বিংশতিতম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব চলচ্চিত্রের মহামিলনমেলা

চিত্তবিনোদন ও অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য নিয়েই চলচ্চিত্র পথচলা শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। এরপর মাধ্যমটির শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন শিল্পীরা। দর্শকও অনুভব করতে শুরু করেন চলচ্চিত্র নিছক বাণিজ্যিক পণ্য নয়, এর রয়েছে ভিন্নমাত্রা, অন্যরকম আকর্ষণ। যৌথ শিল্পটিকে ঘিরে তাই একসময় যৌথচর্চাও শুরু হয়। সেই যৌথচর্চারই একটি রূপ চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসব যদি হয় আন্তর্জাতিক, তাহলে কথাই নেই, সেখানে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র তো দেখা যায়ই, মেলামেশা ও ভাববিনিময় ঘটে বিচিত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেধাবী মানুষের মধ্যে। একই ব্যাপার ঘটল এবারের বিংশতিতম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।

নানা দেশের নানা ছবি

বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের ২২৫টি ছবি এতে অংশ নেয়। এগুলোর ভেতর পঞ্চাশ মিনিটের বেশি দৈর্ঘ্যরে ছবি ছিল ১২৯টি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র ছিল ৯৬টি। বাংলাদেশের কথা আলাদা করে বললে দেখা যাবে, এদেশের চলচ্চিত্র ছিল ৪০টি, যার মধ্যে ২২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন এবং ১৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য।

শুধু নয় ছবি নয়, অর্ধশতাধিক ভিনদেশি চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, চলচ্চিত্র বাছাইকারী ও সমন্বয়ক (প্রোগ্রামার), চলচ্চিত্র-সমালোচক ও বিচারকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এ-উৎসবে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, বেলারুশ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কানাডা, চীন, ক্রোয়েশিয়া, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক রিপাবলিক, কঙ্গো,  মিশর, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, প্যালেস্টাইন, জার্মানি, গ্রিস, গুয়েতেমালা, হাঙ্গেরি, ভারত, ইরান, ইরাক, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, লেবানন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মালয়েশিয়া, মৌরিতানিয়া, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, নেপাল, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পাকিস্তান, পেরু, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, পর্তুগাল রোমানিয়া, রাশিয়া, রুয়ান্ডা, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুর, সেø­াভাকিয়া, সেø­াভেনিয়া, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিরিয়া, তাইওয়ান, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম ও ইয়াকুতিয়া থেকে প্রতিনিধি আসার কথা থাকলেও করোনা অতিমারির কারণে অনেকেই ঢাকার বিমান ধরতে পারেননি। তবে উল্লিখিত দেশগুলোর চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছে এদেশের দর্শকদের।

পর্দা উঠলো যখন

জমকালো আয়োজনে ১৫ই জানুয়ারি পর্দা ওঠে বিংশতিতম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। দেশের বৃহৎ এবং দুই দশকের পুরনো এই উৎসবের আয়োজন করে রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসব সংসদ। ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ – এটাই তাদের সেøাগান।

জাতীয় জাদুঘরের অডিটরিয়ামে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ উজ্জীবিত। গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা বিভিন্ন সংস্কৃতির চলচ্চিত্র দেখে। এমন অনেক ছবি আছে যেগুলো থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। ঢাকা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটি আন্তর্জাতিক মানের উৎসব। যেখানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এদেশের সংস্কৃতির মিলন ঘটে।’

উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল বলেন, ‘করোনার কারণে এবার ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিপূর্ণ আমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বিদেশি মেহমান অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও আসতে পারছেন না। আমি এই উৎসবের সাফল্য কামনা করছি।’

উৎসবে বিশেষ অতিথি বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, ‘ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটি আন্তর্জাতিক মানের উৎসব। যেখানে ভারত থেকে ৩৪টি সিনেমা দেখানো হবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বর্তমানে বিশ্ব অঙ্গনে খুবই ভালো করেছে। সম্প্রতি রেহানা মরিয়ম নূর কান চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছিল। গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও বাংলাদেশ বেশ ভালো করেছে।’

উৎসবে বিশেষ অতিথি সাংস্কৃতিক

প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে একটি জাতি তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখে। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের তরুণ সমাজের পরিচয় ঘটছে। এতে আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটছে।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে থাকে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ। এখানকার প্রতিটি ছবিই আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর লেবানন ও জার্মানির যৌথ প্রযোজনা এবং মারিয়া ইভানোভা জেড-পরিচালিত দ্য অ্যাঙ্গার চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়।

নতুন জানালা, পুরনো দরজা

এবারের আয়োজনে খোলা হয় নতুন বিভাগ ‘ওয়াইড অ্যাঙ্গেল’। দেশে ও দেশের বাইরে অনেক মেধাবী এবং যোগ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা রয়েছেন, যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি বা কোনো কারণে অনালোচিত রয়ে গেছেন, তাঁদের নিয়েই এই আয়োজন। এবার উৎসবে ‘ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে’ মূল ফোকাসে রাখা হয় জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার শাহীন দিল-রিয়াজকে। যদিও তিনি এরই মধ্যে বিদেশের মাটিতে বেশ পরিচিত; কিন্তু বাংলাদেশের অনেকেই হয় তো তাঁকে চেনেন না। দেশের দর্শকদের কাছে শাহীন দিল-রিয়াজকে পরিচয় করিয়ে দিতে দেখানো হয় চারটি প্রামাণ্যচিত্র, বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে।

‘ওয়াইড অ্যাঙ্গেল’ ছাড়াও উৎসবে অনেক আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল। যেমন :

প্রতিযোগিতা বিভাগ – এশিয়ান সিনেমা কম্পিটিশন : এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২১টি চলচ্চিত্র নিয়ে অনুষ্ঠিত (ন্যূনতম ৭০ মিনিটব্যাপী ফিকশন ফিল্ম) এ-প্রতিযোগিতায় সেরা চলচ্চিত্র নির্ধারণে ছিলেন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ড।

রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ : বিশ্ব চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব জাপানি অতর চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াসুজিরো ওজু (১২ ডিসেম্বর ১৯০৩-১২ ডিসেম্বর ১৯৬৩)। নির্বাক যুগে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন ওজু। শুরুতে ছোটখাটো কমেডি সিনেমা বানালেও ত্রিশের দশক থেকে তিনি জাপানের পারিবারিক কাঠামো, বিয়ে ও বিভিন্ন প্রজন্মের ভেতরকার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাশীল ছবি নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীকালে এসব বিষয়ই হয়ে ওঠে ওজুর ছবির মূল বিষয়বস্তু। এবারের উৎসবে ওজুর পাঁচটি চলচ্চিত্র দেখানো হয় জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে। চলচ্চিত্রগুলো হলো : ১. টোকিও স্টোরি (১৯৫৩), ২. টোকিও টোয়াইলাইট (১৯৫৭), ৩. ইকুইনক্স ফ্লাওয়ার (১৯৫৮), ৪. লেট অটাম (১৯৬০) ও ৫. অ্যান অটাম আফটারনুন (১৯৬২)।

ট্রিবিউট : সদ্যপ্রয়াত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি অভিনয়শিল্পী জঁ-পল বেলমন্দোকে এই বিভাগে শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্যারিসের অদূরে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী বেড়ে উঠেছিলেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতর। প্রথম জীবনে তিনি খেলধুলায় মনোযোগী ছিলেন, বক্সার হিসেবে শুরু করেছিলেন ক্যারিয়ার। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে পঞ্চাশের দশকে তিনি পেশাদার অভিনেতা হিসেবে মঞ্চে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে ফরাসি নিউ ওয়েভ পরিচালক জঁ-লুক গদারের ছবিতে কাজ করে তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বেলমন্দো ২০২১ সালে ৮৮ বছর বয়সে মারা যান। ট্রিবিউট বিভাগে বেলমন্দো-অভিনীত ও গদার-পরিচালিত ব্রেথলেস (১৯৬০) ও পিয়েরো দ্য ম্যাডম্যান (১৯৬৫) ছবি দুটো দেখানো হয় ঢাকার আঁলিয়স ফ্রঁসেজের মিলনায়তনে।

বাংলাদেশ প্যানোরমা : উৎসবের এ-বিভাগে বাংলাদেশের নয়টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রচার-প্রসার ও আন্তর্জাতিক বাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে উৎসব কমিটি এবার এই বিভাগ সংযোজন করেছে। এই বিভাগে বাংলাদেশের নির্মাতাদের বাছাইকৃত নয়টি চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার সুযোগ পায়। চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপ্রেসির পক্ষ থেকে তিনজন বিচারক বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ পুরস্কার প্রদান করেন।

সিনেমা অব দ্য ওর্য়াল্ড : এই বিভাগে বিভিন্ন দেশের সমকালীন সেরা ৪৭টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।

চিলড্রেন্স : এই বিভাগে ১৮টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। বরাবরের মতো এবারো সব শিশুর জন্য এই প্রদর্শনী ছিল উন্মুক্ত। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলো দেখার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। এই বিভাগ থেকে একটি চলচ্চিত্র ‘বেস্ট জুভেনাইল অডিয়েন্স বাদল রহমান অ্যাওর্য়াডে’র জন্য মনোনীত হয়।

স্পিরিচুয়াল ফিল্মস : এই বিভাগে ২৯টি ছবি প্রদর্শিত হয়। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানবতাবাদী চলচ্চিত্র এ-বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভাববাদী চলচ্চিত্রগুলোর জন্য ইন্টারফেইথ জুরি একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র নির্ধারণ করেন।

উইমেন ফিল্ম মেকার্স সেশন : দেশ-বিদেশের নারী নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নিয়ে এই বিভাগটি সাজানো হয়। এতে দেশি-বিদেশি ২৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠিত নারীরা এই বিভাগের একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেন। এছাড়া এই বিভাগ থেকে একজন শ্রেষ্ঠ নারী নির্মাতাকে পুরস্কৃতও করা হয়।

শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মস : ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নবীন ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নিমার্তাদের তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রগুলো প্রদর্শিত হয়। এতে দেশি-বিদেশি ৬১টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যেই এই বিভাগটি উৎসবে যুুক্ত করা হয়েছে।

যেসব জায়গায় ছিল দর্শকদের পদচারণা

জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ও কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন, শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালা ও নৃত্যশালা মিলনায়তন, আঁলিয়স ফ্রঁয়েজ মিলনায়তন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যাকাডেমি মিলনায়তন ও স্টার সিনেপ্লে­ক্স – এসব জায়গায় যেহেতু এবার একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে, তাই চলচ্চিত্রপিপাসু মানুষ এখানে ভিড় জমিয়েছেন এবং উপভোগ করেছেন বিভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র।

দর্শক-প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে দর্শকদের ভেতর ছিল ভীষণ আগ্রহ। বাংলাদেশি পরিচালকদের নির্মিত ছবিগুলো দেখতে প্রতি সন্ধ্যায় প্রদর্শনী হলে মানুষের ঢল নেমেছিল। বিশেষ করে আজব কারখানা, লাল মোরগের ঝুঁটি, চন্দ্রাবতী কথা, ঢাকা ড্রিম, বিশ্ব সুন্দরী ইত্যাদি ছবি ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখতে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির, তেমন একটা আগ্রহ পরিলক্ষিত না হলেও, এসব ছবি ঘিরে তাদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল লক্ষণীয়। এছাড়া বিদেশি ভাষার ছবির প্রতি, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের, একধরনের আগ্রহ বরাবরই থাকে। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বন্ধু দলবেঁধে শিল্পকলা একাডেমীর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে আসেন একদিন। বিকেল ৫টা থেকে শুরু হওয়া কালকক্ষ দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত সবাই। দলের একজন শারমিন শান্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ছেন। চলচ্চিত্র-উৎসবে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘চলচ্চিত্র দেখার জন্য পরিবেশটা খুব জরুরি। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবে এসে সেই আমেজটা পাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আমরা মাত্রই কালকক্ষ দেখা শেষ করলাম। ছবির গল্প বেশ ভালো লেগেছে।’

১৮ই জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারি এবং মিউজিক ও ড্যান্স অডিটরিয়ামে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। শিল্পকলার এ দুটি ভেন্যুতেই সন্ধ্যায় বেশ দর্শক সমাগম লক্ষ করা যায়।

পরিবার নিয়ে প্রতিদিনই বিকেলে শিল্পকলায় চলচ্চিত্র দেখতে এসেছিলেন পিয়াস তালুকদার। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অফিস শেয়ে পরিবার নিয়ে চলচ্চিত্র দেখতে চলে আসি। এতো ভালো ছবি দেখানো হচ্ছে এখানে! ছোট  বাচ্চাকে  সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও এখানে আসার একটা কারণ।’

বিষয় : নারী, পরিপ্রেক্ষিত : সিনেমা

এবার উৎসবের অংশ হিসেবে ১৬ ও ১৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘চলচ্চিত্রে নারী’ শীর্ষক অষ্টম ঢাকা আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই দুদিনে পাঠ করা হয় মোট ছয়টি প্রবন্ধ।

প্রথম দিন ‘নিউ জেনারেশন টার্কিশ ফিমেল ডিরেক্টরস ফ্রম পেলিন এসমার টু ডেনিজ গামজ এরগুভেন’ শীর্ষক নিবন্ধ উপস্থাপন করেন তুরস্কের সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক ওইয়া ডোগান। আলোচক হিসেবে ছিলেন ফ্রান্সের প্রযোজক ও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল প্রোগ্রামার মেরাল মেলিকা ডুরান ও বুলগেরিয়ার চিত্রনির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কা।

ভারতের চলচ্চিত্র গবেষক ড. দেবযানী হালদার-রচিত ‘সানসোধান টু থালাইভি : প্যাট্রিয়াটিক ভার্সেস পলিটিক্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইম্যান : আ ফিল্মিক কনটেমপ্লেশন’ প্রবন্ধটির ওপর আলোচনা করেন ভারতের চলচ্চিত্র শিক্ষক ড. ইপ্সিতা বরাত ও চলচ্চিত্রকার সামিয়া জামান।

রাশিয়া-ফ্রান্সভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা এভডোকিয়া মস্কভিনা-রচিত ‘উইম্যান ইন সিনেমা : বিটুইন ডকুমেন্টারি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডিং’ কি-পেপারের ওপর আলোচনা করেন ক্রোয়েশিয়ার চলচ্চিত্র প্রযোজক ডালিয়া আলিক ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রযোজক শ্রেয়সী সেনগুপ্ত।

সেমিনারের দ্বিতীয় দিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রশিক্ষক ও লেখক সিডনি লেভিন-রচিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর : আ ফেমিনিস্ট স্টোরি অ্যাজ টোল্ড বাই মেন উইথ ভিশন’ কি-নোটের ওপর আলোচনা করেন প্যারিসভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রযোজক ও সংগঠক মেরাল মেলিকা ডুরান এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক ফাতিমা আমিন।

‘ক্যারেক্টারস ডেপিক্টেড বাই ফিমেইল ডিরেক্টরস – আ ম্যাটার অব চয়েজ অর রেসপন্সিবিলিটি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি রচনা ও উপস্থাপন করেন বুলগেরিয়ার চিত্রনির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কা। এই প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন ড. ইপ্সিতা বরাত ও শ্রেয়সী সেনগুপ্ত।

‘ইউরোপিয়ান সিনেমা : আ ক্লোজ আপ টু উইম্যান অ্যান্ড ডাইভারসিটি পলিসি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মেরাল মেলিকা ডুরান। আলোচক ছিলেন নরওয়ের প্রযোজক ও সংগঠক গিডা ভেলভিন মাইক্লেবাস্ট এবং বাংলাদেশের শিল্প বিশেষজ্ঞ নাঈমা চৌধুরী।

পুরস্কার মানে স্বীকৃতি

এশিয়ান চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ভারতের কুজাংগাল (পেবেলস)। ছবিটির পরিচালক পিএস বিনোথরাজ। সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন নেপালের সুজিত বিদারি তাঁর বাটারফ্লাই অন দ্য উইন্ডো ছবির জন্য। রঞ্জিত শংকর-পরিচালিত সানি ছবির জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন জয়সূর্য। সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন সুজান পারভা, ইরান ও কানাডার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত বোটক্স চলচ্চিত্রের জন্য। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা কাভেহ মাজাহেরি। সেরা স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়েছেন ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী এবং সুগত সিনহা, বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত মায়ার জঞ্জাল চলচ্চিত্রটির জন্য। এর নির্মাতা ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। সেরা সিনেমাটোগ্রাফির পুরস্কার জিতেছেন চীনের ঝউ ওয়েনকাও, শি জিয়াওফান-নির্মিত ক্যাফে বাই দি হাইওয়ে ছবিটির জন্য।

এবার শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্র বাদল রহমান পুরস্কার পেয়েছে রাশিয়ান চলচ্চিত্র আফ্রিকা। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা দারিয়া বিনেভস্কায়া। স্পেশাল অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ভারতের চলচ্চিত্র সেমখোর। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা এমি বড়ুয়া। শ্রেষ্ঠ অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড যৌথভাবে পেয়েছে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এন রাশেদ চৌধুরীর চন্দ্রাবতী কথা ও নুরুল আলম আতিক-নির্মিত লাল মোরগের ঝুঁটি।

এছাড়া বাংলাদেশ প্যানারমা বিভাগে ফিপ্রেসি জুরিদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে আজব কারখানা। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা শবনাম ফেরদৌসী। আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা ফিচার ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছে চীনের চলচ্চিত্র ইয়াংজেন’স জার্নি। এর নির্মাতা চেংজু ল্যান। বেস্ট ডকুমেন্টারি পুরস্কার পেয়েছে ইরানের চলচ্চিত্র হলি ব্রেড। এর নির্মাতা রহিম জাবিহি। সেরা শর্টফিল্ম পুরস্কার পেয়েছে তুর্কির চলচ্চিত্র আনটোল্ড স্টোরি অব ফাতিমা কায়াচি, নির্মাতা ওরহান তেকেওগ্লু।

উইম্যান ফিল্মমেকার্স সেকশনে বেস্ট ফিচার ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছে ইরানের চলচ্চিত্র লেডি অব দ্য সিটি, চলচ্চিত্রটির নির্মাতা মরিয়ম বাহরলোলুমি। বেস্ট শর্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ফ্রান্সের এ সামার প্লেস। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা আলেকজান্দ্রা ম্যাথিউ। বেস্ট ডকুমেন্টারি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে জার্মানি-ফিনল্যান্ডের চলচ্চিত্র দি আদার সাইড অব দি রিভার। এর নির্মাতা অ্যান্টোনিয়া কিলিয়ান।

চিত্রনাট্য লিখে হাজার ডলার

এই উৎসবে ১৬-১৯ জানুয়ারি আঁলিয়স ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় দিনব্যাপী সেমিনার ও কর্মশালা – ‘ওয়েস্ট মিট ইস্ট : চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা’। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর চলচ্চিত্রেরও রয়েছে নিজস্ব শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ; কিন্তু তা প্রাচ্য থেকে একেবারেই ভিন্ন। ধারণা করা হতো যে, ‘এই দুই অঞ্চলের শিল্প কখনো এক হবে না।’ কিন্তু বিগত কয়েক বছরে চলচ্চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। ফলে চলচ্চিত্র হারিয়েছে নিজ সীমানা, পেয়েছে বৈশ্বিক পরিচিতি। এই একাত্মতাকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করা যায়, সেই ভাবনা উসকে দিতেই এই আয়োজন।

শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য হিসেবে নেপালের কিরণ পোখরেল-রচিত ড্রিম অফ আ বাটারফ্লাই পায় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের তাসমিয়া আফরিন মৌ-রচিত ফিয়ার-ই-টেইল পায় তিন হাজার মার্কিন ডলার এবং তৃতীয় স্থান জয়ী ভারতের গৌরব মদনের চিত্রনাট্য দ্য জায়ান্ট অনিয়ন পায় ২ হাজার মার্কিন ডলার।

বিচারের আসনে ছিলেন যাঁরা

এই বিপুল আয়োজনে বিচারক হিসেবে ছিলেন দেশ-বিদেশের মোট ১৫ জন জুরি। তাঁদের ভেতর চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপ্রেসি (ঋওচজঊঝঈও) থেকে ছিলেন তিনজন জুরি। উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগের ছবিগুলো বিচার করেন নরওয়ের নির্মাতা ও প্রযোজক গিডা ভেলভিন মিক্লেবাস্ট, ফ্রান্সের সমাজতাত্ত্বিক ও চিত্রসমালোচক মেরাল মেলিকা ডুরান, ফ্রান্সের নির্মাতা ও লেখক পিয়েরে ফিলমন, রাশিয়ার চলচ্চিত্রের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রোমান ডোরোফিভ, তুরস্কের সাংবাদিক ও লেখক ওইয়া ডোগান, বুলগেরিয়ার নির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কা, ইরানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এলাহি নোবাখত, বাংলাদেশের স্বাধীন নির্মাতা মেহজাদ গালিব, বেলারুশের চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক ইগর সুকমানভ, ভারতের চিত্রনাট্যকার ও অভিনেত্রী রাজনি বাসুমাতারি, ইরানের নির্মাতা নেগিন আহমাদি ও বাংলাদেশের অভিনেতা নাদের চৌধুরী।

চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক ও সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিপ্রেসি থেকে এই উৎসবে জুরি হিসেবে ছিলেন মিসরের চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক মোহাম্মেদ সায়িদ আবদেলরেহিম, ভারতের চলচ্চিত্র-সাংবাদিক ও চিত্রসমালোচক সিরাজ হাশিম সাঈদ এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র লেখক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু।

উৎসব পরিচালকের বক্তব্য

উৎসবের পরিচালক হিসেবে আহমেদ মুজতবা জামাল জানান, কতটা প্রতিকূল পরিবেশের ভেতর দিয়ে এই আয়োজনটি করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ করোনার কারণে সবাই আতঙ্কের মধ্যে ছিল।’

মহামারি ছাড়াও উৎসবের নিজস্ব সংকট আছে, যেমন – ছবি দেখানোর জন্য একটি স্থায়ী জায়গা বা উৎসবের জন্য একটি নির্দিষ্ট উন্মুক্ত স্থান, বাইরের দেশে যেমন হয়, সেগুলো এখনো হয়নি এদেশে। জামাল বলেন, ‘আমাদের এখনো পারমান্যান্ট ভেন্যু নেই, যেখানে ফিল্ম স্ক্রিনিং করতে পারি। যেখানে ডিজিটাল স্ক্রিনিং থাকবে, সাউন্ড সিস্টেম থাকবে, একটা এনভায়রনমেন্ট থাকবে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এরিয়ায় ক্যাফেটেরিয়া থাকা প্রয়োজন। আমাদের একটা কমপ্লেক্স দরকার, যেখানে সবাই আসবে। কান বা বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মতো। সেখানে লোকজন এমনিতেই ঘুরতে যায়। তবুও আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। এর মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমাদের তরুণ নির্মাতাদের আমরা এর মধ্য দিয়েই গড়ে তুলবো। আমাদের এখানকার নির্মাতাদের আসলে এই ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে বাইরের নির্মাতাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের সুযোগ ঘটে।’

উৎসবের পরিচালক আশাবাদী, তিনি বলেন, ‘আগামী উৎসব চেষ্টা করবো আরো সুন্দর করার এবং তরুণ নির্মাতাদের আরো যুক্ত করার। আরো বেশি সংখ্যক ভালো অতিথি নিয়ে আসবো। অন্যসব বিভাগের পাশাপাশি নতুন বিভাগ যোগ করতে পারি। পরের বছর আরো ভালো করার চেষ্টা করবো।’

গণমাধ্যমের আলো ও অতিথিদের প্রতিক্রিয়া

নয়দিনব্যাপী গণমাধ্যম সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে উৎসবের খবর পৌঁছে দিতে সকলের মাঝে। কোথায় কোন সিনেমা দেখানো হচ্ছে সেটার সময়সূচি তো বটেই, উৎসবে আসা বিদেশি অতিথিদের সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়েছে নিয়মিত।

এবার জাপান থেকে আসা মিকা সাসাকি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। এর কারণ তিনি তৈরি করেছেন বাঙালির প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র, নাম টেগর সংস। রবিঠাকুরের গানের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর এ-সৃষ্টিকর্ম। প্রামাণ্যচিত্রটির কিছু অংশের শুটিংও হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাভাষায় লেখাপড়া করা মিকা গণমাধ্যমকে তাঁর কাজ নিয়ে বলেন,  ‘টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। বাংলা পড়তে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জেনেছি এবং আশ্চর্য হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমি শুধু কবি মনে করতাম; কিন্তু তাঁর ওপর পড়াশোনা করে জানতে পারি, তিনি কেবল কবি নন, তিনি অসাধারণ গানও লিখেছেন। তখন থেকেই আমি তাঁর সংগীতের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করি। তাঁর সম্পর্কে জানতে জানতে এবং সেগুলো দেখতে দেখতে তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়।’ সেই আগ্রহ থেকে মিকা হাত দেন প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণে।

বুলগেরিয়া থেকে আসা চিত্রনির্মাতা ইয়ানা লেকারস্কা শুধু সিনেমা বানান না, নারী অধিকার নিয়েও কাজ করেন। তিনি এবারের উৎসবে চলচ্চিত্রে নারীবিষয়ক একটি প্রবন্ধও পাঠ করেছেন। গণমাধ্যমের কাছে তিনি নারী অধিকার ও কাজ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা নারী অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার – সেটা বলতে পারেন। অনেকে হয়তো কথা বলার সুযোগ বা প্ল্যাটফর্ম পায় না। আমরা তা পাই। এখানেও আমরা নারী চলচ্চিত্রকার বা নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলছি। বলতে পারেন এটিও আমার আসার একটি কারণ। আর চলচ্চিত্র তো আমার নেশা, পেশা, ঘুম-জাগরণ সবই।’

মুম্বাই থেকে চলচ্চিত্র-সমালোচক ও ফিপ্রেসি জুরি সিরাজ সাইদি ঢাকা এসে বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে যান। গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে আমার খুবই ভালো লাগছে। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব একটি আন্তর্জাতিক মানের উৎসব।’

মিশরের চলচ্চিত্র-সাংবাদিক মোহাম্মদ সাইদও জানান, বাংলাদেশের মানুষের বন্ধুত্ব, আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছে তাঁকে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন নতুন বন্ধু হচ্ছে এখানে এসে।’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বেশ ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি। সর্বমোট আটটি বাংলা ছবি দেখেন তিনি। মোহাম্মদ সাইদের মতে, ফিল্মে নারীদের আরো বেশি এগিয়ে আসা উচিত।

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবের সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে কাজ করছেন ভারতের দেবানিক কুণ্ডু। ভারত থেকে যত চলচ্চিত্র উৎসবে আসে সবকিছুর সমন্বয়কের দায়িত্ব তিনিই পালন করে থাকেন। তাই ঢাকা চলচ্চিত্র-উৎসব তাঁর কাছে নিজেরই উৎসব। এই উৎসবের মতো এতো চলচ্চিত্র পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখানো হয় না বলে দাবি দেবানিকের। তাঁর মতে, ‘একসঙ্গে এতো ছবি, কান বাদে অন্য কোথাও দেখায় বলে আমার জানা নেই।’

শেষ মানে নতুন শুরুর ইঙ্গিত

অতিমারির চোখ রাঙানি নিয়ে শেষ হয় নয়দিনের চলচ্চিত্র- উৎসব। ২৩শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে ইতি টানা হয় চলচ্চিত্রের এই মহাযজ্ঞের।

জাতীয় জাদুঘরে মূল মিলনায়তনে অতিথি, জুরি ও বিভিন্ন দেশের নির্মাতা-প্রযোজকদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হয় বিজয়ী ছবি, তথ্যচিত্র, নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও চিত্রগ্রাহকের নাম। এ-আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফিপ্রেসি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক মফিদুল হক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। সমাপনী আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল।

সহযোগিতা মানে উৎসাহ

বিগত উৎসবের মতো এবারো যাঁরা উৎসবকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস এবং সামিট পাওয়ার লিমিটেড ও খনা টকিজ। উৎসব পার্টনার হিসেবে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, আঁলিয়স ফ্রঁসেজ ঢাকা, স্টার সিনেপ্লেক্স, ঢাকা ক্লাব লিমিডেট, নরওয়েজিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হগুসন্ড, রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, চ্যানেল আই, দুরন্ত টিভি, একাত্তর টিভি ও সেন্স ফর ওয়েভ, বঙ্গ বিডি, ক্লাউডলাইভ।

আয়োজকদের সম্পর্কে

দুটো কথা

রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ ১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সৎ চলচ্চিত্র প্রদর্শন সংস্কৃতি বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সাল  থেকে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ আয়োজন, চলচ্চিত্রবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা সেলুলয়েড প্রকাশনার পাশাপাশি নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার ও শুদ্ধ সংগীতের আসর আয়োজন করে আসছে।

রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ একটি অলাভজনক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংসদের নিয়মিত কার্যক্রম ও চলচ্চিত্র- উৎসবে উন্নত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রসমূহের সমাহার ঘটিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, পরিবেশক, প্রদর্শক ও কলাকুশলীদের সুস্থ চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, সর্বোপরি সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এদেশের দর্শকদের রুচির প্রসার ঘটানোই তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

[নিবন্ধটি রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, নিবন্ধকারের উপস্থিতি ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি করা। এতে ব্যবহৃত সব ছবি রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সৌজন্যে পাওয়া।]