রবির ‘ল্যাবরেটরি’তে নারীর ক্ষমতা

গত শতকের শেষ দশকের শেষ দিকটাতে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে ডা. আহম্মদ রফিকের নেতৃত্বাধীন রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র থেকে আয়োজন করা হয়েছিল দুদিনব্যাপী এক সেমিনার। তাতে উপস্থাপিত আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধর্মীয় মৌলবাদ’। বোধ করি, আমার প্রায়-অকাট্য বিশ্লেষণে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন একজন আলোচক, তিনি বেশ প্রতিভারও পরিচয় দিলেন, যখন ‘রবীন্দ্র মৌলবাদ’-এর মতো একটি শব্দবন্ধ হাজির করলেন। এ হচ্ছে বাংলাদেশ-সুলভ মানসবদ্ধতা ও মানসগতির একটি দৃষ্টান্ত – যে বদ্ধতাকে ত্যাগ করতে চাই না আমরা; বরং, তাকে রক্ষা করার জন্যে কোন সব মানসিক গতিধারা নিয়ে এগোই আমরা, এখানে তার উদাহরণ এটা। ভদ্রলোক কিন্তু ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সর্বমহলে চড়ে-বড়ে বেড়ান, সমস্যা হয় না। তার কারণ, ভেতরের অন্ধকারকে এখানে অধিক আড়াল করতে হয় না। কারণ, অন্ধকার বেশ বাইরেও, তার প্রতি রয়েছে সহজ এবং ব্যাপক প্রশ্রয়।

অপরপক্ষে, এ-ঘটনা রবীন্দ্রনাথের ধারণাগুলির সচরাচর অস্বীকৃত ব্যাপ্তি তথা আলোর সত্যটিকে নির্দেশ করেছিল। তাকে সন্ত বা ংধমব ঢ়ড়বঃ বলে শেষ করে দেওয়ার যে-চাল অতীতে ছিল, পশ্চিমাদেরই বেশি, এখনো তা রয়েছে; আমাদেরও। তা না করলে যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা যায় না! রবীন্দ্রনাথকে ধর্মের দিকের কেউ না-বললে যে পাটাতনটা কেঁপে ওঠে। হ্যাঁ, ধর্ম, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ছিল, কিন্তু কোন? শেষ পর্যন্ত তাঁর ছিল মানবধর্ম, বস্তুর ধর্ম, তাঁর ছিল এমনকি বিবর্তনবাদী প্রত্যয়, নিজেকে ভেবেছেন দূর অতীতে জন্ম-নেওয়া উদ্ভিদ পর্যন্ত। বিশ্ব পরিচয়-এ তাঁর এসব অগ্রসর অবস্থান। তবে এসবের খুঁটিনাটিতে এখন যাবো না।

এখানে আরো একটি সেমিনার সম্পর্কে একটু বলতে হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা কেন্দ্র থেকে আয়োজিত ওই সেমিনারটি ছিল রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যটি নিয়ে। তাতে অংশ নিয়ে আমার সহআলোচক বলে বসেছিলেন যে, এই কাব্যনাট্যটির সবটাই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক। এভাবে নির্বিচারে সর্বত্র পুরুষতন্ত্র খুঁজে পাওয়ার হুজুগের প্রতি জবাব না দিয়ে সেদিন আমি পারিনি। বলে বসেছিলাম যে, এরকম পরিস্থিতিতেই সমাজে মাতৃতন্ত্রের মতো একপেশে এবং সে-অর্থেই পাল্টা-অন্ধত্বধর্মী এবং দাপুটে একটি ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ ছোটগল্পটি আমার পড়া হয়নি। মাত্র কদিন আগেই গল্পটি পড়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছে হয়েছে। জানি না, কী দাঁড়াবে।

যাঁরা ‘ল্যাবরেটরি’ পড়েছেন, তাঁরা হয়তো স্মরণ করতে পারবেন। আমিও আবার বিষয়টি জানাচ্ছি। এ-গল্পটি পড়ে আমার উত্তেজিত আর উদ্বুদ্ধ বোধ করার কারণ হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারটিতে আমার মাতৃতন্ত্র বিষয়টি উল্লেখ করা। বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে ‘ল্যাবরেটরি’তে। তবে আগেভাগে বলে নিতে হবে যে, গল্পের চরিত্রের বক্তব্য গল্পকারের বক্তব্য নয়। আবার আমি এও বলব যে, চরিত্রের মুখ দিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ কি লেখকের পক্ষ থেকে একটি অন্যতম সচেতন অবস্থান নয়? তিনি কি অন্তত প্রশ্নটি/প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে চাননি? ‘ল্যাবরেটরি’র অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরি আর সোহিনীর মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের ছিল যুগপৎ আবেগ আর বুদ্ধিবৃত্তির সংমিশ্রণের এক দুর্লভ মান আর প্রকৃতি। সে-সম্পর্কের কাঠামোতে তারা প্রায় শুরুতেই নিচে উদ্ধৃত কথাগুলি বলেন :‘‘দেখো মিসেস মল্লিক, রাগ করবে কাকে নিয়ে। জান মেট্রিয়ার্কাল সমাজ কাকে বলে? যে সমাজে মেয়েরাই হচ্ছে পুরুষের সেরা। এক সময়ে সেই দ্রাবিড়ি সমাজের ঢেউ বাংলাদেশে খেলত।’’

সোহিনী বললে, ‘‘সে সুদিন তো গেছে। তলায়-তলায় ঢেউ খেলে হয়তো, ঘুলিয়ে দেয় বুদ্ধিসুদ্ধি, কিন্তু হাল যে একলা পুরুষের হাতে। কানে মন্ত্র দেন তারাই আর জোরে দেন কানমলা। কান ছিঁড়ে যাবার জো হয়।’’

‘‘আহা হা, কথা কইতে জান তুমি। তোমার মতো মেয়েদের যুগ যদি আসে তা হলে মেট্রিয়ার্কাল সমাজে ধোবার বাড়ির ফর্দ রাখি মেয়েদের শাড়ির, আর আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালকে পাঠিয়ে দিই ঢেঁকি কুটতে। মনোবিজ্ঞান বলে, বাংলাদেশে মেট্রিয়াকি বাইরে নেই, আছে নাড়িতে। মা মা শব্দে হাম্বাধ্বনি আর কোনো দেশের পুরুষমহলে শুনেছ কি। …’’ (পৃ ৬১৭, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

এ পর্যন্ত এতটুকু দাবি করা হচ্ছে যে, যে-যাই বলুক, এখনো মাতৃতন্ত্র কিংবা মেট্রিয়ার্কির প্রসঙ্গটা অবান্তর নয়। রবীন্দ্রনাথের সমর্থন নিয়েই এ-দাবি করা যেতে পারে।

এর পরে চলে যেতে চাই আমার দীর্ঘদিনের একটি থিসিস উপস্থাপনের চেষ্টা বিষয়ে। দীর্ঘকাল আমি বলতে চেয়েছি নারীর ক্ষমতা সম্পর্কে। চারদিকে শুধুই যে এবং যত পুরুষ-শাসন/ দমন ইত্যাদি বলা হয়েছে, হচ্ছে, তাতে আপত্তি জানিয়ে এবং যোগ করে আমি দাবি করেছি যে, সমাজে সর্বকালেই নারীরও এক প্রকার শাসন, দমন ইত্যাদি ছিল, রয়েছে। আমি নজরুলকে উদ্ধৃত করেছি, ‘রাজা করিছেন রাজ্যশাসন, রাজারে শাসিছে রানী।’ ইত্যাদি। আবারো নজরুল, ‘অথবা পাপ যে-শয়তান যে – নর নহে নারী নহে,/ ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়ে রহে।’ এভাবে এগিয়েছি। সফোক্লিস, শেক্সপিয়র, ব্রাউনিং, ইবসেন – বহির্বিশে^র এমন যুগন্ধরদের সাহিত্য থেকে উদ্ধৃত এবং বিশ্লেষণ করেও কিছু ভিন্ন-নূতন কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ-যুগের রাজনৈতিক তত্ত্বায়নের পরিবেশে কোনো ভিন্ন তত্ত্ব, স্বর প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত দুরূহ। তবে পৃথিবীর বড় লেখক-মনীষীদের সাহিত্যকর্মে যে-সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে, গিয়েছে, তাও কম রক্ষাকারী নয়। আমি শুধু অন্য বুদ্ধিজীবীদের ‘একচক্ষু’ প্রকৃতি দেখে হতবাক থাকি, আর তাদের নারীবাদী হুজুগ এবং করে খাওয়ার মনোভাব, ইত্যাদি দেখে। নারীবাদের জোয়ার মূলত রাজনৈতিক ব্যাপার; রাজনীতিকদের সংকীর্ণ স্বার্থ থাকা সম্ভব, তবে, এখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীর অবস্থানের রহস্য কি, ব্যাখ্যা? তাঁরা কি নিরেট এলিট গোষ্ঠীর অংশমাত্রই – এজন্যেই তাদের দেবীবাদ?

নারীর ক্ষমতার ধারণাটি প্রমাণ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি বুঝি প্রকৃতই একটি ল্যাবরেটরি। জীবনে সম্ভাব্য কোন সব অভিজ্ঞতার কারণে কিংবা ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ এ-গল্প লিখেছিলেন, ভেবে বিস্মিত হতে হয়। পুরুষের দৈহিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি ক্ষমতার কথা বলেই যাঁরা আলোচনা শেষ করেন, রূপ-যৌবন-রমণ ইত্যাদির ভিত্তিতে জাদু, মোহ এবং আবেগ বিস্তারের যে ক্ষমতা নারীর চিরদিনের, সে-প্রসঙ্গে যাঁরা যানই না, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি এবং সততা দুটোই প্রশ্নযোগ্য। এসব বিষয়ের আলোচনা-বিশ্লেষণে বর্তমানে এমন এক ভারসাম্যহীনতা দাঁড়িয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ না-হয়ে উপায় থাকে না। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের সোহিনী চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারীর এই বিশেষ এবং আমোঘ ক্ষমতার ইস্যুটিকে রবীন্দ্রনাথ যত বেশি সামনে এনেছেন, এখন আর তা নিয়ে আলোচনা-ছাড়া যেন কোনো বিকল্প নেই। অবস্থাদৃষ্টে শেষ পর্যন্ত মনে হয় যে, নারীর প্রতি মোহে পড়ে পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিও খর্ব হয়ে আছে এবং সে-সুযোগে নারীবাদের মতো একটি তত্ত্ব তার এখনকার অদ্ভুত বেঢপ আকার ধারণ করতে পেরেছে।

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের দ্বিতীয় অংশে দেখা যাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার নন্দকিশোর মারা গিয়েছেন এবং তার পরের দুরূহ পরিস্থিতি তাঁর স্ত্রী সোহিনী তার বৈশিষ্ট্যসূচক যোগ্যতা-ক্ষমতার সঙ্গেই সামাল দিচ্ছে। কি সেই যোগ্যতা-ক্ষমতা? রবীন্দ্রনাথের বহু গানে যে-নারী পুরুষের ভালোবাসার আবেগ, আকুলতা, স্তুতি ইত্যাদির পাত্র, এই গল্পে দেখা যাচ্ছে যে, স্বার্থরক্ষায় তার জীবনে আবেগ-অনুভূতির কোনো স্থান নেই। বাকি সংসার যেমন আগ্রাসী, সোহিনীরও নেই কোনো দ্বিধা-জড়তা-দুর্বলতা। আত্মীয়তার দাবিদারদের ফাঁদা মামলা লড়তে সে যেমন ‘আইনের প্যাঁচ’ বুঝে নিল, তেমনি ‘নারীর মোহজাল বিস্তার করে দিল স্থান বুঝে উকিলপাড়ায়। সেটাতে তার অসংকোচ নৈপুণ্য ছিল, সংস্কার মানার কোনো বালাই ছিল না।’ (পৃ ৬১৫, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

শুধু স্বামীর সম্পদ রক্ষায় নয়, একমাত্র কন্যা নীলাকে আগলানোতেও সোহিনীর ব্যবস্থাদির যে বিবরণ গল্পকার রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেন, তাতেও সাধারণভাবে নারীর রমণবৃত্তিকে ব্যবসাবৃত্তি বলেই মনে হয়। স্কুলপড়ুয়া সুন্দরী মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে জাতগোষ্ঠী ‘বিচার করবার রাস্তা ছিল না’ ভালো, কিন্তু কী করে-কী করে যা ছিল, সে হচ্ছে ‘মন ভোলাবার পথ’। এ কি সেই শেষের কবিতার ‘আফিম’ গেলানোর পথই  নয়? স্কুলপড়ুয়া মেয়েটির নিজেরই সেখানে কী বিস্ময়কর তরক্কী!

মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে কুলশীল জাতগুষ্ঠির কথা বিচার করবার রাস্তা ছিল না। একমাত্র ছিল মন ভোলাবার পথ, শাস্ত্রকে ডিঙ্গিয়ে গেল তার ভেল্কি। অল্প বয়সের মারোয়ারি ছেলে, তার টাকা পৈতৃক, শিক্ষা একালের। অকস্মাৎ সে পড়ল এসে অনঙ্গের অলক্ষ্য ফাঁদে। নীলা একদিন গাড়ির অপেক্ষায় ইস্কুলের দরজার কাছে ছিল দাঁড়িয়ে। সে সময় ছেলেটি দৈবাৎ তাকে দেখেছিল। তার পর থেকে আরো কিছুদিন ঐ রাস্তায় সে বায়ুসেবন করেছে। স্বাভাবিক স্ত্রীবুদ্ধির প্রেরণায় মেয়েটি গাড়ি আসবার বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই গেটের কাছে দাঁড়াত। কেবল সেই মারোয়ারি ছেলে নয়, আরো দু-চার সম্প্রদায়ের যুবক ঐখানটায় অকারণ পদচারণার চর্চা করত। তার মধ্যে ঐ ছেলেটিই চোখ বুজে দিল ঝাঁপ ওর জালের মধ্যে। আর ফিরল না। সিভিল মতে বিয়ে করলে সমাজের ওপারে। বেশি দিনের মেয়াদে নয়। তার ভাগ্যে বধূটি এল প্রথমে, তারপরে দাম্পত্যের মাঝখানটাতে দাঁড়ি টানলে টাইফয়েড, তারপরে মুক্তি। (পৃ ৬১৫, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

ফলে, মেয়ের বিয়ের সমস্যা ফিরে আসে। চলতে থাকে। তার সমাধান এক দীর্ঘ, বাঁকা যে-পথে খোঁজে সোহিনী, তার অংশ হয়ে আসেন মন্মথ চৌধুরী নামের এক প্রৌঢ় অধ্যাপক, তিনি কন্যা নীলার জন্যে প্রত্যাশিত বর ‘রেবতীর শিক্ষক, প্রথম দিককার অধ্যাপক’। গল্পকারের ভাষায় সোহিনী ‘তাঁকে নিল বশ করে।’ এই অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ছাত্র রেবতী ভট্টাচার্যকে নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়েই আসে তারও ইতোমধ্যেই বশ হয়ে থাকার তথ্য। কি রকম? অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, ‘শিশুকাল থেকেই একটি মেয়ে গ্রহ ওর কুষ্ঠি দখল করে রেখেছে।’ এরপরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যাপক চৌধুরী আরো যা বলেন, সেখানেই রয়েছে ম্যাট্রিয়ার্কাল সমাজের প্রসঙ্গ, আমরা তা ইতিমধ্যেই সবিস্তারে উদ্ধৃত করেছি। অধ্যাপক এবং সোহিনী দুজনেই সেখানে বাংলাদেশের সমাজে এখনো কার্যকর ম্যাট্রিয়ার্কির আকার-আয়তন নিয়ে কথা বলেন। একটু পরে স্বামীর মৃত্যুর পরে সহায়-সম্পত্তির লড়াইয়ে নিজের জয়ের ‘কৌশল’ প্রসঙ্গে সোহিনী নিজেই বেশ খোলামেলা বলে, অধ্যাপকের সঙ্গে তার সে-সংলাপ নিম্নরূপ :

“… বিষয়ের দখল নিয়ে মামলা করতে হয়েছে বিস্তর। যে করে জিতেছি সেটা বলবার কথা নয়।”

“শুনেছি কিছু কিছু। বিপক্ষ পক্ষের আর্টিকেলড ক্লার্ককে নিয়ে তোমার নামে গুজব রটেছিল। মকদ্দমায় জিতে তুমি তো সরে পড়লে। সে লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যায় আর-কি।”

“এত যুগ ধরে মেয়েমানুষ টিকে আছে কী করে। ছল করায় কম কৌশল লাগে না, লড়াইয়ের তাগবাগের সমানই সে, তবে কিনা তাতে মধুও কিছু খরচ করতে হয়। এ হল নারীর স্বভাবদত্ত লড়াইয়ের রীতি।”

                                                                                                        (পৃ ৬১৮, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

কুরূপা চিত্রাঙ্গদাও কামদেব/ মদনের কাছে সুরূপ প্রার্থনা করতে গিয়ে রূপ, লাস্য ইত্যাদি সম্পর্কে যুদ্ধবিদ্যার বোধই ব্যক্ত করে; রবীন্দ্রনাথের গীতিনৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদায় এই পৌরাণিক কাহিনীর যে-ভাষ্য পাওয়া যায়, তাতে সে বলে, ‘শিখিয়াছি যুদ্ধবিদ্যা, / শিখি নাই হাবভাব বিলাসচাতুরী’, ইত্যাদি। অর্থাৎ, সোহিনীর ওই ভাষ্যে মেয়েদের ‘হাবভাব বিলাসচাতুরী’ তাদের নিজেদের চোখেই যুদ্ধবিদ্যা, ক্ষমতা-বিস্তারের উপায়। অতএব, অতঃপর অধ্যাপক চৌধুরী সোহিনীকে বলেন, ‘… আমি যে তখন প্রোফেসর ছিলুম, আর্টিকেলড ক্লার্ক ছিলুম না, সেটা আমার বাঁচোয়া। মার্করি সূর্যের কাছ থেকে যতটুকু দূরে আছে ততটুক দূরে থেকেই বেঁচে গেল। ওটা গণিতের হিসেবের কথা, তবে ওতে ভালো নেই মন্দ নেই।’ (পৃ ৬১৮, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) ইত্যাদি।

তার অর্থ কি এই যে, অন্তত অধ্যাপক চৌধুরীর বিচারে নারীর নৈকট্য ধ্বংস ডেকে আনে বস্তুজগতের নিয়মগুলির মতো অমোঘ রীতিতে। একটু পরে এই অধ্যাপক একে বলেন ‘অঙ্কের হিসেব’, ‘অঙ্ককষার খেলা’ ইত্যাদি। গল্পের এই তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথের নিজের কি-না, বলা যাবে না; তবে তা তাঁর মগজের ভেতর দিয়ে অন্তত অতিক্রম করেছে। অধ্যাপক বলছিলেন, ‘আর একটা কথা কবুল করছি। এইমাত্র তোমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে একটা হিসেব মনে মনে কষছিলুম, সেও অঙ্কের হিসেব। ভেবে দেখো, বয়সটা যদি অন্তত দশটা বছর কম হত তা হলে খামকা আজ একটা বিপদ ঘটত। কোলিশন ঐটুকু পাশ কাটিয়ে গেল। আর কি। তবু বাষ্পের জোয়ার উঠছে বুকের মধ্যে। ভেবে দেখো, সৃষ্টিটা আগাগোড়াই অঙ্ককষার খেলা।’ (পৃ ৬১৮)

এরা রবীন্দ্রনাথের নিজের কথা না-হোক, কিন্তু এদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিশ্চিত বোঝা যায়, যখন এর পরে গল্পের সর্বজ্ঞ (ড়সহরংপরবহঃ) বর্ণনাকারীর কাছ থেকে নিম্নরূপ মন্তব্যটি পাওয়া যায় : ‘এই বলে চৌধুরী দুই হাঁটু চাপড়িয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। একটা কথা তাঁর হুঁশ ছিল না যে, তার সঙ্গে দেখা করবার আগে সোহিনী দু’ঘণ্টা ধরে রঙে-চঙে এমন করে বয়স বদল করেছে যে সৃষ্টিকর্তাকে আগোগোড়াই দিয়েছে ঠকিয়ে।’ তার অর্থ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ না হলেও, গল্পকার বলতে চেয়েছেন যে, নারীর রমণ-ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সচেতনতাই শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট নয়, একটা পরিমাণ জ্ঞান ও সচেতনতা সত্ত্বেও অধ্যাপক চৌধুরী সোহিনীর রূপচর্চার রূপের কাছেও সম্পূর্ণই পরাভূত হয়েছিলেন। অন্যথায়, তিনি তাঁর নিজের বয়স নিয়ে আক্ষেপ করতেন না। কোনো জ্ঞান বা চেতনাই বোধ করি নারীর রূপের কিংবা রূপের ছলনার বিরুদ্ধে কার্যকর নয়। সে-অর্থে তা বয়স তথা প্রকৃতির বিরুদ্ধেও দীর্ঘকাল কার্যকর থাকে। গভীর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে : নারীবাদীরা নারীর এমন সব ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব।

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরী এবং সোহিনীর সরস আড্ডার বাক্যগুলিতে জীবনের অমোঘ সত্য কতটা ধরা পড়েছে, তা বড় বিচার-বিশ্লেষণ দাবি করে। এই প্রসঙ্গে আমার অবস্থানের সমর্থনে আমি খুঁজে পাচ্ছি অনেক-অনেক উক্তি এবং উচ্চারণকে। যেমন, অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর ছাত্র রেবতী ভট্টাচার্যের পারিবারিক পটভূমি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে রেবতীর এক পিসি সম্পর্কে বলেন, ‘এতটুকু খুঁত নিয়ে ওঁর খুঁতখুতুনি সংসারকে অতিষ্ঠ করে তুলত। তাঁকে ভয় না করত এমন লোক ছিল না পরিবারে। ওর হাতে রেবতীর পৌরুষ গেল ছাতু হয়ে। ইস্কুল থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে পঁচিশ মিনিট লাগত তার জবাবদিহি করতে।’ রেবতীর এই পিসির মতন মানুষ কি সংসারে খুবই দুর্লভ? আর, এদের উপস্থিতি এবং সক্রিয়তা সত্ত্বেও পুরুষতন্ত্র কিংবা পিতৃতন্ত্র বলে যা বোঝানো হয়, তা কতটা সত্য থাকে, কার্যকর? এখানে এক নারীকে ‘ভয়’ পাওয়ার যে দাবি অধ্যাপক চৌধুরী করেন, মনে পড়বে বিখ্যাত ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পেও রয়েছে এক গোটা পরিস্থিতি – যেমন এলোমেলো, তেমনই ভারসাম্যহীন, তাতে অধ্যাপক চৌধুরী এবং সোহিনীর এর পরের আলোচনাটুকুও অনেক আলো ফেলে :

সোহিনী বললে, “আমি তো জানি পুরুষরা করবে শাসন, মেয়েরা দেবে আদর, তবেই ওজন ঠিক থাকে।”

অধ্যাপক বললেন, “ওজন ঠিক রেখে চলা মরালগামিনীদের ধাতে নেই। ওরা এদিকে ঝুঁকবে ওদিকে ঝুঁকবে। কিছু মনে করো না, মিসেস মল্লিক। ওদের মধ্যে দৈবাৎ মেলে যারা খাড়া রাখে মাথা, চলে সোজা চালে। যেমন -’

(পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

ওদের আড্ডায় এই এক দুর্লভ মুহূর্ত, সোহিনীকে বলতে শোনা যাচ্ছে অত্যন্ত আত্মসমালোচনামূলকভাবে, ‘কিন্তু আমার মধ্যেও শিকড়ের দিকে মেয়ে মানুষ যথেষ্ট আছে।’  ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর সোহিনী যখন আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু শুধু পিসিমাদের দোষ দিলে চলবে কেন। মায়ের দুলাল ভাইপোদের হাড় বুঝি কোনো কালে পাকবে না।’ (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮), তখন অধ্যাপক চৌধুরী আবার ফিরে যান ম্যাট্রিয়ার্কির প্রসঙ্গে; বলেন, ‘সে তো পূর্বেই বলেছি। মেট্রিয়ার্কি রক্তের মধ্যে হাম্বাধ্বনি জাগিয়ে তোলে। হতবুদ্ধি হয়ে যায় বৎসরা।’ (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) ইত্যাদি। বাঙালি হিন্দুর অধিকাংশ দেবীপূজার এ এক চমৎকার সেমিওলজি, রবীন্দ্রনাথের গল্পে। কিন্তু বাঙালি মুসলমান বৎসরাও কি এই সেমিওলজির বৃত্তেই এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে না? তাদের হাড় কি পাকছে, ভিন্নভাবে? সে যাক। সোহিনী তখন চ্যালেঞ্জ নেয়, রেবতীকে সে ‘টেনে তুলবে ডাঙায়’। (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) অতঃপর সোহিনীর সধবা-বিধবা – উভয় জীবনের যেসব টুকরো-টুকরো সত্য সে প্রকাশ করে, তাতে গল্পকার রবীন্দ্রনাথের নারী-চরিত্রের জ্ঞান অনেকটাই ফেটে পড়েছে। স্বামী নন্দকিশোর বেঁচে থাকতে এবং তার মৃত্যুর পরও সোহিনী পবিত্র জীবন যাপন করেনি, সে নিজেই জানায়। পুরুষের পতিতাগমনের যে সত্যই শুধু সমাজে প্রতিষ্ঠিত, অতঃপর দেখা যায়, নারীর জন্যে তারও প্রয়োজন হয় না। সংসারই সেখানে যথেষ্ট পতিতালয়। এটা বিস্ময়কর যে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এখানে হঠাৎ একবচনের স্থানে বহুবচন এসেছে, এক সোহিনী সেখানে সব নারীর কথা বলছে। এ যেন রীতিমতো ‘তত্ত্ব’-বিস্তার, এ-যুগের ভাষাভঙ্গিতেই।

সমাজ-সংসার যে নারী-পুরুষের মিলিত যৌনতা-ক্লিন্নতায়ই পূর্ণ, সে-সত্যই ফেটে পড়ে। গবেষক পুরুষদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে সে প্রথমে বলে, ‘নোংরা আমি। দু’চার জনের সঙ্গে জানাশোনা হয়েছে, যাদের কথা মনে পড়লে আজও মনের মধ্যে মুচড়িয়ে ধরে।’ (পৃ ৬২০, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)  এরপরে তার ভাষা তত্ত্বের, ‘থিওরি’র, ‘মন যে লোভী, মাংসমজ্জার নীচে লোভের চাপা আগুন সে লুকিয়ে রেখে দেয়, খোঁচা পেলে জ্বলে ওঠে। আমি তো গোড়াতেই নাম ডুবিয়েছি। সত্যি কথা বলতে আমার বাঁধে না। আজন্ম তপস্বিনী নই আমরা। ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদীকুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতাসাবিত্রী।’ (পৃ. ৬২০, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)।

লিঙ্গভিত্তিক বিচারকে চূড়ান্ত ও সামগ্রিক করে তোলার ফলে বর্তমান বিশে^ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এরপরে দেখা যায় সোহিনীর মধ্যে তার উপলব্ধি। সে তাই রেবতীর পিসির ক্ষতিকর মনোভাব এবং ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রার্থনা জানায় যেন তেমন ‘মেয়েলিবুদ্ধি’ ভর করবার আগেই তার মৃত্যু হয়, ‘… মেয়েলিবুদ্ধি বিধাতার আদি সৃষ্টি। যখন বয়স অল্প থাকে মনের জোর থাকে, তখন সে লুকিয়ে থাকে ঝোপেঝাপে, যেই রক্ত আসে ঠান্ডা হয়ে বেরিয়ে আসেন সনাতনী পিসিমা। তার আগেই আমার মরবার ইচ্ছে রইল।’ (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

দেখা যাচ্ছে নারীর রূপ ও রমণের ক্ষমতাকে চিহ্নিত করার সঙ্গে-সঙ্গে অনুমোদন ব্যক্ত করছেন রবীন্দ্রনাথ রক্তমাংস এবং প্রবৃত্তির অধিকারী নারীর প্রতিই, ক্ষমতাকে যে নেতিবাচকভাবে প্রয়োগ করে – রেবতীর যে পিসিমা, তার প্রতি নয়। এরূপ নেতিবাচক অহংয়ের অধিকারী এক নারীর পরিচয় রয়েছে অপর এক সাহিত্যকর্মে, নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক ডরিস লেসিংয়ের প্রথম উপন্যাস, দ্য গ্রাস ইজ সিংগিং-এর নায়িকা সে। এখানে ম্যারি নামে এই নারীর প্রসঙ্গে বলবো অপর যে-কারণে, তা হচ্ছে, সেখানেও লেখিকার ভাষা এক পর্যায়ে তত্ত্ব-উপযোগী হয়ে ওঠে, বিশ্বজনীন সত্য উচ্চারণের কণ্ঠস্বর লাভ করে তা। মহৎ সাহিত্য দেশে-দেশে মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের ঊর্ধ্বের যে রূপকে, রীতি-বৈশিষ্ট্যকে উপস্থিত করেছে, বিস্ময়কর যে, এ-যুগের নারীবাদের আতিশয্য তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে, অবজ্ঞাও। তার স্বরূপ জানাতেই দ্য গ্রাস ইজ সিংগিং উপন্যাসের নায়িকা সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের কিছু উন্মোচনকে, রীতিমতো তত্ত্ববিচারকে উপস্থিত করতে চাই। মানবজীবনের কত অংশেই যে ভয়াবহ সব ভারসাম্যহীনতা! এক গৃহপরিচারককে নিয়ে গৃহকর্ত্রীর ভাবনা ডরিস লেসিং কি জানাচ্ছেন? তিনি যা জানাচ্ছেন, তারপরে কী আর নারীর ক্ষমতা সম্পর্কে ভিন্ন তত্ত্ব-আলোচনার প্রয়োজন হয়? Ô… this boy she would keep : so she said to herself. But, she never relaxed her will; her will that he would do as she said, as she wanted, in everything.Õ (83)

রবীন্দ্ররচনাবলীতে তথা রবীন্দ্রদর্শনে ‘ল্যাবরেটরি’ এতটুকুও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। বহু গদ্য এবং পদ্য রচনায় রবীন্দ্রনাথ উন্মোচন করেছেন যাকে বলা হয়েছে নারীর রমণক্ষমতা (erotic power)-কে। সমালোচক-বিশ্লেষকগণই বরং এগুলিকে লক্ষ করতে এবং উচ্চকিতভাবে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমি এর কিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে নিতে চাই। শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত রায়ের কণ্ঠে শোনা যায় : ‘পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু হবে। দুর্বলের আধিপত্য ভয়ঙ্কর।’ এখানকার ‘দুর্বল’ শব্দটি, বোঝাই যায়, বাস্তব এবং আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত, কারণ, এটাই গোটা তর্ক-বিতর্কের পটভূমি তৈরি করে। অমিত রায়ের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে অন্যত্র আমি লিখেছিলাম নিম্নরূপ, যার শেষাংশে নারীর ক্ষমতা সম্পর্কে আবার রবির উদ্ধৃতি আরো গভীরার্থক নির্ণয় :

আধিপত্য কিংবা ক্ষমতার মতো ব্যাপারকে যেভাবে কোনো ব্যক্তি, শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্যে একক-নির্দিষ্ট বলে বলা হয়, বাস্তব জীবন কিন্তু তাকে তার চেয়ে অনেক বিস্তৃততর, এমন কি সর্বজনীন বলেই প্রমাণ করে। ক্ষমতার মতো প্রজাপতি বৈশিষ্ট্য এখনকার সব ব্যবস্থাকে অতিক্রম করেই সত্য হয়ে উঠতে চেয়েছে, উঠেছে। তাকেই বলা হয় দ্বন্দ্ব, দ্বান্দ্বিকতা। ক্ষমতা বা আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া, রূপ ইত্যাদি বিচিত্রও বটে, একটি কিংবা কয়েকটি চিহ্নে বা রূপেই যে তাকে চেনা যাবে তা কখনোই নয়। শোষিত বা নির্যাতিত প্রাণীকেও সকল অর্থে শুভ্র বা পবিত্র মনে করার সুযোগ নেই। এরূপ গভীর প্রসারী-এক বাস্তবতা বোধ প্রকাশ পায় অমিত রায়ের মুখের বিখ্যাত কিছু কথায় : ‘যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে, অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধে বটে, কিন্তু  ভোলায় না; আফিমওয়ালী বাঁধে বটে, ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটা আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার যোগান দেয়।’ (পৃ ১১৪, কথা কালান্তরের, প্রগতি)

চিত্রাঙ্গনা কাব্যনাট্যেও খোদ চিত্রাঙ্গদার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দেখা যায় ভিন্ন এক ক্ষমতার কিংবা ভিন্ন ‘ধনুর্বিদ্যা’ হিসেবে ‘হাবভাব, বিলাসচাতুরী’র মতো একটি ধারণা, মদন কিংবা কামদেবের কাছে রূপ প্রার্থনা করতে গিয়ে সে নিজের এবং নিম্নরূপ বিবরণ দেয় :

পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা,

লাভ নাই মনোহরণের দীক্ষা –

         কুসুমধনু;

অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু।

       অর্জুন ব্রহ্মচারী

মোর মুখে হেরিল না নারী,

ফিরাইল, গেল ফিরে।

       দয়া করো অভাগীরে –

শুধু এক বরফের জন্যে

      পুষ্পলাবণ্যে

মোর দেহ পাক তব স্বর্গের মূল্য

      মর্তে অতুল্য।

                  (পৃ ৪৮১, গীতবিতান, প্রতীক, ১৯৯৫)

নারীর বড় দীক্ষা যে পুরুষের ‘মনোহরণের’, মদনের কাছে করা চিত্রাঙ্গদার প্রার্থনায় তা যেমন স্পষ্ট, প্রদত্ত বরের বিবরণে মদনও তেমনি স্পষ্ট করেই, ‘শর’, ‘বন্দী’ ইত্যাদি শব্দের সাহায্যে একটি বিরোধ এবং যুদ্ধকেই নির্দেশ করেন। চিত্রাঙ্গদাকে উপেক্ষা করেছে যে পুরুষ অর্জুন, সে ‘নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসী’। ক্ষমতার কেন্দ্রে তা হলে কে – পুরুষ, না নারী? চলুন, মদনের বর দেওয়ার ঘোষণাটি লক্ষ করি :

     তাই আমি দিনু বর,

কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর,

     মম পঞ্চম পর –

নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসীরে

     পাবে অচিরে –

বন্দী করিবে ভুজপাশে

     বিদ্রƒপহাসে।

মনিপুর রাজকন্যা

  কান্তহৃদয়বিজয়ে হবে ধন্যা।

                    (পৃ ৪৮১, গীতবিতান, প্রতীক, ১৯৯৫)

রূপচর্চা কিংবা রমণবিদ্যা মানব-ইতিহাসে এক তথাকথিত সমাজ-বহির্ভূত কাঠামো পেয়েছে পতিতাবৃত্তিতে। কিন্তু সম্পূর্ণ সমাজ-অন্তর্গতভাবে এর চর্চা, প্রয়োগ, ব্যবহার কি খুব কম, অদৃশ্য? রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি নারীর ক্ষমতা, বিশেষত তার রমণক্ষমতার একটি প্রদর্শনী এবং পরীক্ষাগার, ‘ল্যাবরেটরি’। এ-গল্পটি রচনার কোনো পটভূমি ইতিহাসের কোথাও রয়েছে কি না, আমি জানি না, তবে তা খুবই সন্ধানযোগ্য, খুবই কর্তব্য একটি গবেষণা হতে পারে। চিত্রাঙ্গদার ক্ষেত্রে কিন্তু এরূপ বিবরণ রবীন্দ্রনাথই রেখে গিয়েছেন, খুব মূল্যবান আলো তা ফেলে। সে যাই হোক। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে মৃত স্বামীর ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা হিসেবে সোহিনী যখন অধ্যাপক রেবতী ভট্টাচার্যকে লক্ষ করে এগোবে ভাবলো, তখন অধ্যাপক চৌধুরীর সঙ্গে শলা-পরামর্শের এক পর্যায়ে কিন্তু চিত্রাঙ্গদায় প্রাপ্ত নারীর যুক্তিবিদ্যা-ধনুর্বিদ্যা ‘হাবভাব-বিলাসচাতুরী’র প্রসঙ্গটা আসে, প্রায় তত্ত্বসদৃশ ভাষায়। এ আমি আগেও বলেছি। প্রসঙ্গের দাবিতে পুনরুদ্ধৃতি দিচ্ছি। অধ্যাপক চৌধুরীকে সোহিনী এখানে নিম্নরূপ দেয় : ‘এত যুগ ধরে মেয়েমানুষ টিকে আছে কি করে। ছল কলায় কম কৌশল লাগে না, লড়াইয়ের তাগবাগের সমানই সে, তবে কি না তাতে মধুও কিছু খরচ করতে হয়। এ হলো নারীর স্বভাবদত্ত লড়াইয়ের রীতি।’ (পৃ ৬১৮, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) এরপরে যাবো গল্পের পঞ্চম ভাগে যা সোহিনীর তো ঠিক নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রযোজিত পরিচালিত নারীর ‘লড়াইয়ের’ দৃশ্য।

রূপ-যৌবন-রমণবিদ্যার মিলিত প্রয়োগে অধ্যাপক রেবতী ভট্টাচার্যকে জয় করার সেই আয়োজনের যে-বিবরণ রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে এসেছে, তাঁর গোটা রচনাবলিতেও নিশ্চয় তা নজিরবিহীন। এসবের বিশুদ্ধ রোমান্টিক কিংবা আবেগী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যাঁরা করেন, কখনো-কখনো রবীন্দ্রনাথও তাতে শামিল, তাঁরা নিশ্চয় রণে ভঙ্গ দেবেন। এর সবকিছু যত যুদ্ধসজ্জিত, রণপরিকল্পিত, পুরুষের যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক আবেগ তাতে যাবে উড়ে, যাবে ভস্ম হয়ে। দেহজ-‘ক্লেদজকুসুম’ যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে! রেবতীকে জয় করার জন্যে ‘বোটানিকালে’ পৌঁছেছিল পাকা-বেসাতী মানুষ সোহিনী, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মেয়ে নীলাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে – সে এক পরিবেশন বটে! কিন্তু এই পরিবেশনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল অধ্যাপক রেবতীর জীবনের ক্ষমতাবতী মানুষটি, তার পিসি, যার উল্লেখ আমরা সময়মতো দেখবো। চলুন, দেখি সৈন্যসজ্জা এবং তার প্রবেশ কীভাবে ঘটছে লক্ষ করি :

নদীর ঘাট থেকে আস্তে আস্তে দেখা দিল নীলা। রোদদুর পড়েছে তার কপালে, তার চুলে। বেনারসি শাড়ির উপরে জরির রশ্মি ঝলমল করে উঠছে। রেবতীর দৃষ্টি এক মুহূর্তের মধ্যে ওকে ব্যাপ্ত করে দেখে নিলে। চোখ নামিয়ে নিল পরক্ষণেই। ছেলেবেলা থেকে তার এই শিক্ষা। যে সুন্দরী মেয়ে মহামায়ার মনোহারিণী লীলা, তাকে আড়াল করে রেখেছে পিসির তর্জনী। তাই যখন সুযোগ ঘটে তখন দৃষ্টির অমৃত ওকে তাড়াতাড়ি এক চুমুকে গিলতে হয়।

                        (পৃ ৬২৩, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

এবারে রেবতী ভট্টাচার্যের এই পিসি সম্পর্কে দু-এক কথা বলা প্রয়োজন। গল্পে তিনি রেবতীর মাতৃস্থানীয়া। নারীর তথা ক্ষমতার বৃত্তি যে শুধু ইরোটিক তথা রমণধর্মী নয়, সে-সত্যটিও পরিষ্কার হওয়া দরকার। তা শুধু জৈবিক তথা যৌনতাকেন্দ্রিকও নয়। নিয়ন্ত্রণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রবৃত্তিও সত্য। অধ্যাপক চৌধুরী সোহিনীকে রেবতী আর তার পিসি সম্পর্কে নিম্নরূপ বলেন :

রেবতীকে জন্ম দিয়েই ওর মা যান মারা। বরাবর ও পিসির হাতে মানুষ। ওর আচারনিষ্ঠা একেবারে নিরেট। এতোটুকু খুঁত নিয়ে ওর খুঁতখুঁতনি সংসারকে অতিষ্ঠ করে তুলত। তাকে ভয় না করত এমন লোক ছিল না পরিবারে। ওর হাতে রেবতীর পৌরুষ গেল ছাতু হয়ে। ইস্কুল থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে পঁচিশ মিনিট লাগত তার জবাবদিহি করতে।

                     (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

সংসারের বিভিন্ন কিসিমের নর-নারী সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য, ধারা ইত্যাদির জ্ঞান, উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের কেমন ছিল, তা সম্পূর্ণ লিঙ্গায়িত/ লিঙ্গভিত্তিক ছিল কি না, কী বোঝা যায় ওপরের উদ্ধৃতি থেকে? এই পিসি, অধ্যাপক চৌধুরীর বিবরণ মোতাবেক, রেবতীর জীবনের একাধিক ছোট-বড় গবেষণা-প্রকল্পকে মাটি করেছিলেন, এমনকি কেমব্রিজে যাওয়ার একটি সরকারি বৃত্তিকেও। সোহিনী এবং অধ্যাপক চৌধুরী দেখা যাচ্ছে এমন পরিস্থিতির জন্যে পিসিদের ভাইপোদের ব্যর্থতার অংশেও তাকিয়েছেন, ‘যেখানে মেট্রিয়ার্কি রক্তের মধ্যে হাম্বাধ্বনি জাগিয়ে তোলে, হতবুদ্ধি হয়ে যায় বৎসরা।’ (পৃ ৬১৯, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক)। রবীন্দ্রনাথের ন্যায়-অন্যায়ের সব ধারণা-উপলব্ধি এখানে রয়েছে, তাও মূল্যবান। যেমন, অধ্যাপক চৌধুরীর সোহিনীকে বলতে শোনা যায় নিম্নরূপ : ‘জানোয়ারগুলোকে শিরে ধরে তলিয়ে দেবার হাত তোমার, পাকা-লেজে ধরে তাদের উপরে তোলবার হাত তেমন দুরন্ত হয়নি। …’ ইত্যাদি। দেখা গেছে, রেবতীর পিসির ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ শতভাগ এবং নেতিবাচক। এরপরে আলোচনা পৌঁছে যায় সোহিনীর পূর্বোল্লিখিত স্বীকারোক্তিতে, ‘ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদীকুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতাসাবিত্রী।’ (পৃ ৬২০, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) আমার প্রশ্ন : বর্ণিত পরিস্থিতির জন্যে কি স্বয়ং সোহিনী এবং নন্দকিশোরের ‘অবৈরাগী’ ছাত্ররাও দায়ী নয়? যে-সোহিনী স্বীকার করে, ‘মন যে লোভী, মাংসমজ্জার নীচে লোভের চাপা আগুন সে লুকিয়ে রেখে দেয়, খোঁচা পেলে জ্বলে ওঠে’ (পৃ ৬১৮, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)? গল্পের এই ৪নং অংশ শেষ হয় রেবতীর পিসির ক্ষমতাবাজ নেতিবাচকতার প্রতি ধিক্কার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে।

এ-গল্পের ৫নং অংশ থেকে নিয়ে আরো বলার থাকে। কন্যা নীলাকে নিয়ে সোহিনীর যে রূপযুদ্ধ, প্রসাধন-অভিযান, তার নানা দিক, মাত্রা। এর বাহ্যিক লক্ষ্য অধ্যাপক রেবতী ভট্টাচার্য, যাকে করায়ত্ত করার প্রয়োজন ছিল প্রকৌশলী নন্দকিশোরের, ল্যাবরেটরিটিকে কিছু লোভী ব্যক্তির হাত থেকে রক্ষা করার একটি বৈষয়িক লক্ষ্য থেকে। বৃহত্তর একটি ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গেও এর জোর সংযোগ। সোহিনী তার নারীর ক্ষমতা-সম্পর্কিত জীবনবোধকে যাচাই করে নিতে চেয়েছিল এই আয়োজন থেকে। কিন্তু এর পদে-পদে মিথ্যে, মিথ্যাচার, আত্মপরতা, তার সঙ্গে মিশেল নানা আধুনিক ভাবনার। রেবতী ভট্টাচার্যকে সোহিনী পায়ে ধরে প্রণাম করলে, তার পক্ষে সাফাই হিসেবে বলল যে, রেবতী বিদ্যার দিক থেকে ‘সেরা ব্রাহ্মণ’ (পৃ ৬২০, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮), একটা প্রশ্নযোগ্য অভিযানের নানা অংশে এলোমেলো সব কাজ, কথা। রেবতীকে পটাতে সোহিনী তার বোটানির আগ্রহের উল্লেখ করে। বর্ণনাকারী রবীন্দ্রনাথ এখানে পাঠককে পরিহাস-তথ্য জানান যে, নন্দকিশোরের সঙ্গে সোহিনীর বর্মায় যাওয়া ‘কিন্তু সায়েন্সের চর্চায় নয়।’ (গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮) কী রকম? রবি জানাচ্ছেন, ‘নিজের ভিতর থেকে যে গাদ উঠত ফুটে, স্বামীর চরিত্রের মধ্যেও সেটা অনুমান না করে থাকতে পারত না। সন্দেহের সংস্কার ছিল ওর আঁতে আঁতে।’ (পৃ ৬২২, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)। এরপরেও পাই আরো কিছু মিথ্যেভাষণ, লেখক রবীন্দ্রনাথ আমাদের তা জানাতে থাকেন, যেমন বর্মা থেকে ‘এক গাছের চারা’ আনার ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে কি? – ‘আজই সকালে স্বামীর লাইব্রেরি ঘেঁটে এ নাম সোহিনী প্রথম বের করেছে। গাছটা চোখেও দেখেনি। বিদ্যার জাল ফেলে বিদ্বানকে টানতে চায়।’

(পৃ ৬২২, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)। এরপরে সোহিনীর আর এক মিথ্যাচার মেয়ে নীলাকে রেবতীর সামনে হাজির করার পথে আর একটি ধাপ। কী রকম?

বললে, “আমার স্বামী সহজে কিছু মানতেন না, তবু তাঁর একটা অন্ধবিশ্বাস ছিল ফলে ফুলে প্রকৃতির মধ্যে যা-কিছু সুন্দর, মেয়েরা বিশেষ অবস্থায় তার দিকে একান্ত করে যদি মন রাখে তাহলে সন্তানরা সুন্দর হয়ে জন্মাবেই। এ কথা তুমি বিশ^াস কর কি?”

বলা বাহুল্য এটা নন্দকিশোরের মত নয়।

রেবতী মাথা চুলকিয়ে বললে, “যথোচিত প্রমাণ তো এখনো জড় হয়নি।”

সোহিনী বললে, “অন্তত একটা প্রমাণ পেয়েছি আমার আপন মরেই। আমার মেয়ে অমন আশ্চর্য রূপ পেল কোথা থেকে? বসন্তের নানা ফুলের যেন-থাক্্-নিজের চোখে দেখলেই বুঝতে পারবে।”

দেখবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠল রেবতী। নাট্যের কোনো সরঞ্জাম বাকি ছিল না। (পৃ ৬২২, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

সোহিনী তার রাঁধুনি বামুনকে সাজিয়ে এনেছে পূজারী বামুনের বেশে। পরনে চেলি, কপালে ফোঁটা তিলক, টিকিতে ফুল বাঁধা, বেলের আঠায় মাজা মোটা পইতে গলায়। তাকে ডেকে বললে, “ঠাকুর, সময় তো হল, নীলুকে এবার ডেকে নিয়ে এসো।”

নীলাকে তার মা বসিয়ে রেখেছিল স্টীমলঞ্চে। ঠিক ছিল ডালি হাতে সে উঠে আসবে, বেশ খানিকক্ষণ তাকে দেখা যাবে সকালবেলার ছায়ায় আলোয়। (পৃ ৬২২, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ১৯৯৮)

রবীন্দ্রনাথ কোন জ্ঞান বেশি রাখতেন – রূপচর্চার, মনুষ্য, না নারী মনস্তত্ত্বের? সোহিনীর যে-ভূমিকাগুলি তিনি উপস্থিত করেছেন, তাতে কি প্রমাণ হয়? এরূপ প্রশ্ন আমাদের মনে এরপরে আরো আসতে থাকে – তাঁর চরিত্রদের নিয়ে তিনি আরো অগ্রসর হন। যেমন, সোহিনী যখন রেবতীকে ‘তন্নতন্ন করে দেখে নিতে লাগল’, তার সেই দেখার বিবরণ বা ছবি এবং মন্তব্য শরীর এবং চেহারাসমেত এই মানুষটি এবং গল্পকার রবীন্দ্রনাথের মনস্তত্ত্বের অগ্রসর এবং গভীর জ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু বলে :

রঙ মসৃণ শ্যামবর্ণ, একটু হলদের আভা আছে। কপাল চওড়া, চুলগুলো আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে উপরে তোলা। চোখ বড়ো নয় কিন্তু তাতে দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছ আলো জ্বলজ্বল করছে, মুখের মধ্যে সেইটেই সকলের চেয়ে চোখে পড়ে। নীচে মুখের বেড়টা মেয়েলি ধাঁচের মোলায়েম। রেবতীর সম্বন্ধে ও যতো খবর যোগাড় করেছে তার মধ্যে ও বিশেষ লক্ষ্য করেছে একটা কথা। ছেলেবেলাকার বন্ধুদের ওর ছিল কান্নাকাটি জড়ানো সেন্টিমেন্টাল ভালোবাসা। ওর মুখে যে একটা দুর্বল মাধুর্য ছিল, তাতে পুরুষ বালকদের মনে মোহ আনতে পারত। (পৃ ৬২২)

রেবতী এবং নন্দকিশোরের তুলনামূলক অনাকর্ষণ আর আকর্ষণের আভাস দিয়ে এগোতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক মনস্তত্ত্বের এমন জ্ঞান বিস্ময়কর ঠেকে। তারই কাঠামোয় কখন রেবতী নীলার জন্যে ব্যবহারযোগ্যমাত্র শিখণ্ডী হয়ে দাঁড়াতে পারে, ল্যাবরেটরির ট্রাস্ট এবং নীলার জীবনের যুগ্ম প্রকল্পের পক্ষে – সেই শঙ্কায় সোহিনী ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত হয়ে পড়ছে বলে মনে হবে পাঠকের। নন্দকিশোরের সঙ্গে তার নিজের অতীতের ভাবনা তুলনায় আসে। সোহিনীর মনের অবস্থাটা গল্পকার রবীন্দ্রনাথ নিম্নরূপ জানাচ্ছেন :

মনে পড়ল নিজের প্রথম বয়সের রসোন্মত্ততার ইতিহাস। ও যাকে টেনেছিল কিংবা যে টেনেছিল ওকে, তার না ছিল রূপ, না ছিল বিদ্যা, না ছিল বংশগৌরব। কিন্তু, কী একটা অদৃশ্য তাপের বিকিরণ ছিল যার অলক্ষ্য সংস্পর্শে সমস্ত দেহ মন ও তাকে অত্যন্ত করে অনুভব করেছিল পুরুষ মানুষ বলে। নীলার জীবনে কখন এক সময়ে সেই অনিবার্য আলোড়নের আরম্ভ হবে এই ভাবনা তাকে স্থির থাকতে দিত না। যৌবনের শেষ দশাই সকলের চেয়ে বিপদের দশা, সেই সময়টাতে সোহিনীকে অনেকখানি ভুলিয়ে রেখেছিল নিরবকাশ জ্ঞানের চর্চায়। কিন্তু দৈবাৎ সোহিনীর মনের জমি ছিল স্বভাব উর্বরা। কিন্তু সে জ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক, সব মেয়ের তার প্রতি টান থাকে না। নীলার মনে আলো পৌঁছয় না।

নারীর কামদ ক্ষমতার (erotic power) সত্যকে ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের নায়িকা সোহিনীর মধ্য দিয়ে যত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, এ-প্রশ্নে কন্যা নীলার সঙ্গে সোহিনীর যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ, এ সবই এ-গল্পকে রবীন্দ্রসাহিত্যে, রবীন্দ্র-ভাবনাজগতে অনন্য করে তুলেছে, অবিস্মরণীয়। সোহিনীর মধ্যে তবু কামদ ক্ষমতার পাশাপাশি ‘জ্ঞানের চর্চা’র একটি অংশ ছিল, নীলা কি সেই তুলনায় নারীর ক্ষমতা ধারণার আরো সত্য প্রতিনিধি, নারীর ‘রসোন্মত্ততার’ – যে নীলার কথা তার মা সোহিনীই বলেছেন আলাদা করে, যে ‘নীলার মনে আলো পৌঁছয় না।” নর-নারীর মানস গড়নের এমন গভীর জ্ঞান, ব্যাপ্ত জ্ঞান, রবীন্দ্রনাথ কিভাবে অর্জন করেছিলেন?

বাস্তবে অর্থাৎ নারীর যুদ্ধযাত্রায় সক্রিয় এখন কিন্তু মা-মেয়ে, সোহিনী-নীলা দুই দেহ – এক আত্মা। ধাপে-ধাপে এখানকার মিথ্যেগুলিকে উন্মোচন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। নীলাকে উচ্চকিত সাজসজ্জায় পরিবেশন করেও সোহিনী যখনই দেখছে রেবতীর মনোযোগ কিংবা উৎসাহের অভাব, তখনই সোহিনীর ‘মনে মনে রেবতীকে ধিক্কার’ কিংবা তার কাটব্য : ‘নাঃ আর পারা গেল না।’ ইত্যাদি। এ একেবারে দেবতা মদনের উদ্দেশে সেই কুরূপা চিত্রাঙ্গদার ক্ষোভ : ‘অর্জুন ব্রহ্মচারী/ মোর মুখে হেরিল না নারী, ফিরাইল, গেল ফিরে।’ ইত্যাদি। পৌরাণিক তথা রাবীন্দ্রিক বিশে^র এই ধারণা-কাঠামো রীতিমতো যুদ্ধের, পাঠকের মনে পড়বে আশা করি। সেখানে ব্রহ্মচর্যা যেমন ‘পুরুষের স্পর্ধা’, রূপ হচ্ছে ‘নিরস্ত্র নারীর অস্ত্র’, ‘অবলার বল’ ইত্যাদি। মদন দেবতার উদ্দেশে অর্জুন-উপেক্ষিতা এবং কুরূপা চিত্রাঙ্গদা রূপের যে প্রার্থনা জানায়, তাতে বারবার-বারবার যুদ্ধের ধারণা; রূপ সম্পর্কে ধারণা অস্ত্রের, চিত্রাঙ্গদা : পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা

            লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা

            কুসুমধনু,

            অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু।

*        *         *        *

           শুধু এক বরষের জন্যে

           পুষ্পলাবণ্যে

           মোর দেহ পাক তব স্বর্গের মূল্য

           মর্তে অতুল্য ॥

মদন :    তাই আমি দিনু বর,

           কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর,

           মম পঞ্চম শর –

           দিবে মন মোহি,

           নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসীরে

           পাবে অচিরে

           বন্দী করিবে ভুজপাশে

           বিদ্রƒপ হাসে

           মনিপুর রাজকন্যা

           কান্তহৃদয় বিজয়ে হবে ধন্যা।

(পৃ ৪৮১, গীতবিতান, প্রতীক, ১৯৯৫, ঢাকা)

এখানে গোটা শাসনকাঠামো নারীর নিয়ন্ত্রণে, নারীর প্রতি অমনোযোগের আচরণ বিদ্রোহের সমতুল্য আর মনোযোগ কিংবা সমর্পণ ‘বন্দী’ত্ব, নারীর পক্ষে তা ‘বিজয়’। কিন্তু এ যে উল্টোরথের যুদ্ধ, তাই প্যারিসের সঙ্গে পলায়নকালে হেলেনের যেমন আলতো পদক্ষেপ, আপাত-আলতো নিশ্চয়, ÔLightly she crossed the threshold/ and left her palace, fearless/ Of what should wake her fears;/ And took to Troy as dowry/ Destruction, blood and tears.Õ (p 57, Aeschylus, The Oresteian Trilogy, Tr. by Philip Vellacott, Penguin Books, 1988, London)। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের এই মোক্ষম মুহূর্তেও নীলা ‘ডালি হাতে এল ধীরে ধীরে।’ কিন্তু সোহিনীর প্রযোজিত এই নাটকে, আবারো উদ্ধৃত করি, ‘নাট্যের কোনো সরঞ্জাম কি ছিল না।’ নীলার ‘ডালিতে ছিল দুর্লভ জাতীয় অর্কিডের মঞ্জরি, রুপোর থালায় ছিল বাদামের তক্তি, পেস্তার বরফি, চন্দ্রপুলি ক্ষীরের ছাঁচ, মালাইয়ের বরফি, চৌকো করে কাটা ভাপা দই।’ এসব খাদ্য খাদ্যই, কিন্তু পেশকৃত তথ্য মিথ্যে। কি রকম? সোহিনী বললে, ‘এ সমস্তই তৈরি নীলার নিজ হাতে।’ রবীন্দ্রনাথকে রোমান্টিসিজমের আতিশয্যের জন্যে অভিযুক্ত করেছি আমিই, কিন্তু তিনিই তার গোমড় ভাঙেন। ভেঙেছেন কিভাবে? পাঠকের জন্যে লেখকের এই মুহূর্তের উন্মোচন : “সোহিনী বললে, ‘একটু মুখে দিতে হয় বাবা, ঘরে তৈরি তোমারই উদ্দেশে।” প্রকৃতপক্ষে এ সব ফরমায়েশে তৈরি বড়ো বাজারের এক চেনা দোকানে। ‘সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। এসব কাজে নীলার না ছিল হাত, না ছিল মন।’ (পৃ ৬২৩)।

গল্পের এই পঞ্চম অংশ শেষ হওয়ার পূর্বেই পরিষ্কার হয় যে, এরপরের দৃশ্যে এ-নাটকের নিয়ন্ত্রণ-পরিবর্তনের শঙ্কা ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে সোহিনীর মনে – তার কর্তৃত্ব চলে যাবে কন্যা নীলার হাতে। নীলা ইতোমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর, অধ্যাপক রেবতীও তাতে সাড়া দিচ্ছে। গল্পের এই পঞ্চম অংশের শেষে আমরা পড়ি : ‘নিজের স্বামীর অভিজ্ঞতা অনুসারে সোহিনীর ধারণা ছিল বিদ্যাসাধনার বেড়া দেওয়া থেত যে-সে গোরুর চরবার খেত নয়। আজ আভাস পেল বেড়া সকলের পক্ষে সমান ঘন নয়। সেটা ভালো লাগল না।’ (পৃ ৬২৪)।

রবীন্দ্রনাথ একাধিক ছোটগল্পে মেয়েদের চোখ দিয়ে মেয়েদের দেখিয়েছেন, পাঠককে। তেমন একটি গল্প ‘শেষের রাত্রি’তে যতীন-মনির দাম্পত্যকে যতীনের মাসি কোন আলোয়, কিভাবে দেখেছেন, আমি লিখেছি – নারী হয়ে এবং হয়েও মাসী মনির কি শক্তি দেখেছেন, কি দুর্বলতা। ‘ল্যাবরেটরি’তেও আমরা সোহিনীকে দেখছি কন্যা নীলাকে দেখতে। আশা করি পাঠক মানবেন, এ দেখা সম্ভবত অধিকতর নির্ভরযোগ্য, অবশ্য যদি রবির আলো ঠিক থাকে, রবীন্দ্রনাথের। সেখানে এর পরে গল্পের ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখা যায় সোহিনী পরদিনই অধ্যাপক চৌধুরীকে ডেকে কন্যা নীলার ওপরে তার অনাস্থা জানাচ্ছেন। কি রকম? কন্যা নীলাকে অধ্যাপক রেবতীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ‘মতলব’ তো তার ছিলই। বর্তমান কালে আমাদের চারদিকে যারা শুধু মেয়েদের দুঃখকষ্ট, নির্যাতন ইত্যাদির কথা বলেন, তারা কি মা সোহিনীর কন্যা নীলার এমন মূল্যায়ন নেবেন, নিতে পারবেন, চাইবেন? চৌধুরীকে সোহিনী বলেন, ‘… পুরুষের খোরাকে আমিষ পর্যন্ত ভালোই চলে কিন্তু মদ ধরালেই সর্বনাশ। আমার মেয়েটি মদের পাত্র, কানায় কানায় ভরা।’ (পৃ. ৬২৫)। তাদের এর পরের কথোপকথনে অনেক কিছু পরিষ্কার হয় :

“তা হলে কি করতে চাও বলো।”

“আমার ল্যাবরেটরি দান করতে চাই পাব্লিককে।”

“তোমার একমাত্র মেয়েকে এড়িয়ে গিয়ে?”

“মেয়েকে? ওকে দান করলে সে দান পৌঁছবে কোন্ রসাতলে কী করে জানব? আমার ট্রাস্ট সম্পত্তির প্রেসিডেন্ট করে দেব রেবতীকে। তাতে তো পিসির আপত্তি হতে পারবে না?”

“মেয়েদের আপত্তির যুক্তি যদি ধরতেই পারব তা হলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে গেলুম কেন? কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছিনে, ওকে যদি জামাই না করবে তা হলে প্রেসিডেন্ট করতে চাও কেন?”

“শুধু যন্ত্রগুলো নিয়ে কি হবে? মানুষ চাই ওদের প্রাণ দিতে। আর একটা কথা এই – আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটাও নতুন যন্ত্র আনা হয়নি। টাকার অভাবে নয়। কিনতে হলে একটা লক্ষ্য ধরে কিনতে হয়। খবর পেয়েছি, রেবতী ম্যাগনেটিজম নিয়ে কাজ করেছেন। সেই পথে সংগ্রহ এগিয়ে চলুক, যত দাম লাগে লাগুক-না।”

“কী আর বলব, পুরুষ মানুষ যদি হতে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে নেচে বেড়াতুম। তোমার স্বামী রেল-কোম্পানীর টাকা চুরি করেছিলেন, তুমি চুরি করে নিয়েছ তার পুরুষের মনখানা-এমন অদ্ভুত কলমের-জোর-লাগানোর বুদ্ধি আমি কখনো দেখি নি। আমারও পরামর্শ নেওয়া তুমি যে দরকার বোধ কর, এই আশ্চর্য।”

পাঠকের নিশ্চয় মনে পড়বে নন্দকিশোর-সোহিনীর দুই চুরির বিন্যাসেই পাওয়া যায় কাজী নজরুলের বিখ্যাত দুই শাসনের তত্ত্ব – ‘রাজা করিছেন রাজ্য শাসন/ রাজারে শাসিছে রানী’, ইত্যাদি। বাংলার দুই রেনেসাঁস বুদ্ধিজীবী – রবি আর নজরুল-এর দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিশ্বাস্য সব মিল। অবিশ^াস্য সমগ্রতা এবং দ্বান্দ্বিকতায় চারধার দেখেছেন তাঁরা। গল্পে এর একটু পরেই পাওয়া যাবে অধ্যাপক চৌধুরীর তথা রবির দুই বয়স্কার চরিত্রে একই রকম নিয়ন্ত্রণ-অভীপ্সা – রেবতীকে তাঁরা দুজনই চান নিয়ন্ত্রণ করতে। চৌধুরী তাই সোহিনীকে বলেন, ‘পিসিমা দি সেকেন্ড! এক পিসিমা দেবে এক গালে চাপড় আর এক পিসিমা দেবে অন্য গালে চুমু।’ (পৃ. ৬২৬)। ইতোমধ্যে একবার নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক ডরিস লেসিংয়ের তত্ত্ব-বিস্তারের দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম – উপন্যাসের (Text)-এর) অংশই কিভাবে যথেষ্ট তত্ত্ব প্রমাণিত হয়, বলেছিলাম। আমার সেই পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধেই লেসিংয়ের একটি সাক্ষাৎকারের অংশ উদ্ধৃত করে আমি এও বলেছিলাম, সেখানে তিনি এ-যুগে তরুণ-কিশোরদের সুস্থভাবে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার পক্ষে প্রতিকূল পরিবেশ কোথায় কি দেখছেন। The Observer পত্রিকার সাংবাদিক বারবারা এলেনকে ডরিস লেসিং নিম্নরূপ বলেন, এ-যুগের ‘নারীবাদীদের’ এবং ‘তরুণ নারীদের’ সম্পর্কে :

If it was some polemical crusade, it might be something, but it’s like young women have got 10 minutes to spare, so they may as well spend it rubbishing men. It’s part of the culture now. There’s an unconscious bias in our society : girls are wonderful; boys are terrible. And to be a boy, or young man, growing up, having to listen to all this, it must be painful. (2001)

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর ছাত্র রেবতী ভট্টাচার্যকে বলেন, ডরিস লেসিং যেমনটা সাংবাদিক বারবারা এলেনকে বলেছিলেন, রেবু, ওঠ বলছি ওঠ। মেয়েদের কাছে অমন মুখচোরা হয়ে থাকতে নেই। ওতে ওদের আস্পর্ধা বেড়ে যায়। ওরা তো পুরুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র পেলেই টেম্পেরেচার চড়িয়ে দেয় হু হু করে। সাবজেক্টটা জানা আছে, ছেলেগুলোকে সাবধান করতে হয়। আমার মতো যারা মার খেয়েছে, মরে নি, তাদের কাছ থেকেই পাঠ নিতে হয়। … (পৃ. ৬২৭)

‘ল্যাবরেটরি’ গল্প এরপরে মূলত ল্যাবরেটরির বৈষয়িক সম্পদের অংশ নিয়েই এগোতে থাকে। তারই মধ্য দিয়ে নারীদের মনস্তত্ত্ব, ক্ষমতার বোধের দ্বন্দ্বের উন্মোচন। তাতে মা সোহিনী আর মেয়ে নীলা দ্বন্দ্ব-বিরোধে জড়াতে থাকেন। ইতোমধ্যে অধ্যাপক চৌধুরীর সঙ্গে সোহিনীর সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। জাপানি ক্লাবের মেম্বাররা আবার নীলা আর রেবতীকে নিয়ে অগ্রসর হতে চায়। কিন্তু দু-দুটো বাধ্যকতায় পড়ে এই সন্ধিক্ষণেই অধ্যাপক চৌধুরী আর সোহিনীকে যেতে হয় বাসস্থান ছেড়ে, যথাক্রমে ওজরানওয়ালা আর আম্বালায়। মাঝখানের সময়টাতে জাপানি ক্লাবের মেম্বাররা নীলাকে ‘অভিনন্দন’ দেবে – এ সবকিছু নিয়ে যাতে কোনো হুজ্জতি না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে সোহিনী নীলাকে শাসিয়ে যায় – নীলার সোলিসিটর বঙ্কুবাবুকে উল্লেখ করে :

“তোমার বঙ্কুবাবুকে আমি সিধে করে দেব যদি আমার সীমানায় তিনি পা বাড়ান। আইনে না পারি, বে-আইনে। ফেরবার সময় আমি পেশোয়ার হয়ে আসব। আমার ল্যাবরেটরি রইল দিনরাত্রি চারজন শিখ সিপাইয়ের পাহারায়। আর যাবার সময় এই তোমাকে দেখিয়ে যাচ্ছি – আমি পাঞ্জাবের মেয়ে।” বলে নিজের কোমরবন্ধ থেকে ছুরি বের করে বলল, “এ ছুরি না চেনে আমার মেয়েকে, না চেনে আমার মেয়ের সোলিসিটরকে। এর স্মৃতি রইল তোমার জিম্মায়। ফিরে এসে যদি হিসেব নেয়ার সময় হয় তো হিসেব নেব।”  (পৃ ৬৩৩)

গল্পের একাদশ অধ্যায়ে দেখি নীলার পক্ষ থেকে এক অভিযানকে। গভীর রাতে সে তার ‘রাত-কাপড়’ পরে – ‘পাতলা সিল্কের শেমিজ’ ইত্যাদি, রেবতীর ল্যাবরেটরি ঘরে ঢুকে তার ‘কোলের উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল।’ এমন কিছু কি মেনেলসের প্রাসাদে অতিথি প্যারিসের ভাগ্যে জুটেছিল – হেলেনের দিক থেকে? বাহ্যিক দৃষ্টিতে এমন কিছু তো অভিযান, যুদ্ধ ইত্যাদির ধারেকাছে নয়, কিন্তু পরিণতিতে তো বাস্তব যুদ্ধ – ট্রয়ের – ঘটে। সোহিনীর নিয়োজিত পাঞ্জাবি প্রহরী বাধা দেওয়াতে নীলা কক্ষ ত্যাগ করে – ‘রাত-কাপড়ের ভিতর থেকে নীলার নিখুঁত দেহের গঠন ভাস্করের মূর্তির মতো অপরূপ হয়ে ফুটে উঠল, রেবতী মুগ্ধ চোখে না দেখে থাকতে পারল না।’ (পৃ ৬৩৪) – এর কোথাও পরিকল্পনা নেই – যুদ্ধের? রূপ-অচেতন চিত্রাঙ্গদার দশা কি নীলার? কিন্তু রেবতীর তো দশা পরিষ্কার পরাজিতের।

আমাদের মনে পড়ে কার্ল মার্কসকে, ধর্মকে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণের আফিম।’ মনে পড়ে এই ‘নেশা’-জাগরূক দ্রব্যটি রবিও তাঁর আর একটি রচনা – শেষের কবিতায় ব্যবহার করেন, অমিত রায়ের মুখে বসান – ‘মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা’ ইত্যাদি বক্তব্য। কিন্তু যা ঘটাতে চায়, সেখানে এ-যুগের ‘একমাত্র দৃশ্যমান ঈশ^র’ অর্থ – টাকা – ঢুকে পড়ে – ব্যাংক। অর্থ লেনদেনের প্রতিষ্ঠান ব্যাংক যুক্ত না হলে কি এলিটদের কোনো প্রবন্ধে ওজন-চটক প্রমাণ হয়? রবির সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ এলাকায় তাই ব্যাংকেরও স্থান হয়েছে, দেখা যাচ্ছে। তবে নীলার অভিযান অসম্পূর্ণ ছিল। তাই সে ফিরে আসে।

নীলা আবার ঘরের মধ্যে এল। বললে, “একটা কাজ আছে ভুলে গিয়েছিলুম।”

দারোয়ান রুখতে গেল। নীলা বললে, “ভয় নেই তোমার, চুরি করেতে আসিনি।”

“একটা কেবল সই চাই। জাপানী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করব তোমাকে, তোমার নাম আছে দেশ জুড়ে।”

অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে রেবতী বললে, “ও ক্লাবের আমি তো কিছুই জানি নে।”

“কিছুই তো জানবার দরকার নেই। এইটুকু জানলেই হবে, ব্রজেন্দ্রবাবু এই ক্লাবের পেট্রন।”

“আমি তো ব্রজন্দ্রবাবুকে জানি নে।”

“এইটুকু জানলেই হবে মেট্রপলিটন ব্যাঙ্কের তিনি ডাইরেক্টর। লক্ষ্মী আমার, যাদু আমার, একটা সই বৈ তো নয়।”

বলে ডান হাত দিয়ে তার কাঁধ ঘিরে তার হাতটা ধরে বললে,“সই করো।”

সে স্বপ্নাবিষ্টের মতো সই করে দিলে।

এই ‘স্বপ্নাবেশ’, ‘নেশা’ ইত্যাদি নারীর সেই অস্বীকৃত ক্ষমতা, যাকে চিহ্নিত না-করে মানবসমাজ চলেছে, চলছে। চলছে তার প্রাসঙ্গিক বিচার-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, পরিকল্পনা, আইন-প্রণয়ন ইত্যাদি। এর অর্থনীতি রয়েছে, রাজনীতি, রাজনৈতিক-অর্থনীতি। গল্পে এরপরে আরো ধরা পড়ে নীলার যে ‘নেশা’-ধরানোর ক্ষমতা, তার পক্ষে কিছু কারো সক্রিয়তাও (activism) ছিল। অর্থাৎ, এ কোনো বিশুদ্ধ মনস্তত্ত্বের, যোগাযোগ (communication) কিংবা সাজসজ্জা-রূপচর্চার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ পরিস্থিতি নয়। প্রমাণ? গল্পে এর পরে রবীন্দ্রনাথ যোগ করেছেন নিম্নরূপ :

কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ঢুকলো পাঞ্জাবী। বললে, “চারিদিকে আমি দরজা বন্ধ করে রাখি, তুমি ভিতর থেকে খুলে দিয়েছ।”

এ কি সন্দেহ, কী অপমান।

বার বার করে বললে, “আমি খুলি নি।”

“তবে ও কী করে ঘরে এল।”

সেও তো বটে। বিজ্ঞানী তখন সন্ধান করে বেড়াতে লাগল ঘরে-ঘরে। অবশেষে দেখলে রাস্তার ধারে একটা বড় জানলা ভিতর থেকে আগল দেওয়া ছিল, এতে সেই আগলটা দিনের বেলায় এক সময়ে খুলে রেখে গেছে।

শুধু রাত-কাপড়ের মতো উপকরণ নয়, আপাতনির্দোষ প্রসাধন আর রূপচর্চা, প্রয়োজনে নারীর ক্ষমতার তৎপরতায় যুক্ত হয় স্পষ্ট এবং সমাজ-স্বীকৃত অপরাধী কর্মকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথ এখানে তার প্রমাণ রেখে গেছেন। নারী-পুরুষের দেহ-সৌষ্ঠবের মতো প্রাকৃতিক ব্যাপারকে ঘিরে প্রসাধন সামগ্রীর বিশাল-বিপুল শিল্প-বাণিজ্য এবং তার অঘটন, ফাঁকি, চুরি, লুণ্ঠন যেমন চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তার সামূহিক ক্ষতিতে চিহ্নিত করা, তেমনি এই কামাগ্নির পক্ষে অন্য যে আহুতি ঘটতে থাকে, পড়তে – তাকে, তার ক্ষতিকে উন্মোচন করাও। মানবসভ্যতায় এ পর্যন্ত এর এই প্রয়োজনই আজ পর্যন্ত স্বীকৃত নয়, নিশ্চয় কামাগ্নির দাহেই, আবেশেই। সব মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিই কি বিবশ, বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছে রসোন্মত্ততায়? কিন্তু, এই এক দুষ্টচক্রের (vicious cycle) সংকটই হয়, তার কি কোনো সমাধান নেই?

তবে আপাতত, এখনো, তেমন উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই। বরং কায়েমি স্বার্থের অভিমুখে গড়ে উঠছে নানা রূপের নানা আঁতাত, সংঘ – যেমন এ গল্পের কাপালী ক্লাব। সেখানে রেবতী ভট্টাচার্যের জন্য যা মøান এবং নেতি তার ক্ষমতা, রবীন্দ্রনাথ বোধ করি এ-সত্যও উন্মোচন করেন কিভাবে তার মতো ডিগ্রিসর্বস্বকেও তারকা বানানো হয়, স্বার্থবাজদের সংকীর্ণ সব তাগিদে। এই বৃন্দবাদনে সংবাদপত্রও যে এক বাদ্যযন্ত্র, সম্মতি সৃষ্টির কোরাসে গুরুত্বপূর্ণভাবে শামিল, রবীন্দ্রনাথ দৃশ্যের সে-অংশের প্রতিও আমাদের চোখ টানেন। এ এক সামষ্টিক যজ্ঞ-প্রহসন। আসুন, আবার রবির বিবরণ পড়ি, দেখুন সমাজের কত সব ধারা, গোষ্ঠী শামিল সেখানে – গুণহীন, ডিগ্রিখচিত এবং গুরুত্বে শোভিত অধ্যাপক রেবতী ভট্টাচার্য কোন প্রয়োজনীয় মণ্ডলীর কেন্দ্রাসীন :

একটা পিঠ-উঁচু মখমলে-মোড়া চৌকি, মণ্ডলীর ঠিক মাঝখানেই। বুঝতে পারলে সমস্ত জনতার প্রধান লক্ষ্যই ও। নীলা এসে ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলে, কপালে দিলে চন্দনের ফোঁটা। ব্রজেন্দ্রবাবু প্রস্তাব করলেন ওকে জাপানী সভার সভাপতি পদে বরণ করা হোক। সমর্থন করলেন বঙ্কুবাবু, চারিদিকে করতালির ধ্বনি উঠল। সাহিত্যিক হরিদাসবাবু ডক্টর ভট্টাচার্যের ইন্টারন্যাশনাল খ্যাতির কথা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, “রেবতীবাবুর নামের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের জাপানী ক্লাবের তরণী খেয়া দেবে পশ্চিম-মহাসমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।” (পৃ ৬৩৫)

সমাজের বিভিন্ন পেশা-পদবির উচ্চবর্গীয়গণ কিভাবে পশ্চিমের ‘ঘাটে-মাঠে’ তরী ভেড়ায়, নানা স্বার্থোদ্ধারে, এ-সম্পর্কিত সভা-সংগঠন-সমিতি-আয়োজনের চিত্র কি এখনকার বাংলাদেশেও এখানে বর্ণিত রকম থেকে খুব কিছু বদলেছে? পরিস্থিতি বরং আরো বেশি নির্লজ্জতা আর নগ্নতার দিকে গিয়েছে। ঔপনিবেশিক সময়ে রবীন্দ্রনাথ এমনটা ঘটতে দেখেছেন, আরো বেশি ভয়াবহভাবে ঘটবে বুঝতে পেরেছেন। ফ্রানৎস ফানো যেমন সব দালালি আর পদলেহনের তত্ত্ব উপস্থিত করেছেন।

গণমাধ্যম সম্পর্কেও এখনো কি কিছু ভিন্ন দেখি? নীলাদের আয়োজনে দেখা গেল : সভার ব্যবস্থাপকেরা রিপোর্টারদের কানে-কানে গিয়ে বললে, “উপমাগুলোর কোনোটা যেন রিপোর্ট থেকে বাদ না যায়।”

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে এর পরের অনুচ্ছেদ মনোবিদদের বিশেষ বিষয়, সমাজতত্ত্বেরও স্তুতি-স্তাবকতার মাধ্যমে কিভাবে মিথ্যে-বানোয়াট নেতা-নেতৃত্ব তৈরি সম্ভব – পুতুল নেতৃত্ব, গল্পের এই অংশটুকু যেন তারই পরীক্ষাগার কিংবা মহড়ামঞ্চ। পরিস্থিতির বিষম চাপে কাফ্কার প্রেগর সাম্্সা যেমন কীটপ্রবরে পরিণত হতে পারে, তারই বিপরীত প্রক্রিয়ায় দুর্বলচিত্ত-হীনবল এক পদবিধারীও ফুলেফেঁপে উঠতে পারে নেতার/ শাসকের পরিচয়ে, আসনে। এমন মেটামরফসিসও নিশ্চয় সম্ভব। দেশে-দেশে বৈষয়িক স্বার্থের প্রতিনিধি সেজে হবু-গবুরা, রেগান-বুশরা নেতা কিংবা শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, হচ্ছেন। রেবতী ভট্টাচার্যের মতো দুর্বলচিত্তের ক্ষেত্রেই এমন রূপান্তর ঘটা বেশি সম্ভব, সহজ। রবির বর্ণনায় এর নিম্নরূপ দৃশ্যায়ন বিশ্বাসযোগ্য, বিনোদনমূলকও, দেখুন :

বক্তারা একে একে উঠে যখন বলতে লাগল “এতদিন পরে ডক্টর ভট্টাচার্য সায়ান্সের জয়তিলক ভারতমাতার কপালে পরিয়ে দিলেন,” রেবতীর বুকটা ফুলে উঠল – নিজেকে প্রকাশমান দেখলে সভ্যজগতের মধ্যগগনে। জাপানী সভা সম্বন্ধে যে-সমস্ত দাগী রকমের জনশ্রুতি শুনেছিল মনে মনে তার প্রতিবাদ করলে। হরিদাসবাবু যখন বললে, “রেবতীবাবুর নামের কবচ রক্ষাকবচরূপে এ সভার গলায় আজ ঝোলানো হল, এর থেকে বোঝা যাবে এ সভার উদ্দেশ্য কত মহোচ্চ,” তখন রেবতী নিজের নামের গৌরব ও দায়িত্ব খুব প্রবলভাবে অনুভব করলে। ওর মন থেকে সংকোচের খোলসটা খসে পড়ে গেল। মেয়েরা মুখের থেকে সিগারেট নামিয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর চৌকির উপর, মধুর হাস্যে বললে, “বিরক্ত করছি আপনাকে, কিন্তু একটা অটোগ্রাফ দিতেই হবে।”

এ হলো একটা পরিমাণ দেবত্বারোপ, মহত্ত্ব-উৎপাদন। দশ-চক্রে ভূত ভগবান। সদৃশ প্রক্রিয়ায়ই ইতিহাসের মানুষ দৈত্য-দানো, দেবতা এবং ঈশ্বরের ধারণা-কল্পনায় পৌঁছায়। মনোবল-সংগ্রহের, উদ্দেশ্য সাধনের সামষ্টিক প্রয়োজনে।

রবির জীবনসায়াহ্নের এই ‘ল্যাবরেটরি’ গল্প ১৯৪০ সালের রচনা। বলা হয়, বোঝাও যায়, সম্ভব সর্বাধিক প্রজ্ঞা নিয়ে লিখেছেন তিনি এই আখ্যান নর-নারীর সম্পর্ক, সমাজ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে, বিষয়ে। গল্পে এর একটু পরেই ঘটে নীলা-রেবতীর মধ্যে বাগদান। সেখানে নারীর ক্ষমতার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় – ‘ভয়’ – উচ্চারিত হয়। অবশ্য পাত্রপাত্রী এখানে নীলা-রেবতীর মতো অত্যন্ত প্রশ্নযোগ্য গড়নের দুই নর-নারী। তবু কী ঘটে দেখা যাক। নীলাই উদ্যোগ নেয়।

বেঞ্চির উপর দু’জনে কাছাকাছি বসল। নিজের হাতের উপর রেবতীর হাত তুলে নিয়ে নীলা বললে, “ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনি পুরুষ মানুষ হয়ে মেয়েদের এত ভয় করেন কেন।”

রেবতী স্পর্ধাভরে বললে, “ভয় করি? কখনো না।”

“আমার মাকে আপনি ভয় করেন না।”

“ভয় কেন করব, শ্রদ্ধা করি।”

“আমাকে?”

“নিশ্চয় ভয় করি।”

“সেটা ভালো খবর। মা বলেছেন, কিছুতে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না। তা হলে আমি আত্মহত্যা করব।”

“কোনো বাধা আমি মানব না। আমাদের বিয়ে হবেই হবে।” ইত্যাদি (পৃ ৬৩৫-৬)

এমনসব দৃশ্য রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত করেছেন – নারীকে পুরুষের ভয়-পাওয়ার। একটু আগেই বলছিলাম নীলা আর রেবতীর প্রশ্নযোগ্য মানস গড়ন সম্পর্কে – তাতে এই কাহিনী কতটা অর্থ হারায়। রেবতীর দুর্বল ব্যক্তিত্ব তাকে কতটা অদৃষ্টান্ত করে? এ-ভাবনায় গল্পকার নিজেই আমাদের সাহায্য করেন কি? এখানে ল্যাবরেটরিটির অর্থসম্পদের প্রশ্নটিও যুক্ত। গল্পকার জানাছেন :

পাণ্ডিত্যের চাপে রেবতীর পৌরুষের স্বাদ ফিকে হয়ে গেছে  – তাকে নীলার যথেষ্ট পছন্দ নয়। কিন্তু ওকে বিবাহ করা নিরাপদ, বিবাহোত্তর উচ্ছৃঙ্খলতায় বাধা দেবার জোর তার নেই, শুধু তাই নয়। ল্যাবরেটরির সঙ্গে যে লোভের বিষয় জড়ানো আছে তার পরিমাণ প্রভূত। ওর হিতৈষীর বলে ল্যাবরেটরির ভার নেবার যোগ্যতর পাত্র কোথাও মিলবে না রেবতীর চেয়ে। সোহিনী কিছুতে ওকে হাতছাড়া করবে না। এই হচ্ছে বুদ্ধিমানদের অনুমান। (পৃ ৬৩৬)

এই হচ্ছে প্রদত্ত পরিস্থিতিতে রেবতীকে নিয়ে এগোনোর পেছনে নীলার নারীর ক্ষমতার বোধের ছক – রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ জীবনে নারীর এমন চরিত্রবিন্যাসের পরিচয়ে পৌঁছে থাকতে পারেন – বিয়ে সেখানে বিয়ের পরের ‘উচ্ছৃঙ্খলতার’ অনুমোদনপত্র। এ নিয়ে এই গল্পে রেবতীর যে বিষম মানসিক সংকট তৈরি হচ্ছিল না, তা নয়। দেহ নিয়ে এ-যুগের নারীবাদী তত্ত্বকারদের বিপুলায়তন প্রশ্নোত্তর, বিচার-বিশ্লেষণ আমরা দেখছি। ছোটগল্পে ছোট রেবতীর জীবনে কি ঘটেছিল, রবীন্দ্রনাথ পাঠককে তার আভাস দেন :

মাঝে মাঝে রেবতীকে ঈর্ষায় কামড়ে ধরে। ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টরের মুখের চুরুট থেকে নীলা চুরুট ধরায়। এর নকল করা রেবতীর অসাধ্য। চুরুটের ধোঁয়া গলায় গেলে ওর মাথা ঘুরে পড়ে, কিন্তু এই দৃশ্যটা ওর শরীর-মনকে আরো অসুস্থ করে তোলে। তা ছাড়া, নানা রকমের ঠেলাঠেলি টানাটানি যখন চলতে থাকে, ও আপত্তি না জানিয়ে থাকতে পারে না। নীলা বলে, “এই দেহটার পরে আমাদের তো কোনো মোহ নেই, আমাদের কাছে এর দাম কিসের – আসল দামি জিনিস ভালোবাসা, সেটা কি বিলিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারি।” বলে চেপে ধরে রেবতীর হাত। রেবতী তখন অন্যদের অভাজন বলেই মনে করে – ভাবে ওরা ছোবড়া নিয়েই খুশি, শাঁসটা পেল না।

(পৃ ৬৩৬)

এই হচ্ছে নারীদের কারো কারো সতীত্ব রক্ষা করার সংগ্রাম, প্রেমে নিষ্ঠা ইত্যাদি সম্পর্কে রবির শেষ জীবনের জ্ঞানাংশ, মূল্যায়ন। এর মধ্যে কি নারীর পক্ষ থেকে কোনো স্বৈরাচার নেই, নেই নির্মমতা-নির্যাতন? যখন সে নিজে ভোগ-উপভোগে, লীল-লাস্যে যাচ্ছে, তখন তার দেহ তার কাছে তুচ্ছ, দেহবঞ্চিত জনের জন্যে তার ‘ভালোবাসা’। আমরা তো লীল-লাস্য করতে পারবো না!

এর পরের দৃশ্যের মঞ্চ-নির্দেশনা কি এসেছে কবির কাছ থেকে? তা নিম্নরূপ : ‘ড্রয়িংরুমে সোফায় পা দুটো তুলে কুশনে হেলান দিয়ে নীলা। মেঝের উপর নীলার পায়ের কাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে রেবতী …।’ (পৃ ৬৩৭) এখনো কিন্তু এদের দুজনার বিয়ে হয়নি। এই মঞ্চ-নির্দেশনা কি রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে অসচেতন? অসচেতন কি এর একটু পরেই পূর্বোল্লিখিত ব্যাংক-ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদারের নিম্নরূপ আগমন, উপস্থিতি :

গুরুভার দীর্ঘ দেহকে সিঁড়ির ওপর দিয়ে সশব্দে বহন করে সাহেবি পোশাকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদার মচমচ শব্দে এসে উপস্থিত। বললে, “নাঃ এ অসহ্য, যখনই আসি নীলাকে দখল করে বসে আছ। কাজ নেই, কর্ম নেই, নীলাকে তফাত করে রেখেছ আমাদের কাছ থেকে কাঁটা গাছের বেড়ার মতো।” (পৃ. ৬৩৭)

রবীন্দ্রনাথ যেভাবে উপস্থিত করেছেন, সেই স্পষ্ট বিবরণ পরিষ্কার লীলা-লাস্যের, বিবাহপূর্ব যৌনতার এবং তা সংশ্লিষ্ট নারীর আগ্রহে-আনন্দে ঘটে। তার বিবাহ আসন্ন যে পুরুষের সঙ্গে, সে সেখানে অসহায়, নির্যাতিত নিশ্চয়। সংশ্লিষ্ট পুরুষ দুর্বলচিত্ত এবং দুর্বলদেহ বলেই এরকম ঘটে; কিন্তু সম্ভোগপরায়ণা নারীর পক্ষে সমাজ-সংস্কৃতির এই ভার-অসাম্যকে বাংলা সাহিত্যে কবার এভাবে উন্মোচিত করা হয়েছে? এখানকার এই দুর্বলচিত্ত পুরুষ কি প্রতিক্রিয়ায় যেতে পারে না উৎকট সহিংসতায়, বহুলালোচিত সহিংসতায়, একালে যা অনেক আলোচনা-বিতর্কের বিষয়? আসুন, দৃশ্যটির রবি-বিবরণ পড়ি :

দেখা যায়, এখানকার “নারী-অপহরণের” ঘটনাটির উদ্যোগও আসে অপহৃতা নীলার পক্ষ থেকেই। উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলেও পাঠককে গোটা দৃশ্যটি দেখাতে চাই, সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভোগ-অনৈতিকতার ঘটনায় নারী-পুরুষের আপেক্ষিক অবদান কার কতোটা, কী রকম থাকে বলে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, সেটা পরিষ্কার জানা-বোঝা যাবে :

নীলা বললে, “ডক্টর ভট্টচার্যের দোষ হচ্ছে, উনি আসল কথাটা জোর করে বলতে পারেন না। উনি কাজ আছে বলে এসেছেন এটা বাজে কথা, না এসে থাকতে পারেন না বলেই এসেছেন এটাই একটি শোনবার মতো কথা এবং সত্যি কথা। আমার সমস্ত সময় উনি দখল করেছেন ওঁর জেদে ও জোরে। এই তো ওঁর পৌরুষ। তোমাদের সবাইকে ঐ বাঙালের কাছে হার মানতে হল। আচ্ছা ভালো, তা হলে আমাদেরও পৌরুষ চালাতে হবে। জেপে উঠবে পৌরাণিক যুগ।

নীলা বললে, “বেশ মজা লাগছে শুনতে। নারীহরণ পাণিগ্রহণের চেয়ে ভালো। কিন্তু পদ্ধতিটা কী রকম।”

হালদার বললে, “দেখিয়ে দিতে পারি।”

“এখনই?”

“হ্যাঁ, এখনই।”

বলেই সোফা থেকে নীলাকে আড়কোলা করে তুলে নিলে।

রেবতীর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। ওর মুশকিল এই যে, অনুকরণ করবার কিংবা বাধা দেবার মতো গায়ের জোর নেই। ওর বেশি করে রাগ হতে লাগল নীলার ’পরে, এই সব অসভ্য গোঁয়ারদের প্রশ্রয় দেয় কেন। হালদার বললে, “গাড়ি তৈরি আছে। তোমাকে নিয়ে চললুম ডায়মন্্ড হারবারে। আজ সন্ধের ভোজে ফিরিয়ে এনে দেব। ব্যাঙ্কে কাজ ছিল, সেটা যাক গে-চুলোয়। একটা সৎকার্য করা হবে। ডাক্তার ভট্টাচার্যকে নির্জনে কাজ করবার সুবিধে করে দিচ্ছি। তোমার মতো অত বড়ো ব্যাঘাতকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো, এজন্যে উনি আমাকে ধন্যবাদ দেবেন।” রেবতী দেখলে, নীলার ছটফট করবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, নিজেকে সে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টামাত্র করলে না, বেশ যেন আরামে ওর বক্ষে আশ্রয় করে রইল। ওর গলা জড়িয়ে রইল বিশেষ একটা আসক্তভাবে। যেতে যেতে বললে, “ভয় নেই বিজ্ঞানীসাহেব, এটা নারী হরণের রিহর্সলমাত্র – লঙ্কাপারে যাচ্ছি নে, ফিরে আসব তোমার নেমন্তন্নে।” (পৃ ৬৩৭-৩৮)

এই হচ্ছে নারী-হরণে নারীর দায়ের তুলনামূলক চিত্র – মূল উদ্যোগ-উস্কানি নারীর নিজের। ব্রজেন্দ্র হালদারইবা জাপানি ক্লাবের ‘পেট্রন’ হবেন কেন – বিনা-প্রাপ্তিতে, অর্থ কি অর্থহীন হতে পারে? সমাজে প্রাসঙ্গিক ভারসাম্যের উপলব্ধি এর পরে রেবতীর কাছে কি দাঁড়াতে পারে। রবির পর্যবেক্ষণ : ‘হালদারের বাহুর জোর এবং অসংকুচিত অধিকার বিস্তারের তুলনায় নিজের বিদ্যাভিমান ওর কাছে আজ বৃথা হয়ে গেল।’ (পৃ ৬৩৮) শুধু কি বিদ্যাভিমান, বিদ্যা নয় – এখানে হেরেছে? আর এর কি অন্য কোনো নির্গলিত তাৎপর্য নেই? যেমন নেই কি গুণবিচারীর চেয়ে দর্শনধারীর এগিয়ে থাকার প্রবাদটির বিশ্বব্যাপী তাৎপর্য, ফল? তা যে আছে, ওইদিন সন্ধ্যায় একটি আয়োজনেও তার বেশ প্রমাণ মেলে – ‘একটা নামজাদা রেস্তোরাঁতে’ আয়োজিত সান্ধ্যভোজেও দেখা যায় ভোগমত্ততা, অর্থ আর  ‘বাহুর জোর’  – এরই প্রদর্শনী। পাঠক লক্ষ করুন – তাকে তুলে আনতে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তখনো অত্যধিক প্রবীণ কিংবা ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে পড়েননি :

নিমন্ত্রণকর্তা স্বয়ং রেবতী ভট্টাচার্য, তার সম্মানিত পাশর্^বর্তিনী নীলা। সিনেমার বিখ্যাত নটী এসেছে গান গাইতে। টোস্ট প্রোপোজ করতে উঠেছে বঙ্কুবিহারী, গুণগান হচ্ছে রেবতীর আর তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে নীলার। মেয়েরা খুব জোরের সঙ্গে সিগারেট টানছে প্রমাণ করতে যে তারা সম্পূর্ণ মেয়ে নয়। প্রৌঢ়া মেয়েরা যৌবনের মুখোশ পরে ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে অট্টহাস্যে উচ্চকণ্ঠে পরস্পর গা-টেপাটেপিতে যুবতীদের ছাড়িয়ে যাবার জন্যে মাতামাতির ঘোড়দৌড় চালিয়েছে।

(পৃ ৬৩৮)

এখনই বেগম রোকেয়ার প্রায়-‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর দেশ কায়েম হয়েছে ‘নামজাদা রেস্তোরাঁতে।’ কিন্তু, সোহিনী আর সর্বশেষ রেবতীর পিসির প্রবেশ না ঘটলে তো তা সম্পূর্ণ হয় না। সুতরাং, প্রথমে সোহিনী এসে নীলা আর তার সঙ্গীদের একটি পরিকল্পনা – ‘ল্যাবরেটরি ফান্ডে সম্ভাব্য ছিদ্র খুঁজে বের করার’ – ভেস্তে দিলো। নীলা যে নন্দকিশোরের সন্তান কিংবা ল্যাবরেটরির উত্তরাধিকারী নয় – এ-তথ্যও উপস্থিত করে দেয় সোহিনী। বাংলা সাহিত্যে নিজের বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানের পরিচয় এভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা করতে কি আর কাউকে দেখা গিয়েছে – সোহিনীর আগে, পরে? নীলাকে সোহিনী বলে, ‘কে তোর বাপ, কার সম্পত্তির শেয়ার চাস? এমন লোকের তুই মেয়ে এ কথা মুখে আনতে তোর লজ্জা করে না?’ তার পরের কথোপকথন নিম্নরূপ :

নীলা লাফিয়ে উঠে বললে, “কি বলছ মা।”

“সত্যি কথা বলছি। তার কাছে কিছুই গোপন ছিল না, তিনি জানতেন সব। আমার কাছে যা পাবার তিনি সম্পূর্ণ পেয়েছেন, আজও পাবেন তা, আর-কিছু তিনি গ্রাহ্য করেননি।”

ব্যারিস্টার ঘোষ বললে, “আপনার মুখের কথা তো প্রমাণ নয়।”

“সে কথা তিনি জানতেন। সকল কথা খোলসা করে তিনি দলিল রেজিস্ট্রি করে গেছেন।” (পৃ ৬৩৯)

এর পরে নীলা এবং তার সঙ্গীদের রণে ভঙ্গ ঘটতে বিলম্ব হয় না। সে-মুহূর্তেই অধ্যাপক চৌধুরী উপস্থিত হন। তাদের মিলিত বাক্যালাপে সাব্যস্ত হয় যে, ভুলক্রমে ল্যাবরেটরিতে গোয়ালঘর বসে যাচ্ছিল – ‘গোবরের কুন্ডে আর একটু হলেই ডুবত সমস্ত জিনিসটা’ – অধ্যাপক রেবতী ভট্টাচার্যের প্রতি ইঙ্গিত এখানে, তার নির্বুদ্ধিতা, অপোগণ্ডতা। আরো পাকা হয় যে এই নির্বোধ অধ্যাপকের সঙ্গে নীলার বিয়ের রেজিস্ট্রেশন প্রদত্ত নোটিশ অনুযায়ীই হবে – ‘কিন্তু ল্যাবরেটরি থেকে শত হস্ত দূরে।’

ইতোমধ্যে সশরীরে উপস্থিত হন নারীর ক্ষমতার পরীক্ষাগারের ‘ল্যাবরেটরি’র শেষ নারী চরিত্র, রেবতীর পিসিমা। এই ছোট দৃশ্যের বর্ণনা আমি কি আর দিতে চাই?

হঠাৎ আর একটা ছায়া পড়ল দেয়ালে। পিসিমা এসে দাঁড়ালেন।

বললেন, “রেবি, চলে আয়।”

সুড়-সুড় করে রেবতী পিসিমার পিছন পিছন চলে গেল, একবার ফিরেও তাকাল না।  (পৃ ৬৪০)

তাহলে এই হচ্ছে জীবনের শেষ দিনগুলির রবীন্দ্রনাথের নারীর ক্ষমতার ধারণা। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটির রচনাকাল : আশি^ন, ১৩৪৭। একে সেক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে কবির চূড়ান্ত ধারণা বলবো কি না, পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। অন্য সবকিছুর মতো দীর্ঘ সময়কালে-জীবনকালে চিন্তা, ধারণা ইত্যাদিরও তো বিবর্তন-পরিবর্তন-পক্বতা ঘটে। অথচ, রবীন্দ্রনাথের এই নাড়া-দেওয়া এবং অন্যতম শেষ ছোট গল্পটি নিয়ে আমি অন্তত তেমন লেখাজোখা-কথাবার্তা দেখিনি, শুনিনি। সম্প্রতি ভেবেছি, আগেই বলেছি, ভারতী রায়ের অবস্থান। কিন্তু, ÔNew women in Rabindranath Tagore’s short stories : An Interrogation of ÒlaboratoryÓ নামের প্রবন্ধে সোহিনীকে ‘নূতন নারী’ হিসেবে চিহ্নিত করেই শেষ করেছেন ভারতী রায়। রবীন্দ্রনাথের অন্য যে সব উপন্যাস, ছোটগল্প এবং কবিতা এমন ‘নূতন নারী’কে উপস্থিত করেছে, সেগুলির উল্লেখ এবং আলোচনাও তিনি এক-আধটু করেছেন, এই প্রশ্নে পরিস্থিতি এবং রবীন্দ্রভাবনার পরিবর্তনের একটি ছকমতন হাজির করেছেন। এমন উপস্থাপন এবং বিশ্লেষণ-ধারাও দুর্লভ, যথেষ্ট প্রশংসনীয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীর মধ্যেও যে ক্ষমতার বোধ আর আচরণ, যেমন লীলা-লাস্যের ক্ষমতা বিচিত্রভাবে উপস্থিত আর ক্রিয়াশীল, ‘ধনুর্বিদ্যা’ হিসেবেই যা-সবের চর্চা এবং প্রয়োগ হতে থাকে, রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রমী চোখ-কান নিয়ে সারাজীবনই একে লক্ষ করে গিয়েছেন। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে একাধিক নারী-চরিত্রের মধ্যে ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণের আচরণ খুবই স্পষ্ট-দৃশ্যমান, গল্পটির এই ব্যতিক্রমী মূল্য চিহ্নিত করতে ভারতী রায় ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতী রায় এবং সমদৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীদের এই অত্যন্ত বড় ব্যর্থতাটি পরিষ্কার, তাঁরা ভাবেন এবং বলতে চান যে, নারী-পুরুষ সম্পর্কে যথার্থ কোনো দ্বন্দ্ব তথা দ্বান্দ্বিকতা থাকে না, কোনো এক পক্ষই এখানে ক্রিয়া করে, দমন-নির্যাতন। সুসম্পর্কের উদ্যোক্তাও কোনো এক পক্ষই, তা-ই হতে হবে। এমন অবস্থান এবং মনোভাবের উৎসে কী রয়েছে, প্রণোদনা কিংবা নিয়ামক কী, তা অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে, বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন এবং তা শুধু ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ দাবি করে। রবীন্দ্রনাথ যে তেমন পর্যবেক্ষণের চোখ শুরু থেকেই রেখেছিলেন, আমার অন্তত সেটাই দাবি। বড় রক্ষার বিষয় এই যে, ভারতী রায়ের মতো কেউ-কেউও কিছুটা তা-ই মনে করেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথের লেখক-জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় গিয়ে ভারতী রায় ‘নষ্টনীড়’ ছোটগল্পটিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন নারীর বাস্তব জীবনের এবং কামনা-বাসনার কাহিনি হিসেবে। সামাজিক রীতি-নীতির বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করেও যে নারীরা আত্মতা (Subjectivity) প্রতিষ্ঠা করেছেন, প্রকাশ করেছেন মতভিন্নতা, প্রেমের স্বাধীনতা, তার দৃষ্টান্তের রবীন্দ্র-রচনাগুলির আলোচনা শেষে ভারতী রায় এও লিখেছেন যে, বিশেষ আবেগান্বয়ের (ঝবহংরনরষরঃরবং) অধিকারী নারীদের কাছে পুরুষদের প্রেমাকাক্সক্ষা করতে হবে (ড়িড়বফ), দাবি করলে চলবে না (ঈষধরসবফ) – কিছুসংখ্যক রবীন্দ্ররচনা প্রসঙ্গেই ভারতী রায়ের এই বিশ্লেষণ :

How do we situate Rabindranath in terms of his literary career and the development of his thoughts on women? While young Rabindranath, imbued with romanticism, looked at women as sources of inspiration and imagination, by the time he wrote his short story ÒNashtoneerÓ (1903), he had learned to situate women in their real words, to see them as reasoning and desiring subjects who were constrained by social rules and notes. ÒNashtoneerÓ can be thought to be as one of his earlier works to give voice to women’s subjectivity, and the theme was developed in many subsequent writings between 1903 and 1940. In Tagore’s reputed novel Gora (1910), Suchorita and Lalita, the two main female characters, hold their personal views on marriage. In Ghare Baire (1916), Rabindranath advanced a new doctrine. Nikhil, the male protagonist, would give his wife Bimala personal freedom so that she might assess the true value of their love and they love him freely if she so desired. Yagoyaga (Links and Gaps, 1930) depicts a conjugal relationship based on force, rather than consent. The Tagorean message here is that Madhusudan’s – or any man’s for that matter – idea that women were simply beings to be kept and used was not acceptable (Bandyopadhay 377). Women had particular sensibilities and needed to be wooed, not just claimed. (New Woman in Rabindranath Tagore’s Short Stories : An Interrogation of “Laboratory”, Asiatic, Volume 4. Number 2, December 2010, Kolkata, p 73)

সম্পর্কের পারস্পরিকতায় না গিয়ে যদি বলপ্রয়োগ এবং প্রেমযাঞ্চার দাবির মতো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দাপটের আচরণে সেঁটে থাকে দুটি পক্ষই, নর-নারী সম্পর্কের সংকট কি তাহলে নিরসন হবে, কোথাও উত্তীর্ণ হবে? এসবই ক্ষমতার আচরণ, স্বৈরী মনোভাব। রবীন্দ্রনাথের স্টেথোসকোপে তা ধরা পড়েছে, ভারতী রায়ের মতে, শুরু থেকেই। কিন্তু, চারুলতার আচরণ/ মনোভাবকে তিনি বলেছেন ‘সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা।’ একটি দাম্পত্যের পক্ষে এ যে ক্ষতিকর ঝুঁকি তৈরি করেছিল, তার ওপর তৈরি করছিল প্রচণ্ড মানসিক চাপ – এভাবে দেখার দৃষ্টিকোণ ভারতী রায়রা প্রমাণ করতে পারেন না। এই বিচার-রীতির অসঙ্গতি এবং স্ববিরোধ স্পষ্ট। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের আলোচনা-বিশ্লেষণেও একই পক্ষপাত, সেখানে তো মৃণালকে বিন্দু তার স্বামী, শ^শুর-বাড়ি, শাশুড়ি ইত্যাদি সম্পর্কে নিম্নরূপ বলে : ‘তিনি (স্বামী) পাগল। শ^শুরের এই বিবাহে মত ছিল না – কিন্তু তিনি আমার শাশুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।’ ‘স্ত্রীর পত্র’ নামক দীর্ঘ গল্পের অতি ক্ষুদ্র এক অংশে রবির কলম থেকেই নিঃসৃত এই যে কটি বাক্য রয়েছে, সমাজব্যবস্থা, নর-নারীর সম্পর্ক সম্পর্কে তারা কি খুব কম কিছু বলে? আমি দেখিনি ভারতী রায়সহ কোনো নারীবাদী বুদ্ধিজীবীকে অনেক-আলোচিত এই গল্পের এই বিধ্বংসী অংশটিকে উল্লেখ কিংবা ব্যাখ্যা করতে। ভাবের ঘরে এমন চুরি নিয়ে কি কোথাও পৌঁছুনো যাবে? ঢাকায় আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমি এ সম্পর্কে বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের দ্বিতীয় তীর্থবাসী ব্যক্তি, বিন্দুর শ^শুরের গল্পটি লিখতে রবীন্দ্রনাথের পরে তো কেউ আর এগিয়ে এলেন না। আমরা কোথায় পাবো এই গল্প? এর জন্যে প্রয়োজনীয় সততা অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক সততার অনুপস্থিতিতে যে কোনো আলোচনা-বিশ্লেষণ তো মগজের কসরতমাত্র, বিদ্যায়তনিক শিল্প (Industry)। তবে, এতদসত্ত্বেও, ভারতী রায় প্রশংসার দাবিদার এজন্যে যে তিনি রবীন্দ্র-জীবন এবং রচনায় নর-নারীর সম্পর্ক-বিশ্লেষণের একটি বিবর্তমান এবং বিকশিত স্রোতধারাকে লক্ষ করেছেন, লক্ষ করেছেন অসাধারণ সব নারীচরিত্রকেও। এভাবে অগ্রসর হয়েই ভারতী রায় লিখেছেন, শেষাবধি রবীন্দ্রনাথ লিখতে পেরেছেন ‘ল্যাবরেটরি’র মতো চক্ষুরুন্মিলক গল্প। অর্থাৎ, ল্যাবরেটরি রবীন্দ্ররচনা কিংবা ভাবনায় কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এবং এ-কথাটি সকলকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে এও যে, একদিকে নানা যোগসূত্রে উপস্থিত যে কেজো নারীবাদ কিংবা নারী-অধিকার মতবাদ, অপরদিকে বাস্তবের নারী-পুরুষ, তাদের সম্পর্কের জটিলতা এবং তার নিরসন, উত্তরণ – ইত্যাদি খুবই ভিন্ন। বাস্তবতার নির্ণয় এবং সংকট নিরসনের জন্যে রবীন্দ্র সমাজবীক্ষার সাহায্য গ্রহণ জরুরি।

তথ্যসূত্র

১.         কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৯), কথা কালান্তরের, প্রগতির, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা। 

২.        ডরিস লেসিং (২০০১), ‘ইন্টারভিউ উইথ বারবারা অ্যালেন (২০০১)’ অবজারভার ম্যাগাজিন সেকশান অব দ্য অবজারভার, লন্ডন।

৩. ফিলিপ ভেলাকট (অনূদিত, ১৯৯৮), এস্কিলাস্, দ্য ওরেস্টিয়ান ট্রিলজি, পেংগুইন বুকস্, লন্ডন।

৪. ভারতী রায় (ডিসেম্বর, ২০১০), ÔNew Woman in Rabindranath Tagore’s Short Stories : An Interrogation of “LaboratoryÕ, এশিয়াটিক, ভলিউম ৪, নম্বর ২, কলকাতা। 

৪.        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৯৮), ‘ল্যাবরেটরি’, গল্পগুচ্ছ, প্রতীক, ঢাকা।

৫.        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৯৫), গীতবিতান, প্রতীক, ঢাকা।