একেবারে অচেনা নয়

সম্প্রতি হাতে এলো একটি বই, নাম অচেনা কুসুমের গন্ধে। লেখক ইফ্ফাত আরা দেওয়ান। লেখকের নাম অনেকেরই খুবই পরিচিত, কারণ অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে তারা তাঁর গানের উৎসাহী শ্রোতা। রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে তাঁর গানের জীবন শুরু, যদিও পরে পুরাতনী এবং আধুনিক গানসহ বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছেন তিনি। এবং অনেককাল ধরে সংগীতজগতে এক বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন। কণ্ঠের মাধুর্য এবং অননুকরণীয় গায়কীর কারণে আমি তাঁর মুগ্ধ শ্রোতা সেই ১৯৭০ সালে প্রথম রেকর্ড বের হওয়ার পর থেকেই।

গানের পাশাপাশি ইফ্ফাত আরা ছবি আঁকেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর ছবির একক প্রদর্শনীও হয়েছে। সেই ইফ্ফাত আরা লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবার। স্বাভাবিকভাবেই আমি উৎসাহী। আরো কেউ কেউ হয়তো বেশি উৎসাহী বইটির নাম দেখে।

কী ধরনের বই এটি? পেছনের প্রচ্ছদে পরিচিতি হিসেবে যা লেখা তা থেকে একটু ধারণা পাওয়া গেলেও স্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বোঝা গেল না। মনে হলো, এটি একটি স্মৃতিকথা। বইয়ের সূচিপত্র দেখলে – বিশেষ করে কয়েকটি শিরোনাম দেখলে মনে হতে পারে, লেখকের জীবনের কিছু ঘটনা বা অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই লেখাগুলোয়। আবার কোথাও লেখাগুলিকে ভ্রমণকাহিনির মতোও মনে হতে পারে। রয়েছে বাজার, আর্ট গ্যালারি, শিল্পকলা এবং শিল্পীর কথা। সুতরাং নির্দিষ্ট কোনো শাখায় একে বাক্সবন্দি করা যাবে না। আর সেখানেই এই বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বইটির শুরু চট্টগ্রাম এবং লাহোরে লেখকের শৈশব ও কৈশোরের কথা দিয়ে, যা স্মৃতিকথার আদলেই লেখা। কিন্তু শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবন এবং পরবর্তী জীবনের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে আসেনি আর। এসেছে টুকরো টুকরো জীবন ও সময়ের কথা। প্রথম গান রেকর্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা, কলকাতার নিউমার্কেট এবং গেস্ট হাউসের কথা, ভ্যান গঘের সমাধিতে গিয়ে অনুভূতি, দিল্লি থেকে কলকাতা রাতের ট্রেনের ভেতরে বাঁশির সুরের মায়া, বৃষ্টিস্নাত কলকাতায় ভোরে ট্যাক্সিতে ভজনের সুরের আবহ, প্যারিসের রেস্তোরাঁ, ভিয়েনার পুরনো এক বাড়িতে গভীর রাতে খোলা জানালা দিয়ে দেখা চাঁদ – আরো কত কি!

রাতের বর্ণনা, চাঁদের আলো, তারাদের ভিড় এসেছে বেশ কয়েকটি লেখায় – বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিবেশে। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় ইফ্ফাতের আঁকা ছবিতে চাঁদের কথা। শিল্পীর ঘরের খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায় পূর্ণ চাঁদ। ছবির মতো লেখাতেও নানাভাবে বলেছেন চাঁদের আলোর কথা। ট্রেন থেকে দেখা ‘ম্লান চাঁদ’, ফ্রান্সের/ জেনেভার ফার্ম হাউস থেকে দেখা ‘বিশাল চাঁদ’, ভেনিসের চাঁদ আর ভিয়েনার এক পুরনো বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে দেখা ‘বড় চাঁদ’। রয়েছে রাতের কথা, তারার কথা। রাতের নাচ-গানে উদ্দাম হওয়া মানুষদের দেখে লেখকের রক্তও ‘চঞ্চল’ হয়ে ওঠে। আবার রাতে সাথিহারাদের কথা ভেবে মগ্ন হন তিনি।

লেখাগুলি পড়তে পড়তে একধরনের মায়া জন্মে যায় তাদের জন্য, সেগুলিতে উপস্থিত চরিত্রগুলির জন্য, এবং লেখকের জন্যও। বোঝা যায়, এগুলি নিছক লেখা নয়, প্রতিটিতে রয়েছে তাঁর হৃদয়ের কথা – যা বলতে আমরা অনেকেই ব্যাকুল, কিন্তু পারি না এমন করে বলতে। আর কোথাও কোথাও উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের মতো না পড়ে একটি অংশ পড়েই ভাবতে ইচ্ছে করে তার আবহ সম্পর্কে, লেখকের মনের জগৎ সম্পর্কে।

এমনি করেই আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ বিষয়গুলিও হয়ে উঠেছে বিশেষ। হৃদয়ের গহিন থেকে তুলে আনা হয়েছে অনেক কথা। সেগুলিতে আনন্দ, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস, সবই রয়েছে। তাই পাঠকের হৃদয়ও ছুঁয়ে যায় তারা। কোনো কোনোটি হয়ে উঠেছে কবিতার মতো, আবার কোনোটি ছোটগল্পের মতো – শেষ হয়েও হইলো না শেষ। রেশ রেখে যায় মনের মধ্যে। লেখার গুণে গদ্যও কখনো কখনো কবিতা হয়ে উঠতে পারে। এই বইয়ের লেখাগুলি তার উদাহরণ বলা যেতে পারে। ইফ্ফাত আরার গাওয়া গানের মতোই তারা হৃদয়কে আচ্ছন্নও করে ফেলে। এসব অনুভূতি, হাসি আর হাহাকার কি আমাদেরও সম্পূর্ণ অচেনা?