ভদ্দা কুণ্ডলকেশা

নগরবাসী এমন নির্দয় দৃশ্য কখনো দেখনি।

চৈত্রের আকাশ খুব যেন রাগ করে আছে। সূর্যের তীব্র আলো, উদ্ধত উত্তাপ। পুড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ। নিদাঘের এমন দুপুরে মগধের রাজধানী রাজগৃহের রাজপথের দৃশ্য : পিছমোড়া বাঁধা এক যুবক, চোখে কালো ফেট্টি। চাবুকপেটা করে, টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে রাজার কয়েকজন সান্ত্রী।

আধো কৌতূহল, আধো ভীতি। নিরাপদ দূরত্বে থাকা কিছু লোকের চাপা কণ্ঠ, যুবকটিকে দেখে তো সদ্বংশীয়ই মনে হচ্ছে! গৌরবর্ণ শরীরের স্থানে স্থানে রক্তচিহ্ন। এখন আর হাঁটতে পারছে না। একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। সান্ত্রীরা দ্বিগুণ নিষ্ঠুরতায় যুবককে পেটাচ্ছে, বলছে – ‘ওঠ ব্যাটা তস্কর, খামোখা আমাদের খাটাচ্ছিস। আর তো সামান্য পথ। আজই তোর ভবলীলা সাঙ্গ হবে…’

রাজগৃহের ধনী বণিকের সুন্দরী কন্যা সুভদ্রা তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির ছাদে পায়চারি করছে। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যার সৌন্দর্য অনেকের প্রিয়। সুভদ্রার ভালো লাগে দুপুরের স্তব্ধতামুখর এই সময়টা। ছাদে একা ঘোরে। রোদ লেপ্টে থাকা আকাশ তখন অন্য আকাশ। অবাক এর রূপসমষ্টি। মানুষের চলাচল তেমন থাকে না। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে দৃষ্টিতৃপ্তির আলো। কিন্তু আজ অন্যরকম দৃশ্য। অদূরে একটা জটলা। এর কোলাহল ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে। কী কাণ্ড! যুবকটিকে ওরা এমন মারধর করছে কেন! ইস রে! ও তো চলতেই পারছে না। কেমন একটা মায়াক্লান্তি সুভদ্রাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। যুবকটিকে ওর খুবই চেনা চেনা লাগছে।

কতগুলো দৃশ্যের সারাংশ তার মনের মুকুরে ছায়া-ছায়া, ছায়ার মধ্যে আলোরেখা হয়ে ভেসে উঠছে। পিতার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে গেলে, একটি সুন্দর কিশোরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রাজপুরোহিতপুত্র সন্থুক, সে-ও তার পিতার সঙ্গে প্রাসাদে যেতো। এরা বাগানে খেলা করতো। সন্থুক ফুল কুড়িয়ে সুভদ্রার কোচড় ভরিয়ে দিত। সুভদ্রা ফুলে ফুল জুড়ে মালা রচনা করে তুলে দিত সন্থুকের হাতে।

বাগানে প্রজাপতির মেলা। দুজন ছুটতো রঙিন পাখার প্রজাপতির পিছু পিছু। ছুঁতে পারতো না। একদিন, সন্থুক কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা মরে থাকা প্রজাপতি। নানা রঙে রঙিন! পাখি যেমন হঠাৎ গান করে ওঠে, সন্থুক মরা প্রজাপতিটাকে সুভদ্রার বেনিতে বসাতে বসাতে বলেছিল, ‘আজ এটা দিলাম। একদিন একটা বেঁচে-থাকা প্রজাপতি এনে দেব।’

সুভদ্রা বাড়ির ছাদ থেকে দ্রুত নিচে নেমে এলো। ভিড় ডিঙিয়ে সান্ত্রীদের কাছে জানতে চাইল, যুবকের এই দশা কেন? খুব আমোদের ব্যাপার যেন – সান্ত্রীরা দাঁত কেলিয়ে যা বলল, সুভদ্রার ধড়ে আর প্রাণ নেই। পিতার কাছে ছুটে এলো। ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলল, যে করেই হোক সন্থুককে বাঁচাতে হবে।

সুভদ্রার পিতা খুব নরম গলায় সান্ত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন মায়ামুখের ছেলেটাকে পেটাচ্ছ কেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

‘আপনি জানেন না, রাজপুরোহিতের ছেলে হয়েও ও কত বড় তস্কর। পিতার মুখে কালি লেপে চুরিচামারি করে। বারবার ধরা পড়ে বন্দি হয়েছে। আমাদের দয়ালু রাজা পুরোহিতজির মুখর দিকে চেয়ে ওকে ক্ষমা করেছেন।’

‘আর একবার ক্ষমা করা যায় না!’

 ‘ওর জ্বালাতনে সবাই অতিষ্ঠ। মৃত্যু ছাড়া ওর আর কোনো পথ নাই।’

 এবার গলা আরো ছোট করে সুভদ্রার পিতা সান্ত্রীদের বললেন, ‘রাজদণ্ড রোধ তো রাজাই করতে পারেন। ছেলেটি আমার খুব স্নেহের। ওকে নিয়ে তোমরা আমার ঘরে আসো। মৃত্যুর আগে ওকে একটু ভালো কিছু খাওয়াতে চাই।’

সান্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বণিককে অনুসরণ করল। বণিক অনেক স্বর্ণমুদ্রা উৎকোচ দিয়ে সন্থুককে ছাড়িয়ে নিলেন। সান্ত্রীরা মহাখুশি। ওরা অন্ধকারে সন্থুকের জায়গায় অন্য কোনো নিরীহ লোকের জীবন বধ করেছিল কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।

একটা ঘোর। নিজের বেঁচে থাকাটাও সন্থুকের কছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। ডাঙায় তোলা, মৃত্যুর কাছে পড়ে থাকা মাছের ছটফটানির মতো একটা শ্বাসকষ্ট ওকে জাপটে আছে। বধ্যভূমির ঘুটঘুটে অন্ধকারেও সন্থুক স্পষ্ট দেখছে, ওর কাটা মুণ্ডুটা শরীরের কাছেই পড়ে আছে। জোড়া লাগতে চাইছে, হচ্ছে না। হাত দুটো এগিয়ে এসেছে। ছুঁয়ে দেখছে, কপালে অনেকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সান্ত্রীদের মারের চোটে শুরু হওয়া যন্ত্রণাগুলো এখনো আছে। বরফের হঠাৎ ঠান্ডার মতো কপালে কীসের যেন স্পর্শ নেমে এলো। চেপে থাকা ঘোরটা একটু কি কেটেছে! অন্ধকারেরও একধরনের আলো থাকে। তেমনি এক চিকন আলোয় সন্থুক দেখতে পেল একটি নারীছায়া তার কাছে বসা। সুভদ্রাকে সে চিনতে পেরেছে। অনেকটা আর্তকণ্ঠে বলল, ‘সুভদ্রা, তোমার পিতার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রাণ বাঁচালেন।’

‘পিতা আমার দাবি রক্ষা করেছেন।’

‘তোমার কাছেও কৃতজ্ঞ।’

‘কৃতজ্ঞ হওয়ার কিছু নেই। নিজের স্বার্থেই তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি।’

‘কী তোমার স্বার্থ?’

‘তোমাক পেয়ে আমি সুখী হতে চাই। এবার তোমার মতটা বলো।’

 ‘কী বলছ? তোমরা বিত্তবান, আর আমি …’

 সন্থুককে কথার মাঝপথে থামিয়ে সুভদ্রা একটু খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তুমি একটা তস্কর, মানে চোর। চোর তো বটেই, বড় ধরনের চোর।’

সন্থুকের মুখে কথা নেই। পুকুরের জলের ওপর নুয়ে-থাকা গাছের শাখার মতো ওর মুখ। হাসির আবহ ছড়িয়ে সুভদ্রা বলল, ‘বড় চুরিটা তো করেই ফেলেছ, এবার এসব ছাড়ো।’

হাসতে হাসতে সন্থুকের বুকে ভেঙে পড়ে সুভদ্রা বলল, ‘কিছুই বোঝ না। মনচোরের শাস্তি আজীবন বিবাহদণ্ড।’

টানা ঘোর হালকা হওয়ার পর, সন্থুক ওর কপালে যে বরফস্পর্শ অনুভব করেছিল, এখন মনে হচ্ছে ক্রমেই ওটা রূপ বদলাচ্ছে। বরফে কি ওম থাকে! দুটি ঘন নিশ্বাস বারবার মুখোমুখি হচ্ছে। ঠোঁট এবং ঠোঁট ডুবে যাচ্ছে কবোষ্ণ চুমোয়।

দুই

সন্থুক আর সুভদ্রার সুখের কোনো প্রান্তসীমা নেই। কোনো এক রতিস্নিগ্ধ রাতে, ওরা এলোমেলো বিছানায় শুয়ে-বসে গল্প করছে। ‘আচ্ছা ভদ্রা, তোমার কি মনে আছে, একদিন, রাজবাড়ির বাগানে আমি তোমাকে একটা মুক্তাবিন্দু দিয়েছিলাম। তুমি তো অবাক, ‘বললে, এটা কেন দিলে?’ আমি বললাম, ‘তোমার জন্মদিবসের উপহার।’ তোমার চোখ হেসে উঠল, বললে, ‘আজ তো তোমারও জন্মদিবস।’ তুমি কোচড় থেকে বের করে কিছু গুঞ্জাফল আমাকে দিলে। জানো সেই গুঞ্জাফল এখনো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তোমার পিতার কাছে জানতে পেরেছি, শুধু একই দিনে নয়, আমাদের দুজনের জন্ম একই বছরে।’

‘খুব মজা তো’, বলতে বলেতে সুভদ্রা হেসে গড়িয়ে পড়ল। ধপ করে নিভে যাওয়া আলোর মতো সুভদ্রা হঠাৎ কেমন গম্ভীর। সন্থুক কিছু বলার আগেই সুভদ্রা বলল, ‘জন্মদিবসের মতো আমাদের মৃত্যুও যেন একই দিনে হয়।’

সন্থুক আঁতকে উঠে বলল, ‘এসব কী বলছ! আমি চাই তুমি অনেকদিন বাঁচো।’

সুভদ্রা বলল, ‘দুজনই অনেকদিন বাঁচি, সেটা তো আমি চাই। কিন্তু আমার আগে তুমি চলে গেলে, এ-বিরহ আমি সইতে পারব না।’

‘তোমার মৃত্যু আগে হলে আমি আর বেঁচে থাকব কেন!’

 সুভদ্রা আর সন্থুক চেয়ে আছে একে অন্যের মুখের দিকে। দুজনের চোখে চিকচিক করছে অশ্রুরেখা। একই সময়, একই উচ্চারণে ওরা বলল, ‘তুমি আমাকে এতো ভালোবাস?’

 সন্থুক কথাটা পাড়ল, কোথাও বেড়াতে গেলে ভালো হয়। শত সুখের হোক, প্রতিদিনের একই অভ্যাসে ক্লান্তি এসে গেছে। নতুনত্ব চাই। সুভদ্রাও একপায়ে দাঁড়ানো। কত দূর, কোথায় – এসব নির্ধারণের ভার সন্থুকের ওপর।

সুভদ্রার শরীরে ঘন হয়ে বসে সন্থুক বলল, ‘সেদিন, রাজার সৈন্যরা আমাকে যখন বিন্ধ্যপর্বতের পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখি একটা মন্দির! আমার মনটা খুব গলে গেল। প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই, সব খারাপ কাজ ছেড়ে এই মন্দিরে এসে পূজা দেব। প্রাণে তো বেঁচে গেলাম, তোমার প্রেমের ছায়াতলে সুখে জীবন কাটাচ্ছি। এখন শুধু সেই মন্দিরে পূজা দেওয়াটা বাকি। অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে আমাদের অমঙ্গল হবে। চলো আমরা সেই মন্দিরে পূজা দিতে যাই।’ ‘খুবই উত্তম প্রস্তাব। তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। কাল সকালেই আমরা যাবো। আর খুব দূরের যাত্রাও তো নয়।’

সন্থুক যথেষ্ট উৎফুল্ল হয়ে সুভদ্রাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে চুমুয় চুমুয় বিভোর করে তুলল।

‘দুটো কথা আছে।’

‘আর কী কথা?’

‘বিয়ের পর প্রথম আমরা প্রাসাদের বাইরে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে প্রহরী, সেবক-সেবিকা না নেওয়াই উত্তম। পূজাটা তো আছেই, আর এটা আমাদের প্রথম অভিসারও।’

‘বুঝলাম, আমাকে একান্তে পেতে চাচ্ছ।’

‘তোমার বুদ্ধির তুলনা নেই। আমার ইঙ্গিতকথা ঠিক বুঝতে পেরেছ।’

‘আর একটা কী কথা?’

‘তুমি তো জানোই, এয়ো স্ত্রীলোক যখন স্বামীর কল্যাণে পূজা দেয় – পট্টবস্ত্র, অলংকারে সাজতে হয়।’

‘শোনো, এতো শাস্ত্র শিখিয়ো না। আমি শাস্ত্র কিছু জানি। আর পিতা তো আমাকে কম অলংকার দেননি। তুমি যা চাইছ, তা-ই হবে।’

পরদিন সাজানো রথে, বহু মূল্যবান অলংকার, বসনে সেজে সুভদ্রা স্বামী সন্থুকের সঙ্গে বিন্ধ্যপর্বতের মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলো। ওরা যখন পৌঁছাল, মাথার ওপর দুপুরের রোদ। এলাকাটা যথেষ্ট নির্জন এবং বন্ধুর। সুভদ্রা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবু স্বামীর মঙ্গলের জন্য পূজার অর্ঘ্য সাজাতে হবে। পাহড়ের পাদদেশে কাঠ জ্বেলে অর্ঘ্য প্রস্তুত করে থালায় সাজিয়ে, পাহাড়চূড়ার মন্দিরে গেল। কিন্তু কোনো দেব-বিগ্রহ সেখানে নেই।

ক্লান্ত, বিরক্ত সুভদ্রা জানতে চাইল, ‘কোথায় তোমার সেই দেবতা?’

‘সেদিন তো আমি বন্দি ছিলাম। রাজার সৈন্যরা এই মন্দিরে দেবতা থাকার কথা বলেছিল। আচ্ছা, এসেছি যখন, পূজা তো দিতে হবে। এক কাজ করো, কুলদেবতা বিষ্ণুর নামে এই উপাচারগুলো সাজাও। এর আগে তোমার সব অলংকার খুলে আমার হাতে দাও।’

প্রথটায় ঠিক বুঝতে পারেনি, ভেবেছে তস্করের ভয়ে হয়তো সন্থুক অলংকার খুলে তার হাতে দিতে বলেছে। সন্থুককে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি না বলেছ, স্বামীর কল্যাণে পূজা দিতে এলে অলংকার পরতে হয়!’

‘এতো তর্ক করছ কেন! যা বলছি তা-ই করো। অলংকারগুলি আমার হাতে দাও।’

সন্থুকের চোখে-মুখে লোভের উৎকট প্রতিচ্ছবি।

‘তুমি কি আমার চেয়ে অলংকার বেশি ভালোবসো?’

‘যাক, বুঝতে পেরেছ। দেরি করছ কেন? অলংকারগুলো দিয়ে আমাকে মুক্তি দাও। আমি আর তোমাদের ঘরে ফিরে যাব না।’

সন্থুক অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। একদিন, ওর যে-চোখে সুভদ্রা প্রেমের সরোবর খুঁজে পেয়েছিল, সেখান থেকে ঝলকে উঠছে আগ্নেয়গিরির লাভা।

‘অলংকার দেওয়ার পর তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?’ সুভদ্রার কণ্ঠে ভয়ের আর্তি।

‘সেটাই করতাম। কিন্তু একদিন তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, আজ আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম। পাহাড়ের নিচে তোমার রথ রয়েছে। ঘরে ফিরে যাও।’ সন্থুকের কথায় আদেশের ঝাঁজ।

হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকে অন্ধকারের বস্তু দেখে ফেলার মতো, যা ঘটল, আসন্ন যা, বুঝতে সুভদ্রার দেরি হয়নি। মুহূর্ত মাত্র। করণীয় ঠিক করে ফেলল। সামান্য ছলনা এখন তার একমাত্র অস্ত্র। চোখে জল এনে বলল, ‘আমি সব অলংকার খুলে দিচ্ছ। তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছি। শেষ স্মৃতি হিসেবে তোমাকে আলিঙ্গনে পেতে চাই’, সুভদ্রার কণ্ঠে গভীর আকুতি।

কী যেন কী ভেবে সুভদ্রার প্রস্তাবে সন্থুক রাজি হয়ে গেল। কামরাঙা হয়ে সে সুভদ্রার দিকে এগোচ্ছে। ওদের পেছনেই গভীর খাদ। চোখে পলক পড়ার আগেই সুভদ্রা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করল।

যতই হোক, এমন মৃত্যুদৃশ্য সুভদ্রার সহ্য হয়নি, আঁচলে চোখ ঢেকেছে। কানে আসছে সন্থুকের আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

তিন

শূন্যতারও একটা ওজন আছে। সুভদ্রার অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্ত এখন শূন্যতার এক দুর্ভার ওজনে নিমজ্জিত। পায়ের পাতা রাখবে – শূন্যতা জমে আছে। ছুঁয়ে দেখবে একটি কুসুমের মুখ – কীটের কলুষ। শুনবে পাখির গান – ভেসে আসে অতল হাহাকার।

কোন মুখে ফিরে যাবে পিতা-মাতার কাছে! তাদের রূপসী-বিদুষী কন্যার বিয়ে হবে একটা তস্করের সঙ্গে! এই বিয়েতে এরা কেউ রাজি ছিলেন না। কিন্তু কন্যার জেদের কাছে তাঁদের অবস্থান টেকেনি।

পাহাড়টির পাদদেশে ছিল জৈন ধর্মাবলম্বীদের একটি সংঘ। সুভদ্রা এতে যোগ দিলো। অন্ধকারের স্রোতের মতো সুভদ্রার চুল। তালপাতার কাঁটা দিয়ে তা উৎপাদটন করা হলো, শীর্ণ বস্ত্রে ঢাকা পড়ল সুভদ্রারা যৌবনদীপ্ত শরীর। ছাইচাপা আগুন যেন – ধিকিধিকি জ্বলে। কদিন যেতেই সুভদ্রার মাথায় গজাল কুণ্ডলী পাকানো চুল। সেই থেকে তার নাম ‘কুণ্ডলকেশা’।

জৈনদের সংঘে থেকে অনেক পুথি পড়ল; কিন্তু কুণ্ডলকেশার জ্ঞানপিপাসা সামান্যও মেটেনি। সংঘ ছেড়ে হলো পথের মানুষ। নতুন উপলব্ধি – প্রকৃতির সকল অঙ্গই জ্ঞানের আধার। মানুষেই বিরাজিত সৃষ্টি আর লয়ের বিধান। পথে পথে ঘোরে আর মানুষ পাঠ করে। সঙ্গী জুটেছে ‘উপচালা’, সে-ও সংসারত্যাগী সন্ন্যাসিনী।

 কুণ্ডলকেশার বাসনা, সে জম্বু দ্বীপের সেরা তার্কিক হবে। তর্কযুদ্ধে মানুষকে পরাজিত করার এক অদ্ভুত নেশায় পড়েছে কুণ্ডলকেশা। তার জ্ঞানের কাছে হেরে যাওয়া মানুষের ম্লান মুখ দেখে সে একধরনের আনন্দ পায়। সখী উপচালা মাঝে মাঝে বলে, ‘তর্কে তুমি কী এমন পাও?’

কুণ্ডলকেশা কোনো জবাব দেয় না। হাসে। প্রব্রজ্যায় বেরিয়ে ওরা পথের নানা স্থানে জামের ডাল পুঁতে রাখে। কেউ এই ডাল মাড়ালে বা স্পর্শ করলে কুণ্ডলকেশার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে হবে। রাস্তায় পোঁতা জামের মরা ডাল দেখে অনেকের কৌতূহল জাগে বটে, উটকো ঝামেলা ভেবে সবাই দূর দিয়ে চলে যায়। এটা কুণ্ডলকেশাকে হতাশ করে।

অনেক নগর প্রব্রজ্যাশেষে দুই সন্ন্যাসিনী এসেছে শ্রাবন্তী নগরীতে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। কাঠফাটা রোদ, বাতাসে আগুনের হলকা। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি আর আবহাওয়ার পাগলামোয় কুণ্ডলকেশা দমবার পাত্র নয়। পথে জামের ডাল পুঁতে মানুষকে তর্কে জড়ানোর কাজ থেমে নেই।

সেদিন সদর রাস্তার এক স্থানে জামের ডাল পুঁতেছে। উপচালা আর কুণ্ডলকেশা পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে। একজন রাস্তায় পোঁতা জামের ডালের কাছাকাছি থাকছে। রোদে মগজ বেরিয়ে আসার উপক্রম। অন্যজন অদূরে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। তখন কুণ্ডলকেশার বিশ্রাম নেওয়ার পালা। চোখ একটু লেগে এসেছে। অনেক মানুষ একসঙ্গে যাচ্ছে। চলাচলের শব্দে কুণ্ডলকেশার তন্দ্রা কেটে গেছে। ততক্ষণে ভিড়টা দূরবর্তী হয়ে পড়েছে। দৌড়ে কাছে গেলে উপচালা বলছে, ‘দিদি গো, কী বলি! আগুনের মতো গায়ের রং, মুখটা সরল, চোখ দুটো পুকুরের মতো শান্ত!’

‘উপচালা, কার কথা বলছিস?’

‘গোটা মগধ যাকে নিয়ে আলোড়িত।’

‘হেঁয়ালি রাখ, ভেঙে বল তো কে তিনি।’

‘লোকের মুখে শুনলাম, তিনি শাক্যকুমার গৌতম। আমাদের জামডাল তো পদদলিত হয়ে গেছে।’

কুণ্ডলকেশা কয়েক মুহূর্ত চিন্তারুদ্ধ। পরক্ষণেই ভাবল, ‘যাক ভালোই হলো, তর্ক করার মানুষ পাওয়া গেল!’

‘তুই তাঁকে বলিসনি, এই জামডাল যে পদদলিত করবে, তাকে আমার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে হবে।’

‘তিনি তো জামের ডাল পদদলিত করেননি। তাঁরই এক শিষ্য, তিনি ধ্যানসুখে পথ চলেন, তাঁর পায়ে লেগে জামের ডালটা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।’

‘শাক্যকুমার গৌতমের শিষ্য, তা না হয় বুঝলাম, বাকি পরিচয়?’

‘তিনি হলেন ঋষি গৌতমের অগ্রশ্রাবক সারিপুত্তর।’

‘ভালোই হলো, তাকে দিয়েই তর্কের সূচনা হবে।’

চার

গৌতম শিষ্যদের সঙ্গে শাস্ত্র-আলোচনায় ব্যস্ত। অগ্রশ্রাবক মৌদগল্যায়ন তাঁকে জানাল, ‘প্রভু, দুজন ভিক্ষুণী আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’

গৌতম হাত ইশারায় অনুমতি দিলেন। কিছু সময় পর শিষ্যদের বিদায় দিয়ে সাক্ষাৎপ্রার্থী দুজকে কাছে ডাকলেন। কুণ্ডলকেশা আর উপচালা নিজেদের পরিচয় দিলো। শাক্যকুমার নিজের পরিচয় জানিয়ে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, তোমাদের অভিপ্রায় বলো।’

‘আমি এসেছি আপনার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। আচার্য রুদ্রকের কাছে যে শাস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছি তা বাজিয়ে দেখতে চাই।’

শাক্যকুমার গৌতম মেঘমুক্ত আকাশের মতো ধীরস্থির। একটু হেসে বললেন, ‘আমি কোনো যুদ্ধে বিশ্বাসী নই। তর্কের পাশে যে যুদ্ধ শব্দটি জুড়েছ, ওটা বাদ দিলে আমি তোমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি। এতে উভয় পক্ষের জ্ঞান লাভ হবে।’

‘তা-ই হবে। তবে, প্রথমে আমি আপনার শিষ্য সারিপুত্তের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই।’

‘ঠিক আছে’, বলে ঋষি গৌতম সারিপুত্তরকে কুণ্ডলকেশার সঙ্গে আলোচনায় বসতে আহ্বান জানালেন। গুরুকে প্রণাম করে সারিপুত্তর কুণ্ডলকেশার দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকাল।

‘এই ভূমণ্ডলে সবচেয়ে বড় সম্পদ কী?’

তীব্র তীরের মতো কুণ্ডলকেশার প্রথম প্রশ্ন।

মুহূর্ত না-ভেবে সারিপুত্তর উত্তর দিলো, ‘বিশ্বাস, বিশ্বাসই হলো মানবের বড় সম্পদ।’

‘এই সম্পদ যদি কেউ চুরি করতে আসে?’

‘চোরকে তো চুরির সুযোগ দেওয়া যাবে না। প্রতিরোধ করতে হবে।’

সারিপুত্তের কাছ থেকে এমন জবাব শুনে কুণ্ডলকেশা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকল। অনুভব করল, তার মনে জ্ঞানের যে অহমিকা তৈরি হয়েছিল, যোগ্য আগুনের আঁচে, মোমের মতো তা গলতে শুরু করেছে। এরপর কুণ্ডলকেশা আরো কটি প্রশ্ন করল।

সারিপুত্তর উত্তর দিতে কালক্ষেপণ করেনি।

‘আমি তো অনেক প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি, এবার আপনি প্রশ্ন করতে পারেন’, সারিপুত্তের চোখে থেমে আছে কুণ্ডলকেশার চোখ।

‘আপনার কাছে আমার একটিই জিজ্ঞাসা, আচ্ছা বলুন তো এক কী?’

‘এক!’

সারিপুত্তের ছোট একটি প্রশ্নে কুণ্ডলকেশা বড় ধাক্কা খেল। মুখে কোনো কথা নেই। ভাবতে থাকল, সারিপুত্তর প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী। সাধারণ বিবেচনায় ‘এক’ হচ্ছে হিসেবের প্রথম সংখ্যা। এমন জবাব তো দেওয়াই যায়। সারিপুত্তের সহজ প্রশ্নের মধ্যে নিশ্চয় গূঢ় কোনো বিষয় আছে! কুণ্ডলকেশা ভেবে কোনো কূল পাচ্ছে না। তাহলে কি তার অধীত সব বিদ্যা অসার হয়ে গেল!

ভাবনার রেখাগুলো যেন জটের কুণ্ডলি। কোথাও আলোচিহ্ন নেই। ঝরাপাতার বুকে যে মর্মরধ্বনি, একটু বাতাস পেলে তা হয়ে ওঠে সুবর্ণ সংগীত। আগুনের ছোট্ট ছোঁয়ায় হেসে ওঠে আবশ্যক আলো। কুণ্ডলকেশার জীবন কি ঝরাপাতার থেকেও তুচ্ছ! সুর নেই, আলো নেই! মনের অজান্তেই সে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘সারিপুত্তরের প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, জা-নি-না … আমার অধীত বিদ্যা মিথ্যা, সব মিথ্যা। হে প্রভু, আমাকে মার্গ দেখান।’

দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কান্নায় ভেঙে পড়ে কুণ্ডলকেশা।

‘মা, শান্ত হও। তোমার কোনো কিছুই মিথ্যে নয়। একটি প্রশ্নের উত্তর না জানলেই সব বিদ্যা মিথ্যা হয়ে যায় না। সব জ্ঞান এক জীবনে আহরণ করা সম্ভব নয়। আর সবাই সবকিছু জানবে, এমন তো কথা নেই।’

একটু থেমে গৌতম বললেন, ‘সারিপুত্তর যে প্রশ্ন করেছে, এর উত্তর কঠিন কিছু নয়। পৃথিবীর সকল জীব একের অধীন। অর্থাৎ জীবের জীবনধারণ আহারের ওপর নির্ভরশীল।’

‘আমাকে আপনার শিষ্যত্বে গ্রহণ করুন। আপনার কৃপা চাই প্রভু।’

‘শোনো মা, ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী মার্গ বড় কঠিন। এ-মার্গ নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, উপশম, অভিজ্ঞা, সম্যকবোধ, শ্রমণত্ব বা নির্বাণত্ব লাভের মার্গ। তুমি কি এই কঠিন পথে ব্রতী থাকতে পারবে?’

কুণ্ডলকেশার বিনীত কণ্ঠ, ‘প্রভু, আমি তো কঠোর অনুশাসন, অনুশীলনের ভেতর দিয়েই চলেছি। পার্থিব সবকিছু পরিত্যাগ করেছি। মানবের কল্যাণে যুক্ত করেছি আমার এ-তুচ্ছ জীবন।’

‘গূঢ়-অর্থে জগতের সবই তুচ্ছ। ধ্যানে জ্ঞানে পুণ্যে ত্যাগে সকল অস্তিত্ব ও অবস্থান আলোকিত হয়।’

‘প্রভু, আলোকের যাত্রাপথে আমাকে স্থাপন করুন।’

বুদ্ধের চোখে সম্মতির আভা।

পাঁচ

কোনো প্রতিযোগিতায় জেতার মধ্যে নিশ্চয়ই আনন্দ আছে। সত্যের সৌন্দর্যের কাছে হেরে যাওয়াটাও নিরর্থক কিছু নয়। সারিপুত্তরের সঙ্গে আলোচনায় হেরে কুণ্ডলকেশা আনন্দের নতুন একটি দর্শনের সন্ধান পেয়েছে।

জ্ঞান হচ্ছে সমুদ্র। এতে ডুবে থাকা, ভেসে যাওয়া – একই অর্থ প্রকাশ করে। হার-জিতে নয়, অন্বেষণেই জ্ঞানের অর্জন।

কুণ্ডলকেশা মুগ্ধকর অপেক্ষায় নিমজ্জিত। কোনো এক পুণ্যপ্রাতে, সারিপুত্তের সঙ্গে তার আলোচনা হবে। বিষয় ‘দুই’ কী? সারিপুত্তর হয়তো অবগত আছে – দুই কাকে বলে। আকাশের হাসি ফুটে থাকা জলের মতো কুণ্ডলকেশা স্বচ্ছ করে জানে, ‘দুই’ হচ্ছে সৃজনের অমূল্য আধার।

কুণ্ডলকেশা প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করে, ‘হে অপেক্ষা, তুমি থাকো। সন্ধ্যায়, কুলায় ফেরা পাখিদের মতো, একদিন সারিপুত্তর এসে, প্রাণের প্রাচুর্য ঢেলে ব্রতপুণ্য আলো জ্বেলে দেবে।’