ভরা থাক স্মৃতিসুধায় : ইব্রাহিম আলকাজি

ইব্রাহিম আলকাজি আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের স্থপতি। ভারতীয় থিয়েটারের প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি পুরুষ, থিয়েটার প্রতিষ্ঠানের প্রধান পুরুষ – শিক্ষক, নির্দেশক, ডিজাইনার।

‘দিনের পরে দিন যে চলে যায়’ – সময় যে কারো জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকে না। পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এমন কিছু মানুষ আসেন, যাঁরা শুধু মানুষকে দিয়েই যান। তাই তো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা বলতে পারি, ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও।’ সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষকে, বিশেষ করে নাটকের জন্য, তাঁর কীর্তি অনন্য, অসামান্য, অভাবনীয়। নয়ন ছেড়ে গেল চলে – সেই মানুষটি হলেন ইব্রাহিম আলকাজি। তিনি হলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের স্থপতি। ভারতীয় থিয়েটারের প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি পুরুষ, থিয়েটার প্রতিষ্ঠানের প্রধান পুরুষ। শিক্ষক, নির্দেশক, ডিজাইনার, ইব্রাহিম আলকাজি ২০২০ সালের ৪ঠা আগস্ট ৯৫ বছর বয়সে লোকান্তরিত হন। তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, গুণগ্রাহী, সংবাদপত্রের সাংবাদিক, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা ও নির্দেশক সবাই তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লিখেছেন। তাঁদের কথা শুনলেই এই অতিকায় মানুষটি সম্পর্কে ধারণা করে নেওয়া যায়।

চলচ্চিত্রাভিনেতা ও ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার স্নাতক নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী বললেন, ‘আলকাজি ছিলেন থিয়েটারের একজন অতিকায় মানবমূর্তি। তিনি ছিলেন একজন জাদুকর, যিনি মঞ্চের অনেক বড় বড় প্রতিভাকে লালনপালন করেছেন, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার প্রাক্তন পরিচালক এবং নাট্যব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম আলকাজির সংস্পর্শে এসে আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের এমন এক ব্যক্তিও নেই যাঁরা উপকৃত হননি, প্রভাবান্বিত হননি। আলকাজি সুদীর্ঘকাল এনএসডির পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সব নামকরা ছাত্রের মধ্যে রয়েছেন মনোহর সিং, সুরেখা সিক্রি, ওম শিবপুরী, ওম পুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, বিজয় মেহতা, বি ভি করনথ্, রোহিনী হাত্তাঙ্গাডি, উত্তরা বাওকর প্রমুখ। এঁরা মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তিনি থিয়েটারের একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ভাষা তৈরি করেছেন নতুন করে।’

নামী অভিনেত্রী সুষমা শেঠ উল্লেখ করেছেন, ‘ইব্রাহিম আলকাজি হলেন অবিসংবাদিত, অবিতর্কিত, আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের প্রবক্তা, যিনি এই থিয়েটারের নন্দনতাত্ত্বিক বিবর্তন, ব্যাপ্তি ও উন্নয়ন করে এর বৃদ্ধি ঘটান ও প্রতিষ্ঠা দেন।’

১৯২৫ সালের ১৮ই অক্টোবর মহারাষ্ট্রের পুনেতে আলকাজির জন্ম। বাবা ছিলেন সৌদি আরবের একজন ব্যবসায়ী। মা ছিলেন কুয়েতি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আলকাজির পরিবারের অন্য সদস্যরা পাকিস্তানে চলে যান; কিন্তু তিনি ভারতেই রয়ে যান। আলকাজি প্রথমে পুনের সেইন্ট ভিনসেন্ট হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে তিনি আরবি, ইংরেজি, মারাঠি ও গুজরাতি ভাষা শেখেন। সেখান থেকে তিনি মুম্বাইয়ের সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে সেইন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র থাকা অবস্থায় সুলতান ‘ববি’ পদমসির ইংরেজি থিয়েটার কোম্পানি ‘থিয়েটার গ্রুপে’ যোগ দেন। তাঁর পরিবারে শিক্ষা-দীক্ষা, পড়াশোনা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বিরাজিত ছিল সবসময়। আলকাজি পরে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আলেক পদমসির (বড়ভাই স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবরোর গান্ধী চলচ্চিত্রে ‘জিন্নাহ’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন) সুলতান ‘ববি’ পদমসির সঙ্গে পরিচয়, সাক্ষাৎ এবং কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াটা তাঁর থিয়েটারের নতুন দিগ্দর্শন উন্মোচনে সহায়তা করেছিল। এখানে সারাক্ষণ অভিনেতাদের সঙ্গে নানান বিষয়ে আলোচনা, কথাবার্তা এবং ভাবের আদান-প্রদান চলত, নতুন নতুন বিষয় নিয়ে বিনিময় হতো।

১৯৪৮ সালে আলকাজি ইংল্যান্ডে যান রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টসে (রাডা – RADA) পড়তে। থিয়েটার তিনি এতোটাই ভালোবেসেছিলেন ওই বয়সে যে, কর্মজীবন হিসেবে থিয়েটারকেই বেছে নিলেন পড়াশোনা করার জন্য। লন্ডনে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টস থেকে প্রশিক্ষিত হন, কাজের ও প্রতিভার স্বীকৃতি পান। ‘রাডা’ থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর পেশা পরিবর্তন করার সুযোগ পান। ইংলিশ ড্রামা লিগ এবং ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে (বিবিসি – BBC) কাজ করার সুযোগ পান; কিন্তু সে-সুযোগ গ্রহণ না করে ঘরে ফিরে আসার ডাক পান। মুম্বাই ফিরে আসেন নতুন ধরনের থিয়েটার করার তীব্র তাগাদা নিয়ে। এরপর মুম্বাইয়ে তাঁর পুরনো ‘থিয়েটার গ্রুপে’ যোগ দেন এবং ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। তাঁর কন্যা এবং গুণী থিয়েটার ব্যক্তিত্ব অমল আল্লানা বলেন, ‘তিনি ভবিষ্যতের থিয়েটারের স্বপ্ন দেখতেন।’ ২০১৫ সালে মিন্ট লাউঞ্জের এলিজাবেথ কুরুভিলাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আলকাজি নতুন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ভুলাভাই দেশাই মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটে, যেখানে এম. এফ. হুসেন (মকবুল ফিদা হুসেন), তায়েব মেহতা এবং আকবর পদমসির মতো শিল্পীরা যুক্ত ছিলেন। তাঁদের স্টুডিও ছিল যার যার মতো। এঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘প্রগেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’। এটাই ছিল তাঁর কর্মজীবনের শুরু। ফিদা হুসেন, এফ. এন. সুজা, এস. এইচ. রেজা, তায়েব মেহতা ও আকবর পদমসি – এঁরা পরে তাঁর নাটকের সেট ডিজাইন করেছেন এবং ছবিও এঁকেছেন। নাট্য-নির্দেশনার পাশাপাশি এছাড়াও ১৯৫৩-তে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নাটকের খবরাখবর ও নাটকের বিষয় নিয়ে মাসিক Theatre Unit Bulletin পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পরে তিনি School of Dramatic Arts প্রতিষ্ঠা করেন এবং বোম্বে নাট্য অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ পদে বৃত হন।’

আলকাজি থিয়েটারকে নতুন করে শক্তিশালী করার জন্য যখন পথ খুঁজছিলেন সে-সময় দিল্লিতে আমন্ত্রণ পান এনএসডির পরিচালক পদে যোগ দেওয়ার জন্য। তখন দিল্লি ছিল সাংস্কৃতিক মরুভূমির মতো। যেখানে ছিল না রস, ছিল না জল। সেখানেই শুরু করেন তাঁর কাজ। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে তিনি যোগদান করেন ১৯৬২ সালে। আলকাজি পরিচালক থাকার সময়ে যদিও তাঁর কাজের পটভূমি ছিল ইংরেজি থিয়েটার – এ-সময় থেকেই হিন্দি থিয়েটারে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তাঁর আধুনিক থিয়েটারের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তিগত শৃঙ্খলা আনার মধ্য দিয়ে। তখন তিনি নামকরা চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অভিনেতা এবং পরিচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজয় মেহতা, ওম শিবপুরী, হরপাল তিওয়ানা, নিনা তিওয়ানা, ওম পুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, বলরাজ পণ্ডিত, মনোহর সিং, উত্তরা বাওকার, সুরেখা সিক্রি, জ্যোতি সুভাষ, সুহাস যোশি, বি. জয়শ্রী, জয়দেব ও রোহিনী হাত্তাঙ্গাডি প্রমুখ। ১৯৬৪ সালে তিনি এনএসডির রেপার্টরি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভাবনা তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল যে, একদল প্রশিক্ষিত সু-অভিনেতাকে দিয়ে বৈচিত্র্যধর্মী নাট্য-প্রযোজনা দর্শকদের উপহার দেওয়া যাবে, যার মধ্যে ভাবনার খোরাক থাকবে। যতদিন তিনি স্কুলের চাকরিতে ছিলেন, রেপার্টরির প্রযোজনাগুলোর নির্দেশনা তিনিই দিয়েছেন।

তিনি শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন – এ-প্রসঙ্গে এনএসডি স্কুলের প্রাক্তন পরিচালক অনুরাধা কাপুর বলেন, ‘আমার তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু আমার অনেক নাট্যবন্ধু তাঁর ছাত্র ছিলেন। তাঁদের সবার কাছেই শুনতাম, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ নাট্যশিক্ষক, তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল আকর্ষণীয়, চমকপূর্ণ এবং জাদুকরি।’

প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক নীলম মান সিং চৌধুরী, যিনি ১৯৭৩-৭৫ পর্যন্ত তাঁর ছাত্র ছিলেন, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে Margপত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ‘Personal Reflections on Ibrahim Alkazi and B.V. Karanth’-এ লেখেন, ‘তাঁর কাছে কোনো কাজই কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি তাঁর ছাত্রদের ভালো কাজে, প্রয়োজনীয় কাজে উদ্বুদ্ধ করতেন। যেমন, নিজে নিজে চা বানানো, মঞ্চ ধোয়া, মোছা ও ঝাড়ু দেওয়ার কাজ, পোশাক নিজে ইস্ত্রি করা, গ্রিনরুম সাজিয়ে ঠিক রাখা, টয়লেট-বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখা দলগতভাবে, নিজের প্রশিক্ষণ, সবকিছুই একটি চরিত্র সৃজনের মতো।’

তাঁর আরেকজন নামকরা ছাত্র নাসিরুদ্দিন শাহ। তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, ‘আলকাজি ছিলেন এমন একজন শিক্ষক যিনি তাঁর ছাত্রদের সবসময় অনুপ্রেরণা দিতেন। একদিন তাঁকে তিনি প্রশংসা করেছিলেন। নিজেকে বোকার মতো অনুভব করে সেটা বুঝতে দেননি যে, কেন তিনি এই কাজটা করেছেন। তখন আমি তাঁর ছত্রছায়ায় তৈরি হচ্ছি, আর তিনি আমাকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন, শাস্ত্রীয় সংগীতের এবং ভারতীয় থিয়েটারের নানান আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, চলচ্চিত্রের নানান দিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন, তিনি আমাদের বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করেছেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে নিয়ম করে দিয়েছেন, যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচয় ও কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছেন।’

আলকাজি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন সুলতান ‘ববি’ পদমসির বোন রোশনের সঙ্গে (মৃত্যু ২০০৭)। তিনিও ছিলেন একজন অত্যন্ত গুণী মহিলা। আলকাজির প্রতিটি নাটকেরই কস্টিউম ডিজাইন তিনি করেছেন। ভারতীয় পোশাকের ইতিহাস বিষয়েও তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি দিল্লির ত্রিবেণী কলা সঙ্গমে ১৯৭৭ সালে Art Heritage Gallery প্রতিষ্ঠা করেন। ইব্রাহিম আলকাজি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার চাকরি ছাড়ার পর ১৯৭৭ সাল থেকেই দুজনে মিলে এই গ্যালারি পরিচালনা করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান। অমল আল্লানা (কন্যা) – একজন প্রখ্যাত

নাট্য-নির্দেশক, ডিজাইনার ও ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার প্রাক্তন চেয়ারম্যান। আরেক সন্তান ফয়সাল আলকাজি (পুত্র) – দিল্লির একজন নামকরা নাট্য-নির্দেশক।

১৯৫৪ সালে মুম্বাইতে ‘থিয়েটার ইউনিট’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতীয় থিয়েটারকে পেশাদারি পর্যায়ে উন্নীত করা এবং মঞ্চের মঞ্চসজ্জা, মঞ্চ ব্যবস্থাপনা, অভিনয়ের নতুন দিকনির্দেশনা, আলো এবং সামগ্রীর নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন আলকাজি। তিনি ভারতের প্রধান থিয়েটার ইনস্টিটিউটকে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টের মতো করে সাজাতে শুরু করেন। তিনি কাটিং-এজ প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষাক্রমে নতুনত্ব ও গভীরতা, প্রযুক্তিগত শৃঙ্খলা এবং আন্তর্জাতিক মানে ভারতীয় থিয়েটারকে জাগরিত ও উন্নীত করার কাজে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন।

আলকাজি প্রোসেনিয়াম ও উন্মুক্ত স্থান মিলিয়ে প্রায় ৫০টির মতো নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে তিনি মুম্বাইতে স্যামুয়েল বেকেটের Waiting for Godot-এর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। মকবুল ফিদা হুসেনকে আলকাজি এ-নাটকের সেট ডিজাইন করতে দিয়ে প্রথম তাঁকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসেন।

আলকাজি লন্ডনে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টসে থাকার সময়ে ব্রিটিশ ড্রামা লিগের পুরস্কার পান তাঁর অসাধারণ মেধার জন্য এবং সম্প্রচার কাজের জন্য বিবিসির (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) পুরস্কার পান।  তিনি থিয়েটারের শৈল্পিক গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা এবং অত্যন্ত সার্থকভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক অভিব্যক্তির ধারার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটি নতুন ধারা সৃষ্টির প্রয়াসে সার্থক হন। এ-কারণেই তিনি সব থেকে সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে প্রথম Roopwedh প্রতিষ্ঠানের তানভীর অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ১৯৬৬ সালে ‘পদশ্রী’, ১৯৯১ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ভারতের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মবিভূষণে’ ভূষিত হন ২০১০ সালে। থিয়েটারের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কালিদাস সম্মাননা’ পুরস্কারও পান তিনি। ভারতের সংগীত, নৃত্য ও নাটকের জাতীয় অ্যাকাডেমি ‘সংগীত নাটক একাডেমি’র পুরস্কার তিনি দুবার পেয়েছেন। প্রথমবার ১৯৬২ সালে নাট্য-নির্দেশনার জন্য এবং দ্বিতীয়বার সংগীত নাটক একাডেমির সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘সংগীত নাটক একাডেমি ফেলোশিপ’ পান থিয়েটারে সারাজীবনের কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ।

১৯৭৭ সালে ৫০ বছর বয়সে তিনি এনএসডি ছেড়ে স্ত্রী রোশন আলকাজির সঙ্গে চিত্রশিল্পী ও গবেষকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য Art Heritage Gallery প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তাঁরা পাঁচশোর বেশি

চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আলকাজির ছবি সংগ্রহের শখ ছিল। তাঁর সংগৃহীত ছবি নিউইয়র্কের Sepia International Gallery-তে রাখা আছে। এই ছবিগুলো ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলংকার ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের ইতিহাস সংক্রান্ত ছবি। এনএসডি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি কিন্তু থিয়েটার নিয়ে ভাবনাচিন্তা ও কাজকর্ম বন্ধ করেননি। নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা ও প্রকল্প পরিকল্পনা করতে থাকেন। ব্যাঙ্গালুরুর ‘রং সংকরা’ (RANG SANKARA) এবং Serendipity Art Festival-এর থিয়েটার বিষয়ক কিউরেটর অরুন্ধতী নাগ ইব্রাহিম আলকাজিকে

 একজন পরিপূর্ণ থিয়েটারের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আলকাজি নিজে এই কর্মযজ্ঞে দুই লাখ টাকা দান করেছিলেন। তিনি নিজে এই বিষয়ে একটি মজার বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি দুই লাখ টাকার চেকটিকে বিশ হাজার রুপি মনে করেছিলেন। সেটাও তিনি ওই সময়ে অনেক টাকা মনে করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে গিরিশ কারনার্ড বলেছেন, ‘অবশ্যই, তিনি হলেন আলকাজি। তিনি দুই লাখই দেবেন, বিশ হাজার নয়।’ বলে তিনি হেসে ওঠেন।

নবীন প্রজন্ম তাঁর ভাবনাচিন্তা ও ভাবধারায় উজ্জীবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছিল, যদিও তাদের সঙ্গে আলকাজির তেমন কোনো সংযোগ ঘটত না। কওসার-ঠাকুর-পদমসি অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁদের পিতা আলেক পদমসি বলতেন, ‘আলকাজি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ ও বিষয়কে তাঁর নান্দনিক সৌন্দর্যসহ নিপাট সাজানো-গোছানো পালিশ করা এক টোটাল থিয়েটার উপহার দিতেন।’

‘আল কাজী তাঁর থিয়েটারে শৃঙ্খলা ও গবেষণার ওপর ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছেন। সেটা বিষয় ও ভাব, ভৌগোলিক বিবরণ ও পোশাকের বিবরণের ব্যাপারে। শিল্পের ওপর তাঁর আগ্রহই তাঁকে নান্দনিক সৌন্দর্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় ধারাবাহিক শিল্পতত্ত্বের আলোচনায়। অভিনেতাদের নতুনভাবে আবিষ্কার করে কয়েক প্রজন্ম আগেই তিনি সবার নজরে এসেছিলেন। ২০২০-এ এসে তিনি আমাদের নাটকে অভিনয় উপভোগের স্বাদটাই বদলে দিয়েছেন। অভিনয়ের নতুন ধারাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের মাধ্যমে।’ (গিরিশ কারনাড)

অরুন্ধতী নাগ বলেন, ‘ইব্রাহিম আলকাজির পথ ধরে দর্শকরা থিয়েটারের এক নতুন ভাষা খুঁজে পান। আর তিনিই সেই থিয়েটারের প্রবক্তা ও পথ প্রদর্শক।’

১৯৬২-তে এনএসডিতে যোগদানের পর থেকে আলকাজি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুম্বাইতে তিনি ইংরেজি থিয়েটার করতেন; কিন্তু দিল্লিতে হিন্দিতে ছাড়া চলবে না। হিন্দিতেই থিয়েটার করতে হবে। ওই সময়ে হাবীব তানভীরের ‘নয়া থিয়েটার’ হিন্দিতে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলো তৈরি করছিল। Indian Express-এর দীপান্বিতা নাথ তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ষাটের দশকে আলকাজি হিন্দি থিয়েটারের একজন হিসেবে পরিগণিত হলেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ইডিপাস রেক্স, কিং লিয়ার (১৯৬৪) এবং মলিয়েরের দ্য মাইজার (১৯৬৫) মঞ্চস্থ করেন হিন্দিতে। থিয়েটারের ক্ষেত্রে তাঁর আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, বদ্ধ প্রোসেনিয়াম থেকে থিয়েটারকে মুক্ত করে উন্মুক্ত অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া। তিনি পুরনো সৌধ ও কেল্লাকে পটভূমি হিসেবে তৈরি করে, যেমন দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা ও পুরানা কেল্লাকে অভিনয় উপযোগী করে ধরমবীর ভারতীর অন্ধ যুগ (Andha Yug) এবং গিরিশ কারনাডের তুঘলক নির্দেশনা দেন ও প্রযোজনা করেন, যা আজ পর্যন্ত অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা নাট্য-দর্শকদের, যুগ পরম্পরায় এই নাট্য-আবিষ্কারের ধারা ইতিহাস হয়ে রইবে। অন্ধ যুগ ও আষাঢ় কা একদিন (মোহন রাকেশ) আজ পর্যন্ত ধ্রুপদী প্রযোজনা হয়ে রয়েছে। এর আগে দর্শকেরা এ-ধরনের সেট ও অভিনয়ের পরিমিতি এবং সূক্ষ্মতার প্রকাশ দেখেননি। আমি মনে করি, এই ধরনের স্থান ও দৃশ্যপট (সেট) আজ পর্যন্ত কেউ তৈরি করেনি। অন্ধ যুগ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, ঠিক চীন-ভারত যুদ্ধের পর, যখন ভারত তার যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছিল হাড়ে হাড়ে। আলকাজি এই নাটকের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের নৈতিক সংকট মহাভারতের যুদ্ধের শেষদিনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে আজকের দিনের বাস্তবতায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আলকাজি এই নাটকে জাপানি কাবুকি থিয়েটারের মূল্যবোধ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমদিকে গান্ধারীকে কাবুকি থিয়েটারের কিমোনো ও হাতাওয়ালা জ্যাকেট পরিয়েছেন পোশাক পরিকল্পনা করে। এই প্রযোজনা প্রথমদিকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল; কিন্তু আলকাজি এ-ব্যাপারে পরিষ্কার ছিলেন যে, অন্ধ যুগের মতো একটি মহাকাব্যিক প্রযোজনা, যেখানে যোদ্ধা, মহান ব্যক্তিত্ব, রাজা, মহারাজা, যুবরাজ – এদেরকে নিয়ে বাস্তবধর্মী প্রযোজনা করে লাভ নেই, ঐতিহ্যবাহী কোনো আঙ্গিকে উপস্থাপনা করাই ভালো। কেননা এটা তার আখ্যানগত আবহ থেকে অনেক দূরে ছিল।’ অনুরাধা কাপুরের মন্তব্য।

প্রিয় ছাত্রদের স্মৃতিময় অনুভূতি

Indian Express-এ প্রকাশিত NSD Alumni-এর কথন –

‘Alkazi : A Guru who was a father figure’ নিবন্ধটি লেখেন প্রখ্যাত গুণী নাট্যাভিনেত্রী ও নাট্যশিক্ষিকা ইলা অরুণ। তিনি সুগায়িকাও ছিলেন। আলকাজির নির্দেশনায় তাঁর এই শিষ্যা King Oedipus নাটকে অভিনয় করেছিলেন, যা তাঁর অভিনয়জীবনে একটি মাইলফলক হয়ে আছে, সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে আছে। আলকাজি ও তাঁর স্ত্রী রোশন আলকাজির সঙ্গে শেষদিন পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করে গেছেন ইলা। গুরুকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে তিনি যা দিয়েছেন তা আমার সারাজীবনের শিক্ষা হিসেবে রয়ে গেছে। তিনি ছিলেন আমার পিতার মতো। যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই তাঁদের কাজেকর্মে ও জীবনে পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণ আমার কাছে একটা যুগের পরিসমাপ্তি, একটা প্রতিষ্ঠানের, একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা তাঁর ছাত্র ও শিষ্যরা সবাই অনাথ হয়ে গেলাম।’

অভিনেতা ও নাট্য-নির্দেশক সতীশ কৌশিক বলেছেন, ‘আমাদের আজকে যা কিছু অর্জন, সবকিছু তাঁরই (আলকাজি) জন্যে। তাঁর অধীনে অভিনেতা হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ শুধুই প্রশিক্ষণ ছিল না, তিনি শিখিয়েছিলেন বাস্তব জীবনে কীভাবে চলতে হবে, মঞ্চে কীভাবে হাঁটতে হবে। আলকাজি তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্র-শিষ্যদের মাঝে এখনো বেঁচে আছেন, থাকবেন। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি নিজের মধ্যেই এমন এক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিলেন, যা শুধু একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি আমাদের মধ্যে অভিনয় ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতেন। সব বড় অভিনেতা – প্রয়াত মনোহর সিং, অনুপম খের, নাসির ভাই (নাসিরুদ্দিন শাহ), প্রয়াত ওম পুরী – সবাই তাঁর কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আমিও সৌভাগ্যবান যে তাঁর কাছ থেকেই থিয়েটারের শিক্ষা পেয়েছি।’

মিতা বশিষ্ঠ বলেন, ‘আমি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকে শকুন্তলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম, যেটা আলকাজি দেখেছিলেন। ১৯৮৭ সালের Silver Jubilee উৎসবের এক সপ্তাহ পরে দুই ব্যাচ এবং কেবল পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের ব্যাচকে ডিনারে আপ্যায়ন করেন তাঁর ফার্ম হাউসের পিকনিকে। অনেক কথাবার্তা, অনেক প্রশ্ন করলেন আমাদের কোর্স সম্পর্কে। খুব ভালো সময় কাটল সেদিন। তাঁর স্নেহপ্রবণ আলাপচারিতা এবং তাঁর মতো একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো আমাদের জীবনে এক বিরল ঘটনা। এর কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি আমাকে আলাদা করে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানালেন। তাঁর চমৎকার বিদুষী স্ত্রীও ছিলেন। দুরুদুরু বক্ষে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। পুরো সন্ধেটা তাঁর সঙ্গে নানান বিষয়ে গল্প করে কাটালাম। তিনি অনেক বই বের করে আমায় দেখালেন, এসবের মধ্যে অনেক বই ছিল চিত্রকলা বিষয়ক। আমি তাঁর আশীর্বাদধন্য হয়েছি এতো কাছে এসে। তাঁকে প্রণাম জানাই, এই মহান গুরুকে।’

অভিনেতা কে. কে. রায়না আলকাজির মৃত্যুতে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে স্মৃতিচারণ করেন – ‘আমি কাশ্মিরের একটি ছোট শহর থেকে এনএসডিতে এলাম। তখন কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না, প্রকৃত পথটা কী এবং চলনটাই বা কী! তিনি আমার পিতার মতোই ছিলেন। খাবার টেবিলে কীভাবে কাঁটাচামচ নিয়ে কেতাদুরস্তভাবে খেতে হয়, তাও পর্যন্ত শিখিয়েছেন আমাদের। আমি তাঁর কাছ থেকে শিশুর মতো প্রথম থেকে শিক্ষা পেয়েছি। তিনি আমাদের সবকিছু শিখিয়েছেন। আজ তাঁর সম্পর্কে কিছু বলার মতো ভাষা আমার নেই। তাঁর সঙ্গে আমার অন্য ধরনের এক ব্যক্তিগত ও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যখনই আমি কোনো সংশয়ে পড়েছি বা তেমন কিছু অনুভব করেছি, তাঁর নাম নিয়ে ভেবেছি, আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তাঁর এই চলে যাওয়া আমার কাছে খুবই কষ্টের।’

Indian Express-এর দীপান্বিতা নাথ লেখেন, ‘দিল্লির এসকর্ট হাসপাতালে তিনি ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। তিনি যখন প্রথম দিল্লিতে এসে এনএসডিতে যোগ দিলেন, দেখলেন বাথরুমগুলো অত্যন্ত নোংরা। তখন তিনি নোটিশ বোর্ডে একটা বিজ্ঞপ্তি দিলেন – সিংক বা বেসিনে কোনো পানের পিক ফেলা যাবে না। দুদিন পর দেখা গেল সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি ডিটারজেন্ট ও একটা মোছার কাপড় (মোছনি) নিয়ে নিজেই নোংরা দাগ পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। কর্মচারীরা তখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন।’

এম. কে. রায়না লেখেন, ‘আলকাজি প্রায়শ বলতেন, মনে রাখবে – যত তুমি ভালো কাজ করবে, হয়তো তুমি অনেক বাধা পাবে, কিন্তু পেছনে তাকাবে না, তুমি সামনে থেকে লড়ে যাবে, একদিন জয় তোমার হবেই।’

উত্তরা বাওকারের অনুভূতি, ‘তিনি যেভাবেই বলতেন আমি সেভাবেই করতে অভ্যস্ত ছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের গাইড, তিনি আমাদের হাতে ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন। আমি তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দিল্লি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির নিষেধাজ্ঞার কারণে যেতে পারিনি।’

আলকাজি তাঁর প্রযোজনাগুলোতে অসাধারণ সব দৃশ্যের সংযোজন ঘটাতেন। এগুলো তাঁর প্রযোজনার সাধারণ দর্শকদের ধারণা। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায়

 অন্ধ যুগ প্রযোজনায় তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু উপস্থিত ছিলেন। পুরানা কেল্লায় তুঘলক নাটকে Intimate Theatre-এর প্রবক্তা আলকাজি – তিনিই শুরু করেন অন্তরঙ্গ থিয়েটারের এই তত্ত্ব ও প্রয়োগকৌশল। আষাঢ় কা একদিন নাটকটি এনএসডির পুরনো ঠিকানা কৈলাস কলোনি অঙ্গনে অভিনীত হয়েছিল। অন্যদিকে ওয়েটিং ফর গডো এবং ইডিপাস রেক্স তাঁরই ডিজাইন করা রবীন্দ্রভবনের স্টুডিও থিয়েটারে ৮০ জন দর্শকের সামনে অভিনীত হয়েছিল। রবীন্দ্রভবনের অন্তরঙ্গ মঞ্চ ‘স্টুডিও থিয়েটার’ আলকাজির এক অসাধারণ সৃজনকর্ম। তাঁর আরেকটি অসাধারণ সৃষ্টি উন্মুক্ত থিয়েটার মঞ্চ (Open Air Theatre) ‘মেঘদূত থিয়েটার’ – রবীন্দ্রভবন অঙ্গনে।

দিল্লির একজন নামী নাট্য-নির্দেশক ও ইব্রাহিম আলকাজির পুত্র ফয়সল আলকাজি বলেন, ‘তিনি (আলকাজি) অন্তরঙ্গ পরিবেশে অন্তরঙ্গ দর্শকদের মাঝে নাটক মঞ্চস্থ করতে পছন্দ করতেন। তিনি ৩০০ দর্শকের বেশি হলে নাটক মঞ্চস্থ করাটা পছন্দ করতেন না। এ-ব্যাপারে তিনি আগ্রহীও হতেন না। আলকাজি মনে করতেন, অল্পসংখ্যক দর্শকের মাঝে অন্তরঙ্গ অভিনয় সব থেকে বেশি কার্যকর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।’

মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই আলকাজি এনএসডির পরিচালক হন। তিনি কোন্ মাপের এবং মানের নাট্য-নির্দেশক, নাট্য-শিক্ষক ও নাট্য-ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, সারা ভারতের নাট্যপ্রেমী ও শিল্পাঙ্গনের মানুষ তাঁর সম্পর্কে ততোদিনে জেনে গিয়েছিলেন। হিন্দি নাটকের ক্ষেত্রে এবং ভিন্ন প্রয়োগমাত্রায় সবার নজর কেড়েছিলেন তিনি। বাংলায় তখন শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার, উৎপল দত্ত বাংলা নাটকের প্রযোজনা সৌকর্যে সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছেন। আলকাজি তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। লন্ডনে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টসে থাকার সময়েই তিনি উইলিয়াম শেক্সপিয়র, হেনরিক ইবসেন, স্যামুয়েল বেকেট ও অগাস্ট স্টিন্ডবার্গের কয়েকটি শক্তিশালী প্রযোজনা উপহার দিয়েছেন। দেশে ফিরে এসে ‘থিয়েটার গ্রুপ’ এবং ‘থিয়েটার ইউনিটে’র সঙ্গে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন।

সতু সেন ছিলেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার প্রথম পরিচালক (১৯৫৯-৬১); কিন্তু তারপরই ১৯৬২-তে যোগ দেন আলকাজি এবং পরিচালক পদে কাজ করে গেছেন ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদে এতোদিন কাজ করার ঘটনা এনএসডি কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে বিরল। আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের জনক বলা হয় ইব্রাহিম আলকাজিকে। এনএসডি থিয়েটারের প্রশিক্ষণের যে ব্লুপ্রিন্ট বা রূপরেখা তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা এখন সারা ভারতের সর্বত্রই থিয়েটার প্রশিক্ষণে অনুসৃত হয়।

তিনি ছিলেন কঠিন নিয়মের অনুসারী। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও তিনি সেই কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা চালু করেছিলেন। সৃজনশীল আলোক পরিকল্পনা প্রশিক্ষণ ও তার প্রয়োগ করেছিলেন এনএসডিতে। তিনি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, ‘আমার মায়ের বেশ কিছু বন্ধু ছিলেন, কিছু সবজি বিক্রেতা। তাঁদের কাছ থেকে আমি মারাঠি ভাষা শিখেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি শিখেছি সব মানুষ সমান, কোনো ভেদাভেদ নেই। কোনো কাজই ছোট নয়। ছোটবেলা থেকেই আমি শিখেছি, আমার নিজের কাজ নিজে নিজে করা। আজ পর্যন্ত আমার বাথরুমের জিনিসপত্র এবং বাথরুম নিজেই পরিষ্কার করি। এসব জিনিস আমি আমার ছাত্রদেরও শিখিয়েছি।’ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আরো বললেন, ‘যখন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি তাঁর আর কোনো ছাত্র ছিল না; কিন্তু তিনি তাঁর যাত্রা থামাননি। তিনি আরও বললেন, ‘এখনো যত মানুষের ভেতর প্রতিভা আছে, তাদের যতজনকে পারি, তাদের সৃজনী শক্তি সম্পর্কে সচেতন করি। আমি তখনো থিয়েটারে ও চারুকলায় অসম্ভব প্রতিভাধর শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি।”

এমনটাই ছিলেন ইব্রাহিম আলকাজি। তাঁর জীবনটাই ছিল শিল্পের জন্য নিবেদিত। জয়তু ইব্রাহিম আলকাজি।

তাঁর সময়ে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন কৃতী নাট্যশিক্ষার্থী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের (ওঈঈজ) বৃত্তি নিয়ে এনএসডিতে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা কৃতিত্বের সঙ্গে কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে অসংখ্য কাজ করে সুনামও অর্জন করেছেন। তাঁরা হলেন আহমেদ মুনীর (প্রয়াত শহীদ মুনীর চৌধুরীর পুত্র), সৈয়দ মহিদুল ইসলাম (প্রয়াত),

এস. এম. মহসিন (প্রয়াত), নায়লা আজাদ নূপুর, জিনাত খান (গনি), সৈয়দ জামিল আহমেদ, খ. ম. হারুন, তারিকুল আনাম খান (তারিক আনাম) ও সালেক খান।

তথ্যসূত্র

১. Times of India, Indian Express, Hindustan Times, Wikipedia, Encyclopedia Britannica, Encyclopedia of Asian Theatre, Vol. 1; A-N, Greenwood press.

2.        A Poetics of Modernity: Indian Theatre Theory, 1850 to the Present, Aparna Bhargava Dharwadker, ed. 16 October, 2018.

3. ‘Theatre is revelation’ (Interview), The Hindu, 24 February, 2008.

4.  Who’s Who in Contemporary World Theatre, ed. Daniel Meyer-Dinkgrafe, Rutledge.

5. World Encyclopedia of Contemporary Theatre, Vol.3, Taylor & Francis.

6.         The Cambridge Guide to Theatre, Cambridge
University.ৎ           ছবি : ইন্টারনেট