সৌভিক রেজা
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এক লেখায় শঙ্খ ঘোষ তাঁকে শহর কলকাতার ‘রাখাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন : ‘আধুনিক এই শহরের পথে চলতে গিয়ে সে-মানুষ যেন গেয়ে চলেছে শুধু অন্তহীন কোনো রাখালিয়া গান, হৃদয়পুরের জটিলতায় ভরা।’ কবি আসাদ চৌধুরীকেও আমরা বলতে পারি শহর ঢাকার তেমনি এক রাখাল। আসাদ চৌধুরী বাস করেন শহরে, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় ঢাকা শহরে, কিন্তু তিনি তাঁর বুকের মধ্যে ধারণ করেন এক গ্রামীণ পটভূমি। যেখানে আছে নদী, গাছের শ্যামল ছায়া, প্রাচীন জনপদ, সেই জনপদের মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনাসহ জীবনের বিচিত্র সব সম্ভার। সেখানে নানা রঙের সুর আছে, আছে নানাবিধ স্বর। আর সবকিছুর ওপরে আছে তাঁর নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ধর্ম, নিজস্ব বাঙালিয়ানা। আরো আছে সৌন্দর্যের মায়াময় স্পর্শ, আছে ধ্বনির বৈচিত্র্য, রসময় অভিঘাত। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কবিতা আসলে ভালোও নয়, মন্দও নয়, কবিতার রসগ্রহণের মধ্যে আছে স্বীকৃতি। সার্থক কবিতা হচ্ছে পজিটিভ একটা হ্যাঁ। আসাদ চৌধুরীও বলেন :
ঠিক আছে
হাত ছেড়ে দিচ্ছি।
ঠিকই বুঝেছ
টাকার এপিঠ ওপিঠের চেয়ে ঢের সত্য
আমার নিজের ধর্ম,
আমার বাঙালিয়ানা।
(‘ঠিক আছে’)
কবে থেকে এই ‘ধর্ম’ কবির নিজস্ব হলো? বাঙালি বলতে কাদের বোঝাবে? শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বেশ খানিকটা সহজ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের যে-কোনো অংশে যারা মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলাদেশের আর্থিক জীবনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলার ঐতিহ্যকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে, তারাই বাঙালি।’ আর ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন-সংগ্রাম বাঙালিকে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানকে, তার ‘স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের’ সুযোগ করে দিয়েছিল। আসাদ চৌধুরীর কাব্যিক অভিযাত্রা এখান থেকেই শুরু, যাকে আমরা সূচনা-বিন্দু বলতে পারি। এই বাঙালিয়ানাকে কেন্দ্র করে নিজের দৈনন্দিন জীবনটাকে তিনি তাঁর কাব্যের পটভূমি হিসেবে যেন মেনে নিয়েছেন। শুধুই যে তিনি মেনে নিয়েছেন তা নয়, নতুন করে তাঁকে পথের সন্ধানে তৎপর হতে হয়েছে, যেভাবে প্রত্যেক আত্মসচেতন কবি তৎপর থাকেন। কবির নিজস্ব ভাষায় বলতে পারা যায় :
যে-যায় সে শুধু জানে
কোথায় মঞ্জিল
কী আছে অপেক্ষা করে তার,
কাঁপা কাঁপা পাত্র হাতে
রেশমি রুমালে-ঢাকা মুখ,
নাকি সোনার শিকল?
শুধু এটুকুই বলে কবি থামেননি। তাঁর নিজের কাব্যপ্রত্যয় যেন ব্যক্ত হয়েছে এই কটি পঙ্ক্তিতে :
শব্দ আর রঙ নিয়ে
এইসব মূলধন করে
তবু
কেউ কেউ পথের সন্ধানে নামে।
(‘পথের কাব্য’)
দুই
এই যে পথের সন্ধানে নামা, একে জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে পারি ‘জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুড়ঙ্গ-লালিত সম্পূর্ণ সম্বন্ধ : সম্বন্ধের ধূসরতা ও নূতনতা।’ যেখানে দেখা যায় কবির কল্পনা-প্রতিভার এক অমোঘ বিচ্ছুরণ। সেই বিচ্ছুরণের কয়েকটি নমুনা এখানে পেশ করছি –
কিছু পাখি চলে গেছে
জানি, কোনো চিহ্ন রাখেনি
বৃক্ষের আশেপাশে
কিংবা অদৃশ্য আকাশের
ঝাপসা গুহায়
বৃক্ষরে কথা উঠলই যখন …
কী করে ভাবতে পারলে
বৃক্ষ অভিবাসী হবে
বৃক্ষ কি মানুষ?’
(‘বৃক্ষ কি অভিবাসী হবে’)
কিংবা,
ফুলের মধ্যে কোনো মহাপুরুষ এসে
আলো জ্বালেননি
সেখানে কোনো আলোই নেই
কখনো ছিল না
তবুও ফুলের মধ্যে ঠিকই আলো জ্বলে
চোখের মধ্যেও
যেমন একাত্তরে
বীরাঙ্গনার চোখে
শহীদদের চোখে
এমনকি কচি কলাপাতার মধ্যে
আগুন ছিল
ফুলের মধ্যে তো ছিলই।
(‘আগুন ছিল’)
কবিতাটি পাঠের সময় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটি কানে যেন ভেসে আসে। একাত্তরের আগুনের সেই যুদ্ধ তো একটি ফুলকে বাঁচানোরও যুদ্ধ। আর রবীন্দ্রনাথ কি সাধে আগুনকে ভাই বলেছিলেন! কারণ আগুনের মধ্যেই তিনি দেখেছিলেন ‘শিকল-ভাঙা … রাঙা মূর্তি’। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নয়, বরং তাঁর হাতে হাত রেখেই তো আসাদ চৌধুরীর কবিতার পথে যাত্রা।
তিন
যাঁদের সঙ্গে কবিতার পথে চলেছেন, তাঁদের কথা কবি আসাদ চৌধুরী নানাভাবে বলেছেন। নানা কথার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের
কথাও। তাঁকে অন্তিম বিদায় জানাতে গিয়ে তিনি বলছেন :
বুকে পুরে চৌষট্টি হাজার গ্রাম
দুঃখী হেলিকপ্টার আকাশে
যাচ্ছে কুড়িগ্রাম
মানুষ আসতাছে বানের লাহান
পরানের গহীন ভিতরে থরে থরে
বাঁশি আর দোতারা একতারা …
বস্নু জিন্সে গতর ঢেকে …
সব খালি করে
ঘাসের ঠিকানা মেনে নেওয়া।
(তৃণে-ছাওয়া আদিম ঠিকানা)
সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, ‘এটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অসহনীয় একটা দুঃসংবাদ এবং গোটা বাংলাদেশের মানুষের কাছেও এক অপূরণীয় ক্ষতি বলেই ধরে নেব। শিল্প-সাহিত্য জগতের আমাদের এখানে যে-ভা-ারটি আছে তার একটা বিশাল স্থান শূন্য হয়ে গেল। এবং আমার মনে হয় এই শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হবার নয়।’ হাসান যে-শূন্যতার কথা এক ধরনের হাহাকার নিয়ে বলেছেন তারই এক কাব্যিক অনুরণন শুনতে পাওয়া যায় আসাদ চৌধুরীর এই কবিতায়। তিনি যখন বলেন ‘মঞ্চ খালি/ মল খালি’ তখন সেটি যেন আমাদের কারো কারো মনে ‘বড়ো বেদনার মতো’ করে বাজে। তবে এই বেদনার কথা বলতে গিয়ে কবি আসাদ চৌধুরী আবেগের তোড়ে দিশেহারা হননি, ভেসে যাননি। তাতে করে বেদনা জাগিয়েও দাঁড়িয়ে গেছে তাঁর কবিতা। এই কাব্যগ্রন্থে আসাদ চৌধুরীর কোনো সাফল্যের কথা যদি বলতেই হয় তার কেন্দ্রবিন্দু ঠিক এখানে।
চার
শুধু সৈয়দ শামসুল হককে নিয়েই নয়, কবি রফিক আজাদকে ঘিরেও তিনি বাজিয়েছেন বিষণ্ণ শোকের একতারা। কবি রফিক আজাদ সম্পর্কে শামসুর রাহমান সেই ১৯৭৩ সালে লিখেছিলেন, ‘রফিক আজাদের বেশিরভাগ কবিতায় এমন একটা ঐকান্তিকতা রয়েছে, যা সহজেই পাঠকের মনে প্রভাব বিস্তার করে। অবশ্য শুধু ঐকান্তিকতা কোনো কবিতার উৎকর্ষের মাপকাঠি হতে পারে না; রসোত্তীর্ণ হলেই কবিতা কাব্যরসিকদের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুখের বিষয়, রফিক আজাদের যেগুলো উৎকৃষ্ট কবিতা সেগুলোয় ঐকান্তিকতা ও শিল্পগুণের সমন্বয় ঘটেছে। … রফিক আজাদের কবিতা পড়ে আমি আনন্দ পাই। ঔৎসুক্যের সঙ্গে লক্ষ করি তাঁর শব্দ ব্যবহার, বাক্প্রতিমা, সস্ন্যাং ব্যবহারের দক্ষতা।’ পরবর্তী সময়ে কবি রফিক আজাদ তাঁর সেই কাব্য-পথ থেকে সরে যাননি। আসাদ চৌধুরীকে তাই লিখতে হয় –
পায়ে হেঁটে নাকি পদব্রজে
কীভাবে কী জানি
রফিক আজাদ চলে গেল
সুতার ওপারে।
ছোট ছোট অনুশোচনার ঢেউ
কিছুক্ষণ স্মৃতির ওপর
এলোমেলোভাবে ঘুর-ঘুর করছিল।
(‘রফিক আজাদ’)
এই কাব্যের আরেকটি কবিতায় আসাদ চৌধুরী তাঁর কালের কবি রফিক আজাদকে নিয়ে লিখেছেন –
কেউ আগে, কেউ বা পরে, যেতে তো হবেই
অতিপ্রিয় নিজের ছায়াটি ফেলে রেখে
টুকরো টুকরো স্মৃতির বুনোটে কথার তরঙ্গ তুলবে কেউ,
কেউ কেউ রেগে-মেগে টুকরো করবে কাছি …
পরিপাটি জামা ও কাপড়ে ঝলমল উচ্ছল রফিক,
আমাদের রফিক আজাদ।
(‘রফিক আজাদ’, সশব্দে কাঁপিয়ে ঘরবাড়ি)
অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন লিখেছিলেন, ‘রফিক আজাদ বাস্তবস্বপ্নের জটিল সূত্রবিজড়িত একজন কবি, যিনি অপরিহার্য এবং যূথবদ্ধ হয়েও যূথভ্রষ্ট, একাকী, স্বতন্ত্র।’ আসাদ চৌধুরীর কবিতাটি পাঠ করার সময় মন্তব্যটির যথার্থতা আরো একবার বুঝতে পারা গেল। দেশ-প্রকৃতি-মানুষ-স্বজনের প্রতি আসাদ চৌধুরীর এই যে আকুলতা, তার নেপথ্যের কারণ হয়তো এই যে, তাঁর বুকের মধ্য দিয়েও বয়ে চলেছে এক সজল নদী। নদীমাতৃক এই দেশেরই তো সমত্মান তিনি। নদী যেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বয়ে যায় জীবনের সমান্তরালে। তাই তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব হয় –
বিরহিনী যতোটা স্মৃতিতে ধনী
নদী তারও চেয়ে সামান্য কিছুটা বেশি
তবু নদী, নদী ছাড়া অন্য কিছু নয়।
(‘তবু নদী’)
কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘কবি কোনো হাটে বসে কবিতা লেখেন না। তাঁর কবিতায় হাটের কোলাহল ভেসে আসতে পারে, থাকতে পারে মাঠের উদার শোভা, কিন্তু কবিতা নির্জনতারই প্রসূন। অর্থাৎ কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি নিঃসঙ্গ। কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে তাঁর সময় ও সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করে না।’ আসাদ চৌধুরীর তৃণে-ছাওয়া আদিম ঠিকানা কাব্যটি পাঠ করে শামসুর রাহমানের মন্তব্যটি নতুন করে উপলব্ধি করা গেল। আবারো বুঝতে পারা গেল যে, বাড়ির কাছে শুধুই আরশিনগর নয়, এই কবির ঠিকানাটাও যেন সেখানে। একেবারেই আমাদের বাড়ির পাশের কবি যেন আমাদের আসাদ চৌধুরী।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.