভাবনা আর জীবনদর্শনের সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত ফসল। এতে করে এর মাঝে নানাবিধ, বহুমাত্রিক মানবিক ভাবনার নানান চিন্তাধারার সমন্বয় যেমন হয়েছে, তেমনি এর ভেতরে ইহজাগতিক অথচ দারুণ এক অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছে, যা বাঙালির একান্ত নিজস্ব। শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত সবকিছুকে ছাপিয়ে বাঙালির সংস্কৃতিভাবনার একেবারে ভিত্তিমূলে রয়েছে এই সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক মানস আর মনন।

‘কোন নামে ডাকিলে তারে, হৃদাকাশে উদয় হবে/ আপনা আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে’ – এই পঙ্ক্তির মাঝেই লোকায়ত জীবনযাপনের ভাবনায় সব রকম ভেদাভেদ ও বিভাজনরেখা অতিক্রম করে সাম্যের জয়গাথা ধ্বনিত হয়েছে। আর এই সাম্যের ভাবনা প্রদর্শনে এক প্রকার লোকতান্ত্রিক চিন্তার সংযুক্তি ছিল, পরার্থবাদিতার অনুষঙ্গ ছিল চিরকাল। আর ঠিক এই কারণেই যুগ যুগ ধরে নানান মত, পথ, মতবাদ, আচার, প্রণালির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ঘটলেও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের চর্চা আর চর্যায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি যুগ যুগ ধরে। লোকায়ত চিন্তা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতপাত নির্বিশেষে সব মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবতে প্রাণিত করে, সাম্যের ভাবনা থেকে সকলকে এক কাতারে ফেলে অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধ সমাজ সৃজনের স্বপ্ন দেখে।

এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে

যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে ॥

(লালন সাঁই)

এমনকী আজকের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের স্বপ্ন দেখার পেছনে এবং নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নকে সত্যিকারের মূর্তরূপ দেওয়ার পেছনেও কিন্তু সেই চিরন্তন লোকায়ত দর্শন থেকে উদ্ভূত অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ কাজ করেছে। তাই আজ এর অন্যথা হলে কিংবা অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের চর্চা আর চর্যায় ব্যত্যয় ঘটলে তা আসলে বাঙালির চিরকালীন লোকায়ত দর্শনের ওপর, তথা বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির ওপর প্রকারান্তরে কুঠারাঘাত করা হয়। এতে অপমানিত হয় বাঙালির সহজাত জীবনবোধ, যা কি না সহজ কিন্তু গভীর, সরল অথচ নিবিড়, প্রাঞ্জল তথাপি প্রগাঢ়; অবদমিত হয় বাঙালির সভ্যতা। আর চিরন্তনকে পাশ কাটিয়ে গেলে নিজস্বতা, সভ্যতা আর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা যায় না।

জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে, নইলে তার কাছ থেকে বড়কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা

কথাটা একরকম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। 

(‘সংস্কৃতি কথা’, মোতাহের হোসেন চৌধুরী)

আজকের বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা আর চর্যায়, তার নিত্যকার জীবনযাপনের অভ্যাসে আর বিশ্বাসে উপরোল্লিখিত এই সাবধানবাণী মনে নিয়ে চললে হয়তো আমাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে। আর এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির হয়তো ফের গভীরভাবে আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতিভাবনার শেকড়সন্ধানের সময় হয়েছে।