‘আমি কোনো গ্রাম বা কোনো সম্প্রদায় কিংবা আপনাদের জন্য লিখি না। কল্পনার নিতান্ত আত্মগত চর্চাও আমার কাজ নয়। আমার লেখালেখির কাজটাকে হতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিক। এর অভিমুখ সেইটাই। সমালোচকদের মধ্যে আজকাল এমন একটা বাজে ধারণা চালু আছে, কোনো লেখায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেই সেই লেখকের গায়ে কোনো না কোনোভাবে একটা দাগ লেগে গেল। আমার অনুভূতি ঠিক এর উলটো – সে-ধরনের প্রভাব না থাকাটাই বরং কলঙ্কের। সমস্যাটা দেখা দেয় যখন শিল্পকে বক্তৃতা মনে হয় তখনই। আমার তো মনে হয় শ্রেষ্ঠ শিল্প অবশ্যই রাজনৈতিক – এবং শিল্পটাকে একই সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে রাজনৈতিক এবং স্থির-নিশ্চিতভাবে সুন্দর করে তোলার ক্ষমতা আপনার থাকা চাই।’ কথাগুলো বলেছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টনি মরিসন (ক্লোই আর্ডেলিয়া উয়োফোর্ড, ১৯৩১-২০১৯)। ‘লেখক’ বিশেষণটিকে চাইলে ‘ঔপন্যাসিক’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। কেননা, তিনি মূলত ঔপন্যাসিকই। আটাশি বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রেখে গেছেন এগারোটি উপন্যাস, যেগুলোর একটি আরেকটির মতো নয় – প্রতিটিই স্বতন্ত্র চারিত্র্যের। কি বিষয়ে কি ভাবনায়, তাঁর প্রতিটি উপন্যাস মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। আর দুটি নভেলা। ভাবি, কথাসাহিত্যিকরা যেরকম উপন্যাসের প্রেল্যুড হিসেবে কিংবা উপন্যাসের সমান্তরালেই ছোটগল্প লেখেন টনি সেরকম লেখেননি। কেন লেখেননি তার একটা কারণ হয়তো অনুমেয়। শুরু থেকেই তাঁর লেখার উপাদান আর আয়তন এত বিপুল যে, সেগুলোকে উপন্যাস নামক পরিব্যাপ্ত শিল্পরূপে গেঁথে রাখার প্রাণনাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল বেশি। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক এবং ব্যক্তিগত মাত্রায় এত বিশাল যে, টনি মরিসন স্বয়ং একটি উপন্যাস। আরম্ভের কথাগুলো তাঁর রচনাসমগ্রের কেন্দ্রগ অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচ্য। যে-শিরোনামে কথাগুলো বলা হচ্ছে তা থেকে অনুভব করা যাবে, তিনি কোন জাতের লেখক : ‘রুটেড্নেস্ : দ্য অ্যানচেস্টর অ্যাজ ফাউন্ডেশন’। অ্যানচেস্টর বা পূর্বসূরি চরিত্রের সামাজিক-সাহিত্যিক অভাববোধ তাঁকে পীড়িত করে। এই সূরিত্বকে আরেকটু টেনে রাষ্ট্রীয় অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিচার করে দেখলে তাঁর ভাবনার গভীরতা বোঝা যাবে। পৃথিবীর দেশে-দেশে ক্রূর বর্তমান নানা পন্থায়, নানা কায়দায় সূরিত্বকে মুছে ফেলে ইতিহাস নামক স্বতঃস্ফূর্ত প্রেক্ষাপটকে স্বেচ্ছাচার গড়ন দেওয়ার যে-ক্রীড়ায় মত্ত সেই বাস্তবতাকে মনে রাখলে টনি মরিসনের কথাগুলো পরিণত হয় দর্শনে, জীবনের দর্শনে। একই সঙ্গে তাঁর উপন্যাসগুলো হয়ে ওঠে ইতিহাস, সমকাল ও ভবিতব্যের ত্রিমাত্রিক প্রেক্ষাগার।
১৯৮৭ সালে ইলেইন শোওয়াল্টার আফ্রো-আমেরিকান ও ফেমিনিস্ট সাহিত্যতত্ত্ববিষয়ক একটি রচনায় আমেরিকার বেশ কয়েকজন নারী-লেখকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, এঁদের সাহিত্যকর্মকে নারীরচিত সাহিত্য বলে চিহ্নিত করার পুরনো দিন শেষ হয়ে গেছে। যে-লেখকগুচ্ছের নাম নেন ইলেইন তাঁরা হলেন অ্যান বিয়েটি, গ্রেস প্যালে, অ্যানি ডিলার্ড, অ্যান রেডমন্ড, সিনথিয়া ওসিক, অ্যান টাইলার, এলিস ওয়াকার, ম্যাক্সিন হং কিংস্টোন, মার্জ পিয়ার্সি, ক্যাথারিন রেনওয়াটার ও টনি মরিসন। তাঁদের শক্তির মাত্রা সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে ইলেইন দৃষ্টান্তসহ প্রতিতুলনায় দেখান, তাঁদের রচনা পুরুষ লেখক হেনরি জেমস, শারউড অ্যান্ডারসন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ডেভিড থোরু, ফ্ল্যানারি ও’কনর, ইউডোরা ওয়েল্টি কিংবা উইলিয়াম ফকনারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। টনি মরিসনকে তিনি স্থাপন করেন ফকনারের সমকাতারে। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস টার বেবিতে (১৯৮১) ইলেইন দেখতে পান শ্রেণি, বর্ণ এবং লিঙ্গায়ন-ক্ষমতার এক অসাধারণ প্রতিফলন। বর্তমানকে উপস্থাপন করতে গিয়ে ঔপন্যাসিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেন দক্ষ সমাজবিজ্ঞানীর মতো। উপন্যাসের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র মডেলকন্যা জাডিন এবং কৃষ্ণাঙ্গ যুবক সন, যাদের উৎসভূমি ক্যারিবীয় দ্বীপ। জাডিন ফ্রান্সের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট এবং মডেলকন্যা। ওর কাকা-কাকি একটি ধনাঢ্য শ্বেতাঙ্গ পরিবারে গৃহপরিচারকের কাজ করে। সন এক ক্যারিবীয় দ্বীপে শ্রমিকের পেশায় নিয়োজিত। জাডিন এবং সন দুজনের প্রেম এবং নৈকট্যের মধ্য দিয়ে আমরা দেখি স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন থেকে ছিটকে গিয়ে মানুষ কি করে দুঃস্বপ্নের গহবরে পড়ে। দ্বীপ থেকে তারা পাড়ি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে – আবাস বা আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু গৃহই তাদের অভিবাসী জীবনে জন্ম দেয় দুঃস্বপ্ন ও বেদনা। এটি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বেদনা, সংগ্রাম আর আপসকামিতার পরিস্থিতির দুঃসহ-বাস্তব চিত্রণ। ১৯৯৫ সালে কারিন ব্যাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টনি মরিসন বলছিলেন, শৈশব থেকেই তিনি জানতেন শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়েদের বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের ‘টার বেবি’ (আলকাতরা-মেয়ে) নামে সম্বোধন করে। একসময় আলকাতরার খনি পবিত্র বা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচ্য ছিল। কেননা, সেটি নির্মাণের কাজে লাগত। মোজেসের ডিঙি কিংবা পিরামিডের মতো বিভিন্ন জিনিসকে একত্র-নিবদ্ধ করে রাখত আলকাতরা। টনি মরিসন আসলে আলকাতরা-শিশু বলতে বুঝিয়েছেন সেই কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে যে কিনা এরকমই একত্র-নিবদ্ধ করে রাখার কাজটাতে সমর্থ। উপন্যাসের একটা বড় সার্থকতা এখানে, কৃষ্ণাঙ্গরা এতে প্রধান চরিত্র হলেও এটি কেবলই তাদের কাহিনি হয়ে থাকেনি। এটি হতে পারে অভিবাসী পূর্ব ইউরোপীয়, দক্ষিণ এশীয় কি লাতিন আমেরিকার জনগোষ্ঠীর জীবনেরও প্রতিপাদ্য। বর্তমান মানবাভিবাসনের অষ্টাবক্র জটিল মানচিত্রে উজ্জ্বল আলো ফেলতে সমর্থ চার দশককাল আগেকার এই উপন্যাস। উপন্যাসটির ধ্রম্নপদসম্ভব আবর্তনের বৈশিষ্ট্যকে মনে রেখেই হয়তো অনেক সমালোচক এটিকে একটি মহৎ পোস্টমডার্ন উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
টনি মরিসনের লেখালেখিকে অনেকেই তাঁর জাতিগত ও ব্যক্তিগত জীবনবেদনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মুক্তো বলে আখ্যা দিয়েছেন। একসময়ে আফ্রো-আমেরিকান বা আফ্রিকান লেখকদের জন্যে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ও চর্চিত মাধ্যম ছিল আত্মজৈবনিক ধরনের রচনা। এমন অসাধারণ সব রচনার কথা বলা যায়, যেগুলো উপন্যাসের চাইতেও স্মরণযোগ্য কিংবা উপন্যাসেরই সমান্তরাল এক ক্ষিপ্র ধারা হয়ে আজো ধরে রেখেছে নব-আবিষ্কৃত দ্বীপসম কত কত জীবনকে। কেনীয় ঔপন্যাসিক এন্গুগিকে পাঠ করতে গেলে তাঁর বন্দিজীবনের আত্মকথা ডিটেন্ড : এ রাইটার্স প্রিজন ডায়েরির (১৯৮১) কথা আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। এমন অনেক অসাধারণ কথা পাওয়া যাবে তাঁর এ-গ্রন্থে, যেসব তাঁর উপন্যাসে নেই কিন্তু তাঁর মানসকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে গেলে
কথাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। তিনি লিখেছিলেন, তাঁর বন্দিত্বের বিষয়টি আসলে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি কেনিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের নিরিখেই গুরুত্বপূর্ণ। স্পষ্ট ভাষায় তিনি উচ্চারণ করেন, তাঁকে যারা বন্দি করেছে তারা আসলে উপনিবেশবিস্তারী আন্তর্জাতিক পুঁজিশক্তির তাঁবেদার। যুগ যুগ ধরে তারা কেনিয়ার স্থানীয় স্বার্থান্বেষীদের সঙ্গে মিলে প্রতিবাদী জনতার কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছে। তাঁর আত্মকথনে নীরবতা, বিষণ্ণতা আর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সংযোগ হারানো এক অদ্ভুত জগতের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়। টনি মরিসন স্বয়ং এ-জাতীয় রচনার অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। আমাদের কাছে মনে হয়, নিজের অভিজ্ঞতা এবং তাঁর বিশ্বউপন্যাস পাঠের সমন্বয়টাকে তিনি করতে পেরেছেন অনবদ্যভাবে। অল্প বয়স থেকেই বাকপটু এবং ভাষা-ব্যবহারে দক্ষ মেধাবী টনি গল্প-উপন্যাস পাঠের মধ্য দিয়ে ইতিহাস, সমাজ ও সময়কে পর্যবেক্ষণ করার এষণা অর্জন করেছিলেন। একদিকে নিজের ও অন্যদের দুঃস্বপ্নতাড়িত বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে ছাত্রজীবন থেকে উপন্যাসপাঠ এবং পরে সাহিত্যের ছাত্র হয়ে উপন্যাস নিয়ে গবেষণাকর্ম করার প্রস্ত্ততিপর্ব – এই দুই সজোর স্রোত তাঁর প্রকৃত জীবনটাকেই একদিন উপন্যাসময় করে তোলে।
একটা আতঙ্কগ্রস্ত ‘ট্রমাটাইজ্ড’ জীবনের সমূহ চাপ কাঁধে নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর পিতা জর্জ উয়োফোর্ডের জর্জিয়ার কার্টারসভিলের জীবনটা হয়তো ঔপন্যাসিক মরিসনের আদি পশ্চাৎপট। পনেরো বছর বয়েসি জর্জ দেখতে পান, তাঁর দুই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবেশী শ্বেতাঙ্গদের হাতে নিহত হচ্ছে। দুটি মৃতদেহের সাক্ষী এক কিশোরের বাকি জীবনটা সেই আতঙ্কের ছায়ায় কেটে যায়। আবার টনির যখন দুই বছর বয়স, তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর দরিদ্র শ্রমিক পিতার বাড়িভাড়া বাকি পড়ে যাওয়ায় শ্বেতাঙ্গ বাড়িঅলার ভয়ংকর অদ্ভুত-অস্বাভাবিক আচরণ ও প্রতিক্রিয়া। বাড়িঅলা স্বয়ং আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে ভাড়াটিয়ার মানে বাড়িঅলার নিজেরই ঘরে। আগুনলাগা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হো-হো-হা-হা অট্টহাসি হাসে বাড়িঅলা, হতাশা নয় বরং উৎকট উদ্যাপনে। এসব রূঢ় রোদে তেতে ওঠা টনির জীবন পাপড়ি ছড়িয়ে মেলে যেতে থাকে ক্রমে। কখনো কখনো বাইরের পৃথিবীর লু-হাওয়া সয়ে যায় ভেতরের সতেজ হাওয়ায়। সেই হাওয়া ছিল তাঁর পিতামাতার উত্তরাধিকারবাহিত। বাবা-মায়ের মুখে শোনা আফ্রো-আমেরিকান লোকগল্প, ভূতের গল্প কি গান তাঁকে নিয়ে যেত ভিন্ন এক কল্পলোকে। আফ্রিকার সেই আদি জীবনের নির্যাস কি শেকড়ের টান এভাবেই তাঁর সত্তার গভীরে অব্যবহিত উপাদানে রূপ নেয়। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া থেকে আসা, পোল্যান্ড থেকে আসা, ইউক্রেন কি হাঙ্গেরি থেকে আসা লেখকেরা তাঁদের আদি উৎসকে তাঁদের উপজীব্যতার অন্তর্গত করতে পারলে তিনি কেন তাঁর আফ্রিকীয় উৎসকে অবলম্বন করতে পারবেন না। হয়তো সেই আদি উৎসে হাত দিলেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসবে দাসত্ব আর ঔপনিবেশিকতার অকহতব্য ইতিকথা। কিন্তু সেটিকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। টনি মরিসন কিন্তু তাঁর আফ্রিকীয় উত্তরাধিকারকে তাঁর মনন ও চেতনার সর্বস্ব করারও পক্ষপাতী ছিলেন না। আমরা স্মরণ করতে পারি কৃষ্ণাঙ্গ লেখক রিচার্ড রাইট কিংবা জেমস বল্ডউইনকে। একসময় তাঁদেরই আফ্রো-মার্কিন সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচয়িতা হিসেবে গণ্য করা হতো। টনি নিজের প্রকাশে রাইট এবং জেমস বল্ডউইনের চাইতে খানিকটা ভিন্ন কায়দা বেছে নেন।
উপন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবনকে দেখে-দেখে সেইসঙ্গে নিজের জীবনকে মেপে পথ হাঁটা মরিসন ছাত্রজীবনেই উপন্যাস-দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ওঠেন। প্রিয় দুই লেখক জেন অস্টিন কিংবা লেভ তলস্তয়ের সাহিত্যে নিমগ্ন থাকেন মুগ্ধতা নিয়ে। ছাত্রজীবনে জেন অস্টিনের উপন্যাসে নারীর অবস্থা নিয়ে তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনার উদ্যোগে অবাক হন তাঁর প–ত শিক্ষকগণ। এম.এ. ক্লাসে গবেষণা অভিসন্দর্ভ রচনা করেন ভার্জিনিয়া উলফ এবং উইলিয়ম ফকনারের সাহিত্যকর্ম নিয়ে। উপন্যাস যে জীবনের ঠিক পাশ ঘেঁষে যাওয়া একটি স্পষ্ট রেখা, সে-কথা সর্বদা বিশ্বাস করতেন টনি মরিসন। লেখালেখি-সংক্রান্ত নানা গদ্যে তাঁর এসব চিমত্মাভাবনার টুকরো-টাকরা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেছেন, উপন্যাস একসময় ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির বিষয়, যেখানে বৃহত্তর জনজীবনের কোনো উপস্থিতি ছিল না। অথচ বাইরের বৃহত্তর জীবনটা অনেক বেশি জীবন্ত আর বর্ণিল। সেখানে নাচ-গান-উৎসব উপলক্ষ আর গল্পগাথার অবিরত প্রবাহ চলমান। অভিজাত শ্রেণি চেয়েছে তাদের শিল্পাঙ্গিক দিয়ে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা রচনা করে রাখতে। কালক্রমে উপন্যাসই বদলে গিয়ে অবহেলিত সেই বৃহত্তর শ্রেণিটাকে আত্মস্থ করে নিল। সেটা হয়তো দুম্ করে একদিনেই ঘটেনি। টনি স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পামেলা কিংবা জেন অস্টিনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত দেন, যেসব উপন্যাস নিজস্ব শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অভ্যাস-প্রথা প্রভৃতি প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলে যায়। পরে উপন্যাস মানুষকে এমনসব কথা বলতে আরম্ভ করে, যেসব কথা এতকাল তাদের কাছে ছিল অজানা। হয়তো সেসব তাদেরই কথা; কিন্তু সেসব কথা থেকে তাদের অবস্থান ছিল বহু দূরে। টনি মরিসন দেখলেন তাঁর নিজস্ব উত্তরাধিকার তাঁর পূর্বপুরুষদের স্থান-কাল-ইতিহাসের অমোচনীয় একটা ছাপ কোথাও না কোথাও থেকেই যাচ্ছে। যে গান-গল্পগাথার সন্ধান তিনি পান তাঁর পিতা-পিতামহদের কাছে তারই একটা উদ্গম তিনি টের পান তাঁর সাহিত্যিক সত্তার অভ্যন্তরে। তিনি দেখলেন, নাচ-গান-নাটকীয়তায় ভরা জীবনটা উপন্যাসে আসেনি মানে ইউরোপীয় দৃষ্টিতে সেসব ছিল অচিন্তনীয়। তিনি চাইলেন উপন্যাসটাকে জনসংযোগের একটা হাতিয়ারে পরিণত করতে। কেমন সে-অবলম্বন – ধরা যাক কোনো এক কৃষ্ণাঙ্গ-চার্চে ফাদার সার্মন করছেন জনতার মধ্যে জনতার উদ্দেশে। ঈশ্বরের সত্তা এবং জনসমষ্টির মাঝখানে উভয় পরিম-লীর একটা সেতুবন্ধন তিনি। কখনো কখনো এমন হয়, সার্মন চলাকালীন দুঃখ-পরিতাপে দগ্ধ ফাদার কান্নার প্রশামিত্ম নিয়ে আসেন। তখন চার্চের শ্রোতৃম-লীরও কান্না পায়। ঔপন্যাসিকের জায়গাটা সেরকম একটা অবলম্বনের বোধ এনে দেবে পাঠককে। এমনকি প্রচলিত প্রকৃতিবর্ণনকেও টনি মরিসন বদলে দিতে চান। ব্লুয়েস্ট আই, সুলা, টার বেবি কিংবা সং অব সলোমন উপন্যাসে প্রকৃতি পূর্বেকার মতো মানুষের সত্তার সমান্তরালে থাকে না, প্রকৃতি মানুষের সংবেদনা এবং অনুভূতির উপাদানে পরিণত হয়। বৃক্ষরাজি, মাছ, মেঘ অথবা মৌমাছি – প্রকৃতির এসব উপাদান তাদের সজীবতা দিয়ে (যেহেতু তারা নির্জীব নয়), তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়ে প্রকাশ করে তাদেরই পাশাপাশি অনুভূতি নামক এক বিচিত্র জিনিসের অধিকর্তা মানবের বেঁচে থাকা ও সংগ্রাম করাটাকে। গাছেদের কম্পন, মাছেদের ভয়ার্ত প্রতিক্রিয়া, মেঘের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি কি মৌমাছির নৃত্যের তৎপরতা যেন এক অনিবার্য ভাষিকতা যার পাঠোদ্ধার কখনো সম্ভব হয়, কখনোবা সেসব দুর্জ্ঞেয় প্রতীকতার মুদ্রা। টনি আফ্রিকার
কৃষ্ণাঙ্গ চিত্রকলার (লোকায়ত এবং নাগরিক দুই-ই) ঐতিহ্য থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের জন্যে।
নিজের আফ্রিকীয় উত্তরাধিকার এবং সেটির সঙ্গে তাঁর মার্কিন বর্তমানতার মেলবন্ধনটাকেই টনি মরিসন ভবিতব্যের জীবনবিকাশের মূল সঞ্চয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেওয়ার আগে যখন তিনি বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদনার চাকরি করেন, তখন থেকেই তিনি আফ্রো-আমেরিকা বিষয়ে সচেতন। মূল্যবান সব প্রকাশনা সম্পাদনা করে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, সমৃদ্ধ করেন গোটা বিশ্বকেও। র্যান্ডম হাউস থেকে প্রকাশ করেন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর জীবনী, হেনরি ডুমাস, অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং এইচ. পি. নিউটনের সাহিত্যকর্ম। অনেক লেখকের আবিষ্কর্তাও তাঁকে বলা যাবে। তিনি ভুলতে পারেন না প্রাণবন্ত হেনরি ডুমাসকে, যে ১৯৬৮ সালে নিউইয়র্কের সাবওয়েতে নিহত হয় বর্ণবাদী হামলায়। ডুমাসের কবিতা ও গল্প প্রকাশ করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন টনি মরিসন। টনি কেড বাম্বারা, অ্যাঞ্জেলা ডেভিস, ব্ল্যাক প্যান্থার হুয়ে নিউটন, গেইল জোন্স তাঁরই আবিষ্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক জগৎকে চমকে দেয় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দ্য ব্ল্যাক বুক। সেই ১৯২০ সালের দাসত্বের দিন থেকে শুরু করে পৌনে এক শতাব্দীকালের মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের এক বহুবর্ণিল বৃত্তান্ত সেটি। ছবি, চিত্রকর্ম, বিবরণ, প্রতিবেদন, ইতিহাস, রচনাকর্ম, প্রামাণ্য দলিল প্রভৃতির এক গ্রন্থিক মহাফেজখানা টনি-সম্পাদিত বইটি। এসব থেকে তাঁর মেজাজ এবং চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই মিলতে পারে। তখনকার গনগনে সত্তরের দশক মারাত্মকভাবে ফুটছে আর সে-দশকের আগুনের মধ্য দিয়ে পথ কেটে লেখক হয়ে উঠবেন টনি নিজেও। ভাবা যায়, ১৯৫৮-তে তাঁর বিয়ে হলো হ্যারল্ড মরিসনের সঙ্গে এবং ১৯৬৪ সালে তাঁর সংসার ভেঙে গেল বিবাহবিচ্ছেদের জেরে। টনির কাঁধে দুজনের সম্মিলিত অবদান দুটি সমত্মান; কিন্তু লালন-পালনের ভার একা টনি মরিসনের। ভোর চারটায় তাঁকে জেগে উঠতে হয় রোজ। সংসার শুরুর আগে শুরু হয়ে যায় উপন্যাসের সংসার – প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই রচনার শব্দশ্রম। দিনভর কর্মজীবন আর দু-দুটি সমত্মানের দেখাশোনার প্রাণান্ত পরিশ্রম। তবু ভেঙে পড়েন না, ক্লামিত্ম তাঁকে ক্লিন্ন করতে পারে না। পৃথিবীকে জানানোর মতো কত কত কথকতা যে তাঁর জমে ছিল। এরই মধ্যে আফ্রিকায় ওলে সোয়িংকা, চিনুয়া আচেবে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাথল ফুগার্ড বিস্ফারিত হয়ে গেছেন নতুন যুগের বার্তা নিয়ে। এলেন টনিও – ব্যাপ্টিজমালের সময়কার অর্জন মধ্যপদ অ্যান্থনিকে সংক্ষিপ্ত ও প্রাথমিকে পরিণত করে – তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান চিরকালের জন্য এবং তাঁর নামের সঙ্গেও থেকে যান চিরদিনের জন্যই।
লেখালেখির সঙ্গে কোথাও যেন একটা সম্পর্ক রয়েছে সত্তার সংগ্রামশীলতার। পরিস্থিতি যত বৈরী ও প্রতিকূল লেখক সত্তা ততই প্রকাশোন্মুখ। লেখালেখিটা তাঁর জন্য অর্থপূর্ণ বর্তমানতা, আপন পৃথিবীর নির্মাণ। দ্য ট্রু কনফেশন্স অব অ্যান অ্যালবিনো টেররিস্ট গ্রন্থের রচয়িতা ব্রেইটেন ব্রেইটেনবাখ তাই বলেন, ‘লেখালেখি হলো বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা এবং চেতনা ও সংবেদনার প্রসারণ।’ বিষয়টাকে আরো সুন্দর করে বলেছেন মিলোভান জিলাস। তাঁর দৃষ্টিতে যত রুদ্ধতাই আসুক তা লেখককে কোনোভাবেই কব্জা করতে পারবে না। যুগোশস্নাভিয়ার একসময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট জিলাস ছিলেন প্রেসিডেন্ট টিটোর ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৫৪-তে তিনি বহিষ্কৃত হন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। জীবনের বহু বছর তাঁর কেটেছিল কারাগারে এবং কারাগারেই তিনি তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর অব প্রিজন্স অ্যান্ড আইডিয়াস পৃথিবীর বৈরী পরিস্থিতিতে থাকা লেখকদের জন্যে প্রকৃত অনুপ্রেরণার উৎস। ইন্দোনেশীয় লেখক প্রামোদিয়া অনন্ত তোয়ের (১৯২৫-২০০৬) তাঁর বিখ্যাত কোয়ার্ট্রেট বুমি মানুসিয়া রচনা করেছিলেন কারাগারে থাকাকালীন। কাজেই ইতিহাস বর্তমান আর প্রতিকূলতার সমূহ চাপ সামলে নিয়ে যখন টনি মরিসনের দ্য ব্লুয়েস্ট আই প্রকাশ পেল, সেটা ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের জন্য এক ধরনের এভারেস্ট আরোহণের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, লোকসাহিত্য, দুঃস্বপ্নসম বাস্তব এবং সংগীত সবকিছু উপন্যাস নামক এতদিনকার প্রচলিত একটি আয়তনে কীভাবে ধরা সম্ভব, সেটাই দেখাল উপন্যাসটি। বিভিন্ন স্কুল এবং লাইব্রেরি প্রতিবাদের ঝড় তুলল, মরিসনের উপন্যাসটিকে বাজেয়াপ্ত করা হোক। বাস্তবের এমন দগদগে চেহারাটাকে দেখার জন্য তৈরি ছিল না মানুষ অথচ সেই মানুষেরাই সেই বাস্তবের নির্ণায়ক। বর্ণবাদ, যৌন নিপীড়ন, অজাচার, ধর্মীয় প্রসঙ্গ, বিবাহবিচ্ছেদ এসব বিষয় গোটা উপন্যাসে এক ভয়াবহ ক্যানভাসের সৃষ্টি করে। এই উপন্যাসটিকেই যখন নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটি তাদের ব্ল্যাক-স্টাডিজ বিভাগের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করল এবং আরো কয়েকটি কলেজ মনোনীত করল তাদের পাঠ্যসূত্র-গ্রন্থ রূপে, তখন বোঝা গেল টনি মরিসনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলে ওঠার জন্য।
টনি মরিসনের প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই প্রসঙ্গে স্বয়ং রচয়িতার অনুভূতি জানার আগে উপন্যাসটি থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি লক্ষ করা যেতে পারে –
আমাদের বাড়িটা পুরনো, ঠান্ডা আর সবুজ। রাতের বেলা একটা কেরোসিন বাতি একটা বড় কামরাকে আলোকিত করে রাখে। অন্য কামরাগুলো ঢাকা থাকে আঁধারে, তেলাপোকা আর ইঁদুরের দখলে। বড়রা আমাদের সঙ্গে কথা বলে না – তারা আমাদের নির্দেশ দেয়। তারা আদেশ হাঁকে আমাদের উদ্দেশে, উপায়-পন্থা এসব বলে দেওয়া ছাড়াই। যখন আমরা পা হড়কে পড়ে যাই ওরা চোখ মেলে তাকায় আমাদের দিকে। কোথাও যদি কেটে যায় কিংবা জখম হয়ে যায় তখন ওরা প্রশ্ন করে, তোরা পাগল নাকি? কখনো সর্দি-ঠান্ডা লেগে গেলে আমাদের বিবেচনাবোধের অভাবকে লক্ষ করে তারা মাথা নাড়াতে থাকে ঘৃণাভরে। ওরা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, তোরা কীভাবে আশা করিস, তোরা সব অসুস্থ হয়ে গেলে কেউ এসে সব কিছু করে দেবে? আমরা কোনো উত্তর দিতে পারি না সেসব প্রশ্নের। আমাদের রোগ সারানো হয় অবমাননাকর, অপবিত্র কালো ওষুধের ঢোঁক আর ক্যাস্টর অয়েল গিলিয়ে – ফলে আমাদের মনটা ভোঁতা হয়ে যায়। …
আমরা জানতাম, জীবনের আসল সন্ত্রাস ছিল ঘরছাড়া হওয়া। ঘরছাড়া হয়ে পড়াটা ছিল সেইসব দিনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আধিক্যের সমস্ত সম্ভাবনা এর সঙ্গে সঙ্গে নস্যাৎ হয়ে যেত। দেখা গেল কেউ অধিক পরিমাণে খেয়ে যাচ্ছে, তো তার পরিণতি হয়ে যেতে পারে গৃহহীনতা। কেউ একজন বেশি-বেশি কয়লা জ্বালিয়ে গেল, তো তার পরিণতি হতে পারে গৃহহীন হয়ে যাওয়া। লোকেরা জুয়া খেলা, মদ খাওয়ার পরিণামে ঘরছাড়া হয়ে যেতে পারে। কখনো-কখনো মায়েরা তাদের সমত্মানদের ঘরছাড়া করে দিত। আর সেরকমটা ঘটলে সমত্মান কী করেছিল সেটা কোনো ব্যাপার নয়, সমস্ত সহানুভূতি থাকত তার সপক্ষে। সে ঘরছাড়া হলো, হলো তার নিজেরই রক্তমাংসের শরীর দিয়ে। বাড়িঅলার দ্বারা ঘরছাড়া হওয়াটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এটা জীবনের এমন একটা দিক যার ওপর আপনার কোনো হাত নেই, যেহেতু আপনার উপার্জনটাকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু কাউকে ঢিলেমি করে ঘরছাড়া করে দেওয়া কিংবা অত্যন্ত হৃদয়হীনভাবে নিকটাত্মীয়কে ঘরছাড়া করাটা সত্যি অপরাধ। …
আমার পিতার মুখ একটা পাঠের বিষয়। শীত এসে জেঁকে বসে এর ওপর। তাঁর চোখগুলো বরফের পাহাড় হয়ে যায়, যেন তুষারঝড়ের আশঙ্কা। তার চোখের ভ্রূগুলো পত্রশূন্য বৃক্ষের কালো-কালো ডালপালার মতো বেঁকে যায়। শীতের সূর্যের বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, হলুদ কিরণ পড়ে তার চামড়ায়। তার চোয়াল দেখে মনে হয় যেন বরফাবৃত প্রান্তরের কেটে নেওয়া শস্যের খোঁচা-খোঁচা অবশেষ। তার কপাল যেন ঠান্ডায় জমে যাওয়া ইরি-হ্রদের প্রবাহ, যেখানে লুকনো তার শীতল ভাবনারাজির তরঙ্গগুলো অন্ধকারে ঘুরপাক খায়। চিতাবাঘ-হত্যাকারী পরিণত হয় বাজপাখির সঙ্গে লড়ুয়েতে। দিনরাত তার কাজ হলো কাউকে দরজার সামনে থেকে এবং জানলার কপাটআঁটা কাঠের নিচ থেকে সরিয়ে দেওয়া। আগুনের শিখা পাহারা দিতে থাকা অগ্নিগিরির মতো তিনি আমাদের নির্দেশ দেন, কোন দরজাটা বন্ধ রাখতে হবে অথবা কোন দরজাটা রাখতে হবে খোলা। যাতে করে তাপের সুষম বণ্টন বজায় থাকে। আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে কয়লার গুণাগুণ বিষয়ে আলাপ করতে থাকেন। আমাদের শিখিয়ে দিতে থাকেন, কীভাবে আগুন নাড়িয়ে কয়লা সত্মূপ করে আগুনটাকে সামলাতে হয়। এবং বসন্তকাল না আসা পর্যন্ত তাঁর এই বাঙ্ময়তা চলতেই থাকবে।
উপন্যাসটির পশ্চাৎপটে থাকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপট – ১৯৪১ সাল আবার বিশ্বযুদ্ধেরও অন্তর্বর্তীকাল। টনি মরিসন একটি ঐতিহাসিক-সামাজিক পরিপ্রেক্ষেতে এমনসব বিষয়কে ধারণ করেছেন যেগুলো অধিকাংশ মানুষের কাছে অস্বস্তিকর বাস্তবতার নামান্তর। কিন্তু বর্ণবাদের ভয়ংকর ক্ষতিকর দিকটাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই যখন বিপুল জীবনাভিজ্ঞতার ধারক টনি মরিসন স্বয়ং এক সুদীর্ঘকালের বিবর্তনের সাক্ষী। তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসটির চরিত্র পেকোলা বর্ণবাদী দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচাইতে কদাকার আর অসুন্দরের প্রতীক। পেকোলার নীল চোখের স্বপ্ন আসলে গায়ের চামড়ার রং কালো হওয়ার কারণে তার মনে যে জমাটবদ্ধ বিষাদাচ্ছন্নতা তা থেকে মুক্ত হওয়া। পেকোলার ক্ষেত্রে সেটি হয়তো নীল চোখের প্রত্যাশা। অন্য কারো প্রসঙ্গে অন্যতর আকাঙক্ষা। কিন্তু মূল কথাটা হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তের দুঃস্বপ্নের তাড়না থেকে বাঁচা। যদিও বাস্তব তাদের প্রত্যাশানুযায়ী অনুকূল থাকে না। বরং বাস্তব আরো ভয়ংকর আরো প্রাণঘাতী পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে। বাস্তবতা এমনই যে, পেকোলার মা পলিন সারাক্ষণই সময় কাটায় শ্বেতাঙ্গ মানুষের ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজে এবং ধর্মেও তারা খ্রিষ্টান। তবু ঈশ্বর শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের ছেড়ে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকীয়দের প্রতি অনুকূল হন না। এক প্রশান্ত ও সম্ভাবনাময় নারী পেকোলার ক্রমে উন্মাদ হয়ে যাওয়াটা ব্যক্তিক বৃত্তের বৃত্তান্ত হলেও এতে ব্যক্তি ছাড়িয়ে বৃহত্তর জাতিগত চেতনার ছায়াপাত ঘটে। পিতার দ্বারা ধর্ষিত হওয়া পেকোলার বিবর্তনটিকে বিস্ময়কর কুশলতার সঙ্গে সামলান টনি মরিসন। গুপ্ত বাস্তব রূপ নেয় প্রকাশ্য বাস্তবে। উপন্যাসটির প্রকাশের সিকি শতাব্দীকাল পরে ১৯৯৩ সালে টনি মরিসন বলেন, ‘পেকোলার গ্রন্থবদ্ধ জীবনটাকে সঠিকভাবে অনুভব করার জন্য পঁচিশ বছর সময় লেগেছে।’ আর তারও সিকি শতাব্দীকাল পরে এসে এমনকি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্নের বাস্তবায়নের পরবর্তী পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েও বলতে পারা যাবে, পেকোলার জীবনবাস্তবতা বা জীবন-দুঃস্বপ্ন থেকে খুব দূরে সরে যাওয়া যায়নি।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ – কালপরিসরটিকে টনি মরিসনের জীবনের ট্রিলজি দশক হিসেবে অভিহিত করা যায়। ১৯৮৭-তে বেরোয় তাঁর বিলাভড, ট্রিলজির প্রথম উপন্যাসটি; ১৯৯২-তে জাজ এবং ১৯৯৭ সালে প্যারাডাইস। এই ট্রিলজি প্রথমত এক আত্ম:মহাদেশীয় জীবনবাস্তবতার শক্তিমান কথাচিত্রণ এবং দ্বিতীয়ত এটি টনি মরিসনকে দেয় বিশ্বপরিচিতি এবং তৃতীয়ত এই ট্রিলজি দশকেই তিনি অর্জন করেন সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার (১৯৯৩)। অবশ্য তাঁর প্রথম উপন্যাস এবং ট্রিলজির প্রথমটার আগে বেরোয় টনি মরিসনের আরো তিনখানা উপন্যাস – সুলা, সং অব সলোমন এবং টার বেবি। সুলা উপন্যাসটিকে অনেকেই নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার্য বলে মনে করেন। এর কারণ উপন্যাসটির নারী চরিত্রাধিক্য এবং এতে রয়েছে বেশ কয়েকটি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনা যেগুলোতে থাকে নারীর সংশিস্নষ্টতা। তবে সাহসী সমালোচক বারবারা স্মিথ তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী সমালোচনামূলক প্রবন্ধে মরিসনের সুলা উপন্যাসটির পাঠকে লেসবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য বলে মন্তব্য করেন। তাঁর তৃতীয় উপন্যাস সং অব সলোমন অনেকের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস-সমাজতত্ত্বের পাঠ (‘টেক্সট’)। বিখ্যাত অপরাহ্ উইনফ্রে তাঁর ‘বুক ক্লাবে’র জন্য গ্রন্থটি মনোনীত করলে এটি বৃহত্তর পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। বিশ শতকের কালপরিধিতে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ পঁচিশটি উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। ১৯৯৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমির শংসাবচনেও এটির উল্লেখ থাকে। উপন্যাসটিকে বহুসাংস্কৃতিক-বহুজাতিক জীবনের একটি বৃহদায়তন আঙিনা হিসেবে দেখেছেন সমালোচকগণ। আফ্রো-মার্কিন বাস্তবতার শেকড়টিকে যথার্থ রূপেই চিহ্নিত করার কাজটি করেন মরিসন। সং অব সলোমন প্রসঙ্গে পাঠকের মনে পড়তে পারে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপবাসী লেখক প্রামোদিয়া অনন্ত তোয়েরকে। তাঁর বুরু কোয়ার্ট্রেট নামে খ্যাত বুমি মানুসিয়া (দিস আর্থ অব ম্যানকাইন্ড) উপন্যাসটিকেও এমনিভাবে বহুসাংস্কৃতিক-বহুজাতিক প্রতিফলনের আকর হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। উপন্যাসটিতে আছে ১৮৯৮ সালের দিকে জাভা দ্বীপে গড়ে উঠতে থাকা ঔপনিবেশিকতার সূচনাবিন্দু থেকে পরবর্তী পরিসর। এই কালপর্বটি গুরুত্বপূর্ণ এজন্যেই, শিগগির এর ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠবে অদূরের অস্ট্রেলিয়া। জাভা দ্বীপের রাবার, কফি, চিনি, খনিজ দ্রব্য প্রভৃতির হাতছানিতে বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে ঢোকে বহিরাগতরা। ডাচ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, অভিযাত্রীর দল আর অন্যান্য ইউরোপীয় সকলেরই আস্তানা গাড়ার অধ্যবসায় চলমান। বন্দরে ভিড় করে আরো আরব, ভারতীয়, চৈনিক মানুষেরা। অদ্ভুত এক মহাজাতিক মিশেলের পরিণতি জাভা, যেখানে প্রত্যেকে সঙ্গে নিয়ে আসে নিজ নিজ জীবনের কাহিনি। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা, কুসংস্কার, ঘৃণা, কল্পনা এবং ভবিতব্য – সবই আছে প্রামোদিয়ার উপন্যাসে। যেমনটি থাকা সম্ভব এমন বাস্তবে ঠিক তেমনটাই। জাভানিজ, ডাচ, মালয়, মাদুরিজ ইত্যাদি বিচিত্র ভাষাভাষী মানুষ সেখানে কথা বলে। একেক শ্রেণির মানুষের আবার একেক ভাষা। যেমন স্থানীয়দের ডাচ ভাষা ব্যবহারের অধিকার ছিল না। এ যেন আর্যাবর্তে প্রাকৃতজনের সংস্কৃতানধিকার। মরিসনের উপন্যাসে পাই মিশিগান অঞ্চলে মার্সি নামের এক কল্পিত শহর, যেখানে কাহিনির আবর্তন ঘটে ১৯৩০ থেকে শুরু করে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। আবার উপন্যাসের নায়ক মিল্কম্যান ডেডের পিতামহ-প্রপিতামহদের সূত্রে চলে আসে উনিশ শতকের কালিকতা। উপন্যাসের নায়ক মিল্কম্যান সংগ্রাম চালায় তার পরিবার থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র হয়ে স্বকীয় একটা জীবনের অধীশ্বর হতে। এই বহুবিচিত্র-বহুস্বর পরিবৃত্তের মধ্যে নিজের থাকাটাকে অস্তিত্বপূর্ণ করে তুলতে চায় সে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর খুব কম লেখকই এমন ধারার উপন্যাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর জন্যে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের ক্ষমতা অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ করার শক্তি। প্রামোদিয়া কিংবা মরিসনের উপন্যাসকে কেউ কেউ ‘ক্যালাইডোস্কপিক’ উপন্যাসও বলে থাকেন। পরপর দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর টনি মরিসন তাঁর তৃতীয় উপন্যাসেই এমন অসাধারণ শক্তির নজির রাখতে সমর্থ হলেন। বস্ত্তত এটির প্রকাশ-প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই তাঁকে ধ্রম্নপদী ঔপন্যাসিকের তালিকায় স্থায়ী আসন দিয়ে দেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ছিল তাঁর সেই ধ্রম্নপদত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সং অব সলোমন উপন্যাসের গতিময়-স্বচ্ছ ভাষার প্রশংসা করে থাকেন সমালোচকেরা। উদ্ধৃতি দেওয়া যাক –
শোবার ঘরে ফিরে মিল্কম্যান ড্রেসিংটেবিলের সামনে ওর জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিল। ওর যেদিন ষোলো বছর বয়স হয় সেদিন ওর মা ওকে এক জোড়া রুপা-বাঁধানো চিরুনি উপহার দিয়েছিল। গায়ে গাঁথা ওর নামের সংক্ষিপ্ত রূপ যা কিনা একজন চিকিৎসকের ডিগ্রিও বটে। সে এবং তার মা এটা নিয়ে বেশ কৌতুক করত। মা খুব করে চাইতেন ও যেন মেডিকেল স্কুলে পড়াশোনা করে। ‘কেমন দেখাবে সেটা? এম. ডি., এম. ডি.। তোমার অসুখ হলে তুমি কী এমন কোনো লোকের কাছে যাবে যার নাম ড. ডেড?’ – জোরের সঙ্গে সে বলত মাকে। …
কিন্তু সবকিছুর শুরু এগারোটার দিকে। গিটার এবং মিল্কম্যান রাত সাড়ে আটটার দিকে যখন আসে, তখন সত্যিকার অর্থেই চারদিক ফাঁকা। একটা শুঁড়িখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। অর্ডার করল স্কচ আর পানির জন্য। মিল্কম্যান ওর অংশটুকু দ্রম্নত গলাধঃকরণ করেই আরেকটার জন্যে অর্ডার দিলো। গিটারকে জিজ্ঞেস করে সে, ‘আচ্ছা ওরা আমাকে মিল্কম্যান ডাকে কি জন্যে?’
‘বালের কথা, আমি জানব কী করে? সেটা তোর নাম, তাই না?’
‘আমার নাম ম্যাকন ডেড।’
‘আমাকে এই গোটা রাস্তা ডিঙিয়ে আনলি তোর নাম বলার জন্যে?’
‘এটা আমার জানা দরকার।’
‘আরে, ইয়ার, পান করো।’
‘তুমি তো তোমার নাম জানো, জানো না?’
‘বাজে কথা রাখ। তোর মনের আসল কথাটা বল তো?’
‘আমার বুড়োটাকে ধরাশায়ী করেছি?’
‘ধরাশায়ী?’
‘হ্যাঁ। ঘুষি মেরেছি। মেরে ওকে বাঞ্চোত রেডিয়েটরটার ওপর ফেলেছি।’
‘ও কী করেছিল তোকে?’
‘কিচ্ছু না।’
‘কিচ্ছু না? তুই ওর ওপর চড়াও হলি আর ওকে মার লাগালি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোনো কারণ ছাড়াই?’
‘ও আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছিল।’
‘ওহ্।’
‘ও আমার মাকে মেরেছিল। আমি মারলাম ওকে।’
‘বেশ শক্ত ব্যাপার।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি সত্যিই বলছি।’
‘জানি।’ মিল্কম্যান দীর্ঘশ্বাস নেয় – ‘আমি জানি।’
‘শোন। আমি বুঝতে পারছি তোর অনুভূতিটা কেমন।’
‘ওহ্ ওহ্। তুই বুঝতে পারছিস না। এরকম ব্যাপার তোর না ঘটলে তুই বুঝতে পারবি না \’
রিচার্ড রাইট কিংবা জেমস বল্ডউইনের উপন্যাসের কৃষ্ণাঙ্গ জীবন মরিসনে মোড় নিয়েছে খানিকটা ভিন্নতায়। আগ্রাসী বা আক্রমণাত্মক কৃষ্ণাঙ্গ অভিব্যক্তির যথেষ্ট বর্তমানতা সত্ত্বেও মরিসন চূড়ান্তভাবে সমন্বয়ের ধারণাতেই স্থিত হন। সং অব সলোমনে গিটার চরিত্রটিকে অনেকেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের অনুসারীদের বিপরীত মেরুর সমান্তরাল কৃষ্ণাঙ্গ অভিব্যক্তি রূপে দেখেছেন। মরিসন দেখিয়েছেন, আফ্রো-মার্কিন বাস্তবতা আমেরিকায় এমনই স্থায়ী ছাপ সৃষ্টি করেছে যে, একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ইতিহাসের অনুসন্ধান আসলে প্রয়োজন বর্তমানের বিন্যাসের জন্যই। পূর্বসূরিদের ভুল বা পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হলে ভবিষ্যতে আরো দুর্যোগেরই সম্ভাবনা। ওলে সোয়িংকার কবিতার সেই লন্ডন শহরের শ্বেতাঙ্গ বাড়িঅলির কথা বলা যায়, যে কখনো কোনো কৃষ্ণাঙ্গকে বাড়ি ভাড়া দেবে না। কিন্তু ফোনে বাড়ি ভাড়া নিতে চাওয়া নাইজেরীয় যুবকের কণ্ঠ থেকে সে বুঝতে পারে না, লোকটি সাদা না কালো। একটি কবিতায় এক বিপুল ইতিহাসের ছায়া ফেলার দারুণ কৃতিত্ব দেখান সোয়িংকা। মজার ব্যাপার, এ-কবিতাটি বর্তমানে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে পাঠ্য। ইংরেজরা তাদের বিগত কৃতকর্ম থেকে এই শিক্ষাই গ্রহণ করে, একই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে। মরিসনের উপন্যাসের ভয়ংকর-কদাকার ইতিহাসের দিকগুলো তখনই সার্থক বলে প্রমাণিত হবে, যখন উপন্যাসের পাঠক মনে করবে, হ্যাঁ, উপন্যাস আসলে ইতিহাসের বিশাল প্রেক্ষাপটে যে-গহবরগুলো থাকে, যে-শূন্যতা থাকে সেগুলোরই ভরাট রূপ। উপন্যাসে বিধৃত ভায়োলেন্সের মরিসনকৃত চিত্রণ থেকে আমরা অনুভব করি, বিশ্বের যে-কোনো স্থানে যে-কোনো আঙ্গিকেই ঘৃণার জন্ম হতে পারে কিন্তু ঘৃণাটাকে জয় করাটাই হবে মানবজাতির জন্যে একটা বড় বিজয়।
আমার বোন পিয়া। মায়ের দুধ পান করার সঙ্গে-সঙ্গে আমি ওর রক্তও পান করেছিলাম। কোনো শব্দ কানে আসারও আগে যে-শব্দটা আমার কানে আসত সেটা হলো হামা দিয়ে ওর সিঁড়ি ভাঙার শব্দ। পল ডির আগমনের আগ পর্যন্ত ও-ই ছিল আমার গোপন সঙ্গী। সে এসেই ওকে বিদায় করে দিলো। খুব ছোটবেলা থেকেই সে ছিল আমার সঙ্গী। যখন বাবার বাড়ি ফেরার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতাম, ও-ই সাহায্য করত আমাকে। ও এবং আমি অপেক্ষা করতাম কখন বাবা ফিরবে। মাকে ভালোবাসি আমি কিন্তু আমি জানি মা তার নিজেরই পেটের একটা মেয়েকে হত্যা করেছিল। আর আমার বোনটা যে আমার সঙ্গে রয়েছে সেই ভয়ে আমি কাবু হয়ে থাকি। মা আমার ভাইদের মেরে ফেলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে এবং আমার ভাইয়েরা সেটা জানত। ওরা আমাকে ডাইনি-হত্যার গল্প শোনায়। আমাকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে সেটা করতে হয়। আমার যদি কখনো তেমনটা করার প্রয়োজন পড়ে তাই।
টনি মরিসনের বিলাভড উপন্যাস থেকে উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি। পিয়া যে-মেয়েটির নাম, সে আসলে মৃত। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকারী তারই জননী। মেয়েকেও যাতে তার মতো দাসত্বের শৃঙ্খল বরণ করতে না হয় সেজন্যে শিশুটিকে হত্যা করে সে। কিন্তু জীবনের আগমনকে ঠেকাতে পারে না সেই মা এবং পারে না দাসত্বেরও মূলোৎপাটন করতে। তবু এই মৃত্যু ঘটে। আর পিয়া মেয়েটি নিহত হয়েও প্রবলভাবে জীবিত এবং গোটা উপন্যাসে আগাগোড়া তার হত্যাকারী মায়ের এবং আরো বহুজনের অস্তিত্বকে সে কাঁপিয়ে দেয়। মার্কিন গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-৬৫) পরবর্তী কয়েক বছরের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। আফ্রো-আমেরিকান দাস মার্গারেট গার্নারের জীবনের সত্য ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা বিলাভড। টনি মরিসন ১৯৭৪ সালে র্যান্ডম হাউজে সম্পাদনার চাকরি করার সময়ে গার্নারের কাহিনিটি পড়েন আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট (১৮৫৬ সালের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত) পত্রিকায়। পরে মরিসন সেটি ছাপেন তাঁর দ্য ব্ল্যাক বুক গ্রন্থে, যেটিকে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি আকরগ্রন্থ বিবেচনা করা হয়। বিলাভড প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন জাগায়। ১৯৮৮ সালে এটি অর্জন করে ‘পুলিৎজার পুরস্কার’, একই বছরে চিত্রায়িত হয় এবং বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব অপরাহ্ উইনফ্রে অভিনয় করেন চলচ্চিত্রটিতে। লাখ লাখ কপি বিক্রি হতে থাকে উপন্যাসটির। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার জরিপে উঠে আসে, ১৯৮১ থেকে ২০০৬ – এই পঁচিশ বছরের কালপরিধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসটির নাম টনি মরিসনের বিলাভড।
বিলাভড উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে টনি মরিসন কেবল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানই নয়, পৃথিবীজুড়ে থাকা দাসত্ব কিংবা বৈরিতায় রুদ্ধ মানবজাতির পক্ষে একটি ঐতিহাসিক দায়িতব পালন করেন। উপন্যাসটি এমনই এক বিভাজনরেখা যে, এটিকে সামনে রেখে বলা যেতে পারে – যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জীবন : বিলাভড উপন্যাস প্রকাশের আগে এবং পরে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা ছোট্ট একটি বাক্য যেখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘সিক্সটি মিলিয়ন অ্যান্ড মোর’। মুহূর্তেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে শুধু কি আমেরিকা-আফ্রিকা কিংবা মরিশাস-ফিজি-অস্ট্রেলিয়া, আমরা চলে যাই সেই খ্রিষ্টপূর্বাব্দের গ্রেকো-রোমান পরিপ্রেক্ষেতে। মাঝখানে সমুদ্রের অসীম জলরাশি আর গ্রিসের উত্তর দিক থেকে দাস-মানুষেরা জীবনের অযুত ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে রোমান সাম্রাজ্যে। মরিসনের উৎসর্গপত্রটি হয়তো আটলান্টিক দাস-ব্যবসার পরিণামে নিহত মানুষদের মানবিক গাঁথা, তবু বিলাভড এক বৈশ্বিক বাস্তবতার উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেথের পিঠে অজস্র চাবুকের দাগ যে-বৃক্ষের ইমেজ এঁকে দেয়, সেটি যেন সমগ্র মানবজাতির জন্যে একটি ‘জিনিয়ালজিক্যাল ট্রি’, যেখান থেকে গ্রহণ করতে হয় মানবিকতার প্রকৃত পাঠ। বিলাভড উপন্যাসটি নিজেই জন্ম দিয়েছে অনেক ইতিহাসের। এর ক্যানভাসে চিত্রিত ভয়াবহতাকে সবাই যে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল তা কিন্তু নয়। আটচল্লিশজন আফ্রো-আমেরিকান লেখক স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদপত্র ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় – উপন্যাসটির সপক্ষে এবং শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও মরিসন অর্জন করে নেন বিখ্যাত সব পুরস্কার। অনেকেই এটিকে ভূতের গল্পের কারিগরি-আশ্রিত শিল্পকর্ম রূপে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, সেথের কন্যা পিয়ার চরিত্রটি বাস্তব না সে পুনরুত্থিত আত্মা সেটা উপন্যাসে খানিকটা সংশয় বা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু এই চরিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে বরং আরো তীব্রতা দেয়। ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি স্কুল বিলাভড উপন্যাসের পাঠ নিষিদ্ধ করে তাদের শিক্ষায়তনে। শুধু তা-ই নয়, বহু স্কুল-কলেজে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে উপন্যাসটির বিরুদ্ধে ঘোরতর আপত্তির কথা জানা যায়। সবার একটাই কথা, এতে আছে বর্বরতা, শিশুহত্যা, যৌনতা এবং সন্ত্রাস। কিন্তু এটাও তো সত্য, এসবের স্রষ্টা টনি মরিসন নন, ইতিহাসের মানুষেরাই। এতকাল তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি কেউ, কিন্তু এত বিশাল অন্যায় আর অমানবিকতাকে কোনোভাবেই যে ছাড় দেওয়া চলে না সেটাই করে দেখিয়েছেন জীবনবাদী টনি মরিসন।
বলেছি, টনি মরিসনের সব উপন্যাসই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি, সমষ্টি, জাতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস যা কিছুই আমরা বুঝতে চাই না কেন, তার একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপট প্রয়োজন। টনি মরিসনের উপন্যাস হলো সেই প্রেক্ষাপট – সমগ্র বিশ্বের জন্যে। জাজে তিনি তাঁর আফ্রিকা-সত্তা থেকে পাওয়া সাংগীতিক অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করেন আঙ্গিক হিসেবে। জাজ-সংগীতের টুকরো-টুকরো নোটেশনের মতো দৃশ্য-চরিত্র-সংলাপ নির্মিত হয় এতে। প্যারাডাইস উপন্যাসে দেখা যাবে সামাজিক নারী-অবস্থানের চমৎকার নিরীক্ষা। ২০০৮-এ প্রকাশিত এ মার্সি উপন্যাসের কথা বলা যায়, যেখানে আমেরিকার প্রাথমিক পর্বের দাসজীবনকে নতুনভাবে চিহ্নিত করা হয়। এতে নারীসত্তার প্রবল শক্তির পরিণতি মাতা এবং কন্যার চরিত্রে বিধৃত। সেইসঙ্গে মার্কিন জীবনের নেপথ্যে যেসব অন্ধকারাবৃত ইশারার সংস্থান সেগুলোকে তুলে আনা হয় সাহসের সঙ্গে। এতে বাইবেলের ধার্মিকতার উপজীব্যও প্রতীকতায় ধরা পড়ে। মোট কথা পাঠকের প্রাণের মানুষ বা ভালোবাসার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবেন টনি মরিসন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.