মম আসেনি

কথা ছিল, কার্জন হলের সামনের চত্বরে অপেক্ষা করবে। সময় জানিয়েছিল এগারোটা। সাজিদ কথামতো ঠিক সময়ই এসেছে। এবং তারপর থেকে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ সদ্য চারা গজানো ফুলের বেডগুলো দেখে, তারপর দেখে মাঝারি সাইজের মেহগিনি গাছের সারি। ডালে ডালে নোনা ফলের সাইজের ফল ধরেছে। কিছুটা আগাম হলেও অশোক গাছের ডালে একটা দুটো লাল রঙের ফলের থোকাও চোখে পড়ে। ওই সব গাছ আর ফুল ফল দেখে চলল কিছুক্ষণ। মাঝখানে একবার পূর্ব-পশ্চিম দুদিকের গেট পর্যন্ত হেঁটে এল। এমনকি প্রকাণ্ড শিরীষ গাছটার তলা দিয়ে পেছনকার পুকুরের পাড় পর্যন্ত হেঁটে আসে। কিন্তু না, মম অর্থাৎ মমতা হাসান কোথাও নেই।

অথচ বারবার করে বলে দিয়েছিল যে, আজ দুজনে সারাদিন ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াবে। গত পরশু সাজিদকে তার কলেজে গিয়ে জানিয়েছিল তার মনের ইচ্ছাটা। ঐদিনই ছিল সাজিদের রিটেন ফাইনালের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে বেরুতেই দেখে, মমতা বারান্দায় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে প্রশ্নের উত্তর পুরোটা পাওয়ার আগেই মমতা নিজের মনের ইচ্ছেটা জানায়। সাজিদ আপত্তি করার কারণ খুঁজে পায়নি। শুধু জানতে চেয়েছিল, উপলক্ষটা কী, সেটা বলো, দুজনে সারাদিন ঘুরেফিরে বেড়াব, ভালো কথা। কিন্তু কেন?

উত্তরে কিছু বলেনি। শুধু মুখ টিপে হেসেছিল মমতা। তারপরে বলেছিল, উপলক্ষ আবার কী হবে? কিছু না। কেন আমরা দুজনে কি এমনি এমনি উপলক্ষ ছাড়াই ঘুরে বেড়াইনি? স্মরণ করে দেখো।

সাজিদের স্মরণ না হওয়ার উপায় নেই। আসলেই তো কথাটা সত্যি। পরীক্ষা-টরীক্ষা কিংবা ক্লাসের চাপ না থাকলে দিব্যি বেরিয়ে পড়েছে। আসলে দুজনের মনের ভেতরে তো সর্বক্ষণ কাজ করে চলেছে, কাছাকাছি হওয়া আর থাকার আকাক্ষাটা – যতক্ষণ পারা যায়। সেই কবে প্রথম দেখা ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়ে বেড়াবার সময় – এই কার্জন হলের গেটেই পেছন থেকে এক শয়তান ছেলের ধাক্কা খেয়ে রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল মমতা। তাকে তখন পাশ থেকে হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়েছিল সাজিদ রহমান। সেই ধাক্কা খেয়ে পড়া এবং টেনে তোলার ঘটনা থেকেই পরিচয়। সাজিদ ঢাকা মেডিক্যাল-এ ভর্তির সুযোগ পায়, কিন্তু মমতা পায় না। তার নাম উঠে বরিশাল মেডিক্যাল-এর লিস্ট-এ। মাকে ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই সে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রিতে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়ে যায়। তার ফলে এক জায়গায় না হোক, পাশাপাশি জায়গায় তো ঠাঁই মেলে! তাই বা কম কিসে? একদিকে যদি কার্জন হল, তো তার উল্টো দিকে ঢাকা মেডিক্যাল, এমন কিছু দূর নয়। প্রায়ই দেখা হয়েছে তারপর। নানান ছুতোয়, দুজনে দুজনের কাছাকাছি চলে এসেছে। ঐভাবে দেখা হতে হতে সম্পর্কটা এখন বন্ধুত্বের সীমানার মধ্যেই যে আটকে নেই, সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, এ ব্যাপারে দুজনের মনেই কোনো সন্দেহ নেই। পূর্ব আর পশ্চিমের দেখা-সাক্ষাতের সম্পর্কটা এখন যে উত্তর আর দক্ষিণের মিলনের দিকে গড়িয়েছে, তা এখন দুজনেই বোঝে। তাই উত্তরে মিরপুরের রূপনগর আর দক্ষিণে গেণ্ডারিয়া এলাকার ফরিদাবাদ – এই দুয়ের মিলনস্থল হয়ে পড়েছে কার্জন হল আর ঢাকা মেডিক্যাল। একটা পূর্বে তো অন্যটা পশ্চিমে। সব মিলালে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম চারটা দিকই দুজনে মিলিয়ে দিয়েছে বললে বেশি বলা হয় না।

সাজিদ ভেবে পাচ্ছিল না, মমতার এমন ধরনের প্রোগ্রাম তৈরি করে ঘোরাফেরা করতে চাওয়ার কারণ কি? দ্বিতীয়বার কারণ জানবার জন্য পীড়াপীড়ি করলে খানিক মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল, এত অস্থির হবার কী হয়েছে? এক্ষুনি জানার কী দরকার? পরশুদিন যখন দুজনে একসঙ্গে বেরুব, তখন এমনিতেই জেনে যাবে মাঝখানে একটা তো দিন মোটে – এই একদিনের তর সইছে না।

মমতা না বলতে চাইলেও সাজিদের অনুমান করতে বাধা থাকে না। সে ধরে নেয় যত রহস্যই করুক মমতা, আসলে উপলক্ষটা জন্মদিনই, অন্য কিছু নয়। তবে একেবারে নিশ্চিত হতে পারছিল না। কারণ এত বছর ধরে জানাশোনা, এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, কিন্তু ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠান কখনো হয়েছে বলে তার মনে পড়ে না – ওর কবে জন্ম সেই তারিখটাও কখনো জানায়নি। আর সবচাইতে বড় কথা, জন্মদিন উদযাপনই যদি হয়, তাহলে গোপন করার মধ্যেই বা এমন কী রহস্য থাকতে পারে?

দেখতে দেখতে এদিকে বারোটারও বেশি বেজে যায়। কিন্তু কার্জন হলের বিশাল চত্বরে ইতস্তত হাঁটতে থাকা, বা ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দেওয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে মমতার মুখ সে খুঁজে পায় না।

সে ভেবে পায় না, কী হতে পারে মম’র! হ্যাঁ, এই নামেই সে কিছুদিন হলো ডাকতে শুরু করেছে। ঐ নামে ডাকা নিয়েও কথা আছে। মমতা হাসান ওর আসল নাম। সবাই মমতা বলে ডাকে। তবে সম্পর্কটা গভীর হয়ে যাবার জন্যই কী না জানে না হঠাৎ একদিন সাজিদ জানায়, আমি তোমার নামটা একটু ছোট করতে চাই – তিন সিলেবলে উচ্চারণ না করে দুই সিলেবলে উচ্চারণ করব।

সেটা কী রকম? মমতা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলে সে বলেছিল, তোমার নামের শেষের ‘তা’টা বাদ দিয়ে ডাকতে চাই।

তার মানে ‘মম’? হেসে উঠেছিল মমতা। পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মম’ শব্দের মানে জানো?

বাহ জানবো না! মূলে শব্দটা সংস্কৃত, সর্বনাম পদ হলেও কোন বাঙালি না জানে ঐ শব্দের মানে, বলো?

একটু থেমে আবার বলেছিল মমতা, ঐ নামে সবাই ডাকলে তার মানে কী দাঁড়ায় ভেবে দেখেছো? যে আমাকে ঐ নামে ডাকবে, আমি তারই হয়ে যাব।

হ্যাঁ যাবে। সাজিদ বোকার মতো বলেছিল, সবাই তোমাকে একান্ত আপনজন বলে ভাববে, নামটা তখন কত মিষ্টি শোনাবে।

মমতা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠেছিল, যাক অত মিষ্টি হওয়ার দরকার নেই।

তারপর বলেছিল, তুমি এত বুদ্ধ কেন বলো তো? মমতা ডাকতে যদি তেতো লাগে তো তাই লাগুক। আমার নাম মিষ্টি করার দরকার নেই, আমি সবার … ‘মম’ হতে পারব না।

সাজিদ বুঝেছিল আপত্তিটা কেন। বলেছিল, সবাই কেন ঐ নামে ডাকবে? শুধু আমি ডাকব।

অবশ্যি তখন তখনই ডাকেনি। কিছুক্ষণ পর থেকে ডাকতে শুরু করে সাজিদ। তাতে মমতা বলেছিল, শেষ পর্যন্ত ঐ নামেই ডাকতে শুরু করলে? ঐ নামে ডাকার দায়িত্ব নিতে পারবে তো?

উত্তরে হেসেছিল সাজিদ। বলেছিল, দেখো পারি কি না – বেশি দিন তো আর নেই, খুব জোর সাত-আট মাস।

হ্যাঁ, ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার দিন কয়েক আগে ঐ নাম ডাকা নিয়ে কথা হয়েছিল দু’জনায়।

গতকালও কথা হয়। অনেক কথার মাঝখানে মমতা মুখোমুখি তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল, আমাকে কি তোমাদের বাড়ির লোকেরা সবাই দেখেছেন? মাত্রই তো দু’তিন দিন গেছি – ওঁদের কারুর আপত্তি নেই তো?

নাহ! কার আপত্তি থাকবে? সংসারে তো ঝগড়া বাঁধে শাশুড়ি-বউয়ের মধ্যে নইলে ননদ-ভাবির মধ্যে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে ও ঝামেলার কোনোটারই সম্ভাবনা নেই – মা যে নেই, সেটা তো জানো। আর একটি মাত্র বোন তারও বিয়ে হয়ে গেছে – ওখানে তুমি খালি তিন তিনটি দ্বিতীয় ‘বর’ পাবে।

কি বললে? মমতা প্রায় আঁতকে উঠেছিল।

আরে দেবর শব্দটাই তো এসেছে দ্বিবর থেকে – কী করবে? তোমার কপাল – দেবর-ভাবির সম্পর্ক তো ট্রাডিশনালি খুব মধুর। তাই না?

তোমার বাবার সঙ্গে কিন্তু একবারও দেখা হয়নি। মমতা একটু যেন গম্ভীর হয়েছিল।

আমার আব্বার কথা বলো না, উনি সাংবাদিক মানুষ। কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনোই নাক গলাতে চান না।

পরিবার সম্পর্কে ঐ শেষ কথার পরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেদিন মমতা জানতে চেয়েছিল, আমার মা যে হিন্দু ঘরের মেয়ে, সে খবরটা কি সবাইকে জানিয়েছ?

না জানাইনি, খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সাজিদ জানিয়েছিল। বলেছিল, কী দরকার ওসব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার যখন হিন্দু ছিলেন, তখন ছিলেন, এখন নেই। ব্যস হয়ে গেল। পুরনো ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে আমার বিশ্রী লাগে।

বাহ আমার দিকটা তুমি ভেবে দেখবে না! মমতার গলার স্বরে তখন আহত ভাব ফোটে। বলে, আমার অতীত নিয়ে কি তোমার কোনো কৌতূহল জাগে না? ঐ ধরনের কথা শুনতে সাজিদের যে বিরক্তি লাগছিল, সেটা সে গোপন করেনি, খোলাখুলি বলেছিল। ওসব অতীতের ঘটনা নিয়ে আমি কখনো কথা বলি না। আমার একদম ভালো লাগে না – নিজের ব্যাপারে যেমন, অন্যের ব্যাপারেও তেমনি, বাদ দাও, ওসব কথা তুলো না। সাজিদের উত্তেজনা দেখে মমতা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কিন্তু তারও মনে তো অনিশ্চয়তার ভয়। মন থেকে জীবনের কথা সে কীভাবে সরায়? এক সময় সে হালকা ভঙ্গিতে আবার জানিয়েছিল, এই জানো, নিজেকে আমার অদ্ভুত লাগে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলে খুবই অস্বস্তির মধ্যে আমাকে থাকতে হয় – চিন্তা করে দেখ আমার দিকটা। আমি মিলেমিশে যেতে পারি না। আমার পেছনে শুধু রিলিজিয়নই দু’রকমের নয়, লাইফস্টাইল দু’রকমের, ট্রাডিশন দু’রকমের, কালচার দু’রকমের সমস্ত কিছুতে দু’রকমের ধারা মিশে গেছে – সাজ-পোশাক, রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, সমস্ত কিছুতে দু’রকমের ধারা এসে মিশেছে – আমি স্বাভাবিকভাবে বাইরের সঙ্গে মিশতে পারি না – কোনো কোনো সময় এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় যে বলার কথা নয়। বুঝতে পারি না, কী আমার করা উচিত। আমি আসলে কী, কী আমার আসল পরিচয়!

সাজিদ বাধা দিয়ে বলেছিল, এসব কী বলছ পাগলের মতো? তোমার তো বিব্রত হওয়ার কারণ নেই। তোমার তো গর্ব বোধ করা উচিত – তোমার মধ্যে দু’ধরনের কালচার, রিলিজিয়ন, ট্রাডিশন একাকার হয়ে গেছে – তুমি তো মোস্ট মডার্ন একটা একজিসট্যান্স – অতীত আর বর্তমান, নেটিভিটি আর ইমিগ্রেশনের একটা গ্লোরিয়াস সিনথেসিস – এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়, বলো?

সাজিদের মুখে তখন অমন কথা শুনে মমতার মুখের ভাব করুণ হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, তোমার কথা বুঝি না যে তা নয় – অমন থিয়োরির কথা ভাবতে ভালোই লাগে। কিন্তু যখন বাইরে বের হই, কোনো কারণে আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাই তখন খারাপ লাগে, মনে কষ্ট পাই আমার মায়ের দিক থেকে তো আপনজন কেউ নেই, তবু মায়ের জ্ঞাতি ভাইবোনদের কাছে গেলে ওরা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকায় আবার যখন বগুড়ায়, মানে আমার দাদির বাড়ি গেছি তো সেখানেও দেখেছি একই ব্যাপার আমি যেন অদ্ভুত কোনো জীব – সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আর আমার নজরের আড়ালে ফিসফিস করে কী যেন বলাবলি করছে – আমার মা তাই কোনো দিকেই যেতে চান না, না বাপের বাড়ির দিকে, না শ্বশুরবাড়ির দিকে।

গতকাল ঐসব পুরনো কথা নিয়ে ঐ পর্যন্তই আলাপ হয়। সাজিদের ভালো লাগছিল না। তাই সে একরকম জোর করেই মমতাকে থামিয়ে দেয়। কারণ সে দেখে আসছে, পুরনো দিনের কথা বলতে আরম্ভ করলেই মমতার মন ভারি হয়ে ওঠে তাছাড়া তার অজানা তো কিছু নেই, সবই তো তার জানা। প্রত্যেক বছর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহটা মন ভার হয়ে থাকে মমতার। বলে, মা হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছেন, নিঃশব্দে খালি কাঁদছেন, খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো করেন না।

সাজিদ কী বলবে? তার বুদ্ধিতে কুলায় না যে কিছু বলবে। ’৭১-এর মার্চ আর ’৯১-এর মার্চ, দুটোই তো সমান আঘাত মমতার মায়ের জীবনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা সভায় যোগ দেওয়ার জন্য মোমিন হাসান বগুড়া যাচ্ছিলেন, মাঝপথে বাস দুর্ঘটনায় তাঁকে চিরবিদায় নিতে হয়। সংবর্ধনা সভায় পৌঁছতে পারেননি।

আর ’৭১-এর মার্চের কথা তো সবারই জানা। সবারই জীবন ঐ সব দিনের কোনো না কোনো দুঃখ-বেদনার স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছে। সাজিদ মমতাকে কোনো বুদ্ধিই দিতে পারে না। শুধু বলে, তুমি মাকে সান্ত্বনা না দিতে পারো, তাঁর সঙ্গে তো থাকতে পারো তুমি ঐ ক’টা দিন সর্বক্ষণ কাছে থেকো – তাহলেই হবে।

আমি তাই তো থাকি, মমতা জানিয়েছিল। বলেছিল, কিন্তু আমারও তো দুঃখে বুক ভেঙে যেতে চায় – অসহ্য লাগলে তখন বাইরে বেরিয়ে পড়ি।

মমতার জন্ম ’৭১-এর বহু পরে। কিন্তু ওর জন্মের সূচনা তো ঐ ’৭১ থেকেই। ২৭শে মার্চের ভোর বেলা বাবা-মা, ছেলে-মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রাণে বাঁচবার জন্য। দুদিন হেঁটে তারা নৌকায় চেপে ফরিদপুর যশোর পাড়ি দিয়ে সপ্তাহখানেক পরে বর্ডারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। বর্ডার পাড়ি দেওয়ার সময় গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যান। প্রাণ বাঁচাবার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে কে যে কোনদিকে ছিটকে পড়ে তার ঠিক ঠিকানা থাকে না। ঐভাবে ছুটতে থাকার সময় স্কুল পেরুনো সদ্য শাড়ি পরতে শেখা অনিমা রাণী মজুমদারের সঙ্গে দেখা হয়, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র মোমিন হাসানের। বর্ডার পার হবার পর অনিমা রাণী খালি কাঁদে আর ডাইনে বাঁয়ে ছুটোছুটি করে খুঁজে বেড়ায় মা-বাবা আর ছোট ভাইটিকে। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে খোঁজ পাওয়া যায় বাবা-মায়ের। ভাইটি নেই তার লাশ পথেই ফেলে আসতে হয়েছে বাবা-মাকে – বাবা হাঁটতে পারেন না – ঊরুতে রাইফেলের গুলি লেগে মাংস ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছিল। প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকা মানুষরাই তাঁকে ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে নিরাপদ দূরত্বে। যখন দেখা হয় তখন সতীশ মজুমদার সদ্য তৈরি রিফিউজি ক্যাম্পের হাসপাতালে। দেখাশোনা করার জন্য লোকজন কেউ নেই। এদিকে মোমিন হাসানের সঙ্গী- সাথিরাও কে কোনদিকে যে গেছে তার কোনো পাত্তা নেই। অগত্যা মজুমদার পরিবারের সঙ্গী হয়ে মোমিন হাসানকেই সব কিছু দেখাশোনা করতে হয়। ওদিকে মজুমদার বাবুর ঊরুর ঘা শুকোবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যেমন দগদগে ছিল তেমনই রয়ে গেছে। হাঁটতে পারেন না। মোমিনের মনের উদ্বেগ তখন নেই কারণ বগুড়ার খবর ওরই মধ্যে তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল যে তার বাবা-মা, ভাই-বোন ভালোই আছে। তারা বগুড়া শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি সারিয়াকান্দিতে ঠাঁই নিয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অন্যসব তরুণের মতো মোমিন হাসানও জুটেছিল। কিন্তু ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই হতে পারেনি। তার চশমার পাওয়ার এক চোখে মাইনাস সাড়ে তিন, আরেক চোখে মাইনাস আড়াই। তবে কমব্যাট গ্রুপে যেতে না পারলে  কী। কাজের অভাব ছিল না – অফিসের কাজের জন্য লোক দরকার, আহতদের দেখাশোনা করার জন্যও লোক লাগে। তারপর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় খবর পৌঁছানোর জন্যও তো মানুষ লাগে। একেকদিন বর্ডার পার হয়ে ভেতরের দিকে পর্যন্ত খবর নিয়ে যেতে হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় সাজিদ ঐসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তবু অমন ব্যস্ততার মধ্যেও সে প্রায়ই রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যেত অনিমা আর ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।

যুদ্ধ শেষ হলে সবার মতো ওরাও দেশে ফেরে। সতীশ বাবুর কাজকর্ম করার কোনো ক্ষমতাই তখন নেই। কোনো রকম নেংচে নেংচে দু’চার পা এদিক-ওদিক নড়াচড়া করতে পারেন মাত্র। তাঁর ভাগে পাওয়া বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দেওয়া হয়, আর তিনি চেয়ারে বসে প্রাইভেট-এ ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। তাঁর মেয়ে কলেজে পড়া বাদ দিয়ে মিটফোর্ড-এর নার্সিং স্কুলে ঢুকে পড়ে। মেয়ে পাশ করে বেরুবার আগেই সতীশ বাবুর চিরবিদায়ের ঘণ্টা বেজে যায়। কারণ ডায়াবেটিস রোগীর শরীরের ঘা খুব পুরনো হয়ে গেলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। আর অমন পচন ধরলে সেটা আর সারানো যায় না। ততদিনে মোমিন হাসানের সঙ্গে পরিবারটির সম্পর্ক আরো গাঢ়তর হয়ে উঠেছে এবং পুরনো ঢাকার এক নতুন কলেজে তার চাকরিও জুটে গেছে। দুজনের মেলামেশাও তখন বেড়ে যায়। অনিমাদের আত্মীয়স্বজনরা আগে আড়ালে নানান কথা বলত, তখন তারা মুখের ওপর কথা বলতে আরম্ভ করে। তাতে অবশ্যি কারুর লাভ-ক্ষতি হয় না। কারণ অনিমার মা নিজেই মেয়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। মুখের ওপর বলে দেন, হ্যাঁ আসবে ও, একশবার আসবে। ঘোর বিপদের দিনে ও-ই ছিল একমাত্র সহায়, তখন তো আপনাদের টিকিটি দেখা যায়নি। এখন কেন আসেন খবরদারি করতে।

সমালোচনা যারা করতে আসত তাদের আরো একটা অসুবিধা ছিল। কারণ বাড়িটার অন্য অংশের মালিক সতীশ বাবুর ভাইরা তাদের অংশ বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল আর তা কিনে নিয়েছিল স্থানীয় মাতব্বর বসির মোল্লা। তার দাপটের কথা সবাই জানত।

তবু সমাজ-সংসার বলে কথা। হিন্দু বাড়ির একেবারে ভেতরের দিকে মুসলমান ছেলে আসবে যাবে, বিয়ের যুগ্যি মেয়ের সঙ্গে হাসাহাসি করে আড্ডা দেবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা – এমনটা কোন মানুষ মেনে নিতে পারে?

শেষে মা-ই একদিন মেয়েকে ডেকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন, মোমিন কি তোকে বিয়ে করতে চায়?

অনিমা লজ্জা পায় না মায়ের প্রশ্ন শুনে। সেও মুখোমুখি তাকিয়ে উত্তর দেয়। বলে, হ্যাঁ চায়।

তাহলে বিয়ে করছিস না কেন তোরা? ওকে বল, দুজন বন্ধু আর তোকে নিয়ে যেন কোর্টে চলে যায় – কাজটা সেরে ফেল।

বিয়ের ব্যাপারে মায়ের মুখে অমন কথা শুনে অনিমা একটু যেন ইতস্তত করে। তারপর জানায়, আমিই রাজি হচ্ছি না।

মেয়ের কথা শুনে মা আকাশ থেকে পড়েন। বলেন, সে কি! তুই কেন রাজি হচ্ছিস না? তোর কী অসুবিধা? এত কিছু হয়ে যাবার পর – আমি বলেছি বিয়ের পর ওকে এখানে, এই বাড়িতে থাকতে হবে। মেয়ের কথা শুনে মায়ের মন আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে। চোখের জল সামলাতে পারেন না। আধবোজা গলায় বলেন, আমার জন্য ভাবতে হবে না, শিগগির তোরা বিয়েটা সেরে ফ্যাল। লোকজনের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না।

মোমিন হাসানের বাড়ির দিক থেকে বোধহয় কিছুটা আপত্তি ছিল, কিন্তু সে পাত্তা দেয়নি। বিয়েটা সিভিল ম্যারেজ হয়নি, অনিমাই হতে দেয়নি। সে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে তারপর মুসলমানি আকিদা মেনে কাজির অফিসে বসে বিয়ের তিন কবুলের এজেন স্পষ্ট উচ্চারণ করে দিয়েছে।

এসব বৃত্তান্ত সাজিদের একটু একটু করে জানা। মমতাই বলেছে এক একদিন এক এক ঘটনার কথা। হ্যাঁ, অনিমা মজুমদার কলেমা পড়ে আমিনা খাতুন হয়েছিলেন এবং মোমিনুল হাসানকে বাক্স-বিছানা নিয়ে ফরিদাবাদের মাধব দত্ত লেনে স্বর্গীয় সতীশ মজুমদারের বাড়িতে এসে ঠাঁই গাড়তে হয়। নিজ ধর্মত্যাগের পর মুসলমানকে বিয়ে করে অনিমা মজুমদার কেমন সুখী হয়েছিলেন – তার বয়ান মমতার মুখ থেকে সাজিদ শুনতে পায়নি। কারণ বগুড়া যাওয়ার পথে বাস অ্যাকসিডেন্টে বাবা যখন মারা যায়, তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সুখ কী জিনিস, তা বুঝবার মতো বয়স মমতার হয়নি। ও শুধু এইটুকু জানিয়েছে যে, তার নাম মমতা রেখেছেন তার মা, এবং তা রেখেছেন বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে। আর সেই জন্যই বাবার স্মৃতি যতটুকু মনে আসে তাই সে মনের মধ্যে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। মায়ের চাকরি এখনো আছে আর বসবাসও সেই পুরনো বাড়িতেই – যার বেশির ভাগ অংশ অনিমার জ্যাঠা-কাকারা বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছেন বাবা মারা যাওয়ার পরপরই। ভাগে পাওয়া চারটি কামরার দুটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর বাকি দুটিতে মা আর মেয়ের বসবাস। মা অন্য কোথাও যাবেন না, বাবা-মা’র স্মৃতি যে
ঘর-বাড়ির সর্বত্র!

কার্জন হলের চত্বরে টহল দিতে দিতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। বিকেল গড়িয়ে আসে। শেষে সাজিদের বোঝা হয়ে যায় যে, মমতা আজ আর আসছে না। আর তাতে মনের ভেতরকার ধারালো প্রশ্ন জেগে ওঠে, কিন্তু কেন? কেন আসবে না? নিজে দুদিন ধরে এত করে বলল, অথচ নিজেই আসবে না? এ কী হয়? এমনভাবে কথা দিয়ে কথার খেলাপ তো সে কখনো করেনি। তাহলে কি পথে কোনো বিপদ-টিপদ হয়েছে?

সে ঘুরে ঘুরে শেষে মম’র সহপাঠীদের খোঁজে, ওদের কারুর সঙ্গে মম’র দেখা হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সে চেষ্টাও বিফলে যায়। কারণ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে, সহপাঠী যারা আসে, তারা তো ক্লাস করতে আসে না, আসে বেড়াতে। তেমন কাউকে পায় না। অনার্স ফাইনালের একটি মেয়ে মম’র চেনা, তাকে জিজ্ঞেস করলে, সে বলে, না, মমতাপাকে আজ দেখিনি।

ক্রমে কার্জন হলের গোটা এলাকাটা ফাঁকা হয়ে যায়। অগত্যা উঠতে হয় সাজিদকে। তার মনে তখন রীতিমতো আশঙ্কা হয় মম’র, নইলে ওর মায়ের কিছু হয়েছে। আশঙ্কাটা মনের মধ্যে পাক খেতে আরম্ভ করলে সে দেরি করে না, রওনা হয়ে যায় পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ার দিকে।

রাস্তা, বাড়ি, কোনোটাই অচেনা নয় – কারণ বেশ কয়েকবারই সে ঐ বাড়িতে গিয়েছে। ফরিদাবাদের বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকতে হয়, যার নাম মাধব দত্ত লেন। খুবই প্রাচীন গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখে মম’দের ঘরের বাইরের দেওয়ালে একখানা টিনের বোর্ড আটকানো। বাড়ির ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর মম’র নাম ধরে ডাকাডাকি করে। কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। তখন নজরে পড়ে দুই ঘরের দরজাতে তালা। তবু সে ডাকাডাকি করলে বারান্দায় দাঁড় করানো পার্টিশনের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া একজন মহিলার মুখ দেখতে পায়। দু’পা এগিয়ে গেলে মহিলা জানান, তারা কেহ নাই – সকাল থিকাই দেহি না।

কোথায় গেছে জানেন?

প্রশ্ন শুনে মহিলা ত্রস্ত ভঙ্গিতে ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে মাথা নাড়ান। তারপর নিচু গলায় বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালে খোঁজ নিয়া দ্যাখতে পারেন – সকালবেলা বাড়ি দখল কইরা লইছে বসির মোল্লা।

বসির মোল্লা কে?

ওই যে, মহিলা হাত তুলে বাড়ির অপর দিকটা দেখিয়ে বলেন, বাড়ির ওই দিকটা য্যায় কিনছে।

আরো কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু তার আগেই পেছনে গেটের কাছ থেকে একটা হুঙ্কারধ্বনি শোনা যায়। কে একজন বলে ওঠে, কে? আপনে কারে চান? কার লগে কথা কন, অ্যা?

বলতে বলতে মাঝবয়সী লাঠিহাতে মাথায় পাগড়ি বাঁধা লোকটা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, কারে চান? ক্যান আইছেন? আরে কথা কন না ক্যান?

আমার চেনা মানুষ থাকতেন এই বাড়িতে –

অরা নাই, কেহ নাই অহন, সব গ্যাছে গিয়া।

কোথায় গেছে?

কই গ্যাছে, ক্যামনে কমু? খ্যাদান খাইয়া যে মানুষ পলায় যায়, সে কি কইয়া যায়? আপনে অহন যান। রাস্তা কিলিয়ার করেন। এই হানে থাকলে কিন্তু বিপদ হইতে পারে কইলাম – যান বাইরান।

সাজিদ গেটের বাইরে বেরিয়ে দেওয়ালে আটকানো টিনের বোর্ডে লেখাটা পড়ে। তাতে লেখা –

মিউনিসিপ্যালিটি হোল্ডিং নম্বর ৭৩, বাড়ি ও জমির দাগ নং ২৭৬, হাল খতিয়ান নং ১৮৮, মৌজা ফরিদাবাদ, থানা সূত্রাপুর, জেলা-ঢাকা। ইংরাজি ৭ই জানুয়ারি ১৯৭৩ তারিখে খরিদ সূত্রে এই জমিন ও বসতবাড়ির মালিক হইয়াছেন আব্দুল বসির মোল্লা, সাং ১১ নং পিএন দাস লেন, গেন্ডারিয়া, ঢাকা, এবং উক্ত তারিখ হইতে এই জমিন ও বসতবাড়িসহ সকল সম্পত্তি আইনগতভাবে ভোগ দখল করিয়া আসিতেছেন। মালিকের বিনা অনুমতিতে এই জমিন ও বসতবাড়িতে কাহারও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হইল।

ওদিকে বেলা একেবারে ফুরিয়ে এসেছে। গলিপথ দিয়ে একজন দুজন করে মানুষ চলতে দেখা যায়। রাস্তার অপরদিকের বাড়ির জানালা দিয়ে দু’একজনকে উঁকি মারতেও দেখা যায়। সাজিদ রাস্তার অপর দিকের এক বাড়ির গেট খোলা দেখে ঢুকে পড়ে। তারপর একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, রাস্তার ওপারের বাড়িতে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা কোথায় গেছেন বলবেন কি? বললে খুব উপকার হতো।

লোকটির চোখেমুখে সন্ত্রস্ত ভাব ফোটে। ডাইনে-বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে বলে, আমরা কিছু জানি না ভাই, আমরা এ পাড়ায় নতুন এসেছি। একজন লোক ধীর পায়ে হেঁটে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকেও সাজিদ জিজ্ঞেস করে। লোকটা ভ্রু কুঁচকে মুখের দিকে তাকিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, আপনি আমিনা খাতুনের কে হন?

উনি আমার খালা হন।

সাজিদের জবাব শুনে লোকটা ধমকে ওঠে। বলে, দূর মশাই – আমিনা খাতুনের ভাইবোন কেউ নেই – আর ও তো হিন্দু ছিল – ও খালা কীভাবে হবে? ওদের এখানে পাবেন না।

কোথায় পাওয়া যাবে বলবেন?

লোকটির পরনে লুঙ্গি থাকলেও বোঝা যায় সে হিন্দু। সে বিড়বিড় করে বলে, ভগবান জানে কই গেছে!

বলুন না প্লিজ।

আরে এ তো মহাজ্বালা! লোকটি বিরক্ত হয়ে বলে, আমারে কি কইয়া গ্যাছে যে আমি কমু? জানেন না, হ্যায় নার্সের চারকি করে, হাসপাতালে যান – এই বাড়ি দখল হইয়া গেছে –

লোকটি নিচু গলায় বলে, এই গলির ভিতরে ঘুরাফেরা কইরেন না – বসির মোল্লার লোক দ্যাখলে মাইরপিট লাগাইয়া দিবো – পলান।

সাজিদ ভেবে পায় না কী করবে। সে কি ফিরে যাবে নিজের হোস্টেলে, কিংবা বাড়িতে? মম’দের বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। মা-মেয়েকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কি তার কিছুই করার নেই? তার বুকের ভেতরে কেউ যেন বারবার করতে থাকে প্রশ্নটা। তোমার কি কিছু করার নেই? সাজিদ, কিছুই কি করতে পারো না? ছি! সাজিদ ছি!

সাজিদ গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে গিয়ে রিকশায় চেপে রিকশাঅলাকে বলে, চলো মিটফোর্ড হাসপাতাল।

তার বিশ্বাস ওখানে গেলে মম আর ওর মাকে পাওয়া যাবে; তারপর কাজটা শুরু করতে হবে আজই। এত বড় অন্যায়টাকে চুপচাপ ঘটে যেতে দেওয়া যাবে না – কিছুতেই না।

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪/ ফাল্গুন ১৪১০) প্রকাশিত হয়েছিল।