বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ২০১৪

কানন পুরকায়স্থ

২০১৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবৃত্ত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় যথাক্রমে ৬, ৭ এবং ৮ অক্টোবর ২০১৪ এবং পুরস্কার প্রদান করা হয় সুইডেনের স্টকহোম কনসার্ট হলে ১০ ডিসেম্বর ২০১৪। রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড হিউজ মেডিক্যাল স্কুলের এরিক বেটজিগ্ (Eric Betzig) জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের স্টিফেন ডব্লিউ হেল (Stefan W. Hell) এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম ই মোরনারকে (William E. Moerner)। রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাদের প্রেস  রিলিজে উল্লেখ করে, ‘for the development of super resolved fluorescence microscopy’-র জন্য বেটজিগ্, হেল এবং মোরনারকে আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার এই পুরস্কার সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হলো। বেটজিগ্ ও মোরনার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং হেল জার্মানির নাগরিক।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসামু আকাসাকি (Isamu Akasaki), হিরোসি আমানো (Hiroshi Amano) এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজি নাকামুরা (Shuji Nakamura)। রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাদের প্রেস রিলিজে উল্লেখ করে, ‘for the invention of efficient blue light emitting diodes which has enabled bright and energy saving white light source’-এর জন্য আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরাকে আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার এই পুরস্কার সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, আকাসাকি এবং আমানো জাপানের নাগরিক, কিন্তু নাকামুরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। নাকামুরা জন্মসূত্রে জাপানি হলেও জাপানে দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা না থাকায় তিনি নোবেল কমিটির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি পেলেন।

২০১৪ সালে শারীরবৃত্ত বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের অধ্যাপক জন ও’কিফ্ (John O’Keefe), নরওয়ের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মে-ব্রিট মোসার (May-britt Moser) এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডভার্ড আই মোসার (Edvard I. Moser)। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলি তাদের প্রেস রিলিজে উল্লেখ করে, ‘for their discoveries of cells that constitute a positioning system in the brain’-এর জন্য জন ও’কিফকে দেওয়া হয় আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেক সমানভাবে পান মে-ব্রিট মোসার এবং এডভার্ড মোসার। উল্লেখ্য, ও’কিফ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক। এডভার্ড মোসার এবং তাঁর স্ত্রী ও সহকর্মী মে-ব্রিট মোসার নরওয়ের নাগরিক। উপরোক্ত বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্মের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা এ-প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয়।

দুই. রসায়নবিজ্ঞান

আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা অণু-পরমাণুর মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে তা দেখা বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ০.২ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত সীমিত। ১ মাইক্রোমিটার হচ্ছে ১০-৬ মিটার। একটি প্রোটিন অণু এবং কোষের অভ্যন্তরে অন্যান্য অণুর আকার ১ থেকে ১০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। উল্লেখ্য, ১ ন্যানোমিটার হচ্ছে ১০-৯ মিটার। আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের এই সীমাবদ্ধতার কথা বিজ্ঞানীদের জানা অনেক দিন থেকে। বেটজিগ্, হেল এবং মোরনারের অবদান হচ্ছে এই আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রকে ন্যানোবীক্ষণ যন্ত্রে রূপান্তরিত করা, যাতে ০.২ মাইক্রোমিটার থেকে ছোট কোনো বস্ত্তকে, বিশেষ করে কোষের অভ্যন্তরে অণুর মিথস্ক্রিয়াকে প্রত্যক্ষ করা যায়। বিজ্ঞানীরা কীভাবে এটি সম্ভব করলেন, তা জানার আগে অপবর্তন সীমা সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন।

আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশ্লেষণ-ক্ষমতা নির্ভর করে দুটি গুণাঙ্কের (factor) ওপর – আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য (l) এবং সংখ্যাবাচক রন্ধ্র (Numerical Aperature, NA)। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অতিবেগুনি এবং আলোকিত রশ্মির মধ্যে পড়ে। NA হচ্ছে একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সের আলো সংগ্রহের ক্ষমতার পরিমাপ। ১৮৭৩ সালে আর্নেস্ট অ্যাবে (Ernest Abbe) দেখান যে, একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যে আকারের বস্ত্তকে বিশ্লেষণ করা যাবে, তার ব্যাস হবে , অর্থাৎ যদি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 500nm হয় এবং NA = 1 হয়, তাহলে d = 250nm।  এই সমীকরণকে ১৮৯৬ সালে লর্ড রেলি (Lord Rayligh)  একটু সংশোধন করেন এবং দেখান যে, ক্ষুদ্রতম দূরত্ব, যাকে আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা বিশ্লেষণ করা যাবে, তা হবে। এখানে R হচ্ছে রেলি নির্ণায়ক (Rayligh criterion)। আলোর অপবর্তন (diffraction) আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং এই সীমার পরিমাণ মোটামুটিভাবে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেক। চিত্র-১-এ দেখা যায়, দুটি বিন্দু উৎস (point source) বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রেলি নির্ণায়কের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, x এবং y সমতলে দুটি অণুর মধ্যে দূরত্ব যদি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেক হয় তাহলে তাকে বলা হয় অপবর্তন সীমা (diffraction limit)। এই অপবর্তন সীমার নিচের বস্ত্তকে আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। এই অপবর্তন সীমার কারণে ০.২ মাইক্রোমিটার থেকে ছোট আকারের কোনো বস্ত্ততে লেজার রশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করা যায় না।

বেটজিগ্, হেল এবং মোরনার প্রতিপ্রভা অণু (Flourescent) ব্যবহার করে অপবর্তন সীমাকে অতিক্রম করার গবেষণা শুরু করেন নববইয়ের দশকে। হেল হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ-ডি অধ্যয়ন শেষ করে চলে যান ফিনল্যান্ডের টরকু বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ সেখানে প্রতিপ্রভা অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে কাজ করছিলেন কতিপয় বিজ্ঞানী। একদিন কোয়ান্টাম অপটিক্সের একটি বই থেকে হেল ‘উদ্দীপিত নিঃসরণ’ (Stimulated emission)-এর ধারণা পান। হেল লক্ষ করলেন, প্রতিপ্রভা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আলোর স্পন্দন (pluse) ব্যবহার করে কোষের ডিএনএকে উত্তেজিত করলে কিছু সময়ের জন্য কোষকে দীপ্ত (glow) করে রাখা যায়। এভাবে দেখা যায়, কোনো অ্যান্টিবডির কোষের অভ্যন্তরে অণুর মধ্যে কী ক্রিয়া চলছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে শুধু অনেক ডিএনএকে একত্রে দেখা যায়, লক্ষ্য হচ্ছে একটি ডিএনএকে কীভাবে দেখা যায়? স্টিফেন হেল ধারণা করলেন, যদি ন্যানো ঝলকদীপ (Nano flash light) তৈরি করা যায়, যা কোনো বস্ত্তর ওপর ন্যানোমিটার করে পর্যবেক্ষণ করবে এবং উত্তেজিত নিঃসরণ ব্যবহার করে প্রতিপ্রভা অণুকে নির্বাপিত (quenching) করতে পারে, তাহলে এই প্রক্রিয়ায় আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। ১৯৯৪ সালে স্টিফেন হেল তাঁর এই তাত্ত্বিক ধারণা প্রকাশ করলেন অপটিক্যাল লেটারস জার্নালে। হেল তাঁর পদ্ধতির নাম দিলেন ‘stimulated emission depletion microscopy’ সংক্ষেপে STED। এই পদ্ধতি অনুযায়ী একটি আলোর স্পন্দন প্রথমে সমস্ত প্রতিপ্রভা অণুকে উদ্দীপিত করবে এবং আরেকটি আলোর স্পন্দন সমস্ত অণু থেকে প্রতিপ্রভা অণুকে নির্বাপিত করবে শুধু ন্যানোমিটার অংশকে বাদ দিয়ে। তাহলে যে ন্যানোমিটার অংশকে বাদ দেওয়া হয়েছে নির্বাপণের প্রক্রিয়া থেকে, সেই অংশের সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। হেলের ভাষায়,  ‘The smaller the volume allowed to fluorescence at a single moment, the higher the resolution of the final image। এভাবেই অপবর্তন সীমাকে অতিক্রম করা সম্ভব। হেলের এই তাত্ত্বিক কাজে প্রথমে সাড়া না পাওয়া গেলেও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের জৈব ভৌত-রসায়নবিজ্ঞান বিভাগ তাঁকে এ বিষয়ে আরো গবেষণা করার সুযোগ করে দেয়। এই প্রতিষ্ঠানে হেল তাঁর তাত্ত্বিক ধারণার ভিত্তিতে তৈরি করলেন STED অণুবীক্ষণ যন্ত্র (চিত্র-২ দ্রষ্টব্য)। এই যন্ত্র দিয়ে ২০০০ সালে হেল ই-কলাই ব্যাকটেরিয়ার আণবিক স্তরের চিত্র ধারণ করেন, যার বিশ্লেষণক্ষমতা আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি। STED অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ই-কলাই ব্যাকটেরিয়াকে চিত্র-৩-এ দেখা যায়।

বেটজিগ্ এবং মোরনার স্বতন্ত্রভাবে আরো দুটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যদিও তাঁদের লক্ষ্য এক – কীভাবে অপবর্তন সীমাকে অতিক্রম করা যায়। ১৯৮৯ সালে মোরনার ক্যালিফোর্নিয়ার আইবিএম সেন্টারে কাজ করার সময় প্রথম একটি অণুর আলো শোষণ করার ক্ষমতা পরিমাপ করতে সমর্থ হন। ১৯৯৭ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজ প্রতিপ্রভ প্রোটিন (green fluorescent protein) সংক্ষেপে জিএফপি নিয়ে কাজ করছিলেন নোবেল বিজ্ঞানী রজার ৎসিয়ান (Roger Y. Tsien)। মোরনার জিএফপির একটি রূপের (variant) প্রতিপ্রভাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান যে, ৪৮৮ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো দ্বারা প্রোটিনকে উত্তেজিত করলে তা প্রতিপ্রভ হয়, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার প্রতিপ্রভা থেমে যায়। আবার ৪০৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো দ্বারা ওই প্রোটিনকে সক্রিয় করা সম্ভব এবং ৪৮৮ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে আবার প্রতিপ্রভা হয়ে ওঠে। মোরনার এরকম উত্তেজিত করা যায় এমন প্রোটিনকে জেলের (gel) মধ্যে ছড়িয়ে দেন, যাতে করে প্রোটিন অণুর মধ্যে দূরত্ব অপবর্তন সীমার চেয়ে বেশি হয় এবং আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা প্রতিটি অণুর দীপ্তি প্রত্যক্ষ করা যায়। এই পরীক্ষা দ্বারা মোরনার প্রমাণ করেন যে, একক অণুর প্রতিপ্রভাকে আলোর সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ১৯৯৭ সালে নেচার পত্রিকায় মোরনার তাঁর গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে উল্লেখ্য একটি গ্রাফ, যা চিত্র-  ৪-এ দেখা যায়। এই গ্রাফে দেখানো হয়েছে কীভাবে জিএফপির প্রতিপ্রভাকে আলোর সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বেটজিগ্ মোরনারের গবেষণা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে নিউজার্সির বেল ল্যাবরেটরিতে নিকটক্ষেত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র (near field microscopy) (যা চিত্র-৫-এ দেখা যায়) নিয়ে কাজ করার সময় লক্ষ করেন যে, যদিও এ-ধরনের অণুবীক্ষণ যন্ত্র অ্যাবের অপবর্তন সীমা বা রেলির নির্ণায়ককে অতিক্রম করতে পারে; কিন্তু কোষের উপরিস্তরের ভেতর ভালোভাবে দেখা যায় না। ১৯৯৫ সালে বেটজিগ্ নতুন এক ধারণার সূত্রপাত করলেন। অর্থাৎ কোনো অণু যদি  বিভিন্ন রঙের প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে তাহলে এর দ্বারা অপবর্তন সীমাকে অতিক্রম করা সম্ভব। নিকটক্ষেত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা তিনি একটি অণুর প্রতিপ্রভা শনাক্ত করেছেন, কিন্তু বিভিন্ন অণু যদি বিভিন্ন রঙের প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে, যেমন – লাল, হলুদ এবং সবুজ রঙের প্রতিপ্রভা এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র যদি প্রতিটি রঙের জন্য পৃথক ছবি ধারণ করতে পারে এবং বিভিন্ন রঙের ছবিকে একত্রিত করে একটি ছবি তৈরি করা হয়, তাহলে অপবর্তন সীমার বাধা আর থাকবে না। ১৯৯৫ সালে অপটিক্স লেটারস জার্নালে বেটজিগের এই তাত্ত্বিক ধারণা প্রকাশিত হয়। এ-ধারণাকে বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এমন অণু বের করা যার মধ্যে আলোর বিভিন্ন ধর্মকে শনাক্ত করা যায়। তারপর বেটজিগ্ কোনো এক অজানা কারণে অ্যাকাডেমিয়া ছেড়ে চলে যান তাঁর পিতার কারখানায় কাজ করতে। তারপর দশ বছর গবেষণাকাজের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ২০০৫ সালে বেটজিগ্ যখন আবার ফিরে এলেন গবেষণাকাজে, তখন তিনি সবুজ প্রতিপ্রভা সৃষ্টিকারী এক প্রোটিনের সন্ধান পেলেন, যার মাধ্যমে কোষের অভ্যন্তরে অন্যান্য প্রোটিনকে দেখা সম্ভব এবং এই প্রোটিনকে ইচ্ছেমতো সক্রিয় করা সম্ভব। বেটজিগের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে লাইসোজোম (lysosome) কোষবেষ্টিত ঝিল্লির সঙ্গে যুক্ত করলেন উত্তেজিত হয় এমন প্রতিপ্রভা প্রোটিন। তারপর আলোর স্পন্দন ব্যবহার করে প্রোটিনকে সক্রিয় করা হলো, যাতে ওই অণু প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে। এই অবস্থায় দীপ্ত প্রোটিন অণুর অবস্থানের ছবি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়া বারবার করতে থাকলে অনেক ছবি ধারণ করা সম্ভব এবং ওই ছবিগুলোকে উপরিস্থাপন (superimposed) করলে লাইসোজোম ঝিল্লির অতিবিভাজিত চিত্র (super resolution) পাওয়া যায়। ২০০৬ সালে সায়েন্স জার্নালে বেটজিগের গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশিত হয়। বেটজিগের এই পদ্ধতিকে বলা হয় একক অণু অণুবীক্ষণ যন্ত্র (single molecule microscopy) যাকে বেটজিগ্, হেস এবং লিপিনকট সোয়ার্জ তাঁদের গবেষণাপত্রে বলেছেন PALM (Photo Activated  Localization Microscopy) চিত্র -৬-এ দেখা যায় PALM দ্বারা তোলা লাইসোজোমের চিত্র।

বস্ত্তত হেল, মোরনার এবং বেটজিগ্ – এই তিন বিজ্ঞানীই অণুর প্রতিপ্রভা ধর্মকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগিয়ে ন্যানোস্কেলে অণু-পরমাণুর ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তাই নোবেল কমিটি বলেছে, সামগ্রিকভাবে super resolved fluorescnce microscopy-এর উন্নয়ন সাধনের জন্য এই বিজ্ঞানীদের পুরস্কৃত করা হয়। এই বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার মানবকল্যাণে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কলাকৌশল জানার জন্য স্টিফেন হেল ব্যবহার করেছেন তাঁর উদ্ভাবিত ন্যানোবীক্ষণ যন্ত্র। মোরনার হান্টিংটন রোগে প্রোটিনের ভূমিকা নির্ণয়ে ব্যবহার করেছেন তাঁর উদ্ভাবিত ন্যানোবীক্ষণ যন্ত্র। বেটজিগ্ ভ্রূণের অভ্যন্তরে কোষের বিভাজন কীভাবে হয়, তা জানতে ব্যবহার করেছেন তাঁর উদ্ভাবিত ন্যানোবীক্ষণ যন্ত্র। কোষজীববিদ্যা, স্নায়ুজীববিদ্যা এবং অণুজীববিদ্যার নানা ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

তিন. পদার্থবিজ্ঞান

২০১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত আবিষ্কারকে বুঝতে হলে প্রথম জানা প্রয়োজন আলো নিঃসরণকারী ডায়োড (light emitting diode বা এলইডি) কী? এলইডি হচ্ছে সে-ধরনের ডায়োড, যার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে আলো নিঃসরিত হয়। এ-ধরনের ডায়োড অর্ধপরিবাহী পদার্থ যেমন – গ্যালিয়াম আরসেনাইড ফসফাইড দ্বারা তৈরি করা হয়। ডায়োড দ্বারা তৈরি বাল্বে সাধারণ বাল্বের মতো ফিলামেন্ট নেই। ডায়োডে বিদ্যুৎ একদিকে প্রবাহিত হয় এবং ভোল্টেজ প্রয়োগ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক সরলরৈখিক (rectilinear) নয়, বরং বক্ররৈখিক (exponential)। তাই ওহমের সূত্র ডায়োডে  প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য, ওহমের সূত্র হচ্ছে – কোনো পরিবাহী পদার্থের দুটি প্রান্তের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ দুটি প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্যের আনুপাতিক।

এলইডি লাল, সবুজ এবং নীল রঙের আলো নিঃসরণ করতে পারে (চিত্র-৭-এ দেখা যায়)। ডায়োড-মিশ্রিত রঙের আলোও নিঃসরণ করতে পারে। লাল ও সবুজ ডায়োড অর্ধশতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু নীল আলো নিঃসরণকারী ডায়োড তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি এতদিন। আমরা জানি, লাল, সবুজ এবং নীল রঙের মিশ্রণ ঘটাতে পারলে সাদা রং পাওয়া যায়। সাদা আলো নিঃসরণকারী ডায়োড চিত্র ৮ এ-দেখা যায়। এই ডায়োডের জন্য প্রয়োজন নীল আলো নিঃসরণকারী ডায়োড।

এই ডায়োডই আবিষ্কার এবং এর উন্নয়ন সাধন করলেন আকাসাকি, আমানো ও নাকামুরা। কিন্তু কীভাবে তৈরি হলো এই ডায়োড? এলইডিতে থাকে অর্ধপরিবাহী পদার্থের একাধিক স্তর। এই  স্তরকে একাধিক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন এন-স্তর, যেখানে ইলেকট্রনের আধিক্য রয়েছে এবং পি-স্তর, যেখানে ইলেকট্রনের ঘাটতি রয়েছে। এই এন এবং পি স্তরের মধ্যে রয়েছে সক্রিয় স্তর।

এই সক্রিয় স্তরকে পি-এন সংযোগও (P-N Junction) বলা হয়। এটি এন-টাইপ এবং পি-টাইপ অর্ধপরিবাহী পদার্থের আন্তঃতল (interface)। পি-এন সংযোগ অর্ধপরিবাহী পদার্থের একটি মৌলিক কাঠামো। যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরির পদার্থবিদ রাসেল ওল (Russeell Ohl) প্রথম এটি আবিষ্কার করেন। পি ডোপিং (doping) এবং এন-ডোপিং করা পদার্থ পরিবাহী হয়, কিন্তু তাদের সংযোগস্থল আধান বাহকের অভাবে অপরিবাহী হতে পারে, যা নির্ভর করে অর্ধপরিবাহী পদার্থের দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যের ওপর। এই পি-এন স্তরকে নিপুণভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে ডায়োড তৈরি করা হয়। একটি ডায়োডের গঠন চিত্র-৯-এ দেখা যায়। এখানে উল্লেখ্য, ডোপায়নের মাধ্যমে পি-এন সংযোগ তৈরির নানা পদ্ধতি রয়েছে, যেমন আয়ন স্থাপন (ion implantation), ডোপেন্টের ব্যাপন (diffusion of dopants) এবং অধিকেলাসন (epitaxy)। এই শেষোক্ত পদ্ধতিতে কেলাসের একটি স্তরকে ডোপেন্ট ব্যবহার করে বৃদ্ধি করা হয় এবং তার ওপর আরেক ধরনের ডোপেন্ট ব্যবহার করে কেলাসের আরেকটি স্তর বৃদ্ধি করা হয়। এই অধিকেলাসন পদ্ধতি আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরা তাঁদের উদ্ভাবিত ডায়োড তৈরির কাজে ব্যবহার করেন। এই ডায়োডে বৈদ্যুতিক ভোল্ট ইলেকট্রনকে এন-স্তর ও পি-স্তর থেকে সক্রিয়  স্তরে নিয়ে যায়। যেখানে এন-স্তর ও পি-স্তরের ইলেকট্রনের মধ্যে মিলন ঘটার ফলে আলো নিঃসরিত হয়। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে কী ধরনের অর্ধপরিবাহী পদার্থ দ্বারা এলইডি তৈরি তার ওপর। সাধারণ বাল্বে বিদ্যুৎশক্তির কিছু অংশ তাপশক্তিতে এবং বাকি অংশ আলোর কণায় রূপান্তরিত হয়। প্রতিপ্রভা বাল্বেও তাপ ও আলো দুটিই তৈরি হয়, কিন্তু এলইডিতে শুধু আলোর কণা তৈরি হয়।

অর্ধপরিবাহী পদার্থ থেকে আলো নিঃসরিত হওয়ার ঘটনা প্রথম ১৯০৭ সালে মার্কনির সহকর্মী হেনরি রাউন্ড জানান। মার্কনি হচ্ছেন সেই বিজ্ঞানী যিনি বেতার টেলিগ্রাফি আবিষ্কারের জন্য ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯২০ এবং ত্রিশের দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানী লোসেভ (Oleg V. Losev) অর্ধপরিবাহী পদার্থ নিয়ে আরো গবেষণা করেন। কিন্তু পদার্থের ইলেকট্রো প্রতিপ্রভার ধর্ম সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ১৯৫০-এর দশকে লাল আলো নিঃসরণকারী ডায়োড আবিষ্কার হলো এবং তা ঘড়ি ও ক্যালকুলেটারে ব্যবহার শুরু হলো। আকাসাকি ও আমানো নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাকামুরা নিচিয়া কেমিক্যাল কোম্পানিতে নীল আলো নিঃসরণ করে এমন ডায়োড নিয়ে কাজ করছিলেন। ১৯৮৬ সালে আকাসাকি এবং আমানো প্রথম উন্নতমানের গ্যালিয়াম নাইট্রাইড কেলাস তৈরি করতে সমর্থ হন। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al203) বিক্রিয়কের ওপর অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইডের স্তর স্থাপন করে তার ওপর  গ্যালিয়াম নাইট্রাইড কেলাস বৃদ্ধি করেন। কেলাসের এই বৃদ্ধি (growth) করানোর কলাকৌশল একটু ভিন্ন। সত্তর দশকে নতুন  কেলাস বৃদ্ধির দুটি পদ্ধতি – Molecular Beam Epitaxy (MBE) এবং Metal Organic Vapour Phase Epitaxy  (MOVPE) আবিষ্কার হয়। ১৯৭৪ সালে টোকিওর মাৎসুসিতা গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত থাকাকালে আকাসাকি গ্যালিয়াম নাইট্রাইড কেলাসকে বৃদ্ধি করা নিয়ে গবেষণা করেন। পরে নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান এবং তাঁর পিএইচডি গবেষণারত ছাত্র আমানোর সহযোগিতায় ১৯৮৬ সালে MOVPE কলাকৌশল ব্যবহার করে তাঁরা উন্নতমানের গ্যালিয়াম নাইট্রাইড কেলাস গঠন করতে সমর্থ হন। তাঁদের পদ্ধতিটি এরূপ : বহু কেলাসিত অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইডের পাতলা স্তর (আনুমানিক ৩০ ন্যানোমিটার) স্থাপন করা হয় অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড বিক্রিয়কের ওপর ৫০০c  তাপমাত্রায়। তার ওপর আনুমানিক ১০০০c তাপমাত্রায় গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের স্তর বৃদ্ধি করা হয়। নাকামুরা একটু ভিন্নভাবে এ-কাজটি করেন। তিনি অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইডের পরিবর্তে নিম্ন তাপমাত্রায় গ্যালিয়াম নাইট্রাইড ব্যবহার করেন। আশির দশকের শেষদিকে আকাসাকি এবং আমানো লক্ষ করেন, যদি গ্যালিয়াম নাইট্রেটকে জিঙ্ক দ্বারা ডোপ করা হয় তাহলে তা থেকে অধিক আলো নিঃসরিত হয়। একইভাবে স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে তাঁরা লক্ষ করেন গ্যালিয়াম নাইট্রেটকে ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা ডোপ করে তাকে নিম্নশক্তির ইলেকট্রন দ্বারা বিকিরণ করলে তা থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো পি-ডোপিং ধর্ম পাওয়া যায়। অত্যন্ত কার্যকর নীল আলো নিঃসরণকারী ডায়োড তৈরির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সংকর ধাতুর কেলাসের  পি-ডোপিং এবং কেলাস বৃদ্ধি করা। তা থেকেই পাওয়া যায় কার্যকর পি-এন সংযোগ, যা ডায়োড তৈরির অন্যতম শর্ত।

আলোক প্রযুক্তিতে এই বিজ্ঞানীত্রয়ের অবদান বিপ্লব ঘটিয়েছে। আলোর উজ্জ্বলতা পরিমাপের একক লুমেন (Lumen) এবং শক্তি পরিমাপের একক ওয়াট। প্রাচীনকালে তেলের প্রদীপে ১ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে পাওয়া যেত ০.১ লুমেন আলো। টমাস আলভা এডিসনের যুগে ১৮৭৯ সালে ১ ওয়াট শক্তি খরচ করে পাওয়া যেত ১৬ লুমেন আলো। ১৯০০ সালে পি কুপার হিউয়েটের প্রতিপ্রভা বাল্ব থেকে ১ ওয়াট শক্তি খরচ করে পাওয়া যায় ৭০ লুমেন আলো। কিন্তু এলইডি দিয়ে ১ ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি খরচ করে পাওয়া যায় ৩০০ লুমেন আলো। সুতরাং এলইডি অত্যন্ত কম বৈদ্যুতিক শক্তিনির্ভর একটি প্রযুক্তি। একটি সাধারণ বাল্ব ১০০০ ঘণ্টা পর্যন্ত আলো দান করতে পারে, একটি প্রতিপ্রভা বাল্ব ১০০০০ ঘণ্টা; কিন্তু একটি এলইডি বাল্ব ১০০০০০০ ঘণ্টা পর্যন্ত আলোদান করে তারপর নিঃশেষিত হয়। সুতরাং এলইডি তুলনামূলকভাবে টেকসই একটি প্রযুক্তি।

সাদা এলইডি ল্যাম্প দুই পদ্ধতিতে তৈরি হতে পারে। একটি পদ্ধতি হচ্ছে নীল আলো নিঃসরণকারী ডায়োড দ্বারা ফসফোরকে (phosphor) উত্তেজিত করা যাতে এটি লাল এবং সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। যখন তিনটি রং একত্রিত হয় তখন সাদা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, একটি ল্যাম্প তৈরি করা, যার মধ্যে নীল, সবুজ এবং লাল এলইডি থাকবে। আমরা এই ল্যাম্প থেকে নিঃসরিত আলো সাদা দেখব। আমাদের চোখ এ-কাজটি করবে। একটি এলইডি ল্যাম্প চিত্র ১০-এ দেখা যায়। বর্তমানে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মনিটর বা টেলিভিশনের স্ক্রিনে গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের এলইডি ব্যবহৃত হচ্ছে। নীল এবং অতিবেগুনি আলো নিঃসরণকারী ডায়োড ব্যবহৃত হচ্ছে ডিভিডিতে। এলইডি থেকে নিঃসরিত অতিবেগুনি রশ্মিকে পানি বিশুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে যেখানে আগে কেরোসিনের ল্যাম্প ব্যবহার করা হতো, সেখানে দিনে সৌরশক্তিকে মজুদ করে রাতে তা দিয়ে এলইডি ল্যাম্প জ্বালানো হচ্ছে।

চার. শারীরবৃত্ত বা চিকিৎসাবিজ্ঞান

মস্তিষ্কের একটি মৌলিক কাজ হচ্ছে কোনো স্থান সম্পর্কে অনুভব করা এবং দেহকে পরিচালনা করা। এক ধরনের প্রচেতনা কোনো পরিবেশে আমাদের অস্তিত্ব এবং অবস্থানকে নির্ধারণ করে। বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক ইমানুয়াল কান্ট অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুক্তি দেখান যে, মানুষের কতিপয় মানসিক সামর্থ্য অভিজ্ঞতানির্ভর নয়। কোনো স্থান সম্পর্কে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা মস্তিষ্কের একটি অন্তর্জাত সামর্থ্য (innate ability), যার মাধ্যমে আমাদের পরিপার্শ্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড টলম্যান ১৯৪৮ সালে এক গবেষণায় দেখান, একটি প্রাণীর মস্তিষ্কে তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ধারণাসমর্থ মানচিত্র (cognitive map) তৈরি হয়। কিন্তু মস্তিষ্কের কোন অংশ এ-ধরনের মানচিত্র তৈরিতে সমর্থ বা ইমানুয়েল কান্টের অন্তর্জাত সামর্থ্য মস্তিষ্কের কোন অংশ থেকে জাত, তা এতদিন জানা যায়নি। ও’কিফের ও মোসার পরিবারের আবিষ্কার এ-সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে সম্প্রসারিত করেছে।

জন ও’কিফ ১৯৭১ সালে আবিষ্কার করেন, একটি ইঁদুরকে যখন কোনো নতুন পরিবেশে নেওয়া হয়, তখন তাদের মস্তিষ্কের কতিপয় স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়। আবার পরিবেশের পরিবর্তন করলে অর্থাৎ অন্য আরেক পরিবেশে ইঁদুরকে নিয়ে গেলে তাদের মস্তিষ্কের নিম্ন স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়। যেহেতু কতিপয় স্নায়ুকোষের সক্রিয়তা পরিবেশনির্ভর, সেহেতু এই কোষকে ও’কিফ (স্থানিক কোষ) (Place cell) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মস্তিষ্কের যে-অংশে এই ‘স্থানিক কোষ’ অবস্থিত, সেই অংশকে বলা হয় ‘হিপোক্যাম্পাস’। মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাসের অবস্থান চিত্র-১১-তে দেখা যায়।

ও’কিফের এই আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন একটি রেকর্ডিং পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোনো প্রাণীর চলাফেরাকে রেকর্ড করা হবে। ষাটের  দশকের শেষদিকে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে গবেষণার সময় ও’কিফ কোনো কোষের ক্রিয়াকলাপ এবং স্থানিক ক্ষেত্র (Place field) প্রত্যক্ষ করেন। এই স্থানিক ক্ষেত্রের স্থানিক কোষের সঙ্গে তার স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপের সম্পর্ক নিরূপণ করেন। একটি পরীক্ষা দ্বারা ও’কিফ দেখান, স্থানিক কোষ থেকে স্মৃতি (memory) এবং বিভিন্ন স্থানিক কোষের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে একটি পরিবেশের মানচিত্র একটি প্রাণীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়। ও’কিফ সিদ্ধান্তে এলেন যে, স্থানিক কোষের মূল কাজ হচ্ছে একটি প্রাণীর চারপাশের পরিবেশের মানচিত্র স্মৃতিতে সংরক্ষণ করা।

মে-ব্রিট মোসার এবং এডভার্ড মোসার ওসলোর পারএন্ডারসন গবেষণাগারে পিএইচ-ডি অধ্যয়নের সময় এবং পরবর্তীকালে এডিনবার্গে রিচার্ড মরিস এবং লন্ডনে ও’কিফের গবেষণাগারে কাজ করার সময় ধারণা করেন যে, স্থানিক কোষের সক্রিয়তা হিপোক্যাম্পাস ছাড়াও হিপোক্যাম্পাসের বাইরে ক্রিয়াকলাপের ওপর নির্ভরশীল। ২০০৫ সালে মোসার পরিবার আবিষ্কার করে যে, একটি ইঁদুর যখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে যায় অর্থাৎ তার চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে, তখন স্থানিক কোষ ছাড়াও মস্তিষ্কে এনটোরহিন্যাল করটেক্সের (entorhinal cortex)          (চিত্র-১২ দ্রষ্টব্য) স্নায়ুকোষও সক্রিয় হয়। এনটোরহিন্যাল করটেক্স এবং হিপোক্যাম্পাসের বিদ্যমান স্নায়ুকোষের সমন্বয়ে এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক এক জিপিএস পদ্ধতি (Global Positioning System) হিসেবে কাজ করে। এই পদ্ধতির আওতায় যে-কোষগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে তাদের বলা হয় গ্রিড কোষ (grid cell)। এই কোষ মস্তিষ্কে এক ধরনের স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা (coordinate system) তৈরি করে। গ্রিড কোষ এবং এনটোরহিন্যাল করটেক্সের অন্যান্য কোষ ইঁদুরের মাথার দিক এবং অবস্থানকে শনাক্ত করে এবং হিপোক্যাম্পাসের স্থানিক কোষ তৈরি করে এক ধরনের নেটওয়ার্ক। এসবের সমন্বয়ে গঠিত হয় এক ধরনের জিপিএস পদ্ধতি। মানুষের মস্তিষ্কেও ইঁদুরের মতো এ ধরনের জিপিএস পদ্ধতি রয়েছে। চিত্র ১৩-তে দেখা যায় গ্রিড কোষ এবং ইঁদুরের মস্তিষ্কে অবস্থানের দৃশ্য।

ইঁদুরের মস্তিষ্কে স্থানিক কোষ এবং গ্রিড কোষ আবিষ্কারের পর অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কেও তা লক্ষ করা গেছে। এই বিজ্ঞানীত্রয়ের গবেষণা মস্তিষ্কের নানা রোগের আরোগ্যে বলিষ্ঠ অবদান রেখে চলেছে। ডিমেনসিয়া এবং আলঝেইমারস রোগের কারণ হিসেবে স্থানিক কোষের ক্ষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের বোধশক্তি কীভাবে মস্তিষ্কে তৈরি হয় এবং তাতে গ্রিড কোষ ও স্থানিক কোষের ভূমিকা নিয়ে নানা গবেষণা চলছে। ও’কিফ ও মোসার পরিবারের গবেষণালব্ধ ফল এখনো সরাসরি চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তবে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফল যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পাঁচ

পরিশেষে বাংলার কোনো এক গীতিকবির লেখা একটি গানের কলি মনে পড়ছে, ‘আমাকে দেখার চোখ তোমার কই গো।’ অণু-পরমাণুর জগতেও কিন্তু তাই। দেখার ক্ষমতা না থাকলে দেখব কীভাবে? বেটজিগ্, হেল এবং মোরনারের আবিষ্কার ‘অণু-পরমাণুর নিত্যখেলা দেখার এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখন কোষের অভ্যন্তরে একটি ডিএনএ অণু প্রতিনিয়ত কী করছে তা দেখতে পারি – ফলে নানা রোগপ্রতিরোধকারী ওষুধ তৈরি সম্ভব হচ্ছে। রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার তারই স্বীকৃতি। বাংলার আরেক গীতিকবি লিখেছেন, ‘যখন দুচোখভরে নামবে অাঁধার, তখন যেন দেখি…।’ আঁধারে দেখার জন্য প্রয়োজন আলো এবং সে-আলো যদি সাদা আলো হয় তাহলেই দেখা হয়ে ওঠে বাস্তবসম্মত। লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে কমশক্তি ব্যবহার করে আমাদের দেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন যাঁরা, সেই আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরার এলইডি প্রযুক্তিই এনে দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল স্বীকৃতি। আমরা কীভাবে জানি আমরা কোথায় আছি? কীভাবে আমরা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার পথ খুঁজে পাই? কেই-বা জোগান দেয় এই ধারণাসঞ্জাত বোধ? জিপিএস প্রযুক্তি যে আমাদের একটি অন্তর্জাত সামর্থ্যেরই বহিঃপ্রকাশ, সেসবের উত্তর যারা খুঁজে বের করেছেন, সেই ও’কিফ এবং মোসারদ্বয়কে দেওয়া হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার আগামী দিনে মানবকল্যাণে যে নিরন্তর অবদান রেখে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

তথ্যসূত্র

রসায়নবিজ্ঞান

১. The Royal Swedish Academy of Science (RSAS), Press Release 8 Oct, 2014.

২. RSAS, Scientific Background on the Nobel Prize in Chemistry 2014, Sweden.

৩. Betzig, E, Proposed method for molecular Optical imaging. Optical Letters, 20 : 237-239, 1995.

৪. Hell, S.W and Watchman, J, Breaking the Diffraction Resolution Limit by stimulated emission : STED,          Optical Letters, 19 : 780-782, 1994.

৫. Moerner, W. E  and Kador, L, Optical Detection and Spectroscopy of single Molecules in a Solid. Physics Review Letters, 62 : 2535-2538, 1989.

 

চিত্রঋণ : রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি

পদার্থবিজ্ঞান

১. RSAS, Press Release, 7 October 2014, Sweden.

২. RSAS, Scientific Background on the Nobel Prize in Physics 2014, Sweden.

৩. N Zheludev,  The Life and Times of the LED – a 100 Years History, Nature Photonics, Vol-1, 2007

 

চিত্রঋণ : রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি।

চিকিৎসাবিজ্ঞান

১.   The Nobel Assembly at Karolinska Institutet, Press Release, 6 October 2014, Sweden.

২.    Ole Kiehn and Hans Forssburg, Science Background : the Brain’s Navigational Place and Grid Cell System, Karolinska Institute, Sweden.

৩.   O’Keefe, J. Place Units in the Hippocampus of the Freely Moving Rat : Experiment Neurology, 51,          78-109, 1976.

৪.   Fyhn, M. Molden, S, Witter, M.P. Moser, E. I. Moser M. B. Spinal Representation in the Entortinal Cortex, Science, 305, 1258-1264, 2004.

চিত্রঋণ : দ্য নোবেল অ্যাসেম্বলি প্রেস রিলিজ