বিপন্ন কালের লিপি   

রিপ ভ্যান উইঙ্কল নামে সেই বহুপঠিত চরিত্রটির কথা ধরুন। দীর্ঘ দুই যুগ বনপাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থেকে যখন সে জাগে, চোখ রগড়ে চারদিকে তাকিয়ে তার সবকিছু অচেনা মনে হয়। অবশেষে লুপ্তপ্রায় স্মৃতি ফিরে আসার সঙ্গে মনে উঁকি দেয় ফেলে-আসা গ্রাম। সেইসঙ্গে স্ত্রী ও শিশুকন্যার মুখ। কিন্তু রাস্তা ঘুরে ঘুরে কিছুতেই খুঁজে পায় না নিজ বাড়ির ঠিকানা। পথচলতি লোকদেরও কেউ তাকে চিনতে পারে না। সেও চেনে না কাউকে। কারণ ইতোমধ্যে বহু বদলে গেছে দৃশ্যপট।

আমাদের আজকের আলোচ্য চরিত্র মাসুদের কাহিনিও অনেকটা এই রূপকথার গল্পটির মতো। দেশে ফেরে সে প্রায় চার যুগ পর। স্মৃতির ভেতর গাঁথা সেই চেনা গ্রাম আজ উধাও। বদলে যাওয়া এই পতনমুখী স্বদেশ, এই বেগানাপ্রায় গ্রামে ‘বাহাত্তুরে প্রবীণ’ মাসুদের প্রত্যাবর্তন নানা ঘটনা ও দৃশ্যের জন্ম দেয়। নিজ গ্রামে ফিরে শান্তমনে স্মৃতিকথা লিখতে চেয়েছিল যে-মাসুদ, ওইসব ঘটনা ও আশাহত বাস্তবের বিপরীত স্রোত ওর ভেতর ক্ষুব্ধ আলোড়ন তোলে; একটা গোপন সংকল্প দানা বাঁধে মনে, এই বিপন্ন স্রোতের বিরুদ্ধে লড়বে সে।

কথাশিল্পী মঞ্জু সরকারের সাম্প্রতিকতম উপন্যাস উজানযাত্রার গল্পটি শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মাসুদের স্বদেশে ফেরা ও ঢাকার বিমানবন্দরে ছোটভাই মুকুলের জন্য অপেক্ষমাণ থাকার একটি দৃশ্য দিয়ে। প্রফেসর মাসুদুল হক পাটোয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ছোট ভাই মুকুলের গাড়িতে নিজ গ্রাম ধর্মপুরের উদ্দেশে যেতে যেতে রাস্তার দুদিকে নজর ফেরায়।

‘অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটি গরুর গাড়িও নজরে পড়ে না। মসৃণ পাকা রাস্তায় নানা যান্ত্রিক যান, … রাস্তার ধারে গজিয়ে উঠেছে ইটের তৈরি নানা স্থাপনা, বাজার ও দোকানপাট … একটা বিশালকায় কোল্ড স্টোরেজ এবং একটা ইটভাটাও চোখে পড়ে। … হাটবাজারগুলি এতোটাই ফুলেফেঁপে উঠেছে যে চিনতে পারে না মাসুদ। একদিকে মেঠোপথ ধরে একটি বালকের পাকা রাস্তার দিকে ছুটে আসতে থাকা দেখে শৈশবে প্রথম এই রাস্তায় মোটরগাড়ি দেখার কথা মনে পড়ে মাসুদের। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তাটির ওপরে পাকা সেতু ও কালভার্ট হওয়ার পর প্রথম মোটর গাড়িটি যেদিন তিস্তার মুখ পর্যন্ত ছুটে যায়, সেটা ছিল নিজ গ্রাম ধর্মপুর থেকে মাসুদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভবত প্রথম ঘোষণা।’ – উপন্যাসের শুরুর দিকে এই অংশটুকু বেশ মনোযোগ কাড়ার মতো। মোটরগাড়ি যা গতির প্রতীক হিসেবে এখানে উপস্থিত, একই সঙ্গে বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত; বাঞ্ছিত – কারণ এটি আমাদের সময় ও শ্রম বাঁচায়, দূরত্ব হ্রাস করে; অবাঞ্ছিত – কারণ, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতা থেকে এটি আমাদের দূরে ঠেলে দেয়, নৈকট্যচিহ্নিত সরল আর অনাড়ম্বর জীবন থেকে আমাদের নিয়ে যায় দূরে …।

এই যে নিজের জন্মভিটা আর আশৈশব চেনা পরিবেশ, তা থেকে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং পুনরায় বহুদিন পর সেখানে ফিরে আসা, নতুন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখা, সেই দেখার ভেতরে যে গভীর গাঢ়তর মমত্ববোধ, নতুন ধ্যান, হৃদয় ও চোখের যৌথ অবলোকন, ঔপন্যাসিকের বয়ানে সেই সত্যের উন্মোচন আমাদেরও নিয়ে যায় হৃত বাংলার ঐশ্বর্যঘন ছবিগুলির কাছাকাছি : ‘ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলা মাসের হিসাবে ধর্মপুরে আউশ ও আমন ধানের মৌসুম যখন আসে, ধর্মপুর তখন অবশ্যই ধানের দেশ …।’

কিন্তু কেবল এই ঐশ্বর্যের বর্ণনাই নয়, পাশাপাশি আছে অন্ধবিশ্বাস ও নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অশিক্ষিত গ্রামসমাজকে ঘিরে-থাকা আধিভৌতিক তমসারও গল্প। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গরিব কৃষক ‘মাছুয়া ধোঁধা’র কন্যা অঞ্জনি। বাবার দারিদ্র্য সত্ত্বেও যে স্বভাবচঞ্চল, উচ্ছল আর বিচিত্র অদ্ভুত সব কথার তোড়ে বালক মাসুদের মন ভাসিয়ে দেয়। অঞ্জনির সঙ্গে জলে নেমে মাছ ধরার ঘটনা একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকে মাসুদের মনে। সেই অঞ্জনির একদিন বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর ঘরে অসুখী অঞ্জনি এক মধ্যরাতে তিন-চার গ্রাম পেরিয়ে বিস্রস্ত বসন ও এলোচুলে বাবার বাড়িতে এসে ওঠে। তখন বাড়ির সবাই বিস্ময়স্পৃষ্ট। ছানাবড়া সন্ত্রস্ত চোখে ওকে দেখে; তাদের বিশ্বাস, অঞ্জনিকে নির্ঘাত ভূতে ধরেছে। কাহিনির আরেকটি উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্র মোমেনা, শিক্ষিত আর আধুনিক হয়েও যে শেষ পর্যন্ত মোল্লা আর মোল্লাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে বৈপরীত্য সৃষ্টির মাধ্যমে লেখক তাঁর গল্পের আকর্ষণ ও আবেদন বাড়িয়ে তোলেন।

ফ্ল্যাশব্যাকে এরকম সব ঘটনা বর্ণনাশেষে ঔপন্যাসিক ফিরে আসেন বর্তমানে। কাহিনি-কাঠামো নির্মিত হয়েছে মূলত দুটি সমান্তরাল ধারার বর্ণনা দিয়ে। একদিকে প্রকৃতিঘন ধান-প্রান্তর-নদী-মাছের ঐশ্বর্যে ভরা স্মৃতিময় সরলাচারের গ্রাম। অন্যদিকে বর্তমানের পাল্টে যাওয়া ছবি এবং নতুন-দেখা গ্রামকে নতুন করে সাজানোর
স্বপ্ন-সংগ্রাম, উদ্যোগ ও তৎপরতা। এভাবে একটা দ্বান্দ্বিক পটভূমি তৈরির মাধ্যমে এগিয়ে গেছে কাহিনি।

সদ্য গ্রামে ফেরা স্মৃতিতাড়িত স্বপ্নমগ্ন মাসুদ দেখতে পায় বদলে যাওয়া গ্রামের ছবি। ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব। সম্পত্তি নিয়ে গোপন ঈর্ষা আর শত্রুতা। আপাত চাকচিক্যের আড়ালে এককেন্দ্রিক প্রভাব ও রাক্ষুসে রাজনীতির দুষ্টগ্রাস। করপোরেট বাণিজ্যের আগ্রাসী চরিত্রে ছোটভাই মুকুল গ্রামের বিশাল এলাকা, ফসলি জমির দখল নিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে-থাকা লোকজনের সঙ্গে তার ওঠাবসা। সে নিজেও একজন নেতা। নিকটজন ও প্রতিবেশীর জমি হস্তগত করে গড়ে তুলেছে ফল ও শাকসবজির বাগান, তৈরি করেছে মাছ চাষের পুকুর। স্থানীয় দরিদ্র গ্রামবাসীকে সেখানে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। গ্রামে অবস্থানকালে বড়ভাই মাসুদের নির্বিঘ্ন আরাম-আয়েশে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সে উদ্দেশ্যে তার জন্য একটি বড় দ্বিতল বাংলোবাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে এবং নিজ বাগানের ফলমূল, শাকসবজি, পুকুরের মাছ সরবরাহ করছে। বাংলোবাড়িটি অবশ্য মাসুদের পাঠানো টাকাতেই তৈরি। ঢাকায় কেনা দুটি ফ্ল্যাটও ওর টাকায় কেনা। তবে মাসুদ যখন এসবের মালিকানা পাকাপোক্তভাবে নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে মুকুলকে বলে, সে তখন কৌশলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়, মালিকানা হস্তান্তরে গড়িমসি এবং মাসুদের বিরুদ্ধে নানা কথা প্রচার করতে শুরু করে।

মালিকানা নিয়ে এই দ্বন্দ্বের কথা বলা অবশ্য লেখকের উদ্দেশ্য নয়। উপন্যাসের বিস্তৃত পরিসরে তিনি দেখাতে চেয়েছেন একটি চেনা গ্রামের সবকিছু বদলে যাওয়া।

দখল-দূষণ, বিকৃতি, উধাও শস্যক্ষেত আর কুটিল বিনাশী রাজনীতির পঙ্কে পতিত এক গ্রাম। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পঞ্চাশ বছরে সমাজের অভ্যন্তরে যে অশুভ পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পরিবর্তনের ছবি ধরতে গিয়ে তিনি তাঁর ক্যানভাসে বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। বিয়াল্লিশ বছর পূর্বেকার মাসুদের বাল্যসখী অঞ্জনি এখন বৃদ্ধা। তার খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, শৈশব দারিদ্র্যের বিষচক্রে এখনো সে বন্দি। মাসুদের দানকৃত টাকা নিয়ে ওর পরিবারের অপেক্ষাকৃত দুই নবীন সদস্যের মধ্যে কাড়াকাড়ি এই প্রকট দারিদ্র্যেরই সাক্ষ্য বহন করে। এই অঞ্জনি আদতে বাস্তবের অসংখ্য অঞ্জনির একজন। উন্নয়নের সোপান বেয়ে দেশ তরতরিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে – সরকারের এই প্রচারণার বিপরীতে যাদের সংখ্যা সাম্প্রতিককালে বহুগুণিত, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মাত্র এক যুগের ব্যবধানে যখন এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে, ক্ষুধা আর ঋণভারে জর্জরিত হয়ে নীরবে অগত্যা বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। কিন্তু এই খবরগুলি সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় খুব ছোট করে ছাপা হয়। অনেকের তা চোখে পড়ে না।

পড়ার সময় আমার জহির রায়হানের হাজার বছর ধ’রে উপন্যাসের কথা মনে পড়ছিল, যেখানে বলা হয়েছে, হাজার বছর ধ’রে আমাদের প্রিয় গ্রাম একইরকম আছে – একইরকম নিরুপদ্রুত শান্তি ও সৌহার্দ্যরে আগার। উপন্যাসের শেষ পাতাগুলি সেরকমেরই কিছু ইঙ্গিত দেয়। হ্যাঁ, তা হয়তো ছিল একসময়, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত। মঞ্জু সরকারের উজানযাত্রায় সেই চিরচেনা গ্রামের মর্মস্পর্শী ভাঙনপ্রবণ নতুন ছবিটি উঠে এসেছে। যে-গ্রাম আমাদের কৃষিব্যবস্থা ও কৃষিজ ভোগ্যসামগ্রীর জোগানদাতা, সেই গ্রামগুলিকে এভাবে নতুন দৃশ্যপটের ওপর স্থাপন করারও বেশ দরকার ছিল। উজানযাত্রা এই দাবি পূরণের ক্ষেত্রে একটি আন্তরিক সত্যলগ্ন সুন্দর প্রয়াস।

কিন্তু উপন্যাসের আসল কথাটি এখনো বলা হয়নি। এবার তা বলার চেষ্টা করি। মূল চরিত্র মাসুদ নিখুঁত কোনো মানুষ নয়। মেধাবী হলেও নানা মানবীয় দুর্বলতায় চিহ্নিত। লেখক তাকে তার স্বাভাবিক আদলেই এঁকেছেন। এতে কাহিনির বিশ্বস্ততাই বরং রক্ষিত হয়েছে। তাকে অবিমিশ্র সাধুবেশ পরাতে গেলে একটা মিথ্যাচার হতো। তবে সে দ্বৈতসত্তাও নয় এবং এই খুঁত তার মানব হিতৈষণার সঙ্গে কোনো প্রকৃত দ্বৈরথ সৃষ্টি করে না।

একটা হিতোদ্দেশ্যে মাসুদ তার সম্পত্তিকে কাজে লাগাতে চায়। ধর্মান্ধ সমাজের গায়ে কিছু মুক্ত বাতায়নপথ তৈরির  উদ্দেশ্যেও সে কাজ শুরু করে। গ্রামের বখে যাওয়া বাতাসে একটা মঙ্গল বাতাবরণ রচনায় তার সহৃদয় প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কাজটি সহজ নয়। এ-কাজে প্রধান বাধা তার আপন ভাই। এবং তার স্বপ্নের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে পুরনো বিশ্বাসে থিতু গ্রাম্য সমাজ। কিন্তু সে সংকল্প করে, উদ্দেশ্যের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। এ-কাজে যোগ্য সঙ্গীরও প্রয়োজন। বয়স সত্তরোর্ধ হলে কী হবে! মাসুদ দেহে-মনে এখনো একজন তরুণের মতোই সবল ও সতেজ। আচার, সংস্কার ও স্বার্থভজন রাজনীতির বিষ ক্ষালন করতে সে যে-উজানপথের যাত্রী হতে যাচ্ছে, সে-পথের শক্তি জোগাতে তৃতীয় প্রজন্মের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গ থাকা চাই। অতএব, সে অঞ্জনির নাতনি শিক্ষিত ও আধুনিক বহ্নির সহযোগিতা কামনা করে। তাকে আরো ঘনিষ্ঠ করে পেতে চায়। এখন পাঠকই রায় দেবেন, এ-চাওয়া কি কেবলই দৈহিক, নাকি নবীন ও প্রবীণের কোনো দূর গন্তব্যমুখী যৌথযাত্রার প্রস্তুতি, যা ঔপন্যাসিক একটা প্রতীকের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছেন।