আকতার হোসাইনের কবিতা

দেড় শতাধিক কবিতা রয়েছে কবি আকতার হোসাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইটিতে। বিষয় হিসেবে যেমন এসেছে প্রেম, প্রত্যাখ্যান, বিরহ, দ্রোহ, কাম, তেমনি রয়েছে যাপিত জীবন, আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-হাহাকার, সমাজ, অসংগতি আর বৈষম্যের আখ্যান। আছে মধ্যবিত্তের টানাপড়েন আর পরিণত বয়সের দ্বার পেরিয়ে জীবনবোধের উন্মেষ। কবিতায় নারী যেমন নিপীড়িত রূপে এসেছে, তেমনি নারীর সংগ্রামী ও সংহারী রূপও আছে কবিতার পঙ্ক্তিতে। নারীর প্রতি শুভকামনায় কবি বলেন –

আমার অনুমানের প্রাচীর অতিক্রম করুক

একঘেয়ে জৈবিক সন্তরণ ও সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকুক সে।

                                          (‘অন্তিমে শবাধার’)

কবিতায় জোয়াল কাঁধে নেওয়া পুরুষের পর নিপীড়িক পুরুষের দেখা মেলা বিরল নয়। অর্থাৎ নারীর মতো পুরুষও এসেছে কবিতায় বারবার, কখনো সংসারের ঘানি টানা, কখনো প্রেমিকরূপে, কখনো বা পলাতক মন নিয়ে। স্বপ্নের দায় নিয়ে মানুষ যেন চিরকালের সিসিফাস। কবির কবিতায় তাই ভেসে ওঠে আক্রান্ত মানুষের ছবি –

স্বপ্ন – আক্রান্ত পুরুষ আমি

স্বপ্ন আমার পিতামহকে দেউলে করেছিল

আমার পিতাকে তাড়িয়েছে বুনো মোষের উন্মত্ততায়

মাকে দিয়েছে বায়ুবিদীর্ণ প্রসব যন্ত্রণা

এখন, অজগরের মতো স্বপ্ন আমার শরীর গিলেছে

আমার রক্তে ঢেলেছে পুরুষাণুক্রমিক বিষক্রিয়া।

                                              (‘স্বপ্ন’)

এভাবে কবিতা থেকে কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন আমাদের পারিপার্শ্বিক জগৎ। কবি দরিয়াপাড়ের মানুষ বলে এসেছে নদীর গল্প, জলজীবনের গল্প, এসেছে নদীভাঙনের বেদনা। সব কবিতা পড়া হয়ে গেলে পাঠক অমøানবদনে স্বীকার করে নেবেন, এসব কবিতার সমাহার একটি নিবিড় সৃষ্টি।

কবির স্বাতন্ত্র্য দেখতে পাই উপমা ব্যবহারেও – যেখানে দাড়িয়াবান্ধা খেলে যায় ব্যাঙাচির ঝাঁক, যেখানে বুকবতী মেঘভরা বর্ষায় হয়ে ওঠে দুগ্ধবতী অথবা ভেবে নিতে পারি নিঃসন্তান মায়ের কোল জুড়ে আসবে কাঙ্ক্ষিত নবজাতক।

এ আগুন নিভে যাবে;

মৃতবৎসা মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠবে সবুজের চর,

পোয়াতি মেঘের বুক একদিন দুগ্ধবতী হবে।

বায়ু, তুমি কার বাড়ি যাবে?

মেঘ কি সাজিয়ে দেবে পুনরায় সতীনের ঘর!

                 (‘জলে পোড়ে জলের পরান’)

‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’র ধারণাটি এত বেশি চর্বিত এবং অপব্যবহৃত হয়েছে যে, এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে যাওয়া বেশ জটিল, অথচ কবি কত অনায়াসে বলেছেন –

এসো মিলি, মিলে যাই

প্যাগোডা ও মসজিদের মধ্য দরজায়

ধর্ম-কর্মের সীসা গলে যাক প্রাণের আগুনে

এসো, ঋতুর জরায়ুতে ভ্রূণ হই প্রথম ফাগুনে।

                                  (‘এসো মিলি’)

সামাজিক দায় ও আমাদের ব্যর্থতার মাঝে ক্ষীণ পর্দা উন্মোচিত হয় ‘সম্ভ্রান্ত ভয়’ কবিতায় –

আমি ভদ্রলোক। কাছে যেতে পারি না, হাত ধরে বলতে পারি না –

‘এসো মেয়ে, তোমাকে ঘরে পৌঁছে দিই।’

সুখতলা ফুঁড়ে পেরেকের মাথা গোড়ালিতে হানা দেয়

কান্না নয়, বিভীষিকা নয়

যদি দায় চাপে, সম্ভ্রান্ত ভয়।

কবিতা সব সময় প্রথম পাঠেই ধরা দেয় না। তবু কিছু কবিতা যা ভালো লেগেছে তার উল্লেখ করতে হলে লিখতে হবে  ‘তোমাকে প্রার্থনার মতো ডাকি’, ‘বর্ষাবন্দনা’, ‘আনন্দময়ী’, ‘দহন’, ‘আমি তার ধ্যানেই আছি’, ‘এখনও যুবক আছি’, ‘সে’, ‘দিনের জোনাকি’, ‘পাঠক’, ‘পিননের ঘোর’ প্রভৃতির কথা।

বইটি প্রকাশ করেছে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন। বইটি, অনায়াসে বলা যায়, পাঠকের ভালোবাসার দাবিদার। সেই দাবি যেন পূরণ হয়। কবি, পাঠক, প্রকাশক সবার জন্য শুভকামনা।