ভ্রমণ-পিয়াসু বিশ^যাত্রী রবীন্দ্রনাথ কখনোই এক জায়গায় বেশিদিন থিতু হয়ে থাকতে পারতেন না। বিচিত্রের আহ্বানে তাঁকে বারবার ছুটে যেতে দেখি স্থান থেকে স্থানান্তরে। এই যাত্রাপথে পালকি, গো-শকট, ডাণ্ডি, নৌকা, স্টিমার, পদ্মাবোট, জাহাজ, অ্যারোপ্লেন ইত্যাদি বাহনের মধ্যে কবির প্রিয়তম পছন্দটি ছিল রেলগাড়ি। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে রেলপথেই। ছুটন্ত ইস্পাত-কামরার বাতায়নে বসে তিনি দু-চোখ ভরে চেয়ে থাকতেন ‘পিছনপানে ছুটে চলা জীবনের’ বিচিত্র খণ্ডচিত্রগুলির দিকে। তাঁর কথায়, ‘রেলগাড়ির মতো আমাদের প্রত্যেকের জীবন ছুটে চলেচে, কিন্তু তার মধ্যে থেকে যেটুকু পাচ্চি সে ক্ষণকালীন নয়, সে চিরকালীন।’ রেলভ্রমণের উদ্দেশ্য তাঁর কাছে কেবল গন্তব্যে পৌঁছানোই নয়, তা ছিল চলমান জীবনের এক প্রতীকী রূপকে অনুভব করার মাধ্যম। রেলগাড়িতেও তাঁর সদাজাগ্রত মন ব্যস্ত থাকত নানা সৃষ্টিশীল রচনায়। ‘স্তিমিততারা নিশীথিনীর মধ্যে গাড়ির চাকার অবিশ্রাম শব্দের তালে তালে মাথার ভিতরে সৃষ্টিছাড়া স্বপ্নের দল’ কবিকে জোগাত গল্প-উপন্যাস-নাটকের নতুন নতুন প্লট। রেলগাড়িকে উপলক্ষ করে অসংখ্য মণিমুক্তা-খচিত রচনায় সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে তাঁর বিচিত্র রচনাসম্ভার।

১৮৭৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে হিমালয়যাত্রার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথের রেলভ্রমণের সূচনা এবং দীর্ঘ ৬৮ বছর পর ১৯৪১ সালের ৫ই জুলাই রেলের বিশেষ সেলুনকারে বোলপুর থেকে চিরবিদায় নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসাতেই তার সমাপ্তি। এই বিস্তীর্ণ সময়কালে রেল-পরিবহনে তিনি  দেশে-বিদেশে যত জায়গায় পাড়ি দিয়েছেন তেমনটি বোধহয় আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। বোলপুর-কলকাতাই যে কতবার পারাপার করেছেন তার হিসাবই বা কে রাখে?  বিভিন্ন উপলক্ষে রেলভ্রমণের পথে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন রাজর্ষি উপন্যাস কিংবা ‘অপরিচিতা’ গল্পের স্বপ্নলব্ধ পটভূমি, অথবা রেললাইনের পাশের আগাছার জঙ্গলে হলদে-সাদা-বেগুনি ফুল দেখে চিত্রাঙ্গদা নাটকের আভাস। তেমনি চলমান ট্রেনের দুলুনির মধ্যেই রচনা করেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা।

১৮৭৩ সাল। রবীন্দ্রনাথ তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের ছাত্র। সবে মাথা মুড়িয়ে উপনয়ন হয়েছে দাদা সোমেন্দ্রনাথ আর ভাগ্নে সত্যপ্রসাদের সঙ্গে। উপনয়নের পরে ন্যাড়া মাথায় স্কুলে গেলে ফিরিঙ্গি সহপাঠীরা হাসাহাসি করবে ভেবে বালক রবির দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। সেই সংকটময় অবস্থায় হিমালয়যাত্রার সঙ্গী করে তাঁকে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন স্বয়ং পিতা দেবেন্দ্রনাথ। সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম রেলভ্রমণ। কঠিন অনুশাসনে ঘেরা জোড়াসাঁকোর চার দেয়ালের সীমাবদ্ধ খাঁচা থেকে অজানা আকাশে ওড়ার ডাক। সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তাঁর জীবনস্মৃতির পাতায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে, বোলপুর, অমৃতসর হয়ে বৈশাখ মাসে তাঁরা হিমালয়ের বক্রোটা শিখরে পৌঁছেছিলেন। সেবার অমৃতসরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তাঁর প্রথম গান –

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।

ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,

সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে।

কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি

অনাহূত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে।

স্কুলের পড়াশোনায় যখন কিছুতেই মন বসানো গেল না, তখন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে স্কুলছুট রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমেদাবাদে, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সেটা ১৮৮৭ সালের মে মাস। সেখান থেকে বোম্বাইতে আন্না তড়খড়ের তত্ত্বাবধানে ইংরেজিতে কথা বলা আর বিলিতি আদবকায়দার পাঠ নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মেজদাদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জাহাজযোগে রওনা দিলেন লন্ডনের দিকে। দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁকে দুবার রেলগাড়ি চড়তে হয়েছিল। ৩রা অক্টোবর সুয়েজ থেকে আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘এমন গজগামিনী রেলগাড়ি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় না। সমস্ত রাত্রিই গাড়ি চলেছে; দিনের বেলা যখন জেগে উঠলেম তখন দেখলুম ধুলোয় আমাদের কেবল গোর হয় নি, আর সব হয়েছে। চুলে হাত দিতে গিয়ে দেখি, চুলে এমন এক স্তর মাটি জমেছে যে মাথায় অনায়াসে ধান চাষ করা যায়। এই রকম ধুলোমাখা সন্ন্যাসীর বেশে আমরা অ্যালেক্‌জান্দ্রিয়াতে গিয়ে পৌঁছলেম।’ এরপর ইতালির ব্রিন্দিস স্টেশন থেকে প্যারিসের পথের প্রায় ষোলো ঘণ্টার ট্রেন-জার্নির একটি মনোরম ছবি এঁকেছেন য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র-এ, ‘তিনটের ট্রেনে ব্রিন্দিসি ছাড়লেম। রেলোয়ে পথের দু-ধারে আঙুরের খেত, চমৎকার দেখতে। পর্বত, নদী, হ্রদ কুটীর, শস্যক্ষেত্র, ছোটো ছোটো গ্রাম প্রভৃতি যত কিছু, কবির স্বপ্নের ধন সমস্ত চার দিকে শোভা পাচ্ছে। গাছপালার মধ্যে থেকে যখন কোনো একটি দূরস্থ নগর, তার প্রাসাদচূড়া তার চার্চের শিখর, তার ছবির মতো বাড়িগুলি আস্তে আস্তে চোখে পড়ে তখন বড়ো ভালো লাগে। সন্ধেবেলায় একটি পাহাড়ের নীচে অতি সুন্দর একটি হ্রদ দেখেছিলেম তা আর আমি ভুলতে পারব না। তার চারদিকে গাছপালা, জলে সন্ধ্যার ছায়া – সে অতি সুন্দর, তা আমি বর্ণনা করতে চাই নে।’

সেবার লন্ডন থেকে দূরের এক শহরে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছিল জনৈক মিসেস উডের ঘরোয়া আমন্ত্রণে। দুর্যোগপূর্ণ শীতের রাত, বরফ পড়ছে, কুয়াশায় আকাশ অন্ধকার। টিকিট কেটে রবীন্দ্রনাথ আরাম করে রেলের কামরায় বসেছেন, চোখ বইয়ের পাতায়। স্টেশনের পর স্টেশন চলে যাচ্ছে। গন্তব্য আর আসে না।  হঠাৎ এক জায়গায় ট্রেন থামলে কবি জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন, ‘সমস্ত অন্ধকার। লোকজন নাই, আলো নাই, প্ল্যাটফর্ম নাই, কিছুই নাই। কিছুক্ষণ বাদে গাড়ি পিছু হটিতে লাগিল।’ আসলে রবীন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক থাকায় বুঝতেই পারেননি যে, ট্রেন তাঁর গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে আবার ফিরে চলেছে লন্ডনের দিকে। সে-রাতে রবীন্দ্রনাথকে অসীম কষ্টভোগ করতে হয়েছিল। কোনোমতে রাত দশটার পর আমন্ত্রণকর্ত্রীর বাড়ি পৌঁছে, তাঁর অমানবিক অবহেলায় না জুটল আহার না থাকার জায়গা। সে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। 

১৮৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের রেলভ্রমণে ছাব্বিশ বছরের রবীন্দ্রনাথের এক করুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার মৃণালিনী, মাধুরীলতা, বড়দিদি সৌদামিনী, ন’দিদি স্বর্ণকুমারী, তাঁর দুই মেয়ে হিরণ¥য়ী, সরলা আর দাসী সমেত এক বিরাট দল নিয়ে তিনি চলেছেন দার্জিলিং। স্টিমারে পদ্মা পেরিয়ে শিলিগুড়ি থেকে উঠতে হবে ন্যারো গেজের ট্রেনে। স্টিমার ঘাটে সে এক মহাহাঙ্গামা। রাত দশটা। ‘জিনিসপত্র সহস্র, কুলি গোটাকতক, মেয়েমানুষ পাঁচটা এবং পুরুষ মানুষ একটিমাত্র।’ রবীন্দ্রনাথ অনেক ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি ছোটাছুটি করে অগুন্তি বাক্স-পেঁটরা, পোঁটলাপুঁটলি সামলিয়ে, মহিলাদের নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। খাটনি নিতান্ত অল্প হয়নি – তবু ন’দিদি বললেন, ‘রবি তেমন কিছুই করেনি।’ দিদির কথায় রবীন্দ্রনাথের পৌরুষে কি একটু টোকা লেগেছিল? এরপর ট্রেন যত ওপরে উঠতে লাগল ততই ‘ক্রমে ঠাণ্ডা, তার পরে মেঘ, তার পরে ন’দিদির সর্দি, তার পরে বড়দিদির হাঁচি, তার পরে শাল কম্বল বালাপোষ, মোটা মোজা, পা কন্‌কন্‌, হাত ঠাণ্ডা, মুখ নীল, গলা ভার ভার, এবং ঠিক তার পরেই দার্জিলিং।’ আরো একপ্রস্ত হাঙ্গামার পর তাঁরা সদলবলে এসে উঠলেন সেখানকার বিখ্যাত ক্যাসলটন হাউসে। 

১৩১২ সনে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ আইনের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন উত্তাল, তখন রবীন্দ্রনাথের লেখা স্বদেশি গানগুলি মানুষের মনে বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন মাসখানেকের জন্য গিরিডিতে ছিলেন, অসুস্থ শরীরকে মেরামতের আশায়। গিরিডি কলকাতা থেকে দূরে হলেও কলকাতার আন্দোলনের আঁচ সেখানেও এসে পড়েছিল যথাসময়ে। আন্দোলনের সেই উন্মাদনা গিরিডির মানুষকে যে দোলা দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথও তাতে শামিল হয়েছিলেন। প্রশান্ত পালের কথায়, তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ‘অন্যতম চারণকবির ভূমিকা’ নিয়েছিলেন। অল্পদিনেই রচনা করে ফেলেছিলেন প্রায় ২৩টি স্বদেশি গান।

সেবার আশ্বিন মাসের ২২ তারিখে বাগবাজারের পশুপতিনাথ বসুর প্রাসাদে একটি বিজয়া-সম্মিলনের আয়োজন করা হয়েছিল। কলকাতা থেকে দূত পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আহ্বান জানানো হলো সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। আহ্বান গ্রহণ করে গিরিডি থেকে কলকাতায় আসার সময় রেলগাড়িতে বসেই কবি রচনা করলেন আরো একটি দেশাত্মবোধক গান। তাঁর কথায়, ‘আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।’ রেলপথে লেখা সেদিনের গানটি –

ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,

মোদের ততই বাঁধন টুটবে।

ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,

ততই মোদের আঁখি ফুটবে।

গীতাঞ্জলির পর্বশেষ করে ১৩১৭ সনে গীতিমাল্যের যুগ শুরু হলেও এই কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই লেখা হয়েছিল ১৩২০ সনে। এর প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতা। জনতার কোলাহল থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে শিলাইদহে গিয়ে প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছেন, ‘চারিদিকের নানাবিধ তাড়নায় মাথার মগজের মধ্যে একটা আবর্তের সৃষ্টি হয়েছিল – ক্ষণে ক্ষণে ঘুরপাক খেলত। এখন একটু ভালো আছি কিন্তু বুদ্ধির যন্ত্রটাকে বেশি খাটাতে সাহসও হয় না ইচ্ছাও হয় না – একটা মৌরসী ছুটির জন্যে মনটা মাঝে মাঝে দরখাস্ত লিখতে বসে। গাল পাড়বার বেলায় বৈরাগ্যকে রেয়াৎ করিনে কিন্তু হাড়ে হাড়ে সে যেন বাঁশি বাজাতে থাকে একেবারে ভিতরের দিক থেকে সে আমাকে উদাস করে। যদি শুষ্ক বৈরাগ্য হত তাহলে এ’কে কাছে আসতে দিতুম না, কিন্তু এ যে বাসন্তী রঙে রাঙানো – আমের বোলের গন্ধে ভরা।’ চৈত্র মাসেই গীতিমাল্যের ভাণ্ডার ভরে উঠলো আরও ২৪টি গানে। তারই একটি, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়’, গানটি রচিত হলো শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে, রেলগাড়িতে।

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।

তোমায় দেখতে আমি পাই নি।

বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥

আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়

তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি ॥

১৩২১-এর আশি^ন মাস। রবীন্দ্রনাথ সবান্ধবে অবকাশ যাপন করছেন গয়া শহরের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার বন্ধু প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাসভবনে। গয়া শহরের নিকটবর্তী বেলা স্টেশনের কাছেই বরাবর পাহাড়ের গুহাগুলি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। একদিন জনৈক ব্যক্তি কবিকে উৎসাহিত করার জন্য বরাবর পাহাড়ের সৌন্দর্য নানাভাবে বর্ণনা করে সকলকে সেই অপূর্ব গুহাগুলি দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা জানি, যা কিছু নতুন তা দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের  মন সদাই ব্যাকুল হয়ে থাকে। বরাবরের মতোই পাহাড়ের হাতছানি তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে, পরদিন মধ্যরাত্রে সতীর্থদের নিয়ে গয়া স্টেশন থেকে রেলপথে যাত্রা করলেন গুহাদর্শনের উদ্দেশ্যে। সেই যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ রেলগাড়িতেই রচনা করলেন গীতালির একটা নতুন কবিতা, ‘পথে পথেই বাসা বাঁধি মনে ভাবি পথ ফুরালো’।  কিন্তু এই অভিযান কবির কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। চূড়ান্ত অব্যবস্থা, খাবার আর পানীয় জলের অভাব, পালকির অনুপস্থিতি আর দুঃসহ গরমে তিপ্পান্ন বছরের রবীন্দ্রনাথ এতই কাহিল হয়ে পড়েছিলেন যে, পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তাঁর গুহা দেখার শখ মিটে গিয়েছিল। ভগ্নহৃদয়ে কবি ফিরে চললেন। সূর্য-ঢলে-পড়া সন্ধ্যায় পালকি এসে পৌঁছাল বেলা স্টেশনে। বিধ্বস্ত যাত্রীদল উঠে বসল গয়া ফেরার জন্য। সকলের শরীর-মন ক্লান্তিতে অবশ। একমাত্র ব্যতিক্রম চিরতরুণ রবি। রেলের মৃদু দুলুনির মধ্যেই তাঁর অক্লান্ত কলম লিখে চলল –

ওগো, পথের সাথি, নমি বারম্বার।

পথিকজনের লহো লহো নমস্কার।

ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি, ওগো দিনশেষের পতি,

ভাঙা বাসার লহো নমস্কার।

বরাবর পাহাড়ের গুহাদর্শনের ব্যর্থ অভিযানের পরে গয়া থেকে এলাহাবাদে এসে প্যারীলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জর্জ টাউনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন অতিথি হয়ে ছিলেন। সেখানেই তিনি রচনা করেছিলেন বলাকা কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘তুমি কি কেবলই ছবি’। এলাহাবাদ থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে  সুরুলের বাড়িতে কিছুদিন থেকে পৌষ মাসের ২৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলেন আসন্ন চীন-জাপান ভ্রমণ আর মাঘোৎসবের প্রস্তুতির জন্য। এবারের যাত্রাপথের  সঙ্গী তাঁর সকল গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন অন্য কামরায়। ট্রেনে আসতে আসতে রবীন্দ্রনাথের মনে একটি গান এলো, সঙ্গে কথা আর সুরও। সুরটি ভুলে যাওয়ার আগেই পাশের কামরা থেকে কবি ডেকে নিলেন তাঁর বিশ্বস্ত স্বরলিপিকারকে। দিনেন্দ্রনাথ মুহূর্তের মধ্যে মুখে মুখে সেই গানের স্বরলিপি তৈরি করে ফেললেন। যাত্রার বাকি পথটুকু দুজনে তন্ময় হয়ে গাইলেন সদ্য লেখা গান – ‘আনন্দগান উঠুক তবে বাজি’। 

আনন্দগান উঠুক তবে বাজি

এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।

অশ্রুজলের ঢেউয়ের ’পরে আজি

পারের তরী থাকুক ভাসিতে।।

যাবার হাওয়া ওই-যে উঠেছে, ওগো, ওই-যে উঠেছে,

সারারাত্রি চক্ষে আমার ঘুম যে ছুটেছে।

১৩২২ সনে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করা হবে। রবীন্দ্রনাথের সম্মতির জন্য লর্ড হার্ডিং তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ফাল্গুনী নাটক শেষ করে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা হয়ে ব্যারাকপুরের উদ্দেশে রওনা হলেন ছোট লাট লর্ড হার্ডিংয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। যাত্রাপথে রেলগাড়ির গতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন – ‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা’  এবং ‘চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে’। দুটিই ফাল্গুনী নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কবির অষ্টম বিদেশভ্রমণ। চলেছেন ইতালিগামী জাহাজে য়ুরোপের পথে। নানা বন্দর ছুঁয়ে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে পৌঁছালেন ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে। পরের গন্তব্য জার্মানি। যাত্রাসঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ আর নির্মলকুমারীকে নিয়ে কবি হামবুর্গ যাওয়ার ট্রেনে উঠলেন। কোপেনহেগেন থেকে জার্মানি যেতে হলে বাল্টিক সাগর অতিক্রম করতে হয়। এই যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ এক অভিনব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে রইলেন। রেল থেকে নেমে জাহাজে চড়তে হলো না। পুরো রেলটাই উঠে পড়ল বিশাল জাহাজের ডেকে। গভীর রাত। কবি বসে রয়েছেন রেলে তাঁর নির্দিষ্ট কামরায়। নিমীলিত চোখ। চারপাশের হইচইয়ের মধ্যেই মনের গভীরে জেগে উঠেছে গানের সুর। গুনগুন করে রচনা করলেন একটি গান – ‘সে কোন্ পাগল যায় পথে তোর’। পাশের কামরা থেকে নির্মলকুমারীকে ডেকে তাঁকে শিখিয়ে রাখলেন তার সুরটি।

সে কোন্ পাগল যায় যায় পথে তোর, যায় চলে ওই

                                              একলা রাতে –

তারে ডাকিস নে ডাকিস নে তোর আঙিনাতে।।

সুদূর দেশের বাণী ও যে  যায়  যায় বলে, হায়, কে তা

                                                 বোঝে –

কী সুর বাজায় একলারাতে।।

১৯৩০ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে রবীন্দ্রনাথ হাওড়া থেকে রেলপথে চলেছেন মাদ্রাজ অভিমুখে। এবারের যাত্রার উদ্দেশ্য প্যারিসে চিত্র-প্রদর্শনী, য়ুরোপের বিভিন্ন শহরে বক্তৃতামালা, সঙ্গে বিশ্বভারতীর জন্য অনুদান সংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬৯ বছর, শরীর দুর্বল, প্রায়ই নানা অসুখে ভুগছেন। সঙ্গে চলেছেন রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, কন্যা নন্দিনী, ডাক্তার সুহৃৎনাথ চৌধুরী, ডাক্তার নলিনীরঞ্জন এবং আরো কয়েকজন। এককথায় বিশাল বাহিনী। এই যাত্রাতেই মাদ্রাজ মেলে বসে তিনি রচনা করলেন একটি অত্যন্ত পরিচিত গান ‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে, দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।’ অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ গানটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে উদ্দেশ করে লিখেছেন। কিন্তু কবি নিজের কথায়, ‘আজ চলেছি রেলগাড়িতে মাদ্রাজের দিকে। একটা ভারীগোছের নীল মলাটওয়ালা বই এনেছিলুম – সে আর খোলা হল না। জানলার বাইরে আমার দুই চক্ষের অভিসার আর থামে না। জানলা দিয়ে এই ফাল্গুনের রৌদ্র যখন একটি অভাবনীয় মাধুরী মূর্তি দেখি তখন নিশ্চিত জানি সেটা দেখতে দেখতে মিলিয়ে যাবে। মনকে জিজ্ঞাসা করি এই উপলব্ধিটা কি একেবারেই মায়া। মন তো তা স্বীকার করে না। যা দেখছি সে তো একলা আমারই আনন্দের দেখা নয়, যারা এতকাল দেখেছে এবং চিরকাল দেখবে তাদেরই দেখাকে সংগ্রহ করে নিয়ে গেলুম – সেইসঙ্গে একটা কবিতাও লেখা হয়ে গেল : সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে।’ 

সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে

দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।

এ কথা কভু আর পারে না ঘুচিতে,

আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে।

এ কথা শিখানু যে আমার বীণারে,

গানেতে চিনালেম সে চির-চেনারে।

১৯৪১ সালের ২৫শে জুলাই। সুদূর অতীতে যে-পথ দিয়ে একদিন বালক রবি বাষ্পীয় শকটে চেপে জোড়াসাঁকো থেকে বোলপুর পৌঁছেছিলেন, আজ আশি বছরের বিশ্বপথিক সেই পথ দিয়েই বোলপুর থেকে ফিরে এসেছেন তাঁর জন্মস্থান জোড়াসাঁকোয়। রবীন্দ্রনাথ তখন গুরুতর অসুস্থ। রয়েছেন শান্তিনিকেতনে। চিকিৎসকেরা জানালেন, অপারেশন ছাড়া তাঁকে সুস্থ করা যাবে না। কবি চাননি তাঁর শরীরে আর কাটাছেঁড়া করতে। তবু বিশেষ সেলুনকারে করে তাঁকে নিয়ে আসা হলো বোলপুর থেকে হাওড়া স্টেশনে। সকাল আটটায় রওনা দিয়ে রেল এসে পৌঁছাল বেলা আড়াইটায়। জীবনের শেষ রেলভ্রমণকে চোখের জলে বিদায় জানিয়ে অসুস্থ কবি ফিরে চললেন জোড়াসাঁকোয়।

ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,

এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।

মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,

নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।

এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,

আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।

আসে কারা এক দিক হতে ঐ,

ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ঐ।